আজ আম্মুর বিয়ে সকাল থেকে এত কাজ করেছি যে আমি ভীষণ রকম ক্লান্ত। তবু আমি খুশি। কারণ, আজ আম্মুর বিয়ে। বিয়ের সব দ্বায়িত্ব আমার। বাবা যেদিন মারা গেলেন, সেদিন সবাই খুব কান্নাকাটি করলেও আমি মোটেও কাঁদতে পারিনি। হুট করে কেমন যেন আমি বড় হয়ে গেলাম। দ্বায়িত্ব নিতে শিখলাম। এক ঝটকায় আমি আম্মুর মা হয়ে গেলাম।
আমি জানি না হাদিস বা কুরআনে কোথাও লেখা আছে কি না, স্বামী মারা যাবার সাথে সাথেই স্ত্রী কে পুরো সফেদ সাদায় মুড়িয়ে ফেলতে হবে। সাদা রঙ টা ভীষণ প্রিয় ছিল আমার। সাদা জামা, জুতো, শাড়ি, চুড়ি, কাজল… কি রাখিনি সংগ্রহে। কিন্তু এক নিমিষেই রঙ টা অপ্রিয় হয়ে গেল। শুভ্র সাদায় একদিকে বাবা মরে গিয়েও সজীব আর আম্মু বেচে থেকেও মৃত। এরপর থেকে আম্মুর জন্য আমি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে শাড়ি কিনেছি। না, সাদা আর দেইনি। আম্মু আমার জন্য সজীব থাকুক। আমার বড় একটা ভাই আছে। বাবা মারা যাবার পর থেকে খুব খারাপ ব্যবহার করতেন। বয়সে আমার থেকে খুব বেশি বড় না। অবিবাহিত। সারাক্ষণ রুমের দরজা বন্ধ করে রাখে। নাহ, এডিক্টেড না। কিন্তু আমাদের সময় দেইনি। হয়তো তিনি নিজেও মানসিক চাপে ছিলেন।
১৮০০ স্কোয়ারফুট বাসায় আমি আর আম্মু ছিলাম অসহায়। তবে আমি আম্মুকে একা থাকতে দেইনি। আম্মু আজ অব্দি প্রতি রাতে আমার রুমে ঘুমিয়েছেন। কিন্তু বিপত্তি হলো আমার বিয়ের কথা চুড়ান্ত হবার পর। আম্মু একা কিভাবে থাকবেন? উনি তো আমার উপর নির্ভরশীল। বাবা মারা গেছে আজ দশ বছর। এতদিনে অনেক কিছু বদলে গেছে। ভাই বিয়ে করেছে। সংসার হয়েছে। তবু সেই আগের মতো দরজা বন্ধ থাকে। এদিকে আমি আর আম্মু একা। আমার যার সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে তিনি কানাডায় থাকেন। বিয়ের পর আমাকেও সাথে নিবেন।
মাঝে মাঝে মনে হয় মেয়ে হয়ে জন্ম নেয়াই আজন্ম পাপ। বাবা এত ভালবাসতেন, তার মৃত্যুর পর খাটিয়া টা কাধে নিতে পারিনি। ভাই ঠিকই নিয়েছিল। তাই দেখুক বা না দেখুক অন্তত এজন্যও একটা ছেলে থাকলে ভালো হয়। আর এখন আম্মুকে আমার সাথে নিতে পারবো না। কারণ, শ্বশুরবাড়ি অনেক কিছু মানিয়ে নিতে হয়। সেখানে বাপেরবড়ি ব্যাপার টা এলাও না। তাই অনেক ভেবে সিদ্ধান্ত নিয়েছি আম্মুর বিয়ে দিব। বিয়ে কি শুধু জৈবিক চাহিদা মেটানোর জন্য বা সন্তান উৎপাদনের জন্য? না, আমার তা মনে হয় না। পাশাপাশি বসে কথা না বলেও হাতে হাত রেখে সারাটা জীবন একসাথে শান্তিতে আর ভালবাসা নিয়ে থাকার নামই বিয়ে। আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে তাই মনে হয়। আম্মুর বিয়ে হয়েছিলো ১৪ বছর বয়সে। ১৬ বছর বয়সে প্রথম সন্তান হয়। এখন আম্মুর বয়স ৫০। বাবার সাথে আম্মুর বয়সের ডিফরেন্স ছিল অনেক।
একজন ভদ্রলোক আমাদের বিল্ডিংয়েই থাকেন। বেলাল সাহেব। তিনি বিয়ে করেননি। বয়স ৫৩। বৃদ্ধ মা নিয়ে আছেন। সরকারি কর্মকর্তা। অনেক বছর ধরে তাকে দেখছি। ভীষণ ভদ্রলোক। আমি একদিন নিজে থেকেই তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিলাম। উনি মৃদু হেসে আমার মাথায় হাত দিয়ে বললেন, “জীবনে ভালো মানুষের সান্নিধ্যে থাকা জরুরি। তোমাকে খুব ছোট থেকে দেখছি। ভীষণ মিষ্টি মেয়ে তুমি। আমি কি তোমার আম্মুর জন্য পারফেক্ট?” উত্তরে বলেছিলাম, “আমার আম্মু আপনার সাথে কষ্টে থাকবে না।” উনি সেদিন কিছু বলেন নাই। কয়েকদিন পর আমাদের বাসায় মিষ্টি নিয়ে আসেন। আর আম্মুর জন্য বিয়ের প্রস্তাব দিলেন। ভাইয়া শুনে খুব অপমান করলো তাকে। শেষে সব মুরুব্বীরা মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে আম্মুর আবার বিয়ে হবে। খুব ঝামেলায় ছিলাম কিছুদিন। এত দরবার করতে হয়েছে, বলে বোঝাতে পারবো না।
আজ সব শেষে আম্মুর বিয়ে। একটুও ধুমধামে না। খুব সাধারণভাবে হচ্ছে বিয়ে টা। তবে বাসা টা সাজিয়েছি। কারণ, আমার মেয়ে বলে কথা। বরপক্ষের অল্প ক’জন, কিন্ত সবাই এসেছেন। কাজী সাহেব এসেছেন। কিন্তু, আমাদের আত্মীয়দের মাঝে তেমন কেউ নেই দু একজন ছাড়া। আমার ভাই টা খুব কাজ করছে আজ। হয়তো দ্বায়িত্ব থেকে মুক্তি পাচ্ছে তাই। তবে আমার বিয়ে টা হচ্ছে না। যে পরিবারে মায়ের বিয়ে হয়, সে পরিবারের মেয়ে তারা নিবেন না। অবশ্য এ নিয়ে আমার আফসোস নেই। আমার মায়ের মুখের হাসিই আমার বেহেশত।
গল্পের বিষয়:
গল্প