কদিন ধরে একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটছে। আমি বাসায় ফিরে দেখছি ঘরদোর পরিপাটি করে গোছানো। বিছানা, এলোমেলো বইয়ের তাক সব ঠিকঠাক। প্রথমে ভাবলাম, না – এটা আমারই ভুল। হয়তো বেরোনোর আগে নিজেই সব গুছিয়েছি। হিসাব করলাম তিনদিন ধরে এমনটা ঘটছে। অথবা বলা যায়, আমার এই বিভ্রম দিন তিনেকের পুরনো। রহমতগঞ্জে তিন রুমের ব্যাচেলর কোয়ার্টারে আমি একাই থাকি। স্টেনলেস স্টিলের ডায়মন্ড তালার দুটো চাবিই আমার কাছে। বাড়িভাড়া নেওয়ার সময় তালাটা বাড়িওয়ালা হানিফ উদ্দীনের কাছ থেকে পাওয়া।
নিজের রান্না নিজেই করি আমি। বুয়ার ঝামেলা নেই। লাঞ্চটা অফিসের ক্যান্টিনে সারি। সন্ধ্যায় এসে দুটো ভাত ফুটিয়ে নেওয়া। অনেক সময় ঝামেলা এড়াতে বাইরেও খেয়ে নিই। সে-কারণে গত তিনদিনের ঘটনার কোনো ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে পারছিলাম না। ব্যাপারটা নিয়ে আলাপ করার জন্য বাড়িওয়ালার কাছে যাব কি-না ভাবছিলাম। হানিফভাইয়ের সঙ্গে তো আমার বাড়িওয়ালা-ভাড়াটে সম্পর্ক নয়! সুতরাং তাকে বলাই যেত। কিন্তু নিজেই আরেকটু দেখি… এমন ভাবনা থেকে বলা হয়নি।
গত শনিবারের ঘটনা। তালা খুলে অভ্যাসবশে ব্যাগটা দরজার পেছনের র্যাকে ঝুলিয়ে খাটে শুয়ে জুতা খুলতে-খুলতে বেডসুইচ অন করি। বেডসুইচের ব্যবস্থাটা আগের ভাড়াটে করে গেছেন। বলা যায় আমাকে একরকম অলস বানিয়ে গেছেন। বাতি জ্বলে উঠতেই ঘরটা হঠাৎ আমার কাছে অপরিচিত ঠেকে। বিছানার চাদরটা ওয়ারড্রোব থেকে অনেকদিন বের করিনি। সাদার ওপর বড়-বড় লাল ফুল। কিছুটা গরম। রোদের একটা ঘ্রাণও আছে। অর্থাৎ চাদরটা কেবল বেরই করা হয়নি – রোদেও দেওয়া হয়েছিল। আমি যে চাদরটা রোদে দিইনি সেটা নিশ্চিত। কারণ আমি কাপড় কাচি না। লন্ড্রিতে দিই। এ-বাড়ির ছাদের একাংশে বাড়িওয়ালা থাকেন। খোলা ছাদটা সে-বাড়িরই বারান্দার মতো অনেকটা। তাই ছাদে কাপড় শুকাতে দেওয়া হয়নি কখনো।
কেবল বিছানা চাদর যে পালটানো হয়েছে তা নয়, খাটের ওপর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখা বইপত্র, পেপার – সবই গুছিয়ে রাখা হয়েছে। রান্নাঘরের হাঁড়ি-পাতিল, প্লেট-কাপ ঝকঝক করছে সবকিছু। চা-পাতার কৌটার মুখটা কখনো লাগিয়েছি বলে মনে পড়ে না। কিন্তু সেদিন দেখলাম মিটসেফের ওপরে কনডেন্সড মিল্কের কৌটার পাশে ওটা রাখা আছে। বাথরুমটাও কেমন অচেনা লাগলো। কমোড, শ্যাওলা ধরা মেঝে সবই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন।
দুই
অফিসের কাজে মন বসছিল না কিছুতেই। বারবার তাকাচ্ছিলাম ঘড়ির দিকে। মনকে অন্যদিকে ফেরাতে ডুব দিলাম ফেসবুকে। নিজের অজান্তেই স্ট্যাটাস লিখলাম, ‘সে কোন বনের হরিণ ছিল আমার মনে!’ বনের হরিণ! আরে তাই তো। রুয়াল মারমার কাছ থেকে শোনা গল্পটা হঠাৎই মনে পড়ে গেল। বাংলাদেশ বনশিল্প উন্নয়ন সংস্থার কাপ্তাই কার্যালয়ে কাজ করে সে। রিজার্ভ ফরেস্টের কিছু বন্যপ্রাণী ও গাছ-গাছড়ার সায়েন্টিফিক ড্রয়িংয়ের জন্য আমাকে বহুবার কাপ্তাই যেতে হয়েছে। যাওয়া-আসা করতে-করতেই ঘনিষ্ঠতা তার সঙ্গে। একবার রুয়াল জানতে চেয়েছিল, হরিণের মাংস চেখে দেখতে চাই কি-না। বনের কাছাকাছি একটা বাজারে বিক্রি হয়। হরিণের মাংস আমি খাই না। কেন খাই না তাও ব্যাখ্যা করে বলেছিলাম রুয়ালকে। হরিণ শিকার করা অন্যায়। সুতরাং মাংস খেলে সে-দুষ্কর্মকে স্বীকার করে নেওয়া হয়। রুয়াল আমার ব্যাখ্যা শুনে হেসেছিল। তারপর একটা চাক লোককথা শুনিয়েছিল বেশ রসিয়ে রসিয়ে। গল্পটা ইন্টারেস্টিং। শোনার পর আমার চোখে-মুখে মুগ্ধতা দেখে রুয়াল বলেছিল, ঠিক আছে এবার না-হয় না খেলেন, তবে চিটাগাং অফিসে গেলে আপনার জন্য হরিণের মাংস নিয়ে যাব।
গত বৃহস্পতিবার ভোরে হরিণের মাংস নিয়ে বাসায় উপস্থিত হয় রুয়াল। প্রায় তিন-চার কেজির মতো হবে। আমি ফ্রিজে মাংস রেখে ওর সঙ্গে নাস্তা সেরে অফিসে গিয়েছিলাম। হরিণের মাংসের প্রতি আমার বিরাগ কিংবা রান্নার ঝামেলার কারণে মাংসগুলো বের করা হয়নি। ভেবেছিলাম হানিফভাইকে নিয়ে একটা আয়োজন করব। রুয়ালেরও আগামী সপ্তাহে আসার কথা। অদ্ভুত ঘটনাটা ঘটতে শুরু করার পর মাংসগুলোর কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। এক মুহূর্ত বিলম্ব না করে ফোন দিলাম রুয়ালকে। মাংস দিয়ে যাওয়ার পর থেকে যা-যা ঘটেছে সব বললাম। অন্যপাশ থেকে আদিবাসী উচ্চারণে ভাঙা বাংলায় রুয়াল বলল, ‘ডুটো উপায় আসে দাদা। জলদি বিয়েতা কোরে ফেলেন। তাহলে আর সোমস্যা হোবে না। তা না পারলে মাংসোগুলা রান্না করে খেয়ে ফেলেন, সব থিক হয়ে যাবে।’
তিন
রাতে বিছানায় আজ এপাশ-ওপাশ করেই কাটাই। ভাবি রং-তুলি নিয়ে বসলে অন্তত কিছু একটা নিয়ে ব্যস্ত থাকা যাবে। কিন্তু পুরনো ব্রাশ আর শক্ত কঠিন হয়ে পড়া রংগুলো দিয়ে কী ছবি আঁকবো। যে-ক্যানভাসটায় বহুদিন আগে সাদা রং চড়িয়েছিলাম, সেটার গায়েও ময়লা জমে তামাটে বর্ণ ধারণ করেছে। তার চেয়ে বরং কিছু স্কেচ করলে কেমন হয়? কয়েকটা সাদা হ্যান্ডমেড কাগজের ওপর চারকোল ঘষতে থাকি। কালোর ওপর একটা সাদা অবয়ব ফুটে ওঠে। মুখটা স্পষ্ট নয়, তবে নাভি আর স্তন যুগলের ডিটেল পাওয়া যাচ্ছিল। তার মাথার দুপাশে গাছের শাখার মতো একটা শিংও গজিয়ে উঠল। অ্যাক্সিডেন্টাল পেইন্টিং কি? সচেতনভাবে তো আঁকিনি? পছন্দ হলো না। নবিশদের মতো কাজ। কাগজগুলো দলা করে ফেলে দিয়ে পায়চারি করি। জানালার পর্দা উলটে তাকাই অন্যপাশের বাড়িটার দোতলার ফ্ল্যাটের দিকে। আলোটা জ্বলছে। এই সময় মাঝে মাঝে ফ্ল্যাটটার জানালা হাট করে খোলা থাকে। ২০-২৫ বছরের কোনো তরুণীর কক্ষই হবে। মেয়েটাকে ভীষণ আÍভোলা মনে হয়। জানালা খোলা রেখেই পোশাক পালটায়। তার খোলা বুক, নিতম্ব আর কাঁধ খুব স্পষ্ট না হলেও দেখা যায় এতদূর থেকে। মাঝে মাঝে স্তনদুটোতে হাত-দুহাত রাখে প্রার্থনার ভঙ্গিতে।
ওই ঘরের আলো নিভে গেলে আমার নিজেকে কেমন নিঃসঙ্গ লাগে। গত কয়েকদিন আগে একটা স্বপ্ন দেখেছিলাম। একটা নগ্ন মেয়ে আমার ঘর গোছাচ্ছে। বিছানায় শুয়ে-শুয়ে দেখছিলাম তাকে। কিন্তু মেয়েটি আমাকে দেখে একটুও চমকালো না। বরং ইশারায় যেন আমাকে সাহায্য করতে বলল। সেটা করতে গিয়ে তার হাতের সঙ্গে হাত লাগল, শরীরের সঙ্গে শরীর। আমি তার পেছনে দাঁড়িয়ে বিছানার পাড়টা ধরি। সে সরে আসে আরো কাছে। বলে, বিছানাটা টান করে ধরেন।
অফিস থেকে দুনম্বর বাসে আন্দরকিল্লা নেমে জেএম সেন হলের পাশের রাস্তাটা পার হতে-হতে মনে হলো, এভাবে দৌড়াচ্ছি কেন? প্রশ্নের কোনো উত্তর পাওয়া গেল না। বুঝলাম, নিজেকে বাড়ি পর্যন্ত এভাবেই ছুটিয়ে নিয়ে যেতে হবে আমাকে। অন্ধকারে দেখতে পাইনি। ধাক্কাটা খাওয়ার পর টের পেলাম ভালো ক্যাচালে পড়েছি। লোকটা প্রায় পড়েই যাচ্ছিল। আমিও টাল সামলাতে না পেরে পেছনের দেয়ালে গিয়ে ঠেকলাম। একটু হলেই নালায় পড়ে যাচ্ছিলাম।
‘ছোখ কোয়ালত তুইল্লস নারে চোদানির ফোয়া?’ গলা শুনে তলপেটে একটা মোচড় অনুভব করলাম। মহল্লা-সর্দার রহমতউল্লা। ‘স্লামালাইকুম চাচা।’ প্রায় রিফ্লেক্স অ্যাকশনের মতোই কপালে হাত উঠল আমার। বললাম, ‘অন্ধকারে দেখতে পাইনি।’ রহমতউল্লা সোজা হয়ে দাঁড়ান। লুঙ্গি ঠিক করে শার্টটা নামিয়ে দিয়ে অবাক হওয়ার ভঙ্গিতে বলেন, ‘তুঁই রশিদার মাস্টর রাসেল ন? ফরেস্টত খাম গর নঅ?’ আমি মাথা নাড়ি। ‘দেখিনি চাচা!’ ভয়ে-ভয়ে বলি। ‘এইল্লা কা লাগাইয়ো? ফ্যাকেনা দইজ্জে না?’ সর্দারের মৃদু তিরস্কার শুনে লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে আসে। এবার পিঠে হাত রাখেন তিনি। ‘তোঁয়ার আর কী দোষ? বয়স বয়স। ব্যাক বয়সর দোষ। যগই যগই, তাড়াতাড়ি য, কাম সারো।’ আমি দ্রুত এগিয়ে গেলাম। নিজের পথ ধরলাম। হাতির মতো লোকটার সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে নিচের ঠোঁটটা রীতিমতো ফুলেছে। তবু অল্পের ওপর দিয়েই তো গেল। চড়-থাপ্পড় যে পড়েনি এজন্য মনে মনে আল্লাহকে শুকরিয়া জানাই।
মহল্লার গেট দিয়ে ঢুকলেই একটা বারোয়ারি আঙিনা। তার প্রায় মাঝখানটায় সিটি করপোরেশনের টিউবওয়েল। পানি আসে ভোর ৫টায়, থাকে সকাল ৭টা পর্যন্ত। এ সময় পানি নেওয়ার জন্য লাইন দেয় মহল্লার লোকজন। যাদের বাড়িতে পানির টানাটানি তারা গোসলও করে এখানে। অবশ্য এই হাঙ্গামা আমাকে পোহাতে হয় না। বাড়িওয়ালার আন্ডারগ্রাউন্ড রিজার্ভার আছে। মোটরও ছাড়েন দুবেলা। কলতলাটা এখন সুনসান নীরব। যেন বেশ একটা লম্বা ঘুম দিয়ে সকালে জাগবে। তবে আশপাশের ঘরবাড়ি ও ফ্ল্যাটগুলো সন্ধেবাতি পেয়ে সবে জেগে উঠেছে। বাড়িগুলোর সিঁড়ির নিচের খোলা জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আড্ডা দিচ্ছে মহল্লার তরুণেরা। কারো-কারো মুঠোফোন থেকে বিনবিনিয়ে উঠছে হিন্দি গান।
কলঘর আর আঙিনাটা পার হলেই আমার বাড়িওয়ালার দোতলা দালান। নিচতলার বাঁপাশটা হানিফ উদ্দিনের ভাইয়ের ভাগে পড়েছে। তিনি এখানে থাকেন না। নিজের অংশটা ভাড়া দিয়ে রেখেছেন। প্রতি মাসে একবার আসেন ভাড়া তুলতে। হানিফ উদ্দিনের ভাগে পড়া অপর অংশের একমাত্র ভাড়াটে আমি। তিনি লোক ভালো। দুবছরে পাঁচ হাজার থেকে এক টাকাও ভাড়া বাড়াননি।
দরজার কাছে আসতেই মনে হলো, যদি ভেতরে ঢুকেই দেখি সব এলোমেলো, কিছুই কেউ গুছিয়ে রাখেনি! তাহলে এই গালাগালি, ঠোঁট ফেটে যাওয়া হজম হবে কীভাবে? তালা খুলে ভেতরে ঢুকেই বাতি জ্বালাই। না, সবকিছু নিখুঁত পরিপাটি করেই সাজানো। ঘরের মেঝেটা ঝকঝক করছে। আলনায় আমার কাপড়গুলো ভাঁজ করে রাখা। ছাইদানিটা যেন নতুন কেনা। কেবল বুকশেলফে রবীন্দ্র রচনাবলির খণ্ডগুলো এলোমেলোভাবে সাজানো। আমি হলে ওগুলো একসঙ্গে রাখতাম। কিন্তু যে সাজিয়েছে সে হয় পড়তে পারে না কিংবা হয়তো তাড়া ছিল তার। সারাদিনের টান-টান উত্তেজনা হঠাৎ থিতিয়ে এলো। খাবারদাবারের খোঁজে ফ্রিজ খুলতেই মনে পড়লো হরিণের মাংসের কথা। ডিপফ্রিজের ডালা খুলতেই সাদা পলিথিনে মোড়ানো মাংসগুলো চোখে পড়লো। ডিপের দেয়ালে পুরু বরফের আস্তর। সেখানে মাংসগুলো প্রায় সপ্তাহখানেক পড়ে আছে। ঠান্ডায় পাথর হয়ে আছে নিশ্চয়। কিন্তু হাত দিয়ে দেখি মাংসগুলোতে বরফের হিম স্পর্শ নেই মোটেও। ধরার সঙ্গে সঙ্গে আলগা হয়ে উঠে এলো। যেন এই মাত্র ছাল ছাড়িয়ে আনা হয়েছে। টাটকা একটা গরম ভাবও আছে। আমি ভয় পেয়ে মাংসগুলো আবার যথাস্থানে রেখে দিই। ফ্রিজে কিছু ঢেঁড়স আর ডিম ছাড়া কোনো তরকারি নেই। একটা পাউরুটির কয়েক টুকরোও পাওয়া গেল। ঢেঁড়স আর ডিম দিয়ে অমলেট করাই যুক্তিযুক্ত মনে হলো। সেদিনের মতো পাউরুটি আর অমলেট খেয়ে শুয়ে পড়ি বিছানায়।
উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা সত্ত্বেও পুরো বিষয়টি আমার জন্য অন্যরকম। মনে আমার ভালোই লাগছিল। বিছানায় শুয়ে সিগারেট ধরিয়ে টিভি অন করি। রিমোট দিয়ে ঘুরতে থাকি এক চ্যানেল থেকে আরেক চ্যানেলে। অন্যসব দিনের মতো বিবিসি কিংবা ন্যাশনাল জিওগ্রাফিতে এসে স্থির হলাম না। একটার পর একটা চ্যানেল পালটেই যাচ্ছিলাম। হঠাৎ একটা চ্যানেলে এসে থমকে দাঁড়াতে হলো। ফরাসি চ্যানেল। গুনগুন করে গান গাইছে কেউ। শব্দের উৎসের খোঁজে ক্যামেরা বিভিন্ন ঘর পার হয়ে বাথরুমের খোলা দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। বাথটাবের সাবানজল আর ফেনার মধ্যে আধশোয়া এক নারী, হাতে সুদৃশ্য পানীয়ের গ্লাস। নগ্ন পা-দুটো সাবানের বুদ্বুদের ওপর মাঝে মাঝে দৃশ্যমান হচ্ছে। গুনগুনিয়ে গান গাইতে-গাইতে মেয়েটি একটু পরপর চুমুক দিচ্ছে গ্লাসে। তখন তার আ-ঢাকা বুক সাবানের বুদ্বুদ সমেত উঠে আসছে পানির ওপরে। তন্ময় হয়ে দেখছিলাম। হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে চমকে উঠি। রাত ১০টায় আবার কার প্রয়োজন পড়লো? হন্তদন্ত হয়ে দরজা খুলে দেখি মহল্লার সর্দার রহমতউল্লার মেয়ে রশিদা। হাতে একটা বারকোশে ঢাকা ট্রে।
‘মেজবানের গরুর মাংস পাঠাইসে আব্বা। আর বলছে আপনারে মাইন্ড না করতে। আজকে আপনারে কি নাকি বলসে?’
আমার চোখে-মুখে বিস্ময় দেখেই বোধহয় এক নিশ্বাসে কথাগুলো বললো রশিদা। মাংসের বাটি আমার হাতে না দিয়ে ঘরে ঢুকে পড়ে সে। মুখে চাপা হাসি। রান্নাঘরে বাটিটা রেখে ফিরে যাওয়ার সময় হঠাৎ একবার দাঁড়ায়। এগুলা কী দেখেন, ছিঃ! বলেই ছুটে বেরিয়ে যায়। আমার খেয়াল হয় টিভিটা ছাড়া ছিল এতক্ষণ।
চার
নিজের চেহারা নিয়ে আমার একটু হীনমন্যতা আছে। মাথায় চুল যা আছে তা একটু সময় নিয়ে গুনে ফেলা যাবে। মাঝারি একটা ভুঁড়ি আর মিশমিশে কালো গায়ের রং আমাকে আয়নার সামনে বেশিক্ষণ দাঁড়াতে দেয় না। তবু রশিদাদের বাড়ি যাওয়ার সময় আমি ইস্ত্রি করা ফতুয়া পরি। একটু ব্র“ট বডি ¯েপ্রও লাগাই। সন্ধ্যায় অফিসের পর সপ্তাহে তিনদিন ড্রয়িং শেখাতে হয়। চারুকলায় অ্যাডমিশন টেস্টের বৈতরণী পার করে দিতে হবে আমাকে। মহল্লার সর্দারের বউটি অতিসজ্জন। বলেছিলেন, বাবা সব তোমার হাতে। মেয়েটা শিল্পকলায় প্রাইজ পেয়েছে। এবার ভার্সিটিতে ভর্তি হবে বলে গোঁ ধরেছে।
রশিদার গায়ের রং কালো। নাকটা বোঁচা। তবে এতোদিন দেখতে-দেখতে ওর মধ্যে কোনো এক অজানা সৌন্দর্যের সন্ধান পেয়েছি আমি। ভাবি, পিকাসো হলে রশিদাকে ছবির মডেল বানাতেন। ওর ন্যুড স্টাডি তখন মিউজিয়ামের দেয়ালে ঝুলত। রশিদার মুখের ভাঁজ, শরীরের রেখা নতুন রং-রূপ পেয়ে ভেঙেচুরে যেত।
অথচ রশিদা ফ্রিহ্যান্ডে বৃত্ত আঁকতে জানে না। একটা রেখাও সোজা হয় না। আমি ওকে স্টিললাইফ করতে দিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকি। শাড়ির আড়াল থেকে বের হয়ে আসা স্তন দেখি। তবু মেয়েটার প্রতি আমার কিছুমাত্র আকর্ষণ তৈরি হয় না। খুব জানতে ইচ্ছে হয়, ওকে নগ্ন দেখলে আমার অনুভূতি পালটাবে কিনা।
‘স্যার বহুক্ষণ ধরে কী চিন্তা করতেছেন?’ রশিদা মাঝে মাঝে এমন প্রশ্ন করে আমাকে অপ্রস্তুত করে তোলে। আমি মাথা নেড়ে বলি, না তো, কিছু না। সেদিনও রশিদা এমন প্রশ্ন করার পর বাসার সমস্যাটা ওকে বলবো কিনা ভাবি। ভাবতে-ভাবতে বলেই ফেলি।
‘আচ্ছা রশিদা গত কয়েকদিন ধরে একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটছে। আমার বাসার জিনিসপত্র কে যেন গুছিয়ে দিয়ে যায়। অথচ চাবি আমার কাছে থাকে।’
রশিদা হেসে হেসে লুটোপুটি খেতে থাকে। ‘জিন-পরির আসর। মিলাদ পড়াবেন? আব্বারে বলবো দাঁড়ান।’ আমি প্রাণপণ চেষ্টা করি ওকে থামাতে। কিন্তু রশিদা তার কথায় অটল। বাড়িতে উঠেছি পর্যন্ত মিলাদ পড়াইনি এটা রশিদার কাছে মহাঅন্যায়।
কয়েকদিন এভাবেই চলতে থাকলো। আমি ঘর অগোছালো করে যাই, অফিস থেকে এসে দেখি সব ঠিকঠাক। মিলাদ মাহফিলের পর এলাকার আর কারো জানতে বাকি রইলো না এমন একটা ঘটনা ঘটেছে মহল্লায়। হরিণের মাংসের কথাটা কেবল আমি গোপন রাখতে পেরেছিলাম। মহল্লার পানদোকানদার আকিজ একদিন জিজ্ঞেস করে, ‘স্যার অনেরে বলে জিনে দইজ্জে?’
পাঁচ
মহল্লার লোকজনের কাছ থেকে আমি নানা উপদেশ-পরামর্শ পেতে শুরু করেছিলাম। পানিপড়া, তাবিজ, ভালো সাইকিয়াট্রিস্টের ঠিকানা – এসব। দিনে দিনে বাড়ছিল শুভাকাক্সক্ষী। একদিন মহল্লার সর্দার রহমতউল্লা এসে হাজির। একটা তাবিজ দিয়ে বললেন, ‘গরমবিবির মজারেত্তুন আইন্নি। বালিশের নিসে রইবা।’
রাতে বালিশের নিচে তাবিজটা রেখে ঘুমাই। ঘুমের মধ্যে টের পাই খুটখাট শব্দ। ধড়মড় করে উঠে দেখি কেউ নেই। এরকম প্রায়ই ঘটছিল। ফলে ১২টা বাজলো আমার ঘুমেরও। চোখের নিচে পুরু কালির একটা স্তরও পড়ল। না, এভাবে আর পারা যাচ্ছে না। এর একটা শেষ দেখতে হবে। যেই হোক হাতেনাতে ধরতে হবে তাকে।
একদিন ভোরে উঠেই আবারো ঘরদোর ওলটপালট শুরু করলাম। উত্তেজনার বশে হয়তো একটু বাড়াবাড়িই করে ফেলেছি। দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে সম্বিত ফিরল। খুলেই দেখি হানিফভাই দাঁড়িয়ে। ‘কী হলো বলো তো! তোমার ঘরে সাতসকালে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ কেন?’ আমি আমতা-আমতা করে বলি, ‘হানিফভাই, মানে একটু ঘর গোছাচ্ছিলাম।’ হানিফ উদ্দীন এ-কথায় সন্তুষ্ট হলেন বলে মনে হলো না। ভ্রু কুঁচকে চোখ দুটো ছোট করে একদৃষ্টে দেখতে লাগলেন আমাকে। যেন পত্রিকার শব্দজট মেলাচ্ছিলেন। একটা সিগারেট ধরিয়ে ঘরে ঢুকতে উদ্যত হন তিনি। আমি বাধা দিই। বলি, ‘সব এলোমেলো। চলুন আজ বাইরে নাশতা সারি।’ দরজায় তালা দিয়ে দ্রুত বেরিয়ে পড়ি। মোমিন রোডের ক্যাফে ডি কদমে ঢুকে হানিফভাই চাপাতি, নেহারি মানে গরুর নলির ঝোল, ডিমের অমলেট আর ডাল-ভাজির অর্ডার দেন। আমি মৃদু প্রতিবাদ করি। ‘এই খাবার খেতেই তো দুপুর হয়ে যাবে।’ হানিফ উদ্দীন আমার দিকে কঠোর দৃষ্টিতে তাকালেন।
‘শিখণ্ডীর কাহিনি জানো?’ আমি ঢোক গিললাম, আবার মহাভারত?
হানিফভাই লেখালেখি করেন। সাহিত্যে উত্তর ঔপনিবেশিকতাবাদ নামে একটা বই লিখেছেন। নিজের প্রকাশনাও আছে একটা। বইটা সেখান থেকেই বের হয় প্রায় বছর দশেক আগে। আমি ভাড়াটে হয়ে এ-বাড়িতে আসার পর একটা কপি আমাকে গিফট করেছিলেন। দু-এক পাতা উলটেছি, পুরোটা পড়িনি। তবে মনে আছে বইটাতে সাহিত্য ও পুরাণ নামের একটা পরিচ্ছেদ ছিল। সেখানে মহাভারত, রামায়ণ নিয়ে সারগর্ভ আলোচনাও ছিল। আমাদের সাহিত্যে পুরাণের গল্প বলার ধরনটা কেন নেই সেটাই আলোচনার বিষয় ছিল যতদূর বুঝতে পেরেছি। বললাম, ‘মহাভারত, রামায়ণ বহু আগে পড়েছি।’ হানিফভাই মাথা নাড়লেন।
‘বলতে চাইছিলাম শিখণ্ডী হয়ো না। হলে ভীম বা কর্ণের মতো হবে। বীর্যবান পুরুষ ওরা। ভীম কটা ডিম খেতেন জানো?’
চোখ কপালে ওঠে আমার। ‘এটাও লিখেছে মহাভারতে?’
‘আরে তা কেন লিখতে যাবে? এখন মডার্ন সায়েন্স কোন উচ্চতায় পৌঁছেছে খবর রাখো? ফরেনসিক মেডিসিনের নাম জানা আছে? এ-বিজ্ঞান কেবল সদ্য মৃত ব্যক্তিকে নিয়ে এখন আর মাথা ঘামায় না। বরং ইতিহাস বা পুরাণের বিবরণ বিশ্লেষণ করে ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা এখন বলে দিচ্ছেন কোন ঐতিহাসিক চরিত্রের কী রোগ ছিল? কে কীভাবে মারা গেল? কার শারীরিক গঠন কেমন ছিল এসব। তেমন হিসেব-টিসেব করে দেখা গেছে, গড়ে ৩৩টার কম ডিম খেত না ওরা।’
‘ওরা মানে!’ আমি স্পেসিফিক নাম জানতে চাইলাম। হানিফভাই একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলেন। যেন বহুদূরে কোথাও চলে গিয়েছিলেন। সেখান থেকেই উত্তর দিলেন, ‘ওরা মানে রুস্তম, ভীম, গিলগামেশ, এনকিদু।’ বুঝলাম গল্পের গরু এখন গাছে চড়ার পাঁয়তারা করছে।
প্রায় সবটাই আমাকে একাই খেতে হলো। হানিফ উদ্দীন অল্পই খেলেন। চারটা বিশাল সাইজের চাপাতি পেটে চালান করে হাঁসফাঁস করছি ।
হানিফভাই হঠাৎ বাস্তবে ফিরে এলেন। বললেন, ‘এই যা, ভুলেই গেছি। যে জন্য তোমার কাছে আসা। দেখো তো এটা তোমার কিনা।’
হানিফ উদ্দীনের হাতে একটা স্টেনলেস স্টিলের তালার চাবি।
‘সকালে তোশক ওলটাতে গিয়ে পেলাম। তোমার ভাবি বললো নিচের আঙিনাটা ঝাড় দেওয়ার সময় তোমার দরজার কাছে পেয়েছে।’
আমি চাবিটা নিয়ে পকেটে থাকা আর দুটো চাবির সঙ্গে মিলিয়ে দেখি।
হ্যাঁ, শতভাগ মিল আছে। চাবিটা আমার তালারই। ‘কিন্তু চাবি তো মাত্র দুটো থাকার কথা। আর একটা এলো কী করে? আর সেটা দরজার সামনেই বা পড়ল কীভাবে?’
শুনে হানিফভাই একটু চিন্তিত হলেন। বললেন, ‘ডায়মন্ড তালার চাবি তো চারটা থাকার কথা। আমি যখন তোমাকে দিয়েছিলাম তখন চারটা চাবি ছিল না? নাকি আগের ভাড়াটে দুটো চাবি হারিয়েছে? সে যাকগে। রেখে দাও।’
বিল চুকিয়ে হানিফভাই যখন বিদায় নিলেন তখন ঘড়ির কাঁটায় সাড়ে ১০টা। আজ আর অফিসে যাওয়া হবে না। ফোনে জানিয়ে দিলাম শরীর খারাপ, আসছি না।
ছয়
আমার পা যেন চলতে চাইছিল না। মহল্লার গলির কাছাকাছি আসতেই বুকের ধড়ফড়ানি শুনতে পেলাম। সরু গলির দুধারে লম্বা পাঁচিল। দেয়ালের বাঁপাশে ওয়াপদা কলোনির সারি সারি ফ্ল্যাটবাড়ি। ডানপাশে একটা আয়ুর্বেদিক ঔষধালয়ের কারখানা ও গুদাম। সেদিক থেকে প্রতিদিনকার মতো একটা কড়া সালসার গন্ধ এসে নাকে ধাক্কা দিলো। গন্ধটা অনেকটা আমাদের মহল্লার চৌহদ্দির মতো। মাঝে মাঝে বাড়ি ফিরতে রাত হলে অন্ধকারে এই গন্ধ সড়কবাতির মতো আমাকে মহল্লায় স্বাগত জানায়। ফটক দিয়ে ঢুকে উঠানে পা দিতেই মনে হলো ফ্ল্যাটবাড়িগুলো থেকে বউ-ঝিয়েরা সবাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু সাহস সঞ্চয় করে চারদিকে চেয়ে দেখলাম আমার অনুমান সত্য নয়। বারান্দাগুলো ফাঁকা। দু-একজন আসছে যাচ্ছে তবে দাঁড়াচ্ছে না কেউ। অফিসওয়ালারা এতোক্ষণে অফিসে পৌঁছে গেছে। মহল্লার যেসব গৃহিণী ছেলেমেয়েদের নিয়ে স্কুলে গেছে তারা ফেরেনি এখনো। রান্নাঘরগুলো থেকে হাঁড়ি-পাতিল আর কড়াইয়ের সঙ্গে খুন্তি-হাতার সংঘর্ষের সংবাদ ঘোষিত হচ্ছিল চারদিকে। তেলে পাঁচফোড়ন দেওয়ার গন্ধও এসে নাকে লাগছিল। আণ্ডাবাচ্চাদের শোরগোলের সঙ্গে কাপড় কাচা, আদা-রসুন পেষার শব্দ তালগোল পাকিয়ে হুড়মুড় করে এসে পড়েছিল মহল্লার রাস্তায়। আমি সন্তর্পণে ঘরের দিকে এগোই। ঠিক এই সময় আমাদের ফ্ল্যাটের অন্যপাশের ছতলা বাড়ি থেকে ঝপাৎ করে এক গামলা ময়লার পানি এসে পড়ে আমার পেছনে। নোংরা পানির একটা ঝাপটা ভিজিয়ে দিয়ে যায় আমার পিঠ। ভূমি মাইন বিস্ফোরণের মতো এমন আকস্মিক ঘটনায় হতবিহ্বল হয়ে পড়েছিলাম। পিঠের দিকে শার্ট, প্যান্ট ভিজে লেপ্টে আছে শরীরের সঙ্গে। শার্টের কলারের কাছে ছিটকে এসে পড়া একটা মুরগির পালকের উপস্থিতি টের পেলাম। তবু পেছনে ফিরে উৎসটা আবিষ্কারের চেষ্টা থেকে অনেক কষ্টে নিজেকে বিরত রাখি। তাতে কথাকাটাকাটি, ঝগড়া-বিবাদ ও লোক জড়ো হওয়ার আশঙ্কা থাকে। আর এখন তেমনটা ঘটুক আমি চাই না। তবে আমার হয়ে পেছন থেকে কোনো একজন বাসিন্দা এই কুকর্মের প্রতিবাদ করলেন।
‘ওই মাগির ঝি, ফাড়া ইবারে ডাস্টবিন ফাইওস না?’ মহল্লার সর্দার রহমতউল্লার গলা চিনতে অসুবিধা হয় না। পুরনো বাঁশ চেরার মতো ফ্যাঁসফেঁসে, ভরাট আর জোরালো গলা। প্রত্যুত্তরে কেউ একজন বলে ওঠে, ‘ডাসবিন ন, ময়লার ডিফু।’ একটা নারীকণ্ঠের গজগজানিও প্রতিধ্বনির মতো আছড়ে পড়ে। এই হট্টগোলের মাঝে আমি তালা খুলে ভেতরে ঢুকে পড়ি।
জানালা আর ঘুলঘুলি দিয়ে আসা মৃদু আলোয় দেখলাম যেমন এলোমেলো করে গিয়েছিলাম ঠিক তেমনই আছে আমার ঘর। ছড়িয়ে থাকা জিনিসপত্রের জন্য পা ফেলার জায়গা নেই। তবু কোনোমতে অগোছালো বিছানার ওপর এসে বসি। ময়লাপানিতে ভিজে যাওয়া জামা-কাপড় নিয়েই সটান শুয়ে পড়ি বিছানায়। নাহ্, এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। তবে সবই মিথ্যে? উর্বর কল্পনা? ভাবতে-ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানি না। ঘুম যখন ভাঙলো তখন জানালার বাইরে বিকেলের নরম আলো।
সাত
ভেজা কাপড়ে ঘুমানোর কারণেই হয়তো শরীরে হালকা জ্বরের মতো অনুভূতি। সেইসঙ্গে মুরগির নাড়িভুঁড়ির একটা উৎকট গন্ধ। জিনিসপত্রের স্তূপ ঠেলে বাথরুমে এলাম। জঘন্য অবস্থা। বালতি-মগ সবই উপুড় করে রেখেছিলাম সকালে। এখনো তেমনি আছে। বড় পানির পিপেটাও কাত হয়ে আছে মেঝেতে। এক ফোঁটা পানিও ধরে রাখা হয়নি আজ। এ সময় পানি থাকার কথা নয়। মোটরও বন্ধ। তবু আশা নিয়ে একবার বাথরুমের কল ছাড়লাম। পাইপে জমে থাকা জলটুকু বের করে দিয়ে আবার খটখটে শুকনো অবস্থায় ফিরে গেল কলটা। বিকেলের আলো ততক্ষণে মরে গেছে। আমি বাথরুম থেকে বের হয়ে বিধ্বস্ত কক্ষটাতে পায়চারি করতে-করতে ভাবতে থাকি এখন কী করা উচিত? হঠাৎ ফ্রিজটার দিকে চোখ পড়ে। ঘরের বাতি জ্বালিয়ে ফ্রিজের ওপরের ডালাটা খুলি। সাদা পলিথিনে মোড়ানো হরিণের মাংসগুলো ঠিক তেমনই আছে। কিন্তু হাত দিতেই চমকে উঠি। পলিথিনটা শক্ত হয়ে চেপে বসেছে ফ্রিজের ট্রেতে। পলিথিনের বাইরে বরফের হালকা একটা স্তর। ভেতরের মাংসগুলো ইটের টুকরোর মতো কঠিন আর বরফশীতল। বিষয়টা এক ধাক্কায় বাস্তবে টেনে আনল আমাকে। না, এখন গোসল ছাড়া আর কোনো কিছুই ভাবা যাচ্ছে না। কিন্তু পানি? বালতি নিয়ে হানিফভাইয়ের বাসায় যাব? ভাড়াটে হিসেবে এক বালতি পানি চাইতেই তো পারি। কিন্তু এ সময় হানিফ ভাই থাকেন না। প্রেসে বসেন। তারপর আড্ডা সেরে ফেরেন রাত করে। বাড়িতে হানিফভাইয়ের স্ত্রী এখন নিশ্চয় একা। দু-একবার তার সঙ্গে আলাপ হয়েছে, যখন হানিফভাই লেখা দেখাতে ডেকেছিলেন ওপরে। মাঝে মাঝে একটা দুটো বইয়ের প্রচ্ছদ, ইলাস্ট্রেশন করে দিতেও আমাকে ওপরে যেতে হয়েছে। হানিফভাইয়ের বৈঠকখানায় আমাদের কথাবার্তার ফাঁকে নিঃশব্দে চা-নাস্তা রেখে গেছেন তার স্ত্রী। চোখাচোখি হয়নি কখনো। একবার পর্দার আড়াল থেকে কেবল জানতে চেয়েছিলেন, আমি চারুকলা থেকে পাশ করে বন বিভাগে কী চাকরি করি। উত্তরটা আমার হয়ে হানিফভাই দিয়েছিলেন।
‘ওদের গবেষণার কাজে আর্টিস্টেরও দরকার হয়। গাছ-গাছড়া, বন্যপ্রাণীর ড্রয়িং জুড়ে দিতে হয় গবেষণার বিবরণের সঙ্গে। আর আমাদের রাসেল এই কাজটাই করে। তুমি চাইলে ছবি আঁকাও শিখতে পারো ওর কাছ থেকে।’
কিন্তু ভেতর থেকে আর কোনো উত্তর এলো না। বুঝলাম হানিফভাইয়ের স্ত্রী গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ। এখন বালতি নিয়ে এমন একজন অ-মিশুক গম্ভীর নারীর মুখোমুখি পড়লে কেমন হবে ভাবতেই আমার গোসলের ইচ্ছেটা দমে যায়। তবু সাহস নিয়ে বালতি হাতে দরজা খুলে বেরিয়ে আসি। সিঁড়িঘরে পা দিতেই ওপর থেকে মগ কেটে গোসলের ঝবঝব শব্দ শুনতে পেলাম। মনে পড়লো বাড়ির পাশ ঘেঁষে ছাদের এককোণে একটা কলঘরও দেখেছিলাম। সেখানে এই সন্ধ্যায় কে গোসল করছে? হানিফভাই কি? কিন্তু পানি ঢালার ঝপাৎ শব্দের সঙ্গে নারীকণ্ঠের গুনগুনানিও ভেসে আসছিল। আমি থমকে দাঁড়াই কিছুক্ষণের জন্য। যাওয়া উচিত হবে? যদি কলঘরের দরজা খোলা থাকে? কিন্তু বেশিক্ষণ ভাবার সুযোগ পেলাম না। ভেজা ঠান্ডা একটা সাবানের গন্ধ আমাকে টেনে নিয়ে চললো সরু অন্ধকার সিঁড়ি দিয়ে। ঠিক তখন টুং করে একটা শব্দ আমার পায়ের কাছ থেকে দু-এক সিঁড়ি গড়িয়ে স্তব্ধ হলো। বুঝলাম হানিফভাইয়ের দেওয়া আলগা চাবিটা হারিয়েছি।
আট
সাতদিন জ্বরে ভোগার কারণেই মুখে একটা তেতো অনুভূতি। তাছাড়া আর সবকিছুই ঠিক আছে। এ কদিন হানিফভাই বারবার এসে দেখে গেছেন। ডাক্তার ওষুধপত্র, পথ্য সবকিছুরই ব্যবস্থা করেছেন। গতকাল থেকে আর জ্বর আসেনি। অফিসে খোঁজ নিয়ে রুয়াল মারমা আমার অসুস্থতার খবর জেনেছিল। আজ দুপুরে কাপ্তাই থেকে এসে উপস্থিত। সঙ্গে বাঁশকোড়লের তরকারি আর একবোতল দোচোয়ানি। আরোগ্য উদ্যাপনে হানিফভাইও উপস্থিত। আমি সকালে উঠেই দুপুরের জন্য সব আয়োজন করে রেখেছি। পোলাওয়ের চালের ভাত, মাংস ভুনা নিজে রান্না করেছি। হানিফভাইয়ের বাসা থেকে এসেছে কড়কড়ে করে ভাজা বাটিভর্তি বড় চাপিলা মাছ আর ঘন ডাল।
খাটে পা ঝুলিয়ে বসে সিগারেটের ধোঁয়া দিয়ে একটার পর একটা রিং বানাচ্ছিলেন হানিফভাই। তেল দেওয়া চুল পরিপাটি করে পেছনের দিকে আঁচড়ানো। মানে নিখুঁত ব্যাকব্রাশ। ধোঁয়ার আড়াল সরে গেলে চশমার পেছনে তার চোখজোড়াও স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। আড়চোখে লক্ষ করলাম সেগুলো আমার মুখের ওপরই নিবদ্ধ। অস্বস্তি এড়াতে আমি তাই বারবার নড়েচড়ে বসছিলাম। একটু পরপর আপন মনে হাসছিল রুয়াল।
‘তাহলে আপনি বলছেন, ওর ভয় পেয়ে জ্বর বাঁধানোর সঙ্গে আপনার যোগ আছে?’ হানিফভাইয়ের কথার উত্তর না দিয়ে রুয়াল চেয়ার ছেড়ে উঠে আমার দিকে এগিয়ে আসে। ‘সিগারেত দরান না দাদা!’ প্যাকেটটা বাড়িয়ে দিতেই আমি একটা শলাকা ধরিয়ে ধোঁয়া ছাড়ি। একটা কাজ পাওয়ায় স্বস্তি বোধ করি। তাছাড়া ধোঁয়ার আড়ালটাও সুবিধা দেয় কিছুটা। চেয়ারে ফিরে গিয়ে রুয়াল এবার কথা শুরু করে। ‘আসলে দাদা এই হরিণের মাংসই সব নসতের গোরা।’ রুয়াল আবার হাসতে থাকে।
‘কীরকম?’ প্রশ্নটা করতে করতে তিনটে গ্লাসে সমান করে পানীয় ঢালেন হানিফভাই। পরিমাণমতো পানিও মেশান। সবার হাতে গ্লাস তুলে দিয়ে একটা চাপিলা মাছে কড়াৎ করে কামড় বসান।
গ্লাসে চুমুক দিয়ে রুয়াল আমার দিকে তাকায়। ‘দাদা তো যে ভয় পাইসে। হরিণমানবীর ভয়।’ হানিফভাই বললেন, ‘মানে? খুলে বলুন না’।
‘আসলে এই জন্য আমিই দায়ী। দাদা একে তো অবিবাহিত তার ওপর একা থাকেন। গল্পটা বলাতেই বেচারার এমন জ্বর উতল!’ রুয়াল বাটি থেকে চাপিলা মাছ তুলে নিতে নিতে হঠাৎ ছাদ ফাটিয়ে হেসে ওঠে। হানিফভাই অধৈর্য হয়ে টেবিলে ঠকাস শব্দে খালি গ্লাস রেখে দ্বিতীয় পেগ ঢালেন।
একচুমুক গলায় ঢেলে রুয়াল একবার আমার দিকে আরেকবার হানিফভাইয়ের দিকে তাকায়। ‘আমারে কিন্তু প্রথম ফেগেই দরে যায় দাদা।’ খাড়া খাড়া চুল, লম্বটে মুখ আর পেশল শরীর রুয়ালের। কে বলবে ওর বয়স চল্লিশের ঘরে? জিন্স প্যান্ট আর সাদা টিশার্ট ওর বয়স আরো কমিয়ে দিয়েছে। যেন পঁচিশের ঘরেই থমকে আছে এখনো।
ছাদের দিকে মুখ করে দৃষ্টিটাকে দূর অতীতে নিয়ে যায় যেন সে। ‘বহুকাল আগের কথা। গহিন পাহাড়ে বাস করতো এক শিকারি। মাচাং গরে একাই থাকতো সে। আসপাসের কয়েক মাইলের মদ্যেও কোনো বসতি ছিল না। শিকার করে, জঙ্গল থেকে এতা সেতা জোগাড় করে দিন চলত। একদিন বনে গিয়ে একতা হরিণ শিকার করে। মাংস কেতে কুতে রেখে দেয় পাটিলে। বুজঝেননি, ব্যাচেলার মানুষ তো, রান্না করার সময় নাই। তাই মাংস পাটিলেই থেকে যায় আরকি। তো একদিন শিকারি গরে আসি দেখল তার সব কিছু গোসগাস করা। হাঁড়ি-পাতিল, কাপড় সব দুুয়ে রাখসে কে যেন।’
এটুকু বলে রুয়াল গ্লাসে পানীয় ঢালে আবার। বেশ মনোযোগ দিয়ে একটা চাপিলা মাছ শেষ করে। তারপর একটা সিগারেট ধরায়। হানিফভাইয়ের ডান চোখের নিচের চামড়াটা হঠাৎ কাঁপতে থাকে। খুব উত্তেজিত হলে এমনটা হয়। গালে হাত দিয়ে তিনি তাকিয়েছিলেন রুয়ালের দিকে। রুয়াল ফের শুরু করে।
‘তো প্রথমে শিকারি ভাবলেন এটা কিছু না মনের ভুল। কিন্তু পরদিন, পরদিনের পরদিনও একই কান্দ ঘতল। শিকারি চিন্তায় পড়ল। কে আসে ঘরে? কেন ঘরের সব কাজকর্ম করে? বনে-জঙ্গলে শিকারে গিয়ে আর মন বসে না। খালি চিন্তা করে বুজঝেননি? তো একদিন শিকারি তীর-ধনুক নিয়ে বাইর হয়। কিছুদূর গিয়ে আবার ফিরি আসি দরজার কাছে লুকাই থাকল। বেড়ার ফাঁক দিয়ে উঁকি মারি দেখে মাংসের হাঁড়ি থেকে সব মাংস জড়ো হয়ে একটা সুন্দরী মেয়ে রূপ ধারণ করসে। অপূর্ব সুন্দরী মেয়ে। কাঁচা হলুদের মতো গায়ের রং। তো সেই মেয়ে যখন গরদোর গোসানো শুরু করসে, শিকারি আস্তে আস্তে গিয়ে পিছন থেকে দরলো তারে। বললো কে তুমি! সে বলে আমি হরিণ। শিকারি বলে ধরসি যখন তোমারে ছাড়বো না। আমারে বিয়ে করো। মেয়ে রাজি হয়। ওরা বিয়ে করে সুখের সংসার পাতল, বুজলেননি। এরপর আরো আসে। তবে আর বলার প্রয়োজন নাই দাদা।’
গল্প শেষ, বোতলও ততক্ষণে শেষ। হানিফভাইয়ের চোখ চকচক করছে। ‘দারুণ, দারুণ গল্প। জানো রাসেল আমাদের গল্পকারেরা এসব গল্প কাজে লাগাতে পারলে সোনা ফলত। অথচ এর চেয়ে কত নিকৃষ্ট জিনিসকে আমরা জাদুবাস্তবতা বলি!’
দ্রব্যগুণেই হয়তো আমাদের বাঘের মতো খিদে পায়। প্লেটে ভাত বেড়ে হাতে হাতে তুলে দেই সবার। হানিফভাই মাংসের বাটি থেকে কয়েক টুকরো নিয়ে প্রথমেই মুখে চালান করে দিলেন। ‘আরে রাসেল তো পাকা রাঁধুনি। কিন্তু কেমন যেন মেজবানের মাংসের মতো মনে হচ্ছে! গরুর গোশত গরুর গোশত লাগছে।’
আমি বললাম, ‘কী যে বলেন হানিফভাই। আপনার নেশা হয়েছে।’ রুয়াল হেসে ওঠে। ‘থিক থিক দাদা, নেসা হইলে এমন মনে হয়।’ দুজনেই এরপর মুখের ভাত ছিটিয়ে, প্লেট হাতেই বিছানায় গড়াগড়ি যায়। সে-হাসি একটু বিরতি দিয়ে দিয়ে চলতেই থাকে।