প্রতিদিনের ভোর আমার একইরকম। কর্কশ আর নিরানন্দ। জীবনধারণের গ্লানি আর দুর্ভাবনায় ভরা। তবু ভোর আসেই শান্ত-সজীবতায়। আহা বেঁচে থাকা! ক্লান্ত, ক্লিষ্ট ভোর। তবু কী মধুর! দুঃখের দিনার দিয়ে গাঁথা, ঠুনকো সুতোয় তারা ঝুলে থাকে। বাড়িওয়ালার গম্ভীর, ক্রুদ্ধ মুখ, সহকর্মীদের ধূর্ত চোখ ব্যঙ্গে বাঁকা, পাওনাদারদের বিদ্রুপ ভরা রাগী চেহারা আমার প্রতিদিনের পাথেয়। তবু আজকের ভোরটি ছিল অন্যরকম। ধূমকেতুর লেজের উজ্জ্বল প্রভায় দীপ্ত। দেদীপ্যমান।
গতরাতে আমার স্ত্রী আমাদের তৃতীয় সন্তানটির জন্ম দিয়েছেন আমার একান্ত অনিচ্ছাতেই। তার আশা পূর্ণ হয়েছে। প্রথম দুটি পুত্রসন্তানের পরে কন্যাসন্তানের জন্য বড্ড আকুলতা ছিল তার।
আমি জানতাম, আমার মতো দরিদ্র মানুষের জন্য সন্তান কামনা বিলাসিতা মাত্র। তবু তার ইচ্ছায় সায় দিতেই হলো। কেননা, তার অপরাপর স্বাদ-আহ্লাদ পূরণ করা হয়নি আমার। প্রথম দুটি সন্তান ঢাকা শহরের একটি ক্লিনিকে হয়েছিল। তখন আমার আর্থিক অবস্থা একটু ভালো ছিল। এবার আমার কাজের বুয়াটিই এ-ব্যাপারে আমার স্ত্রীকে সাহায্য করেছে। হে নগরবাসী, তোমরা শুনে রাখো, ক্রুদ্ধ-জঙ্গম-কুৎসিত-পঙ্কিল-নিষ্ঠুর-সুন্দর পৃথিবীতে আরেকটি শিশুর আগমন। অমিত সম্ভাবনার। অশেষ দুঃখময় পরিণতির। অনেক গ্লানি-অপমান-পরাজয়ের ব্যর্থতার-বিজিতের দৈন্যের-অকিঞ্চিৎকর প্রাত্যহিকতায় অনন্ত জীবনের অনুগামী এক অকলঙ্ক, নিষ্কলুষ দেবশিশু। হে নগরবাসী, তোমরা শুনে রাখো, আরেকটি শিশু স্বর্গচ্যুত হয়েছে।
প্রথম যেদিন হাসি-হাসি মুখে ও খবরটি দিলো, আমার মাথায় খুন চেপে গেল। কী অসম্ভব? হতেই পারে না। ওষুধ তুমি ঠিকমতো খাওনি। সমস্যা বাড়িয়ে লাভ নেই। এমআর করিয়ে নাও। আমার বন্ধুর ক্লিনিক আছে। কোনো পয়সা লাগবে না। আমার চোখমুখ আর ভাবভঙ্গিতে বোধহয় একটা খুনির চেহারা ফুটে উঠেছিল। ভয়ার্ত চোখে তাকাল সে।
যা-ই হোক শিশুকন্যাটির মুখখানি ও চোখদুটি এত মায়াময় যে, আমার সমস্ত বিতৃষ্ণা ঝেড়ে ফেললাম এবং প্রসূতির জন্য কিছু পুষ্টিকর খাবার-দাবারের জন্য তৎপর হই।
খোঁজ নিয়ে জানলাম, এখনো পাঁচ কেজি চাল, কিছু ডাল, আধা কেজি শিম ও বরবটি, পাঁচটি টমেটো ও কিছু সুজি আছে। অন্তত দু-তিনদিন চালিয়ে নেওয়া যাবে। কিছু পুরনো খবরের কাগজ ছিল, যা বিক্রি করে বুয়ার টাকাটা দিলাম। কিন্তু প্রসূতিকে ভালো খাবার দিতে না পারলে শিশুটি দুধ কোত্থেকে পাবে? আমি একদিক দিয়ে ভাগ্যবান। আমার স্ত্রীর রূপ-লাবণ্য আমার গর্বের ধন। তার স্তনযুগল একটি সন্তানের ক্ষুধা প্রশমিত করার জন্য যথেষ্ট। পৃথিবীতে সবচেয়ে আনন্দের ঘটনা হলো সন্তানের পিতা হওয়া। কেননা, বেঁচে থাকার প্রেরণা বলে যদি কিছু থাকে তা হলো পিতৃত্বের প্রেরণা আর নারীপ্রেম। কিন্তু নারীপ্রেম ক্ষণস্থায়ী। আজ যাকে মনে হচ্ছে পরম আরাধ্য, যার স্পর্শে মনে হয় গোলাপ ফুটবে, কাল তা মনে নাও হতে পারে; কিন্তু সন্তানবাৎসল্য হলো এক অজেয় আনন্দ। দুঃখের ব্যাপার হচ্ছে এই যে, যখন অনিচ্ছাতেই সে-আনন্দকে গলাটিপে মারতে হয়।
মনে পড়ল ‘গরিবের বন্ধু’ পত্রিকায়, যেখানে খণ্ডকালীন সাংবাদিকতার কাজ করি, সেখানে কিছু টাকা পাওনা আছে। আরেকটা দৈনিকের সাহিত্য পাতায় একটি লেখা ছাপা হয়েছিল, ওই দুটি টাকা পেলে পনেরো দিনের জন্য নিশ্চিন্তি।
বাড়িওয়ালা গতকাল ওয়াসার সাপ্লাই লাইনে টিউবওয়েল বসিয়ে দিয়েছে। এখন আর জলের কষ্ট থাকবে না। গতরাতে বুয়া ড্রাম ভরে রেখেছিল। রাতজেগে লেখালেখি আর স্ত্রীর সন্তান প্রসবের উদ্বিগ্নতায় ভালো ঘুম হয়নি কিংবা সামান্য সময় ঘুমিয়েছিলাম মাত্র। তাই টলটলে ঈষদুষ্ণ জলে মনসুখ গোসল করলাম। শরীরটা ঝরঝরে লাগল। কিন্তু একটিও ইস্ত্রি করা কিংবা কাচা শার্ট-পাঞ্জাবি আলনায় দেখতে পেলাম না। ট্রাঙ্কে খোঁজাখুঁজি করে পুরনো অথচ পরিষ্কার একটা পাঞ্জাবি পেয়ে চিৎকার দিয়ে উঠলাম – ইউরেকা! ন্যাপথালিনের গন্ধমাখা ফিনফিনে পাঞ্জাবিটি পরে শরীর ও মন দুই-ই চাঙ্গা হয়ে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল গত মাসের মুদিওয়ালার টাকাটা শোধ করা হয়নি। মেসার্স ডিজেল মোটর অ্যান্ড সার্ভিসেস (বিডি) লিমিটেডে আমার চাকরি, যা একটি মোটর ওয়ার্কশপ। পার্টিদের কাছে পাওনা বিলের টাকার ওপরই নির্ভর করে আমাদের বেতন। প্রায়ই অনিশ্চিত। ফলে পাওনাদারদের কাছে আমাকে কাঁচুমাচু করেই চলতে হয়। এতোদিনে আমি জেনে গেছি, মানুষের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখেই আমাকে বাঁচতে হবে। এটাই নিয়ম, তাদের সীমাহীন ভণ্ডামি, অকাট মূর্খতা কিংবা ধূর্তামির মতো জঘন্য মনোবৃত্তিকে তোয়াক্কা করেই। এগুলো বেঁচে থাকার ও সহবাসের অবশ্যপালনীয় শর্ত। এ ছলনাগুলো আমি অতিকষ্টে আয়ত্ত করার চেষ্টা করছি। সম্পূর্ণ যে সফল হয়েছি তা মনে করি না।
সকাল ১০টা। চায়ের তৃষ্ণা অনুভব করলাম। পাকঘরে খোঁজাখুঁজি করে চাপাতা পেলাম না; কিন্তু একটা কৌটায় দুটাকা দামের কফির মিনি প্যাকেট পেয়ে গেলাম। মনটা খুশিতে নেচে উঠল। নিজেই বানিয়ে নিলাম। শাশ্বতী নিজের হাতে কফিটা বানাতে চেয়েছিল। আমি তাকে বারণ করি। আমার স্ত্রীর ভালো নাম নূরজাহান বেগম। বড্ড সেকেলে, সেকেলে ওটি আমার পছন্দ না। আমি তাকে শাশ্বতী বলে ডাকি। আমার আত্মীয়স্বজনও বলেন, এ কেমন নাম? হিন্দুয়ানি নাম দেওয়া কি ভালো? আমি তাদের আশ্বস্ত করে বলি, ওটি বাংলা নাম। আর তাছাড়া আমার যে ভালো লাগে! কী করি! আমি তাকে শাঁখাও পরাতে চেয়েছিলাম; কিন্তু তার নিজের ও আত্মীয়স্বজনের প্রবল বিরোধিতার মাঝে আর হয়ে ওঠেনি।
কফি-হাতে ঘরে এসে দাঁড়াই। ততক্ষণে গর্ভফুল পড়ে গেছে। গরমজলে গোসল সেরে একটা ধবধবে সাদা শাড়ি পরেছে সে। শিশুকন্যাটিকে স্তন্যপান করাচ্ছে। এত ভালো লাগল যে কী বলব। মনে হলো, আমার গরিবঘরে এক শাশ্বতী ম্যাডোনা! আমার চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। তাড়াতাড়ি বারান্দায় এসে বেতের চেয়ারটায় বসি। বেদনা ও আনন্দের মাঝে বিভাজন মুছে গেল।
দু-কামরার টিনশেডের বাসা। একচিলতে বারান্দা। বিয়ের সময় আমার গরিব শ্বশুরের অনেক কষ্টে দেওয়া উপহার একটা ক্যাসেট রেকর্ডার পেয়েছিলাম। সেটি অনেক যতেœ এতোদিন টিকে আছে। শম্ভু মিত্রের ‘মধু বংশীর গলি’ চালিয়ে দিলাম। আমার গরিবঘর এক স্বর্গীয় মূর্ছনায় ভরে উঠল। আনন্দ-বেদনা-আনন্দ-বেদনা-আনন্দ-বেদনা ঝরে ঝরে সারাঘরে মুক্তোর দানার মতো ছড়িয়ে পড়ল।
আজ আরো একটি আনন্দের স্মৃতি মনে পড়ল। বিয়ে করে প্রথম ঢাকায় যখন এক-কামরার বাসা নিলাম, প্রথম রাত্রিযাপনের পর ভোরে স্যুটকেস খুলে একটি সিল্কের শাড়ি তার হাতে তুলে দিলাম। তখন তার মুখে যে আনন্দ-হাসি দেখেছিলাম, তা স্বর্গের দ্যুতিকেও হার মানায়।
ভুলিনি
ভুলিনি
ভুলিনি
শিওয়াজ লুকড লাইক অ্যান অ্যাঞ্জেল ইন দ্যাট শাড়ি এমব্রয়ডার্ড উইথ ফ্লোরাল প্যাটার্ন অব পিকক্ ব্লু। কী যে অনির্বচনীয় আনন্দে মন ভরে উঠেছিল তা আজো মনের মাঝে অম্লান হয়ে আছে।
একটা পুরনো ম্যাগাজিন টেনে নিলাম। অনেকদিন পর আবারো আবিষ্কার করলাম, বন্ধুবর সিরাজ উদ্দিন আহমেদের একটি সাক্ষাৎকার সেটিতে ছাপা হয়েছে। তিনি অনেক বাগাড়ম্বর করেছেন সেখানে। মন বিতৃষ্ণায় ভরে গেল। লেখক নাকি সমাজের কাছে দায়বদ্ধ। এসব আজগুবি কথা আজকাল হরহামেশা শোনা যায়। সভা-সমিতিতে মন্ত্রী ও সান্ত্রীরা প্রায়ই বলে থাকেন, গণসাহিত্য করুন। গণমানুষের কথা বলুন, গণমানুষের আশা-আকাক্সক্ষার ছবি ফুটিয়ে তুলুন। আহ্, উপদেশ বিতরণ কী মধুর, যেন বাণী ছড়াচ্ছেন কোনো প্রেরিত পুরুষ।
লেখক আবার সমাজের কাছে দায়বদ্ধ হলেন কবে? লেখক তো সমাজের কাছে উচ্ছিষ্ট, বিবমিষা, বমি, জঞ্জাল। একজন লেখকের একটি সুন্দর গল্পের পারিশ্রমিক সমাজের দেওয়া থুথু – তিনশো কি পাঁচশো টাকা। একজন ভ্রাম্যমাণ যৌনকর্মীর আধঘণ্টার পারিশ্রমিকের চেয়েও কম। আসলে এ-সমাজের আমলা ও মাস্তানশাসিত সমাজের সবচেয়ে নাজুক অংশ হলো লেখক ও শিল্পীর দল। তাই তো ঝরে গেলেন হুমায়ুন কবির, আবুল হাসান, কায়েস আহমেদ, হাসান জান, রুদ্র, সাবদার সিদ্দিকী, আরো কত নাম।
ড. হুমায়ুন আজাদকে চাপাতির আঘাতে বিদীর্ণ হতে হয়। তসলিমা নাসরিনকে হতে হয় দেশছাড়া। অন্যদিকে শিল্পীদের, লেখকদের পিঠ চাপড়ে বাহ্বা কুড়ায় জঘন্যরকম ধূর্ত ও অসৃষ্টিশীল, কল্পনাশক্তিরহিত মন্ত্রী ও সান্ত্রীর দল।
একজন কবি যদি সত্যিকারের কবিখ্যাতি চান, যদি কিছু বলার থাকে তার, তবে তার না লেখাই উত্তম!! কেননা, তাঁকে প্রথমেই প্রচলিত রীতিনীতির কাছে বশ্যতা স্বীকার করে, নাকে খত দিয়ে অগ্রসর হতে হবে। তার ঝকঝকে ধারালো তলোয়ারটিকে ভোঁতা করে ফেলতে হবে কিংবা লুকিয়ে ফেলতে হবে লেঙ্গুটির ভাঁজে। চলতে-ফিরতে তার নিতম্বে খোঁচা খেতে-খেতে কবিতা বানাতে হবে সম্পাদকের মুখ চেয়ে, কবি সম্পাদকের মিথ্যে প্রশংসা করে, সমাজের ভ্রƒকুটি ও সরকারি অদৃশ্য তর্জনী নির্দেশের তোয়াক্কা করেই কলম ধরতে হবে। কী লাভ তাতে? প্রাণে স্পন্দন জায়গায় এমন শব্দটি কেটে দাও। কেননা, অমুক সম্পাদক ওটি পছন্দ করবেন না, হা। বিবমিষা-বিবমিষা-বিবমিষা হে কবি, তার চেয়ে বায়ু নিঃসরণ করো, যা অনেক বেশি স্বস্তিকর! ভাবনার সুতো ঢিলে হলে আকাশের দিকে তাকাই। শরতের স্বচ্ছ, ময়ূর-নীল মুগ্ধ আকাশ। আজ ছুটির দিন। এখানেই বেতের চেয়ারটায় বসে ছুটির দিনে আকাশের সঙ্গে খেলা। আমার একমাত্র সুখ। রাজার মতো।
কোলে পড়ে থাকে রোজকার দৈনিক। আজকাল পত্রিকার পাতায় লাল হরফে রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের বিষয়ে মজার-মজার খবর ছাপা হচ্ছে। কে আটক, কে জেলে প্রথম পদধূলি দিয়েছেন, কে কত ধনী, কার স্ত্রী স্বামীর চেয়েও বেশি ধনী -। ইত্যাকার খবরে পত্রিকার পাতা সয়লাব। কার গোয়ালঘর ত্রাণের টিনে ছাওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি। আর সাধারণ মানুষ আত্মহারা। আর এরাই নেতা-নেত্রীদের ডাকে মিছিল গিয়ে গুলি খায়, শহীদ উপাধি পায়। আর তাদের স্ত্রী, ছেলেমেয়ে নেতা-নেত্রীদের আশীর্বাদপুষ্ট হাতের ছোঁয়া পেয়ে ধন্য হয়। কেমন যেন বিবমিষা লাগে আমার। আমার মনে হয়, এ সবকিছুর সঙ্গে আমার কোনো যোগ নেই। এই সংঘর্ষময় জীবনের সঙ্গে আমার যেন ঘটে গেছে চিরবিচ্ছেদ। ছুটির দিনে অজন্তা প্রেসে আড্ডা হয়। নাখালপাড়ায় বসার একমাত্র স্থান। বন্ধুবর শহীদুল আলম সে-প্রেসের কর্ণধার এবং আড্ডার মধ্যমণি। একসময়ের তুখোড় সাংবাদিক, কবি, মুক্তিযোদ্ধা। বেশকটি লিটল ম্যাগের সম্পাদক। রেগে গেলে তাঁর মুখে খিস্তি-খেউড় হিরণ¥য় দীপ্তিতে ঝলসে ওঠে! সেই শহীদভাই আমাকে প্রায়ই ঝাড়েন। আরে ভাই, আপনি তো একজন অরাজনৈতিক লোক, আপনি দেশের অবস্থা কী বোঝেন, করেন তো একটা কেরানির চাকরি, আপনি রাজনীতির কী বোঝেন? আমিও আজকাল তাঁর কাছ থেকে পাঠ নিয়ে খিস্তি-খেউড়ে রপ্ত হয়েছি। ফলাফল মনোমালিন্য। তাঁর অজন্তা প্রেসের সামনে দিয়ে রোজ অফিসে যেতে হয়। দু-একদিন এড়িয়ে গেলে রাস্তায় পথ আটকে দাঁড়ান। দু-কান ছোঁয়া হাসি দেন, হাত ধরেন। অতএব, বসতেই হয়। আর যিনি নিজ হাতে স্যুপ বানিয়ে খাওয়ান, তাঁর সঙ্গে রাগ করে থাকি কী করে। সেই শহীদ ভাইয়ের একমাত্র কন্যা মাথিন, আমাদের সবার প্রিয় মাথিন, যে সাংবাদিকতা বিষয়ে অনার্স পড়ে এবং ভালো রবীন্দ্রসংগীত গায়। একদিন সে আমাকে ‘আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণ ধুলার তলে’ গানটি শুনিয়েছিল। এমন গভীর, এমন আত্মহারা ছিল সেই নিবেদন যে, আমার চোখে জল এসে গিয়েছিল। ভুলিনি – ভুলিনি – ভুলিনি। মাথিনের নিজস্ব ঘরটি খুব সুন্দর করে সাজানো। দরজা পেরোতে গেলেই ডোরবেল টুংটাং শব্দে অতিথিকে অভ্যর্থনা জানায়। তার ঘরের দেয়ালে ঝুলানো আছে মন কেড়ে নেওয়া মাদার তেরেসার বিনম্র ছবিটি। মাথিন – আমাদের প্রিয় মাথিন। তার ঘরে বসেই আমরা সবাই দেখেছি সত্যজিতের ক্লাসিক ছবিগুলি… পথের পাঁচালী, অরণ্যের দিনরাত্রি, কাঞ্চনজঙ্ঘা, অভিযান, চারুলতা, প্রতিদ্বন্দ্বী।
ওখানে আসেন নাখালপাড়া হোসেন আলী হাইস্কুলের ইংরেজির শিক্ষক জনাব ইয়াদ আলী। ছ-ফুট লম্বা, নিগ্রো ব্ল্যাক। সবসময় ফিটফাট। আসেন ওপেলভাই; মানুষের উপকার করা যাঁর ব্রত। যে-কোনো মানুষের বিপদে আত্মীয়-অনাত্মীয় বিচার না করে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ভীষণ রসিকও বটে। চল্লিশোর্ধ্ব, কাঁচাপাকা গোঁফ কনফার্মড ব্যাচেলর। রেগে গেলে তিনিও কম যান না। আসেন শিমুলভাই। একটা গার্মেন্টসের পিএম। জমে ওঠে আড্ডা। এই বিশ্বসংসারের এমন কোনো বিষয় নেই, যা এখানে আলোচিত হয় না। ওই আড্ডাতে আসেন সোনালী ব্যাংকের রিটায়ার্ড জিএম মাহমুদুল হক। অসম্ভব বিনয়ী ও পরিশীলিত মানুষ একজন। তাঁর হাতে থাকে নাগিব মাহফুজের উপন্যাস। মাহমুদ দারবীশের কবিতা। আমার অসম্ভব প্রিয় একজন মানুষ। তিনি প্রতিবছরই একটি করে অতীব লোভনীয় ডায়েরি উপহার দেন। এবার এ-পর্যন্ত দুটি পেয়েছি।
আমাদের এ-আড্ডায় হঠাৎ-হঠাৎ উড়ে আসেন আখতারভাই, আমাদের সবার প্রিয় ছড়াকার আখতার হোসেন। অন্যের মতকে হার্ট না করে প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে তার যুক্তি তুলে ধরেন। আমি অজান্তেই তাঁর একনিষ্ঠ ভক্ত হয়ে পড়েছি। আর ইয়াদ আলী প্রায়ই আমাকে খুব আন্তরিকতার সঙ্গে গাল দেন। ভাই, কিছু মনে করবেন না। আপনি একটা অপদার্থ! একটা গার্মেন্টসের দুগ্ধপোষ্য মেয়েও আপনার চেয়ে বেশি টাকা বেতন পায়। আর এতো জার্গন ঝাড়বেন না। আমরা কিছু লেখাপড়া করেছি। এত পাণ্ডিত্য করে কী লাভ হলো? আমি হেসে বলি, হ্যাঁ, অনেক ব্যাপারেই আমি আপনার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করি; কিন্তু এ-ব্যাপারে আমি আপনার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত। সত্য যে কঠিন, কঠিনেরে ভালোবাসিলাম। তারপর অনাবিল হেসে বলি, ভাই, আমি আসলেই একটা অপদার্থ!
বেঁচে থাকার, ভালোভাবে বেঁচে থাকার আবশ্যিক ছলনাগুলো আমি এখনো সম্পূর্ণ আয়ত্ত করতে পারিনি ভাই। আমি এমনিতেই মুখচোরা মানুষ। একাকী থাকতেই ভালোবাসি। কিন্তু এই মানুষগুলোর সঙ্গ আমার কাম্য। তাদের রাগ, আন্তরিকতা, ভালোবাসা সবমিলিয়ে আমার ঢাকা শহরবাসের নির্বান্ধব জীবনে একমাত্র সান্ত্বনার স্থান। তাদের উষ্ণতার স্পর্শে আমি উজ্জীবিত হই বইকি। এই নশ্বর জীবনের যত মালিন্য, গ্লানি, ব্যর্থতা এবং যাবতীয় অসংলগ্নতা ছাপিয়ে আনন্দে ক্ষণিকের জন্য হলেও আপ্লুত হই। বেঁচে থানার প্রেরণা লাভ করি, আরো কিছুদিন বাঁচার ইচ্ছায় প্রলুব্ধ হই।
আমার বাবা ছিলেন প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক। আমাকে নিয়ে তাঁর ছিল অনেক স্বপ্ন। গর্বও ছিল বইকি। বরাবর ক্লাসে ফার্স্ট হতাম। ১৯৫৭ সালে সদ্য গ্রাম থেকে আগত গোবেচারা চেহারার ছাত্রটিকে প্রথম-প্রথম শহরের সপ্রতিভ সহপাঠীরা টিটকারি দিত। কিন্তু হাফ-ইয়ারলি পরীক্ষায় প্রথম হলাম। সহপাঠীরা এবার ভিন্নচোখে দেখতে শুরু করল। হেডস্যার নূর মোহাম্মদ, বাংলার শিক্ষক দীনেশ স্যার, ইতিহাসের সাহাবুদ্দীন স্যার, আবদুর রউফ স্যার – যিনি পরে বিচারপতি হন – তিনি বিজ্ঞান ও অঙ্ক পড়াতেন, সবার চোখে পড়ে গেলাম। গফুর স্যার একদিন ডেকে নিয়ে বললেন, – কী রে তোর স্বাস্থ্য এতো খারাপ কেন? আমার কাছ থেকে রোজ আট আনা নিয়ে যাবি। ডিম কিনে খাবি।
সহপাঠীদের মধ্যে আলতাফ আর মিন্টু ছিল সবচেয়ে কাছের বন্ধু। পাশাপাশি বাসা। লুই কানের অমর সৃষ্টি আজকের সংসদ ভবনটি ছিল ভুট্টাক্ষেত। তার পাশেই ছিল ইটখোলা কলোনিটি। আমার চাচা-সাহেবের সে-কলোনির বাসায় থেকে তেজগাঁও পলিটেকনিক হাইস্কুলে পড়তাম।
ইয়াদ আলীর কথার উত্তরে অনেক সময় বলতে ইচ্ছে হতো, হ্যাঁ বাবা ভুল করেছিলেন। পড়ালেখা না করে যদি কৃষক হতাম, মাঠে লাঙলের ফলায় উর্বর মাটি উলটিয়ে চাষ করে ফলাতাম সোনালি ধান, পাট, কলাই। রাতে জোছনা থইথই করত উঠানে। প্রকৃতির ডাকে বাইরে এলে দেখতাম গাবের অন্ধকারে জোনাকির ফুলকি। অমাবস্যার রাতে অন্ধকার বিলে দেখতাম আলেয়ার আলো। নৌকার গলুইয়ে দাঁড়িয়ে আশ্বিনে হ্যাজাকের আলোতে টেঁটাবিদ্ধ করতাম শোল, গজার কিংবা বোয়াল। শরতের নির্মেঘ আকাশে দেখতাম তুলোসাদা মেঘের খেলা। ঢেউ-খেলানো আউশের ক্ষেতে দাঁড়িয়ে ধরতাম নীল গারো পাহাড় থেকে উড়ে আসা বুড়ির দুধসাদা চুল। ধরে আমার সন্তানের মাথায় জড়িয়ে দিতাম। আমন ধানের গুচ্ছ ছিঁড়ে কন্যার কপালে দিতাম লক্ষ্মীপোকার সবুজ টিপ।
মধুকূপী আগাছার ফুল ছিঁড়ে মৌমাছির মতো টেনে নিতাম তার মধুরস। ঢাকা শহরের এই কেরানির জীবনে আমার কিছু পাওয়ার যেমন নেই, তেমনি নেই কিছু কাউকে দেওয়ার। আমার জীবনের গল্প একেবারে সাদামাটা। একরৈখিক। শুধু নিশ্চুপে ক্ষরণ। আমি কি কাপুরুষ? বীরভোগ্যা এই বসুন্ধরা, বুঝি না। জানি না। এই পৃথিবীতে কেউ কাউকে উদ্ধার করে না। এই পৃথিবী হলো ডাকাতের পৃথিবী। যা চাও ছিনতাই করো। ছলে-বলে বা কৌশলে। ভালোবাসা? তাও।
চোদ্দো বছর মুগদাপাড়ার মেসে কাটিয়েছি আমি। ভুসো আটার রুটি আর আলকাতরার মতো কালো গুড় খেতে কেমন লাগে তা কী করে বুঝবে মানুষ। কখনো রাতের গান্দা তরকারির ঝোলে ডুবিয়ে পাউরুটি – রাস্তার ধারের কল থেকে জল খেয়েও ক্ষুধা প্রশমিত করতে হয়েছে আমাকে। এতে গর্বের কিছু নেই। আমার মতো কত মানুষ আছে এদেশে। রাস্তায় শুয়ে থাকা এই মানুষেরা একদিন জেগে উঠবে নিশ্চয়। তাদের হিসাব তারা বুঝে নেবে একদিন। মানুষকে ভালোবেসে, মানুষের কল্যাণের জন্য সারাবিশ্বকে এক রাষ্ট্র, এক পরিবারের স্বপ্ন দেখেছিলেন মহামতি কার্ল মার্কস, সে-স্বপ্নকেও তছনছ করে দিয়েছে মানুষই – প্রভুত্ব আর প্রতিপত্তির জন্য। সেসব মানুষের কী শূন্যগর্ভ আস্ফালন – নাপাম, জীবাণু বোমা, কন্টিনেন্টাল ব্যালাস্টিক মিসাইল, অ্যান্টি এয়ারক্র্যাফট গান আর নিউক্লিয়ার বোমা – কী ভয়াবহতার মাঝে মানুষের বেঁচে থাকা। সম্পদের কী নিদারুণ অপচয়।
আমাদের দেশের নেতা-নেত্রীরা যখন জনগণের সুখ-শান্তির কথা বলেন, তখন তাদের চেহারা সত্যিই দেখার মতন। এক অনির্বচনীয় দীপ্ত আভায় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে তাদের মুখ। তাদের কথার ফুলঝুরিতে নিরন্ন মানুষ বিমুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে।
সেই সমাজ আসবে কবে যখন সবল বলবে, হাঁটতে পারছ না? ভয় কী আমার গায়ে অনেক জোর। এসো ভাই আমার কাঁধ ধরে হাঁটো। তোমার ঘরে খাবার নেই, তাতে কী? আমাদের আজকের মতো আছে। চলো, দুঃখের অন্ন ভাগাভাগি করে খাই। মানুষ হয়ে উঠবে মানুষের ভাই, বন্ধু আর রক্ষাকর্তা। সবার জীবন হয়ে উঠবে আনন্দে হাস্যোজ্জ্বল। সবার জানালাগুলো থাকবে খোলা। আলোকিত। পর্দাঢাকা ঘরে নিরেট পাথরের মতো মুখ করে কেউ একাকী বসে থাকবে না।
আমি বোধহয় আনমনা হয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ দেখি শাশ্বতী কন্যাটিকে কোলে করে সামনে দাঁড়িয়ে আছে হাসিমুখে। হাতে একটা না-খোলা খাম। ভুলেই গিয়েছিলাম। জানি এর মধ্যে কী আছে। একটা ইন্টারভিউ কার্ড। খুলে দেখি ইন্টারভিউর তারিখ আজই। ডায়মন্ড লেদার ইন্ডাস্ট্রিজ থেকে এসেছে। হাজারীবাগ ট্যানারিপল্লিতে এদের অফিস।
যাবে না?
হ্যাঁ, যাব।
বিকেল ৩টায় ইন্টারভিউ। ২টার মধ্যে বেরিয়ে পড়লাম। ট্যানারিপল্লিতে পৌঁছামাত্র একটা দুর্গন্ধ পেলাম। একটা ধারালো ব্লেডের মতো দুর্গন্ধটা নাসারন্ধ্র ভেদ করে ফুসফুসে কেটে বসে গেল। মুহূর্তে মনে হলো, এ একটা অন্য জগৎ, যার সম্বন্ধে আমার কোনো ধারণাই ছিল না। দেখলাম অনেক মানুষ চলাফেরা করছে অবাধে, স্বচ্ছন্দে।
আমার অস্বস্তি লাগল। দমবন্ধ হওয়ার একটা অনুভূতি। বিবমিষা। হয়তো বমি হয়ে যেতে পারে যে-কোনো মুহূর্তে। কাঁচা ড্রেনগুলো দিয়ে মরিচা রঙের জল বয়ে নিয়ে যাচ্ছে চামড়া শিল্পের যাবতীয় বর্জ্য। লালি-মাখানো তামাকের রাবের মতো, নরকের গলিত পুঁজের মতো, গলিত বিষ্ঠার নর্দমার মতো। বিদ্যুচ্চমকের মতো মনে হলো, এ হচ্ছে ফুসফুস, যকৃত, প্লীহা আর পাকস্থলী থেকে নির্গত শ্রমিকের, বঞ্চিত শ্রমিকের কালরক্ত।
বিষের মতো বাতাস। সিসার মতো ভারী। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হতে লাগল। যা হোক অনেক কষ্টে বসে থাকলাম ঘণ্টাখানেক। তারপর ডাক পড়ল। নাম-পরিচয়ের পর প্রথম প্রশ্নটা এলো।
প্রথম প্রশ্নকর্তা : দেখা যাচ্ছে, আপনার যথেষ্ট বয়স হয়েছে। তবু কেন চাকরি চান?
উত্তর : ভাত খেতে।
বোর্ডের সবার মুখেই একটা মজার হাসি।
দ্বিতীয় প্রশ্নকর্তা : আচ্ছা বলুন তো, চাঁদের ওজন কত?
উত্তর : ওয়ান থাউজেন্ড ট্রিলিয়ন কেজি পয়েন্ট জিরো জিরো গ্রাম।
বোর্ডের সবার মুখে একটা অসহায়তার ছাপ।
তৃতীয় প্রশ্নকর্তা : আচ্ছা আপনার বায়োডাটাতে এই যে আমার সামনেই আছে ধর্মের জায়গায় লিখেছেন মানব ধর্ম। সেটি আবার কী জিনিস?
উত্তর : মানুষ হিসেবে আমাদের যা করা উচিত।
ভালো চেয়ারটিতে যিনি বসে আছেন, তিনিই বোধহয় ম্যানেজিং ডিরেক্টর। তাঁর মুখে স্মিত হাসি। তিনি বললেন, আপনি তো অ্যাকাউন্ট্যান্ট। বলুন অন হোয়াট প্রিন্সিপল উইল ইউ ড্র ইওর ব্যালান্সশিট?
উত্তর : আই উইল ড্র মাই ব্যালান্সশিট অন প্রিন্সিপল অব প্রেফারেন্স।
প্রশ্ন : প্লিজ এক্সপ্লেইন।
উত্তর : সামওয়ান স্টার্ট ফ্রম ফিক্সড অ্যাসেট টু লিকুইড ক্যাশ, আদারস স্টার্ট ফ্রম লিকুইড ক্যাশ টু কামডাউন টু ফিক্সড অ্যাসেট। সো দেয়ার ইজ অ্যা কোয়েশচেন অব চয়েস অর প্রেফারেন্স ¬-।
প্রশ্নকর্তা : ভেরি গুড! দিস ইজ দ্য আনসার আই ওয়ান্টেড ফ্রম এভরিবডি বাট নো বডি কেম আউট -। ইউ আর সিলেকটেড। আপনার এক্সপেকটেশন কত?
উত্তর : এক্সকিউজ মি, স্যার। চাকরিটি আমি করব না।
প্রশ্নকর্তা : বাট হোয়াই -।
উত্তর : ইন দিস স্মেল অব হেল আই কান্ট সারভাইভ -।
প্রশ্নকর্তা : ডোনচ ইউ নো – সারভাইভাল ফর দ্য ফিটেস্ট।
উত্তর : ডারউইনের এ থিওরিটি মানবতাবিরোধী বনস্পতির নিচে যে আন্ডারবুশ, তাকেও বাঁচতে দিতে হবে – প্রকৃতিতে সেটি আছে – কিন্তু মানুষ সেখান থেকে শিক্ষা নেয়নি।
বেরিয়ে এসে টেম্পোতে উঠে বসলাম।
বাসায় ফিরলাম ৬টায়। শাশ্বতীর ঘরে গিয়ে কাপড় ছাড়লাম। কিন্তু সে কিছু জিজ্ঞেস করেনি। সে জানে, সব সময় ইন্টারভিউ দিয়ে এসে আমার মেজাজ থাকে তিরিক্ষি। যাহোক চা-নাশতা রেডি ছিল। নাশতা সেরেই দৌড়ালাম। ‘গরিবের বন্ধু’ পত্রিকায় আমার ম্যাটার দেওয়ার কথা আজ। একটু দেরি হলো বইকি। আমার সিনিয়র কামালভাই, কামাল-বিন-মাহতাব কৃত্রিম রাগের সঙ্গে বললেন, কী হে বুলবুল, ইউ আর টু আরলি ফর দ্য নেক্সট ডে। আমি মুচকি হাসি দিয়েই উত্তর দিই। আমি কানে কানে তাঁকে আমার বিশেষ ঘটনাটি উল্লেখ করে ক্ষমা প্রার্থনা করি। কামালভাই হইহই করে ওঠেন। আরে তাই বলুন। মিষ্টি কই? আমার অবস্থা তাকে বলি। তিনি নিজে তাঁর সফেদ খদ্দরের পাঞ্জাবির পকেট থেকে একশ টাকার নোট বের করে বলেন, এটা ধার দিলাম। মিষ্টি খাওয়ান।
পিয়নকে ডেকে অগত্যা মিষ্টি আনতে বলি।
কামাল-বিন-মাহতাব যিনি ‘ছোটগল্প’ পত্রিকার সম্পাদক, যাকে ঘিরে তখনকার প্রতিভাবান তরুণরা জড়ো হয়েছিলেন পূব পাকিস্তানের সাহিত্যাকাশে। অনেক কষ্ট করে চালাচ্ছিলেন পত্রিকাটি, আমি তার নীরব সাক্ষী। কিন্তু যখন তার সব পথ বন্ধ হয়ে গেল, তখন তার একটি ব্যতিক্রমধর্মী প্রস্তাবে রাজি হন লুৎফর রহমান সরকার। ব্যাংকার কিন্তু সাহিত্যপিপাসু, সুলেখক ও সাহিত্যের প্রতিপালক সরকারভাই তাকে একটি ব্যতিক্রমধর্মী লোনের বন্দোবস্ত করে দিয়েছিলেন। কিন্তু অভাবের আগুনে কামালভাইয়ের সেই প্রজেক্টের স্বপ্ন পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল। সেই স্মিত হাস্যময় কালো মানুষটির সঙ্গে আমার ধীরে-ধীরে সখ্য গড়ে উঠছিল। অনেক তর্ক হতো তার সঙ্গে।
তিনি বলতেন, বুলবুল, এত সততা-সততা করবেন না। জানেন, এ-সমাজে সততা জিনিসটি কী?
আমি বলতাম, কী?
সততা হলো গনোরিয়ার পুঁঁজ, যার পরিণতি অণ্ডকোষের হার্ড শ্যাঙ্কার।
আর সিনসিয়ারিটি?
সিফিলিসের ঘা! যার চিকিৎসা না হলে এর ফল সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হবে। সবশেষে স্থান হবে উন্মাদ আশ্রমে।
তারপর মিটিমিটি ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি। আর কিছুক্ষণ পর বলতেন, বুলবুল আপনার চিকিৎসা দরকার! বলেই হো-হো করে হাসি। সপ্তম দিন থেকে আমার শিশুকন্যাটি মায়ের দুধ খেতে পারছিল না। ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলাম। কিন্তু ডাক্তার বুঝতে পারেননি বোধহয়। তাঁর ওষুধে কোনো কাজ হলো না। দশম দিনে তার খিঁচুনি আরম্ভ হলো। মহাখালী হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। ডাক্তার বললেন, টিটেনাস!
শাশ্বতী পাথর হয়ে গেল। তার চোখে বিদ্যুচ্ছটা। আমার প্রতি ধিক্কারে, ঘৃণায় বিস্ফোরণমুখো হয়ে উঠল। বুয়ার নোংরা হাতের কাজ, ব্লেড ইত্যাদি ঠিকমতো স্টেরাইল করা হয়নি হয়তো। তাই বিপত্তি, এই সর্বনাশ। হাসপাতালের ডাক্তার বললেন, আজকাল পঞ্চাশভাগ রোগীকে বাঁচানো যায় বইকি। অনেক টাকার ব্যাপার। পাঁচশো টাকার ইনজেকশন কালোবাজারে তিন হাজার টাকা। প্রতি ছ-ঘণ্টা অন্তর ইনজেকশন দিতে হবে। কমপক্ষে ১৫ দিনের চিকিৎসা। আর পনেরো দিন অবজারভেশনে রাখতে হবে। এক্ষুনি, এই মুহূর্তে চিকিৎসা শুরু করতে হবে।
ছুটলাম পত্রিকা-অফিসে। কামালভাইকে জানানো দরকার। কামালভাই নিজে উদ্যোগী হয়ে প্রধান সম্পাদকের রুমে কয়েকজন সহকর্মীসহ ঢুকে গেলেন। তিনিই মুখপাত্র। কমপক্ষে এ-মুহূর্তে বিশ হাজার টাকা দরকার, স্যার। বাচ্চাটিকে না-হয় বাঁচানো যাবে না। সম্পাদক সাহেব ও মালিক মি. চৌধুরী চিবিয়ে-চিবিয়ে বললেন, আমার বাসায় বাথরুমের কমোডটা হলদে হয়ে গেছে অনেক দিন। টাকার অভাবে পালটাতে পারছি না। আর তাছাড়া উনি তো খণ্ডকালীন কাজ করেন আমাদের এখানে।
বন্ধু সহকর্মীরা দশ হাজারের বন্দোবস্ত করলেন। ডিজেল মোটর থেকে আমাদের চেয়ারম্যান এইচএন আশিকুর রহমান শুনেই পনেরো হাজার টাকার চেক দিলেন। আমার বড় ছেলেটি তার বন্ধুদের নিয়ে মিটফোর্ডে তন্নতন্ন করে খুঁজে কিছু ইনজেকশনের জোগাড় করল। চিকিৎসা শুরু হলো। কিন্তু তিনদিন পর আমার ক্যাসিওপিয়া, দ্য কুইন অব দ্য স্কাই গন টু মিট হার মেকার। মনে-মনে আমি চিৎকার করে উঠেছিলাম। আমি কে? কী আমার পরিচয়? আমি কোন দেশের নাগরিক? ওষুধের অভাবে কেন আমার কন্যা মারা যাবে? কী দোষ আমি করেছি? কিংবা সেই শিশুকন্যাটি?
কিসের গণতন্ত্র? হাসপাতালে কেন ওষুধ পাওয়া যাবে না? কার এই গণতন্ত্র? এ-স্বাধীনতা কার? সংসদ ভবন ভেঙে ফেল – সেখানে কে মরহুম আর কে শহিদ এ-তর্কে লিপ্ত যারা, তাদের ডাকো। সেই অমর দার্শনিক স্থপতি লুই কানকে কারা অপমান করছে? তাদের চিহ্নিত করো। জবাবদিহি করতে হবে তাদের আমার কাছে। কোটি-কোটি মানুষের শ্রমের ঘামের প্রতিটি বিন্দুর হিসাব দিতে হবে। কাদের গালে, বগলে, কুঁচকিতে, নিতম্বে ফ্যাট জমেছে তাদের খোঁজ করো। কারা আমাদের শ্রমিকদের হার্ড আর্নড ফরেন কারেন্সি খরচ করে ঘন-ঘন ওমরা হজ করতে যান, তাদের তালিকা তৈরি করো।
হে নগরবাসী, আমার সোনামণি – আমার বুকের রুধির – আমার জ্যাকুলিন – আমার ক্লিওপেট্রা – আমার ডেসডিমোনা – আমার ঝাঁসির রানী – আমার তেরেসা – আমার ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল – আমার জোয়ান অব আর্ক – আমার প্রীতিলতা কেন মারা যাবে?
হে নগরবাসী, তোমরা যারা শ্রমিক, খেটে খাওয়া মানুষ, যাদের শ্রমে-স্বেদে গড়ে উঠেছে এই শহরের সুদৃশ্য অট্টালিকাগুলো, তোমরা যারা কলে-কারখানায় সভ্যতার চাকাকে সচল রেখেছ, তোমরা আমার হেলেনের জন্য কেঁদো না, করো না অশ্র“পাত বরং তোমাদের চোখকে শানিত করো, হাতকে করো হাতিয়ার – প্রস্তুত থাকো, দিন আসবেই।
আজিমপুর গোরস্তানে ফুলে-ফুলে সাজিয়ে দিয়েছিলাম আমার ক্যাসিওপিয়াকে, আমার হেলেনকে। তার ছোট্ট কবরটির বুকে গেঁথে দিয়ে এলাম কয়েকটি গ্ল্যাডিওলা – পিংক, ইয়োলো, হোয়াইট, অরেঞ্জ, ভারমিলিয়ন -।
সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে এসে দেখি আমার ছোট ছেলেটি যে শেষকৃত্যে অংশ নেয়নি, ছোট বোনটির ছোট্ট-ছোট্ট জামা, টাওয়াল, ন্যাপকিন ইত্যাদি পুঁটলি করে বুকের মাঝে জড়িয়ে, কুঁকড়ে, যেন আফোটা একটি কোরক, ঘুমিয়ে আছে। বারান্দায় দুটো চেয়ারে বসে থাকি আমি আর শাশ্বতী পাশাপাশি। অনেকক্ষণ। নিঃশব্দে।
বয়ে যায় পল অনুপল।
স্ফটিক-স্বচ্ছ সময়।
যতিহীন।
অন্ধকার আরো গভীর হলে একসময় পৃথিবীর গর্ভ ভেদ করে, সমুদ্রের তলদেশ থেকে যেন উঠে এলো এক চাঁদ, বিশাল, ভয়াবহ, রক্তলাঞ্ছিত চাঁদ।