কাঁঠালগাছের তলা অবধি হেঁটে এসে দেখি ভবানন্দ আর নেই। এ কী অবাস্তব ব্যাপার! নিরূপমা চোখ কচলান। জ্বলজ্যান্ত মানুষটা হাঁটুর ওপর ওঠানো ধুতি আর ওঁর পছন্দের আকাশি রঙের ফতুয়া গায়ে হেঁটে আসতে আসতে হাওয়ায় মিলিয়ে গেলেন!
আগের দিন বিকেলে গোবর ও আঠামাটি দিয়ে লেপা ঘরের দাওয়া তখনো শুকোয়নি। অথচ পিঁপড়েরা ইতোমধ্যেই সারি-সারি ব্যস্তসমস্ত। লাল-লাল, লাল-কালো, লাল-খয়েরি, একই প্রজাতির প্রায় একই আকারের পিঁপড়ের দলে ভিন্ন ভিন্ন রঙের পিঁপড়েরা কেউ থেমে নেই। বাতাসে তেলমেনির গন্ধ ম-ম।
এই গন্ধ ভীষণরকম স্মৃতিমাখা। মা বলেন, ‘এই রান্নাডা আমার
মা আমার ঠাকুরমার কাছ থেইক্যা শিখছে। হলদি, মরিচ, জিরা ও আদা একলগে বাইট্যা মশলা বানাইয়া, তার মইধ্যে এলাচি চেইছ্যা দিয়া ভালো কইরা ভাইজ্যা তারপর আগে ভাইজ্যা রাখা মেনিমাছ ছাইড়া ছিঁডা জল দিয়া রাখতে হয়, এইবার মাখা-মাখা হইলে পরে নামাইয়া রাখতে হয়।’
শ্বেতা বলে, – হ-হ, কেলুরা ভ্যাদা কয়!
মা বলেন, – না না, ভ্যাদা পূর্ববাংলারই নাম! পশ্চিমবাংলায় মেনিরে কয় ভেঁটকি। পিসামশাইর মুখেই আমরা প্রথমে এই নাম শুনছি!
মায়ের পিসেমশাই ভবানন্দ বেশ কয়েক বছর কলকাতার কাছাকাছি টিটাগড় শহরের কোনো কাগজের কারখানায় খাতা লেখার চাকরি করেছেন। সেই সুবাদে তিনি সমস্ত চেনা মাছের অচেনা সব নাম শিখে এসেছিলেন। যেমন, ভাংনা বা এলগন মাছকে বলতেন বাটা, মকা বা মলয়া মাছকে বলতেন মৌরলা – এমনি আরো কত কী! তেলমেনিকেও ভবানন্দ বলতেন, জলভাজা! এতো সহজ-সরল মানুষ, একটাও বাজে কথা বলতেন না, মজা করে কথা বললেও কাউকে নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ, কাউকে ছোট দেখানো, কারো মনে কষ্ট দিয়ে কথা বলা ছিল ওঁর স্বভাববিরুদ্ধ। সব মিলিয়ে ভবানন্দকে নিরুপমা বেশ শ্রদ্ধা করতেন। শুধু তিনি কেন, সমীহ করতেন বরদাকিশোরও। ছোটবোনের বরকে মানুষ এমনিতেই েস্নহ করে, ভালোবাসে। যে-মানুষটার সঙ্গে আদরের বোনটার বিয়ে হয়েছে সে যদি বোনকে কষ্ট না দেয়, ভালোবাসা দিয়ে ভরিয়ে রাখে, – সে তো জ্যেষ্ঠ শ্যালকের প্রিয়পাত্র হয়ে উঠবেই! কিন্তু ভবানন্দ তাঁর পরিচিত মহলে, আত্মীয়স্বজনের কাছে, ছাত্রছাত্রীদের কাছে একটি বিশেষ জায়গা দখল করে থাকেন তার সততা, সময়ানুবর্তিতা ও নিষ্ঠার জন্যে। হাসিমুখে কঠিন সব জাগতিক বিষয় তিনি খুব সহজেই বুঝিয়ে দিতে পারতেন। তাই ভবানন্দ নামের সঙ্গে ‘মাস্টার’ শব্দটা জুড়ে গেছে উপাধির মতো। গত কদিন ধরে জি বি হাসপাতালে এতো ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক-শিক্ষিকা ও অভিভাবক- অভিভাবিকা ওঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছে যে, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ হিমশিম খেয়েছে। অথচ কারো ওপর রাগ করার উপায় নেই। ওঁরা কেউ টুঁ শব্দটিও করেনি। যা বলার ফিসফিস করে বলেছে।
ফিসফিস করে না বলেও উপায় নেই। ভবানন্দ মাস্টারের গ্যাস্ট্রিক অপারেশন করে প্রবাদপ্রতিম শল্যচিকিৎসক এইচ এস রায়চৌধুরী আর রথীন দত্ত ওঁর ডিউডেনামে পেয়েছেন একমুঠি ঝকঝকে ধান। তিনি যেন একটা সাদা পায়রা কিংবা কোনো জালালি কবুতর, দূর আকাশে উড়ে উড়ে নানা ধানক্ষেত থেকে পাকা শস্য খেয়ে পেট ভরিয়েছেন!
পেটভরে ভাত খাওয়া বলতে আমাদের মা-মাসিরা যা বোঝেন, সেটা আমাদের পক্ষে বেশ কষ্টকর ব্যাপার! সেজন্যে আমি কৌশলে বড়মামার মেয়ে রুপা আর আমার বোন শ্বেতাকে পরিবেশনের দায়িত্ব চাপিয়ে খুব খুশি। ওরাও একটু বড় বড় ভাব দেখাতে পেরে বেশ মজা পেয়েছে।
সাংবাৎসরিক ছুটিতে এসেছি। আগরতলায় আমার প্রধান আকর্ষণ হলো অরুন্ধতিনগর। আমার জন্ম ভিএম হাসপাতালে। কিন্তু শশাঙ্ক ও সাগরের জন্ম ওই অরুন্ধতীনগরে, তেরো নম্বর রাস্তার পাশে আমার মামার বাড়িতে। আগে ওই টিলাটাকে সবাই বলত লালটাকুরের টিলা। মহারানী কাঞ্চনপ্রভার হয়ে ব্রিটিশ আদালতে কেস জিতে নরেন্দ্র উকিল এই টিলাটা রানীর কাছ থেকে উপহার পেয়েছিলেন। পরে তিনি নিজের গুরু লালঠাকুরকে ওই টিলা দান করেন। লালঠাকুর নিজে ও তাঁর বংশধররা ওই টিলা ভাগ-ভাগ করে বিক্রি করে। এখন সেখানে প্রায় ত্রিশটি পরিবারের বসবাস। সেখানে আমাদের মেজমামা ও ছোটমামা সপরিবারে থাকেন। বড়মামা থাকেন ছত্রিশগড় রাজ্যের দুর্গ শহরে। আগে তিনি ভিলাই ইস্পাত কারখানায় ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। পেনশন পেয়ে সেই দুর্গেই বাড়ি করেছেন। কেননা, বোনের বিয়ে হয়েছে ভিলাইয়ে, ভাইটাও ওখানেই চাকরির চেষ্টা করছে। বড়মামা আর আগরতলায় ফিরবেন না।
এবার পুজোয় বড়মামাও এসেছেন। তিন মামাই দা-রু-ণ। আমাদের মা ওদের একমাত্র দিদি। মামিমারও মাকে খুব শ্রদ্ধা ও সমীহ করেন। ওরা সবাই আমাদের খুব ভালোবাসেন। আমরা যাওয়ায় আজ তিন মামা-মামিমা ও সমস্ত ভাইবোন একসঙ্গে মেঝেতে গোল হয়ে বসে খেয়েছে। প্রত্যেকটা রান্না দারুণ হয়েছে। কাজেই কম-কম করে খেয়েও আইঢাই অবস্থা! অগত্যা অনেকদিন পর দুপুরে একপ্রস্থ ঘুম। ঘুম থেকে উঠে জমিয়ে আড্ডা। বর্তমানের সঙ্গে অবলীলায় মিলেমিশে যায় আমাদের ছোটবেলার গল্প, মামাদের ছোটবেলার গল্প, অতীতের গল্প।
আর তারপর অটোরিকশা করে বটতলা ফেরা। বটতলা থেকে দুর্গা চৌমুহনী ফেরার পথে আমি আর শ্বেতা এক রিকশায়। একাদশীর চাঁদ তখন আকাশটাকে আলো করে রেখেছে। পেঁজা তুলোর মতো কয়েক টুকরো মেঘ চাঁদের আশেপাশে উড়ে বেড়াচ্ছে। এরকমই একটির দিকে আঙুল দেখিয়ে শ্বেতা বলে, – ‘দ্যেখ বড়দা, ওই মেঘটা যেন দেবী চণ্ডী! কেমন এলোচুলে অসুরের দিকে ধাইয়া যাইতাছে।’ আমার মাথায় তখনো বিকেলের গল্পের রেশ। আমি ওই মেঘের দিকে তাকিয়ে অন্য ছবি দেখি। আমি যখন অষ্টম শ্রেণির ছাত্র, বাবা-মা আমাদের নিয়ে একবার প্লেনে করে কলকাতা ও সেখান থেকে ট্রেনে করে গয়া, বেনারস হয়ে ভিলাই গিয়েছিলেন। সঙ্গে ছিলেন মায়ের কনকপিসি। তখন ওঁর সমস্ত চুল কেঁপে গেছে। আমার মনে পড়ে ভিলাই থেকে ফেরার দিন গীতাঞ্জলি এক্সপ্রেস করে ফিরবো বলে ভিলাই স্টেশনে দাঁড়িয়েছিলাম। সেখানে ট্রেনটা মাত্র দু-মিনিটের জন্য দাঁড়ায়। বড়মামা, বাবা ও আমি ধরাধরি করে ট্রেনে সব মাল তুলতে পারার আগেই সেদিন ট্রেনটা ছেড়ে দিয়েছিল। ভাই দুটো ও বোনটিকে নিয়ে মা ও বড়মামা ট্রেনের কামরায় উঠে পড়লেও বাবা ও দিদি তখনো প্ল্যাটফর্মেই ছিলেন। আমি শেষ মুহূর্তে চলন্ত ট্রেনে উঠে পড়লেও বাবা কোনোভাবেই দিদাকে তুলতে পারেননি। ট্রেন তখন বেশ গতিতে চলতে শুরু করে। বড়মামা ছুটে গিয়ে পাশের খুপে চেন টেনে ঝুলে পড়েন। বড়মামার পায়ের চাপে ওই খুপের জানালার পাশে বসা এক ভদ্রলোকের স্যুটকেস উলটে পড়ায় ভদ্রলোক চেঁচিয়ে ঝগড়া শুরু করেন। কিন্তু চেন টেনে ধরায় ট্রেনটা প্ল্যাটফর্ম পেরিয়ে প্রায় দুশো মিটার দূরে গিয়ে থামে। তখন আমি ট্রেনের দরজায় দাঁড়িয়ে উঁকি দিয়ে দেখি, বাবা ও কনকদিদা রেললাইন ধরে ছুটে ছুটে আসছেন। এখন চাঁদের দিকে ধেয়ে যাওয়া মহিলাকৃতি মেঘটাও তেমনি যেন কনকদিদা, আতঙ্ক ও উত্তেজনায় চুলগুলি বাতাসে উড়ছে।
এ-কথা শ্বেতাকে বলতেই সে হঠাৎ হো-হো করে হেসে ওঠে। সে ভুলে যায় যে, আমরা রিকশায় আর দুপাশে চলমান শহর। এই পথে ব্লাডমাউথ, সংহতি ক্লাব কিংবা নবোদয় সংঘের মতো যেসব পুজো তাদের অভিনব মণ্ডপসজ্জা কিংবা আলোকসজ্জার কারণে গত চারদিন ধরে অনেক দর্শনার্থী টেনেছে, সেগুলিতে আজো যথেষ্ট ভিড়। এরা কেউ দ্বাদশী আবার কেউ পূর্ণিমায় প্রতিমা বিসর্জন করবে। এই ভিড় টিকিয়ে রাখার কৌশল নিয়ে কয়েক বছর আগে পুলিশ কর্তাদের খুব আপত্তি ছিল। পুর কর্তৃপক্ষও বারবার আপত্তি তোলে। একাদশীর পর আর প্রতিমা মণ্ডপে রাখা চলবে না, এরকম একটা আদেশও জারি হয়েছিল; কিন্তু তখনই রে-রে করে ঝাঁপিয়ে পড়ে পেপসি, কোকাকোলা, হিন্দুস্তান লিভার, রিলায়েন্স কিংবা পিয়ারলেসের মতো বড় বড় কোম্পানির প্রতিনিধিরা। নামে রাজধানী শহর হলেও আসলে আগরতলা যে লাখতিনেক মানুষের কোলাহলমুখর একটি বড় গ্রাম, সেটা এসব কোম্পানির ডেভেলপমেন্ট অফিসাররা ভালোই বোঝেন। শুধু আগরতলা গ্রাম হবে কেন, এক নামি কোম্পানির কর্তা তো সেদিন এক ঘরোয়া আড্ডায় কলকাতাকেই তিন কোটি মানুষের কল্লোলিনী গ্রাম বলেন। একটি বিশাল বাজার! পুজোর সময় গ্রামের মানুষের মতো ভিড় করে সবাই আলোকসজ্জা দেখতে বেরোয়, মণ্ডপসজ্জার পেছনেও কোটি কোটি টাকা খরচ হয়। পাড়ায়-পাড়ায় এখন থিম পুজো, আর এরকম মার্কেটিংয়ের সোনালি সুযোগ কোনো কোম্পানিই মিস করতে চায় না। কোনো বড় কোম্পানির মার্কেটিং স্টাফ এরকম পুজোর দিনগুলোতে ছুটি পান না। স্পন্সরশিপের মাধ্যমে মণ্ডপগুলিতে নিজেদের বিজ্ঞাপনে সয়লাব করে দিয়ে আবালবৃদ্ধবণিতার মস্তিষ্কে সেটিং করে নেওয়াতেই ওদের সাফল্য। তাই ‘জয় দুর্গা মাঈ কী’ কিংবা, মুম্বাইয়ে ‘গণপতি বাপ্পা মৌরিয়া!’ ওই এক্সিকিউটিভ মুম্বাইকেও বড়গ্রাম বলতে ছাড়েননি। আমরা সবাই এখন ঘরে বসে সহস্র চ্যানেলের মাধ্যমে দেশ তথা সমগ্র বিশ্বের সঙ্গে একাত্ম হই। কিন্তু গয়া কিংবা কাশীর পথে ট্রেনের দ্বিতীয় শ্রেণির কামরায় কত সহযাত্রী যে বাবাকে ‘ত্রিপুরা কী আসামে নাকি তামিলনাড়–তে?’ ধরনের প্রশ্ন করেছেন তার ইয়ত্তা নেই। এমনি কলকাতার লোকাল ট্রেনের সহযাত্রীরা আগরতলাকে বেলঘরিয়া ও সোদপুরের মাঝামাঝি এক বিখ্যাত জনপদ বলে ঠাউরেছেন। যারা এসব প্রশ্ন করেছেন তাদের মধ্যে অনেকেই অফিসবাবু কিংবা রেলের কর্মচারী। আমার মতো প্রান্তীয় রাজ্যের বাংলা মিডিয়ামে পড়া এক সাধারণ ছাত্র ওদের সাধারণজ্ঞানের সীমা দেখে তখন হেসে বাঁচি না।
বাড়ি ফেরার পর মা হেসে বলেন, ‘কী যে পাগলের মতন লেখছস, আমার পিসামশাইর নাম বুঝি ভবানন্দ?’
– ‘তাইলে কী নাম?’ আমি অবাক।
– মেঘধন!
নিজের অজান্তেই বলে উঠি, বাহ্! ভীষণ আনকমন নাম তো! কনকদিদার নামের লগেও মানাইছে। পাঞ্জাবি ভাষায় ‘কনক’ মানে অইলো পাকা গম! পাকা গমের সঙ্গে মেঘের সম্পর্ক ভালোবাসার!’
আমাকে চমকে দিয়ে সাগর গমগমে আওয়াজে বলে ওঠে, ‘দাদুর ডিউডেনামে কিন্তু গম আছিল না, সেখানে আছিল ঝকঝকে সোনালি ধান!’
আমি ভাবি, দিগন্তবিস্তৃত সোনালি ধানের ক্ষেত ছিল মেঘধনের। কলকলিয়া সীমান্তে বিশ দ্রোণ চাষের জমি। সীমান্তের ওপারে হরষপুরের পাশে বাগদিয়ায় ওদের বত্রিশ দ্রোণ জমি এপারের এক সম্ভ্রান্ত মুসলমান পরিবারের সঙ্গে পালটে এসেছেন মেঘধন ও তাঁর ভাই পূর্ণশশী। দুজনেই তারপর আগরতলা এমবিবি কলেজের ছাত্র। আর তাদের বাবা দ্বারিকানাথ ছিলেন নামকরা গুণীন। ছনের চালে আগুন লাগলে দ্বারিকানাথ যদি সেখানে পৌঁছে যেতেন, ওখানেই থেমে যেত। আর এক ইঞ্চিও এগোনোর সাহস পেতেন না অগ্নিদেবতা। প্রকৃতির সমস্ত উপাদানের ওপরই নাকি ওর নিয়ন্ত্রণ খাটত। এমনকি ওঁর জীবৎকালে যে-কারো গলায় কাঁটা লাগলে দ্বারিকানাথের নাম জপ করতে করতে হাত দিয়ে মালিশ করলে আপসে তা নেমে যেত। এমনকি ওঁর নাম শুনে সাপের উদ্ধৃত ফণা নিথর হয়ে পড়ত, বাঘ কাউকে না কামড়ে গা-ঘেঁষে ভুসমাইল্যা গন্ধ ছড়িয়ে চলে যেত, মধু সংগ্রহে কিংবা কাঠ কাটতে জঙ্গলে গিয়ে লোকে বিষাক্ত পোকামাকড়, ভীমরুল, বোলতা কিংবা মৌমাছিদের আক্রমণে মরণাপন্ন হয়ে পড়লেও দ্বারিকানাথের নাম করে নানা ভেষজ ঔষধি খাইয়ে দিলে সুস্থ হয়ে উঠত। এমনকি ইংরেজি বিষ বহনকারী মশাদের কামড়ে ম্যালেরিয়া বা ডেঙ্গুজ্বর হলেও ওঁর টোটকা ছিল অব্যর্থ। এছাড়া বাচ্চাদের আমাশয়, কৃমি, কামেলা ও মহিলাদের সূতিকা রোগে মানুষ ওঁর শরণাপন্ন হতেন। পূব পাকিস্তানের নানা গ্রাম থেকে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে গোপনে সীমান্ত পেরিয়ে ওঁর কাছে নানা রোগের উপশমের জন্যে আসত। অনেকে তো রোগীকে টুকরিতে বসিয়ে বা বাঁশে-মাচায় শুইয়ে পালকি বওয়ার মতো কাঁধে করে নিয়ে আসত।
সাগর হেসে বলে, তার মানে তিনি আয়ুর্বেদ চিকিৎসাডা ভালোই জানতেন, তার লগে ওই আগুন-কাঁটা-সাপ-বাঘের প্রকৃতিও! মাঝখানে মন্ত্রতন্ত্র অইল বুজরুকি!
আরতি বলেন, কিন্তু দুঃখের কথা অইল এই অলৌকিক গুণাবলিই অবশেষে তাঁর মৃত্যুর পরোক্ষ কারণ হইয়া দাঁড়াইছিল।
একদিন রাতে কলকলিয়া লক্ষ্মীপুর সীমান্তরক্ষী আউটপোস্টে মোতায়েন সাব-ইন্সপেক্টর ঋষিকেশ দেববর্মাকে পাকিস্তানি সৈন্যরা তুলে নিয়ে যায়। লোকশ্র“তি রয়েছে, ওই খান সেনারা নাকি সেদিন রোগী সেজে দ্বারিকানাথের টোটকা নিতে এসেছিল। ওদের সঙ্গে নাকি দুজন মহিলাও ছিল। ঋষিকেশ দেববর্মা ও তাঁর আউটপোস্টের সিপাইরা সেই রাতে খাসার চালের ভাত আর পাঁঠার মাংস খাওয়ার আগে আকণ্ঠ মদ গিলেছিল। ঋষিকেশবাবু নিজেও নেশায় বুঁদ হয়ে ছিলেন। সেজন্যেই খান সেনারা ওকে ওকে অনায়াসে তুলে নিতে পেরেছিল। পরদিন সবকিছু জানাজানি হয়ে যাওয়ার পরই গোলাগুলি শুরু হয়ে যায়। ভারতীয় সৈন্যরা কলকলিয়ার মানুষকে গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে বলে। ওরা কলকলিয়ার সমস্ত ধানের গোলা, গোবরের টালকে আড়াল হিসেবে ব্যবহার করে। দ্বারিকানাথের পরামর্শে মেঘধন ও পূর্ণশশী মহিলা ও শিশুদেরকে মাইলতিনেক দূরে হরিণাখলায় নিয়ে গিয়ে রেখে আসেন। হরিণাখলা স্কুলেই তখন চাকরি করতেন মেঘধন। স্কুলের কাছেই কানিখানেক জমি কিনে তিনি বছরখানেক আগে যে ছন-বাঁশের চালচালা বানিয়েছিলেন, সেখানেই তখন পুরো পরিবার পার হয়ে যান। শুধু গরু-বাছুর-ছাগল ও হাঁসগুলিকে পাহারা দেওয়ার জন্য থেকে যান দ্বারিকানাথ। তিনি গুণিন, তিনি তো ঈশ্বরের বরপুত্র!
কিন্তু ছেলেদের মন মানে না। গুণিনের বুকে গুলি লাগলে কি ঈশ্বর এসে বাঁচাবে? পরিবারের সবাইকে হরিণাখলায় রেখে ওরা ফিরে যান কলকলিয়া। বাবাকে অনেক বোঝানোর পর তিনিও জনস্বার্থে হরিণাখলা যেতে রাজি হলেন। কিন্তু তখন শুধু গুলি নয়, গোলা বিনিময়ও শুরু হয়েছে। সে যে কী অবস্থা! ওঁরাও ধানের গোলা কিংবা গোবরের টালে আড়াল নিতে নিতে এগোচ্ছিলেন। এর মধ্যেই একটা গুলি এসে ঢোকে মেঘধনের তলপেটে। সঙ্গে সঙ্গে কয়েকজন সীমান্তরক্ষী ছুটে এসে ওকে চ্যাংদোলা করে নিয়ে গিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে তোলে। অ্যাম্বুলেন্স ওঁকে নিয়ে ছোটে কামালঘাট। সেখানে ফৌজি ডাক্তার ওঁর তলপেট থেকে গুলি বের করে ড্রেসিং করে দেন। ইঞ্জেকশন ও খাওয়ার ওষুধ দেন। ততক্ষণে অনেক রক্ত বয়ে গেছে।
হরিণাখলা ফিরেই দ্বারিকানাথের রক্তআমাশয় শুরু হয়ে যায়। কলকলিয়াতেই প্রথম পেটে চিপা দিয়েছিল। ছেলের পেটে গুলি লাগার পর এসে বারবার মাঠে যেতে শুরু করেন। দাদার পেটে গুলি লাগায় পূর্ণশশীও তখন এতো আতাভোঁতা হয়ে পড়েছিলেন যে, ফৌজি ডাক্তারকে দেখিয়ে বাবার জন্যে কোনো ওষুধ নেওয়ার কথা মনে পড়েনি।
দ্বারিকানাথের সমস্ত ভেষজ ওষুধ তখন কলকলিয়ায়। ওখানে তখন ভয়ানক যুদ্ধ। দ্বারিকানাথের যত টোটকা জানা ছিল, সব প্রয়োগ করেও কোনো লাভ হয় না। তিনি তখন উঠোনেই পাটি পেতে শুয়ে আছেন। উঠে বসারও ক্ষমতা নেই। রক্তআমাশয়ে কাপড়-চোপড় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বলে পূর্ণশশী বারবার গামছা পালটে দিচ্ছিলেন। ধীরে ধীরে তিনি প্রায় অচৈতন্য হয়ে পড়েন। বাড়ির সবাই মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে।
পরদিন সকালে মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে জেলাশাসক এম রামমুনি কুমিল্লার জেলাশাসকের কাছে বার্তা পাঠিয়ে তাঁর সঙ্গে বৈঠক করেন আখাউড়া চেকপোস্টের কাছে নো-ম্যানস ল্যান্ডে টেবিল-চেয়ার পেতে। ফিরে এসে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করে পরদিন আবার আখাউড়া সীমান্তে… এভাবে দফায় দফায় বৈঠকের পর দ্বিতীয় সন্ধ্যায় কলকলিয়া সীমান্তে ‘সিজ ফায়ার’ ঘোষিত হয়। তার পরদিন ঋষিকেশবাবুকে আখাউড়া দিয়ে ফিরিয়ে দেয় ওরা। তার বদলে ন’জন পাকিস্তানি বন্দিকে ছাড়তে হয়। ঋষিকেশ বীরের সম্মান পান। আখাউড়া পোস্টের কাছে মেয়েরা তাঁর গলায় মালা পরিয়ে দেয়। মুখ্যমন্ত্রী শচীন্দ্রলাল সিংহ স্বয়ং আখাউড়ায় দাঁড়িয়ে বন্দি বীরকে বরণ করে আনেন। জনতা জয়জয়কার করতে থাকে। পরদিন জাগরণ পত্রিকায় বড় বড় হরফে এই বন্দি-বিনিময়ের কাহিনি ছাপা হয়। পাশাপাশি সাংবাদিক এও লেখেন যে, ‘মদ ও মাংস খাইয়া যে সীমান্তরক্ষীরা চেকপোস্টে ঘুমাইয়া থাকে, তাহাদের নেতাকে অপহরণ করিয়া বিদেশি শত্র“ ‘জাতীয় বীর’ বানাইয়া ফিরাইয়া দিলো। ধন্য মুখ্যমন্ত্রী, ধন্য জেলাশাসক, ধন্য নাগরিকবৃন্দ।’
সেই সকালেই দ্বারিকানাথের ইচ্ছামতো তাঁকে দড়ির স্ট্রেচারে করে কলকলিয়ায় নিয়ে যাওয়া হয়। যেমন করে দূর-দূরান্ত থেকে ওঁর কাছে রোগী আনা হতো। ঠিক একই পদ্ধতিতে মৃতপ্রায় দ্বারিকানাথকে তাঁর ভদ্রাসনে ফিরিয়ে নিয়ে গেলেও তিনি ছটফট করতে থাকেন। বহু যতœ করে তৈরি করা তাঁর ঔষধালয় ও ওষুধ তৈরির কারখানা তখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। তাঁর শোয়ার ঘরটি ছাড়া অন্য সমস্ত ঘর গোলার আঘাতে ধসে পড়েছে। চারদিকে শুধু বারুদের গন্ধ। এসব দেখে দুই ছেলে ঠিক করে যে, বাবাকে আবার কামালঘাটে মিলিটারি ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে; কিন্তু দ্বারিকানাথ এবার বেঁকে বসেন। বছরছয়েক আগে স্ত্রী বিয়োগ হওয়ার পর থেকেই তিনি সংসারের প্রতি ধীরে ধীরে বিরক্ত ও বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছেন; কিন্তু গত তিনদিনে তাঁর বিরক্তি চরমে পৌঁছেছে। ধ্বংসস্তূপের মধ্যে একটা ধারালো ব্লেড খুঁজে পেয়ে তিনি নিজের বাজু কেটে চামড়ার ভেতর থেকে একটা তাবিজ বের করেন। তারপর বলেন, – ‘যা তরা একটা ছাগল ধইরা লইয়া আয়!’
ওরা দুই ভাই আজীবন বাবার বাধ্য সন্তান। আসলে দ্বারিকানাথের ব্যক্তিত্বই এমন যে, ওঁর আদেশ মেনে নেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। এই শতবর্ষ পার করেও তাঁর পৌরুষসমান পরাক্রমী। ওঁরা অনেক খোঁজাখুঁজি করে ভাঙা গোয়ালঘরে একটা ছাগল পান। ওটাকে ধরে নিয়ে এলে দ্বারিকানাথ হাতের ইশারায় ওঁদেরকে ঘরের বাইরে বেরিয়ে যেতে বলেন। তারপর ছাগলটির কানে অস্ফুটস্বরে বিড়বিড় করে কিছু মন্ত্র পড়েন। বাইরে বেরিয়ে ওঁরা দেখেন, বাড়ির একমাত্র দাঁড়িয়ে থাকা ঘরটির মাটির দেয়ালে অজস্র বুলেটের ক্ষত। আশায় আশায় ওঁরা ভাবেন, ভাগ্যিস, এই ছাগলটা বেঁচে ছিল। আর সবই তো সৈন্যরা খেয়ে নিয়েছে। এদেশের সৈন্যরা খেয়েছে না পাকিস্তানি সৈন্যরা নিয়ে গেছে তা অবশ্য কেউ হলপ করে বলতে পারবে না।
কিন্তু দ্বারিকানাথ ছাগলের কানে কী বলছেন? দরজাই বা কেন বন্ধ করালেন? কতক্ষণ বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে? ওরা কিছুই বুঝতে পারেন না। মেঘধনের তলপেটে তখনো টনটনে ব্যথা। তিনি তাই বারান্দার মোটা বরাক বাঁশের খুঁটিতে হেলান দিয়ে ধাইরের ওপর বসে পড়েন।
একটু পরেই দ্বারকানাথের গোঙানি ও ছাগলের ম্যা-ম্যা ডাক শুনে দরজা খুলে পূর্ণশশী ছুটে যেতেই ছাগলটা তিন লাফে ওই ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। মেঘধন দেখেন, ছাগলটার চোখ দুটি অসম্ভব লাল।
ওঁরা ভেতরে ঢুকতেই দ্বারিকানাথ ইশারায় জল খেতে চান। না জানি কী মনে করে মেঘধন ঠাকুরের আসনের পাশ থেকে কলের জল-মেশানো গঙ্গাজলের বোতলটা নিয়ে আসেন।
দ্বারিকানাথ বলেন, – ‘বাবারা নিজেদের মইধ্যে সদ্ভাব রাখিছ। আমি ইচ্ছামৃত্যু যাইতাছি। ছা-গ-ল-ডা-রে মা-রি-ছ না! জ-ল …’
ওঁরা হতভম্ব! কিংকর্তব্যবিমূঢ়! মেঘধন এগিয়ে গিয়ে ওঁর মুখে একটু জল দিতেই তিনি ঢোঁক গিলে খান। তারপর ওদের দিকে সতৃষ্ণ-নয়নে সøেহে তাকান। মেঘধন ওঁর মুখে আরেকটু জল দিলে সেটা মুখেই থেকে যায়। কিছুটা গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে। পূর্ণশশী চিৎকার করে ডাকেন, – ‘বাবা-বাবা -!’
সাগর জিজ্ঞেস করে, এই ইচ্ছামৃত্যুর ব্যাপারটা আবকতালি মনে হয় না মা?
আরতি বলেন, আমারও বিশ্বাস হয় না; কিন্তু মহাভারতে ভীষ্মদেব ইচ্ছামৃত্যু বরণ করছিলেন, লোকনাথ ব্রহ্মাচারীও ইচ্ছামৃত্যু গেছিল শুনছি!
নিরুপমা জোরে কঁকিয়ে ডাকেন, – ‘শুনছেন, কই গো শুনছেন?’
বরদাকিশোর গোঁজ লেংটি দিয়ে ধুতি পরে সামনের বাগানে খুঁটি পুঁতে মুলিবাঁশের বেড়া লাগাচ্ছেন। আকাশে মেঘের ঘনঘটা। জোরে বাতাস বইছে। বরদাকিশোর বলেন, – ‘কী অইলো, সাপে ঝুঁক দিছে নিকি?’
নিরুপমা বলেন, – না, তাইজ্জব ব্যাপার!
‘তাইজ্জব’ শুনে বরদাকিশোর বেশি পাত্তা না দিয়ে বলেন, – ‘খাড়ও একটু, আইতাছি!
বরদাকিশোর সন্তান দলের সদস্য ছিলেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিখ্যাত উকিল রামকানাই দত্তের ভাবশিষ্য ছিলেন তিনি। ওঁর বাড়িতে ব্রাহ্মমন্দিরে থেকে আইএ পরীক্ষা দিয়েছেন। সিট পড়েছিল অন্নদা স্কুলে। যুক্তিগ্রাহ্য না-হলে কিছুই বিশ্বাস করেন না তিনি।
নিরুপমা কী ভেবে একরকম ছুটে গিয়ে কুয়োর পাড়ে রাখা বালতি থেকে শীতল জলের ঝাপটা মারেন চোখে-মুখে। আঁচল দিয়ে চোখ-মুখ ও ঘাড় মোছেন। তারপর ঘরে এসে শাড়ি-ব্লাউজ পালটে বেরিয়ে আসেন। একঝলক রোদ দেখা দিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই সূর্যটা আবার মেঘের আড়ালে চলে যায়।
বরদাকিশোর কাঁধের গামছা দিয়ে হাত মুছে পিতলের লোটা থেকে ঢকঢক করে জল খান। গলার বুটুলি প্রত্যেক ঢোঁকে ওঠানামা করে। নিরুপমার কাছে ওঁর আশঙ্কার কথা শুনে তিনি ভ্রু কুঁচকে তাকান। তারপর চোখ পিটপিট করে বলেন, – ‘ভালো কথা কইছো, মেঘধন হাইট্যা আইতে আইতে বাতাসে মিলাইয়া গেল দেইখ্যা তুমি অক্ষণই হেরে দেখতে যাইবা! হা-হা-হা’ নিরুপমা অবাক হয়ে বের হন, ‘আপনের না বইনের জামাই, অহন রসিকতা মাথায় আইয়ে কেমন? ছিঃ-ছিঃ! আমার তলপেডে মুচড়া দিতাছে,আমি যাই -’
তারপর স্বামীর অনুমতির অপেক্ষা না করেই তিনি দমকা বাতাসের মধ্যে পথে নেমে পড়েন। সম্ভবত জীবনে প্রথমবার তিনি এমনটি করেন। আর তারপর একরকম ছুটতে-ছুটতে বাপের বাড়ি পৌঁছে যান। ঠাকুরঘরে আগে থেকেই তুলসীপাতা দেওয়া নারায়ণের চরণামৃত রাখা ছিল একটা কাচের শিশিতে। আজ বিকেলে এই জল নিয়ে জিবি হাসপাতালে যাওয়ার কথা ছিল। মেঘধনের আজ সেলাই কাটলে ছুটি পাওয়ার কথা। গতকাল সন্ধ্যায় তিনি কনকের সামনে বলেছেন, ‘বউঠাইন, আপনের বাপের বাড়িত থেইক্যা শালগ্রামের চরণামৃত আইন্যেন, এতদিন বারো জাতের হাতে খাইছি, কালকা শুদ্ধ অইয়া আপনের বাড়িত গিয়া ভেটকির জলভাজা খামু। আপনের বাপের বাড়ির নারায়ণ বড় জাগ্রত দেবতা।’
মেঘধনের ওই কথা মনে রেখেই ওই কাচের শিশিটা ডান হাতে নিয়ে লালটাকুরের ‘পুষ্কনি’র পাশ দিয়ে নেমে গিয়ে আবার কালভার্টে উঠে হাতটাকে একদম বুকের কাছে ধরে জোরে-জোরে পা ফেলেন তিনি। জলের বোতলটাই যেন শালগ্রাম শিলা। বড় রাস্তায় পৌঁছেই দেখেন, একটি পাঁচ নম্বর বাস। নিরুপমা প্রমাদ গোনেন। চাইরপাড়া স্টপেজ ছেড়ে বাসটা এগিয়ে আসছে, তারপর থামবে সেই বেলতলিতে। এটা চলে গেলে আবার পনেরো মিনিট চাইরপাড়া স্টপে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে।
নিরুপমা লম্বা করে হাত তোলেন। আর নারায়ণের অসীম কৃপায় ড্রাইভারের মনে দয়ার সঞ্চার হয়। তিনি ওঁর কছে এসে গতি শ্লথ করেন। এক লহমার জন্যে দাঁড়াতেই নিরুপমা উঠে পড়েন। জোরে চেঁচিয়ে বলেন, – ‘বাঁইচ্যা থাইক্য বাবা, ঈশ্বর তুমরার মঙ্গল করবেন!’ তারপর একটা মহিলা আসনে বসে বেলতলি আসার আগেই আঁচলের গিঁট খুলে একটা আটআনা দিলে কন্ডাক্টর কুড়ি পয়সা ফেরত দেন। নিরুপমা বলেন, – ‘চাইরপাড়া থেইক্যা জিবি চাইর আনা নেওয়ার কথা! কন্ডাক্টর হেসে বলেন, – পাঁচপইসা বাড়ছে মাসিমা, যেইভাবে জিনিসপত্রের দাম বাড়তাছে, কিছুদিন পরে পাইত্রিশ অইব!’
নিরুপমা চিন্তান্বিত মুখে কুড়ি পয়সার মুদ্রাটি আঁচলের গিঁটে বাঁধেন। জানালা দিয়ে হু-হু বাতাস এসে বারবার ঘোমটা ফেলে দিতে চায়। নিরুপমা সেটা হতে দেন না। শাড়ির আঁচলটাকে বুকের কাছে শক্তভাবে ধরে রাখেন, যাতে ঘোমটা ঠিক থাকে। বাসটা তখন গোঁ-গোঁ শব্দ করে এমবি টিলার আপে উঠছে। সামনে ধুলোর কুণ্ডলী। লালচে ধুলো। নিরুপমা আঁচল চাপা দেন। এমবি টিলা থেকে বাসে ওঠেন মালবিকাদি। তিনি মহিলা সমিতির সেক্রেটারি। ওঁর কল্যাণেই নিরুপমা এই ছাব্বিশে জানুয়ারিতে চিলড্রেন্স পার্কে তকলি দিয়ে সুতো কাটার প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পেরেছিলেন। তবেই তো নির্দিষ্ট সময়ে প্রায় ১০১ মিটার সুতো কেটে তিনি মুখ্যমন্ত্রীর হাত থেকে একটা অম্বর চরকা আর একুশ টাকা পুরস্কার পেয়েছেন। এখন নিয়মিত রাতে সুতো কেটে তিনি দিনের বেলায় ভুতুরিয়ার তাঁতকলে জমা দিয়ে টাকা পান। তারপর সেখানেই সারাদিন তাঁত বুনে সন্ধে নাগাদ বাড়ি ফেরেন। বরদাকিশোরের কোবরেজির আয়ে টেনেটুনে সংসার চলে। কিন্তু ছেলেমেয়েগুলোকে লেখাপড়া শিখিয়ে নিজের পায়ে দাঁড় করানোর স্বপ্নই তাকে সারাদিনে প্রায় কুড়ি ঘণ্টা পরিশ্রম করায়।
নিরুপমা সসম্ভ্রমে ঘাড় নাড়তেই মালবিকাদি এগিয়ে এসে ওঁর পাশ বসেন। শিক্ষিত মহিলা। ওঁর পাশে বসায় নিরুপমার এত আনন্দ হয় যে, চোখে জল চলে আসে। তিনি বলেন, ‘কী গো সমীরের মা, কান্দ কেরে? কই যাও?’
নিরুপমা তাড়াতাড়ি আঁচল দিয়ে চোখ মুছে বলেন, – ‘আজকা নন্দাইয়ের জিবি থেইক্যা ছাড়া পাওনের কথা!’
– অ! ভালা কথা, তাইলে কান্দ কেরে? নিরুপমা হেসে বলেন, – কই, না তো!
কিছুক্ষণ চুপ থেকে মালবিকা জিজ্ঞেস করেন, সমীরের চিঠি পাও? নিরুপমা ঘাড় নেড়ে সায় দেন। মালবিকা আবার জিজ্ঞেস করেন, – ‘হে অহন কত পায়?’
নিরুপমা বলেন, – আমার পোড়াকপাল দিদি, আপনেরার আশীর্বাদে চাকরির পরীক্ষায় ফার্স্ট হইয়া পুরসভার চাকরি পাইছিল। মাস গেলে একশ দুই টাকা পঞ্চাশ পইসা কইর্যা পাইতো। অহন পুরসভার বলে আয় নাই; ছয়মাস পার না অইতেই ছাঁটাই অইল, হেই জিদেই পুতে আমার দেশ ছাড়ল। অহন যে টাকা স্টাইপেন্ড পায় তা দিয়া কুনুমতে কষ্টেসৃষ্টে নিজের খরচ চালায় -’
– ‘তাইলে তুমার সংসার চলে কেমনে, সুতা কাইট্যা আর তাঁর বুইন্যা, কর্তা কি যজমানি করে?’
– ‘বাব্বা, যজমানি করবো কেরে? কবিরাজের বংশ, মানী কবিরাজ, মাইয়া মাসে মাসে পঞ্চাশ টাকা কইর্যা দেয়, গড়ে দশ- বারো টাকার কবিরাজির আয় আর আমি আরো দশ-বারো টাকা রোজগার করি দেইখ্যা কোনোমতে -’
– অ! ভারতী অহন কই থাকে?
– ভারতী আবার কেডা?
– ‘তুমার মাইয়ার কথা কইতাছি!’ মালবিকা চ্যাটার্জি লাজুক হেসে বলেন। ভদ্রমহিলাকে লজ্জা পেতে দেখে নিরুপমাও যেন লজ্জা পেয়ে যান। তিনি বিনম্রভাবে বলেন, ‘দিদিমণি, আমার মাইয়ার নাম আরতি, তাইর অহন মনুবাজার হাসপাতালে পোস্টিং।’
মালবিকা চ্যাটার্জি কপালে চোখ তুলে বলেন, ‘খাইছে, মনুবাজার তো অঙ্গী মগের এলাকা!’
নিরুপমা শঙ্কিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করেন, – ‘অঙ্গী মগ আবার কেডা!’
মালবিকা বলেন, – ‘ডাকাইত, কম্যুনিস্ট!’
পাশের সিটে বসা এক ভদ্রলোক তখন বলেন, ‘যাদব ডাক্তার, নলিনী চক্রবর্তী আর অঙ্গী মগরে নাকি পুলিশে ধরছে!’
অন্য আরেকজন বলে, – ‘কে রে? যাদব ডাক্তার তো খুব ভালো মানুষ, অঙ্গী মগরে অবশ্য চিনি না।’
– ‘কে রে আবার, হেরা সব দশরথ দেববর্মার চ্যালা!’
– ‘আরে হ! রিফ্যুজি ক্যাম্পের মাইয়ারা নলিনী চক্রবর্তীর প্রোগ্রামে উদ্বোধনী সংগীত গাইছিলো দেইখ্যা দিদিমণির গালি খাইছে!’
– ‘শ্ শ্ শ! দিদিমণি সামনে বইয়া রইছে!’
-‘তাইলে কী অইলো, দিদিমণিও কম্যুনিস্টিদের ভালোবাসে না!’
– ‘কেমনে ভালোবাসবো, হেরা তো ডাকাইত, মাইনষে রে গুলি কইরা মাইরা লায়!’
– ‘ঠিকই কইছেন, খোয়াইয়ের কাছে বলে সুড়ঙ্গ কাইট্যা আন্ডারগ্রাউন্ড ঘাঁটি বানাইছে! বীরেন দত্ত, দশরথ হেরা একদিক দিয়ে ঢুকে আরেকদিক দিয়া বাইর অয়!’
– ‘হেরা অইল চীনের দালাল!’
ওইসব কথা শুনে নিরুপমার শঙ্কা আরো বাড়ে। এখন আরো জোরে বাতাস বইছে। কুঞ্জবনের দিক থেকে শুকনো পাতার বাতাসে উড়ে আসছে, পথের পাশে জমে থাকা ধুলো উড়ছে। নিরুপমা বাসের জানালাটা নামিয়ে দেন। শ্যামলীবাজার স্টপে মালবিকা চ্যাটার্জি নেমে যান। নিরুপমার কেমন অসহায় লাগে! ছেলেটা এতো দূরে থাকে! ওর তো সব খরচ সামলে ওখানে যাওয়ার ভাড়াই জোগাড় হচ্ছিল না! ভাগ্যিস, পুরসভারই এক কেরানি প্রিয়নাথ নন্দী মশাই সাত লাখ টাকা লটারি পেয়েছিলেন, সমীর তাঁর কাছে ধার চাইতে গেলে তিনি কালবিলম্ব না করে ওকে চল্লিশ টাকা দিয়েছিলেন। কলিকাতা অবধি প্লেনের ভাড়াই শুধু আশি টাকা, তারপর বাস-রেলগাড়ি চড়ে দুই রাত পরে ভান্দুয়া পৌঁছেছে ও। প্রথম মাসের স্টাইপেন্ড পেয়ে একসঙ্গে অনেক জিনিস কিনতে হয়। তৃতীয় মাস থেকে টাকা জমিয়ে সমীর ওই সাতলাখি নন্দীকে টাকাটা ফেরত দেওয়ার জন্যে মানিঅর্ডার পাঠায় ছ’মাস পরে। সমীরের বাবা সেই টাকা নিয়ে সাতলাখি নন্দীকে আশীর্বাদ করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু ভদ্রলোক টাকা ফিরিয়ে নেননি। তিনি বলেন, ‘সমীর বড় ভালো ছেলে, সে যে টাকাডা ফিরাইয়া দিতে চাইছে ইডাই অনেক, টাকাডা আপনেরা রাখেন, আমারে ত ঈশ্বর দিছে!’ বরদাকিশোর মনে মনে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেন, যাতে সাতলাখি সত্তরলাখি হন। যার মন এতো ভালো তাঁর সন্তানাদিও অবশ্যই ভালো মানুষ হবে। সেটাই হবে সত্তর লাখের প্রাপ্তি!
বাসটা জিবি বাজারে থামতেই সবাই উঠে দাঁড়ায়। পথে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি পড়তে শুরু করে। নিরুপমা ঘোমটা দিয়ে মাথা ঢেকে দ্রুত পা চালান। সোজা রাস্তা দিয়ে না গিয়ে পথের বাঁপাশে সিঁড়ি বেয়ে একটা টিলা চড়লে আউটডোরের গেটে পৌঁছানো যায়। নিরুপমা সে-পথেই পা বাড়ান। কিন্তু এতগুলো সিঁড়ি চড়ে উপরে উঠতে হাঁটু ও কোমরের ব্যথা বেড়ে যায়। পায়ের পেশিতে খিঁচ ধরে। আউটডোরের পাকা বাঁধানো বসার জায়গায় একটু জিরিয়ে নেন তিনি। পায়ের খিঁচটা যেন ছাড়তেই চায় না। যন্ত্রণায় কান্না পেয়ে যায় নিরুপমার। তখনই একজন অল্পবয়সী নার্স এসে বলে, ‘কানতাছেন কেরে মাসিমা?’
নিরুপমা ব্যাজার মুখে বলেন, – ‘দেখেন না পাও কেমন টান ধরছে, অ মা গো!’
তক্ষুনি ছুটে গিয়ে কোথা থেকে কী একটা মলম নিয়ে আসে নার্সটি। ওঁর সামনে উবু হয়ে বসে ধীরে ধীরে পায়ের পেটে মালিশ করে দেয়। পাঁচ-ছয় মিনিটের মধ্যেই গিঁটটা ছেড়ে যায়। নিরুপমা বলেন,
– ‘আপনের বাপ-মা নিশ্চয়ই খুব ভালোমানুষ মাইঅইন গো, আশীর্বাদ করি -’
মেয়েটি বলে, – ‘আমারে আপনে কইর্যা কইতাছেন কেরে মাসিমা? আমি আশা, আরতির লগে ট্রেনিং করছি, আপনেরার বাড়িতেও তো একবার গেছিলাম! আরতি ত অহন মনুবাজারে –
– ‘হ’! নিরুপমা উঠে দাঁড়ান। তারপর বলেন, ‘কিচ্ছু মনে কইর না মা, আসলে ডিউটির পোশাকে, মাথায় ক্যাপ পরা, চিনতে পারছি না।’ আশা বলে, ‘উঠলেন কেরে, আর একটু বন, ডাক্তার দেখাইয়া দিমু!’ নিরুপমা ম্লান হেসে বলেন, ‘না মা, আমি ডাক্তার দেখাইতে আইছি না, ননদের জামাই ভর্তি আছিল, অপারেশন অইছে, আজকে ছাড়া পাইবো, লইয়া যাইতে আইছি!’
– ‘ও সার্জিক্যাল ওয়ার্ড, তাহলে মাসিমা আমি আর যাইতাম না, অনেক দূরে ওয়ার্ড, আমার ডিউটি -’
– ‘না না, মা, অনেক করছো, বাঁইচ্যা থাইক্য, সুখী হইও!’
নিরুপমা হাসপাতালের লম্বা করিডোর দিয়ে হাঁটতে থাকেন। এ এখনো ওয়ার্ডে পৌঁছোতে মিনিট পাঁচেক লাগবে। আশার সঙ্গে কথা বলে বুকের ভেতরটা কেমন হু-হু করতে থাকে। নিজের মেয়ের কথা মনে পড়ে। সেও নিশ্চয়ই প্রতিদিন এরকম কত কত মানুষের কষ্ট ও যন্ত্রণাকে সারিয়ে তোলার চেষ্টা করছে! চোখ ঝাপসা হয়ে আসে নিরুপমার। তিনি জোরে পা চালান। কনক জানি দুচোখ মেলে ওঁর আসার অপেক্ষায়। ওদের কোনো সন্তানাদি নেই। মেঘধনের তলপেটে গুলি ঢোকায় তিনি নাকি প্রজনন ক্ষমতা হারিয়েছেন। কিন্তু তিনি কনককে ভীষণ ভালোবাসেন। কনক এতেই ভীষণ খুশি। আমাদের দেশের মেয়েরা স্বামীর ভালোবাসাকেই সবচাইতে বড় পাওনা বলে ভাবে। কতদিন ধরে মেয়েটা এখানে হত্যে দিয়ে পড়ে আছে! ও যেন সতী বেহুলা!
দোতলার সিঁড়ি বেয়ে সার্জিক্যাল ওয়ার্ডের সামনে যেতেই বুকটা ছ্যাৎ করে ওঠে। পূর্ণশশী দেয়ালে কপাল ঠুকছেন আর কনক সাদা চাদর দিয়ে আপাদমস্তক ঢাকা মানুষটার পাশে নিথর বসে। বড় বড় চোখ দুটি পাথরপ্রতিমার মতো। হঠাৎ বাতাস থেমে যায়। দমবন্ধ লাগে। জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে নিরুপমা কঁকিয়ে ওঠেন, ‘ও কনক, ইডা কী অইল গো -!’
তিনি কনককে দুহাতে ঝাঁকান। কনক পাগলের মতো ফ্যালফ্যাল তাকিয়ে বলে, – ‘নারায়ণের চরণামৃত আনছো? তাইনের মুখে দেও। মেনিমাছের জলভাজা রানছো? তাইনে খাইবো -!’
নিরুপমা পাথর হয়ে যান। কী করবেন তিনি? হাত-পা থরথর করে কাঁপতে থাকে। ডেটলের গন্ধ ছাপিয়ে হুড়মুড় করে তেলমেনির গন্ধ ভেসে আসে। হায় ঈশ্বর! চোখে অন্ধকার দেখেন তিনি। আর তারপরই গভীর কালো সুড়ঙ্গের অন্ধকারে কেমন অবলীলায় রান্নাকরা মাছগুলি ওঁর চারপাশে ভেসে বেড়াতে থাকে। কোন সে অতল থেকে বুদ্বুদের মতো শব্দ ভেসে আসে, – বউঠান, বউঠান!’
জলদগম্ভীর আওয়াজ কে ডাকে? এটা কার ডাক? দ্রুত সমস্ত অন্ধকার ছাপিয়ে একটি চেতনার আলোক ওকে হকচকিয়ে দেয়। কে যেন ওর চোখমুখে জলের ঝাপটা দেয়। নিরুপমা তাকিয়ে দেখেন পূর্ণশশী ডাকছেন। তিনি হাসপাতালের মেঝেতে শুয়ে। হুড়মুড়িয়ে উঠে বসেন। আর তারপরই তিনি শংকায় কাছে এগিয়ে আসা কনককে জড়িয়ে ধরে হাউহাউ করে কাঁদতে থাকেন।
নিরুপমা বেঁচে থাকতে আর কোনোদিন তেলমেনি, তেলকই বা তেলট্যাংরার জলভাজা রাঁধেননি।
আজ দুই প্রজন্ম পরে অতীতের গল্প থেকে সেই রেসিপি আমাদের রান্নাঘরে ঢুকেছে আবার। উৎসাহে ফুটছে শ্বেতা। মায়ের চোখে হে প্রশ্রয়। তেলমেনি কিংবা জলভাজার গন্ধে ম-ম করছে চারপাশ।