চোখ দুটো সুখপানিতে থইথই করছে মুমুতাজের। ভারতে ক্রীড়াজগতের প্রশিক্ষকদের সেরা সম্মান দ্রোণাচার্য পুরস্কারপ্রাপ্ত ডক্টর সাবির আলি খান মাত্র দেড় হাত দূরত্বে দাঁড়িয়ে আছেন! তাঁর তীক্ষè চোখ দুটো থেকে জ্যোতি বেরিয়ে এসে মুমুতাজের পায়ের ক্ষতে আরোগ্যের প্রলেপ লেপে দিয়েছিল। তেজি ঘোড়ার চিঁহির মতো তীব্র ও বিদ্যুতের তরবারির মতো ধারালো তাঁর কণ্ঠস্বর মুমুতাজের চেতনাকে সম্পূর্ণ নাড়িয়ে একমুহূর্তে ছুটিয়ে দিয়েছিল কমনওয়েলথের লাল ট্র্যাকে। কী দুরন্ত সেই দৌড়। খাট নড়ছিল। মা ভয় পেয়ে ঘুম থেকে ডেকে দিয়েছিল। স্বপ্নের দৌড়টা শেষ হয়নি।
মন্ত্রমুগ্ধের মতো স্থিরদৃষ্টিতে স্বপ্নের কোচ ডক্টর সাবির আলি খানের দিকে তাকিয়ে আছে মুমুতাজ। চারপাশে অ্যাথলেট। মাঠটা খুব বেশি বড় নয়। একদিকে একটা পচা ডোবা। কলমিলতা দুলছে। ডোবার পাশে একতলা ক্লাবঘর। ঘরের ভেতরে একদল ছেলেমেয়ে ঘেমে-নেয়ে জিম করছে। ডানদিকে দুটো নাছোড় যুবক হাইজ্যাম্পের বারের ওপর দিয়ে লাফিয়ে নিজেকে উত্তীর্ণ করার নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। অবাধ্য বারটি খুনসুটি করে বারবার গড়িয়ে পড়ছে মাটিতে। একটা মেয়ে হার্ডল্স টপকাতে থমকে দাঁড়িয়ে বাঁকা চোখে দেখছে মুমুতাজকে। ক্লাবের সামনে চেয়ার পেতে বসে আছেন কয়েকজন ক্লাব-সদস্য। চারদিকে মশার ভন্ভন্। যেন অলিম্পিকের গান। এই একচিলতে মাঠের সবুজ ঘাসের শিকড়ে তিন অলিম্পিয়ানের ঘাম, কষ্ট, রাগ, তেজ, ব্যথা, সংকল্প, আশা-নিরাশা আর আনন্দের লবণ জড়িয়ে আছে। এই মাটিতেই তাদের পদস্পর্শ।
সাবির আলি ধমকে উঠলেন, ‘সুপর্ণা! হার্ডল্স ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়লি কেন?’ সুপর্ণা ছুটে এলো, ‘স্যার, এই মেয়েটার কাছেই আমি রাজ্য মিটে হেরে গিয়েছিলাম।’
‘এই হার্ডলটা আর টপকাতে পারলি না?’
‘স্যার, ও আমার থেকে বয়সে অনেক বড়। সবাই বলেছে জাল বার্থ সার্টিফিকেট…’
‘চোপ্। চ্যালেঞ্জ নিতে পারিস না? নিজেকে ছোট ভাবলে কোনো দিনও বড় হতে পারবি না। যা, প্র্যাকটিসে মন দে।’
হতবাক হয়ে দুমড়ে-মুচড়ে নেতিয়ে পড়ে দাঁড়িয়ে আছে মুমুতাজ।
‘তোমার নাম তো মুমুতাজ পারভিন? জুনিয়র স্কুল ন্যাশনালে রুপো জিতেছো? ভালো, কিন্তু একজন অ্যাথলেট এভাবে বেঁকেবুঁকে, ভেঙেচুরে দাঁড়ায় না। স্ট্রেট হও।’ নিজেকে টানটান করার চেষ্টা করে মুমুতাজ, ‘স্যার, সোনা জিততে পারলাম না। আব্বাকে কথা দিয়েছিলাম কিন্তু শরীরটা…’
‘আগে মনকে মাঠে নামাও। শরীর পরে। মনই চালক। শরীর হলো গাড়ি। শরীরকে টেনে নিয়ে গন্তব্যে পৌঁছে দেবে মন। তবে হ্যাঁ, গাড়িটাকেও প্রস্তুত রাখাতে হবে। পথে তো অ্যাক্সিডেন্ট হয়ই। ভয় পেলে চলবে? লড়াই করতে হবে।’
মুমুতাজের হাতের বুড়ো আঙুল মুখে। আঙুলের নখ দাঁতের চাপে কটাস্। কাঁচাপাকা দাড়ি, টানটান শিরদাঁড়া নড়ে উঠল, ‘এই ছুড়ি, দাঁতে নখ কাটছিস কেন? এটা একটা অপসংহতির লক্ষণ। সুপর্ণাকে হারালেও তোকে পছন্দ হয়নি আমার।’
মানে ফেল! চোখের সুখপানি কান্নায় পরিণত হলো। দুহাতে চোখ ঢাকে মুমুতাজ। পড়ার টেবিলের পেছনে জীর্ণ দেয়ালজুড়ে সাবির আলির পেপার কাটিং।
তাঁর তৈরি অলিম্পিয়ানদের বিভিন্ন সময়ের দৌড়ের ছবি। ঘুম থেকে উঠে সাবির আলির ছবির সামনে দাঁড়িয়ে দোয়া-প্রার্থনা। রাতে শোয়ার আগে সালাম ঠুকে সুস্বপ্ন কামনা। ঘুম গাঢ় হলে – অন ইয়োর মার্ক, সেট, গান, ফায়ার। গতি। আরো গতি। পড়ার টেবিলের পাঠ্যবইয়ের হরফগুলোও ছুটতে শুরু করে। তখন খুবই ছোট, উঠোনে দৌড়তে দৌড়তে গাঁজা উঠে গিয়েছিল মুখে। ধান ঝাড়াই ফেলে ছুটে এসেছিল আব্বা – ‘পাগল হয়ে গেলি নাকি মুমু!’
‘আমি অলিম্পিকে দৌড় খেলতে যাব আব্বা। খবরের কাগজের সেই কোচ লোকটাই আমাকে দৌড় শেখাবে। স্বপ্নে বলেছে।’
‘অলিম্পিক! সে তো ফরেনে হয়! ওখানে যেতে কত পয়সা লাগে জানিস? জমি, ভিটেমাটি, সব বেচে দিয়েও হবে না। প্লেনে করে যেতে হয়। এসব বাজে চিন্তা কে ঢোকাল তোর মাথায়? ওসব চিন্তা বাদ দিয়ে বই পড়। আমরা গরিব…’
‘না। আমি ছবির সেই দিদিটার মতো অলিম্পিকে দৌড় খেলতে যাব।’
‘ফাজলামি! মুখে গাঁজা উঠছে। মাথা ঘুরে পড়ে গিয়ে জ্বর হবে। সক্কাল বেলা! যা, ঘরে গিয়ে বই পড়।’
ক্লান্তপায়ে ঘরে যায় মুমু। কদিন পরে মাটির পুতুলের পরিবর্তে ছোট্ট একটা মাটির ঘট কিনে আনে। পয়সা পেলেই সেই ঘটে। সেই থেকেই। ইচ্ছাশক্তি বড় শক্তি।
স্কুলের প্রতিযোগিতায় বরাবর প্রথম। লেখা নিয়ে কত মার, বকা, রাগ করে না-খেয়ে থাকা। বহু ঝড়ঝাপ্টা সামলে আজ এখানে, এই স্বপ্নপুরে সাবির আলির সামনে। স্কুলের গেমটিচার আব্বা-আম্মাকে বুঝিয়ে তাদের চোখেও স্বপ্ন রোপণ করে মুমুতাজকে নিয়ে এসেছেন কলকাতায়। কিন্তু স্বপ্নের আল্লা যে মুমুকে অপছন্দ করেছেন! হাউহাউ করে কেঁদে ফেলে মুমুতাজ। মাথায় হাত রাখেন দ্রোণাচার্য সাবির আলি খান, ‘বয়স বেশি নয়। হাইটটাও মোটামুটি ভালো। প্র্যাকটিস আর ইচ্ছাশক্তিকে ঠিকঠাক কাজে লাগাতে পারলেই হবে। মাটিকে সালাম জানিয়ে নেমে পড়ো।’
দুই
আব্বা-আম্মার শর্ত, পড়াশোনায় ফাঁকি মারলে চলবে না। সকাল থেকে টানা চার ঘণ্টা পড়াশোনা করে ক্লান্তি ঝেড়ে কলকাতায় যাওয়ার প্রস্তুতি। বনগাঁ থেকে ১২টা ৪৬ ডাউন শিয়ালদহ। সপ্তাহে দুদিন ‘সাই কমপ্লেক্স’ সল্টলেকে, দুদিন সোদপুর অ্যাথলেটিক্স ক্লাব মাঠে। দুঘণ্টা ভিড়েঠাসা ট্রেনে, তারপর ১৫ মিনিট বাসে। ট্রেনিং শেষে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ড্রেস বদলে জোর কদমে হাঁটা। হাঁটতে-হাঁটতেই কিছু ভিজে ছোলা, একটা কলা, দুটো রুটি। বাড়ি ফেরা সেই রাত ১০টায়। ট্রেন মিস মানেই বিপদ। মনে পড়লেই শিউরে ওঠে মুমুতাজ – আর মাত্র একটা স্টেশন। জানালার ধারে একা। ঘুমে চোখ ঢুলছে। দূরে দু-চারজন ঘুমোচ্ছে। সামনের সিটে হঠাৎ একটা ছেলে। চোখ লাল, ধূসর গেঞ্জি, কালো জিন্স। কোমর থেকে রিভলবার টেনে বের করে। পকেট থেকে গুলি বের করে…
মুমু চিৎকার করতে গিয়েও নিজেই নিজের মুখ চেপে ধরে। চোখ বন্ধ। ট্রেনের গতি মন্থর। ঝপাৎ শব্দ। স্টেশনে ঢোকার আগেই ট্রেন থেকে লাফ মেরে চলে যায় ছেলেটা। মুমুতাজের হৃদপিণ্ডের ধুক্পুক্ স্বাভাবিক হয়। টোন্টিং, প্রেমের প্রস্তাব। একদিন তো ভিড় বাসে কিটস ব্যাগে ব্লেড মেরে মানিপার্স তুলে নিল। এসব ব্যাপারে অভ্যস্ত হতে সময় লাগে। কষ্ট হয়। কষ্ট তো করতেই হবে মুমুতাজকে। একদিন সোদপুর ক্লাবের মাঠে স্যার বলেছিলেন, ‘লক্ষ্যবস্তু বা বিষয় ছাড়া আর কোনো আকর্ষণীয় বস্তু বা বিষয়ের হাতছানি হেলায় উপেক্ষা করতে হবে।’ চেষ্টা করে মুমু। স্যার বলেছিলেন, ‘ত্যাগ প্রয়োজন। অনেক ত্যাগের পর একটা কাক্সিক্ষত ফললাভ সম্ভব।’ চপ, কাটলেট, বিরিয়ানি, এগরোল, আলুকাবলি, ফুচকা কিছুই খায় না। হায়দরাবাদের সহিদুল চাচা একটা দামি চুড়িদার উপহার দিয়েছিলেন মুমুকে। মুমুর খুব আনন্দ হয়েছিল, বুকে জড়িয়ে ধরেছিল পোশাকটাকে কিন্তু স্যারের মুখ ভেসে উঠল যে! পোশাকটা আলমারিতেই পড়ে আছে। শতকষ্টের মধ্যেও সোদপুরের একফালি মাঠে ঢুকলেই মুমুর মন ভালো হয়ে যায়। কড়া শাসনের মধ্যেও স্যার যা চান ঠিকঠাক দিতে পারলে বাচ্চাদের মতো লাফিয়ে উঠে বলেন, ‘ভেরি গুড, ভেরি গুড।’ স্যারের স্ত্রী সাহানারা ম্যাডামের মমতা, আদর, অভিভাবকত্ব। তাঁদের একমাত্র সন্তান সোফিকদার মন্ত্র – মাঠই অ্যাথলেটদের মসজিদ বা মন্দির।’ স্যারের অনুপস্থিতিতে সোফিকদার ‘হম্ কোচ বন্গয়া’ ট্রেনিং। তবে সোফিকদা ফিগারগুলো এতো পারফেক্ট করে দেখাতে পারে, রপ্ত করতে সময় লাগে না। দারুণ দৌড়োয়। কিন্তু রাজ্য মিট পর্যন্ত। ন্যাশনালে যে কী হয়! শর্ট হাইটের জন্যই মার খায় বোধহয়।
পরিবারটা একদমই মাঠকেন্দ্রিক। ম্যাডাম একদিন বেঙ্গল কাঁপানো জাম্পার ছিলেন। জাতীয় স্তরেও কাঁপিয়ে দিতেন। এশিয়াড সিলেকশন পাওয়ার পর হঠাৎ পায়ে ভীষণ আঘাত। যাওয়া হলো না এশিয়া মিটে। ডাক্তার বললেন, আর কোনো দিনও জাম্প করতে পারবেন না। প্রতিযোগিতা থেকে সরে গেলেন ম্যাডাম, কিন্তু মাঠ থেকে সরলেন না। দুহাতে আগলে রাখতে লাগলেন দ্রোণাচার্য ডক্টর সাবির আলি খানের ছাত্রছাত্রীদের। ওই মাঠের পচা ডোবা, ধুলোবালি, সবুজঘাস, মশার ভন্ভন্, সবই মুমুতাজের পছন্দ। বর্তমানে একজন অলিম্পিয়ান রেবেনাস খাতুন ওই মাঠেই প্র্যাকটিস চালিয়ে যাচ্ছেন পরবর্তী অলিম্পিকে অংশ নেওয়ার তাগিদে। মশারা যখন ভন্ভন্ করতে করতে রেবেনাসকে কামড়ায় তখন মুমু তাঁর পাশে থাকে। মশা কামড়ে লালফুল হয়ে মুমুর শরীরে ফুটে থাকলেও মুমু তাড়ায় না। ভাবে, একটি মশাও যদি রেবেনাসদিকে কামড়ে তাড়া খেয়ে উঠে এসে তার শরীরে বসে হুল ফোটায়, তবে মশার হুলে লেগে থাকা এক অলিম্পিয়ানের রক্ত মুমুতাজের শরীরে প্রবেশ করবে। মুমুও ভবিষ্যৎ অলিম্পিয়ান হয়ে উঠবে।
তিন
অসম্ভব পরিশ্রম, দারিদ্র্য, বান্ধবীদের কটাক্ষ, বাঁকা দৃষ্টি – সব সহ্য করে নিজের লক্ষ্যে অবিচল ছিল মুমুতাজ। স্যারের প্রিয় ছাত্রী হয়ে উঠেছিল। ম্যাডাম বলেছিলেন, ‘একটা মেয়েকে বিট করতে পারলেই ইন্ডিয়াবেস্ট। এশিয়াডের দরজা খুলে যাবে তোর জন্য।’
কী যে হলো! কদিন ধরেই সুপর্ণা মানে সুপু, আর ওর মায়ের কুনজর, ক্রোধ, ক্ষোভ, পায়ে পা লাগিয়ে অযথা ঝগড়া, কটুকথা, অমঙ্গল কামনা।
কেমন যেন একটা ভয় তাড়া করে বেড়াতে লাগল মুমুতাজকে। মন অস্থির হয়ে উঠল। মিটের চারদিন আগে ভয়ানক জ্বর। কড়া ডোজের অ্যান্টিবায়োটিক। নিস্তেজ শরীর। হেরে গেল মুমু। পরাজয়ের গ্লানিতে মাটি চাপড়াতে লাগল। কেন যে তাকে এভাবে সাজা দিলো বসুন্ধরা! নিশ্চয়ই কোনো পাপ! এর জন্য সুপুই দায়ী। কেন সে ওই বাজে ছেলেটার সঙ্গে প্রেম করার জন্য অনুরোধ করত!
কেন বলত, ভালোবাসাকে আঘাত করতে নেই! অভিশাপ লাগে! প্লিজ একদিন অন্তত প্রাণ খুলে ওর সঙ্গে কথা বল মুমু।
স্যার বলেছিলেন, ‘ভালো পারফরমারদের মিটের আগে কখনোই জ্বর হয় না। ভালো পারফরমাররা মিটের আগেই মনকে পাঠিকে দেয় লক্ষ্যে। নিজের প্রতিটি মাসলের সঙ্গে কথা বলে। মাসলদের আদর করে, যতœ করে। শরীরকে বলে – সুস্থ থাকো। সোনার মেডেলটা তোমার জন্য অপেক্ষা করছে, সবার আগে দৌড়ে গিয়ে তাকে লুফে নিয়ে এসো।’
তারপর থেকে মুমু শুধুই কাঁদে, পারর্ফম ওঠে না। সুপু মাত করতে থাকে। সুপুর বিদ্রƒপ, ওর মায়ের জঘন্য হাসির কর্কশ শব্দ সারাক্ষণ কানের ভেতরে বাজতে থাকে মুমুর। সোফিকদাও উপেক্ষা করতে শুরু করে। সুপু সোদপুরের মেয়ে। বড়লোক। সোদপুর তাই সুপুর পক্ষে। মুমুতাজের মনে হতে থাকে স্যার, ম্যাডাম, পচা ডোবা, মশাদের ভন্ভন্, সবুজ ঘাসের গালিচা, সোনালি, বনি, জয়িতা, অলিম্পিয়ান রেবেনাসদি একে একে সবাই সুপুর পক্ষে। সুপুই মাঠের আগামী আইকন। চারদিকে ষড়যন্ত্রের ছায়া। ক্লাবের বার্ষিক স্পোর্টস। শেষ প্রতিযোগিতা ফোর-ইনটু-ফোর হান্ড্রেড মিটার রিলে। শেষ ল্যাপে, মুমু ও সুপুর মধ্যে লড়াই মুমুর আগেই ব্যাটন পেয়ে তীব্রগতিতে ছুটতে শুরু করে সুপু। মুমু ব্যাটন পাওয়ার জন্য চিৎকার করতে থাকে। ব্যাটন পেয়ে নিজেকে নিংড়ে দিতে থাকে। তিনশো মিটার শেষ, তখনো সুপু এগিয়ে। আরো গতি বাড়ায় মুমু। শেষ পঞ্চাশ মিটার। সুপুকে টপকে এগিয়ে যায় মুমু। দর্শকরা চিৎকার করতে থাকে, ‘টান সুপু, টান…।’
দর্শকদের ভেতর থেকে কে যেন কী একটা বাজে কথা বলে উঠল। চেনা কণ্ঠস্বর। সেই কর্কষহাসি। ফিনিশিংয়ের আগেই মাটিতে ছিটকে পড়ল মুমুতাজ। হ্যামস্ট্রিংয়ে টান। ব্যথায় কাতর। কেউ ছুটে এসে তাকে মাটি থেকে টেনে তুলল না। ব্যথা আরো গভীর হলো সুপুর কাছে পরাজয়ের আঘাতে।
ভালো পারফরমাররা কখনো দর্শকদের কথা শুনতে পায় না। শরীরের অঙ্গগুলোর সঙ্গে মনের সমন্বয় ছিল না মুমুর। বেশ কদিন বাদে স্যার মুমুর আব্বাকে ডেকে বললেন, ‘মুমু ট্র্যাক-আউট হয়ে যাচ্ছে। অন্যমনস্ক হয়ে গেছে। এটা বয়সের দোষ। ঠিকঠাক গাইড করুন, নইলে শিগগিরই মাঠ থেকে বিদায় নিতে হবে।’
কেঁপে উঠলেন মুমুতাজের আব্বা। মুমুকে স্যারের সামনে আসতে বললেন। মুমুর মাথা নিচু, বাক্রুদ্ধ। চোখে টলটলে পদ্মা গঙ্গা। স্যার বললেন, ‘কান্না কারো জয়ের রাস্তা হতে পারে না। তোমার সামান্য প্রশ্রয় না পেলে একটা ছেলে কেন তোমাকে বিব্রত করবে?’
মাঠ থেকে ছিটকে গেলেন মুমুতাজের আব্বা। দারিদ্র্য সহ্য হয় কিন্তু বদনাম সহ্য হয় না। মুমুও কাঁদতে কাঁদতে মাঠ ছেড়ে আব্বার পেছন পেছন। মিথ্যে বদনাম! স্টেশনে ট্রেন ঢুকতেই মনে হলো ট্রেনের ভেতরে ঢোকার থেকে নিচে গিয়ে শুয়ে পড়া অনেক ভালো। আব্বা হাত ধরে টেনে তুললেন ট্রেনের কামরায়। বাড়ি ফিরেই বমি। তারপর শান্ত। চুপ। অনশন। খবর পেয়ে হায়দরাবাদ থেকে সহিদুল চাচা ছুটে এলেন, ‘আমাদের মুমু মাঠে যাবে না হয় নাকি! বাংলাদেশের নানা-নানি বলেছে, মুমু ইন্ডিয়ার সেরা হবে।’
এলেন মুমুতাজের স্কুলের শিক্ষক ও তার সাংবাদিক বন্ধু। মুমু পাথর। সাংবাদিকবন্ধুটি ধাক্কা মেরে, ঘুসি মেরে, ফাটিয়ে, ভেঙে, পাথর মূর্তির ভেতর থেকে টেনে বের করলেন এক অন্য মুমুকে, ‘জয়ের জন্য প্রস্তুত হও। বড় জয়। আমি তোমার জয়ের খবর ছাপতে চাই। যা যা ঘটেছে, তা তা ঘটার কথা ছিল। ফ্লোরেন্স, গ্রিফিথ জোয়নার, য়ুগিন ম, জিউমি লি, মরিতা কোচ, পড়েছো এঁদের জীবনী? এদেশের ডাক্তারি বা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে গেলেও তো র্যাগিং হয়! হয় না? তোমার স্যার দ্রোণাচার্য, ভারতবর্ষের অ্যাথলেটদের সেরা কোচ। অত্যন্ত ভালো মানুষ। তিনি তোমাকে আন্তর্জাতিক ভিক্ট্রি-স্ট্যান্ডের শীর্ষে দেখতে চান। এই মুহূর্ত থেকেই আরো কঠিন লড়াইয়ের জন্য নিজে তৈরি করো। লড়াই মাঠের বাইরেও।’
মুমুর চোয়াল কঠিন। শরীর টানটান। চোখ স্থির। বলল, ‘মাঠে যাব, কিন্তু হারার জন্য নয়। জয় সুনিশ্চিত করার আগে কিছুতেই আমি মিটয়ে নামব না। স্যার, ম্যাডাম যত ইচ্ছা বকুক।’
মুমুর আব্বা বললেন, ‘অনেক হয়েছে। এখনো গায়ে বাংলাদেশের গন্ধ। গরিব মানুষ, অতবড় স্বপ্ন চোখে সয় না। মাঠের ছেলেমেয়েরা কেউ পড়াশোনা করে না। তুই তো পড়াশোনায় ভালো। বরং পড়াশোনায় চ্যালেঞ্জ নিয়ে নে।’
‘রেজাল্ট আমি ভালোই করব, তবে চ্যালেঞ্জটা মাঠেই নেব।’ মাথা উচু করে দাঁড়ায় মুমুতাজ।
‘শাবাশ মেয়ে, তোর মাথা উঁচুতে থাকলে বাবা-মায়ের মাথাও উঁচু হবে।’ ব্যাগের থেকে একটা বই বের করে টেবিলের ওপর রাখতে গিয়েও না রেখে মুমুর হাতে দিলেন সাংবাদিক। বইটির মলাটে একটা ছুটন্ত বাঘিনীর ছবি। মুমু চোখ বন্ধ করতেই চিতাটা যেন জীবন্ত হয়ে তার লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য চূড়ান্ত গতিতে একের পর এক হার্ডলস টপকে চলল।
চার
সময় কখনো কারো জন্য থমকে থাকেনি। মুমুতাজের জন্যও নয়। সে এখন সিনিয়র গ্র“পে। বাইরে অঝোর শ্রাবণ। জানালার পাশে একা। হৃদয় ভাসিয়ে ঝরঝরিয়ে পানি ঝরে চলেছে। মনটা হাউহাউ করে কাঁদছে। মাত্র সাতদিন বাকি। সীমান্ত-ছোঁয়া মফস্বল শহর বনগাঁ ছেড়ে সে চলে যাবে হায়দরাবাদে। স্পোর্টস অথরিটি অব ইন্ডিয়ার হোস্টেলে নয়, হায়দরাবাদের একটি হোস্টেলে থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়বে। বেসরকারি কলেজ। সহিদুল চাচা ভর্তি করে দিয়েছেন। বাইরে পানি গড়িয়ে চলেছে। মনের মধ্যে ভেসে যাচ্ছে কাগজের নৌকোর মতো টুকরো টুকরো ভিডিও ক্লিপিংস। গেঞ্জির পেছনে ইন্ডিয়া লেখা রেবেনাস খাতুন তাঁর জীবনের শেষ অলিম্পিক থেকে বঞ্চিত হয়ে চিরদিনের মতো গেঞ্জিটা খুলে ছুড়ে ফেলে দিলেন। স্পোর্টস অথরিটি অব ইন্ডিয়া কলকাতা শাখার চিফ কোচ দ্রোণাচার্য ডক্টর সাবির আলি খান বয়সের নিয়মে সাই থেকে বিদায় নিয়ে সজল চোখে বললেন, ‘আই অ্যাম স্টিল ইয়ুথ। এবার আমি মুক্তমনে অ্যাথলেট তৈরি করব। ক্লাবে হোস্টেল বানাবো।’ কী যে হলো! কাদের সঙ্গে কাদের গণ্ডগোল! প্রাণহীন ক্লাব। মনমরা, ছন্নছাড়া অ্যাথলেটরা। কেবল সুপুর হাতে মোবাইল, কানে ইয়ারপিস। হেসে, দুলে হাত নেড়ে বয়ফ্রেন্ডদের সঙ্গে কথা বলে মাঠের ভেতরে ট্র্যাকে দাঁড়িয়ে। ওকে কেউ কিছু বলে না। ভবিষ্যৎ অলিম্পিয়ান তো; সোফিকদা চলে গেল জার্মানি। পাতিয়ালা থেকে এনআইএস কোচিং ডিপ্লোমা নিয়ে স্পোর্টস সায়েন্সের ওপর ডক্টরেট করতেই জার্মানি গেছে। সোফিকদাই একমাত্র বলেছিল, ‘মুমু, তোমার ভেতরে অসাধারণ স্পিড লুকিয়ে আছে। টেনে বাইরে বের করতে পার না তুমি।’ এই নিয়ে কত মন্তব্য – ‘ভেতরে ভেতরে সোফিকের সঙ্গে মুমুর প্রেমের সম্পর্ক।’ ‘চাঁদ ধরার স্বপ্ন।’ ‘এই করতেই মাঠে এসেছে মেয়েটা।’ চাঁদ! শেষবার ক্লাবের বার্ষিক স্পোর্টসে রিলেকে আরও আকর্ষণীয় করার জন্য স্যার বলেছিলেন, ‘যে টিমটা প্রথম হবে সেই টিমকে আমি একটা রুপোর চাঁদ দেব।’ আইপিএলের ধাঁচে টিম তৈরি ও কেনার প্রক্রিয়া চলছে। অভিভাবক ও ক্লাব সদস্য-সদস্যারা অংশ নিয়েছেন। সুপুর টিমটাই অধিক মূল্যের। মুমু ব্যক্তিগত ইভেন্টে নামেনি। ঠিক করেছে রিলেতেও নামবে না। যে সোফিকদা ওকে সমর্থন করত সেই সোফিকদাই নব্বই ডিগ্রি ঘুরে বলল, ‘ফেডকাপে জেদ করে নামলে না। ক্লাবের স্পোর্টসেও নামবে না তুমি! বাড়ি যাও। মাধ্যমিকে স্টার মার্কস পেয়েছ। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হও। একটা আনন্দের দিনে…’ সবাই চুপ ম্যাডাম ধমকে উঠলেন, ‘সোফি! তুমি কেন ওর কাছে গিয়েছ? ওই মেয়েটা ফালতু, ও লড়তে জানে না।’
মুমুর চোয়াল কঠিন, ‘ম্যাডাম, আমি রিলেতে নামব।’
‘সমস্ত ব্যাপারে অশান্তি বাধানোই তোমার স্বভাব। নামো।’ শেষ ল্যাপের চারজন সুপর্ণা, মুমুতাজ, জয়িতা ও সোনালি। সব থেকে কম দামি টিম মুমুতাজদের। প্রথম ল্যাপে ছেলেরা, দ্বিতীয় ল্যাপে মেয়েরা, তৃতীয় ল্যাপে ছেলেরা, চতুর্থ ল্যাপে মেয়েরা। স্টার্ট রিলে। জয়িতাদের টিম এগিয়ে।
দ্বিতীয় ল্যাপে জয়িতাকে পেছনে ফেলে এগিয়ে গের সুপর্ণারা। তৃতীয় ল্যাপে তুমুল লড়াই ছেলেদের মধ্যে। তৃতীয় স্থানে মুমুতাজরা। চতুর্থ এবং শেষ চারশো মিটারে সবার আগে ব্যাটন পেয়ে গেল সুপু। জয়িতাও পেয়ে গেল। দূরত্ব বাড়ছে। মুমু চিৎকার করে উঠল, ‘ব্যাটন, ব্যাটন…’। ব্যাটন পেয়েই অদম্য টান, জয়িতাকে টপকে সুপুকে ধরার জন্য গতি বাড়াচ্ছে মুমু। শেষ একশ মিটার। প্রায় কুড়ি মিটার সামনে সুপু। দর্শকদের চিৎকার। তুমুল উত্তেজনা। সুপুর সাপোর্টারদের গলা চড়ছে। মুমু যেন হয়ে উঠছে সেই সাংবাদিকের দেওয়া বইয়ের দুরন্ত চিতা। সুপুকে টপকে ফিনিশিং পয়েন্টে পৌঁছে গেল মুমু। মাঠ স্তব্ধ। এ কী করে সম্ভব হলো! সব থেকে কম দামের টিম প্রথম! ম্যাডাম জড়িয়ে ধরলেন মুমুকে। স্যার বললেন, ‘ভেরি গুড।’ সুপর্ণার গলায় ক্ষিপ্ত কেউটে- ‘ফোঁ-ও-স্…’
ভালো-মন্দ সহ্য করে বেশ চলছিল প্র্যাকটিস। চোখের সামনে সেরাদের বেস্ট টাইমগুলো ঘড়ির পেন্ডুলামের মতো দুলছিল। চোখে স্বপ্ন ছুটছিল। স্যার ডাকলেন, ‘মুমু, আগামী মাসে রাঁচিতে ওপেন ন্যাশনাল। গত মিটে সিলেকশন হয়ে গেছে, তুমি নামোনি। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে বেঙ্গল থেকে তোমার নাম এনলিস্ট করতে পেরেছি। ফোর হ্যান্ড্রেড মিটার ¯িপ্রন্ট ও হার্ডলস। দুবেলা প্র্যাকটিস প্রয়োজন। এনডিওরেন্স আরো বাড়াতে হবে। এ-ব্যাপারে ম্যাডামের সঙ্গে কথা বলো। এই মিটের রেজাল্ট দেখেই এশিয়া মিটের সিলেকশন।’
‘স্যার, ফোর হ্যান্ড্রেডে য়ুগিন ম-এর রেকর্ড ৪৯.৮১ সেকেন্ড, মারিটা কোচ ৪৭.৬০ সেকেন্ড, মনোজিৎ কাউর ৫১.০৫ সেকেন্ড। বর্তমানে ফোর হ্যান্ড্রেডে ইন্ডিয়ার বেস্ট টাইম…’
‘চুপ। এসব আমি জানি।’
‘স্যার, ওই টাইম এখনো আমি ছুঁতে পারিনি। এই মিটে নামব না। আমি আর হারতে চাই না। এশিয়া মিটের অনেক দেরি, তার আগে আরো মিট আছে।’
‘আউট, আউট। এই মুহূর্তেই তুমি মাঠ ছেড়ে চলে যাও। তোমাকে আমি আর ট্রেনিং করাব না। প্রেম করতে এখানে এসেছ? ক্লাব থেকে তোমাকে তাড়িয়ে দিলাম। সুপু ঠিকই বলেছে, তুমি ধান্দাবাজ।’
সুপু! মুমু কিটস্ ব্যাগ নিয়ে মাঠ থেকে বেরিয়ে এলো। পেছনে পেছনে মৃত্যুর হাতছানি। বহুকষ্টে বাড়ি ফিরে এলো। আর কোনো দিনও মাঠে যাবে না সে। মাঠকে ঘৃণা করবে। বিকেলবেলায় রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াবে। এ যেন নেশা ছেড়ে দেওয়ার মতোই কষ্টকর। বিকেল হলেই শরীরের ভেতরে অস্বস্তি। কাঁপুনি। গা-বমি। ছটফট করে মুমুতাজ। লাফদড়ি নিতে উঠোনে চলে যায়। শরীরের মাসলগুলোর জোটবদ্ধ বিদ্রোহ সামাল দিতে পারে না সে। আজ সকাল থেকেই বৃষ্টি। বৃষ্টিতে প্র্যাকটিস বন্ধ হয়নি কখনো। মুমু রেইনকোট পরে চলে যেত। ক্লাবের ভেতরে জিম করত। বৃষ্টির ভেতরেই রাস্তায় দৌড়ত। মাথা নাড়ে মুমু। বৃষ্টির প্রতিটা ফোঁটা যেন স্যারের চোখের জল বলেই মনে হচ্ছে তার। ম্যাডামও কাঁদছেন। সাতদিন বাদেই হায়দরাবাদে। আব্বা বলেছেন, ‘ওখানে অন্য জগৎ, অন্য প্রাণ। অন্য দৌড়। সেই দৌড়ে তুই ঠিকই জিতবি। ক্রীড়াজগৎ তো তোকে শুধু কষ্টই দিয়ে গেছে!’ ভেতরটা খাঁ-খাঁ করে খালি হয়ে আসে মুমুর, ‘উহঃ! কেন যে বারবার স্যার-ম্যাডামের মুখটা ভেসে উঠছে! বাংলাদেশের নানা-নানি বলেছিল যে.. ‘ওদেরকে ভুলে যা। পড়াশোনা করে ভারতসেরা হ।’ মোবাইলে রিংটোন। স্ক্রিনে ম্যাডাম! সাহানারা ম্যাডাম!
‘হ্যাঁ, ম্যাডাম!’
‘অনেক সহ্য করেছি আমরা। বহুদিন পেরিয়ে গেছে। অনেক জেদ দেখিয়েছো। তোমার জন্য তোমার স্যার মাঠে যাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। তুমি চলে যাওয়ার পর থেকে তিনি একই কথা বলে চলেছেন – কেন যাব মাঠে? কোনো দ্রুতগামী ঘোড়ার খুরের শব্দ শুনতে পাই না। তুমি চলে এসো।’
কান্না-জড়ানো গলায়, ‘ম্যাডাম, সাতদিন বাদেই আমি হায়দরাবাদে চলে যাবো। ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্সে ভর্তি হয়েছি।’
ফোনটা কেটে দিলেন ম্যাডাম। গলায় দলা পাকিয়ে উঠছে কান্না।
পাঁচ
সাতদিন বাদে সোদপুরে স্যারের বাড়িতে মুমুতাজ। দ্রোণাচার্য মুমুর কাঁধে হাত রাখলেন, ‘কাঁধটা আরো বলিষ্ঠ করো। তোমার আব্বার কাছ থেকে তোমাকে কেন চেয়ে নিয়ে এলাম জানো?’
মুমু ঘরের দেয়ালে চোখ রাখে। দেশ-বিদেশের ক্রীড়াবিদদের ছবি। সামনে সোফিকদা। ছবি নয়, জীবন্ত। অনেক চেঞ্জ। মাথায় বিদেশি টুপি, হাতে বিদেশি স্টপওয়াচ। গলায় ঝুলছে দামি দুরবিন।
‘সোফি ফিরে এসেছে। কলকাতার সাইতে জয়েন করেছে। ওর একটা চিতাবাঘ দরকার। তোমার ওষুধের পর্ব শেষ হয়েছে। এবার আরোগ্য।’
‘কিন্তু সুপর্ণা! সুপু! ভবিষ্যতের অলিম্পিয়ান! সোদপুরের আইকন!’
‘সুপু কোনো দিনও চিতা ছিল না। ও পচে গেছে। ও কেমিক্যাল ড্রাগ নিয়েছে। ডোপ টেস্টে অ্যানাবলিক স্টেরয়েড ম্যাথানডিওনোন পজিটিভ। মুমু, ওই মেয়েটা তোমাকে যে জেদ, রাগ, তেজ, ধাক্কা দিয়েছে তার জন্য তুমিও ওর কাছে কৃতজ্ঞ থাকো। আমি ভারতবর্ষের কোচদের সেরা পুরস্কার দ্রোণাচার্য, কিন্তু ভারতবর্ষের খেলোয়াড়দের সেরা পুরস্কার অর্জুন – আমার কোনো অর্জুন নেই।’
‘কেন? সোমাদি তো অর্জুন পুরস্কার পেয়েছে!’
‘অলিম্পিক পদক তো জেতেনি! অর্থাৎ লক্ষ্যভেদ করতে পারেনি। লক্ষ্যভেদ করতে না পারলে অর্জুন হবে কী করে?’
সোফিক আলি খান মুমুতাজের কাছে এগিয়ে আসে, ‘আব্বা, তুমি কী মনে করো এ-মেয়েটাই একদিন অর্জুন হবে?’
‘মুমু, আমার অস্ত্রসমগ্র আমি সোফির হাতে তুলে দিয়েছি। আজ আমার সব থেকে প্রিয় ছাত্রী মুমুতাজ পারভিনকে আমি ওর হাতে তুলে দিলাম। তবে হ্যাঁ, তুমি ইচ্ছা করলে সোফির মধ্যেই খুঁজে পাবে আমাকে। চাইলেই পাবে।’ দ্রোণাচার্য সাবির আলি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। ম্যাডাম মুমুর গাল টিপে বললেন, ‘তুমিই সোফির তুরুপের তাস, জিতিয়ে দাও ওকে। তোমার আব্বাকে কথা দিয়ে এসেছি। কথা রেখো। আজ থেকে তুমি সম্পূর্ণ মাঠের মেয়ে।’ ম্যাডামও ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। খানিক নিস্তব্ধতা। চুপচাপ মনে রচিত হচ্ছে বাংলার অদূর ভবিষ্যৎ।
সোফিক আলি খানের চোখে চোখ রাখে মুমু, ‘স্যার’!
স্যার। শব্দে কেঁপে ওঠে সোফিক, ‘হুঁ!’
‘স্যার, আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি মাছের চোখ। লক্ষ্যভেদের জন্য আমি প্রস্তুত।’
‘তুমি’!
‘আমি অর্জুন।’
সোফিকের শিরদাঁড়া বেঁয়ে একটি গরমস্রোত মাথায় গিয়ে ধাক্কা মারে। সে মনে মনে বিড়বিড় করে বলতে থাকে – ‘টান মুমু, টান… ওই যে সোনার মেডেল।’
ছয়
ওহ্, কী সাংঘাতিক ষড়যন্ত্র! রাত ৯টা। খাবার খেতে খেতেই শরীরে অস্বস্তি। গা গুলিয়ে উঠছে। কাল ফোর হ্যান্ড্রেড মিটার ¯িপ্রন্ট ফাইনাল। আর খেতে ইচ্ছা করছে না। উঠে গিয়ে অ্যান্টাসিড খেয়ে শুয়ে পড়ে মুমু। পেটের ভেতরে চিনচিন করে ব্যথা। জল খেতে হবে, আরো জল। ওয়াক্, বমি। শরীর অসাড়। ফোন। ডাক্তার এলেন। রুমমেট এলেন। এতোক্ষণ কোথা ছিলেন রুমমেট! কর্মকর্তাদের ফিসফিস। ডাক্তার বললেন, ‘বমি নাহলে সর্বনাশ হতো। খাবারে বিষাক্ত কিছু পড়েছিল।’ ডাক্তারবাবু ওআরএস দিলেন, সঙ্গে কতগুলো ট্যাবলেট দিয়ে চলে গেলেন। বিষাক্ত কিছু পড়েনি, মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। ঘুম এলো না রাতে। মিটের আগে মাঠে পৌঁছে যতদূরসম্ভব মানসিক শক্তি বাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালাল সোফিক। পারল না মুমুতাজ। বুঝি অলিম্পিক সিলেকশন অধরাই থেকে গেল। খুবই আশাবাদী ছিল সোফিক।
কাল ফুল রেস্ট। পরশুদিন ফোর হ্যান্ড্রেড হার্ডলস ফাইনাল। কোচ সোফিক আলি খানের চোখে পানি। এই অসহায় মুহূর্তে আব্বাকেই স্মরণ করছে সে, দ্রোণাচার্য! দ্রোণাচার্য!
‘স্যার, আপনি কাঁদছেন! একটা সামান্য মেয়ের জন্য কাঁদছেন?’
‘অসহায় অর্জুনের জন্য আমার চোখে পানি আসছে। আমি আমার মধ্যে দ্রোণাচার্যকে প্রবেশ করতে অনুরোধ করছি।’
‘ইচ্ছা করলে তুমি সোফির মধ্যেই আমাকে খুঁজে পাবে।’ মনে পড়ে গেল মুমুর। মুমু মাথা তুলে টানটান হলো, ‘স্যার, আমি সম্পূর্ণ সুস্থ। আপনাকে কথা দিলাম, অলিম্পিকে আমি যাবই।’
কথা রাখল মুমু। সোফিক, কর্মকর্তা, ষড়যন্ত্রকারী, সবাইকে অবাক করে দুরন্তগতিতে হার্ডলগুলো টপকে অলিম্পিকের টাইমিংয়ে পৌঁছে গেল সে।
‘সোফিকদা, আমি অলিম্পিকে অংশ নিতে যাচ্ছি। অলিম্পিকের ট্র্যাকে দৌড়ে লক্ষ্যভেদ করে অর্জুন হয়ে ফিরে আসব।’
হাত তুলল সোফিক আলি। বাজপাখির মতো উড়ে গেল প্লেন। ওপর থেকে মুমুতাজ তাকিয়ে দেখল, সোফিকদা আস্ত একটা ভারতবর্ষ হয়ে হাত তুলে দাঁড়িয়ে আছে। সেই হাত স্পর্শ করছে বাংলাদেশের নানা-নানিকে।