রিকশা থেকে নামতে গিয়ে হুডের সাথে লাগানো আলগা লোহায় হাত খানিকটা কেটে গেছে আমার। হালকা রক্তও বেরুচ্ছে। মনে হচ্ছে দিনটাই খারাপ। বাসায়ও বাবা মার বকবকানির জন্য একদন্ড শান্তি পাওয়ার জো নেই। যেন বোঝা হয়ে গিয়েছি আমি। সামনেই মাস্টার্স ফাইনাল পরীক্ষা। হাতে আর ছয় মাসের মত সময় আছে। আই ই এল টি এস ও করে রেখেছি।
ইচ্ছা আছে স্কলারশিপ নিয়ে ক্যানাডা যাব পড়তে । কিন্তু তা না। বাবা মা গো ধরে বসে আছে বিয়ে করতে হবে। ছেলে যদিও আমার পছন্দেরই। কিন্তু তাতে কি! এখনই বিয়ে করতে হবে এমন কোনো কথা আছে! ক্যারিয়ার গোছাতে হবে, স্ট্যাব্লিশ হতে হবে। কিন্তু না, বাবা মার ইচ্ছে মাস্টার্স শেষ হতে না হতেই বিয়ে করতে হবে।আর শাহেদটাও আছে। কি একটা বেসরকারি চাকরি পেয়েই বিয়ের জন্য উঠে পরে লেগেছে। এত ব্রাইট একটা ছেলে। কই নিজেও স্কলারশিপের জন্য ট্রাই করবে, লাইফে শাইন করার চেষ্টা করবে তা বাদ দিয়ে উনি বিয়ে করতে চান। যত্তসব!
রাস্তার পাশে রুমালে হাতের কাটা অংশ চেপে ধরে শাহেদকে মনে মনে একশটা গালাগাল দিলাম। এরই মধ্যে কাধের উপর কারো হাতের উপস্থিতি টের পেয়ে পিছন ফিরে দেখি শাহেদ এসে দাড়িয়েছে। “এতক্ষনে আসার সময় হল তোমার? তুমি জানো আমি কত সময় ধরে এখানে দাড়িয়ে আছি?” আমার কথায় কোনো পাত্তা না দিয়ে চিন্তিত মুখে আমার হাতের দিকে তাকিয়ে রইল সে। “কি হয়েছে হাতে দেখি?” বলে আমার হাত ধরার চেষ্টা করতেই আমি ঝাড়া মেরে ওর হাত সরিয়ে দিলাম। “হইছে আর আদিখ্যেতা করতে হবেনা। কিছু হয়নাই আমার।” আমার এমন ব্যাবহারে কিছুটা চুপসে গিয়েছে সে। ঘার ঘুরিয়ে এদিক সেদিক দেখে নিয়ে বলল “চল কোথাও গিয়ে বসি। রাস্তার মাঝে এভাবে সিনক্রিয়েট করা ঠিক হচ্ছেনা।”
কিন্তু আমার রাগ যেন কিছুতেই কমছেনা। শাহেদকে দেখে আর কয়েক ডিগ্রি বেড়ে গিয়েছে। কি দরকার ছিল হাদারামের এখনি আমার বাসায় বিয়ের প্রস্তাব দেওয়ার? আমি কি পালিয়ে যাচ্ছি নাকি! আগে দুজনেই লাইফে সেটেল হই পড়ে নাহয় বিয়ে। শাহেদের চুপসে যাওয়া উপেক্ষা করে এবার কিছুটা নিচু স্বরে আমি বলতে লাগলাম “তোমার সাথে কোথাও যাবনা আমি। তুমি আমার জীবনটাকে নরক বানাইয়া ফেলছ। আমি বাসা থেকেও চলে যাব। কোনো একটা হোস্টেল এ থেকে পরীক্ষা দেব। তারপর স্কলারশিপ এর জন্য চেষ্টা করব।” কথাগুলো যে শুধু ধামকি দেওয়ার জন্যই বললাম তা নয়। আমি সত্যি সত্যিই ভেবেছি বাসা থেকে বেড় হয়ে আসব। একটা পার্ট টাইম জব করি আমি। অতএব নিজের খরচ চালানো কঠিন কিছু না।
শুধু শুধু বাবামায়ের আজাইরা প্যাচাল শুনতে নারাজ আমি। আমি একজন এডাল্ট। নিজের লাইফের ডিসিশন নেওয়ার পুরো অধিকার আছে আমার। কিন্তু বাবা মা যেন বোঝেই না। নিজেদের সেন্টিমেন্ট সবসময়ই আমার উপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। আমি কেন খেলাম না। কেন ঘুমালাম না। কার কার সাথে মিশলাম সব কিছুতেই তাদের হস্তক্ষেপ চাই। শাহেদটাও বড্ড ওভার পজেটিভ। নাহলে এত দ্রুত কেও বিয়ে করতে চায় নাকি? তাও এই একুশ শতকে! হাহ! শাহেদ কেবল শুনেই গেল এবার আর কিছু বলল না। ও এমনি তেও বেশ চুপচাপ। আমি যতই রাগ দেখাই না কেন ও আমার উপরে উল্টা রাগ করেনা। পরে যখন আমার রাগ নেমে যাবে তখন ঠান্ডা মাথায় বোঝাবে আমাকে। এবারও নিশ্চয়ই তাই হবে। ওর এমন নির্বিকার চেহারা দেখে আমিও আর কিছু বললাম না।শাহেদের দিকে তাকিয়ে দেখলাম ও একমনে কি যেন দেখছে।
ওর দৃষ্টি অনুসরন করে দেখলাম রাস্তার পাশে স্কুলের গেটের সামনে জনাবিশেক লোকের ছোটো খাটো একটা জটলা বেধে আছে। স্কুলের ছোটো ছোটো বাচ্চারা কৌতুহলী হয়ে কি যেন দেখছে। শাহেদ আর আমিও এগিয়ে গেলাম সেদিকে। দেখলাম জটলাটা একটা পাগলকে ঘিরে। পরণে তার শতচ্ছিন্ন ময়লা লুঙ্গী। সারাগায়ে ময়লা লেগে মলীন গায়ের রংকে আরো মলিন করে তুলেছে। বড় বড় চুল আর দাড়ির ঘন জংগলে বুদ্ধিদীপ্ত একজোড়া চোখ। কেমন খটকা লাগল আমার। এ নিশ্চয়ই পাগল নয়। পাগলদের চোখের দৃষ্টি এত উজ্জ্বল হয়না। পাগলদের চোখ হয় ঘোলাটে, দৃষ্টি হয় বিক্ষিপ্ত। ঢাকা শহরে পাগলের অভাব নেই। আর সচরাচর সব পাগলকে নিয়ে মানুষের জটলাও বাধেনা। যদিনা সে বিশেষ ধরণের পাগলামি করে।এও নিশ্চয়ই বিশেষ পাগল ।
আমার প্রশ্নের জবাব পেয়ে গেলাম মুহুর্তের মাঝেই। স্কুল গেটের নিচে পিচঢালা উচু জায়গায় হরেক রঙের চক দিয়ে ফুল, পাখি, ঘর এসব আকা। কতগুলো ত্রিকোণোমিতির অংকও করা আছে একপাশে। আর আছে অনেকগুলো ছন্দের মত লেখা। আমি ভীড় ডিঙিয়ে পড়তে চেষ্টা করলাম। কোটেশন দিয়ে আলাদা আলাদা করা প্রত্যেকটা লেখা। হাতের লেখা চমৎকার। প্রত্যেক্টা অক্ষর স্পষ্ট। এক জায়গায় লাল বা গোলাপি রঙের চক দিয়ে লেখা ” সর্বনাশা যমুনা” তার পাশেই বড় বড় দাত আর শিং ওয়ালা রাক্ষুসীর ছবি আকা। একেবারে বাম পাশের কিনারা ঘেষে সাদা রঙের চারটে লাইন জ্বল জ্বল করছে “জীবন ছিল, স্বপন ছিল। পরাণ বাচত হাইসা। সর্বনাশা গাঙএর জলে, সবই গেলো ভাইসা।”
এর পাশে একটা প্রাকৃতিক দৃশ্যের মত আকা। নদীর তীর ঘেষে কয়েকটি ঘর। আরো ছোটো ছোটো অনেক লেখা। যেমন ” কয়ডা ভাত দিবেন? অনেক ক্ষুধা লাগছে।” “পানি খাব” “জীবনের যুদ্ধে হেরে যাওয়া এক নাবিক আমি। লোকে বলে পাগল।” পাগলটা এখন বসে বসে ভাত খাচ্ছে। কে যেন এক প্লেট ভাত দিয়ে গিয়েছে। সাথে ডিম ভুনা আর মুরগীর মাংসের ঝোল।
কেমন মায়া করে খাচ্ছে লোকটা। আহারে নাজানি কতদিন না খাওয়া। সবাই তার দিকে তাকিয়ে আছে দেখে পাশের দেয়ালের দিকে মুখ করে বসলে লোকটা। তারপর খাওয়া শেষ করে সুন্দর করে প্লেট ধুয়ে গ্লাস আর প্লেট রেখে তার পাশে চক দিয়ে লিখল “ধন্যবাদ”। শাহেদ আমার কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল “লোকটা একদমই পাগল না বুঝলা। এর ভিতরে কিছু একটা লুকিয়ে রাখছে। ” এই ব্যাপারে শাহেদের সাথে আমি একদম একমত। স্কুল শুরু হওয়ায় জটলাটা নিমেষেই মিলিয়ে গেলো। কেবল দু একজন কৌতুহলী মানুষ এসে দাঁড়িয়ে রইল। শাহেদ এগিয়ে গিয়ে পাগলটার দিকে একশ টাকার একটা নোট বাড়িয়ে দিল। সে টাকাটা নিলোনা। কেবল শাহেদের দিয়ে তাকিয়ে হালকা করে হেসে বলল ” এহন আমার পেট ভরা। ” আমি বেশ অবাক হলাম তার আচরণে। সে কিছু একটা খুজল তার ময়লা কাপড়ের পুটলিতে। ছেড়াফাড়া কয়েকটা লুঙ্গী ওলট পালত করে আবার বেধে রাখল পুটলিতে।
একটা গামছা দিয়ে পিঠ আর মুখের ঘাম মুছে গামছা টা গলায় ঝুলিয়ে রাখল। তারপর লুঙ্গীর কোচ থেকে কয়েকটা কাগজের টুকরা বের করে পাশে রাখল। দেখতে কিছুটা চিঠির মত। সেগুলো নেড়ে চেড়ে ময়লা ঝেরে কাপড়ের পুটলিতে রেখে দিয়ে এবার আমার দিকে তাকিয়ে হাসল। বলল “আপনাগো দুইজনরে খুব সুন্দত মানাইছে।” তারপর শাহেদের দিকে তাকিয়ে পোটলার দিকে ইংগিত করে বলল “ওইগুলা আমার বৌয়ের চিঠি। পাগলি আছিল একখান। আমার কাছ থিকাই লেখা শিখছিল কোনোমতে। ফোনে কথা কইতে লজ্জা পাইত। তয় চিঠিতে যা মন চায় তাই লেইখা রাখত। ছেড়িডার শেষ চিঠি জানি কই হারাইয়া গ্যাছে। কত্ত খুজলাম। পাইলাম না।” আপনমনেই কিছুক্ষন বলে গেল। বলেই মুখে হাত চেপে গুঙিয়ে উঠল। আমি আর শাহেদ মুখ চাওয়া চাওয়ি করলাম। সে আবার কিছুক্ষন পর বলতে লাগল ” তিন মাসের পোয়াতি আছিল বৌডা আমার। তাও ফড়িঙএর নাগাল লাফালাফি করত। না করলেও শুনতনা।
ও যহন টুকটুকা লাল শাড়ি পইড়া চুলার পারে বসত আগুনের আলোয় কিযে সুন্দর দেহা যাইত। আমি খালি চাইয়া থাকতাম। সেবার যহন শহরে আইলাম আমি তহন ও আর আমার ছোডো বোইন বায়না ধরল ঢাকা দেখব। আমি ছোটোখাটো চাকরি করি। মেসে থাকি। ওগরে কই আইনা রাখতাম। মা ও কইল একবার ঘুরাইয়া নিয়া যাইতে। কিন্তু আমি বকা ঝকা কইরা থুইয়া আইলাম। ছোডো বইনডা আমার কেমুন কইরা কানল। তাও আমি থুইয়া আইলাম। বৌডায় সড়ক পর্যন্ত আইয়া খাড়াইয়া রইল। কোনো কথা কইলনা। সেই দেহাই শেষ দেহা।” শাহেদ আর আমি দুজনেই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম তার দিকে। শাহেদ জিজ্ঞেস করল “আপনি কি পড়াশোনা জানেন?” লোকটার চোখে মুখে বিষাদে ছেয়ে গেল। বলল ” হ ইন্টার পাশ করছিলাম আমি। শহরের একটা ইস্কুলে কেরানীর চাকরী করতাম।
শাহেদ ফের জিজ্ঞেস করল “আপনার বৌ, বোন, মা এখন কোথায়? আর আপনার ই বা এই অবস্থা কেন?” তার চোখের বিষণ্ণতা কয়েকগুন বেড়ে গেল যেন। কথা বলার সময় গলা জড়িয়ে আসতে লাগল । সে একটু কেশে গলা পরিষ্কার করে আবার বলতে শুরু করল “বাড়ি আমগো যমুনার পাশে। প্রতি বছরই বাড়িতে পানি উঠে। এইবারো বাড়িতে পানি উঠছিল দেইখা নৌকায় কইরা আমার ফুবুর বাড়ি যাইতে নিছিল ওরা সবাই। নদীর মাঝপথে যাইয়া নৌকা ডুইবা যায়।সর্বনাশী নদিয়ে আমার সব শেষ কইরা দিল। আমার মা, ছোডো বোইন, আমার বৌ আর অর পেডে আমার বাচ্চাডা। সব শেষ কইরা দিল। রুপা আমার বৌ। অর লাশটাও পাইনাই আমি। ” এবার হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল লোকটা। কান্নার শব্দে আরো কিছু কোউতুহোলী মানুষের ভীড় জমে গেছে। এবার যেন কথার খেই হারিয়ে ফেলল সে । আপন মনেই নানা কথা বিড়বিড় করতে লাগল। আমি আরেকটু মনোযোগী হওয়ার চেষ্টা করলাম।
শুনতে পেলাম “দোষটা আমারই। আমি যদি ওগোরে ঢাকায় নিয়া আসতাম আমার লগে তাইলে আর এমন হইতনা। কেও আর আমারে চিঠি লেখেনা। কেও আর ফোন দিয়া কয়না বাবা কবে আইবি বাড়িতে?কতদিন দেহিনা তরে। কেও আর চুড়ি আলতা কিনা দেওয়ার বায়না ধরেনা। আমার পথ চাইয়াও থাকেনারে কেও। আমি মরলাম না বাচলাম তাতে এহন আর কারো কিছু যায় আসেনা।আহারে আমি যদি ঝগড়া না করতাম ওগো সাথে। যদি আর দুইডাদিন বাড়িতে থাইকা আইতাম তাইলে আর এমন দিন দেহা লাগতনা। একসাথে মরতে তো পারতাম। ও আল্লাহ আমারে নিয়া যাও তুমি। নিয়া যাও।” তার আচরণ এখন হিস্টিরিয়া গ্রস্থের মত হয়ে গেছে। আর কি কি বলছে তা বোঝা যাচ্ছেনা। নিজের দুহাত দিয়ে কপাল চাপড়াছে ক্রমাগত। আর হাপুস হয়ে কাঁদছে। যে মানুষগুলো এতখন লোকটির কাছা কাছি দাঁড়িয়ে ছিল তারা এখন দূরে সরে যাচ্ছে। তার দুঃখ শুনে কেও আহারে আহারে করছে। কিন্তু এতে কি তার দুঃখ বিন্দু পরিমাণ ও কমছে?
আমার এখন একছুটে বাড়ি যেতে ইচ্ছে করছে। সকালেও মায়ের সাথে রাগ করে খেয়ে আসিনি। এখন ভীষণ ইচ্ছা করছে আম্মুর কাছে বসে তার হাতে ভাত খেতে। বাবার চেহারাটাও বড্ড মনে পড়তে লাগল। ছোটো ভাইটা ফোন ভেঙে ফেলেছে বলে খুব জোড়েই একটা থাপ্পর মেরেছিলাম ওকে। এখন আমার গালেই যেন সেই যন্ত্রণা হচ্ছে। শাহেদের দিকে তাকিয়ে দেখলাম ও আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। আমি শক্ত করে ওর হাত চেপে ধরলাম। বললাম “চল আমি বাসায় যাব এখন।
আর হ্যা সামনের মাসের মধ্যেই বিয়ে করে ফেলব আমরা। তারপর মিরপুরে তুমি যে ফ্ল্যাট কিনেছ সেখানে গিয়ে ছোট্ট সংসার পাতব। ” হতবিহ্বল শাহেদকে টানতে টানতে নিয়ে গিয়ে রিকশায় উঠে বসলাম। হোক না একটু অবাক ও। জীবনে ভালো থাকতে হলে মাঝে মাঝে একটু অবাক হতে হয়। লজিকের বাইরে গিয়ে চিন্তা করতে হয়। আর কাছের মানুষদের আকড়ে ধরতে হয়। হঠাৎ হঠাৎ তাদের জড়িয়ে ধরে চমকে দিতে হয়। আমাদের জীবনে তারা কতটা জায়গা জুড়ে আছে তা উপলব্ধি করতে হয়। বেলাফুরাবার আগেই।
গল্পের বিষয়:
গল্প