‘ মা, সবাই গোরুর গোশত দিয়ে ভাত খাবে। আমরা খাব না? ‘
‘ আমরাও তো খাব। ‘
‘ কখন? ‘
‘ তোর বাবা গোশত নিয়ে এলেই রান্না করব। ‘
‘ বাবা কি আজকেও কাজ করতে গেছে মা? ‘
এনায়েত মিয়া আজকেও কাজ করতে গেছে। ছোট্ট মেয়ে এতটুকু বুঝতে পেরেছে। নাহলে বাবা এখন বাড়িতেই থাকত। টাকার অভাবে সোনিয়ার বাবা কোনো বছরেই কুরবানি দিতে পারেন না। এবারও পারেননি। মেয়ে বড়ো হয়েছে। এখন বুঝতে পারে কিছু কিছু। মেয়ের সামনে পরাজিত মুখ নিয়ে বসে থাকা একজন বাবার কাছে খুবই কষ্টকর। সোনিয়ার মা জবাব দিল, না তো। কাজ করতে যায়নি। সোনিয়া মুখটা কালো করে বলল, মা, আমাদের কি টাকা নাই? সোনিয়ার মা কী জবাব দেবে বুঝতে পারছে না। ‘ আছে তো। টাকা না থাকলে তোর জন্য নতুন জামা কীভাবে এনেছে তোর বাবা? ‘
সোনিয়া দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল, মা, আমি জানি আমাদের এত টাকা নাই। এজন্য বাবা সকাল থেকে বাড়ির বাইরে আছে। বাবাকে ফোন করে বাড়িতে আসতে বলো। যাদের সামর্থ্য নাই। তাঁদেরকে কুরবানি দিতে মানা করেছেন আল্লাহ। কুরবানি না দিতে পারাটা কোনো অপরাধ না। রুনা বেগম স্তব্ধ হয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন। এত শক্ত শক্ত কথা মেয়েটা জানল কীভাবে? রুনা বেগম তবু বৃথা চেষ্টা করে গেল। ‘ আমরা কুরবানি দিয়েছি তো! তোর বাবা কিছুক্ষণের মধ্যেই গোশত নিয়ে আসবে দেখিস। ‘ সোনিয়া মায়ের অভিনয় বুঝতে পেরে, মাকে আর লজ্জায় ফেলতে চাইল না। সে বলল, মা আমার ঘুম পেয়েছে। বাবা এলে ডাক দিয়ো। সোনিয়ার মা যেন হাফ ছেড়ে বাঁচল। যতক্ষণ মেয়ে ঘুমাবে। ততক্ষণ পৃথিবীর বুকে একটা সুখী প্রাণী হিসেবে নিজেকে ভাববে।
সোনিয়া কাঁথা টেনে শুয়ে পড়ল। চোখের পানি যেন মা না দেখে এজন্যই কাঁথা দিয়ে মুখ ঢাকা। রুনা বেগম জিজ্ঞেস করেছিল, এত সকালে কাঁথা গায়ে দিলি কেন? সোনিয়া জবাব দিল, মা জ্বর জ্বর লাগছে, এজন্য। সোনিয়া মনে মনে বলছে, আল্লাহ কোনোভাবে বাবাকে কমপক্ষে অতটুকু টাকা দাও। যেন পরেরবার কুরবানির দিতে পারে। কমপক্ষে ঈদের দিনটা বাবার সাথে কাটাতে দাও। মহান আল্লাহ পাক তা শুনেননি। পরেরবারও একই কাহিনী। সেবারও সোনিয়া ভাব করল জ্বর এসেছে। সারাদিন শুয়ে থেকেছে। মায়ের লেপন মুখটা দেখতে ভালো লাগে না। ঈদের দিন এই অভিনয়টা সোনিয়া বহু বছর ধরে করে এসেছে। এক যুগের চেয়েও বেশি সময় ধরে। সে এখন যথেষ্ট বড়ো হয়েছে। কলেজ জীবনের শুরু থেকেই টিউশনি করেছে। একশ দুইশ করে টাকা জমিয়েছে।
লেখাপড়ার পাশাপাশি অনেক কাজ করেছে। বছরের একটা দিন তাঁর খুব অসহায় মনে হয়। জীবনটা কত ছোট তা উপলব্ধি হয়। তারপর কোনো এক ঈদে সোনিয়াদের কুরবানি দেয়ার সামর্থ্য হয়েছে। হাতভর্তি কিছু টাকা বাবার হাতে সে দিয়েছে। লোকটা ছোটোখাটো একটা গোরু কিনে আনলো। সকালে হলেই গোরুটাকে জবাই করা হবে। জীবনের প্রথম কুরবানি দিতে পারার আনন্দে সে রাতে এনায়েত মিয়া ঘুমুতে পারলেন না। কিন্তু সকালে উঠে দেখলেন গোয়ালঘরে গোরু নেই! গোরুর দড়ি কাটা! চুরি হয়ে গেছে! এই দুঃখ তিনি সহ্য করতে পারলেন না। তখনই হার্টফেল করলেন! হাসপাতালে নিয়ে যাবার আগেই মারা গেলেন। কুরবানি ঈদের দিন বাবার সাথে বসে এক প্লেট গোরুর গোশত দিয়ে ভাত খাওয়ার স্বপ্নটা আর পূরণই হলো না সোনিয়ার।
সোনিয়া আরও বড়ো হয়েছে। মেডিসিন বিশেষজ্ঞ হিসেবে স্কয়ার গ্রুপে জয়েন করেছে। তাঁর বিয়ে হয়েছে বড়ো ঘরে। কিন্তু সে বাবা মারা যাবার পর থেকে আর গোরুর গোশত খায় না। শ্বশুরবাড়ির লোকেরা জিজ্ঞেস করে তাঁদের কোনো কথায় তাঁর রাগ আছে কি না। এলার্জি আছে বলে সবাইকে বুঝিয়ে দেয়। আজও তাঁর ইচ্ছে করে। জ্বর এসেছে বলে কাঁথা টেনে শুয়ে পড়তে। মুখ ঢেকে চোখের জল ফেলতে। কিন্তু তা আর পারে না। শ্বশুরবাড়ির লোকজনের সাথে থাকতে হয়। স্বামীর বেরসিক কৌতুকে হো হো করে হাসতে হয়। তাঁর জন্য আরও কয়েকটা মানুষের ঈদের দিনটা নষ্ট হোক। তা সে চায় না।
গল্পের বিষয়:
গল্প