প্রাক্তন স্বামীকে রক্ত দেওয়ার পর শ্বাশুড়ি মাকে পাশ কাটিয়ে চলে যাবে ভেবেছিল অদ্রিজা, কিন্ উনি পিছন থেকে এসে মুখোমুখি হয়ে বললেন, কেমন আছ অদ্রিজা?? ভালো,আপনি এখানে?? হ্যা, সায়নের এক্সিডেন্টের খবর শুনে চলে এলাম।ফোনটা মনে হয় তুমি করেছিলে তাইনা? হ্যা,এটা আমার দায়িত্ব বলে করেছি, বলে চলে আসছিল অদ্রিজা।
হঠাৎ উনি বললেন,যে ছেলে একটা সময় তোমার রক্তচোষে খেয়েছে,সন্দেহের জেরে শারীরিক টর্চার করতে করতে করতে শরীর থেকে রক্ত বের করেছে আজ তুমি তার প্রাণ বাচিয়ে মহাত্মার প্রমাণ দিলে মা। অদ্রিজা মনে মনে হাসলো।কি অদ্ভুত আচরণ! একটা সময় ছোটলোক বাদে নাম ধরেও ডাকতো না আর আজ সোজা মা বলে ডাকছে।অদ্রিজা বলল, এখানে মহৎ হওয়ার কোন কথা আসেনা।আমরা হঠাৎ রক্ত জোগাড় করতে না পারলে যে কাউকে দিই। খুব ভালো ,তোমার সাথে একটু কথা বলা যাবে?,বলল অদ্রিজার শ্বাশুড়ি মা। অবাক হয়ে গেল অদ্রিজা তার সাথে আবার কি কথা ভেবে কৌতূহলও হল। হ্যাঁ চলো,আমারও কোনও কাজ নেই এখন,বলে দুজন হাটা শুরু করল। একটা ফাঁকা জায়গা দেখে বসল দুজনে তুমি আর বিয়ে করোনি?,প্রথম কথা বলল শ্বাশুড়ি মা। না। কেন?? একবার আপনার আর আপনার ছেলের কাছে যে শিক্ষা পেয়েছি,আর সাহস হয়নি,বলল অদ্রিজা।
— আমরা খারাপ মানেই যে সবাই হবে তা নাও হতে পারে।তার মানে স্বীকার করছেন আপনারা খারাপ। মনে মনে হাসল অদ্রিজা।
এক বছর আগে সায়নের সাথে ডিভোর্স হয়েছে অদ্রিজার।দুজনেই দেখাশোনা করেই বিয়ে হয়েছিল,মা – ছেলের ছোট সংসার,ভদ্র,শিক্ ষিত,আধুনিক পরিবার। অদ্রিজা নার্স,তাকে নাইট ডিউটি করতে হত।ফিরতে দেরি হত,কাজের চাপও প্রচুর।বিয়ের পর থেকেই সায়নের এই নিয়ে সমস্যা,আর তাতে সমানে ইন্ধন জুগিয়ে গেছে তার মা।ঘরের বৌ, তার বাড়ি ফেরার কোনো সময় নেই,পাড়ার লোকে নানা কথা বলছে।ঘরের সব কাজ আমাকেই করতে হয় ছেলের বৌ এসে কোনো সুরাহা হলো না।কোথায় রান্নাঘর থেকে রেহাই পাবো উল্টো নিজেকে রেঁধে ছেলের বউকে খাওয়াতে হয়।এই নিয়ে শাশুড়িমায়ের অভিযোগের শেষ ছিল না।সায়ন বলতো,যেসব নার্স নাইটে হাসপাতালে ডিউটিতে থাকে ওদের বাজে স্বভাবের কথা কে না জানে।এরকম নানান মিথ্যা সন্দেহের অপবাদে গায়ে হাত তুলতে ভুল করতোনা সে।ইচ্ছা করে অদ্রিজা কাজে বেরোনোর সময় শ্বাশুড়ি মাও ঘরের কোন কাজ করতে বলতেন,কত দিন এমনও হয়েছে যে কাজ শেষ করে কিছু না খেয়েই বেরিয়ে গেছে অদ্রিজা।তাও সব দোষ পড়তো নিজেরি গায়ে।
প্রথম দিকে এসব অত্যচার অদ্রিজা অনেক কষ্টে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু যখন বিয়ে টিকিয়ে রাখার শর্ত হিসাবে চাকরি ছাড়তে বলল সায়ন আর তখন মানিয়ে নেয়নি অদ্রিজা,একবছরের মাথায় তাদের ডিভোর্স হয়ে গেছিল।সে সময় মা-বাবা সবসময় তার পাশে থেকেছে।যে সব মানুষ নার্সদের অসম্মান আর সংকীর্ণ দৃষ্টিতে দেখে তাদের জন্য নিজের ভালোলাগাটুকু ত্যাগ করতে পারে নি সে।নার্স হওয়ার পরেই সে কেবলই জানে,একজন মুমূর্ষু রোগী যখন তার সেবা পেয়ে ভালো হয়ে ওঠে কেমন আনন্দ লাগে।এরকম অসময়ে কাউকে রক্তদান করে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করার আনন্দ টা কেবল সেই বুঝে।রোগী যখন প্রাণ পায় তখন সে আনন্দ দুফোঁটা অশ্রু ঝলে প্রকাশ করে। তাছাড়া এখন মা-বাবাকে নিয়ে অদ্রিজা খুব ভালো আছে আর বিয়ে করার কথা তার মাথায় আনেনা।
সায়নের মায়ের গলা শুনে সম্বিত ফিরে পেল অদ্রিজা আমি কখনও চাইনি তোমাদের বিয়েটা ভেঙে যাক।
–আপনি যদি এই নিয়ে কথা বলার জন্য আমাকে ডেকে বসান তাহলে আমি যাচ্ছি বলে অদ্রিজা ওঠে দাঁড়াতে চাইলো। সায়নের মা হাত ধরে বললেন,
–না না, উঠো না অদ্রিজা, আমাকে বলতে দাও। কে জানে আর কোনদিন সুযোগ পাব কিনা।
অদ্রিজা আবার বসল আমি কিন্তু কোনদিন চাইনি তোমাদের বিয়েটা ভেঙে যাক,আমি চেয়েছিলাম তুমিও আমার মতো সংসারে আটকে থাক।আমি জীবনে যেগুলো পায়নি সেগুলো তুমি পাচ্ছিলে আমার সহ্য হচ্ছিল না জান?খালি মনে হত আমি সারাজীবন সংসারে ব্যয় করলাম আর এই মেয়েটা সবকিছু কত সহজে পেয়ে যাচ্ছে।আমি পড়াশোনাটাও শেষ করতে পারিনি আর এ চাকরি করছে!! অবাক হয়ে যাচ্ছ তাই না,ভাবছ আমি খুব খারাপ,আসলে তুমি আসার পর সবকিছু তে নিজের সাথে তোমার তুলনা করতাম,আর দেখতাম আমি তোমার থেকে কত পিছিয়ে তোমার মত কিচ্ছু পারিনা আমি,তত তোমার উপর হিংসা হত,ভাবতাম চাকরি ছাড়লেই তুমিও আমার মতো হয়ে যাবে।
তাই প্রতিবেশী মেয়ে ছেলেরা যখন আমাকে এসে নার্সদের নামে বাজে ইন্দন জুগিয়ে দিতো তখন আমিও সাহস পেয়ে গিয়েছিলাম তোমাকে প্রতিদন্ধি ভাবার। জানোইতো,নার্সদের নামে তোমাকে কতো আজেবাজে কথা বলেছি।আসলে আমার ধারণায় ছিলো ভুল,সব কাজ সবাই পারেনা।আজ তুমি আমার চোখে আঙুল দিয়ে সে ভুল ধারণাটা পাল্টে দিলে।আর তুমি প্রমাণ করলে কিভাবে শত্রুর মন জয় করা যায়। অদ্রিজা অবাক হয়ে শুনছে,কি বলবে সে,এতদিন এই মানুষটার উপর রাগ হতো এখন মায়া হচ্ছে।সায়নের মা আবারো বলা শুরু করলেন । তুমি ও বাড়ি থেকে চলে আসার পর খুব খারাপ লাগত,মনে হত সবসময় তোমাকে প্রতিপক্ষ না ভেবে যদি একটু তোমার পাশে থাকতাম! যদি সায়নকে একটু বোঝাতাম! নিজের কাছে নিজেই খুব ছোট হয়ে গেছি জান।অনেক বার ভেবেছি তোমার সাথে একবার দেখা করব,ক্ষমা চাইব কিন্তু কোন মুখে যাব।
আজ তুমি আমাকে পথ দেখালে মা।আজ বুঝলাম, কেন তুমি রাত্রেও হাসপাতালে পড়ে থাকতে ভালোবাসতে। যে মানুষ টা তোমার পেশার কারণে তোমাকে রোজ নির্যাতন করতো আজ নার্স হয়ে সে কথা না ভুলে তাকে রক্ত না দিলে এতোক্ষণে হয়তো আমিও অনাথ হয়ে যেতাম।কথাগুলো বলতে বলতে অদ্রিজার হাত দুটো জড়িয়ে ধরলেন সায়নের মা, আমাকে ক্ষমা করে দিস মা এই বলে অদ্রিজাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে তিনি উঠে পড়লেন। এই স্বার্থপর,হিংসুটে মানুষটার জন্য অদ্রিজার চোখভিজে এলো।সায়নের মা এখন যা বুঝতে পারছে তা যদি একটু আগে বুঝত তাহলে সমাজে যে ডিভোর্সি আর পেশা টা নার্সিং বলে তাঁকে যে কথা শুনতে হয় তা আর শুনতে হতোনা।
গল্পের বিষয়:
গল্প