ডাক্তারবাবু -। মুখ তুলতেই, শিউলি। চুড়িদার কুর্তা। ঝকঝকে। শক্ত-সমর্থ। আঠারো-উনিশ। জানান না দিয়ে কেউ ঢুকে এলে আকস্মিকতার ধাক্কা লাগে। ফলে, বিরক্তি। রাগ। পরিচিত লোকের মুখোমুখি হবার আগে মন তার উপযোগী ওষুধ ভেবে নেয়। অপরিচিতকে অবিচ্ছিন্ন একাগ্রতায় বুঝতে চেষ্টা করে প্রথম সাড়ে পাঁচ মিনিট। ডাক্তারি করতে গিয়ে ভেতরে এমনই কোনো সূত্র তৈরি হয়ে গেছে। সেজন্য এ ডাক্তারখানার নিয়ম, সন্ধেবেলা, কাজের সময়, জানিয়ে-শুনিয়ে অনুমতি নিয়ে ঢোকা। ছটার আগে কিংবা সাড়ে নটার পরে না জানিয়ে ভেতরে এসো, কোনো আপত্তি নেই। অবশ্য একজন আছেন যিনি, কখনো, খুব গম্ভীর পরিস্থিতিতে, কাজের মাঝে খবর না দিয়ে ভেতরে ঢুকে আসেন। বিরক্ত লাগে না। না হলে, তিনি সাধারণত রোজই আসেন রাত সাড়ে নটার পর। ওই সময় আমার সহকারী চলে যায়। যে-লোকটি ঝাড়পোঁছ করে দরজায় তালা লাগায়, সেও একবার বাড়ি থেকে ঘুরে দশটায় ফিরে আসে। আমি মাথার পেছনে দুহাত জুড়ে হেলান দিয়ে বসে থাকি। চোখ বন্ধ করে আরাম করি। হঠাৎ চোখ খুলে ভদ্রলোককে দেখতে পাই। চুপচাপ উলটোদিকে এসে বসেছেন! আমাদের কথালাপ শুরু হয়। ছাড় এই্একজনকেই। এই মেয়ে তো সে-ই ব্যতিক্রম নয়!বিরক্তি রাগের দিকে যাবার ঠিক আগেই শিউলি বলল, ডাক্তারবাবু, না বলেকয়ে ঢুকে পড়লুম… আসলে, ফিরে গিয়েই রান্নাঘরে ঢুকতে হবে… বউদির শরীরটা ভালো নেই…। কথার সঙ্গে ওর ভুরুর ধনুক, শান্ত আঁখিপাত, ঠোঁটের কাঁপন সব মিলিয়ে এমন এক ক্ষমাপ্রার্থনার মুহূর্ত, আমার রাগ তো বটেই, বিরক্তিও উধাও। অথবা এমনও হতে পারে, এতক্ষণে আমি এই অঙ্ক কষে নিয়েছি যে, মেয়েটি সরকারবাবুদের রাত-দিনের গৃহকর্মী হলেও ওর মিষ্টি স্বভাবের জন্য যেহেতু পাড়ার সবাই পছন্দ করে ওকে এবং যেহেতু এ-ধরনের সবার প্রিয়, পাড়া-বেড়ানো চরিত্রের মাধ্যমেই মহল্লায় উপকথা তৈরি হয়, সেজন্যই রাগ-বিরক্তির রাশ টেনে ধরা। কারণ, খ্যাতকীর্তি হতে ডাক্তারদের এমন প্রবাদ রচনাকারীদের সাহায্য লাগে। অথবা এও হতে পারে, ওর কাছে নিজেকে অমায়িক প্রতিপন্ন করবার তাগিদ থেকে কটুভাব এলো না। মুখে দ্রুত হাসি ফুটে উঠল।– কী হলো রে?– এই… মানে… কথা ছিল…জেনারেল প্র্যাকটিশনার হলে নানান ঝাপট সামলাতে হয়। বিশেষ করে সে যদি আমার মতো উত্তর কলকাতার মধ্যবিত্ত এলাকায় থাকে তো কথাই নেই। একই সঙ্গে সে গৃহচিকিৎসক আবার সাংসারিক কিংবা ব্যক্তিগত সমস্যা সমাধানের প্রধান পরামর্শদাতা। ভেঙে-পড়া প্রাণে নিরন্তর উৎসাহ অণুবিদ্ধ করে যেতে হবে তাকে। কখনো করতে হবে চৌধুরীবাবুর সঙ্গে চ্যাটার্জিবাবুর ঝগড়া প্রশমনের দৌত্য। শিউলির সমস্যা নিশ্চয় ব্যক্তিগত। বললাম, তুই একটু অপেক্ষা কর, দুজন রোগী দেখে নিই, তারপর…। চোখে নিশ্চয়ই অনুকম্পা ছিল। সহমর্মিতাও। ফলে, মেয়েটি হেসে, মাথা নেড়ে ঘরের বাইরে গেল।ওর সঙ্গে এখনই কথা বলে বুঝে নেওয়া যেত সব। আসলে, আমি কিছুটা সময় নিলাম ভাববার। ও কী বলতে পারে? কাজ করতে গিয়ে ওর ওপর কোনো গোলমেলে জুলুম খাটাতে চাইছে কেউ? নাকি এমন কোনো অসুখ হয়েছে, যা বলতে বেশ সংকোচ হয়? অথবা এত কিছু নয়, ও হয়তো সরকারবাবুদের কাজ ছেড়ে চ্যাটার্জিবাবুদের বাড়িতে যেতে চায়, আমায় হয়তো সরকারবাবুর সম্ভাব্য রাগ কমানোয় ওকে সাহায্য করতে হবে! অবশ্য এমন উৎপটাং আবদার করলে, ওকে বকে দেবো। বলব, তুই কাতু চ্যাটার্জিকে বল এটা করতে। ও তোকে রাখছে, কাজটা ওরই করা উচিত আর অনুরোধ জানাতে হলে তুই কেন? কাতু আসুক আমার কাছে, তখন ভাবা যাবে।সময়মতো ওকে ডাকলাম। এবার যেন ভেতরে এলো একটু কুণ্ঠিত পায়ে। ভুল বুঝতে পারলে, শিক্ষিত কুকুর এবং মানুষ উভয়েরই এমন হয়ে থাকে। হাতের মুদ্রা-ভঙ্গিতে সামনের চেয়ারে বসতে বললাম। জড়োসড়ো বসল।– হ্যাঁ রে বল, কী ব্যাপার?চুপ করে রইল মেয়ে। এই সময়টুকু দিতেই হবে। অধৈর্য হলে চলে না। শীতকালে লেপের মধ্যে উষ্ণতা আসতে সময় লাগেই।যথাসময়ে শিউলি বলল, রণজয় আমাকে বিয়ে করতে চায়…। ওর কানের গোড়া, ভালো বাংলায় যাকে কর্ণমূল বলে, লাল।… আমাদের ভাব-ভালোবাসা বেড়ে গেছে… আমি রাজি… কিন্তু জয় ভয় পাচ্ছে…। এবার ওর পুরো কানটাই রক্তিম, ক্রমশ সারা মুখে, সকাল হওয়ার মতো, ছড়িয়ে পড়ছে সেই আভা। – বলছে, বাবা মত দেবেন না… কারণ, একে তো আমি কাজের লোক, তার ওপর মন্ডল…– রণজয় মানে?মেয়েটি অবাক।– আরে!… র-ণ-জ-য়…ওর দৃষ্টি আমার ভেবলে-যাওয়া স্মৃতিকে আঁকশি দিয়ে টেনে একেবারে ঠোঁটের ডগায় নিয়ে আসে।– ও আচ্ছা… রণজয়… মনে রুণু। ফর্সা দোহারা, তেইশ-চবিবশ। সদ্য চাকরি। শ্যাম্পু-সাবান-ক্রিম কোম্পানির বিক্রয়-বিভাগ। ফলে, মোটরবাইকে ধাবমান। সকাল থেকে রাত। একটু অবাক হলাম। সে কি করে তার চলমান জীবনযাপনে দুদন্ড স্থির থেকে শিউলির সঙ্গে আলাপ করবার সময় পেল! মেয়েটির চোখে চোখ রাখলাম। শান্ত নদীটি। শরীর-ভাষায় নির্জন ঝরনা। সব হইচই শেষে ঝড় তো এমন শান্তিই চায়। সেজন্যই বোধহয় ছেলেটিও -। আমার মুখে মৃদু হাসি।– হ্যাঁ রণজয়… ও আমাকে বিয়ে করতে চায়, কিন্তু -। আবার একই কথা বলে গেল শিউলি।– তা আমায় কী করতে হবে?– আপনিই তো সব…পাড়ার যে-কোনো বাসিন্দা ব্যক্তিগত কাজের অনুরোধ জানানোর শেষে এ-বাক্যটি বলবেই। কিন্তু এই মেয়ে যে সেই চালু-চালাকির কথা বলছে না, বেশ বুঝতে পারলাম। ওর চোখ চিক্চিক্ করছে।– ঠিক আছে দেখছি…। মেয়েটা দরজা খোলার মুখে দেখি, ওর ডান পায়ের হাওয়াই চটির বাঁদিকের ফিতে ছিঁড়বে-ছিঁড়বে করছে, কিন্তু সাবধান করবার আগেই শিউলি বেরিয়ে গেল।কয়েক মিনিট চুপচাপ।… ছেলেটা তো আজব! নিজে তার বাবাকে বলতে পারছে না বলে, মেয়েটিকে পাঠিয়ে দিয়েছে ডাক্তারবাবুর সাহায্য চাইতে! অথবা ছেলেটা পাঠায়নি, শিউলিই উপায় না দেখে ছুটে এসেছে…ছোট-ছোট চুমুকে এক গেলাস জল শেষ করলাম।– রণজয়ের বাবা ভদ্রলোক যদিও বেশ মনখোলা, ছ্যাতলা-পড়া নিয়মনীতি মানেন না, তবু এই উঁচু-নিচু ব্যাপারটা কী –এমন একটি জববর গোর্খা-গিঁট ছাড়াবার ভার ডাক্তারবাবুর ওপর!– ছেলেটা যদি সত্যিই মেয়েটিকে…। – স্যার, পরেরজনকে পাঠাব? দরজা ফাঁক করে শংকর উঁকি দিলো।– পুরনো কেস?– হ্যাঁ স্যার, নীলাঞ্জন রায়– পাঠাওসাড়ে পাঁচ ফুট। সর্দিকাশির ধাত। এ-সময় বাড়ে।নিয়মমতো বুকে-পিঠে স্টেথেসকোপ লাগিয়ে দেখে নিলাম। বুক পরিষ্কার। জ্বরও নেই, তবে খুব কাশি। কাশির ওষুধ, অতিসংবেদ্যতা কমানোর ওষুধ দিতে হবে। লেখনীঅভ্যাসে চলতে থাকে।– শিউলির মুখ আগের চেয়ে ভরাট। গরম নয়, তবু মুখমন্ডলে হালকা ঘামের আস্তরণ। বাঙালি মতে, ওকে লাবণ্যময়ী বলতে হবে –– ডাক্তারবাবু, আবার কবে আসব?– এই দিন সাতেক পরে। তিন-চারদিনের মধ্যে যদি কমার লক্ষণ না দেখেন, জানাবেন। – এই যে…, নীলাঞ্জনবাবু আমার দক্ষিণা ডানহাতে বাড়িয়ে হাসলেন।– ঠিক আছে, জানাবেন কিন্তু…উনি বেরোতেই, শংকরের মুখ।– এবার মনোজকান্তি হাজরা…ডানদিকে মাথা হেলিয়ে হাসলাম।পঁয়ষট্টি, পাঁচ ফুট দশ। পঁচাশি কেজি। হাঁটু-কোমরে যন্ত্রণা। মাঝে মাঝে বেশ ভোগায়।– রণজয় যখন তেরো বছরের, ওর মা গত হলেন। ওর বাবার সঙ্গে কত কথা হয়েছিল। কী করে চালু থাকবে দৈনন্দিনের ব্যবস্থা? ছেলের পড়াশোনো? গৃহশিক্ষণ? সেই থেকে ভদ্রলোক প্রতিদিনই সাড়ে নটার পর আসেন। কখনো দশটাও বাজে। তবে কি ছোট থেকে গৃহকর্মীর সান্নিধ্যে থাকার ফলে ছেলেটা এই নির্বাচন করল? ব্যাপারটা কিছু মনস্তাত্ত্বিক?…– খুব বেড়েছে, রাত্রে ঘুম ভেঙে যায় -। হাজরাবাবু তর্জনী তুলে হাঁটু দেখালেন।পাজামা তুলতে দেখা গেল একটু ফুলেছে। সবকিছু খতিয়ে দেখা দরকার। এক্স-রে, রক্ত পরীক্ষার পরামর্শের সঙ্গে বেদনাহর বড়ির নামও লিখলাম।– খুব অসহ্য হলেই তবে খাবেন, খালি পেটে নয়, ওটা খাবার আগে অ্যান্টাসিড খেয়ে নেবেন, ঠিক আছে?– আর বলবেন না মশয়, ব্যথা বাড়লে মনে হয় পিতৃপুরুষের নাম ভুলে গেছি…– সে তো আপনি এমনিই ভুলে গেছেন… ঠাকুরদার বাবা মানে কর্তাবাবার নাম বলতে পারবেন?কর্তাবাবা?হাজরাবাবু শব্দ করে হাসলেন। আপনি মশয় একইরকম রয়ে গেলেন…– ঠিক আছে তাহলে, সাতদিন পরে জানাবেন…নানান অর্ধস্ফুট শব্দ করে হাজরা দাঁড়ালেন। এরপর দক্ষিণা প্রদান। এবং নির্গমন। রোগী দেখা চলেছেই। মনটা অন্যদিকে ঘোরাবার চেষ্টা করলেও স্থির থাকছে না। শংকরকে জিজ্ঞাসা করলাম, আরো কজন?– এখনো পনেরোজন… তবে সবই পুরনো মুখ– উরিঃ বাবা, পাঠাও পাঠাও…সব মিটতে পৌনে দশটা। ক্লান্ত লাগছে। চোখ বুজে পাঁচ-দশ মিনিট বসে থাকলে ভালো লাগে।চোখ খুলতেই রণজয়ের বাবা। সাদা প্যান্ট। সাদা মাজন রঙের পুরো হাতা শার্ট, প্যান্টের ওপর দিয়ে ঝোলানো। মুখের চামড়া পাকা কাজুবাদাম। একমাথা চুল। কালোর মাঝে রুপোলি চমক। চিনি বলেই জানি বয়েস বায়ান্ন। যদিও পঁয়তাল্লিশের একমাসও বেশি মনে হয় না।এড়িয়ে লাভ নেই। সমস্যা হলো ধেয়ে-আসা পাগল হাতি। অস্ত্র হাতে মুখোমুখি দাঁড়াতেই হবে।বললাম, দুজনেই যখন চাইছে, বাধা দিয়ে –– পাড়ার সবাই তো ওকে বাড়ির কাজের লোক বলে জানে… সেজন্যই… আর তা ছাড়া জাতটাও… মানে পদবিটা…জানতাম এই প্রশ্ন ভেসে উঠবেই– দুনম্বর সমস্যাটা, ওই পদবি নিয়ে খুঁতখুঁতানি, এখনই মেটানো যায়। আদালতে হলফনামা দিয়ে মন্ডলকে রায় কিংবা সরকার বানানো কি এমন শক্ত?– তা ঠিক, কিন্তু তবু জাতটা –– জাত আবার কী? জাত কি অনুভব করা যায়? পদবি শুনে আমরা জাত কল্পনা করি, সেই পদবিই বদলে গেলে আর কী অসুবিধা?– তা অবশ্য ঠিক… কিন্তু কাজের লোক?– এ কোনো যুক্তির কথা নয়, বিদেশে কত এমন হয়… আমরা কথায় কথায় আমেরিকা-ইংল্যান্ড দেখাই… সেখানে খোঁজ নিন, এসব নিয়ে কেউ ভাবে না…– বুঝলাম, কিন্তু আমাদের চারদিকের লোকজন…– ছাড়ুন তো, লোকজনের কথা ভেবে আপনাকে চলতে হবে নাকি? আর জানবেন বিয়ে আটকালেই বরং ওরা বেশি মজা পাবে… তার চেয়ে দুজনের সই-সাবুদ নিয়ে বিয়েটা রেজিস্ট্রি করিয়ে ফেলুন, ইচ্ছে হলে সামাজিক অনুষ্ঠান করুন। মোট কথা, বুক চিতিয়ে সম্পর্কটা মেনে নিন… এতে আপনারই সম্মান বাড়বে।ভদ্রলোক চুপ করে থাকেন।– যা বেশি জরুরি, তা হলো রক্তপরীক্ষা – থ্যালাসেমিয়া, যৌনরোগ, যক্ষ্মা এসব আছে কি-না দেখা দরকার।– মেয়েটার করা দরকার, তাই না?– তা কেন? ছেলেটারও করতে হবে… রিপোর্ট ঠিক থাকলে ব্যস আর কোনো চিন্তা নেই, এগিয়ে পড়ুন…একটু থেমে আমি বললাম, আর একটা কথা। ভদ্রলোক ফিরে তাকালেন।– রণজয় তো আপনাকে কিছু বলেনি?– নাহ্– আপনিও বুঝতে দেবেন না যে, ব্যাপারটা আপনি জানেন, দেখা যাক ও নিজে বলে কি-না?তিনি মৃদু হাসলেন।– ও আলাদা ঘরে শোয়, কখন আসে কখন যায় বোঝা শক্ত, আমার সঙ্গে এমনিতেই দেখা হয় না যে কথা হবে…। ভদ্রলোক নিজের মনে মাথা নাড়তে থাকেন।এখনো আরো কিছুদিন বোঝাতে হবে ওকে।আটদিন ধরে বাক্য-প্রতিবাক্য চলল। এর মধ্যে শিউলি দুবার খবর নিয়ে গেছে। মেয়েটারই যেন বেশি গরজ!নবম দিনে ভদ্রলোক বললেন, আমি রাজি… খবর পাঠানো হলো শিউলিকে। যথাসময়ে মেয়েটি এলো। আজকেও রণজয় নেই।– শোন, রুণুর বাবা মত দিয়েছেন…যতটা উচ্ছবাস দেখব ভেবেছিলাম, ততটা নেই। ওর চোখ-মুখ খুশি হয়ে উঠল কিন্তু বাঁধ ভাঙল না।কেন? বোঝার চেষ্টা করছি। এমন সময়ে শিউলি বলল, রণজয় একটা কথা জানাতে বলেছে –ওর চোখে আমার চোখ। ও হঠাৎ থেমে গেল। আমি তাকিয়েই আছি।একটু পরে বলল, আমি… মানে ডাক্তারবাবু… আমি প্রেগন্যান্ট…শান্ত থাকার চেষ্টা করলাম। এ এমন কিছু আকাশ ফালাফালা করা খবর নয়। দুটি প্রাণ যখন মিলেছে, আর এক অণু-জীবনের আবির্ভাব কিছু আশ্চর্যের নয়।– কমাস?– দুমাস সতেরো দিন।মেয়েটির চিন্তার কারণ বুঝলাম এবার। এখন বিয়েটা না হলে ও সত্যিই সমস্যায় পড়বে। যার দায়িত্ব ছিল এগিয়ে আসা, সে নিজে না এসে ওকে সামনে ঠেলে দিয়েছে। হাবুডুবু খেতে খেতে মানুষ যেখানে খড়ের অাঁটি পেলেও অাঁকড়ে ধরে, সে-জায়গায় আমার মতো রক্ত-মাংসের পূর্ণবয়স্ক পেলে তো নির্ভর করবেই।বললাম, দেখি, একটু ভেবে দেখি, কীভাবে ওর বাবাকে বোঝানো যায়…– ডাক্তারবাবু, আপনি ছাড়া আর কেউ নেই আমার…এটা নিশ্চয় কথার কথা, তবু ওর ওপর সহানুভূতিতে ভেতরটা ভরে গেল। আজো বেরোবার মুখে লক্ষ করলাম, ওর চটির ফিতে বিপজ্জনক অবস্থায়। রথারীতি বলতে দেরি হয়ে গেল। রণজয়ের বাবা চটে গেলেন। কুলাঙ্গার ছেলে। এতদূর এগিয়ে এখন মুখ লুকিয়ে বসে আছে! আমার বাবা বেঁচে থাকলে ও খড়মপেটা খেত। হারামজাদা কী করে আমার চেলে হলো তাই ভাবছি…ঘন ঘন মাথা নেড়ে চললেন ভদ্রলোক।– ঠিক আছে, আমি এতেও রাজি… এবার মেয়েটির সঙ্গে ওকেও ডাকুন… ব্যাটা শয়তান…– হ্যাঁ, এবার চতুষ্কোণ বৈঠক, আমার ডানদিকে বসবেন আপনি, আর টেবিলের ও-ধারে ওরা দুজন। রণজয়ের কথাও শোনা দরকার।আমি পরিকল্পনা সাজালাম। তিনি মাথা নেড়ে সায় দিলেন। শুক্রবার রাত পৌনে দশটায় ওরা এলো। রণজয়ের ডানহাতে নীল হেলমেট। কালো প্যান্ট, হলুদ শার্ট। ছিপছিপে পেটাই চেহারা। গাত্রবর্ণ ওর বাবার মতোই, তবে চোয়াল তোবড়ান, যে-কারণে মুখের ছবিতে কাঠিন্য খেলা করে। চুলের রং ঘন কালো নয়, কিছুটা কটা। যখন মোটরবাইক চালায়, তখনো যেন, সেই হুড়োতাড়ার ছাপ চোখ থেকে পা সর্বত্র। চেয়ারে বসেই হেলমেট বাঁ-হাতে নিয়ে ডান হাত দিয়ে টোকা মারতে শুরু করল। একবার আঙুল চালাল টেবিলের ওপর।শিউলির সেই সাদামাটা তাঁতের শাড়ি। কিন্তু ঝকঝকে কাঁচা। আড়চোখে দেখলাম, ওর কনুইয়ে কোনো ময়লা নেই। নখও পরিষ্কার।আমি ছেলেটাকে এক পলক স্থির দেখে শুরু করলাম।– শিউলি সবই বলেছে তার ডাক্তারবাবুকে, ও যে প্রেগন্যান্ট তাও জানিয়েছে…রণজয় চোখ নামিয়ে নিল।– তুমি ওকে পাঠিয়েছিলে বাবাকে রাজি করাবার জন্য… তিনি রাজি… তোমার কোনো আপত্তি নেই তো?হঠাৎ রণজয় মুখ তুলল। ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল, প্রেগন্যান্ট তাও বলেছে… কিন্তু ও কী জানিয়েছে, অ্যাবরশনের জন্য ওকে ওষুধ খাইয়েছি?– সে কী! স্বাভাবিকভাবেই আমার চোখ বিস্ফারিত। দমের কষ্টও হলো একবার।– সে কী… কবে? কী ওষুধ? পর্যায়ক্রমে রণজয় এবং শিউলির দিকে তাকালাম।শিউলি বলল, এই তো দুমাস দশ দিনের মাথায়…রণজয় যা বলল তার অর্থ এই, প্রথমে সে এক ওষুধের দোকানিকে জিজ্ঞেস করে কোনো বড়ি খাইয়েছিল, তারপর এক কোবরেজের দেওয়া ওষুধ!– কোন দোকান থেকে কিনেছ?শিউলি জানাল, এই অঞ্চলের কোনো দোকান থেকে কিনলে বাবা টের পেয়ে যাবেন বলে সে কিনেছে দক্ষিণ কলকাতা থেকে।মেয়েটির মাথা নিচু। ওর চোখ টলটল। মিনতি-চোখে তাকাল রণজয়ের দিকে। ভুরুর শাসনও ছিল। ছেলেটা গ্রাহ্য করল না। কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, বিয়ে তো করব, কিন্তু অ্যাবরশন করাতে হবে। এই অবস্থায় বাচ্চা জন্মাবে, প্রতিবন্ধী হবেই… আমি দায়িত্ব নিতে পারব না…।শিউলির মুখে কালি মাখিয়ে দিয়েছে কেউ! চোখে একসাগর অসহায়তা। কিন্তু ছেলেটার যুক্তি খুব জোর দিয়ে অস্বীকার করা যাবে না।প্রতিপক্ষকে চুপ করাতে পেরে রণজয়ের মুখেচোখে আহ্লাদ ফুটে উঠতে শুরু করেছে।– আমি দায়িত্ব নেব।ভদ্রলোকের গলা পেয়ে চমকে উঠলাম। শুধু আবেগ নয়, কথার কথা নয়, ধার আছে ওই কণ্ঠে। গভীর বিশ্বাস থেকে বললে, এই আওয়াজ বের হয়।রণজয়ও থমকে গিয়েছিল। তারপর একটু গুছিয়ে নিয়ে শিউলির দিকে ফিরে বলল, উনি কি জানেন বিকলাঙ্গ শিশু হলে তার দেখভালের জন্য কত খরচ? মুখে নাটকের ডায়ালগ বলতে সবাই পারে, কাজে করা সোজা নয়… আমার ভয় হচ্ছিল, ওর বাবা না থাপ্পড় কষিয়ে দেন। কিন্তু তিনি আবার বেশ ঠান্ডা গলায় জানালেন, বললাম তো দায়িত্ব নেব…।শিউলির অবস্থা করুণ! ও বেচারী একবার তাকাচ্ছে ভদ্রলোকের চোখে, পরক্ষণেই ফিরছে রণজয়ের দিকে। আঁচল দিয়ে মুখের কপালের ঘাম মুছল একবার।এক-দুবার চালাচালির পরেই, রণজয় বলে বসল, মুখের কথা মানি না, আমাকে স্ট্যাম্প পেপারে লিখে দিতে হবে…নিজের বাবাকেও এতো অবিশ্বাস! সব থেকে ভয় পেয়ে গেল শিউলি। দম বন্ধ করে ত্রস্ত চোখে তাকাল এদিকে।আশ্চর্য! ভদ্রলোক যেন ধৈর্যের প্রতিমূর্তি। মৃদু হাসলেন, দাও… লিখে দিচ্ছি।রণজয় আবার বাক্যহারা। কই? দাও…। ভদ্রলোক আবার তার পুত্রের দিকে তাকালেন। – তোমার ঔরসে একটি মেয়ের গর্ভে সন্তানের বীজ রোপণ করেছ.. ওই ঘটনা ঘটাবার আগে কোনো চিন্তা ছিল না… এখন পেকে উঠতেই, দায়িত্ব নেবার কলজের জোর নেই, ওকে ভ্রূণহত্যার ওষুধ খাওয়াচ্ছ! ছ্যাঃ! ছিটকে বেরোতে থাকল প্রতিটি শব্দ – লজ্জা করে না তোমার? তুমি আমার ছেলে? তোমার মা বেঁচে থাকলে আজ জিজ্ঞেস করতাম এ সত্যিই আমার ছেলে কি-না? ফর্সা মুখ রক্তিম। চোখে রক্তচ্ছটা। কপালের শিরা ফুলে উঠেছে। চিবুকে স্বেদবিন্দু।শিউলি মাথা নিচু করে ফোঁপাচ্ছিল।– শোন মেয়ে, ওকে বলে দাও, দুটো হাত, দুটো পা, দুটো চোখ, দুটো কান, সবকিছু ঠিকঠাক, কলেজের পরীক্ষা পাশ দেওয়া ওই ভাবনা-চিন্তায় প্রতিবন্ধীটিকে যখন এই তেইশ-চবিবশ বছর ধরে পালন-পোষণ করতে পেরেছি, তখন না-হয় এক চক্ষু, একটি বর্ণ অথবা হৃদপিন্ডে ছিদ্র থাকা এক অসহায় শিশুরও দায়িত্ব নিতে পারব…পরক্ষণেই রণজয়ের দিকে ফিরলেন ভদ্রলোক, হারামজাদা… কুলাঙ্গার… আর একটি কথা বললে জুতিয়ে ছাল তুলে দেবো…পিতৃদেবের এমত জবান – ধোলাই খেয়ে রণজয় সেই যে মাথায় ডান্ডা-খাওয়া সাপের মতো কুঁকড়ে গেল, আর একবারও মুখ খুলল না।আজ তৈরি ছিলাম। দেরি হবার আগেই শিউলির হাতে দিলাম একজোড়া নতুন চটি। মেয়ে হাসল। পায়ে গলিয়ে বেরিয়ে গেল রণজয়ের সঙ্গে।এবার ভদ্রলোকের মুখোমুখি।ডাক্তারি বুদ্ধিমতে বোঝাবার চেষ্টা করলাম ওকে।– দেখুন, রণজয় খুব একটা ভুল বলেনি… ওষুধ খাইয়েছে কিন্তু ঋতুস্রাব শুরু হয়নি এটা ভালো কথা… কিন্তু কী ওষুধ ঠিক বলতে পারছে না… হয়তো তেমন কিছু গুরুতর নয়… তবু তো ভয় থাকে… বাচ্চার প্রতিবন্ধী হবার সম্ভাবনা তো –– রাখুন আপনার যুক্তি… যুক্তি দিয়ে ওর বজ্জাতিটা বোঝাতে পারবেন?… ছেলের কথাই ভাবছেন, একবারও তো ভাবছেন না মেয়েটার মনের অবস্থা? প্রথম সন্তানকে নষ্ট করলে ওর মনে কী চাপ পড়বে ভাবুন তো… ওষুধ খাওয়ালে ওর শরীরের কোনো ক্ষতি হবে কি-না, একবারও তো ছেলেটা ভাবল না!এই কথাতেও সত্যি আছে। মন বাদ দিয়ে মানুষের ডাক্তারি করা যায় না। চিকিৎসার সঙ্গে আবেগও মেশাতে হবে। চুপ করে বসে রইলাম। দুইমসৃণভাবে মিটে গেল বিবাহ-পর্ব। শিউলির পদবি পরিবর্তন করানো হয়নি। আড়াল দেবার কোনো প্রয়োজন বোধ করেননি ভদ্রলোক। পাড়ায় যে খুচরো ফিসফাস শুরু হয়েছিল, সব ঠান্ডা। মহল্লায় তো বটেই শিউলির কাছেও ভদ্রলোকের সম্মান বেড়ে গেছে। মেয়েটা কথায় কথায় বলে, বাবা বটবৃক্ষ আমরা তার ডালে, পাতার নিভৃতিতে থাকা ছোটখাট পাখি! হ্যাঁ, এটি মেয়েটারই কথা। কারণ বিয়ের পরেই আবিষ্কার করা গেছে, মেয়ের পড়াশোনোতেও মন আছে। মাধ্যমিক পাশ।যথাসময়ে সন্তানের জন্ম হলো। একেবারে সুস্থ-সবল ফুটফুটে শিশু। তার ঠাকুরদার বর্ণ পেয়েছে নবজাতক। এর আগমন ঠেকানো নিখাদ শয়তানের কাজ হতো!শিশুর বাড়বৃদ্ধি নিয়ে সমস্যা নেই। বয়েস হতেই সে শিক্ষালয়ে ঢুকে পড়ল। শিউলিও ততদিনে স্কুল পাশ দিয়ে কলেজের প্রান্তসীমায়।এই অবধি আখ্যানটি রূপকথা। তিনসময় গড়িয়ে গেছে। নতুন চিত্রপট। শিশুটি যখন বালক, আট বছর চার মাস, রণজয়ের বাইক-দুর্ঘটনা। লরির মুখোমুখি সংঘর্ষ। মাথায় গভীর চোট।ওর বাঁচার কথা নয়, বেঁচে গেল। কেউ কেউ যেমন বেঁচে যায়! কিন্তু কোমর থেকে পা অসাড়। ওই অঞ্চলে সাড় ফেরার সম্ভাবনা ক্ষীণ। ফলে, হাঁটতে পারে না, শুয়েই থাকতে হয়। প্রয়োজনীয় নিত্যকর্ম সবই পরনির্ভর। প্রস্রাব কৃত্রিম উপায়ে। প্রথমদিকে কথাও জড়িয়ে গিয়েছিল, ক্রমশ স্পষ্ট হয়েছে। কিন্তু এ-আশা নিঃসাড় নিম্নাঙ্গের বেলায় নেই। বিছানায় বসিয়ে দিলে নিজে নিজে খেতে পারে শুধু। টেলিভিশন, খবরের কাগজ, খাওয়া এবং ঘুম এই বাধ্যতায় চলে ওর দিন-রাত। চারভদ্রলোক এলেন একদিন। যেমন আসতেন।– ডাক্তার, মনে পড়ে?আমি তাকালাম ওর দিকে। এখন মাথায় অনেক কাশফুল। দৃষ্টিতে কুয়াশা।– মনে আছে একদিন রুণুর পক্ষ নিয়ে আপনি ডাক্তারি যুক্তি দেখিয়ে বলেছিলেন, ভ্রূণহত্যা করানোই ভালো? না-হলে বিকলাঙ্গ শিশু জন্মাতে পারে?…আমি যন্ত্রের মতো মাথা নাড়ি।– ডাক্তার, আজ কে প্রতিবন্ধী? ওই আট-ন’বছরের বালকটি? না বিছানায় শুয়ে-থাকা ক্যাথিটার লাগানো ওই ছেলে?ভদ্রলোক ঘর কাঁপিয়ে হেসে উঠলেন। তিনদিকের শার্সি ঝিনঝিন করে উঠল।– কে বিকলাঙ্গ ডাক্তার? কে?এমন কর্কশ, অলৌকিক আওয়াজ, সম্পূর্ণ অচেনা।কলিজা ফাটিয়ে হাসতে থাকেন ভদ্রলোক। হাসতে হাসতে ওঁর দুই চোখ থেকেই জল বেরিয়ে আসে।পুনশ্চ – এ-কথা সবাই জানে, ভদ্রলোক তো আমিই। ডাক্তার সুকল্যাণ ব্যানার্জি, এমবিবিএস ক্যাল।
গল্পের বিষয়:
গল্প