সেনাকুঞ্জে বন্ধুর শালির বিয়ের বিলাসবহুল চোখ-ধাঁধানো আয়োজন থেকে বেরিয়ে হারুনের মনে হলো – নিজে গরিব হয়ে বড়লোকদের বন্ধু হওয়ার মতো বিপজ্জনক ব্যাপার আর নেই। এদের নানারকম বাহানা থাকে, বায়নাও থাকে, গরিব বন্ধুদের সেসব মেটাতে গিয়ে অবস্থা কাহিল হয়ে যায়। এই যেমন আজকের ব্যাপারটাই ধরা যাক। তোর শালির বিয়ে, ভালো কথা, তুই যত খুশি মজা কর, কেউ তো তোকে না করেনি, সব বন্ধুবান্ধবকে দাওয়াত দেওয়ার দরকারটা কী? তাও সপরিবারে? আর এদের বিয়ের অনুষ্ঠানও হয় এমনসব জায়গায় যে সেখানে আসা-যাওয়া করাও এক যুদ্ধেরই নামান্তর। এই বৃষ্টিভেজা রাস্তায় দাঁড়িয়ে সেটি আরো তীব্রভাবে মনে হলো হারুনের। তার গাড়ি নেই। এই দুর্গম অঞ্চলে এই প্রায়-মধ্যরাতে সিএনজি পাওয়া এক অর্থে লটারিতে কোটি টাকা পাওয়ার মতোই দূরবর্তী সম্ভাবনার ব্যাপার। সে এখন বউ-বাচ্চা নিয়ে আজিমপুর যায় কীভাবে? একা থাকলে না-হয় হাঁটা দেওয়া যেত, কিন্তু সাজুগুজু করা বউ, নিজেও কিছু কম করেনি অবশ্য, আর দুই বাচ্চা – একজন তো হাঁটতেই শেখেনি – আছে সঙ্গে, এদেরকে নিয়ে সে হাঁটবেই বা কীভাবে? কতদূর হাঁটতে হবে, তারও তো ঠিক নেই কিছু। এমনিতেই সে এখানকার কিছু চেনে না, ক্যান্টনমেন্টে সে সারাজীবনে হাতে গুনে তিন-চারবার এসেছে, আন্দাজে একদিকে হাঁটতে শুরু করলেই তো চলবে না!
আরমানের ওপর ভীষণ রাগ হচ্ছে। কী দরকার ছিল এই ঝামেলায় ফেলার? হারুন আগে থেকেই ব্যাপারটা নিয়ে সচেতন ছিল, বলেছিল – ‘আমার তো গাড়ি নাই, ওখানে যাওয়া-আসা ভীষণ ঝামেলা। আমাকে বাদ দে।’ আরমান হেসেই উড়িয়ে দিলো ব্যাপারটা – ‘এই শহরের নববই ভাগ লোকের গাড়ি নাই। তাদের জীবন কি থেমে আছে? তোর নিজের জীবন কি থেমে আছে? শালা ঘরকুনো ব্যাঙ। হাঙ্কিপাঙ্কি বাদ দিয়ে চলে আয়। শালির বিয়ে-টিয়ে বড় ব্যাপার না। অনেকদিন বন্ধুবান্ধব একসঙ্গে আড্ডা দেওয়া হয় না, সবাইকে বলেছি – একটা গেট টুগেদার হয়ে যাবে।’ যাদের গাড়ি নেই তারা যে সবসময় যাতায়াতের চিন্তায় কাহিল হয়ে থাকে, এই ব্যাপারটা গাড়িওয়ালারা বোঝে না। শ্রেণি-সমস্যা। এই শহরে আসলে দুটো শ্রেণি – এক শ্রেণির গাড়ি আছে, আরেক শ্রেণির নেই। আর দেশটা চালায় গাড়িওয়ালারাই, সর্বস্তরের নীতিনির্ধারকদের গাড়ি আছে, ফলে তাদের পক্ষে গাড়িহীনদের সমস্যা বোঝার কথা নয়। সেজন্যই তো যখন-তখন যে-কোনো রাস্তায় রিকশা চলাচল বন্ধের নির্দেশ আসে। নববই ভাগ মানুষের কথা ভাবার সময় নেই কারো, নিজেদের গাড়ি চলার পথ কণ্টকমুক্ত রাখা দরকার! আরমানকেও ব্যাপারটা বোঝানো গেল না। যেন হারুন না এলে তার শালির বিয়ের পুরো অনুষ্ঠানটিই অপূর্ণ থেকে যাবে! অবশ্য সত্যিই একটা চমৎকার গেট টুগেদার হয়ে গেল আজকে। বন্ধুবান্ধবী আর তাদের পরিবার-পরিজন মিলে পঞ্চাশ-ষাট জনের একটা দল! তারা চুটিয়ে আড্ডা দিলো, ঠাট্টা-দুষ্টুমি চললো, এক বন্ধু আরেকজনের বউকে ক্ষেপালো, বান্ধবীদের বরদের নাজেহাল করলো অন্য বান্ধবীরা, দেশের অবস্থা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক হলো অনেক, কিন্তু তর্ক উত্তেজনার দিকে গড়াতে না গড়াতেই কেউ একজন হয়তো একটা চুটকি শুনিয়ে আবার হাস্যমুখর আড্ডা ফিরিয়ে আনলো – এইসব যা হয় আর কী! আরমান, বোধগম্য কারণেই ব্যস্ত, তারচেয়ে ব্যস্ত তার বউ লুনা। মাঝে মাঝে এসে আড্ডায় যোগ দিচ্ছে তো পরমুহূর্তেই ছুটে যাচ্ছে আরেক অতিথিকে দেখভাল করার জন্য। বোঝাই যাচ্ছে, আরমান-লুনাই মূল হোস্ট, মানে এই বিশাল আয়োজনটা তাদের উদ্যোগেই করা হয়েছে। একবার হারুনের এ-কথাও মনে হলো – আরমান যদি বড়লোক না হতো, তাহলে কি পারতো এভাবে বন্ধুদের দাওয়াত করতে? তার শালির বিয়েতে সে কি পারবে? না, পারবে না। তার শ্বশুর বড়লোক নয়, সে-ও নয়। লুনার বাবাও বড়লোক নয়, কিন্তু আরমানের নিজের সামর্থ্য আছে এরকম আয়োজন করার, বন্ধুবান্ধব নিয়ে আড্ডা বসানোর; তার নেই। বরং ভবিষ্যতে শালা-শালির বিয়েতে ভগ্নিপতি হিসেবে তার যেটুকু করা কর্তব্য সেটুকুও করতে পারবে কি-না সন্দেহ আছে। অবশ্য ভাবনাটাকে সে বেশিক্ষণ বয়ে বেড়াতে পারলো না, এতগুলো বন্ধুর মাঝখানে বসে সেটা পারাও যায় না। আর আড্ডাটাও হয়েছে দীর্ঘস্থায়ী, সম্ভবত আরমানের বুদ্ধির কারণেই। এসে বলেছে – ‘গল্পটল্প কর, আগে বাচ্চাদের খাইয়ে ছেড়ে দে, ওরা বাইরে খেলুক, তোরা এখন খেতে বসিস না। একসঙ্গে সবাই মিলে খাবো।’ তারা তা-ই করেছে। হোস্ট যদি খেতে না করে তাহলে খাওয়ার উপায় কি? পরপর দুটো ব্যাচ খেলো, তারা বসলো না। অধিকাংশ অতিথি বিদায় করে তারপর সময় হলো আরমান-লুনার। সবাই মিলে বিশাল এক টেবিলে বসলো, হাসিঠাট্টা করতে করতে পেটপুরে ও মনভরে খেলো। এরপর আর আড্ডা চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই, ঘড়ির কাঁটা এগারোটা ছুঁইছুঁই করছে, সবারই ঘরে ফেরার তাড়া আছে। সারারাত বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়ানোর বয়স আর নেই, সবাই সংসারী, সবার সঙ্গেই আরো দু-তিনজন বাড়তি মানুষ – বউ বা বর, এবং বাচ্চাকাচ্চা।
রাত হয়েছে, তার ওপর এই মধ্য ফেব্রুয়ারিতে বৃষ্টি হচ্ছে। বিকেল থেকেই মুখ ভার করে ছিল আকাশ, তারপর গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি, তারপর বেশ জোরেশোরে, এখন কমে গিয়ে আবার গুঁড়িগুঁড়ি। বৃষ্টির এই ভাবসাব দেখে এমনিতেই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল হারুন। এই দুর্যোগের রাতে সে ফিরবে কীভাবে? এইসব চিন্তা করতে করতে সে আনমনা হয়ে যাচ্ছিল বারবার, যদিও বেশিক্ষণ আনমনা হয়ে থাকার সুযোগ ছিল না পরিবেশের কারণেই। কিন্তু ফেরার সময় হয়ে এলে দুশ্চিন্তাটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। একবার ভাবলো, আরমানকে ডেকে দু-কথা শুনিয়ে দেয়, কিংবা পৌঁছে দেওয়ার আবদার করে, কিন্তু ও এত আন্তরিক, এত বন্ধুত্বপরায়ণ যে ওকে কোনো কথা শোনানো কঠিন। হয়তো পৌঁছে দেওয়ার কথা বললে দেবেও, কিন্তু তাই বলা যায় নাকি? বিদায় নেওয়ার সময় সোহেল জড়িয়ে ধরলো তাকে; উষ্ণ ও আন্তরিক আলিঙ্গন; গভীর আবেগমাখানো গলায় বললো – ‘তুই না এলে আমার কোনোকিছুই পূর্ণ হয় নারে দোস্ত। তোকে যে কত মিস করি!’ হারুনও এ ব্যাপারে নিঃসন্দেহ। ছোটবেলা থেকে নানা বিরূপ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হতে একসময় তার মনে হতো – পৃথিবীটা দারুণ নির্দয় একটা জায়গা, কোথাও একটুকরো ভালোবাসা নেই; আর পরে এই বন্ধুদের কাছ থেকে অসামান্য শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা পেয়ে তার মনে হয়েছে – এতটা তার পাওয়ার কথা ছিল না।
বাইরে বেরিয়ে বন্ধুরা যেন বিপদেই পড়ে গেল। এমন নয়, যে, সবারই গাড়ি আছে। কিন্তু যাদের আছে তারাও অন্যদের রেখে চট করে চলে যেতে পারছে না। পথের মিল থাকায় একজনের গাড়িতে হয়তো উঠে যাচ্ছে আরেক বন্ধু সপরিবারে, তাতে গাড়িহীনদের একটা গতি হচ্ছে, কিন্তু কেউ-ই আজিমপুরের দিকে যাবে না। মানে, ওদিকে কারোরই বাসা নয়। কারো বাচ্চা ঘুমের জন্য কাঁদছে, ছোটগুলো কোলেই ঘুমিয়ে পড়েছে, সবারই বাসায় ফেরার তাড়া। তবু কেউ কেউ বললো, চল, তোকে নামিয়ে দিয়ে আসি। কিন্তু গাড়িতে জায়গার সংকট, অন্য কোনো গাড়িহীন বন্ধু হয়তো সপরিবারে সঙ্গী হয়েছে, আর হারুনকে পৌঁছে দিতে হলে এই বন্ধুকে যেতে হবে উলটোপথে, সে তাই হাসিমুখে সবাইকে মানা করলো। মনে মনে বললো, গাড়ি তো নেই-ই, থাকিও এমন এক জায়গায় যেখানে কেবল মৃত মানুষরাই থাকে, নইলে তো কারো না কারো সঙ্গে পথ মিলতোই। কোলের বাচ্চাটা ঘুমিয়ে গেছে, আরেকটাও দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না, ঝিমুচ্ছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে, এই অকূল পাথার থেকে তাকে এখন উদ্ধার করবে কে? অসহায়ের মতো পথ চেয়ে দাঁড়িয়ে রইলো হারুন। হাঁটা সম্ভব নয়, এই বৃষ্টিতে এই পোশাকে ঘুমন্ত বাচ্চাদের নিয়ে হাঁটা যায় নাকি? যদি একটা সিএনজি আসে তবেই রক্ষা। সে একবার বউয়ের দিকে তাকিয়ে আপনমনেই বলেছে – ‘কী করা যায় বলো তো!’ আর বউ কাঁচুমাচু হয়ে উত্তর দিয়েছে – ‘বুঝতে পারছি না তো!’ আহারে! বেচারি আজকে এত সুন্দর করে সেজেছে! হারুন সারাজীবনই সাদাসিধে, আটপৌরে। প্যান্টের ওপরে একটা শার্ট চাপিয়ে আর স্যান্ডেল পরেই জীবন পার করে দিচ্ছে। কালেভদ্রে শার্ট ইন করে কিংবা জুতো পরে, অফিসে পার্টি থাকলে স্যুট-টাই পরে, কিন্তু সেটা তার প্রধান পোশাক নয়। সে সাদাসিধে সাজেই আসতে চেয়েছিল, কিন্তু বউয়ের অনুরোধে পাঞ্জাবি-পাজামা পরেছে, একটা শালও চাপিয়েছে কাঁধে। বউকেও সাজিয়েছে সুন্দর করে। নিজে শাড়ি পছন্দ করে দিয়েছে, টিপ লাগিয়ে দিয়েছে, মিল রেখে লিপস্টিকের শেড বেছে দিয়েছে, চুলে এলোখোঁপা করে ফুল গুঁজে দিয়েছে; তারপর কানে কানে বলেছে – ‘তোমাকে পরস্ত্রীর মতো সুন্দর লাগছে।’ কন্যাকে সাজিয়েছে পরীর মতো করে, আর কোলের ছেলেটাকে রাজপুত্রের সাজে! বউয়ের শখটাই বেশি ছিল। কোনোদিন সেনাকুঞ্জে আসেনি সে, এই প্রথম। এসে জাঁকজমক দেখে আর বন্ধুবান্ধবীদের ঠাট্টা-দুষ্টুমিতে সে মুগ্ধ। এদের কতো গল্প শুনেছে সে! নিজের বাসায় দাওয়াত করে খাওয়ানোর সামর্থ্য হয়নি কখনো! আর বাসার যে হাল, পুরনো দিনের বাড়ি, যতই গোছাও, মলিন হয়ে থাকবেই! কাউকে আসতে বলতেও লজ্জা লাগে! তবে নিজেদের এই নিম্নমধ্যবিত্ত জীবন নিয়ে তাদের কোনো অভিযোগ নেই।
হারুন মাঝে মাঝে ভাবে – তার বন্ধুরা এত বড়লোক হলো কীভাবে? আরমান অবশ্য ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান, পৈতৃক সূত্রেই অনেক পেয়েছে, কিন্তু সবাই তো ওরকম নয়। ভাগ্য খুলে গেছে? এই যেমন শেয়ারবাজার-টাজার, বা লটারিতে এক কোটি টাকা? নাকি এদিক-ওদিক নয়-ছয় করেছে কেউ কেউ? নইলে এত তাড়াতাড়ি এত বড়লোক হলো কীভাবে? বন্ধুদের সম্বন্ধে এরকম কথা ভাবতে মন সায় দিলো না। সে তো ঈর্ষাবোধ করে না মোটেই, বরং এতকিছু হওয়ার পরও যে তাদের আন্তরিকতা কমেনি, সেটিই বড় ব্যাপার। আর তাছাড়া, সে তো নিজের জীবন নিয়ে অসন্তুষ্ট নয়। যে-জীবন পেয়েছে, হারুন তাতেই সুখী, দারুণ সুখী। এতখানি পাওয়ার কথা সে কল্পনাও করেনি। গভীরভাবে ভেবে দেখেছে হারুন, সে যেখানে এসেছে সেখানে তার আসার কথাই ছিল না। সব মানুষ নিজেদের জীবন এক জায়গা থেকে শুরু করে না। কেউ শূন্য থেকে শুরু করে, কেউ বেশ খানিকটা এগিয়ে থেকে শুরু করে, আর কেউ শূন্যেরও অনেক পেছন থেকে শুরু করে, শূন্যে পৌঁছাতেই তাদের জীবন অর্ধেক পার হয়ে যায়। সে ওই তৃতীয় দলের মানুষ। গন্ডগ্রামের দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে এসেছে সে, নানারকম গ্লানি আর বেদনার ভেতর দিয়ে, অভাব আর দারিদ্রে্যর ভেতর দিয়ে, শঙ্কা আর অনিশ্চয়তার ভেতর দিয়ে। খুব ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়েছে হারুন, তাঁর কথা আর কিছুই মনে নেই এখন। অকাল বৈধব্য তার রূপবতী মাকে উপহার দিয়েছে নানা বিপদ ও বিপর্যয়, লোকনিন্দা আর নিরাপত্তাহীনতা। এইসব দেখে দেখে বড় হয়েছে সে। একাত্তরে, বাবা মারা যাওয়ার সময়, তার বয়স ছিল বোধহয় কয়েক মাস, এমনকি সে তার সঠিক জন্মতারিখটাও জানে না। বাবার মৃত্যুর পর মা অনেকদিন পর্যন্ত অসুস্থ ছিলেন, যখন সুস্থ হলেন, পেছনের কোনো কথাই ঠিকঠাক মনে করতে পারতেন না, একমাত্র বাবার প্রসঙ্গ ছাড়া। দাদার বাড়িতে থাকতে পারেনি তারা, নানা গিয়ে তার মেয়েকে শিশুপুত্রসহ নিয়ে এসেছিলেন নিজের কাছে। নানা ছিলেন স্কুলমাস্টার, সংসারে সচ্ছলতা ছিল না তাঁর, অনেকগুলো ছেলেমেয়ের সংসারে তবু মেয়েকে বাড়তি বোঝা বলে মনে করেননি, বরং পরম স্নেহে বুকে জড়িয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু তিনি একা আর কতটা পারবেন, চারপাশের মানুষ তাকে একেবারে পাগল বানিয়ে তুলেছিল মেয়েকে আবার বিয়ে দেওয়ার জন্য। সোমত্ত মেয়ে, দেখতেও সুশ্রী, এই মেয়েকে কি এভাবে ঘরে রাখা যায়? কিন্তু মাকে বিয়ের কথা বলাই যেত না। এই প্রসঙ্গ উঠলেই এমন পাগলামি শুরু করতেন যে সামলানো মুশকিল হয়ে দাঁড়াতো। নানান সামাজিক চাপ সত্ত্বেও নানাকে তাই এই প্রসঙ্গ থেকে দূরে থাকতে হতো। এসব কথা হারুনের মনে নেই, বড় হয়ে বিভিন্নজনের কাছে শুনেছে। কিন্তু সে যা দেখেছে এবং নিজ কানে শুনেছে তার ক্ষত এখনো শুকোয়নি। নানার সংসারে টানাটানি, উপায়ান্তর না দেখে মা ছোট্ট একটা সরকারি চাকরিতে ঢুকেছিলেন – স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে। ওই যে টিকা দেওয়া, গর্ভবতী মায়েদের পরামর্শ ও চিকিৎসাসেবা দেওয়া, এইসব আর কি! থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কাজ করতেন তিনি, গ্রামে ঘোরাঘুরির দায়িত্ব থেকে কী কারণে যেন নিষ্কৃতি পেয়েছিলেন বটে, কিন্তু রক্ষা পাননি কুৎসিত সব নিন্দা-মন্দ থেকে। হাসপাতালের ডাক্তারদের সঙ্গে তার সম্পর্ক নিয়ে মনগড়া কুকথা বলে বেড়াতো লোকজন। দিনদুপুরে অজস্র লোকের আনাগোনার মধ্যে মায়ের চাকরি, কোনোদিন সন্ধ্যা করে বাড়ি ফেরেননি, তাদের বাড়িতে কোনোদিন কোনো ডাক্তারকে আসতে দেখা যায়নি, তবু লোকজন যে কেন এসব কথা বলতো – এখনো সে বুঝে উঠতে পারেনি। বড় হয়ে উঠতে উঠতে, স্কুলে পড়ার সময়ই সে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে, এই গ্রাম থেকে মাকে নিয়ে চলে যেতে হবে। কিন্তু চাইলেই তো সেটা সম্ভব নয়। নানার আর্থিক সামর্থ্য নেই, মামা-খালারা সবাই পড়াশোনা করছে নিজের চেষ্টায়, তার এই ইচ্ছা পূরণ করবে কে? স্কুল-কলেজ পেরিয়ে সে যখন ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হলো, এখানে-ওখানে কয়েকটা টিউশনি জুটিয়ে মাকে নিয়ে আসার তোড়জোড় শুরু করলো। কিন্তু মা যথারীতি দৃঢ়চেতা, হেসে বললেন – ‘পাগল রে, আগে পড়াশোনা শেষ করে চাকরি নে, তারপর এসব ভাবিস।’ সে যে টিউশনি করে অনেক টাকা কামায়, পুরান ঢাকায় একটা রুম ভাড়া করে মাকে নিয়ে থাকার সামর্থ্য তার আছে, মাকে এটা বোঝাতেই পারে না। মায়ের বুঝ তার চাইতে বেশি – ‘খামোকা চাপ নিবি কেন বাবা? এখানে তো ভালোই আছি আমি। টিউশনি কোনো চাকরি নাকি? আজ আছে কাল নাই। হাত খালি হয়ে গেলে বাসাভাড়া দিবি কীভাবে? আমাদের কি জমানো টাকা আছে? তারচেয়ে চেষ্টা করে দ্যাখ হলে সিট পাওয়া যায় কি-না। পেলে টিউশনির টাকা একটু একটু করে জমাবি, যেন চাকরি পাওয়ার পর ঢাকায় বাসা নিয়েই তোকে একটা বিয়ে করাতে পারি।’
জমানো হয়নি তার, অচিরেই সে আবিষ্কার করে – মায়ের কথাই ঠিক। টিউশনির কোনো ঠিকঠিকানা নেই – এই আছে তো এই চলে যায়। তখন সামরিক শাসকের স্বেচ্ছাচারিতার কাল। যখন-তখন ইউভিার্সিটি বন্ধ হয়ে যায় অনির্দিষ্টকালের জন্য, অল্প সময়ের মধ্যে হল খালি করে দেওয়ার নির্দেশ আসে কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে, ব্যাগ গুছিয়ে বাড়িতে চলে যেতে হয়, আর অনেকদিন পর ইউনিভার্সিটি খোলার খবর পেয়ে ফিরে এলে দেখা যায় – টিউশনিটা আর নেই। গৃহকর্তা নতুন কাউকে নিয়োগ দিয়েছেন। সত্যিই, বাসা ভাড়া নিলে দারুণ অনিশ্চয়তায় পড়তে হতো। তবে একাধিক টিউশনি করতো বলে একটা না একটা থাকতোই, সেটা দিয়ে নিজের খরচ চালিয়ে নিতে অসুবিধা হতো না, আর বেশি থাকলে মাকে প্রতিমাসেই কিছু না কিছু পাঠাতো সে। এই সময়েই তার বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে সহপাঠীদের সঙ্গে। প্রথমদিকে নিজের সম্বন্ধে কিছুই বলতো না হারুন, কিন্তু পরিচয় গাঢ় হওয়ার পর সে যখন জানায় – তার বাবা যুদ্ধের সময় মারা গেছেন, তার বন্ধুরা কৌতূহলী হয়ে ওঠে।
মারা গেছেন মানে? কীভাবে মারা গেছেন?
যুদ্ধ করতে গিয়ে।
যুদ্ধ করতে গিয়ে?
হুঁ।
মানে তিনি মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন?
হুঁ।
মানে তুই শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সন্তান?
হ্যাঁ। তোদের ভাষায় ব্যাপারটা ওরকমই।
আমাদের ভাষা মানে? তোর ভাষা কি আমাদের চেয়ে আলাদা?
আলাদা তো বটেই। আমি গ্রাম থেকে এসেছি না?
গাধা। আমরা সবাই তো গ্রাম থেকেই এসেছি।
সবাই না, কেউ কেউ।
ওই হলো। যারা শহরে থাকে, তাদের বাপ-চাচারা হয়তো গ্রাম থেকে এসেছিলেন। মানে এক প্রজন্মের পার্থক্য।
এটা অনেক বড় পার্থক্য।
পার্থক্য থাকলেই কী? শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা সব কালে সব জায়গায় শহীদ মুক্তিযোদ্ধাই। গ্রাম আর শহরবিশেষে সেটা পালটে যায় না।
যায় বন্ধু, যায়।
এরকম ইডিয়টের মতো কথা বলছিস কেন?
আমার জায়গায় থাকলে তোরাও এভাবেই বলতি!
কেন বল তো! কী হয়েছে?
আমি যে শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সন্তান এটা প্রথম বুঝতে পেরেছি শহরে এসে। আমাদের গ্রামে এর কোনো বালাই নেই। কারো কাছ থেকে কোনোদিন আলাদা মনোযোগ পাইনি, শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী হিসেবে আমার মা কোনোদিন বিশেষ মর্যাদা পাননি, বরং নানারকম গঞ্জনা সইতে হয়েছে। আমাদের এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের চেয়ে রাজাকাররাই বেশি পাওয়ারফুল। তাদের অনেক টাকা, তারাই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হয়, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হয়, এমপি হয়, মন্ত্রী হয়। তারাই দেশটাকে চালায়। এই বাস্তবতার ভেতরে থেকেও তোরা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হওয়ার ঘটনাকে বিশেষ ব্যাপার বলে মনে করিস?
অবশ্যই করি। দেশের এই অবস্থা চিরদিন থাকবে না। আর্মিরা এসে রাজাকারদের কাছে টেনে নিয়েছে, ক্ষমতার স্বাদ দিয়েছে, সারাদেশে রাজাকারদের প্রতিষ্ঠা দিয়েছে, কিন্তু এটাই তো শেষ কথা নয়। এই বেহায়ার পতন হয়ে এলো বলে। আমরা কি সাধে এই আন্দোলন করছি?
এই সরকারের পতন হলেই কি? সমাজ থেকে, দেশ থেকে রাজাকাররা কি বিলুপ্ত হয়ে যাবে? ওরাই ক্ষমতায় আসবে আবার। সরাসরি না হলেও অন্য কোনো দলের হাত ধরে আসবে।
এত নেগেটিভ কথা বলিস না তো! আমরা বেঁচে থাকতেই ওদের কবর দিয়ে যাবো।
দিস। দিতে পারলে তো ভালোই। আমার কেন যেন বিশ্বাস হয় না। মাঝে মাঝে মনে হয়, বাবা যদি যুদ্ধে না গিয়ে পালিয়ে-টালিয়ে হলেও বেঁচে থাকতো, তাহলে মাকে এত যন্ত্রণা পোহাতে হতো না।
বেঁচে থাকলে ভালো হতো, কিন্তু যুদ্ধে গিয়ে তিনি কোনো ভুল করেননি।
তা হয়তো করেননি। কিন্তু আমরা যে কী পরিমাণ দুর্ভোগ সহ্য করেছি, যদি জানতি!
হ্যাঁ, বুঝি দোস্ত। কোনোকিছুই তোদের অনুকূলে ছিল না। কিন্তু তাই বলে সব ছেড়ে দেওয়ারও কোনো কারণ নেই। এখন তুই বড় হয়েছিস, মায়ের সব দুঃখ মুছে দিবি।
আমি কি তা পারবো, দোস্ত?
অবশ্যই পারবি। আর তুই একা নাকি? আমরা আছি না? তোর মা তো আমাদেরও মা।
হ্যাঁ, কেবল কথার কথা ছিল না, ওরা সত্যিই সেটা প্রমাণ করে দিয়েছে। দল ধরে তাদের বাড়িতে গিয়েছে মাকে দেখতে, সমস্বরে মা বলে ডেকেছে, এতগুলো সন্তান একসঙ্গে পেয়ে মা তো কেঁদেকেটে একাকার। শুধু কি তাই? মাকে ঢাকায় বেড়াতে নিয়ে এসেছে ওরা – সে থাকে হলে, মা থাকবে কোথায়? এই চিন্তাও তাকে করতে হয়নি। যাদের ঢাকায় বাসা আছে সেই সব বন্ধু ও বান্ধবীরা রীতিমতো মাকে নিয়ে টানাটানি করেছে নিজেদের বাসায় রাখার জন্য। দুদিন এর বাসায় তো দুদিন ওর বাসায়। শুধু কি তাই? সবাই মিলে মাকে নিয়ে কত জায়গায় যে ঘুরে বেড়িয়েছে! সে যা করতে পারেনি কখনো, ওরা সবাই মিলে সেটিই করেছে মায়ের জন্য। সবার কাছেই তাঁর পরিচয় ‘মা’। এই সম্মান তো অভাবনীয় ছিল। শুধু মাকে সম্মান জানানোই নয়, পরিচয় পাওয়ার পর থেকে বন্ধুরা যেন তাকে আগলে রেখেছে। কখনো এতটুকু বিপদে পড়তে দেয়নি, এতটুকু ঝামেলায় পড়তে দেয়নি। বন্ধুদের প্রতি তার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। এতখানি সম্মান আর ভালোবাসা তার প্রত্যাশিত ছিল না।
পাশ করার পর বন্ধুদের মতো সে-ও ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবছিল, ঝুঁকিপূর্ণ বেসরকারি চাকরিতে যাওয়ার সাহস হয়নি বলে সরকারি ব্যাংকে যোগ দিয়েছে। বন্ধুরা বলেছিল, মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে কোটার সুবিধা নিতে। তার ইচ্ছে করেনি। তাছাড়া, তার বাবা যে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা এরকম কোনো আনুষ্ঠানিক কাগজপত্রও তাদের কাছে নেই বা জোগাড় করার কথা এতকালেও তার বা মায়ের মনে হয়নি। সরকারি অফিস থেকে নতুন করে সেসব ব্যবস্থা করা দারুণ ঝক্কির ব্যাপার বলে মনে হলো হারুনের। তাছাড়া, মা যেখানে কোনোদিন বিশেষ সুবিধা নেওয়ার কথা ভাবেননি, সে কেন নেবে?
মাকে দেখে সে বরাবর অবাক হয়। এত লাঞ্ছনা-গঞ্জনা সয়েও মহিলা এত শক্ত থাকেন কীভাবে? এত শক্তি তিনি পান কোথায়? একবার সে মাকে জিজ্ঞেস করেছিল, এত যন্ত্রণা সয়েছেন তবু বিয়ে করেননি কেন, মা বলেছিলেন – ‘যে মানুষটি দেশের জন্য যুদ্ধ করতে গিয়ে জীবন দিয়েছেন, তার স্ত্রী কি অন্য কোনো পুরুষকে মেনে নিতে পারে? অন্য কোনো মানুষ কি তার সমান হতে পারবে কোনোদিন?’
বাবাকে তার মনে পড়ে না, কিন্তু মা যেন বাবার বলা প্রতিটি শব্দ মুখস্থ করে রেখেছেন – ‘তোর বাবা কিন্তু ঝোঁকের মাথায় যুদ্ধে যাননি, খুব সচেতনভাবে ভেবেচিন্তে গিয়েছেন। বলতেন – ব্যক্তিগত লাভের কথা ভেবে বা কোনোকিছু পাওয়ার জন্য যুদ্ধ করছি না। এটা হলো সময়ের ডাকে সাড়া দেওয়া, নইলে যে নিজের কাছে ছোট হয়ে যাবো। দেশটা স্বাধীন হোক, আমরা এমনিতেই ভালো থাকবো।’ ভালো ছিলেন না মা, তবু কখনো বিশেষ সুবিধা নেননি বা চাননি। বাবা তো বিনিময় চাননি, মা কেন চাইবেন? আর তাঁদের সন্তান হয়ে সে-ই বা চাইবে কেন?
এমনই দুর্ভাগ্য মায়ের যে, জানতেও পারেননি, তার স্বামী কোথায় মারা গেছেন, কোথায় তাকে কবর দেওয়া হয়েছে। এক রাতে সহযোদ্ধারা এসে বাড়িতে খবর দিয়ে সেই রাতেই ফিরে গিয়েছিলেন। এরপর থেকে অনেকদিনের কোনো স্মৃতি নেই মায়ের, অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন বলে।
চাকরিতে যোগ দিয়ে মাকে স্থায়ীভাবে ঢাকায় নিয়ে এসেছে সে, মায়ের পছন্দেই বিয়ে করেছে, দুটো ফুটফুটে বাচ্চা হয়েছে তাদের। মা তাদের নিয়ে দারুণ ব্যস্ত, পুত্রবধূর সঙ্গে তার সম্পর্কও অতিস্নেহের-মমতার-ভালোবাসার। যেন আর কোনো অপূর্ণতা নেই; তার চির-দুঃখী মুখে এখন যেন আর কোনো বেদনার চিহ্ন নেই। একটু টানাটানি আছে সংসারে। তাতে কী? এই গরিব দেশে এরচেয়ে ভালো থাকাও একধরনের অপরাধ বলেই মনে হয় হারুনের।
এইটুকু জীবনে সে যে কতকিছু দেখলো! এরশাদকে তো যেতে বাধ্য করলো তারাই, মানে তখনকার দিনের তরুণরা, এরপর বিএনপি ক্ষমতায় এলো, রাজাকারদের সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করলো। শহীদ জননীর নেতৃত্বে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আন্দোলন শুরু হলে সে এবং তার বন্ধুরাও ঝাঁপিয়ে পড়লো। তখন যৌবন ছিল, রক্তে ছিল যুদ্ধের নেশা; এরশাদের পেটোয়া বাহিনী বা পরের সরকারের রক্তচক্ষুকে ভয় করতো না। এরপর তো ক্রমাগতই বয়স বেড়ে চললো। শহীদ জননীর আন্দোলনের সুবিধাটুকু কাজে লাগিয়ে, জামায়াতকে চাপে ফেলে রাজাকারদের হাত ধরে আন্দোলন করে ক্ষমতায় এলো আওয়ামী লীগ; ফিরেও গেল পাঁচ বছর পর। আবার বিএনপি এলো-গেল, এবার একেবারে ক্ষমতার মসনদে বসানো হলো ঘাতকদের। যেন ওদেরকে তোয়াজ করার জন্য প্রধান দুই দল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছে। সবাই যায়-আসে, কেবল রাজাকাররা রয়ে যায়। তাদের ক্ষমতা ও দম্ভ কেবল বেড়েই চলে। তার অবাক লাগে। এই স্বাধীন দেশে প্রতিটি সরকার ওদেরকে এমন তোয়াজ করে চলে কেন?
কিন্তু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এসব কী ভাবছে সে? রাত যে বেড়েই চলেছে, ফিরবে কীভাবে? নাকি আরমানকে একটা ব্যবস্থা করতে বলবে? হ্যাঁ, এছাড়া আর উপায় নেই। যদিও ব্যাপারটা খুবই অশোভন দেখাবে, শালির বিয়ের নানা আনুষ্ঠানিকতা নিশ্চয়ই শেষ হয়নি এখনো! কিন্তু কী-ই বা করার আছে? তাকে তো ফিরতে হবে! সেটা অবশ্য করতে হলো না, পকেট থেকে সেলফোন বের করার ঠিক আগমুহূর্তে একটা সিএনজির দেখা পাওয়া গেল। ঝড়ের বেগে এদিকে আসছে। সে সব ভুলে পথের মাঝখানে গিয়ে হাত উঁচু করে দাঁড়ালো। ড্রাইভারের বোধহয় থামার ইচ্ছে ছিল না, পাশ কাটাতে গিয়ে হার্ড ব্রেক করে থামলো।
কই যাইবেন?
আজিমপুর।
নাহ, ওদিকে যামু না।
যেদিকেই যান, আমাদেরকে একটু মেইন রোড পর্যন্ত নিয়ে যান। মহাবিপদে পড়েছি।
ড্রাইভার এবার একপলক তাকিয়ে তার বউ-বাচ্চাদের দেখলো, বললো – হ, বুঝছি। ঠিক আছে ওঠেন, শাহবাগ পর্যন্ত যাইতে পারবেন। আজিমপুর যামু না।
শাহবাগ পর্যন্ত যেতে পারলে তো হয়েই গেল। তার মন খুশিতে প্রায় নেচেই উঠলো। তবু অভ্যাসবশত বলে ফেললো –
মিটার আছে না?
মিটার দিয়া কী করবেন?
তাহলে কত নেবেন?
দিয়েন যা ইচ্ছা।
এই তো ভেজালে ফেললেন। আমার ইচ্ছায় তো আপনি খুশি হবেন না।
আরে স্যার, এই রাইতের বেলা কী শুরু করলেন? শোনেন, যদি আমার লগে শাহবাগ যান, কিছুক্ষণ সেখানে বসেন, তাইলে ভাড়া নিমু না।
সে মৃদু হাসে। হ্যাঁ, সে শুনেছে, শাহবাগে যাওয়ার জন্য রিকশাওয়ালা-সিএনজি ড্রাইভাররা ভাড়া নিচ্ছে না, ঝালমুড়ি-চানাচুর-চটপটি-ফুচকাওয়ালারা ফ্রি খাওয়াচ্ছে, শ্রমিকরা-ভিখারিরা তাদের সারাদিনের উপার্জনের টাকা দিয়ে খাবার কিনে এনে খাইয়ে দিচ্ছে ওখানে অবস্থান নেওয়া ছেলেমেয়েদেরকে। এইসব কত কত আবেগময় ইতিহাস তৈরি হচ্ছে প্রতিদিন! সে নিজেও অফিস থেকে ফেরার পথে কয়েকদিন গিয়ে দাঁড়িয়ে থেকেছে, তরুণদের এই জেগে ওঠা দেখেছে মুগ্ধ চোখে। পুরো একটা প্রজন্ম ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিচ্ছে বলে যে দুঃখবোধ ছিল সেটি মুছে গিয়েছে ওদের এই আবেগ-উন্মাদনা দেখে। এই আন্দোলন কতদূর পর্যন্ত যাবে বলা মুশকিল। এরশাদবিরোধী দীর্ঘ আন্দোলন আর গণআদালতের আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতা থেকে হারুনের মনে হচ্ছে, এই এত বড় গণজাগরণ নিয়ে নানাপক্ষ নানাভাবে খেলবে। সবাই চাইবে এর সুফল নিজের পকেটে ভরতে, না পারলে বিরোধিতা করবে, ধ্বংস করে দিতে চাইবে। রাষ্ট্রই বলো, সরকারই বলো, আর রাজনৈতিক দলই বলো – সবই তো একেকটি প্রতিষ্ঠান, কোনো প্রতিষ্ঠানই এত বড় জাগরণকে বেশিদিন সহ্য করবে না। এদের কোনো সংগঠন নেই, সাংগঠনিক কাঠামো নেই, আবেগ আর ভালোবাসার জোরে এরা দিনরাত একাকার করে এখানে অবস্থান নিয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চায় এই বিপুল তরুণ প্রজন্ম। কিন্তু এইরকম টানা অবস্থান নিয়ে কতদিনই বা থাকতে পারবে ওরা? অসুস্থ হয়ে পড়বে না? সরকার এখান থেকে উঠিয়ে দেবে না ওদেরকে? ঘাতক-দল আর তাদের সহযোগী শক্তিগুলো চাপ প্রয়োগ করবে না? করবে তো! ওদের জন্য মায়া হলো হারুনের। সামনে যে কত দুর্যোগ অপেক্ষা করছে ওদের জন্য, কে জানে! নিজের তারুণ্যের কথা মনে পড়লো। তারাও তো দিনরাত একাকার করে দিয়েছিল একসময়।
রাতের ঢাকায় ঝড়ের বেগে ছুটে চলেছে সিএনজি। অল্প সময়েই ফার্মগেট চলে এসেছে। হারুন ভাবলো, ড্রাইভারের সঙ্গে একটু কথাটথা বলা যাক।
প্রতিদিনই যান নাকি চাচা?
হ, যাই। দুই-তিনবার যাই, যাওয়ার পথে কেউ যাইতে চাইলে ফ্রি নিয়া যাই।
ফ্রি নেন কেন? লস হয় না?
এইডা তো আপনেরে বুঝানো যাইবো না বাবা। যুদ্ধ করছি, কিন্তু যুদ্ধের পরপরই ওই হারামিগুলারে মাইরা ফেলি নাই বইলা এরা এত বাড় বাড়ছে। দেশটারে গিলা খাইতে চায়। আমাগো তো বয়স হইছে, এখন কিছু করতে পারুম না। কিন্তু এই যে পুলাপানগুলা এক জায়গায় খাড়াইছে, এইবার আর উপায় নাই। হারামিগুলার মরণ ছাড়া আর কোনো পথ নাই।
সে একটু চমকালো। লোকটা মুক্তিযোদ্ধা ছিল! সেজন্যই তো এমন আগুন বয়ে বেড়াচ্ছে ভেতরে! একবার তার মুখটা দেখার খুব ইচ্ছে হলো হারুনের। কিন্তু লোকটা সামনের দিকে স্থির তাকানো, ঘুরে না তাকালে পেছন থেকে তো মুখ দেখা সম্ভব নয়। কথা বলার সময় তার বাবড়ি চুলগুলো বেশ আয়েশিভঙ্গিতে নড়ছে, দৃশ্যটা দেখতে ভারি ভালো লাগছে তার। বাবারও নাকি এরকম বাবড়ি চুল ছিল, মায়ের কাছে শুনেছে। অনেক অভিমান নিয়ে বড় হয়েছে বলে বাবার সম্বন্ধে তেমন কিছু জানতে চায়নি সে মায়ের কাছ থেকে। মাঝে মাঝে নিজে থেকেই বলতেন তিনি।
গল্প করতে করতে শাহবাগ পৌঁছে গেল তারা। রূপসী বাংলা হোটেল মোড়েই থামতে হলো, এরপর আর যাওয়ার উপায় নেই। নেমে পড়লো তারা, ড্রাইভারও। তারপর কোনো এক অপ্রতিরোধ্য আবেগে ঘুমন্ত বাচ্চাটাকে বউয়ের কোলে দিয়ে হারুন হঠাৎ এগিয়ে গিয়ে নিচু হয়ে ড্রাইভারের পা ছুঁলো, লোকটা অপ্রস্ত্তত হয়ে জড়িয়ে ধরলো তাকে। সে মৃদুকণ্ঠে বললো, এই প্রথমবারের মতো – ‘আমার বাবাও মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, শহীদ হয়েছেন। তাঁর কথা মনে নেই আমার, কবরটা কোথায় তাও জানি না। আপনাকে সালাম করে আমি আমার ভালোবাসাটুকু তাঁকে পৌঁছে দিলাম।’ লোকটা যেন হতভম্ব হয়ে গিয়েছেন, শক্ত করে হারুনকে ধরে রেখেছেন বুকের ভেতর, এলোপাতাড়ি চুমু খাচ্ছেন কপালে-গালে-চোখে, যেন অনেকদিন পর হারানো শিশুপুত্রকে খুঁজে পেয়েছেন। মুখে কথা জুটছে না, ইশারায় হারুনের বউকে কাছে ডাকলেন তিনি, তারপর দুই বাচ্চাকে একসঙ্গে কোলে তুলে নিলেন। বিস্ময় নিয়ে তারা দেখলো – লোকটার দুই গাল ভেসে যাচ্ছে জলে। স্ট্রিটলাইটের আলোয় চিকচিক করছে অশ্রুবিন্দু, মুক্তোদানার মতো। ওদেরকে সঙ্গে নিয়েই তিনি এগিয়ে চললেন শাহবাগের দিকে। এই মোড় এমনিতেই কখনো ঘুমাতো না, আর এখন এখানে জমেছে লক্ষ প্রাণের মেলা। রাতের শহর কেঁপে উঠছে বিবিধ শিহরণ জাগানো স্লোগানে। আহা! কী অসামান্য এই জেগে থাকা!
পারবে তো ওরা? ঘাতকদের বিচার হওয়ার আগ পর্যন্ত এই আনেদালনকে টেনে নিয়ে যেতে পারবে তো? – হারুন ভাবলো। যদি পারে, যদি ওই ঘাতকগুলোর বিচার হয়, তাহলে এবার সে সত্যি সত্যি বাবার কবরটা খুঁজে বের করবে। সৌধ নির্মাণ করতে না পারুক একগুচ্ছ বেলিফুল দিয়ে কবরটা সাজিয়ে তুলবে, আর চারপাশে লাগিয়ে দিয়ে আসবে বেলিফুল গাছের চারা। মায়ের কাছে সে শুনেছে – বেলিফুল বাবার খুব প্রিয় ছিল।