শেফালির মসৃণ কিন্তু ঈষৎ ভারী তলপেটের কোমল খাঁজ থেকে হঠাৎ নিজের লাঙলচষা শক্ত হাতটা সরিয়ে এনে হিম-শীতলচাপাগলায় আবুল বাশার বলে, ‘বিয়ার আগেই তোর পেটে বাচ্চা আছিলে, ঠিক না!’
একমাস আগে বিয়ে করা নতুন বউকে ঠিক প্রশ্ন নয়, তার কাছে কৈফিয়ত চাওয়া বা জবাবদিহিতাও নয় যেন, বরং বাশারের কণ্ঠে একধরনের হতাশ বিস্ময়। ক্ষোভ নয়, ঘৃণা নয়, বরং তার কথাগুলো যেন যন্ত্রণাকাতর এক অশরীরী অন্ধ আর্তি যা ঘরের বদ্ধ অন্ধকারে একা-একা ঘুরপাক খায়। জীর্ণ বেড়ার ঘরের ফাঁক-ফোকর চুঁইয়ে আসা চাঁদের আলোয় বাশারের চোখমুখের অভিব্যক্তি বোঝা যায় না, শুধু তার আহত অসহায় কণ্ঠস্বর অস্পষ্ট ঝাপসা আঁধারে ঘরময় যেন পা ছেঁচড়ে-ছেঁচড়ে গোঙায়। শেফালি কেমন চমকে ওঠে। বাশার গড়িয়ে সরে যায় চৌকির অন্য প্রান্তে। তারপর হাত-পা মেলে পানিতে ভাসতে-থাকা মৃতদেহের মতো চিৎ হয়ে শুয়ে থাকে। কয়েক রাত ধরে বারবার দেখা স্বপ্নটার কথা মনে পড়ে শেফালির। এক কূল-কিনারাহীন অথই নদী সে যেন কিছুতেই পার হতে পারছে না, হাত-পা ছুড়ে সাঁতারকাটার চেষ্টা করছে, আর প্রবল স্রোতে ভেসে যাচ্ছে, ডুবে যাচ্ছে, আর খাবি খাচ্ছে, দম বন্ধ হয়ে আসছে তার, মনে হচ্ছে বুকের মধ্যে পানি ঢুকে গেছে, শরীর ভারী হয়ে আসছে, সে তলিয়ে যাচ্ছে অতলে।
‘মোর মনে আগেই সন্দেহ হইছিলে …’
আবছা অন্ধকারে বাশারের অস্ফুট কণ্ঠ আবার শোনা যায়। শেফালি নিরুত্তর। বাশারের অসহায় নিশ্বাসের শব্দ শোনা যায়।
পাশ ফিরে শুয়ে শক্ত বালিশে মুখ গুঁজে শেফালি গুনগুন করে কাঁদে। তার সঙ্গে উপকূলের আকাশও কাঁদে। অন্ধকার চিরে দিয়ে ক্রুদ্ধ চোখে বিদ্যুৎ চমকায়। শত দৈত্যের শক্তি নিয়ে শোঁ-শোঁ আওয়াজ তুলে বাতাস আসে। শেফালিদের দুর্বল বেড়ার ঘর সেই ঝড়ো বাতাসের সজোর ধাক্কায় প্রবলভাবে নড়তে থাকে। ওর বুক কাঁপে। ভয় লাগে। উড়ে যাওয়ার ভয়, মরে যাওয়ার ভয়। মসজিদে কান্নার মতো আজানের সুর ভীতি আরো বাড়িয়ে দেয়। মড়মড় করে উঠানের ফলবতী জামগাছটা ভেঙে পড়ে।
‘আহ্-হা রে, মোগো দাদি গাছটা লাগাইছিলে…’
ঘরের পেছনে ছোট্ট কদমগাছটা শেকড়সুদ্ধ উপড়ে পড়ে।
‘বর্ষাকালে হেই গাছটা আর ফুল দেবে না…’ বাজ পড়ার কান- ফাটানো শব্দ শোনা যায়। গাঙে পানি বাড়ে। নদীতে পানি বাড়ে। খালের মধ্যেও হু-হু পানির স্রোত। হুড়মুড় করে পাকঘরটা পড়ে যায়। মা চিক্কাইর দিয়া ওডে। ছোট ভাইবোনগুলো আরো জোরে চিক্কাইর দেয়। শেফালির বড় ডর লাগে। এবার বাতাস এসে বড় ঘরটার চাল উড়িয়ে নিয়ে গেলে সবাই দৌড়ে পাটোয়ারী গো পাকা দালানে গিয়া ওঠে। দালানঘরে গ্রামের আরো ঝড়-বিহবল আশ্রয়হীন মানুষজন গাদাগদি করে আছে। ঝড়-জলের ঝাপটায় শেফালির গায়ের ফুলঅলা ফ্রকটা ভিজে যায়। ফিতায় বাঁধা বেণি ভিজে যায়। শেফালির কিশোরী শরীরে ফ্রক ভিজে লেপ্টে গেলে তার ছোট্ট বুকটা প্রকাশ্য হয়ে ওঠে। ভারি লজ্জা লাগে ওর। পিঠটা কুঁজো করে বেঁকে থাকে শেফালি, হাঁটু ভাঁজ করে বুকের সঙ্গে লাগিয়ে বসে থাকে, যাতে তার বুকের রেখা স্পষ্ট করে না বোঝা যায়। এমন ঝড়-জল-সাইক্লোনের মধ্যেও কারো কারো লোভী চোখ যে তার বুকের ওপর আছড়ে পড়ছে, কেউ-কেউ যে নানা উসিলায় তাকে ছুঁয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে, সেটা শেফালি ভালোই বুঝতে পারছে।
রেড ক্রিসেন্টের ভলান্টিয়াররা লোকজনকে আশ্রয়কেন্দ্রের উঁচু দালানে নিয়ে যাচ্ছে। সেখানেও গিজগিজ করছে মানুষ, ছেলে-বুড়ো, নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর, সঙ্গে গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগিও আছে। এতো ভিড়ের মধ্যেও শোয়ার চিন্তা, ঘুমানোর চিন্তা, খাওয়ার চিন্তা সব ছাপিয়ে নিজের মাসিকের তেনা কীভাবে পালটাবে, কোথায় ফেলবে, আবার ফেললেও বা নতুন আরেকটা তেনা কই পাবে, ভেবে অস্থির লাগে শেফালির। নিম্নাঙ্গে আঠালো চটচটে একটা অস্বস্তিকর অনুভব নিয়ে সে ঝড়-বৃষ্টি থামার জন্য অপেক্ষা করে। বাড়িঘর ফেলে আসা মানুষগুলির চেহারাও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় ফ্যাকাশে হয়ে আছে। এরই মধ্যে বয়স্ক কেউ-কেউ নিচু গলায় বহু আগের প্রলয়ঙ্করী ঝড়-তুফান-জলোচ্ছ্বাসের গল্প শুরু করে।
‘হেইক্কালে বুক পেঁচায়া নারকোল গাছ ধইরা বাঁইচ্যে আছিলাম, বুজজো, ঢেউ কী আইছে, এক্কেলে ১০ তলা দালান তমেত উঁচা, মোর কোলে আছিলে মোর ভাইগ্না, হেরে পানিতে কই যে ভাসায়া লইয়া গেলে, আর খুঁইজ্যে পাইলাম না …’
এক কোনায় শাড়িকাপড় ঝুলিয়ে আলাদা করা হয়েছে একটা পোয়াতি বউয়ের বাচ্চা প্রসবের জন্য। বউটার চাপা কণ্ঠের গোঙানি শোনা যাচ্ছে, তাকে ঘিরে আছে বয়স্ক মহিলারা। মাঝে মাঝে কৌতূহলী শিশুরা শাড়িকাপড়ের ঘের সরিয়ে উঁকি দিচেছ, আর বড়দের ধাতানি খেয়ে সরে আসছে।
‘নাভি দিইয়ে বাচ্চা বাইরাইবে দেহিস…’
একজন বিজ্ঞের মতো তার সমবয়সী সঙ্গীদের ফিসফিস করে বলে। ওদের মধ্যে একটু বড়টা ফিক্ করে হেসে ফেলে। তারপর মাথা নেড়ে বলে –
‘তুই জানো না, বাচ্চা কোম্মে দিয়া বাইরাইবে… মুই জানি… কমু না…’
শিশুরা কোলাহল করে বেরিয়ে যায়।
বাথরুমগুলির সামনে লম্বা লাইন। শেফালির তলপেট ব্যথায় টনটন করে। সে পেশাব চেপে চুপচাপ বসে থাকে। একসময় ঝড়-বৃষ্টি থামে, বাড়িঘর থেকে পানি নেমে যায়, আশ্রয়কেন্দ্র ছেড়ে মানুষজন ঘরে ফেরে; কিন্তু ঘর কি আর ঘর আছে? শেফালিরা আসলে ফিরে আসে ধ্বংসস্তূপে, যেন এটি তাদের রেখে যাওয়া সেই চেনা পুরনো বাড়ি নয়, অন্য কারো বাড়ি, অন্য কোনো ঘর। যেন কোনো মত্ত হাতি মনের খেয়ালে দুমড়ে-মুচড়ে ভেঙে দিয়ে চলে গেছে চারপাশ। এই ঘর তাদের অচেনা। এই বাড়ি-সংসারও স্মৃতিচিহ্নহীন। তবে উপকূলের মানুষের কাছে তো এইয়া নতুন না। হেগো বাড়িঘর কতবার ঝড়-তুফানে ভাইঙ্গে লইয়ে গেছে, আবার কতবার ফের বানানো হয়েছে। তবে এইবার মুশকিল করলো শেফালির বাপ রজব বেপারির ঠ্যাং। তুফানের দিন কোম্মেদ্যে এক গাছের ডাল আইয়ে পড়ছেলে হের ঠ্যাংগের উপরে, হেরপর হইতে ঠ্যাংডা আছে অবশ হইয়ে। বউ আর মেয়ের কাঁধে ভর দিয়ে রজব নিজের হতচ্ছাড়া ভিটায় এসে দাঁড়ায়, দাঁড়াতে তো আর পারে না, বসে পড়ে। আর আশপাশে যা আছে তাই দিয়ে শেফালিকে নিয়ে ঘর বাঁধতে লেগে যায় রজবের বউ, এইদিক ঢাকে তো ওইদিক উদাম হয়ে যায়, ওইদিক ঢাকে তো আরেকদিক ফাঁকা হয়ে পড়ে। এর মাঝেই টুকাইয়া-টাকাইয়া কয়েকটা হোগলাপাতা পাইছেলে আর এহানে-ওহানে পইড়্যে থাকা কিছু ভাঙা বাঁশ-কাঠ জোড়াদ্ দিয়া কোনোমতে থাকনের মতো একটা চালা বানানো গেল – হোক সামান্য চালা, তবু নিজের ভিটা তো – সেই আনন্দেই হয়তো ছোট চারটা ভাইবোনের সঙ্গে ঠাসাঠাসি-জড়াজড়ি করে অনেকদিন পর শঙ্কাবিহীন একটা ভালো ঘুম হয় শেফালির।
বাশারের ঘরেও তার ভালোই ঘুম হচ্ছে, প্রায় অকস্মাৎ বোমা ফাটানোর মতো স্বামীর মুখে এতবড় একটা অভিযোগ শুনেও কোনো কথা না বলে হয়তো কাঁদতে-কাঁদতেই ঘুমিয়ে পড়ে শেফালি, ফলে বাশার যখন হিস্-হিস্ করে বলে – ‘কাইল বিয়ানেই বাজান রে দিয়া তোরে বাপের বাড়ি পাডাইয়ে দিমু…’ তখনো ঘুমকাতুরে শেফালি নিঃশব্দে ঘুমায়, তার ঘরের ভেতরে তখন কলকল করে বয়ে যায় হাঁটুপানি, সেই পানি ধীরে-ধীরে কোমর তমেত ওডে, হেরপর গলা তমেত, গলা ছাড়াইয়ে মাথা… শেফালি অহন ডুইব্যে যাইবে… শেফালি ভাইস্যে যাইবে… ‘মাগ-গো মা, মোরে বাঁচাও…’
শেফালির ঘুম ভেঙে যায়। ঘুম ভাঙলে পেটের ভেতর ক্ষুধা হামাগুড়ি দেয়। সম্বল বলতে তো রিলিফের কয়েক কেজি চাল, শেফালির মা সেগুলিই কৃপণের মতো খরচ করে। রজব পাটোয়ারীর ভাঙা ঠ্যাং পানিতে ভাসা-মরা জীবজন্তুর শরীরের মতো ফুলে উঠলে শেফালির মা বেতাগীর পীর সাহেবের কাছ থেকে পানি পড়া এনে খাওয়ানোর চিন্তা করে।
খালেকের বাপ এসে খবর দেয়, দফাদারের কাছে নাকি রিলিফের টিন এসেছে। রজব ব্যাপারী চৌকিতে শুয়ে কাতরায়। শেফালি জিজ্ঞেস করে, ‘অ মা, মোরা কি হেইলে টিন পামু না? আববায় তো যাইতে পারবে না-নে, লাইন ধরতে হইবে, নাম লেহাইতে হইবে…’
মা পাটোয়ারীগো বাড়িতে কাজে যাওয়ার মুখে বলে, ‘হেইলে তুই-ই যা…’ একটু থেমে আবার বলে, ‘মাথায় কাপড় দিইয়ে যাইছ কইলাম…’
একটা ছেঁড়া ওড়না দিয়ে মাথাটা ঢেকে শেফালি যায়। দফাদারের উঠানে অভাবী মানুষের ভিড়ের মধ্যে মিশে দাঁড়ায়। খাতার মধ্যে নাম-ঠিকানা লেখায়।
‘টেকা আনছো?’
দফাদার জিজ্ঞেস করলে শেফালি মাথা নাড়ে। টেকা তো সে আনে নাই। কোথা থেকেই বা আনবে, যেখানে তাদের পেটের ভাতই জোগাড় হয় না। বাপটা বিছানায় পড়া। মা কাজ করে পরের বাড়ি।
‘টেকা না দিলে টিন নাই। যাও বাড়ি যাও।’
শেফালি তবু মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। খালি হাতে ফিরে যাবে সে? এত আশা করে এসেছে।
‘কি রে, গেলি না? কইছি না মাগনা টিন দেয়া যাইবে না? … খাড়াই রইছো ক্যাঁ? এ্যাঁ? কথা কানেদ্ দিয়া যায় না?’
এবার দফাদার গলা চড়ায়। শেফালি মাটির দিকে চোখ রেখে মিনমিন করে, ‘তুফানে মোগো ঘর ভাইঙ্গে গেছে… টিন লাগবে…’
দফাদার এইবার তাকে আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে। একটু আড়ালে ডেকে নিয়ে বাড়িঘরের খোঁজখবর নেয়। কার মেয়ে? কোন বাড়ি? কেমনে চলে? ইত্যাদি। তারপর গলা নামিয়ে বলে –
‘টিন দিমু… রাইত্যে আহিছ, অহন যা।’
বয়স কম হলেও ‘রাইত্যে’ আসার অর্থ বোঝার মতো বুদ্ধি তো হয়েছে শেফালির। শূন্য হাতে বাড়ি ফিরে মায়ের কাছে সব বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলে সে। মায়ের চোখে হঠাৎ যেন তীব্র আগুন জ্বলে ওঠে। ‘মাউগ্যার পোলা তোরে এইয়্যা কইছে? শুয়ারের বাচ্চা… হে পাইছে কী? মোর নাবালিকা মাইয়াডারে একলা পাইয়া হে এমুন কুপরস্তাব দেতে পারলে?… লাগবে না মোগো এমুন টিন, লাগবে না…’
ছোট ভাইটা ঘরের ভেতরেই খেলছিল। কিছু না বুঝেই মায়ের কথার পিঠে সে সরলভাবে বলে – ‘ও মা, হেইলে বর্ষাকালে মোরা তো ভাইস্যা যামু…’
মা চিৎকার করে, ‘ভাসলে ভাসুম… হেইত্যে কী অইছে? মোর ঘর ভাঙাই থাউক… ’
হেরপর ধীরে ধীরে বামনা-বেতাগী-আমতলী-পাথরঘাটার আকাশজুড়ে সন্ধ্যা নামে। ঘরে-ঘরে মহিলারা কুপি বাতি জ্বালিয়ে সাঁঝলা দেয়। শেফালির মায়ের চেহারাও আকাশের রঙের মতো বদলাইতে থাকে। হোগলা পাতার ফাঁক-ফোকর দিয়া ঘরে চান্দের আলো ঢোকে। মায়ের জ্বলন্ত ক্রোধ, উচ্চকণ্ঠ চিৎকার ধীরে-ধীরে অসহায় কান্নার রূপ নেয়, রাগ এবার পানি হয়ে চোখ দিয়ে, গাল বেয়ে গড়িয়ে নামে। মা-মেয়ে গলাগলি ধরে কাঁদে। ভেজা মাটির দাওয়া মা-মেয়ের চোখের পানিতে ভিজে আরো স্যাঁতসেঁতে হয়ে ওঠে। ভাঙা চৌকি থেকে অবশ পা নিয়ে রজব চেঁচায়, ‘অইছে কী? এ্যাঁ? মা-য়ে-ঝি-য়ে মিইল্যা অতো কান্দনের কী অইছে? মোরে কওনা ক্যাঁ? মুই কি মইর্যে গেছি? মোরে মানু মনে করো না… এ্যাঁ?’
দুই.
রাতের আধো-অন্ধকারে দফাদারের জ্বলজ্বলে চোখের লোভ দেখা যায় না। গোঁফের আড়ালে তার বয়স্ক মুখের ভাবও বোঝা যায় না। শেফালির কচি নাকে শুধু ঝাপটা মারে ঘামের গন্ধ, সঙ্গে জর্দা-পান-তামাকের ঘ্রাণ। অনাথ হরিণশাবকের মতো একলা জঙ্গলে শেফালি ভয়ে থরথর করে কাঁপে। অজগরের বিশাল হা প্রসারিত হয়। সামান্য ঝটপটানি, হয়তো দুর্বল প্রতিরোধ। অস্ফুট চাপা একটা আর্তচিৎকার। ফুঁপিয়ে-ওঠা কান্নার মৃদু শব্দ। তারপর সব চুপচাপ। অখন্ড স্তব্ধতা। ঘন-ঘন শ্বাস ফেলার শব্দ। অজগর হরিণশিশুটিকে গিলে খায়। যেন জলের গভীরে দমবন্ধ হয়ে আসে শেফালির। ফুলের ছাপাঅলা ফ্রকটার কোনা ছিঁড়ে যায়। খুলে যায় বেণিকরা চুলের লাল ফিতা। বুকের কাছে থেকে যায় নখের কয়েকটি কুৎসিত আঁচড়। তারপর ক্লান্তি, তারপর গ্লানি, তারপর টলতে-টলতে ফিরে আসা।
তিন.
শেফালিদের ভাঙা ঘরের চালে হোগলাপাতার জায়গায় চকচকে টিন লাগে। সদর হাসপাতালে রজব ব্যাপারীর ভেঙে যাওয়া পায়ের চিকিৎসা হয়। অনেকদিন পর ছোট ভাইবোনগুলি পেটভরে ভাত খায়। এক রাতের ব্যবধানে বড় হয়ে যাওয়া শেফালি কোঁকায়।
‘মা, হাঁটতে গেলে মুই একছেড় ব্যথা পাই।’
‘ঠিক হইয়া যাইবে মা।’
‘মা, রাইত্যে মোর ঘুম আহে না, ভয় লাগে, খারাপ স্বপন দেহি।’
‘উয়াও ঠিক হইয়া যাইবে মা। ভয়ের কিচ্ছু নাই। আল্লার নাম লইয়া বুকে ফুঁ দেও। ভালো লাগবে।’
‘মা, মোর একছের শরীল কাঁপে, বুক একছের ধড়ফড় করে, শইল্যে জোর বল পাই না।… মা মুই মইর্যা যামু।’
‘উয়া কয় না মা… উয়া কয় না, মোর কাছে আহো মনু, মুই তোমারে ধইর্যা রাখছি…’
মায়ের উষ্ণ শুকনো বুকে মাথা রেখেও যেন গভীর এক অন্ধকারে, দগ্ধ দেহ, আরো দগ্ধ অন্তর, ক্রন্দনদীর্ণ কাতর চক্ষু নিয়ে শেফালি বাতাসে মেলে রাখা কাপড়ের মতো কাঁপতে থাকে। মায়ের বুক ফেটে যায়, মেয়ের নিষ্পাপ চোখের দিকে তাকালে অচেনা এক অপরাধবোধ এসে গলাটিপে ধরতে চায়। মায়ের মনে হয় সংসারের যূপকাষ্ঠে নিজের কচি মেয়েটাকে তিনি বুঝি নিজ হাতে বলি দিয়েছেন। আর অবুঝ নিরপরাধ মেয়েটা কিছু না বুঝেই নিঃশব্দে নিজেকে উৎসর্গ করেছে পরিবারের নিরুপায় অসহায়ত্বের কাছে। তারপরও আরো কয়েকবার রাতের আঁধারে দফাদারের বাড়ির পথে হাত ধরাধরি করে আসা-যাওয়া করে মা ও মেয়ে।
বাড়ির সামনে টিউবওয়েল বসে। দফাদারের চালের আড়তে রজব ব্যাপারী দারোয়ানের চাকরি হয়। সংসারের অতিসামান্য সচ্ছলতায় হঠাৎ-হঠাৎ মায়ের বুক হাহাকার করে ওঠে। আহ্হা রে, মোর গেদা মাইয়াডারে জাইন্যা-শুইন্যা যমের বাড়ি পাডাইলাম, মোরা হেরে বেইচ্যে দিলাম। এইডা মোরা কী করলাম? এই তুফানে মোগো মরণ হইল না ক্যাঁ? মোরা কিরপান্যে বাঁইচ্যা রইলাম?… বুকের মধ্যেকার কষ্ট ও যন্ত্রণার এমত কাঁটাঅলা চিক্কুইরটাকে জোর করে গিলে খেয়ে শেফালির মা যেন পাথর হয়ে যায়। শেফালির অভিযোগ এবার অন্যরকম।
‘মা, মোর একছের মাথা ঘোরায়, বমি-বমি লাগে…’
এইবার শেফালির মা সত্যি চিন্তিত হন। তার কপালে উদ্বেগের ভাঁজ পড়ে। হাতের কাজ ফেলে রেখে মেয়ের কাছে এসে নিচুস্বরে জিজ্ঞেস করেন – ‘এই মাসে তুই মাসিক দেখছো? দেহো নাই?’
শেফালি অনিশ্চিত মাথা নাড়ে। ‘মনে লয়, দেহি নাই।’
‘কয় মাস ধইর্যে দেহো না?’
এবারও শেফালি ঠিক উত্তর দিতে পারে না। ‘দুই মাসও হইত্যে পারে… আবার তিন মাসও…’
মা আতঙ্কে আঁতকে ওঠেন। কী বিপদের কথা। পুরা গেরামের মানুষ এইবার সবকিছু জানবে। কলঙ্ক দেবে। ছি-ছি করবে। মুখের উপরে থুক দেবে। গলায় দড়ি দেওন ছাড়া মোগো আর উপায় থাকপে না-নে। শেফালির মা এবার দফাদারের পায়ের কাছে উপুড় হয়ে পড়ে।
চার.
এক রাতের মধ্যে শেফালির বিয়ে ঠিক হয়ে যায়। তড়িঘড়ি পাত্র নির্বাচন করা, বিয়ের যাবতীয় খরচপাতি দেওয়া, সবকিছুর সুচারু ব্যবস্থা করে দফাদার। পাত্র অন্য কেউ না। দফাদারের বর্গাচাষি আবুল বাশার। বাশারেরা দুই পুরুষ ধরে দফাদারের জমি বর্গা নিয়ে চাষ করে।
নির্ঘুম চোখে চৌকির ওপর এপাশ-ওপাশ করে বাশার।
শেফালি রে বাপের বাড়িতে পাডাইলে দফাদার কি আর তাদের জমি দেবে?
জমি না দিলে তারা হরবে কী? খাইবে কী?
ভোরের আলো টিনের চালের ছিদ্র গলে চৌকির ওপর এসে শেফালির ঘুমন্ত মুখের ওপর পড়ছে।
আবুল বাশার গড়িয়ে এসে শেফালিকে জড়িয়ে ধরে হু-হু করে কাঁদতে থাকে।