মুখপানে চেয়ে দেখি

ঘরের মধ্যে একটা না আলো, না আঁধার। কোত্থেকে একটা ম্লান আঁধার ম্লান আলো ঘরে ঢুকে ঘরটাকে অন্যরকমের করে তোলে। ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে মোতালেব আবিষ্কার করে, এই না আলো, না অাঁধারির মধ্যেও ঘরের মেঝেটা বেশ ঝকঝকে। মোতালেব টের পায়, ঘরের মেঝে থেকে একটা ঠান্ডা স্রোত তার পায়ের তলা বেয়ে সবকিছু ঠেলেঠুলে বুকের কাছটায় চলে আসছে। ঠান্ডা পেয়ে তার বুকটা ভারী হয়ে আসে। মেঝেটা এমনই ঠান্ডা!

চায়ের দোকানঘর থেকে একটা গলি ঢুকে গেছে, সেই গলির দুপাশে টিনের সার-সার ঘর। ঘরটা একেবারে গলি-লাগোয়া। ছোট ঘর। সাত হাত বাই নয় হাত। মোতালেব ঘরে ঢুকে ভালো করে লক্ষ করে, ঘরের বিছানাটা স্বাভাবিক উচ্চতার চাইতে একটু বেশি উঁচু। আর বিছানাটা এতো পরিপাটি করে বিছিয়ে রাখা হয়েছে যে, দেখলেই বিছানায় ঘুমিয়ে যেতে ইচ্ছে করে। বালিশ দুটোও যেন পেটফোলা বেড়াল। নাদুস-নুদুস কোলবালিশ রামপালের সাগরকলার মতো ফুলে-ফেঁপে আছে। ঘরের দক্ষিণ কোণে বুকসমান উচ্চতায় একটা ময়লা রঙের দুপাল্লার কাঠের জানালা। খিল মারা। খিলটা পুরোপুরি মারা হয়নি, যার ফলে জানালাটা একটু ফাঁক হয়ে আছে। এই ফাঁক হয়ে থাকার ফলে বাইরে থেকে বন্য মোষের মতো তেড়ে আসা আলোর টুকরো-টাকরা ঘরের বিছানায় এসে গড়াগড়ি খাচ্ছে। আর তাতেই ঘরের মধ্যে ওরকম একটা না আলো না আঁধারি বাইজির মতো কোমর দোলাচ্ছে।

মোতালেব ঠিক ঠাওর করে উঠতে পারে না, তবে ঘরে ঢোকার পর কেমন একটা হিম-হিম ভাব তাকে

জেঁকে ধরে। নিজের ঘরের সঙ্গে মেলাতে চেষ্টা করে সে। তার ঘরটাও তো ছোট। তবে এর চেয়ে একটু বড়ই হবে। কেমন একটা ধন্দের মধ্যে পড়ে গিয়ে নিজেকে নিজে প্রশ্ন করে মোতালেব, ভুল করে অন্য কারো ঘরে ঢুকে পড়লাম না তো! ঠিক এমন সময় একটা শিরশিরানো ভয়ের ধারা তার মেরুদন্ডের ওপর থেকে জলপ্রপাতের মতো নিচে নেমে আসে।

ঘরের দরোজা বন্ধ করার আগ পর্যন্ত মোতালেবের মধ্যে কোনো ধরনের ভয় কাজ করেনি। বরং একধরনের শিহরণ লাগছিল। অন্ধকারে বেড়ালের চোখ যেমন পিটপিট করে জ্বলে, ঘরের মধ্যে দিনের বেলাতেও একটা লাইট সেরকম করে জ্বলছে। মেয়েটা ঘরে এসে ঢুকল। ঢুকে ঘরের দরোজা বন্ধ করে দিয়ে বিছানার কোণে গিয়ে বসল। জংধরা পুরনো বাক্স খুললে যেরকম আওয়াজ বের হয় দরোজা বন্ধ করার সময় দরোজা থেকে ঠিক সেরকম একটা আওয়াজ উঠল। দরোজা বন্ধ করে মেয়েটা ঘুরে দাঁড়াল।

মোতালেব দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকে। তাকে অমন ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মেয়েটা বলল, কই দাঁড়ায়া রইছেন কেন! বিছানায় আইসা বসেন।

মোতালেব দাঁড়িয়ে থেকে মেয়েটার দিকে ভালো করে তাকাল। মেয়েটার বয়স কত? খুব বেশি হলে বিশ বা বাইশ! শরীরের বাঁধন আর কাঠামো তারই পূর্বাভাস দেয়।

বিছানা লাগোয়া একটা ভাঙা টেবিল। মোতালেব টেবিলের পাশে রাখা চেয়ারে বসল। বসে মেয়েটাকে লক্ষ করল।

লাইটের ছিটকে আসা আলো মেয়েটার কপাল, সিঁথি, গাল, চিবুকে পড়ে ঝলক দিয়ে ওঠে। মোতালেব সঙ্গে সঙ্গে চোখ নামিয়ে নেয়। মেয়েটা মোতালেবের দিকে মুখ করে তাকিয়ে বাচ্চাদের মতো হেসে দিয়ে বলল, এর আগে কি আপনি আমার ঘরে আর আইছিলেন?

বলে কি! মেয়েটার কথায় মোতালেব রীতিমতো আকাশ থেকে পড়ে। সে কেন মেয়েটার ঘরে এর আগে বা পরে আসতে যাবে? বিয়ের আগে একবার এসেছিল। এই নিয়ে দ্বিতীয়বার এলো।

আগেরবার পাড়ায় ঢুকে একটা চায়ের দোকানে বসে চা খাচ্ছিল মোতালেব। হঠাৎ চোখ পড়ে একটা মেয়েকে। সরু গলি। নোংরা ড্রেন। ড্রেনের দুদিকে লম্বা খোপ-খোপ ঘর। একটা ঘরের রকে বসে থাকা একটা মেয়েকে দেখে মোতালেবের বুকটা তাকে জানান না দিয়েই ছ্যাঁৎ করে উঠেছিল। মেয়েটা দেখতে অবিকল রেশমা! সে শুনেছে, মানুষ নাকি দেখতে একরকমের হয়, তাই বলে এতোটা! আর দেরি করেনি মোতালেব। সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে গিয়েছিল পাড়া থেকে।

মোতালেব খানিকক্ষণ মাথা নিচু করে থাকার পর নড়েচড়ে বসল। তার কিছু একটা বলা দরকার। কিন্তু সে বলবেটা কী? মেয়েটার দিকে চোখ তুলে তাকাল। তারপর বলল, টাকা নিয়ে তুমি কোনো চিন্তা করো না। যতটুকু সময় থাকবো তুমি তার দ্বিগুণ টাকা পাবে। আমি তোমার সঙ্গে কথা বলতে এসেছি।

আপনে আমার লগে খালি কথা বলতে আইছেন! বলে মেয়েটা হেসে দিলো। তারপর বলল, আপনের মতো এইরকম সাধু-সন্ত মানুষ পাইলে তো ভালোই হইতো। কাম না কইরা খালি গপসপ করতাম।

মেয়েটার এই কথার বিপরীতে মোতালেব কী বলবে? কী বলা উচিত ভেবে পায় না।

মোতালেবের মনে হলো তার কথায় মেয়েটার কপালে একটা ভাঁজ পড়ল। মনে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাপারটা আরো পরিষ্কার করার জন্য মোতালেব বলল, তুমি কোনো চিন্তা করো না। তারপর ভুল করে বলে ফেলল, আই উইল পে ইউ। ভুল হয়ে গেছে বুঝতে পেরে মোতালেব সময়ক্ষেপণ না করে কথাটার বাংলা তর্জমা করে বলল, আমি কথা বলার জন্যও তোমাকে টাকা দেবো।

ইংরেজি কওনের পর আবার এর বাংলা ট্রান্সলেশন করার কী কারণ? আমি তো আপনের কথা বুঝছি। মোতালেবের কথায় মেয়েটা নির্বিকারভাবে বলল।

এর মধ্যে বাইরে থেকে দরজায় ধাক্কা পড়ল, আনোয়ারা মেহমানের লাইগা চা আনছি। দরজা খোল –

আনোয়ারা! একটু আগে মেয়েটা যে মোতালেবকে বলেছিল তার নাম পপি! তার মানে পপি নামটা মিথ্যে? একটা মানুষের কয়টা নাম হতে পারে? এসব জায়গায় মেয়েদের একাধিক নাম থাকে। আনোয়ারা নামে যে বাইরে থেকে মেয়েটাকে ডাকল, সে-নামও তো মিথ্যে হতে পারে! এতোক্ষণ মেয়েটা কিংবা পপি কিংবা আনোয়ারা মোতালেবের সঙ্গে যা যা বলল তার সবই কি মিথ্যে?

পপি কিংবা আনোয়ারা বিছানা থেকে নেমে গিয়ে দরোজা খুলে দিলো। বিছানা থেকে নামার সময় পপির ফর্সা কাঁধ, গলা, কণ্ঠার হাড় – সব অধিকতর স্পষ্ট হয় মোতালেবের কাছে। একটা রংচঙা ফলমূল-অাঁকা প্লাস্টিকের ট্রেতে দু-কাপ চা নিয়ে মাঝবয়সী এক মহিলা দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। পপি মহিলার হাত থেকে চায়ের ট্রেটা নিয়ে ঘরের ভেতরে ঢুকে টেবিলে রাখল। চায়ের কাপ থেকে ধোঁয়া উড়ছে।

চায়ের কাপ থেকে ধোঁয়ারা যখন উড়ে যাচ্ছিল, তখন পপি আবার দরোজাটা বন্ধ করে দিলো। বন্ধ করার সময় আবারো সেই জংধরা পুরনো বাক্স খোলার আওয়াজ।

মোতালেব চুপ করে বসে থাকে।

গরম-গরম চা খান – পপি বলল।

আমি রং-চা খাই না –

তাইলে আপনের চায়ে দুধের ব্যবস্থা করুম? পপি এমনভাবে কথাগুলো বলল যে, মনে হয় এখনই ও জাদু দিয়ে রং-চাকে              দুধ-চায়ে রূপান্তর করে ফেলবে!

না, না আমি চা খাবো না।

আপনে চা না খাইলে আমি কেমনে খাই?

আমি জানি তুমি রং-চা খুব একটা পছন্দ করো না।

আপনি ক্যামনে বুঝলেন আমি রং-চা পছন্দ করি না?

আর কথা বাড়াল না মোতালেব। চায়ের কাপটা নিল। পপিও নিল।

চা খাওয়া শেষ হলে মোতালেব একটা সিগারেট ধরায়। পপির সঙ্গে কথা বলে। আর পপিও খুব অবাক হয়, লোকটা তো তার সঙ্গে কাজ করছে না! শুধু কথাই বলে যাচ্ছে। কত প্রসঙ্গে মোতালেব যে পপির সঙ্গে কথা বলল! পপি সত্যি-সত্যি অবাক হয়ে যায়।

কথাবার্তা শেষ হলে মোতালেব পপির কাছে বিদায় নেওয়ার জন্য বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াল। তারপর পকেট থেকে পাঁচশো টাকার একটা নোট বের করে পপির দিকে বাড়িয়ে দিলো। মোতালেবের টাকা দেওয়া দেখে পপি আরো অবাক হলো। পপি বলল, কাম না কইরা আমি ট্যাকা নেই না। বলে পপি বিছানায় পা তুলে চায়ের কাপটাকে আয়েশ করে দুহাতে চেপে ধরে চা খেতে থাকে।

পপির কথায় মোতালেবের একবার মনে হলো, মেয়েটা তো ন্যায্য কথাই বলেছে। আবার পরমুহূর্তেই মনে হলো, কাজ না করুক তার সঙ্গে, যতটুকু সময় মেয়েটা মোতালেবের সঙ্গে কাটাল ততক্ষণে তো সে দু-একটা কাস্টমারও বিদায় করতে পারত। মোতালেব কিছু বলল না। শুধু পাঁচশো টাকার একটা নোট টেবিলের ওপর রেখে উঠে দাঁড়াল। মেয়েটা অবাক হয়ে তাকিয়ে-তাকিয়ে মোতালেবকে দেখতে লাগল। মোতালেব বেরিয়ে যাওয়ার আগে কী মনে করে পেছন ফিরে দাঁড়াল। দরোজায় দাঁড়িয়ে থেকে মোতালেব নেমে-আসা গলায় বলল, আচ্ছা আমি চলে যাওয়ার পর তুমি কী করবে?

মেয়েটা ভারি অবাক হয়। বাইরে তখন দ্রুত সন্ধ্যা নামছে।

আপনার কথা ঠিক বুঝলাম না –

মোতালেব আমতা-আমতা করে বলল, না, মানে আমি তোমার ঘর থেকে চলে গেলে তুমি কী করবে?

কী আর করুম বয়া থাকুম। এতটুকু বলে পপি হাসল, কাস্টমার আইবো – হেগো লগে… লটর-পটর করমু –

মোতালেব বলে উঠল, আমি চলে গেলেই তো আর কাস্টমার তোমার ঘরে আসবে না। কাস্টমার আসার আগ পর্যন্ত তুমি কী করবে?

মোতালেবের কথায় এবার মেয়েটা হেসে পড়ল, ও-মা! এইটা কিমুনতর কথা? আপনে চইলা যাওনের পর আমি স্নো-পাউডার-লিপস্টিক দিয়া নিজের মুখ বানামু। হেরপর খদ্দের গো লগে কাম করুম।

নিজের মুখ বানামু মানে? মোতালেব ভীষণ বিস্মিত হয়।

মুখ বানাইন্যা বোঝেন না!

মোতালেব বোঝে না। মুখ বানানো, নিজের মুখ বানানো কাকে বলে? সে ভাবতে থাকে, কে কার মুখ বানায়! ভাবতে-ভাবতে ধন্দের মধ্যে পড়ে যায়।

দুই.

মোতালেব লঞ্চ থেকে নেমে অন্য যাত্রীদের মতো কিছুটা পথ হাঁটে। ঘাট থেকে কিছুটা পথ অতিক্রান্ত হতেই দুপাশে গোটা চল্লিশেক সারিবদ্ধ দোকান। সেসব দোকান থেকে একটা খদ্দেরহীন দোকান বেছে নিয়ে মোতালেব বসল। খদ্দের না থাকা দোকানে ঢুকলে দোকানি খদ্দেরকে আলাদা যত্ন-আত্তি করে। মোতালেব বসাতে দোকানে খদ্দের উঠল। মোতালেবের চায়ের তেষ্টা পেয়েছে। কিছুক্ষণ পরপর তার চা খাওয়ার এই তেষ্টাটা জেগে ওঠে। দোকানের কম বয়েসি দোকানি মোতালেবকে দেখে খুশি হয়ে উঠল,

স্যার, বালা কইরা এককাপ খাঁটি গরুর দুধের চা দেই?

চা খাওনের লাইগাই তো তর দোকানে বইছি।

মোতালেবের কথায় দোকানি একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেল বটে কিন্তু দমল না। সঙ্গে সঙ্গে উত্তর করল,

বন বন – আমার দোকানে বন। যা চাইবেন, হগলই পাইবেন।

যা চাইবেন হগলই পাইবেন – দোকানি ছেলেটার কথায় মোতালেব একটু হকচকিয়ে যায়।

এ আবার কেমনতর কথা! দোকানে আছে দুধের চা, বিস্কিট, কলা, বনরুটি, নিমকি, কেক, চিপস, ঝালমুড়ি, চকোলেট, স্নো, পাউডার থেকে শুরু করে আরো অনেক কিছু। লঞ্চঘাট থেকে নামতেই পায়ে-হাঁটা পথের দুপাশে ছোট ছোট টং দোকান। দোকানের পেছনজুড়ে ময়লা। ডাবের খোসা, প্লাস্টিকের বোতল, জুসের বাতিল প্যাকেট, কবেকার বাসি ফেলে দেওয়া হলুদ হয়ে যাওয়া বেলুন (কনডমকে গ্রামদেশের ছেলেপেলেরা বেলুন বলে)। কেউ-কেউ আবার এ-বেলুন মুখে নিয়ে ফুঁ দিয়ে বড় করে তোলে। বোঝা যায় এখন যেখানে অজস্র দোকানপাট গড়ে উঠেছে, সেখানে আগে ছিল দীর্ঘ বালিয়াড়ি। ভূমিদস্যুদের মতো দোকান-দস্যুদের হাতে পড়ে বালিয়াড়ি বেদখল হয়ে গেছে।

মোতালেব ভাবে, দোকানে বসে সে বোধহয় একটা হোঁচটই খেল। দোকানি ছেলেটা যে বলল যা চাইবেন হগলই পাইবেন – কথাটার মানে কী?

তার মানে এই দোকানি মোতালেবকে আর দূর জেলায় বেড়াতে যাওয়ার যাত্রী ভাবেনি। তাহলে কী তাকে ভেবেছে অরিজিনাল কাস্টমার? আসন্ন ধরা পড়ে যাওয়ার একটা ছাপ তার চোখে-মুখে খেলে গেল।

মোতালেব দোকানি ছেলেটার কথার কোনো জবাব দিলো না। সে এর আগে বহুবার দেখেছে, এরকম কথার জবাব দিতে গেলেই প্রতিপক্ষের সঙ্গে অযথা খাজুইরা ধরনের প্যাঁচাল শুরু হয়ে যায়। খাজুইরা প্যাঁচাল ব্যাপারটা মোতালেবের কাছে অসহ্য রকমের বিরক্তিকর।

পাশের দোকানে দুজন বসে কাচের সরু লম্বা কাপে পাকা গম রঙের চা খাচ্ছিল। তাদের বয়সও কম। এর মধ্যে একজনের চেহারার আদল অনেকটা হিন্দি সিনেমার নায়ক রজনীকান্তের মতো। হঠাৎ করে কেউ তাকে দেখলে ভাববে, রজনীকান্ত বুঝি ছবির শুটিংয়ের জন্য গোয়ালন্দ ফেরিঘাটে এসেছে। শুটিংয়ের ফাঁকে টং-দোকানে বসে আয়েশ করে আলগি পাতি মারা ঘন দুধের চা খাচ্ছে।

রজনীকান্তের সঙ্গের কালো বেঁটে মতো ছেলেটা চায়ে চুমুক দিয়ে দোকানিকে ধমক দিয়ে বলল, ওই ব্যাটা তরে কী আমি শরবত বানাইতে কইছি? চায়ের মধ্যে এতো চিনি দিছস ক্যা? হালা ফাউল কোনহানকার। বলে ছেলেটা চায়ের কাপ উলটো করে সব চা ফেলে দিলো মাটিতে। পলিমাটি শুঁষে নিল চা। শুঁষে নেওয়ার দাগটা লেগে থাকল মাটিতে। ছেলেটা চোখ-মুখ খিঁচড়ে পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে দুটো সিগারেট বের করল। একটা দিলো তার রজনীকান্তকে। আরেকটা নিজে। দক্ষ অভিনেতার মতো বাতাস বাঁচিয়ে তারা সিগারেটে আগুন জ্বালাল।

দোকানি ছেলেটা কথায় পালটা উত্তর দেওয়ার সাহস দেখাল না। সে শুধু মিনমিনে গলায় বলল, ভাইরে কী কম চিনি দিয়া আরেক কাপ চা বানায়া দিমু?

না, আমার আর তর এই গরুর চোনা খাওন লাগব না। একটু পরে তো আসল দুধই খামু। বলে ছেলেটা সিগারেটে লম্বা করে একটা টান দিলো। লম্বা করে টান দেওয়ার ফলে ছেলেটার বুক যেন বুকের আরো ভেতরে ঢুকে গেল। আর তার মুখ দিয়ে গলগল করে ধোঁয়া বেরোতে লাগল।

একটু পরে তো আসল দুধই খামু – ছেলেটার কথায় মোতালেবের মুখ খানিকটা গম্ভীর হয়ে আসে। দোকানি ছেলেটা কেটলির গরম পানি দিয়ে চায়ের কাপটাকে ভালো করে ধুয়ে তাতে লাল লিকার ছেড়ে কনডেন্সড মিল্কের কৌটায় ছোট চামচ ঢুকিয়ে নাড়তে-নাড়তে মোতালেবকে বলল, স্যারের চায়ে কী দুধ-চিনি বেশি দিমু?

মোতালেব এবার ভালো করে ছেলেটাকে দেখল। ওর মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে না ও হাসছে কি-না। কিন্তু মোতালেবের ভেতর থেকে কেউ একজন তাকে বলছে, মোতালেব, এই ছেলেটা কিন্তু তোমারে লয়া হাসি-মশকরা করবার ধান্দা করতাছে। দেহো না, ওর মুখের কোনায় ক্যামুন একটা শয়তাইন্যা হাসি বলক দিয়া দিয়া ফুইটা উঠতাছে!

না, চিনি কম। মোতালেব জবাব দিলো।

তাইলে কি চায়ে দুধটা একটু বাড়ায়া দিমু?

না, দুধেরও খুব বেশি দরকার নেই। যতটুকু লাগে ততটুকু দাও। কথাগুলো বলে মোতালেব পাশ ফিরে পাশের দোকানের ছেলে দুটোকে দেখল। ওরা চলে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়িয়েছে। ওদের সঙ্গে একটা কম বয়েসি ছেলে। কম বয়েসি ছেলেটা ওদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কম বয়েসি ছেলেটা এই দুজনকে পেয়ে যেন পাখির মতো বেশ উড়ে উড়ে যাচ্ছে। দুপাশে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা দোকানঘরগুলো তিনজনের পেছনে একা হয়ে পড়ে রইল।

চায়ে চুমুক দিয়ে মোতালেবের উপলব্ধি হলো, ছেলেটা চায়ের মধ্যে তার অনুমতি ছাড়া আলগা পাতি দিয়েছে। তাতে চায়ের মধ্যে কাঁচা পাতার বাড়তি একটা ঘ্রাণ পাওয়া যাচ্ছে। এই ঘ্রাণ আনন্দিত মোতালেবের নাকে এক অন্য ধরনের আবেশ এনে দিলো। কাঁচা চা পাতার গন্ধে সে কেমন উতলা হয়ে উঠল।

কথা না বলে চা খেয়ে শেষ করে মোতালেব। চা-টা ভালোই হয়েছে। চা খাওয়াতে শরীরটা বেশ ঝরঝরে লাগছে। মোতালেব স্থির করে, সে এখন দুসারি দোকানের মাঝ বরাবর হেঁটে ট্রাকস্ট্যান্ডের পাশ দিয়ে কিছুটা পথ এগোবে। রহমতকে ফোন দেবে।

চা শেষ হলে মোতালেব বলল, বেনসন সুইচ আছে? থাকলে একটা প্যাকেটে পাঁচটা বেনসন সুইচ আর একটা ম্যাচ দিও।

মোতালেব আগে লাল বেনসন খেত। বাজারে সাদা রঙের বেনসন সুইচ আসার পর মোতালেবের বন্ধু রহমত ওকে এই সিগারেট খাওয়া শিখিয়েছে। রহমতের বেনসন সুইচ খাওয়ার স্টাইলটা মোতালেবের খুব পছন্দ হয়েছে। রহমত বেনসন সুইচ সিগারেটে আগুন ধরিয়ে প্রথমে লম্বা করে একটা সুখটান দেয়। তারপর ফিল্টারের অগ্রভাগে চাপ দিয়ে পট করে আওয়াজ তুলে কী যেন ভাঙে। এরপর সিগারেটের স্বাদই যায় বদলে। রহমত সিগারেটের ভেতর পাটকাঠির মতো এই গুটি ভাঙার একটা বিশ্রী নামও দিয়েছে। রহমতের গুটি ভাঙার নামটা শুনে মোতালেব খুব করে হেসেছে। মোতালেব বেনসন সুইচ খাওয়ার পর তার মনে হয়, সিগারেটের শরীর থেকে একটা ঠান্ডা আবেশ যেন তার গলা দিয়ে নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে। এই সিগারেট খাওয়ার পর মোতালেব আরও একটা জিনিস খেয়াল করেছে, এই সিগারেটটা খাওয়ার পর তার মনটাও ঠান্ডা হয়ে যায়।

প্রথমবার যখন মোতালেব এখানে এসেছিল, তখন পূর্ণিমা মোতালেবের এই বেনসন সুইচ খাওয়া দেখে দাঁত বের করে হেসে দিয়ে বলেছিল, আপনে এই লেডিস-মার্কা সিগারেট খান?

পূর্ণিমার মুখে এ-কথা শুনে মোতালেব ভারি অবাক হয়, সিগারেট আবার লেডিস-মার্কা হয় নাকি!

যে-সিগারেট খেলে শরীর-মন ঠান্ডা হয়। শরীর কুল-কুল, ঠান্ডা-ঠান্ডা হয়, হেই সিগারেট হলো লেডিস-মার্কা আর – মোতালেব পূর্ণিমাকে কথা শেষ করার সুযোগ দিলো না।

তাহলে পুরুষ-মার্কা সিগারেট কোনটা? মোতালেব পূর্ণিমাকে পালটা প্রশ্ন করে।

পূর্ণিমা মোতালেবের কথার কোনো উত্তর করে না। সে মোতালেবের দিকে তাকিয়ে থাকে।

কিছুটা পথ এগোলেই ট্রাকস্ট্যান্ড।

পাঁচটা বেনসন সুইচ সিগারেট আর একটা ম্যাচ নিয়ে দোকান থেকে বেরিয়ে জোরে জোরে কদম ফেলতে থাকে মোতালেব। পকেট থেকে ভোমা সাইজের পুরনো মোবাইল বের করে রহমতকে ফোন দিলো। রহমতের ফোনটা ব্যস্ত পাওয়া যাচ্ছে, ‘এই মুহূর্তে আপনার কাঙ্ক্ষিত নাম্বারে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। অনুগ্রহ করে একটু পর আবার চেষ্টা করুন।’

মোতালেবের হাতে সময় খুব একটা নেই। তার মেজাজটা ক্ষণে ক্ষণে বিগড়ে যাচ্ছে। এখানে কাজ শেষ করে তাকে আবার ফিরে যেতে হবে ঢাকা। মোতালেব আবার কল দেয় রহমতকে। ফোন থেকে একই কথা বলা হচ্ছে। ব্যস্ত। মোতালেবের মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। মনে-মনে মোতালেব বলল, রহমত আবার এই অবেলায় কার সঙ্গে পিরিতের কথা মারায়!

মোতালেবের মেজাজ চড়ে গেলে তার মুখ দিয়ে পপকর্ন ভাজলে পপকর্নগুলো আগুনের ওপর যেরকম নাচতে থাকে, সেরকম অশ্রাব্য শব্দ বের হতে থাকে। এই যেমন এখন মোতালেবের মুখ দিয়ে বের হল, ‘কথা মারায়’। এটা তো কোনো ভদ্রলোকের কথা হলো না। মোতালেব মাথা ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করে। তার এখন মাথা ঠান্ডা রাখা দরকার।

হাঁটতে-হাঁটতে সে কিছুটা পথ এগোল। কিছুটা পথ যাওয়ার পর একটা দোকানের সামনে এসে দাঁড়াল। তারপর সিগারেট ধরিয়ে রহমতের নাম্বারে আবার রি-কল করল। এবার রহমতকে পাওয়া গেল। তার ফোনে বাংলা সিনেমার গান বাজছে, ‘তোমাকে ছেড়ে আমি কী নিয়ে থাকবো/ মনটাকে সরিয়ে কোনখানে রাখবো/ মন মানে না, মন মানে না…’

রহমতের এই ওয়েলকাম টোনের গান শুনে মোতালেবের মেজাজ ঠান্ডা হবে কী আরো দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল। গানের কী কথা! ব্যাটা রহমত কাজ করে দালালির। পাড়ার লোকজন ওকে রহমত-দালাল হিসেবে চেনে। মেয়েরা-মাসিরা ওকে সমীহ করে চলে। দালালির পাশাপাশি মারামারি-কাটাকাটি রহমতের অতিরিক্ত কাজ। তার ওপর বছরখানেক হলো রহমত পাড়ার মধ্যে একটা রাজনৈতিক দলের শাখা খুলে তার নেতা সেজেছে। পাড়ায় সব মিলিয়ে প্রায় দুই হাজার ঘর। আর ভোটারের সংখ্যা হাজার পাঁচ-ছয়। এসব কারণে প্রশাসনের লোকজন এখন আর আগের মতো রহমতকে হাতের আঙুলের ফাঁক দিয়ে ফেলে দিতে চাইলেও পারে না। তাকে গোনাগুনতির মধ্যে রাখতে হয়। আগে যেমন কথায়- কথায় রহমতকে থানা পুলিশের লোকজন ধরে নিয়ে যেত এখন আর সেটা সম্ভব না। ইচ্ছেয় হোক ইচ্ছের বিরুদ্ধে হোক তারা রহমতকে গোনে। আর রহমতও তার এই রাজনৈতিক শক্তিটাকে বেশ ভালোভাবে ব্যবহার করে। আগে রহমত কোনো ঘরে ঢুকে সময় কাটালে তাকে পুরো টাকাটা দিতে হতো না। শুধু বখশিশ দিলেই হয়ে যেত। এখন রহমতের অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে তাকে পুরো টাকা, বখশিশ – দুটোর কোনোটাই দিতে হয় না।

ফোনে গান হতে হতে লাইনটা কেটে গেল।

মোতালেবের মেজাজ খারাপ হতে থাকে।

আবার কল করল। অনেকক্ষণ বাজার পর রহমত এবার ফোন ধরল, ভাই আপনে ফোন দিছিলেন? সরি ভাই, ধরতে পারি নাই। একটু বিজি আছিলাম। আর কইয়েন না সব কাস্টমার হইল হালার ফাউলের ফাউল। কাম করনের আগে কয় এক কথা, কাম করনের পর পেজগি লাগায়। রহমতের গলায় ক্ষোভ আর ঝাঁঝ সমানভাবে বাজে। একটু থেমে থেকে রহমত মোতালেবকে বলল, ভাই কী লঞ্চ থিকা নামছেন?

মোতালেব মাথা ঠান্ডা রাখে। বরফ-গলায় সিগারেটে টান দিয়ে সে বলল, হ্যাঁ, আমি ঘাটে। তুমি কোথায়?

আপনে ঘাট থিকা বাইর হইলে দেখবেন মেইন রোডের লগে কয়েকটা রিকশা খাড়ায়া রইছে। আপনি যে-কোনো রিকশাঅলারে আমার নাম কয়া কইবেন, আমি রহমতের কাছে যামু। তাইলে অরা আপনেরে ডাইরেক্ট আমার কাছে লয়া আইবো। আমি আপনের লাইগা পাড়ার সামনে খাড়ায়া আছি। বলে রহমত ফোন রেখে দেওয়ার পাঁয়তারা করে।

রহমতের কথা শুনে বোঝা যাচ্ছে, সে বেশ ব্যস্ত। ওর আশপাশে বেশ কথাবার্তা শোনা যায়। শোরগোল-হট্টগোল। রহমতকে ফোন রাখতে দিলো না মোতালেব। বলল, পূর্ণিমা আছে?

মোতালেবের কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে রহমত আর দেরি করে না। অল্প কথায় উত্তর দেয়, আপনের লাইগা পূর্ণিমাও আছে, অমাবস্যাও আছে।

ফোনটা রেখে দেওয়ার আগে রহমত তড়িঘড়ি করে মোতালেবকে বলল, ভাই আমার আরেকটা ফোন আইছে। আপনে আহেন তারপর সব দেহন যাইবো।

ঠিক আছে বলে মোতালেব লাইনটা কেটে দিলো। মোতালেব প্রয়োজন ছাড়া কথা বাড়ানোর মানুষ না।

রিকশাস্ট্যান্ডে এসে দাঁড়াল মোতালেব। মাটির এবড়ো-খেবড়ো পথ। তার মধ্যে ছয়-সাতটা রিকশা অলস দাঁড়িয়ে আছে।

মোতালেব রিকশাঅলাদের মধ্য থেকে একজনকে ডেকে রহমতের কথা বলল। রহমতের কথা বলতেই যুবকবয়সী রিকশাঅলা নড়েচড়ে বসল। সে এতোক্ষণ রিকশার সিটে বসে বিড়ি টানছিল।

আপনে রিকশায় বন। কোনো অসুবিধা নাই – আমি আপনেরে পাঁচ মিনিটের মইদ্যে রহমত ভায়ের কাছে লয়া যাইতাছি।

রিকশা মাটির রাস্তা থেকে মেইন রোডে উঠে চলতে শুরু করেছে। রাস্তার সামনে-পেছনে দূরবর্তী জেলার বাস এলোমেলো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। লঞ্চঘাট থেকে প্যাসেঞ্জার নামলে সেই প্যাসেঞ্জার নিয়ে রওনা হবে দূরের কোনো জেলায়। ফরিদপুর। রাজবাড়ী। মাগুরা। বাগেরহাট। গোপালগঞ্জ। খুলনা। যশোর। চুয়াডাঙ্গা। কুষ্টিয়া। আরো কত জায়গায় যে যাবে বাসগুলো!

আচ্ছা, এই বাসগুলো কি পাটগ্রাম যাবে?

তিন.

মোতালেব রিকশায় ওঠার পর তার মনটা আস্তে-আস্তে খারাপ হয়ে যেতে লাগল। হাতে সিগারেট জ্বলছে। সিগারেট খেতে ইচ্ছে করছে না। তারপরও ইচ্ছের বিরুদ্ধে সে সিগারেটে টান দিতে থাকল।

রিকশায় উঠে রেশমার কথা মনে হতেই মোতালেবের সবকিছু আউলা হয়ে যায়। আচ্ছা, কবে থেকে রেশমার সঙ্গে তার পরিচয়? মোতালেবের মনে পড়ে বছরখানেকের প্রেম শেষে রেশমা বাবা-মা, ভাইবোন সবাইকে ছেড়ে দিয়ে মোতালেবের কাছে চলে এসেছিল। মোতালেব টুকটাক প্রিন্টিংয়ের কাজ-টাজ করে। দু-তিনটা বড় বড় কোম্পানির ছাপা কাজ সে করে। তাতেই তার বেশ চলে যায়। বিয়ে করার পর মোতালেব রেশমাকে নিয়ে ঘর-সংসারও শুরু করেছিল সাব-লেট হিসেবে মাদারটেকে ওর দূরসম্পর্কের এক চাচাতো ভাই শামীমের বাসায়। দুই রুমের ভাড়া বাড়ি। বড়-বড় রুম। দুই রুমের মাঝে বেশ খানিকটা খোলা জায়গা। ডাইনিং টেবিল বসানোর পরও দুজন মানুষ পাশাপাশি হাঁটাচলা করতে পারে। একটা বড় বাথরুম। বাথরুমের মেঝেটা টাইলসের। মোতালেবের চাচাতো ভাই শামীম বিয়ে করেছে আট-দশ বছর হবে। নিঃসন্তান। শামীম এজি অফিসে কাজ করে। অফিস শেষে সন্ধ্যার পর শামীম তালতলায় কলেজের দুই মেয়েকে পড়ায়। তাতে বাড়তি উপার্জন হয়।

বিয়ের আগে মোতালেব একরকম বেকারই ছিল। ব্যবসাটা অত জমেনি। কিন্তু রেশমাকে বিয়ের পর তার কপালটা খুলে গেল। বিয়ে করার মাসখানেকের মধ্যে দুই-তিনটা এনজিও আর বড় বড় কোম্পানির প্রিন্টিংয়ের কাজও পেয়ে গেল সে। বছর শেষে কখনো কখনো সাব-কন্ট্রাক্টে কিছু বই-ক্যালেন্ডার-ডেস্ক ক্যালেন্ডারের কাজও পেতে লাগল। মোতালেবের হাতে কাজ কম থাকলে সে প্রায়ই শামীমের মাদারটেকের বাসায় চলে যেত। কয়েকদিন না গেলে শামীমের বউ ফুলবানু ফোন করে মোতালেবকে বাড়িতে যাওয়ার কথা বলত। ফুলবানু বলত, সন্ধ্যার আগে-আগে তুমি আইসো, তাইলে পরান খুইলা কথা কইতে পারুম।

ফুলবানুর পীড়াপীড়িতে সৌজন্যের খাতিরে হলেও মোতালেব মাঝেমধ্যে সময় করে মাদারটেকে যেত। শুধু কী সৌজন্য দেখানোর জন্য মোতালেব শামীমভাইয়ের বাড়ি যেত? ফুলবানু দেখতে ফেলে দেওয়ার মতো নয়। না সুন্দর, না অসুন্দর – এই দুয়ের মাঝামাঝি একটা জংলি বা, বুনো সৌন্দর্য ফুলবানুকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। সেই আচ্ছন্ন হাতছানিতে অবশ্যই মাঝেমধ্যে তাড়া করত।

মোতালেব মাদারটেকে গেলে সাধারণত সন্ধের আগে-আগে যেত। তাতে সুবিধা তারই। ঘণ্টাখানেক থেকে শামীমভাই আসার আগে সে বাসা থেকে বেরিয়ে যায়। বুদ্ধিটা ফুলবানুই শিখিয়ে দিয়েছে মোতালেবকে। কয়েকদিন শামীমের বাসায় না গেলে ফুলবানু নিজে থেকেই মোতালেবকে ফোন করে –

কী খবর মোতালেব, তোমার কী অইছে? তুমি আহো না ক্যা?

ফুলবানুকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্য মোতালেব বলত, ভাবি কাজের বহুত চাপ। বলে মোতালেব একটু থামে, পার্টির কাজ-টাজ করি – সবসময় দৌড়ের মধ্যে থাকতে হয়। আর পার্টি কাজ দিলে কাজের চাপে শরীর থেকা রস বাইর হয়।

শরীর থেকা রস বাইর হয় মানে!

ভাবি গেন্ডারির রস বানান দেখছেন কখনো? বলে মোতালেব একটু থামে। তারপর বলতে থাকে, মেশিনে গেন্ডারি ঢুকিয়ে যেভাবে গেন্ডারির রস বের করে গেন্ডারিকে ছোবড়া বানিয়ে ফেলে, সেরকম করে পার্টির লোকরা কাম দিলে আমাদের দৌড়ের ওপর রেখে শরীর থেকা রস বের করে নেন।

মোতালেবের কথায় ফুলবানু খিলখিল করে হাসতে থাকে।

রস থাকলেই না শরীর থেকে রস বাইর করনের প্রশ্ন আসে, বলে ফুলবানু আগের চেয়ে বেশি মাত্রায় খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে।

বিয়ের আগে রেশমার কথাটা মোতালেব ইচ্ছে করে ফুলবানুর কাছে লুকিয়ে রেখেছিল। মোতালেব ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না রেশমাকে কীভাবে নেবে ফুলবানু? শেষে রেশমাকে নিয়ে পরিস্থিতি যখন বেশ একটু ঝামেলার মধ্যে গিয়ে ঠেকল, মানে রেশমার অন্য জায়গায় বিয়ে হয়ে যাচ্ছে, তখন মোতালেব অনন্যোপায় হয়ে এক সন্ধ্যায় ফুলবানুর কাছে গেল। সে ফুলবানুকে সব খুলে বলল।

ফুলবানু মনোযোগ দিয়ে মোতালেবের সব কথা শুনল। তারপর মুচকি হেসে বলল, তোমারে দেইখা তো মনে হইতাছে বুঝি তোমার গরু হারাইছে – ফুলবানুর মুখে হাসি।

হ ভাবি, আমার রেশমা হারায়া যাইতাছে –

তার মানে, রেশমা কি গরু? ফুলবানু মোতালেবের সঙ্গে দুষ্টুমি করে।

ভাবি আমার হইল বিপদের দিন। আর আপনে খালি দুষ্টামি করেন –

আমি মানুষ বুইঝা দুষ্টামি করি। এই যেমন অহন তোমার লগে করতাছি – বলে আবারো ফুলবানুর হাসি।

মোতালেব কিছু বলে না। তাকিয়ে-তাকিয়ে ফুলবানুর দুষ্টুমি মার্কা হাসি দেখে।

সেই সন্ধ্যায় ফুলবানুর বাসায় মোতালেব অনেকটা সময় কাটায়। ভাত খায়। গোসল করে ১০টার দিকে বের হয়ে যায়। ফুলবানু খবরটা মোতালেবকে দেয়। মোতালেবও থেকে যায়। গল্পসল্প করে। সন্ধ্যার আগে শামীম ফুলবানুকে ফোন করে জানিয়েছে, কী একটা কাজে আটকে গেছে। বাসায় ফিরতে তার রাত ১১টা-১২টা বেজে যাবে।

ফুলবানুর বাসা থেকে বের হওয়ার সময় মোতালেবের শরীরটা বেশ ঝরঝরে লাগে।

এর একদিন পরই রেশমাকে বিয়ে করে মোতালেব ফুলবানুর বাসায় এসে ওঠে। আগেই ফুলবানুর সঙ্গে মোতালেবের কথা হয়ে আছে যে, রেশমাকে বিয়ে করে সোজা এ-বাসায় এসে উঠবে। ফুলবানুর এ-প্রস্তাবে মোতালেব প্রথমে রাজি ছিল না। পরে ফুলবানুর চাপে মোতালেবকে রাজি হতে হয়েছে।

বিয়ের পর রেশমাকে নিয়ে মোতালেবের সংসারযাত্রা শুরু হয়। আর ফুলবানুর সঙ্গে ব্যাপারটা তো আগে থেকেই ছিল। তবে সেটা ছিল অলিখিত। অনেকটা ‘এলেনা বেলেনা ঝুপ’ টাইপের।

বিয়ের বেশ কিছুদিন পর রেশমার কাছে মোতালেব আর ফুলবানুর বিষয়গুলো হাতের রেখার মতো পরিষ্কার হয়ে উঠতে লাগল। রেশমা বুঝতে দিত না। ভেতরে-ভেতরে নজর রাখত মোতালেবের ওপর। রেশমা একদিন মোতালেবকে হাতেনাতে কট করে ফেলল। সেদিন ছিল ছুটির দিন। ফুলবানু গোসল করার জন্য বাথরুমে যাচ্ছিল। হাতে শাড়ি-ব্লাউজ। শামীম তখন অফিসের কাজে ঢাকার বাইরে।

মোতালেব আর রেশমা যে-ঘরটাতে থাকে, সে-ঘরের দরোজা বরাবর কয়েক কদম হাঁটলে বাথরুম। রেশমার ঘরের দরোজার পর্দা নড়েচড়ে উঠলে বিছানা থেকে বাইরের সবকিছু দেখা যায়।

কয়েকদিন ধরে রেশমার খুব জ্বর। জ্বর নিয়ে রেশমা বিছানায় শুয়ে থাকে। চোখ বন্ধ করে। মোতালেব কিছুক্ষণ আগে গোসল করতে গেছে। রেশমা কান পেতে রাখে কখন মোতালেব বাথরুম থেকে বের হয়। কারণ তারও একটু বাথরুমে যাওয়ার দরকার পড়েছে। জলবিয়োগের ব্যাপারটা ইদানীং রেশমার ঘন-ঘন হচ্ছে। ব্যাপারটা নিয়ে রেশমা দুশ্চিন্তার মধ্যেই ছিল। তার আবার ডায়াবেটিস হয়ে গেল না তো? রেশমার মায়ের ডায়াবেটিস আছে। সে-কারণে ডায়াবেটিসের ভয়টা রেশমার মধ্যে সব সময়ই কাজ করে। মোতালেবকে কয়েকবার বলেছে রেশমা। ডাক্তারের কাছে গেলে সব দেখেশুনে ডাক্তার বলেছে, বাচ্চা নেওয়ার সময় এরকম ঘন-ঘন বাথরুম হবেই। এটা বহুমূত্রের কোনো লক্ষণ নয়। নো টেনশন।

বাথরুমে দরোজা খোলার শব্দ হলো। মোতালেব গোসল শেষ করে বেরিয়ে আসে। লুঙ্গি পরা। খালি গা। শরীরে ফোঁটা-ফোঁটা পানি। ফুলবানু আগে থেকে বাথরুমের বাইরে পায়চারি করছিল। রান্নাবান্নার পর গোসল না করলে ফুলবানুর কেমন অস্থির লাগে। আর দু-একদিন ধরে যা গরম পড়েছে! ফুলবানু রান্না করার সময় রান্নাঘরটা গরম চুল্লি হয়ে ওঠে। অসহ্য গরম। ফুলবানু সেই অসহ্য গরমে ব্লাউজ পরে না। তবে ব্লাউজ না পরলে কী হবে, ফুলবানু করে কী শাড়িটাকে ভালো করে কোমরের সঙ্গে পেঁচিয়ে রাখে, যাতে শাড়িটা সেমি-ব্লাউজের কাজ করে। ফুলবানুর শরীর তখন হয়ে ওঠে শান-দেওয়া ধারালো ছুরি।

রেশমা মিটমিট করে চোখ ফেলে তাকিয়ে থাকে বাইরে। ফুলবানু রেশমার ঘরের পর্দা সরিয়ে উঁকি দিয়ে রেশমাকে দেখল। ফুলবানুর উপস্থিতি টের পেয়ে রেশমা ঘুমের ভান করে শুয়ে থাকে। রেশমার চোখ বন্ধ। পর্দা নড়েচড়ে উঠলে বাইরের সবকিছু দৃশ্যমান হয়।

মোতালেব গোসল শেষ করে ভেতর থেকে বেরিয়ে বাথরুমের দরোজায় দাঁড়িয়ে থাকে। ফুলবানু ব্লাউজ-শাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মোতালেবের শরীরে শিশিরবিন্দুর মতো ফোঁটা-ফোঁটা পানি দেখে ফুলবানু ঠোঁট কামড়ে হেসে ফেলল।

রেশমা বিছানা থেকে বাথরুমের দিকে চোখ ফেলে রাখে। রেশমা চোখ ছোট-ছোট করে ঘুমের ভান করে তাকিয়ে থাকে। বাতাস পেয়ে দরোজার পর্দা যতটুকু নড়ছে তাতে রেশমা দেখল, বাথরুমের দরোজায় দাঁড়িয়ে থাকতেই ফুলবানু হঠাৎ অদ্ভুত এক কান্ড করে বসল। ফুলবানু করল কী, মুহূর্ত সময় বিলম্ব না করে মোতালেবের বুকে পরম মমতায় হাত বুলিয়ে দিলো। ফুলবানুর ভাবটা এমন যে, পারে তো সে এখনই মোতালেবের বুকে মাথা রেখে ঘুমায়। ফুলবানু ফিসফিস করে মোতালেবকে বলল, এই দুপুরবেলাও গোসল! অহন আর কোমরের ব্যথা-বুথা নাই, না? সব ব্যথা খালি আমার বেলায় বলে ফুলবানু শরীরে একটা তরঙ্গ তুলে ধাক্কা মেরে মোতালেবকে সরিয়ে দিয়ে বাথরুমে ঢুকে যায়।

দৃশ্যটা দেখার পর রেশমার চোখ আপনা-আপনি বন্ধ হয়ে যায়। ভেতরে-ভেতরে মেজাজও গরম হয়ে যায়। ফুলবানুর সঙ্গে মোতালেবের সম্পর্কটা সেদিন থেকে রেশমার কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

গোসল সেরে ঘরে ঢুকে মোতালেব দেখল, রেশমা তার দিকে পিঠ করে শুয়ে আছে। পেছন থেকে ব্লাউজ আর শাড়ির মধ্যবর্তী অংশ দিয়ে রেশমার যতটুকু পিঠ দেখা যায় তাতে মনে হয় ওটা যেন রেশমার পাশ-ফেরা পিঠ নয়, যেন কচ্ছপের কবেকার সাদা হয়ে যাওয়া খোলস। রেশমা ঘুমিয়ে আছে ভেবে মোতালেব রেশমাকে ডাক দিলো না। দুপুরে মোতালেবের এক বন্ধুর বিয়ের দাওয়াত আছে। রেশমা একবার বলেছিল দুপুরে রান্নার ঝামেলা এড়ানোর জন্য সেও মোতালেবের সঙ্গে বন্ধুর বিয়েতে যাবে; কিন্তু গতরাতে জ্বর বেড়ে যাওয়ায় মোতালেবকে বলে দিয়েছে, আমার শরীরটা সায় দিচ্ছে না। তুমি একাই যাও।

মোতালেব ঘরে ঢুকে রেডি হতে থাকে। ঘরে একটা সেমি-ডাবল খাট। একটা মাঝারি মতন ওয়্যারড্রব। সতেরো ইঞ্চি টিভি। একটা টেবিল। দুটো নড়বড়ে চেয়ার। আর ঘরের একেবারে কোনায় কাঠের সস্তা আলমারি। ফরেন ফার্নিচারের দোকান থেকে এই আলমারিটা মোতালেব কিনেছে রেশমার পছন্দে। মোতালেব ওয়্যারড্রব থেকে একটা পাঞ্জাবি বের করল। পাঞ্জাবির সঙ্গে ঘিয়েরঙা ঢিলেঢালা ফুলপ্যান্ট। গত সপ্তাহে বাসাবোর বাটার দোকানে ‘গ্র্যান্ড সেল সিক্সটি পার্সেন্ট’ দেখে দোকানে ঢুকে একটা কালো চামড়ার পাতলা স্যান্ডেল স্যু কিনেছে মাত্র তিনশো নববই টাকায়। পাঞ্জাবি-প্যান্টের সঙ্গে সেটাই পরবে।

পাঞ্জাবিটা নিয়ে রেশমার দিকে আবার তাকাল মোতালেব। রেশমা আগের মতো শুয়ে আছে। বেচারা! রেশমার সঙ্গে মোতালেবও রাত ৩টা পর্যন্ত জেগে থেকেছে। শেষে বিরক্ত হয়ে রেশমাই বলেছে, তুমি ঘুমিয়ে পড়ো। আমার জন্য খামোকা তোমার কষ্ট।

রেশমার কথার পরও মোতালেব জেগে থাকে। রেশমার ঘুমটা এসেছে ভোররাতের দিকে। ঘুমিয়ে গেলে রেশমার দিন-দুনিয়ার কোনো খেয়াল থাকে না। রেশমা জোরে-জোরে নাক ডাকে। নাক ডাকার শব্দে পুরো ঘর ডুবে থাকে। মোতালেবের ঘুম ছুটে গেছে। তার আর ঘুম আসে না। জলবিয়োগ করা দরকার মোতালেবের। ঘরের দরোজা খুলে বাথরুমের দিকে পা বাড়াতেই কে যেন মোতালেবের হাত ধরে টান দিয়ে একদিকে সরিয়ে ফেলে। মোতালেব দেখল, ফুলবানু তার হাত দুটোকে জড়িয়ে ধরে আছে। ফুলবানুর চোখেমুখে একধরনের নির্লিপ্ততা। মোতালেব স্পষ্ট লক্ষ করে, ফুলবানুর বুক দ্রুত ওঠানামা করছে। মোতালেব অবাক হয় যত বেশি, তার চেয়ে বেশি বিস্ময় কাজ করে তার ভেতরে। তার মধ্যে প্রশ্ন খেলে যায়, তাহলে ফুলবানুও কী মোতালেবের মতো সারারাত জেগে ছিল!

ফুলবানু কোনো কথা না বলে এক হ্যাঁচকা টানে মোতালেবকে তার রুমে নিয়ে গেল।

আহ্! কী করছো? রেশমা জেগে উঠবে। মোতালেব ফিসফিস করে এ-কথা বললে ফুলবানু উলটো তাকে শুনিয়েছে, আমি জানি এখন রেশমা আর জাগবো না। ওর জাগতে-জাগতে দুপুর ১২টা। আরে! কী আশ্চর্য – ফুলবানু দেখি জাদুমন্ত্রের মতো রেশমার নাড়ি-নক্ষত্র সব খবরাখবর রাখে।

ফুলবানু মোতালেবকে আর কথা বলার সুযোগ দেয় না। ফুলবানু যতটা সময় পারল নিজের মতো করে কাটিয়ে মোতালেবকে ঘর থেকে বের করে দিলো। তারপর নিজের দরোজায় ছিটকিনি মেরে দীঘল ঘুমে তলিয়ে গেল। শামীম অফিস অডিটের কাজে ঢাকার বাইরে। ঘরে ফুলবানু একা। তবে দীঘল ঘুমে তলিয়ে যাওয়ার আগে ফুলবানু বাথরুমে গেল। ইচ্ছামতো পানি দিয়ে হাত-মুখ পরিষ্কার করলো। ভেজা হাত-মুখ-পা মুছল না। বিছানায় শুয়ে পড়ল। ফুলবানুর ধারণা, ভেজা হাত-মুখ-শরীর নিয়ে ঘুমালে নাকি ভালো ঘুম হয়।

চার.

রেশমার শরীর আরো খারাপ হয়ে গেল। কি রাত কি সকাল চোখের পাতা এক করতে পারে না রেশমা। মুখে রুচি নেই। সারাদিন বিছানায় পড়ে থাকে। রেশমার শরীরে পানি চলে আসে বলে রেশমাকে আগের চেয়ে মোটা বলে ভ্রম হতে লাগল মোতালেবের। শরীর বেশি খারাপ বলে রেশমা পাটগ্রামে ফোন করে, ফোন করে বাবাকে আসতে বলেছে।

মোতালেব মানা করেছিল। বলেছিল, তুমি অতো চিন্তা করো না তো। আমি আছি না? শামীমভাই আছে, ভাবি আছে – তুমি চিন্তা করো না।

মোতালেবের কথা রেশমার কানে গেল কিন্তু মনে গেল না।

রেশমার ফোন পেয়ে ওর বাবা চলে এলো। রেশমা কিছুদিন গ্রামের বাড়িতে থাকবে। গ্রামে যাওয়ার সময় রেশমার বাবা মোতালেবকে বললেন, বাবা আমার মেয়েরে নিয়া গেলাম। নিজের দেখভাল নিজে কইরো। আল্লা-খোদারে ডাইকো, দেখবা সব বালা-মুসিবত দূর হয়া যাইবো। রেশমার দিকে তাকিয়ে কপালে চিন্তার রেখা ফুটিয়ে বাবা আরো বললেন, আমার তিন মেয়ের মধ্যে রেশমার জ্বর-জারি তো দূরের কথা, কোনোদিন কোনো অসুখ-বিসুখ করে নাই। এখন কী যে হইলো বলে তিনি বিদায় নিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন। ঘরের মধ্যে রেশমা দাঁড়িয়ে আছে মাথা নিচু করে। রেশমার বাবা বেরিয়ে যাওয়ার জন্য তৈরি।

রেশমা দাঁড়িয়ে থাকে কিন্তু মোতালেবকে কিছু বলছে না।

মোতালেবও রেশমার মতো দাঁড়িয়ে আছে। সে মাথা নিচু করে রেশমার দিকে তাকিয়ে থাকে। মোতালেবের একবার ইচ্ছে হলো রেশমাকে বলে – রেশমা, তুমি আমাকে ছেড়ে যেও না। তুমি চলে গেলে আমি কী নিয়ে থাকব?

রেশমা কাপড়-চোপড়, ওষুধপথ্যসহ ওর গোছানো স্যুটকেস নিয়ে দরজার কাছে গিয়ে বাবার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকে। ফুলবানুর দরোজাটা না খোলার মতো খোলা। একটু আবজানো। ফুলবানুর ঘরের ভেতর দক্ষিণমুখী বড় একটা জানালা আছে। খোলা থাকলে সেই জানালা দিয়ে রাজ্যের যত আলো এসে ফুলবানুকে তো ভাসিয়ে রাখেই, তার ওপর পুরো ঘরটাকে করে রাখে আলোকিত। ফুলবানুর খুলে রাখা দরোজা দিয়ে সম্ভবত জানালার সেই রাশি-রাশি আলোর যৎকিঞ্চিৎ এসে পড়ছে বাইরের ঘরে।

রেশমার বাবা হাশেম আলী রেশমার দিকে তাকিয়ে মোতালেবকে বলল, বাড়ির গিন্নির কাছে বিদায় নেওনটা ঠিক না? বাবা, উনারে একটু ডাকো।

হাশেম আলী মোতালেবকে এমনভাবে বলল যে, মনে হলো রেশমা নয়, যেন ফুলবানুই তার বিয়ে করা বউ! মোতালেব ভারি অবাক হয়।

মোতালেব এবার সুযোগ পায়। সে রেশমাকে বলে, দরোজা তো খোলাই আছে – তুমি যেয়ে ভাবিরে ডাকো না।

মোতালেবের এ-কথা শুনে রেশমার ভেতরটা রাগে গজগজ করতে লাগল। রেশমা ওর বাবার দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বলার চেষ্টা করল। কিন্তু রেশমার মুখ দিয়ে কোনো রা-শব্দ বের হলো না। প্রচন্ড রকমের রেগে গেলে মানুষের সাজানো কথাও এলোমেলো হয়ে যায়। আর না-হয় কোনো কথাই বের হয় না। এক্ষেত্রে রেশমার হয়েছে দ্বিতীয়টা।

পরিস্থিতি যখন এরকম ঠিক, তখন ফুলবানুর দরোজাটা মন্ত্রমুগ্ধের মতো খুলে গেল। দরোজার দুটো পাল্লার মাঝবরাবর ফুলবানু দাঁড়িয়ে রেশমার বাবাকে বলল, খালু, আজকের দিনটা থেকে গেলে পারতেন। সকালে এসে দুপুরে না খেয়ে চলে যাচ্ছেন – এটা ক্যামন দেখায়। কথাগুলো বলার সময় ফুলবানু রেশমার দিকে তাকাল। রেশমা তখন মোতালেবের দিকে তাকিয়ে থাকে। মোতালেবকে তখন দেখায় প্রস্তরযুগের কোনো মূর্তি।

রেশমার শরীরের দিকে খেয়াল রাইখেন। এই সময় তো যত্ন-আত্তির দরকার। ফুলবানুর এরকম সতর্কবাণীতে রেশমার বাবা সন্ধিগ্ধ দৃষ্টিতে আবারও চোখ ঘুরিয়ে নেয় ফুলবানুর দিকে। ফুলবানু কী বলতে চাচ্ছে? রেশমার বাবা কিছু বুঝে ওঠার আগে ফুলবানুই বলে ওঠে, সময় হইলে সব টের পাইবেন।

হ্যাঁ, সময় হলে সব দেখতে চায় রেশমা। ফুলবানুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রেশমা বাবাকে নিয়ে দ্রুত দরোজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল। রেশমা আর ওর বাবার পেছন-পেছন মোতালেবও বেরিয়ে যায়।

রেশমা পাটগ্রামে যাওয়ার পাঁচদিন পর মোতালেবের নামে একটি চিঠি কুরিয়ারে পাঠিয়েছে। রেশমা চিঠিতে লিখেছে, ‘জীবনে তোমাকে পাইয়া ভাবিয়াছিলাম, আমার এ-জীবন বুঝি ষোলো আনা পূর্ণ হইয়াছে। কিন্তু ফুলবানু যে ভূমিদস্যুর মতো আগে থেকেই আমার ভাগের চৌদ্দ আনা জবর-দখল করিয়া লইয়া বসিয়াছে তাহা আমার জানা ছিল না। এটা আমার কপালের লিখন। তুমি ভালো থাকিও। শরীরের প্রতি যত্ন নিও’ – রেশমা এই লাইনটা লিখে কলম দিয়ে কেটে দিয়ে আবার লিখেছে, ‘সেটার দায়িত্ব ফুলবানু বেগমের ভালোই জানা আছে। আমার জন্য কোনো প্রকার চিন্তা বা দুশ্চিন্তা করিও না। ভালোয়-ভালোয় বাচ্চা-কাচ্চা হইলে দেখার ইচ্ছা হইলে চলিয়া আইসো। আমার হয়েছে মরণদশা। ইতি – রেশমা।’

কতোদিন হলো রেশমা মোতালেবকে ছেড়ে গেছে?

চৌদ্দো দিন? না পনেরো দিন?

পপিদের ওখান থেকে মোতালেব সন্ধ্যার আগে আগে বেরিয়ে পড়ল। রিকশা করে লঞ্চঘাটে এসে নেমে মোতালেব আগের মতো একটা চায়ের দোকানে বসল। চায়ের দোকানে বসে মোতালেব পপির কথা মনে করছে। পপির কথা মনে করতে করতে মোতালেবের কখন যে রেশমার কথাও মনে পড়ে যায়! চা বানায় যে-ছেলেটা সে মোতালেবকে বলল, চা দিমু এককাপ?

আলগা পাতি দিয়া এক কাপ স্ট্রং চা দেও।

হ্যাঁ, মোতালেব এখন এক কাপ স্ট্রং চা খাবে।

চায়ে চুমুক দিয়ে মোতালেবের মনে হলো, ছেলেটা তো বেশ চা বানিয়েছে! রেশমাও ঠিক এরকম চা বানায়। চা খেতে-খেতে মোতালেবের মনে হচ্ছে, সে ঘরে বসে রেশমার হাতে বানানো চা খাচ্ছে। চা খাওয়া শেষ হলে মোতালেব একটা সিগারেট ধরায়। লম্বা করে টান দেয়। তারপর গলগল করে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ে। ধোঁয়াগুলো মিলিয়ে গেল বাতাসে। মোতালেব ধোঁয়ার মধ্যে রেশমার চলে যাওয়ার দিনকার মুখচ্ছবি দেখতে পেল। আর রেশমার মুখ দেখে মোতালেবের মন আরো খারাপ হয়ে গেল। হঠাৎ করেই মোতালেবের মনে হয়, তার ঘরে ফেরা দরকার। সে চায়ের বিল মিটিয়ে দিয়ে দ্রুত কদম ফেলে লঞ্চঘাটে চলে গেল।

ঠিক সন্ধ্যার মুখে লঞ্চ এসে থামল ঘাটে। মোতালেব দ্রুত নেমে গেল লঞ্চ থেকে। লঞ্চ থেকে নেমে কিছুদূর হাঁটতে হয়। তারপর লোকজনভর্তি লালরঙা একটা বিআরটিসি বাসে উঠে পড়ল। মোতালেবের কী হয় বোঝা যায় না, সে একটা অস্বস্তির মধ্যে পড়ে যায়। কিছুদূর যাওয়ার পর একজন যাত্রী নেমে গেলে মোতালেব জানালার ধারে বসার একটা জায়গা পায়। বাতাসের ঝাপটা খুব বেশি। সামনের সিটে বসা এক মহিলা বাতাসের দাপট সইতে না পেরে জানালার গ্লাস বন্ধ করে দিয়েছে। জানালার ধারে বসে মোতালেব দেখে গাছপালা, দূর-দূরান্তের মানুষজন, গরু-ছাগল সবাই তাকে ছেড়ে নির্বিকারভাবে দূরবর্তী হয়ে যাচ্ছে। অনেকক্ষণ ধরে সে এসব দেখছিল। দেখতে-দেখতে তার ভেতরে কে যেন বলল, মোতালেব সবাই তোমাকে ছেড়ে দূরে চলে যাচ্ছে আর তুমি কোথায়, কার পেছন ঘুরঘুর করছো? বাসের মধ্যে সবাই মোতালেবকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে এরকম দৃশ্য দেখতে দেখতে একসময় সে ঘুমিয়ে গেল। কন্ডাক্টরের গলা শুনে তার ঘুম ভেঙে গেল। চোখ মেলে সে দেখে, আমিনবাজার ছেড়ে বাস প্রায় গাবতলী এসে পড়েছে।

বাসায় ফিরতে-ফিরতে মোতালেবের বেশ রাত হয়ে গেল। বাসে করে গুলিস্তানে নেমে মেহেরবান হোটেলে ঢুকে এক প্লেট গরুর তেহারি খেয়ে রিকশায় বাড়ির দিকে রওনা দিলো মোতালেব।

দরোজায় বারকয়েক নক করতে শামীমভাই এসে দরোজা খুলে দিলো। মোতালেবকে দেখে শামীমভাই ঘাবড়ে গেল। মোতালেবকে জিজ্ঞেস করল, ছুটির দিনে তুমি কই গেছিলা? ফোন করি তাও ধরো না, ঘটনা কী?

মোতালেব এ-কথার কোনো উত্তর করে না। শামীম দরোজা থেকে সরে গেলে মোতালেব ঘরে ঢুকল। তারপর নিজের ঘরের দরোজায় এসে দাঁড়াল। প্যান্টের ইন পকেট থেকে ঘরের চাবিটা বের করল। খট করে দরোজা খোলার শব্দ হলো। মোতালেব ঘরে ঢুকে সব সময়ের মতো আজ আর টিউবলাইট জ্বালাল না। জ্বালাল উজ্জ্বল রঙের এনার্জি বাল্ব। ঘরের দেয়ালে ঘিয়েরঙা ডিসটেম্পারে এনার্জি বাল্বের আলোটা যখন পড়ল, তখন পুরো ঘর ঝলমল করে উঠল।

ডিমলাইট জ্বালানোর পর মোতালেব দরোজাটা ঠেলে ভেতর থেকে বাইরের দিকে চাপিয়ে রাখে। অনেকক্ষণ ধরে পানি না খাওয়ার ফলে তার পানির তেষ্টা পায়। টেবিলের ওপর রাখা পানির বোতল। বোতলের মুখ খুলে ঢকঢক করে পানি খেল। তারপর প্যান্ট-জামা পালটে লুঙ্গি আর গেঞ্জি পরল। মোতালেব এখন বাথরুমে গিয়ে সেরকম করে গোসল করবে। মোতালেব বিছানার দিকে তাকাল। বিছানার চাদর হালকা নীল রঙের – তার ওপর ছোট ছোট ফুলের ডিজাইন করা। মোতালেব ভালো করে দেখার পর তার মনে হলো, ডিমলাইটের আলো পেয়ে বিছানার চাদরের ছোট ছোট ফুল যেন একঝাঁক মুনিয়া পাখি হয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে। ঘর থেকে বেরিয়ে বাথরুমের দিকে পা বাড়াল মোতালেব।

গোসল শেষে নিজের ঘরে ঢুকে মোতালেব বিস্মিত হলো। মোতালেব দেখতে পেল, বিছানায় কেউ একজন বসে আছে। তার সামনে খোলা মেকআপ বক্স। চপস্টিক, লিপস্টিক, আলতা, পাউডার, স্নো, পাফ, আই লাইনার। আয়না। সবকিছুই পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। মোতালেব এগিয়ে গিয়ে ঝুঁকে পড়ে দেখল। তার মুখ দিয়ে ফিসফিস করে বেরিয়ে এলো,

কে?

রেশমা?

পূর্ণিমা?

পপি?

ফুলবানু?

মোতালেব একটু পিছিয়ে এলো। ভয়-মিশ্রিত গলায় বলল, তুমি কে? কী করছো?

একজন না, মোতালেব স্পষ্ট শুনতে পেল চারজনের গলা।

আমরা মুখ বানাই।

আমরা মুখ বানাই।

যদিও সে জানে, এটা বিভ্রম। এনার্জি আলোয় মোতালেব স্পষ্ট একজনের ভেতর চারজনকে দেখল।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত