পৃথিবী ওকে ডাকছে – তখন গুঁড়ো-গুঁড়ো কাচের ধুলো সুগন্ধিত এবং তেতে গরম, রৌদ্রোজ্জ্বলময় গ্রীষ্মিত দিনগুলোর স্মৃতি আনন্দের অনুষঙ্গ বয়ে এনেছিল।
শিয়ালমুখো লম্বা ফাইলগুলো ঘাঁটতেই একরাশ ধুলো স্বাগত জানাল, আর পুরনো কাগজের ম্রিয়মাণ ক্লোরিন থেকে একটি রুপালি কয়েন টুপ করে টেবিলের নিচে আঁধার হয়ে গেলে বিস্ময় ও হাসি পায়। ততক্ষণে কম্পিউটারের মনিটরে শিশুটির ক্রনিক হাসি তোমাকে সংক্রমিত করে আর আসার পথে কুকুরের জটলার স্মৃতি থেকে ভীতি অদৃশ্য হয়। তবু ক্লান্তি বিষণ্ণ ছায়ার ইন্দ্রজাল ছড়িয়ে দিলে শিশুটি পেটের তাঁবুর ভেতর সার্কাসের সাইকেল রেস করে। কদিন ধরেই ওর অস্থিরতা তুমুল হয়ে উঠছে আর খুব দুষ্টুমি হচ্ছে, তাই না – আপনমনে স্বগতোক্তি করতে করতে হঠাৎ ব্যথার তরঙ্গে শিউরে উঠলে, গলার মধ্যে রক্তাক্ত নিশ্বাস আটকে বিবমিষা হয় আর একটা আগুনের চক্রজাল পায়ের তালু ভেদ করে মাথার হাড় ফুঁড়ে বেরিয়ে গেল। মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধে হেরে গিয়ে জিব বেরিয়ে যাওয়া একটা অসুস্থ জানোয়ারের মতো নাড়িভুঁড়ি গলায় উঠে এলো, আর ঘিনঘিনে গন্ধের টকানো লালা। অতঃপর উজ্জ্বল রৌদ্রের চনচনে বিদ্যুৎ সমস্ত আসবাব, ফাইল ক্যাবিনেট, হলুদ-কমলা-সবুজ-নীল ফাইলের গুচ্ছ, ঝুলন্ত ক্যালেন্ডার, জানালার পর্দা, পেপারওয়েট, ওয়েস্টবক্স, স্ট্যাপলার, অ্যাটেনডেন্ট রেজিস্টার, প্রথম আলোর নকশা, কম্পিউটার, মাউস, কি-বোর্ড, পেন- হোল্ডার, অ্যান্টিকাটার, প্রিন্টার বরফের সাদা রঙে ঢেকে দিগ্বিদিক অন্ধ করে দেয়। বেনিআসহকলার বিমূঢ় ঘূর্ণিপাকে রঙের ছুটন্ত রেখাগুলো ধীরে ধীরে ফ্যাকাশে এবং নিরবচ্ছিন্ন সাদার বিচ্ছুরণে আঁধার হয়ে গেলে মাথার ভেতর শিশুটি দৌড়ে বেড়ায়।
শিশুটি তখন হাত-পা ছোড়ার শিক্ষানবিশ, আর দু-একটা অস্ফুট ধ্বনির উচ্ছ্বসিত অনুরণন। তুমি ওসব ধ্বনি আর হাত-পা ছোড়াছুড়ির ইঙ্গিতময় ভাষায় ঘরের কাজ করছ, শিশুর সঙ্গে হাসছ, কথা বলছ, গান শোনাচ্ছ। ইভিনিংওয়াকে তোমরা স্বামী-স্ত্রী, তুমি সহসা শিশুর সঙ্গে স্বগতোক্তি করো। তোমার আইন ব্যবসায়ী স্বামী হাইকোর্টে তার সিনিয়রের পরামর্শে মাজার থেকে সরিষার তেলপড়া আনে, লাল সুতোয় বাঁধা দুর্লভ গাছের শিকড় আনে। তুমি ছুঁয়েও দেখো না, ফলে তোমাদের অভিমান দীর্ঘ হয়, বিষণ্ণতায় কান্না জমে গলার ভেতর। শিশুর রক্ত ও স্নায়ুর শিথিল গঠনে কান্নার পরমাণু সংক্রমিত হলে অভিমান লুপ্ত হয়। তেলপড়া আর গাছের শিকড়ের সঙ্গে হিপোক্রেসি করো এবং সেলফোন কোম্পানির বিজ্ঞাপনের ভাষা রপ্ত করে শিশুর সঙ্গে তুমি কথা বলতেই থাক অবিরাম।
এখনো তেমনি অস্ফুটে স্বগতোক্তি করলে – এতো কান্না পেলে চলবে? যে পৃথিবীতে তুই আসছিস, ফরমালিন আর পেট্রোলিয়ামে ফুসফুস ফুটো হয়ে যাবে। খুব ভয় ধরিয়ে দিচ্ছি! পুরো শহর কালো কার্বন আর রক্তের কসাইখানা। শহরের সব বিষ গলায় ঢুকিয়ে চকচকে ছুরির ওপর তোকে দাঁড়াতে হবে, আগুনে চারপাশ দুমড়েমুচড়ে পড়বে, পোড়া পুঁজরক্তের সিফিলিস ফিনকি দিয়ে ছিটকে বেরোবে, তবু কাঁদলে চলবে না। ফোঁচফোঁচ কান্না কেউ পছন্দ করে না। মনে রেখো – কান্না মানে ভীরুতা, ভীরুতার কোনো ব্যক্তিত্ব নেই। পুরো পৃথিবীই আগুন আর ভয়ের বিভীষিকা, সম্পদের কুক্ষিগত নরক। চারপাশে কিলবিলে ভয়ের রক্তলোলুপ মৃত্যুপিপাসিত তাঁবু। সকলে কেবল নিজের চন্ড লালসার লোভ আর স্বপ্ন চরিতার্থ করার জন্যে নিজেকেই বলাৎকার করে চলেছে। সকলে অন্ধ আদিম জন্তুর মতো গুঁতোচ্ছে, মাতাল শুঁড়িখানায় ধ্বস্ত জীবনের খিস্তি আউড়ে চলেছে। আমার অপূর্ণ স্বপ্নের প্রতিচ্ছবি দেখার আকাঙ্ক্ষা তোর ওপর চাপিয়ে দেবো না। ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার বানানোর জন্যে তোর নাকমুখ দিয়ে রক্ত ছোটাব না, তোর যদি ট্রাকড্রাইভার হতে ইচ্ছে করে, যদি মাংসের দোকানের কসাই হতে ইচ্ছে করে অথবা মর্গের ডোম – তা-ই হবি। অবশ্য ইচ্ছে বেছে নেওয়ার মতো স্বাধীন বুদ্ধি সৃষ্টির পথ তৈরি করে দিতে হবে আমাদেরই। তবু তুই হবি মুক্ত, স্বাধীন।
কেমন বক্তিমা দিয়ে চলেছ তুমি; তোমাদের চেয়ারপারসনের বক্তিমাস্বভাব তোমাকে পেয়ে বসল নাকি! মনে মনে হাসি পেল, আর একা-একা কথা আওড়ানোর ঝোঁক তোমার সন্তানের কানের কাছে ফিসফিস শব্দ করে উঠল – আমি তোর মা, আমার কাছেও তোর কোনো বন্ধন থাকবে না – না কোনো ঋণ, না কোনো প্রত্যাশা। আমাদের ভোগের তৃষ্ণা ও আনন্দের মধ্যে তোর প্রাণ প্রস্ফুটিত। তুই হয়তো এমন নিরানন্দময় পৃথিবীতে আসতেই চাইতি না, আমরা যৌনতার নিষ্ঠুর দুরভিসন্ধিতে তোকে নিদারুণ যন্ত্রণার মধ্যে টেনে আনছি। কিন্তু জীবন অনেক আনন্দের; অবশ্য এ-বার্তা তোকে শুনিয়ে নিজেদের ক্ষমার ঊর্ধ্বে তুলে ধরার অভিপ্রায় নিই। অবশ্য তোমার বাবার এসব নিয়ে খুব পুতুপুতু এথিকস আছে। ক্ষমা নয়, বরং মহত্ত্বের মধ্যে বাঁচো! অবশ্য ‘মহৎ’ শব্দটিও বড়োই আপেক্ষিক। চোরও মহৎ, খুনিও মহৎ, বেশ্যার দালালও মহৎ। আসলে মানুষ স্বভাবতই লোভী ও স্বার্থপর। কিন্তু নিজের লোভ ও স্বার্থ মানুষ দেখতে পায় না, দেখতে পায় না বলেই ক্রমাগত অন্ধ প্রেতের মতো লোভের পেছনে ছুটে-ছুটে নিজেকে নিঃশেষ করে ফেলে। তুমি লোভী আর স্বার্থপর হবে না। লোভ এবং স্বার্থের দাসত্ব মানে পরাধীনতা। এর অর্থ খুনি বা বেশ্যার দালালের মতো মহৎ হওয়া নয়। তুমি হয়তো অন্যরকম মহৎ হবে। একেবারেই অন্যরকম! সেই অন্যরকমটা নিশ্চয় তোর বাবার মতো নয়, সকলে অবশ্য নিজের বাবাকেই পৃথিবীর উৎকৃষ্ট ও মহৎ মানুষ মনে করে। তোর বাবা একটা কসাই, পাষন্ড; সবসময় ইরোটিক চিন্তা কিলবিল করছে ওর মাথায় – সকাল নেই, দুপুর নেই, বিকেল নেই – চান্স পেলেই কেবল শুতে চায়। আর কী বিশ্রী স্বভাব, শুতে না শুতেই ঘোঁৎ-ঘোঁৎ করে নাক ডাকে, আমার ঘুমগুলো চিবিয়ে খায়।
আর তেমনি তুই, ঘুম এলো কি-না, নাড়িভুঁড়ি খামচে পেটের ভেতর দুদ্দাড় লাথি ছুটিয়ে চলেছিস। সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনির পর রাতে একটু ঘুমুতে না ঘুমুতেই এমন অত্যাচার একেবারেই অসহ্য। স্বাধীনমতো বসা যায় না, নিচু হওয়া যায় না, পাশ ফিরে শোয়া যায় না। আচমকা ঘুম ভেঙে যায় দু-তিনবার আর তখন তুই রক্তনাড়িভুঁড়ি চেটেপুছে খেয়ে পেটে একেবারে পৈশাচিক ঝাঁকুনি দিয়ে চলেছিস। তুই একটা শত্রু। একটা আস্ত উদ্গান্ডু ভূত। জীবনের সমস্ত সম্ভাবনার শেষ বিন্দুটিও তোর জন্যে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। আমার অস্তিত্বের প্রতিটি নিশ্বাস থেকে পুষ্টি নিয়ে তুই একটা ডাকাতের মতো চুষেচেটে খামচে আমাকে ছিবড়ে করে ছুড়ে ফেলে দিচ্ছিস। নাকমুখ কপালের উঁচু হাড় করোটি মাথার খুলি চুল আগুনে জ্বালিয়ে দিচ্ছিস। দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে তোকে তখন পেটাতে ইচ্ছে করে। চিৎকার করে দাবড়ে চুলের গোছা মুচড়িয়ে হ্যাঁচকা টানে তোকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলতে পারতাম!
ভাবতেই তখন তোমার মাথার মধ্যে দাঁত কিড়মিড় করে অনেকগুলো হাত-পা গজিয়ে ওঠে, তুমি শিশুর চিকন-চিকন হাত-পা কামড়ে হাড়মাস তুষ করে ফেললে। মাথার মধ্যে তখন নিউমোনিয়ায় মৃত শিশু, স্তব্ধ কাগজের চাঁই, ইনসিকিউরড ফুড, ইনসিকিউরড ওষুধ, ইনসিকিউরড বিদ্যালয়, ইনসিকিউরড গাড়ি, ইনসিকিউরড রাস্তা, ইনসিকিউরড কালচার, ইনসিকিউরড ইনস্টিটিউট, ইনসিকিউরড শিশুপার্ক, ইনসিকিউরড পত্রিকা, ইনসিকিউরড মিডিয়া, ইনসিকিউরড পুলিশ এবং এরকম অসংখ্য ইনসিকিউরিটি আর শহরজুড়ে উঁচু উঁচু পেট নিয়ে ঘুরে বেড়ানো নারীরা দাঁতাল হেসে শিশুদের ক্রসফায়ারে দিচ্ছে। শিশুকণ্ঠের কান্না ক্রমাগত বাড়ছে। কালো, যমকালো কানণার ডিপ্রেশন দীর্ঘতর হচ্ছে।
তারপর ঘরের শূন্য সাদা দেয়াল ভেদ করে হু-হু কান্নার বিলাপ দুষ্পাঠ্য আঁধার চিরে অশ্রু হয়ে এলে তুমি নিতান্ত অবজ্ঞা ও তাচ্ছিল্যে চেয়ে চেয়ে দেখ ইতরের মতো ফুলে ডাঁই পেট, ইল্লত সংসারের এঁটোকাঁটা-ছড়ানো বাসি থালাবাটি, কালো কালো আরশোলা আর গেঁয়ো আপাদমস্তক মুষকো একটা বিকট পুরুষ, তোমার স্বামী, বেঘোরে ঘুমায়। কনসিভ করার পরও ওর প্রলুব্ধ হাঁচড়পাঁচড় ছিল। এরকম একটা মাঝারিগোছের প্রায় বেঁটে মানুষটি বিছানায় যে কী দানব হয়ে ওঠে! এখনো লোকটার রক্তমাংস আর মেরুদন্ডের গিঁটে-গিঁটে ওই দানবটা ওঁৎ পেতে আছে। যৌনতা এবং বাচ্চার জন্মদান স্বামী-স্ত্রীর কাছে কোনো গোপন ব্যাপার নয়, কিন্তু এখন – গত কয়েক মাস কী উপায়ে স্পার্ম খসছে লোকটার? মাস্টারবেট অথবা আর কী হতে পারে ভেবে মাথার তার ছিঁড়ে গেলে চারপাশে আবর্জনার স্তূপ, মাছের পচা অাঁশটে গন্ধ নাড়িভুঁড়ি উপড়ে তুলে আনে, বাজারের চেঁচামেচি, পুরুষ, ঘামের বিটকেলে গন্ধ, বেওয়ারিশ কুকুর, নারী, শিশু, হন্তদন্ত ঘর্মাক্ত মুখ, কথার তোতলামি আড়ষ্টতা, উসকো-খুসকো চুল, অফিস, দাঁতাল ফাইলপত্র – মাথার মধ্যে এক ঘূর্ণাবর্ত তৈরি করে।
একদিন কিচেনের ময়লার ঝুড়িতে কনডমের বাতিল খোসা দেখে কান্না পায় আর বুকের মধ্যে নিঃশব্দে রক্তিম সূর্য ঘোলা জলস্রোত শুকনো বিষণ্ণ গাছগাছালি মুখ থুবড়ে পড়ে। হু-হু বাতাস জানালার গ্রিল আর কালো থাইগ্লাসে ঘষা খেলে অচেনা মেয়েমানুষের শাড়ির অাঁচল, জমিনের রং কুয়াশাদৃশ্যে আচ্ছন্ন হয়। অ্যাবসার্ড মেয়েমানুষের হাসি হাওয়ায় দূরে দূরে ছড়িয়ে যায়। হাওয়ার কোনো চিহ্ন থাকে না, ধ্বনির কোনো উপস্থিতি থাকে না; কেবল অভিজ্ঞতা আর স্মৃতির ভেতর রক্তগুলো মরিচা ধরা ব্লেড। এর বাইরে সেই পুরনো মাংসের অনুজ্জ্বল শর্করা, ঘামের চেনা গন্ধ, উন্মুক্ত স্তন, থরথর জঙ্ঘা। ঘুম থেকে জাগরণ। দাঁত ব্রাশ। ওয়াশরুম। মলমূত্র ত্যাগ। নাস্তা তৈরি। খাওয়া। কথা বলা। হাসি-তামাশা। রাগারাগি। অফিস। হিউম্যান রিসোর্স। ক্ল্যারিফিকেশন। প্রজেক্ট প্রপোজাল। চা। হরলিক্স। গাইনোকোলজিস্ট। ফান্ডাল হাইট। আলট্রাসনোগ্রাম। কপ্যুলেশন। আলিঙ্গন। দীর্ঘশ্বাস। নিদ্রা। জাগরণ। নিদ্রা। জাগরণ। নিদ্রা। জাগরণ…
এসব নৈমিত্তিক আর মনোটোনাস কাজের কথা ভেবে তোমার হাত-পা শুকনো পাথর হয়ে গেল।
যদিও যৌনতা নিয়ে তোমার কোনো প্রেজুডিস নেই। প্রতিটি প্রাণী যেমন নিশ্বাস গ্রহণ করে, যেমন চোখের পল্লব, মাথার চুল, আঙুলের নখ, জিহবা, দাঁত – এসবের বৃদ্ধি ঘটছে, পিউবিক আঁশ গজাচ্ছে, নারী বা পুরুষ সকলেই যেমন হাগে, মোতে – তাদের কেবল যোনি আর লিঙ্গের পার্থক্য, পেট হওয়া না হওয়ার পার্থক্য! তুমি যদি কারো সঙ্গে বিছানায় যাও, পেট-বাঁধানো ছাড়া আর কোনো চিহ্ন থাকতে পারে শরীরের ত্বকে; তাহলে সবই মনের কূট-অভিসন্ধি, মনই যত পাপের আধার, মন ছাড়া পাপ নেই।
আর তোমার সন্তান! সে তো এখনো স্নায়ু এবং রক্তের উষ্ণতার মধ্যে অলৌকিক এক জলযান। তার যৌনাঙ্গের প্রতিটি বৃদ্ধি এবং তার ভাষা তাকে চিনতে শেখাবে, যেভাবে মানুষ বৃক্ষ এবং পাখিদের পরিচয় জানতে শেখে, যেভাবে সকলে শিশুকে বলে – তোমার চোখ কই চোখ; দাঁত দেখাও তো দাঁত – এভাবে, এভাবেই তোমার শিশুর সবচেয়ে ভালো বন্ধু হবে তুমি।
তবু প্রতিদিন অফিসে আসা এবং যাওয়ার সময় লোকটি সঙ্গ দিচ্ছে, কিন্তু কেন? তার জন্যে সহানুভূতি অথবা শেয়ারিং? নাকি এতো আদিখ্যেতা শুধু সন্তানের জন্যে? তার জন্যে নয়? তার রিস্কের কথা ভাবছে না! হঠাৎ বজ্রপাতের চিৎকারে তোমার চিন্তার করোটি ভেঙে চুরমার হয়ে গেলে একরোখা গোঁয়ার স্বভাব উস্কে ওঠে – এই সন্তান আমাদের হলেও একান্তই আমার! আমার রক্তের, আমার মাংসের, আমার নিশ্বাসের, কষ্টের, আনন্দের। আমার হৃৎপিন্ড, ফুসফুস, পাকস্থলি মেরুদন্ড যোনি আর রক্তের ভেতর বেড়ে ওঠা আমারই অপর সত্তা। তোকে কেবল আমিই উপলব্ধি করতে পারি, তোর বলতে না পারা ভাষার অস্ফুট ধ্বনির অর্থ আমিই বুঝতে পারি, আমিই বুঝতে পারি তোর ক্ষুধা, ঘুম, ব্যথা আর দুষ্টুমির ইশারা। কয়েক ফোঁটা স্পার্ম বমি করে দেওয়া ছাড়া এখানে তোর বাবার কোনো ভূমিকা নেই। একেবারেই নাথিং। আপাদমস্তক না! – ভাবতেই অনুভূতি এবং প্রজ্ঞার মধ্যে হিমোগ্লোবিনের ঝিমঝিম ড্রাগ ঢোকে। যদিও কিছুক্ষণ আগের ক্রূর ভাবনাগুলো আপাদমস্তক উলঙ্গ করে ছাড়ে। নিজেকে অকারণ বাতিকগ্রস্ত, বিকৃত মনে হয়। যে- লোকটি প্রতিদিন বাজারে যাচ্ছে, ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাচ্ছে, ওষুধ আনছে, তাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাচ্ছে, সুবিধা-অসুবিধার খোঁজ রাখা, অফিস আওয়ারে নিয়ম করে ফোন করা, পুষ্টির চাহিদা পূরণ, লন্ড্রিতে কাপড় দেওয়া ও নিয়ে আসা, মাঝেমধ্যে চা প্রস্ত্তত, এমনকি বুয়া না এলে ঘর ঝাড়ু দেওয়া, কাপড় ধুয়ে শুকানো ইত্যাদি কাজের একটি নাতিদীর্ঘ তালিকার খসড়া মাথার মধ্যে ট্রোম্যাটিক হয়ে এলে ভোরের অাঁধার-অাঁধার বিছানায় পেটের ওপর বালিশ চাপা দিয়ে শিশুর হাত-পা ছোড়াছুড়ি বন্ধের চেষ্টা করে তুমি হয়তো ডাকলে – এই শুনছ, একটু পানি দেবে? তোমার কণ্ঠস্বর মরবিড হয়ে অাঁধারে ডুবে গেল। অথবা আদৌ কোনো স্বর উচ্চারিত হয়নি, আধো জাগরিত চোখে পুনরায় ঘুমের কুহেলিকা নেমে এলে কেউ পানির মগ এগিয়ে দেয়। তুমি নিঃশব্দে মগ উজাড় করে অাঁধার হয়ে গেলে।
অতঃপর প্রত্যুষে সেই ব্যস্ততা, শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে, কিচেনে, করিডোরে, বিছানায়, ডাইনিংয়ে ক্লান্তিকর গল্পের বিবমিষা :
– অফিসে তুমি এতো স্ট্রেস নিচ্ছ। অসহায় লাগছে!
– দুঃশ্চিন্তা করো না। কদিন পরেই তো ছুটিতে যাবো।
– তোমাকে ভয়ানক মিস করছি!
– ‘!’
– দেখো, মানুষের অসুস্থতা আছে, কিন্তু তার ওষুধ এবং নিরাময়ের উপায়ও আছে!
– তোমার কথা বুঝতে পারছি না, এ-ধরনের প্রসঙ্গ আসছে কেন? নিয়মিত ডাক্তারের কাছে যাচ্ছিই তো, ওষুধও চলছে!
– না, তুমি এত কষ্ট করছ, এক বন্ধুর সঙ্গে কথা বলেছি, ও তো সিজার করে ফেলতে বলে।
অতঃপর আঁধার জমা হয় আলোকিত মুখগুলোতে, আর যাবতীয় প্রগলভতাগুলো শান্ত ও কংক্রিট। আড়ষ্ট জড়বস্ত্ত, কোনো কাজ নেই, ব্যস্ততা নেই, পরিকল্পনা নেই। লেলিহান রক্তশিখায় অন্ধ করুণ কান্নার শব্দরাজি তোমার শরীর জড়িয়ে আকুল আর রক্তজলাশয়ের স্তব্ধ তলদেশ থেকে তোমার পেট চিরে একটা মৃত ভ্রূণ নিয়ে লুকোচুরি করে। অনেক আগে পড়া ওরিয়ানা ফাল্লাচির ‘লেটার টু অ্যা চাইল্ড নেভার বর্ন’ গল্পের কথা মনে পড়ল। তুমি কিছুই বললে না, ভাবলে পূর্বাপর আর একেকটি দৃশ্যের চলচ্চিত্র অনুভূতিহীন বোধহীন কল্পনাহীন দুর্জ্ঞেয় শূন্যতার মধ্যে হারিয়ে যেতে থাকে। তবু কোথাও জীবনের অগ্নিগর্ভ সংকেতের অবশেষে শেষপর্যন্ত শূন্য গহবর ছেড়ে বেরিয়ে আসে একটি ধ্বনি – ‘না’।
ডাক্তার নিয়মিত তোমার ফান্ডাল হাইট মাপেন। একগাল হাসি বিস্তৃত করে বলেন, হাঁটছেন তো? আপনার ওয়েট একটু-একটু বাড়ছে। ভালো, এভরিথিং ইজ ওকে। তুমি হাঁটছ – পা ফুলে কোলা ব্যাঙ, পা এলোমেলো পড়ছে, যেন তুমি নিজেই একটি হাঁটিহাঁটি পা-পা শিশু; পৃথিবীর সমস্ত বস্ত্তকণার ঘ্রাণ নিচ্ছ – মাটির গন্ধ, পানির উচ্ছলতা, টকটকে লাল আগুন – এসব। কেউ তোমার শরীর খারাপ বললে মাথার মধ্যে ওইরকম টকটকে লাল আগুনের বিস্ফোরণ জ্বলে ওঠে নিঃশব্দে। তোমার চোখের নিচে কালো কালো অাঁধারের রং জমেছে। কষ্ট হলে তোমার হচ্ছে, অন্য কেউ তো তোমার কষ্ট বহন করছে না! শারীরিক নানান অসুবিধা হচ্ছে বটে, কিন্তু সেসব নিয়ে তোমার কোনো অনুযোগ নেই। তবে অন্যের কেন এতো মাথাব্যথা – তুমি ভেবে পাও না। একদিন অবশ্য তোমার ভীষণ কান্না পেয়েছিল – অফিসে সকলে তোমার শরীর খারাপ, তুমি অসুস্থ – এসব বলেই চলেছেন, অথচ তুমি ফ্রি ওভারটাইম করছ প্রায় প্রতিদিন। অভিমানে ক্ষোভে প্রচন্ড ধ্বংসাত্মক ক্রোধ অগ্নিগর্ভ অশ্রুজলের গরম স্রোত গলগল করে বেরিয়ে এলো। কণ্ঠ ছিঁড়ে যকৃৎ-ফুসফুস ছিঁড়ে কালো রক্তাক্ত অম্লজল তুমি বের করে দিলে – এতো ওভার লোডেড, এতো কাজ করছ অথচ কোনো অ্যাপ্রিসিয়েশন নেই; কোনো কিছু ভুল হতেই পারে, তার জন্যে তোমার সন্তান কেন দোষী হবে! যার এখনো জন্মই হয়নি, যে এখনো পৃথিবীর আলোই দেখল না, মায়ের কোনো ভুলের দায় কেন তাকে বহন করতে হবে! এসব কান্নার অশ্রুপাত বুক ঝাঁকিয়ে মুষলধারায় নেমে এলে মনে হলো – তুমি ক্রমাগত পেছনদিকে হাঁটছ।
ক্রমাগত পেছন দিকে হাঁটছ আর প্রতিনিয়ত ফুসফুস ধূলিধূসরিত ও দ্রুত হয়ে চলেছে। তোমার হাজব্যান্ড তোপখানা রোডের বিলবোর্ড পড়তে-পড়তে এখন রিসেপশনে। ফরেন অ্যাফেয়ার্সের পাশের গলির চাঁদিতে অটবির ঝুলন্ত ফার্নিচারে সাদা পা বের করে বসে থাকা ফটোগ্রাফিক মেয়েটিকে ঈর্ষা হলো। তোমার স্বামীর লোলুপ চোখ তোমাকে ফাঁকি দিচ্ছে, তুমি থাকো পাতায় পাতায়। তোমাকে ফাঁকি দেওয়া! একবার সাইলেন্ট সেলফোনে ভাইব্রেশন মিসড কল তোমার পেটের ওপর অাঁধারে কেঁপে ওঠে তার অপেক্ষার বিবৃতি নোটিশ করেছে। ফিরে যাওয়ার জন্যে তুমি এসএমএস করে ভাবলে, ও কি আজ বাসায় ফিরে ফ্রেশ হয়ে এসেছে? ভাবতেই সাদা শার্ট আর কালো প্যান্ট, মোজা, অ্যাপেক্সের লেদারে বন্দি অফিসফেরত স্রেফ একজন হতোদ্যম খুনি কয়েদির ছবি দৃশ্য হলো। আর সন্ধ্যার বাজার? ফরমালিনে ভেজানো মৃত্যু এবং পচে ধ্বংসের অন্তর্বর্তী শূন্যতার মাঝে অবাক একদল শিশু মাছ, ম্রিয়মাণ লাল শাক, অমলিন হলুদ কলা, একফালি কুমড়ো, সয়াবিন, আতপ চাল, সুজি, বরবটি, হরলিক্স, গুঁড়ো হলুদ, পেঁয়াজ, দেশি আদা ইত্যাদির গলিত ঝ্যালঝ্যালে ভেষজ গন্ধ এবং স্কাইস্ক্যাপারের চূড়ায় ঘেয়ো মেঘের সঙ্গে মিতালি করে। যদিও সকাল আর সন্ধ্যার সবজির মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই, গলগলে সিফিলিসে চুবিয়ে তবেই বাজারে আসছে; মাছও তাই; দুধ, আপেল, কমলা, কলা সবকিছুই অটোম্যাটিক সার্জিক্যাল ল্যাব থেকে পুঁজরক্তের দগদগে গনোরিয়া ঢেকেঢুকে আনা মসৃণ প্লাস্টিক। কোনোকিছুই পচে হেজেমজে যাচ্ছে না। এসব ভাবতেই একটা কচকচে উপলব্ধিতে শরীর ফেনায়িত বুদবুদ পুঁজ হয়ে ওঠে, চামড়ার নিচে থিকথিকে ঘা। রক্ত আর স্নায়ুর মধ্যে কচকচে বরফকুচি চলকে উঠলে ব্রেস্ট জরায়ু ফুসফুস বৃহদান্ত্র অন্ত্রকে মনে হলো রক্তপুঁজে চুবানো এক-একটা কাঁচা টাটকা রক্তের স্ফটিকচাঁই। একবার বিছানায় ঠোঁট ছোঁয়াতেই শরীর কাঁটা দিয়ে উঠেছিল আর ব্রেস্টের নিপল ভাজা পাপড়ের মতো খচমচ করে ভেঙে গিয়েছিল, আর জরায়ু ডিপফ্রিজে জমাট রক্তের টুকরো-টুকরো স্ফটিকের ঘেমে ওঠা গহবর। শিশুটি ওই রক্তগহবরে ঝিমিয়ে ন্যাতানো হাইব্রিড কইমাছের মৃতদেহ। একটা ভয় হিলহিলে জিব লেলিয়ে চক্রাকারে বাঁধতে থাকলে মনে হয় – তার চেয়ে বরং প্রতিদিন একটু একটু ফরমালিন খেলেই ল্যাঠা চুকে যায়, থকথকে পুঁজরক্তের সিফিলিসে জরায়ু ফুসফুস অন্ত্র কুঁকড়ে উঠবে না। এসব ভাবনা ভয়াবহ দুঃস্বপ্নের হিংস্র স্রোতে ডুবে যেতে থাকলে দুর্দম অগিণরক্তের মাঝখানে শরীরের শক্তি একেবারে নিঃশেষ হয়ে যায় মুহূর্তে, হাতপায়ে অনড় পাথরের আলস্যে বিভীষিকা জেগে ওঠে।
শিশুটি রিভলভিং চেয়ারের ফাঁকে ফাঁকে শাড়ির বিবিধ রং, জামদানি শিল্প আর সবুজ আপেলের মাঝে টলমল হেঁটে এলে কেউ চোখ রাঙাল – এই এদিকে নয়, ওটা ধরছ কেন? কেউ আদর করতে গিয়ে চেহারা বিকলাঙ্গ করে ফেললে শিশু ভয়ে চিৎকার করে অন্ধ হয়ে গেল। শিশুর ঠোঁট চিরে মরবিড লালার ব্লেড নেমে এলো। তুমি হাত বাড়ালে, আর শিশুটি হলুদ ফাইলে বন্দি কালো অক্ষরশোভিত একতাল কাগজে পরিণত হলো। তুমি পেটে হাত বুলিয়ে শিশুর গোড়ালি ধরতে চাইলে আলতো করে – যেভাবে ছোট্ট গোলাপ কুঁড়ির মতো কোমল গোড়ালি ধরে ওর অস্তিত্ব অনুভব করো সবসময় – পেটের ভেতর খসখস করে উঠল শুষ্ক কাগজের চাঁই। তখন বিমূঢ় অসহায়তায় শরীর নির্জীব হয়ে এলে কাগজের ভাঁজে শিশুর কলরোল শুনতে শুনতে মাইক্রোফোন দীর্ঘ প্রস্ত্ততি নিয়ে শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করে, উপস্থিত নারীর মানবাধিকার কর্মীবৃন্দের পরিচয় বিবৃত করে। শিশুটি পেটের মধ্যে ফুটবল কিক করলে তার তরঙ্গ তোমার মুখে এতক্ষণের কৃত্রিম আভিজাত্য কুঁচকে গেল। মাইক্রোফোনে চেয়ারপারসন তোমাকে চোখ বিস্ফারিত করে, অবশ্য এসব কেউ ভ্রুক্ষেপ করেনি, সকলে তখন ট্রান্সপারেন্ট ফাইলে গাঁথা রিপোর্টে ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড জেন্ডার সম্পর্কে রচিত এপিটাফ দেখতে ব্যস্ত। ইহার পর মাইক্রোফোন বলিতেই থাকেন, বলিতেই থাকেন – এতো কিছুর দরকার নেই। অফিসে লাউড নয়েজ হবে কেন, কেবল জুতার সাউন্ড ছাড়া অন্য কোনো সাউন্ড শুনতে পাওয়ার কথা নয়।
পেছনের সাদা ব্ল্যাকবোর্ডের কালো কুচকুচে লেখাগুলো দোমড়ানো-মোচড়ানো জুতো হয়ে তোমাকে জুতিয়ে জুতিয়ে জুতিয়ে ভ্যাবলা করে দেয়। তোমার মনে পড়ল, যখন প্রথম এখানে আসি, একজোড়া বাটার স্যান্ডাক স্যান্ডাল জুতো ছিল আমাদের – আমার আর আমার স্বামীর। ওর অবশ্য একজোড়া কালো সু, এখন যেটা পরে ও রিসেপশনে ঘামছে। দুজন একসঙ্গে কোথাও বেরোলে আমার পায়ে গুঁই সাপের খসখসে চামড়ার মতো ফ্যাকাশে রঙের ওই স্যান্ডেল জুতো আর ও কালো জুতো। ও সকাল-সকাল বাজার অথবা বাইরের কাজ শেষ করে এলে আমি ওই স্যান্ডেল জুতো পরে অফিসে আসি। স্যান্ডেল জুতোটার রবারের সোল পায়ের সঙ্গে এতটাই কোমল হয়ে থাকত, মাঝে মাঝে শিশুর নরম গোড়ালিতে হাত বুলিয়ে তোমার তেমন অনুভূতি।
শিশুর জন্যে এমন নরম একজোড়া লাল জুতোর ছবি তুমি ভাবতে-ভাবতে জুতো জোড়া সুড়ুৎ করে পেটের খোলে ঢুকে পড়েছিল। আর একদিন তোমার এক কলিগের ব্যাগের মধ্যে ছোট্ট একজোড়া লাল জুতো দেখে বিস্ময়ে অলৌকিক জ্যোতিষ্কের বিদ্যুৎদ্যুতি চলকে উঠেছিল। ছুটি না পেয়ে বেচারি জুতো জোড়া দুমাস ব্যাগে করে বয়ে বেড়াচ্ছিল, বাড়ি যাওয়ার দিন যেন ভুল করে ফেলে না যায়।
অতঃপর মরবিড চোখ, স্বপ্নের অ্যাবস্ট্রাক্ট দৃশ্যাবলি, কাচের ধুলো, রেললাইন আর লাল পুরনো বাড়ি, রুপার বাজু, নীল নক্ষত্র, তিলের সন্দেশ, নিরুপম বনস্পতির শূন্য উদ্যান, শাড়ির ভাঁজে লুকোনো গন্ধ, শুকনো খটখটে খড় আর মনের মধ্যে কেবল ‘লাল জুতো’ ‘লাল জুতো’। একটি ছোট্ট বাকস, তার মধ্যে ঘুমন্ত দুটি জুতো, কী মধুর! – জুতো জোড়া সেই নরম-কোমল পায়ের, যে পা দুখানি আদর করে স্নেহভরে বুকে নেওয়া যায়, – পেছন থেকে জুতো জোড়া তাকে টানছে, বিপুল তার টান! যেন ডাকছে।
তুমি বিস্ময়ে শুনতে পেলে, মাইক্রোফোন বিস্ফারিত করে হু-হু বাতাস সেঁধিয়ে যাচ্ছে চোখের মধ্যে। আর প্রতিটি শব্দের প্রতিশব্দ ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তুলে মাংসের নিচে চূর্ণকাচ হয়ে যাচ্ছে – চেয়ারপারসন বললেন – আমি খুব গিলটি ফিল করছি। তুমি প্রতিধ্বনিত হলে, ‘গিলোটিন’ – তোমার করোটির ভেতর ওয়ার্কপ্ল্যান আর প্রোগ্রামিংয়ের ঝকঝকে ছুরি আমূল ফুঁড়ে গেল। ফুসফুস একটা আস্ত স্টিলের বনেট।
চেয়ারপারসন : মোর কমিটমেন্ট উইথ নিউ আইডিয়াস, এটা ডিসিপ্লিনের পার্ট। কিন্তু কোনো নিউ আইডিয়া তোমার ওয়ার্কপ্ল্যানে নেই, কেবল এলাম আর গেলাম – কোনো হলিস্টিক অ্যাপ্রোচ নেই, আমরা জানি তোমার শরীর খারাপ, সিঁড়ি ভাঙতে কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু একটা মিটিংয়ের ডেট এতোটা ভেবে দেওয়া হলো, বাট নো কমপ্লিটনেস, নো পেপারস – ম্যানারিজম, ব্যুরোক্র্যাসি – আই অ্যাম সো সিরিয়াস দিস পয়েন্ট, এক্সক্লুসিভলি ভাবতে হবে; মুড অব অপারেশন…
তুমি : অপারেশন… অপ্রেশন… অপ্রেসড এবং অপ্রেসড উইথ এনজাইটিতে নাকের কঁচি হাড় রবারের নলে পেঁচিয়ে গেল, চেহারা একটা নীল অক্সিজেন মাস্ক হয়ে গেল, অ্যাম্বুলেন্স-ভরা রক্তের সিলিন্ডার, ইম্ব্যালান্স হিমোগ্লোবিনের করুণ মৃতদেহ আর তুমি হাসপাতালের অপারেশন টেবিলে – কাঁচি, ছুরি, সিরিঞ্জ, স্লাইড, ট্রে, তুলা, ব্যান্ডেজ আর অন্ধকার স্যাঁতসেঁতে সুররিয়ালিস্ট স্যানাটোরিয়ামে ফ্রিদা কাহলো; উদ্ভ্রান্ত বুনো শুয়োরের মতো ধাবমান সময়গুলো একটা লক্কড়-ঝক্কড় হিউম্যানহলারে তোমাকে টেনেহিঁচড়ে হাড়গোড় ভেঙে টুকরো করে ছুটছে।
নীরবতার মধ্যে শিশুটি গভীর বিষণ্ণতা নিয়ে অাঁধার হয়ে যাচ্ছে আর দীর্ঘ অশ্রুর ডিপ্রেশন তৈরি করছে। তুমি বলতে চাইলে, প্রজেক্ট ডিরেক্টর ছুটিতে থাকায় আপাতত এটি তোমাকেই দেখতে হচ্ছে, কিন্তু এঁরা কোনো ক্ল্যারিফিকেশন পছন্দ করে না। তোমার কান্না পেল, মাথার মধ্যে শিশুর কল্পিত খেলনাগুলো পৃথিবীর বিলুপ্ত প্রত্নসভ্যতা হয়ে গেলে গোপন অশ্রুপাত তোমাকে সংক্রমিত করে। মাইক্রোফোনে মানবাধিকার সংগঠনের চেয়ারপারসনের নিরবচ্ছিন্ন সংগীত সিঁদেল চোর হয়ে গেল। তুমি প্রজেক্ট প্রপোজালের ফাইলপত্র পুনরায় দেখে নিলে, যাবতীয় ডকুমেন্ট রয়েছে, টেবিলে এক্সট্রা সাদা কাগজ, এক কোনায় বেগুনি নীল অর্কিডের ঝাঁপি। ছানার সন্দেশ, লুচি, ভেজিটেবল, সবুজ আপেল, রেডটি, ঠান্ডা পানির বোতল, টিস্যু পেপার, ওয়াশরুমে নতুন ন্যাপকিন, হালকা গোলাপের এয়ারফ্রেশনার, আড়ংয়ের গিফট বক্স, একটা নীল ব্যাগে সংগঠনের পাবলিকেশন্স – অডিটোরিয়ামের দক্ষিণ দেয়ালে নীল ব্যানার, মেসেঞ্জার, আয়া – স্মৃতির ভেতর চেকলিস্টে চোখ বুলিয়ে নিতে নিতে আরো কয়েকটি সংযোগ করে মৃদু হাসলে – অপেক্ষা, অপেক্ষা এবং ধৈর্যের আলস্যে বালের অপেক্ষা। ততক্ষণে সংগঠনের মেম্বাররা ডেভেলপমেন্ট, জেন্ডার বাজেটিং, সিডও সনদ, নারী উন্নয়ন নীতি নিয়ে সরকারের টালবাহানা, ব্ল্যাক কফি, ডেমোক্রেসি, টকশো, বুয়ার রান্না, জামদানি, রামু, সীমা বৌদ্ধবিহারে হামলা, রোহিঙ্গা, ইত্যাদি বিবিধ আড্ডার মধ্যে কেউ হাই তুললেন, হইচই, হাসিঠাট্টার মধ্যে কারো-কারো চায়ের তৃষ্ণা পেল।
তোমার হাড়ের মধ্যে এয়ারকুলারের বরফ ঢুকছে, সহসা শঙ্কা উপস্থিত হলো – কদিন আগে বিকেলে অফিসে ওপর-নিচ করতে করতে তুমি ভয়ানক পিপাসার্ত হয়ে আয়াকে পানি দিতে বলেছিলে, আয়া পানি নিয়ে এলে কাচের ঘেমে ওঠা গ্লাস এক নিশ্বাসে উপুড় করে দেওয়ার আগ্রহ তোমার পিপাসা মুহূর্তেই তীব্র করে তোলে। তুমি গ্লাসটা হাতে নেওয়ামাত্র তোমাদের ডিরেক্টর অ্যাডভোকেসি কেড়ে নিলেন এক ঝটকায় – ঠান্ডা পানি খেলে শিশুর নিউমোনিয়া হবে। এসব ভাবনা স্মৃতির মধ্যে উসকে উঠলে তুমি দ্রুত বেরিয়ে এলে রিসেপশনে। এখানে গরমে প্রাগৈতিহাসিক গাড়ির তেতে ওঠা ইঞ্জিনের জলকুয়াশা বিকীর্ণ হলো, তবু তুমি দাঁড়ালে ফ্রন্টডেস্ক ধরে। কেউ একজন বসতে বলল, চেয়ার এগিয়ে দিলো কেউ, অফিস ততক্ষণে ফাঁকা হতে শুরু করেছে। তোমার যাওয়ার কোনো সময়-অসময় নেই, তুমি বিমূঢ় হাড়মাংসহীন সময়ের কুহেলিকার ভেতর উবু হয়ে বসলে। এসির মধ্যে এতক্ষণ বসে থেকে রক্তের ভেতর মিশে যাওয়া নিউমোনিয়ার বিষ ক্রমশ ঠান্ডা হয়ে এলে তোমার ঘুম পায়। ঘুমের লুব্ধ আলস্য তাড়ানোর জন্যে তুমি হাঁটলে, পুনরায় বসলে। আবার সেই পিপাসার হাঁসফাঁস স্তব্ধতা কণ্ঠ চিরে উপড়ে তুলে আনছে পাকস্থলী। এত ক্ষুধা পায় ইদানীং, আর এতো দ্রুত ক্ষুধায় ক্লান্ত হয়ে পড়তে হয়, স্নায়ু আর রক্তের মধ্যে যেন উপবাসী একটা পৃথিবী কামড় দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। অফিসের ডেস্কে হরলিক্সের বয়াম, বিস্কিটের প্যাকেট, আচার; ভ্যানিটি ব্যাগে কলা, আপেল, কমলা – খাবার বোঝায় এক অলৌকিক জাহাজের কাছি ধরে তুমি টেনে তুলছ বন্দরে। এখন নিঃসীম একটি মধ্যদুপুরের চন্ডরৌদ্র ঝাঁঝাঁ করে উঠল বুকের ভেতর। দেয়াল ভেদ করে ধেয়ে আসা লু হাওয়ায় রক্ত চুষে তোমাকে নিদারুণ কাঁটাতারের ব্যারিকেড দেওয়া খাঁ-খাঁ সীমান্ত করে দিচ্ছে আর পেটের ভেতর একটি শুমো কুস্তিগির হাঁইহুঁই গাঁইগুঁই করে কাঁটাতার ঝাঁকিয়ে-ঝাঁকিয়ে চিৎকারের বিদ্যুৎহ্রেষায় বিদ্ধ করছে আকাশ, স্তূপ স্তূপ মেঘ। মেঘের কালো তরঙ্গে বুনো মহিষের বাঁকানো শিং ধরে ঝুলছে অগণিত শিশু – কেউ বইপত্র ছিঁড়ে টুকরো করে ছড়িয়ে দিচ্ছে, কেউ বড়ো-বড়ো জুতো উলটো করে পায়ে দিয়ে হাঁটছে, থালাবাটি ফেলে বিকট শব্দের ঝনঝনানি, অপুষ্টিতে চিৎকার করে ধুঁকছে, কেউ খাবারের সমাহার ফেলে কেবলই দুরন্তপনা… আর শিশুদের হই-হুল্লোড়ে বড়োরা তেড়ে ওঠে, দরজা বন্ধ করে দেয়, ভূতের ভয়ে শিশুদের হাত-পা কুঁকড়ে ওঠে, গালের মধ্যে ভুসিমালের মতো খাবার গুঁতিয়ে ঢোকায় আর শিশুগুলো নিশ্বাস আটকে হাঁসফাঁস করে, বিবমিষা করে, কান্নার হেঁচকি তোলে, প্রথম মাস্টারবেট শেখার কৌতূহল নিয়ে বেদম প্রহার করে আর মেয়ে হলে তার মিন্সের আতঙ্কে নিশ্বাসে রক্তবৃষ্টি ঝরে। সহসা এই বিবিধ দৃশ্যের চলচ্চিত্র, তারপর আবার স্তব্ধতা, নাভি থেকে বিষণ্ণ শব্দের কুন্ডলী লালা হয়ে গলায় আটক হলে তুমি পানির একটা বোতল উজাড় করলে এক-নিশ্বাসে। অতঃপর সূর্যাস্ত দেখছ, তার রক্তিম উচ্ছ্বাস নিঃশব্দ ডানায় উড়ে আসে আর তোপখানা রোডের ছুটন্ত গাড়ির সিটি একটার পর একটা উত্তেজিত আওয়াজ তুলে উধাও সন্ধ্যার ছায়ায়, তখন খবর পেলে, অতিথিবৃন্দ আসতে না পারায় আন্তরিক দুঃখ প্রকাশ করেছেন।
সহসা এমন মুক্তির উল্লাস তোমাকে আচ্ছন্ন করে, সন্ধ্যাটা নিরুপম হয়ে ওঠে। বাসায় ফেরার পরিবর্তে সূর্যাস্তের আলোকণা ছুঁয়ে-ছুঁয়ে শিল্পকলার মাঠের আইল্যান্ডে বসলে, শরীর কুঁচকে শিশুটি আড়মোড়া ভাঙে। সবুজ ঘাসে পা, কাঠবাদামের পাতা আর বাগানবিলাস ঝরছে টুপটাপ। কতিপয় স্ট্রিট অর্চিন তখনো ফুটবল খেলছিল এক কোনায়। নাটকের দর্শকদের কেউ কেউ তাকে দেখে। অন্যান্য দিন তার হাজব্যান্ড সঙ্গে থাকে, আজ সে একা, তবু ভয় করল না, বরং চিন্তা এবং নিশ্বাসে গ্রীষ্মিত সন্ধ্যার সূর্যাস্ত মনীষার ভেতর কেমন রোমাঞ্চিত মুক্তির উল্লাসে পুনরায় ভরে উঠল। আর সহসা সন্তানের অস্তিত্ব উপলব্ধি করলে – তোর জন্যে জীবনের সকল শুশ্রূষা জ্বালিয়ে দিয়েছি, তথাপি দুশ্চিন্তা নেই কিছু, এই যে তোমার সামনে বিশাল বর্গাকার আকাশের ডানায় অাঁধার ঘনিয়ে আসছে, নক্ষত্রলোকের দীপালি জোনাকি হয়ে পথ দেখিয়ে দিচ্ছে অনন্তের, তুমি সেই অনাগত স্বপ্নের মুক্তির সোনালি পথের আহবান পাঠ করো। পৃথিবীর পঙ্কিল আবর্তের ঘৃণা আর রাষ্ট্রসংঘের স্বৈরাচারিতা থেকে তোমার আত্মাকে নিয়ে যাও বোধিদ্রুমে।
শোনো, শুনতে পাচ্ছ আমাকে, তোমাকে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা কীভাবে আমার রক্ত ও স্নায়ুর ভেতর উচ্চ আগুনের মতো সংহারী হয়ে উঠল জানো!
দুরন্ত কৈশোরে আমাদের এক বোনের বিয়ে হলো। তখন সে উনিশের কোঠায়। বছর না পেরোতেই কনসিভ করল। আমরা ভাইবোন সকলে তাকে ছুঁয়ে-ছুঁয়ে দেখতাম, কী চমৎকার কমলা আলো ওর শরীর ঘিরে আচ্ছন্ন আর ধূসর গন্ধের উল্লসিত মাতলামি! পেটের ওপর কান পেতে শুনতাম – শিশুটি নড়ছে, শিশুটি অাঁধার হাতড়ে অবিরল হাসছে; কখনো অকস্মাৎ মনে হতো – শিশুটি ভয়ানক ক্রুদ্ধ চিৎকারে অাঁধারের অবরুদ্ধ গর্ভকোষ ছিঁড়ে বেরিয়ে আসবে জরায়ুকুঞ্জে। শেষ মুহূর্তের কটা মাস কিছুতেই বোনটিকে আটকে রাখা গেল না। ওর স্বামী অবশ্য থাকা না থাকা নিয়ে কোনো রা করেনি। যাওয়ার সময় বোন আমাদের অঝোরধারায় কেঁদেছিল আর রাতে আমাকে বুকের মধ্যে টেনে নিয়েছিল, আমরা দুবোন শেষবারের মতো শৈশবে ফিরে গিয়েছিলাম, বোন আমাকে বলেছিল – যদি সে মরে যায় তাহলে তার সন্তানের দায়িত্ব আমার। কদিন পরেই ওরা স্বামী-স্ত্রী ফিরে গেল ওদের গাঁয়ে। আমরা বাবা-মা, ভাইবোন গোপন অশ্রু উৎসর্গ করি; মাঝে মাঝে মুড়ির মোয়া, নারকোল নাড়ু, তিলের সন্দেশ, আমের আচার বানিয়ে বাবা বোনের শ্বশুরবাড়ি পৌঁছায়, হয়তো পরদিনই ফিরে আসে; আমরা শিশুর গল্প শুনতেই হই-হুল্লোড় করি, মা রুপার বাজু বানাতে দেয় স্যাকরার দোকানে। আর বাবার বুকে তখন গোপন সমুদ্র মাথা কুটছে, কাঁটাতারে বিভাজিত ঘাসের শিশির-রৌদ্রে লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে, ছুটন্ত ট্রেনের জানালায় বোনের বিষণ্ণ মুখের দৃশ্য হয়ে যাচ্ছে গ্রামগুলো আর কেবলই সন্ধ্যার আঁধার! বাবার পাঞ্জাবির খুঁটে বাঁধা নির্ঘুম রাতের মৃতগল্প, বোনের কালশিটে চোখ আর ঠোঁটে লেগে থাকা এক টুকরো হলদে ক্লান্তি। বোনের সংসারে কাজ কাজ আর কাজ, শাশুড়ি অসুস্থ, অবসরের কোনো সুযোগ নেই, মা কদিন থেকে এলো, তাতে বোনের কাজ কমেনি। তারপর ধীরে-ধীরে ধূসর দিগন্তব্যাপৃত গভীর সন্ধ্যার নীলাভ্র থেকে উত্থিত প্রকান্ড একটা অজগর খপ করে গিলে ফেলে বোনের শরীর। দিকচক্রবাল বধির করে অন্ধ হাওয়ার ঘূর্ণিস্রোত পাক খেয়ে খেয়ে সন্ধ্যায় বোন আমাদের ব্যথায় আছড়ে পড়ে উঠোনে। হেঁসেলে তখন পেঁয়াজের ধূসর খোসা দুরন্ত হাওয়ায় পৈশাচিক হয়ে উঠছে আর মাছের আঁশ নিয়ে প্রতিবেশী বিড়ালের দুঃসাহসী প্রস্থান। বাচ্চা প্রসবের ট্রেনিং পাওয়া যে-মহিলা বোনকে মাঝে মাঝে দেখত তার আঙুল সহসা বিষাদের সুর ছড়িয়ে দেয়। শিশুর পজিশন স্বাভাবিক নয়, শহরে আনার কোনো ব্যবস্থা তখন নেই, ওদের খুব একটা চিন্তাও ছিল না এসব নিয়ে। গভীর রাতে মহিলা শিশুটিকে বের করে এনেছিল টেনেহিঁচড়ে। বোনের পেটের ওপর পা দিয়ে ক্রমাগত নিচের দিকে ঠেলতে হয়েছিল আর গরম পানি ঢেলেছিল জরায়ুতে। নাকমুখের গেঁজলা তখন রক্তস্রোতে অপার্থিব। বোনের চিৎকারে থরথর কেঁপে বিকলাঙ্গ নিথর পড়েছিল চরাচরব্যাপী গভীর রাত।
খবর পেয়ে আমরা ছুটলাম, আমাদের চোখ ভেসে যাচ্ছে অশ্রুতে। হৃৎপিন্ড রেললাইনের দ্যুতিহীন অসংখ্য পাথরের কালো টুকরোর মতো ভেঙে পড়ছে। ট্রেনের জানালায় গ্রামগুলো স্তব্ধ, ধূসর, দৃষ্টির ভেতর হারিয়ে যাওয়ার নীরব উল্লাসে ক্রূর। নিরবচ্ছিন্ন ধূসর সবুজের একটানা ক্লান্তি, ফাঁকা মাঠ, শুকনো খটখটে খড়, মৃত চিকন খাল, সূর্যের অবর্ণনীয় নিষ্ঠুরতা কিছুই আমাদের চোখ ও ত্বকে দৃশ্যময় হলো না। কেবল জ্বলন্ত ছাই অথবা ধূমধুলোর গন্ধে বোনের মুখ উদ্ভাসিত, বোনের শরীরে লেগে থাকা গন্ধের লাবণ্য আর শিশুর চঞ্চলতা আমাদের চারপাশে হাত ধরাধরি করে ঝিকিমিকি নক্ষত্র হয়ে রইল। তারপরও সেই ক্লান্তিকর যাত্রার শেষবিন্দুতে আমরা হয়তো কেউই পৌঁছুতে চাইনি – সেখানে খোলা দরজার সংহারপিপাসু লোমশ অাঁধার চিরে চাপ-চাপ রক্ত জমাট বেঁধে কালো আগুনের চন্ড জিব ছড়িয়ে রেখেছিল আর স্খলিত রক্তধারার গলিত মাংসের স্থির তরঙ্গে একটি ছোট্ট শিশু কোলে নিয়ে বিমূঢ় বসেছিল তার বাবা। রক্তের কী বিষণ্ণ চোখ, রক্তের কী পৌনঃপুনিক বিলাপ, রক্তের কী নিষ্করুণ খসখসে জিব; আত্মা হিম করা টকটকে উজ্জ্বলতা গর্ভ ফুঁড়ে অাঁধার হয়ে যাচ্ছে, রক্তধারা ধীরে ধীরে সন্ধ্যার গেরুয়া মাংস কাটে। তখন সন্ধ্যার আঁধার ঘনিয়ে আসছে, জ্বলন্ত সূর্যের অবশেষটুকু কাঁটাতারে জমাট রক্তবিন্দু। চরাচরব্যাপ্ত ঝিঁঝির ঝিল্লিরবের অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। দূরে সাঁজালের প্রেতার্ত ধোঁয়া। ঝাঁঝালো গন্ধে নিঃসাড় ন্যাড়ামুড়ো গাছগাছালি, ক্লান্ত সরীসৃপ, নিঃসঙ্গ কীটপতঙ্গ, মৃত ঘাস, ধূসর খড়, শুকনো পাতার স্তূপ, শিশুর বিষাদময় কান্না, পিপাসার্ত কুকুর, বৃদ্ধ নারীকণ্ঠের বিলাপ, মানুষের অস্পষ্ট ছায়া, কাপড় ও কণ্ঠের ফিসফিস, দূরে মিলিয়ে যাওয়া ট্রেনের আলো ও হুইসেল জীবন্ত অন্ধকারের হায়ের মধ্যে ঢুকে গেল আর অচৈতন্য রাত্রির হাড়মাংসহীন নিরালম্ব অশ্রুবিন্দু শুকনো রক্তরেখা হয়ে রইল।
শিশুটি তখন একা, ওর বাবার কোলে। ক্ষুধায় কান্না করলে প্রতিবেশী এক মহিলা নিজের শিশুর সঙ্গে ওকেও বুকের দুধ দেয়। তারপর শান্ত ও নীরব। তারপর নিরুপদ্রব নিদ্রা অথবা শ্রাবণের গুটিয়ে যাওয়া কুঞ্জবনের মতো নিবিড় দুটো চোখ মেলে বিষণ্ণতা ঝরছে। নীল অন্ধকার মেঘে ঢাকা নিঃসঙ্গ একটি দ্বীপের মতো মনে হলো শিশুটিকে। অনেক অশ্রুর ভেতর, অনেক বেদনার ভেতর শিশুটি আমাদের কাছে জীবন্ত একটা স্বপ্ন! রক্ততরঙ্গ, নীল নক্ষত্র, মৃত জোনাকি, নিস্তব্ধ পুকুর, সূর্যের অগ্নিকুন্ড, পাখির ছেঁড়া পালক, বোনের শাড়ি, রুপার বাজু, তিলের সন্দেশ – সবকিছুই একটা নিঃশব্দ দুঃস্বপ্নের লেলিহান জিহবা চেটেপুছে দুমড়ে-মুচড়ে ক্ষতবিক্ষত করে ছুড়ে ফেললেও শিশুটি নিরুপম বনস্পতির জ্যোৎস্নায় ঝলমল করে উঠল। আমি ওর নাম রেখেছিলাম নিঝুম।
শিশুর মুখ রক্তশিখায় অন্ধ করুণ কান্নার শব্দরাজি আমার শরীর জড়িয়ে ধরে আকুল হয়ে। পরাক্রান্ত নিস্তব্ধতার মধ্যে নিঃসঙ্গ অনাথ শিশুটির গাল ছুঁই, মুঠো করা হাত স্পর্শ করি। আমার আঙুল ওর মুঠোর মধ্যে রাখতেই অাঁকড়ে ধরে, ছাড়বে না কিছুতেই। কী বিষণ্ণ হাত; কী বেদনায় ভরা টলটলে লুকোচুরি চোখ – উদ্ভাসিত, করুণ ও ইতস্তত অশ্রুপাতে কেবলই আমাকে মায়াময় করে তোলে; বিপন্ন নদীর গভীর নীলতরঙ্গ ফুঁড়ে দৃশ্যময় সোনালি দিগন্তরেখার রক্তবিদ্যুৎ আমাকে আঁকড়ে ধরে, কী বিপুল আর বিষণ্ণ তার টান; নোনা বিষাদে ভরা কালো সমুদ্র আমার রক্তে বিস্ফারিত, তরঙ্গসঙ্কুল। জ্বলজ্বলে সূর্যালোক সহসা তপ্ত শ্রাবণে ঢেকে যায়, রক্তজলাশয়ের নিস্তব্ধ তলদেশ থেকে আমাদের বোন উঠে এসে নিঝুমকে ওর বাবার কোল থেকে কেড়ে নিতে লুকোচুরি খেলে। তারপর দুজনে রণোন্মত্ত বুনো মহিষের বাঁকানো শিং উঁচিয়ে তাড়িয়ে বেড়ায় দুজন দুজনকে। শিঙে-শিঙে ক্রোধান্ধ ধ্বনির উদ্গিরিত আওয়াজ আতশবাজির মতো অগিণস্ফুলিঙ্গ ছুটিয়ে ফেটে পড়ে। মুহুর্মুহু অগ্নিরক্তস্ফুলিঙ্গে শিঙের লেলিহান শব্দবিদ্যুতের উত্তাল তরঙ্গে শিশুটিকে নিয়ে রাতদিন লোফালুফি চলতে থাকে। অতঃপর ট্রেনের জানালায় দূরের গ্রাম, আদিগস্ত ধূসর মাঠ, ছোট ছোট স্টেশনের লাল ঘর, দুর্ভিক্ষের ধ্বস্ত নীরবতা নিয়ে অপেক্ষায় কয়েক প্রবীণ নারী-পুরুষ, আম-কাঁঠালের বাগান, খড়ের স্তূপ বর্ষায় ধুয়ে গলে বয়ে যায়, ঝাপসা হয়ে যায়।
ঝাপসা আর অস্পষ্ট। অস্পষ্ট আর ঝাপসা! ঝাপসা কুয়াশায় বোনের শৈশব, বোনের শরীরজুড়ে পেটের ভেতর শিশুর নড়াচড়া, বোনের গায়ের ধূসর গন্ধের উল্লসিত মাতলামি, সংগীত ও নৃত্যকলা ভবন, কাঠবাদামের গাছ, ক্রিস্টমাস ট্রি, আর্ট গ্যালারি, সবুজ পুকুর, কফি হাউস, নাট্যশালা, দুদকের বাড়ি – সবকিছু ঝাপসা হয়ে এলে তোমার সন্তান তোমার হাতের আঙুল আঁকড়ে ধরে।
চারপাশের সন্ধ্যাবাতিগুলো অশ্রুবিন্দু হয়ে গেল, তখন তুমি উঠলে, শিশুর মুঠোর ভেতর তোমার আঙুল, মাথার ওপর আকাশের বর্গক্ষেত্রে উৎকীর্ণ সন্ধ্যানক্ষত্রের স্নিগ্ধ আলোরেখা অশ্রুর অবরোধ লুপ্ত করে তোমাদের চোখমুখে আঙুলে গোঁড়ালিতে স্পর্শ করে। একটা সরকারি পিকআপ সামনের রাস্তা দাবড়ে মৎস্যভবন পেরিয়ে শাহবাগের দিকে নিরুদ্দেশ হলে গুঁড়ো-গুঁড়ো কাচের ধুলো আর ধোঁয়ার কালো কুন্ডলী রৌদ্রোজ্জ্বলময় গ্রীষ্মিত দিনগুলোর স্মৃতি নীলাভ্রের নক্ষত্র ছায়াপথে মাটির গভীর থেকে অঙ্কুরের গান শোনায় আর জন্মপূর্বের নিঃশব্দ আধারের নিশিলিপিপত্রে তখন পৃথিবী ওকে ডাকে।