আমাদের গ্রামে এখন এক-আধটা নয়, ফোন আছে চল্লিশ-পঞ্চাশটা। তাও আবার যে সে ফোন তো নয়, রীতিমতো ‘সেলফোন’। অর্থৎাৎ মোবাইল ফোন। বিদ্যুৎ নেই, তাই ল্যান্ড-ফোনের প্রশ্নও নেই। অন্ধকার সান্ধ্যরজনীতে ঝোপে-ঝাড়ে এখন যত না জোনাকির আলো জ্বলে তার চাইতে সেলফোনের আলোই জ্বলে বেশি। মানুষ যত না ঘরের লোকের সঙ্গে কথা বলে, কানে মোবাইল চেপে তার চেয়েও বেশি কথা বলে বাইরের লোকের সঙ্গে। ‘হ্যাঁলো!’ একটা কিছু কথা যেন ভেসে আসে ওধার থেকে। এধারের জবাব, ‘না, আমি সনাতন।’ দীর্ঘপ্রবাস হেতু হয়তো অচেনা ঠেকল নামটা। ‘কে সনাতন?’ এধার থেকে উত্তর, ‘হারাধনের ছেলে গো – আমাকে চিনতে পারছেন না?’ হারাধন! সনাতন! সনাতন! হারাধন! – ‘ও-হো-হো-হো – তুই!’ মনে পড়ে যাওয়ার অঝোরঝর আনন্দ! তারপর তো একে একে অনেক কথা। ‘কেমন আছিস রে?’ উত্তরে হয়তো শোনা গেল – ‘আছি ওই একরকম।’ কোথাও কী একটু অভিমান, বিষণ্ণতা ছুঁয়ে যাচ্ছে? এধার-ওধারে সামান্যক্ষণ নীরবতা। তারপরেই – ‘হ্যাঁ রে – তোর বাপটাই বা গেল কোথায়? হারাধন – ওই হতভাগাটা আছে কেমন?’ ফোন কি কেটে গেল? কথা শোনা যাচ্ছে না কেন? – ‘হ্যাঁ লো! হ্যা লো!’ উত্তর এলো তৎক্ষণাৎ, ‘বাবা ভালো নেই।’ ‘তার হয়েছেটা কী?’ সামান্য উত্তেজিত শোনাল ওধারের গলা। ‘তেমন কিছু না, বাত। বাতে হাঁটতে চলতে পারে না আর, শুয়ে থাকে খাটেই। একেবারে শয্যাশায়ী।’ ‘ডাক্তার দেখাসনি?’ দীর্ঘক্ষণ নীরবতা। ফোনটা কিন্তু চালু আছে। এই ফাঁকে পিড়িংপাড়াং করে ফোনের ভেতর ঢুকে আসছে দুয়েকটা মুরগির কুঁক-কুঁক্ কোঁকর, কোঁ, দূরাগত কাকের কর্কশ ডাক, পায়রার বক্বকানি। তার সঙ্গে অন্য একজন মানুষের গলা, ‘কার সঙ্গে কথা বলছিস রে?’ ‘জেঠুর।’ ফোনের ওধারে যে, তার বুঝতে অসুবিধা হলো না, খামারে খাটিয়ায় শুয়ে আছে হাঁটা-চলায় অপারগ তারই খুড়তুতো ভাই হারাধন। হাতের কাছে ঠেস দিয়ে রাখা তার লাঠিগাছাটা। খাটের তলায় ভুক্তাবশেষসহ খাবারের থালা। সেখানেই যত কাক-কুক্কুটের আনাগোনা! আর তাদেরই ‘কঁক্-কঁক্’ ‘কা-কা’ সনাতনের ফোনে। ‘এ্যাই সনা! ফোনটা দে তো হারাধনকে!’ অকস্মাৎ ছর্রা বন্দুকের গুলি ছোড়ার আওয়াজ – ‘গুড়ুম! গুড়ুম!!’ তার শব্দ, সেইসঙ্গে আমাদের দালানের পায়রাগুলি যারা খলা-খামারে তো খলা-খামারে, মাটির হাঁড়ির টোঙের ভেতরেও ঘুরে ঘুরে মুরুবিবর মতো অনর্গল ‘ব-ক-ম ব-ক-ম’, বকে চলে, তারাও ডানা ঝাপটিয়ে ডানায় যেন পালটা গুলি ছোড়ার আওয়াজ তুলে ভদভদিয়ে উড়ে গেল একসঙ্গে, তার শব্দও ফোনের ভেতর এসে গেল। কেটে গেল ফোনটা। দুই কেটে গেল এই ফোনটা কিন্তু সচল হলো আরেকটা। বলেছি, গ্রামে তো গ্রামে, আমাদের ঘরেই মোবাইল ফোন আছে চার-পাঁচটা! একটা হারাধনের, একটা ছোটকাকার বড়ছেলে হাড়িরাম বা রমেশের, আরেকটা বড়দার, চতুর্থটা মেজোকাকার ছেলে হেমন্তের, সর্বশেষ যতদূর খবর পেয়েছি আমার নকাকার মেয়ে ক্লাস সিক্স-সেভেনের পঞ্চমীও একটা কিনে ফেলেছে। এখন গ্রামেগঞ্জে যেন ফোন কেনার হিড়িক পড়েছে। ‘এয়ারটেল’, ‘ভোডাফোন’, ‘বি-এস-এন-এল’ – ‘হ্যালো!’ ওধারে ছোটকাকার গলা। ‘হ্যাঁ, ছোটকাকা! বলুন!’ কিছু একটা বিস্তারিত বলতে যাচ্ছিলেন ছোটকাকা, তাঁকে থামিয়ে দিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘পরে শুনছি আগে বলুন তো -’ ‘কী?’ ‘এই যে একটু আগে হারাধনের ফোনে একটা গুলির আওয়াজ শুনলাম, যার জন্য আমাদের টোঙের গোলা পায়রাগুলোও ডানা ঝাপটিয়ে ভদ্ভদিয়ে উড়ে গেল – মনে হলো। তারপরে ফোনটাও কেটে গেল – কিছুই বুঝতে পারছি না, ফোনেও আর ধরা যাচ্ছে না। হারাধন, সনাতন – ভালো আছে তো?’ কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ। মনে হয় ফোনটা হাতে ধরে ছোটকাকা হারাধন সনাতনের খোঁজখবর নিতে গেলেন। ঠিক তাই। ফিরে এসে বললেন, ‘কই, এই তো দেখে এলাম খাটেই শুয়ে আছে ঘাসি।’ হারাধনের ডাকনাম ‘ঘাসি’ কী না। ‘আর গুলির শব্দ?’ ‘ও কিছু না -’ বলেই কাকা যেন কিছু একটা চেপে গেলেন। তারপরেই বললেন, ‘জানিসই তো, গ্রামে একটা পাগলা আছে। ওই পাগলা ত্রৈলোক্যই মাঝে মাঝে বন্দুকের নল পরিষ্কার করার নাম করে শূন্যে গুলি ছুড়ে ফাঁকা আওয়াজ করে দেখে তার বন্দুকের কলকব্জা ঠিক আছে কী না।’ হ্যাঁ, কাকার কথায় মনে পড়ল ত্রৈলোক্যকে। পুলিশে সার্ভিস করতেন। রিটায়ার্ড করার পরে এখন গ্রামেই আছেন। তাঁর পোশাক-আশাকের শ্রীছাঁদ লক্ষণীয়। নিদারুণ গ্রীষ্মেও কনুইয়ে চামড়ার তাপ্পি-দেওয়া ফুলহাতা খাকি রঙের সোয়েটার। আবার শীতের দিনগুলোয় খাকি রঙের হাফ-প্যান্ট, লাউফুলের মতো সাদা হাফ-হাতা স্যান্ডো গেঞ্জি, পায়ে গামবুট পরে ঘরেই ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কালভদ্রে গ্রামে গেলে তার সঙ্গে দেখা হয়। এতো তড়বড় তড়বড় করে কথা বলেন, তাবড় তাবড় বিষয়কে এমন ফুৎকারে উড়িয়ে দেন যে, তাঁকে দেখলেই আমার মনে পড়ে যায় ক্ষুধিত পাষাণের পাগলা মেহের আলিকে, যে কী না সবকিছুকেই উড়িয়ে দিয়ে চিৎকার করে ঘোষণা করত, ‘তফাত যাও, তফাত যাও। সব ঝুট হ্যায়, সব ঝুট হ্যায়।’ তা, ত্রৈলোক্য তাঁর লাইসেন্সপ্রাপ্ত বন্দুক দিয়ে ‘ব্ল্যাঙ্ক ফায়ার’ করতেই পারেন। কাকাকে বললাম, ‘ব্ল্যাঙ্ক ফায়ার করলে তো বলার কিছু নেই। কিন্তু যা সব ঘটছে -’ ‘কোথায়?’ মনে হলো ছোটকাকার কাছে এখনো তেমন খবর পৌঁছায়নি। আর তাছাড়া আমাদের ওদিকটা এখনো শান্ত আছে। বলব না বলব না করেও বলে ফেললাম জায়গাটার নাম। নাম শুনে ছোটকাকার তেমন কিছু ভাবান্তর হলো বলে মনে হলো না। না হতেই পারে, কেননা, এমন একটা গ্রাম যেখানে টিভি তো দূর-অস্ত, একটা খবরের কাগজও পৌঁছায় না। তবে হ্যাঁ, আছে গাদাগুচ্ছের ‘সেলফোন’ – তিন সবাই চলে গেছেন, এমনকি মা-বাবাও। বাবা তো গেছেন সেই কোন ছেলেবেলায়! তিনজন কাকিমা আর কেবলমাত্র ছোটকাকাই এখনো আছেন। সবেধন নীলমণি ছোটকাকারও এটা-ওটা চেয়ে আবদারের শেষ নেই। কখনো জামার ছিট, কখনো আস্ত এন্ডির চাদর, মাঙ্কি ক্যাপ, মাফলার। কখনো বা বেনীমাধব শীলের ফুল ডাইরেক্টরি পঞ্জিকা, ইশবগুলের ভুসি, ষোলাগুণের শিশি। শহরে থাকা বড় চাকরি করা ভাইপোর কাছে তা তিনি চাইতেই পারেন। আর আমিও সেসব দিতে এতটুকু কার্পণ্য করি না। আমাদের খুড়ো ভাইপোর ভেতর একটা অদ্ভুত রকমের সখ্যও আছে। ধরেই নিয়েছিলাম আজো কিছু একটা চাইবেন, তাই খেই ধরিয়ে দিয়ে বললাম, ‘হ্যাঁ, কী বলছিলেন বলুন!’ আমতা-আমতা করছেন ছোটকাকা, ‘না, কী আর বলব?’ ‘বলুন না!’ ‘তুই তো বলেছিলি -’ ‘কী?’ যেন খানিকটা দম নিলেন ছোটকাকা, ইতস্তত করছেন কিছু একটা বলতে। ফোনের নিস্তব্ধতার এই ফাঁকে ফোনের ভেতর ফের ঢুকে আসছে আমাদের দালানের পায়রাগুলির বক্বকানি। আগের তুলনায় আরেকটু জোরে জোরেই তারা যেন গলা ফুলিয়ে ফের শুরু করেছে মুরুবিবয়ানা – বক্ বক্ বকম! বক্ বক্ বকম!! প্রায় সত্তর ছুঁইছুঁই ছোটকাকার আবদারে সময় সময় খুব মজা পেয়ে যাই আমি। সামান্য অথচ এমন একটা জিনিস চেয়ে বসেন যা খুঁজে পেতে আমাকে হন্যে হয়ে ঘুরতে হয়, এই যেমন ‘ঘোড়ার নাল’।
তেতাও যেমন তেমন নাল হলেও না হয় হতো – চাই কী না কালো ঘোড়ার ‘নাল’! ঘুরে ঘুরে ঘোড়ার ‘নাল’ না হয় পাওয়া গেল কিন্তু তা যে কালো ঘোড়ারই নাল – তার গ্যারান্টি কোথায়? নানা রঙের ছাঁট-কাপড়ের জোববা পরা ফুটপাতের দোকানদার জোরগলায় হাঁকলেই কি বিশ্বাস করা যায়? অগত্যা তাই কিনে ভিপিপি করেই পাঠাতে হয়। কিন্তু এবারের জিনিসটা নাকি দেবো বলে আগেই কবুল করেছি আমি! কী জিনিস, কী – কিছুই তো মনে পড়ে না। ‘ছোট্কা! বলুন না – কী বলেছিলাম? আমার তো মনে পড়ছে না।’ ‘বলেছিলি – কিনে দিবি একটা হারমোনিয়াম।’ হ্যাঁ হ্যাঁ, মনে পড়েছে বইকি – খানিক চুপ মেরে থাকি। না হয় ছোটকাকার গান-বাজানার শখ আছে, মৃদঙ্গ বা শ্রীখোল বাজাবার হাতটা ভারি ভালো, বৈশাখী সন্ধ্যায় গ্রামে নগরকীর্তনে কিংবা প্রতিমাসে পূর্ণিমায় হরিমন্দিরে তাঁর হাতের চাটিতে মৃদঙ্গ বা শ্রীখোলে যখন বোল ফোটে, ‘তিনি তা তিনি ধো তিত্তা খেট্টা ঝেনে ঝেনে খেট্টা তিনি তিনি তা তিনি তা ধো ধো তা ধো’, তখন আসরে ‘ধন্য’ ‘ধন্য’ পড়ে যাবে না? ‘বলি হারি’ ‘বলি হারি’ বলে শোরগোল উঠবে না? কিন্তু এখন – যখন থম মেরে থাকে জঙ্গলমহলের আকাশ, বাতাস রুদ্ধশ্বাস, নক্ষত্রেরা স্থির, নিষ্কম্প, কালেভদ্রে ঝুরঝুর করে ঝরে পড়ে একটি-দুটি ‘পাপীতারা’, যখন পড়ন্ত ‘পাপীতারা’ দেখেও হাতের কড়ে আঙুল কামড়ে ‘ছিঃ থুঃ’ করে বুকে থুথু ছেটাবার একটা লোকও বাইরে খলা-খামারে দাঁড়িয়ে থাকে না, গভীর নিশিথে বনমোরগ বাঙ্ দিয়ে যায়, অচেনা বিস্ফোরক শব্দে ডানা ঝাপটিয়ে ভদ্ভদিয়ে উড়ে ওঠে গৃহস্থের দালানের ‘দাঁতিয়ায়’ ঝোলানো হাঁড়ির ভেতর ঘুমন্ত পায়রাগুলি, আচমকা অন্ধকার রাতে কারো বাড়িতে নারীকণ্ঠে কান্নার রোল উঠলে কেউ যখন ওদিকে পা বাড়ায় না ভুলেও – তখন – তখন – আমাদের সত্তর ছুঁইছুঁই ছোটকাকা কী গলায় হারমোনিয়াম ঝুলিয়ে ‘উদাস’ কণ্ঠে গেয়ে উঠবেন… ‘মন্দির মসজিদ সোপানতলে, কত প্রাণ হলো বলিদান, লেখা আছে অশ্রুজলে…’? কোনোমতে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, ‘আচ্ছা, দেবো যখন বলেছি, দেবোই।’ ‘তাই দিস, তোর যেমন সুবিধা।’ আনন্দে আপ্লুত শোনাল ছোটকাকার গলা। চার আমাদের গ্রাম খুবই বর্ধিষ্ণু গ্রাম। যদিও একটা পাকাবাড়ি নেই, সব বাড়িই মাটির। ইটের দেয়াল দু-একটা পাওয়া গেলেও সব ছাউনিই খড়ের। গ্রামের রাস্তা দিয়ে ‘ক’ বাবুর গরু গোচারণে যেতে যেতে ‘খ’ বাবুর ঘরের চালে মুখ দিয়ে দুয়েক গোছা খড় টেনে মুখে পুরলেও ‘খ’ বাবু তেমন কিছু মনে করেন না, বড়জোর ‘ক’ বাবুর গরুবাগালকে আদর-মিশ্রিত ধমকের সুরে বলেন, ‘অ্যাই র্যা আশু, এমন করলে সামনের বর্ষায় আর যে ঘরে তিষ্টোতে পারব না বাবা! গিনা-বাটি-তাটিয়া এমনকী আমানি খাবার কানাভরি গামলাটা পেতেও অঝরঝর বৃষ্টির টুংটাং জলতরঙ্গ-বাজনা থামাতে পারব না যে!’ ‘ক’ বাবুর গরুবাগাল সংযত হয়, ত্যাঁদোড় গরুটার পিঠে লাঠির ঘা দিয়ে শ্রদ্ধামিশ্রিত সুরে বলে, ‘ভুল হয়ে গেছে বড়বাবা! ছতিশ মাস্টারের গরুটাই ভারি বজ্জাত আছে।’ তারপর হয়তো সারারাস্তাটাই সে ভাবতে ভাবতে গেল – ওই যে বলল – টুংটাং জলতরঙ্গ-বাজনা, কোথায় যেন সে শুনেছে! রেডিও, না যাত্রায়? আর তাছাড়াও বর্ষাকালে সামান্য বৃষ্টি হলে তাদের চাল ফুঁড়েও তো জলের ধারা নামে, মা তার জলের ধারা বরাবর গিনা-বাটি-তাটিয়া পেতে রাখে, পড়ন্ত জল আর বাটিতে তখন আওয়াজ ওঠে ‘টি-ঙ। ঙ্! ঢি-ঙ্— !’ তাই হয়তো বলে জলতরঙ্গ বাজনা। আমাদের বাড়িটা গ্রামের ঠিক মাঝখানে। খড়ের চাল, মাটির দোতলা। উত্তর-দক্ষিণে টানা, দক্ষিণের ‘টুইটা’ সামান্য হেলে আছে, তার মানে ভাঙা। দুই চালের মাঝ বরাবর দালানের ‘দাঁতিয়া’য় ঝোলানো খান পঞ্চাশেক পায়রার ‘টোঙ’। কমপক্ষে জোড়া জোড়া ধরলেও সাকল্যে একশটা পায়রা। আমাদের যৌথ পরিবারে আমরা ছোটরাও কম যাই না। বাবা, পাঁচ কাকা, দুই বিধবা পিসির সন্তানাদিসহ আমরাও কম করে জনাতিরিশ। তবু আমাদের মেজোকাকার কাছে সংখ্যায় তো সংখ্যায়, আদর-কদরের দিক থেকেও আমাদের চেয়ে পায়রাদের প্রতি যৎকিঞ্চিৎ হলেও বেশি ছিল। পায়রাদের খাওয়ানো থেকে শুরু করে মলমূত্র পরিষ্কার করা ইস্তক সব কাজই নিজহাতে করতেন মেজোকাকা। পরিষ্কার আর কী, ঝেঁটিয়ে সাফা করে ঝুড়িতে ভরে রেখে আসতেন ‘ডাহি-জমিনে’।
তাই পচে সার হতো। তপোবন জঙ্গললাগোয়া আমাদের ডাহি-জমিন। পায়রার গু-পচা সারে ডাহি-জমিনে এমন এমন বেগুন, বরবটি আর মকাই ফলাতেন যে তল্লাটের নামজাদা কোবরেজ তো কোবরেজ, চাষি হিসেবেও তাঁর নামডাক ছিল। আমাদের সেই নামজাদা মেজোকাকা আর নেই কিন্তু বংশানুক্রমিকভাবে পায়রাগুলো এখনো আছে। কি টোঙ কি জোড় হিসেবে সংখ্যায় বেড়েছে বই কমেনি। পূর্বাহ্নে কী অপরাহ্ণে তারা বিলে-বাতানে চরে বেড়ালেও মধ্যাহ্নে তারা ঠিক বাসায় ফেরে। আর তখনই আমাদের পরলোকগত মেজোকাকার পদাঙ্ক অনুসরণ করে, উঁ-হু ছোটকাকা নন, আমাদের বেঁচে থাকা কাকিমারাই, বিশেষ করে ন’কাকিমাই মুঠো মুঠো ধান ছড়াতেন, কখনো চাল কখনো খুদ। দানাশস্য খুঁটে খেতে খেতে পায়রাগুলো যেন টোল খুলে টুলো পন্ডিতদের ন্যায় স্মৃতিশাস্ত্র ব্যাকরণ বাক্য ইত্যাদি অধ্যাপনা করছে, কেউ কেউ আবার কালিদাসের মেঘদূত আউড়াচ্ছে গমগমে গলায় – প্রত্যাসন্নে নভসি দয়িতাজীবিতাবলম্বনার্থী জীমুতেন স্বকুশলর্ময়ীং হারয়িষ্যন্ প্রবৃতিম্। স্ব প্রত্যগ্নৈ কুটজ কুসুমৈঃ কল্পিতার্ঘায় তস্মৈ প্রীতঃ প্রীতি প্রমুখ বচনং স্বাগতং ব্যাজহার??৪?? শ্রাবণ মাস এসে গেছে, বিরহী যক্ষ মেঘের মাধ্যমে তার কুশলবার্তা পাঠাতে চায় দয়িতাকে, নবজাত কুটজকুসুমের ডালি উপহার দিয়ে মেঘকে তাই ভালো ভালো কথা বলে সাদর সম্ভাষণ জানাচ্ছে যক্ষ। এ যেন সেই ‘যাও পাখি বলো তারে’।
পায়রার বকম-বকম শুনতে শুনতে আর কার কী মনে হতো জানি না। আমার এই প্রকারই মনে হতো। পাঁচ শহরে – রাস্তায়ঘাটে, বাসেট্রামে, মর্নিংওয়াকের মাঠে, অফিস-আদালতে, কফিহাউসে, রেস্তোরাঁয় – সব জায়গায় এখন সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম, লালগড় আর জঙ্গলমহল। সিঙ্গুর থেকে নন্দীগ্রাম – জমি থেকে উচ্ছেদ হয়ে গেলেন চাষিরা, প্রতিবাদে তাঁরা সোচ্চার হলেন, তাঁদের ওপর চলল নির্বিচারে গুলি – ধর্ষিতা ও খুন হয়ে গেল তাপসী মালিক। গণহত্যা ঘটল নন্দীগ্রামে, ইজ্জত লুট হলো নন্দীগ্রামের নারীদের। সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম, লালগড়, জঙ্গলমহল – সর্বত্রই শাসক-পুলিশ-নেতা-ক্যাডারদের নারকীয় ও দুঃশাসনীয় উল্লাস! তার মধ্যেও শোনা গেল নিহতের মায়ের উচ্চকিত গলা – ‘আমার আর একটা ছেলেকেও মরতে দিতে রাজি আছি, তবু জমি আমি দেবো না!’ ইতিহাসের নাছোড় পালাবদলের ইঙ্গিত নয় কী? আজকাল এসমস্তই আলোচনা হয় অফিসে, কলিগদের সঙ্গে। কফিহাউসে, বন্ধুদের আড্ডায়। আলোচনায় উঠে আসে বইকি আলামণি শবরের কথা, কেঁদুপাতা – ‘বাবই ঘাসের’ দড়ি – ‘কুরকুট্পটম্’ অর্থাৎ লাল-লাল পিঁপড়েদের ভাতের মতো সাদা সাদা ডিমের কথা। – ‘কী জিনিস? আর খেতেই বা কেমন?’ অনেকে জিজ্ঞাসা করেন। বলি, ‘পোস্তপড়ার মতো – টক টক, ঝাল ঝাল – খেতেও তো মন্দ না!’ সহসা বাড়ির জন্য মন আনচান করে। কিন্তু গলায় তো ঝোলানো আছে নিষেধাজ্ঞা – ‘এখন আসিস না!’ পরের দিনই সকালে খবরের কাগজের প্রথম পাতায় ছবি দেখে আঁতকে উঠি। – এ কার ছবি? কে এ? পরনে সালোয়ার-কামিজ, হালকা নীল রঙের। পা-দুটো দড়ি দিয়ে বাঁধা বাঁশের সঙ্গে, হাত দুটোও। মাথাটা যা মুক্ত, ঝুলে আছে। লম্বা বাঁশের দুদিকে যৌথবাহিনীর দুই জওয়ান কাঁধে করে মৃতদেহ বয়ে আনছে। দেখেই মনে হলো এ আমাদের গ্রামের সাঁওতালপাড়া কী কামহারপাড়ার কেউ একজন হবে। কাঁদরী কি? না, গুরুবারী? উহু, রানাদের কুস্মী? হ্যাঁ, কুস্মীই – বৈশাখে বুদ্ধপূর্ণিমায় সাঁওতালদের শিকার উৎসব, ‘দিশম সেঁদ্রা’। ‘টি-লি-ঙ ডু-বু-ল ডু-বু-ল’ করে ধামসা মাদল বাজিয়ে সারারাত জেগে সারাবন তোলপাড় করে তারা শিকার ধরে। কী আর পায় – বড়জোর দু-চাট্টা ‘বরা’ বা বন্যশুয়োর, দু-দশটা ‘ঝিঁকর’ বা সজারু, আর মেটে খরগোশ! তাই বাঁশে দড়ি দিয়ে বেঁধে দুজনে মিলে কাঁধে ঝুলিয়ে ধামসার তালে নৃত্য করতে করতে নিয়ে আসে যুদ্ধজয়ের উল্লাসে। এও যে তাই, তাই। খবরে প্রকাশ – ‘শালবনির রঞ্জার জঙ্গলে রাতের অন্ধকারে মাওবাদীদের সঙ্গে যৌথবাহিনীর সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে নিহত আটজন মাওবাদী। তার মধ্যে দুজন মহিলা। প্রশ্ন উঠেছে, অভিযান রাতের অন্ধকারে কেন? বলা হচ্ছে, অ্যাসল্ট রাইফেল হাতে যৌথবাহিনী নাকি নিদ্রিত মাওগেরিলাদের ঘিরে ধরে গুলি করে মেরেছে। তারপর সকালে প্রকাশ্য দিবালোকে বাঁশে হাত-পা বেঁধে ঝুলিয়ে নিহত পশুদের মতো তাদের বয়ে আনছে দুজন করে জওয়ান। এ যেন মহাভারতের অশ্বত্থামাকৃত ‘সৌপ্তিক’ যুদ্ধ। রাতের বেলা ‘সৌপ্তিক’ যুদ্ধ নীতিবিরুদ্ধ, যে-যুদ্ধে পিতৃশোকে উন্মাদ অশ্বত্থামা হত্যা করেছিলেন দ্রৌপদীর নিদ্রিত পুত্রদের। সেই যুদ্ধের অনৈতিকতা নিয়ে সংশয় ছিল না অশ্বত্থামার মনে। কিন্তু, ক্রোধ এমনই, অনৈতিক হতে বাধেনি তাঁর। এক্ষেত্রেও তো তাই। সেই ‘ট্র্যাডিশন’।
বড়দাকে ধরলাম, যথারীতি ‘সুইচড অফ’।
বউদি বা তাঁর ছেলেমেয়েদের কাছেও ফোন নেই। কী যে করেন না বড়দা! এদিকে বলবেন, ‘এখন আসিস না।’ আবার ওদিকে ফোনও খুলবেন না! কে জানে কেমন আছে রমেশ আর হেমন্ত! হেমন্তকেই ধরলাম। সেদিন সে বলল তো, হাত ফসকে ফোনটা মাটিতে পড়েই নাকি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল তার। হয়তো কোনো কিছু গোপন করছে হেমন্ত, আমি কিন্তু স্পষ্ট শুনেছি – চড়ুই-চটির কলরব, মুরগির কঁ-ক্ কঁ-ক্, দূরবর্তী মানুষের কোলাহল – – ‘হ্যা লো!’ যেন হাঁপাচ্ছে হেমন্ত! ‘কোথায় রে?’ ‘এই তো ঘর থেকে পালিয়ে লুকিয়ে আছি -’ চমকে উঠলাম, এই সকালবেলা ঘরসংসার ফেলে কোথায় লুকিয়ে আছে হেমন্ত! হয়তো এতক্ষণে আমাদের খামারে আড্ডার খাটিয়া পড়েছে, মাতববর দু-চারজন, যাঁদের কাজ নেই, শালপাড়ার ‘চুটা’ বা চুরুট ধরিয়ে বসে গেছেন আড্ডায়, ‘ন্যাঙটা-ভুটুঙ-সাধের কুটুমে’র দল খেলতে শুরু করেছে এক্কা-দোক্কা আর নয়তো ‘লুকলুকানি’, টোঙের পায়রাগুলি উন্মুখ হয়ে আছে মুখ বের করে – কখন তাদের ডাক পড়বে ছড়ানো দানা শস্য খুঁটে খেতে – এমন সময়ে ঘরের বাইরে কীনা আমাদের হেমন্ত! ফিস্ফিস্ করে বললাম, ‘কেন? হয়েছেটা কী?’ – ‘হবে আবার কী! গ্রামে ‘মিলিটারি’ ঢুকেছে – হয়তো এতক্ষণে হাতে হাতকড়া পরিয়ে চালান করে দিয়েছ হাড়িরামকে -’ অ্যারেস্ট করেছে হাড়িরাম তথা রমেশকে? হাতে হাতকড়া পরিয়ে এতক্ষণে চালান করে দিয়েছে তাকে? কেন – চোর না ছ্যাঁচোড় আমাদের হাড়িরাম? কারণটা জানতে চাইলাম। হেমন্ত বলল, ‘অকারণেই সামনে যাকে পাচ্ছে তাকেই তো ধরে নিয়ে যাচ্ছে! এই তো প্রায় মাসখানেক আগে হিড়হিড় করে টানতে টানতে নিয়ে গেল ‘বাবলু’টাকে – আজ পর্যন্ত তার কোনো হদিস নাই। কে জানে মেরে কোথাও পুঁতে দিলো কী না!’ অাঁতকে উঠি! একই কথাই তো সেদিন বলেছিল রমেশ! তবে তারও কী গতি হবে সেই! কোনদিন দেখল যৌথবাহিনীর জওয়ানদের কাঁধে ভর করে বাঁশে-দড়িতে হাত-পা বাঁধা-ছাঁদা হয়ে ঘরেও না মর্গে ফিরছে আমাদের হেমন্ত – আমাদের শরৎ – আমাদের গ্রীষ্ম – আমাদের বর্ষা – আমাদের শীত – রাগে হিস্হিস্ করে হেমন্ত বলল, ‘পার্টিই ধরিয়ে দিয়েছে হাড়িরামকে।’ – ‘কী রকম?’ বেশিকথা বলার তার পরিস্থিতি ছিল না, সংক্ষেপে যা বলল, তা এই – একদিন রাতের বেলা ‘পার্টি’র লোকেরা এসে হাড়িরামকে বলল, ‘আমাদের সঙ্গে যেতে হবে!’ ও বলল, ‘কোথায়?’ ওরা বলল, ‘ট্রেনিং ক্যাম্পে।’ – কিন্তু কেন? ওরা বলল, ‘বন্দুক চালানো শিখতে হবে। এই নে বন্দুক!’ হাড়িরাম বলল, ‘মরে গেলেও বন্দুক আমি হাতে নেব না।’ ওই বলাই তার কাল হলো! হম্বিতম্বি করে ওরা শাসিয়ে গেল, ‘দেখি, কতদিন ক্যাম্পে না গিয়ে বন্দুক হাতে না নিয়ে থাকতে পারিস!’ ওরাই – ওই ‘হার্মাদরাই’ ষড়যন্ত্র করে হাড়িরামকে মিথ্যা ‘চার্জ’ দিয়ে ধরিয়ে দিলো যৌথবাহিনীর হাতে! হ্যাঁ, খবরের কাগজে পড়েছি বটে, ‘মানুষের হাতে বন্দুক তুলে দিয়ে সন্ত্রাস তৈরি করতে চাইছে হার্মাদরা’।
যা পরিস্থিতি, বাড়িতে একবার যাওয়া দরকার। হেমন্তকে বললাম, ‘দুয়েকদিনের ভিতর আসছি রে হেমন্ত।’ হেমন্ত উত্তেজিত হয়ে বলল, ‘না, না, এসো না এখন!’ কী আর বলি, বললাম, ‘সাবধানে থাকিস, হেমন্ত।’ হেমন্ত বলল, ‘আচ্ছা।’ ছয় ওহো! বলা-ই হয়নি, সেদিন হাড়িরাম তথা রমেশের সঙ্গে কথা বলতে বলতে – হেমন্ত – হেমন্তর প্রসঙ্গ ওঠামাত্রই ফোনটা যে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল, আর ফোনের ভেতর দিয়ে – গুড়ুম গু-ড়ু-ম করে তিনবার আওয়াজ হলো, যে আওয়াজে আমাদের দালানের পায়রাগুলি তন্মুহূর্তেই ডানা ফেটিয়ে ভদ্ভদিয়ে উড়ে গেল, সে আওয়াজ ছিল খুবই হৃদয়বিদারক, পরে শুনেছি! কে বা কারা আমারই জেঠতুতো দাদা অনিলদার ছোটছেলেকে খুব সামনে থেকে পরপর তিনবার গুলি করেছে! ‘স্পট ডেড’! ভাবছি ‘এ মৃত্যুউপত্যকা আমার দেশ নয়’। ‘দেশে’ যাওয়ার ইচ্ছাটাই ক্রমে মরে যাচ্ছে। অফিসে, টেবিল-ক্যালেন্ডারের পাতা ছিঁড়ে ছিঁড়ে লিখছি ‘কবিতা’ – শালের পাতা জুড়ে তৈরি হয় পিঁপড়েদের ভাতঘর লাল পিঁপড়ে সাদা ডিম থাকে বলে ‘কুরকুট্ পটম্’ তাই নিয়ে পিঁদাড়ি লোধানী আমাদের গ্রামে এসেছিল একপাতা দু’পাতা করে অনেক কুর্কুট্ কেনা হল শালের গোড়া জুড়ে জন্ম নেয় একরকম ব্যাঙের ছাতা উঁইয়ের ঢিবির মতো জেদী যার নাম ‘শাল পোঙ্ড়া’ তাই নিয়ে সুনি সাঁওতালিনী আমাদের গ্রামে এসেছিল এক টুপা দু টুপা করে অনেক শালপোঙ্ড়া কেনা হ’ল কবেকার কথা আজ খবরকাগজে টিভিতে লালগড় বেলপাহাড়ি গড়বেতা ভুলাভেদা ‘মাও’য়ের মুক্তাঞ্চল এখন ওদিকে অবরোধ রাস্তা কাটা যেতে পারছি না আমি নলিনী বেরা, বাবু গো, আমি মেদিনীপুরের ‘ছানা’ মায়ের নাম শালফুল বাপের নাম শালপাতা বেরা আজ আবার খবরের কাগজে বেরিয়েছে – ‘অঙ্গনওয়ারি কর্মীকে অপহরণ’! ‘রাজাউলি জঙ্গলের লাগোয়া লেদাম গ্রামের বাসিন্দা অঙ্গনওয়ারি কর্মী অনিমা বেসরা অপহৃত হলেন। তিনি বান্দোয়ান বাজারের অদূরবর্তী রাজাউলি গ্রামের অঙ্গনওয়ারি কর্মী। রবিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা নাগাদ তার বাড়িতে হানা দেয় সশস্ত্রকারীরা। তাঁর ভাইয়ের বিবরণ অনুযায়ী, সশস্ত্রকারীরা প্রথম দরজায় ধাক্কা দেয়। তারপর দরজা ভেঙে তার দিদিকে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাজাউলি জঙ্গলের দিকে নিয়ে যায়। এর আগেও শালবনি থানার ভাঙাবাঁধ গ্রামের অঙ্গনওয়ারি কর্মী ছবি মাহাতো অপহৃত হন। আজ পর্যন্ত তাঁর কোনো হদিস নেই।’ মনে পড়ে গেল, আমাদের ছোটকাকার ছোটছেলে সমরেশের বউও অঙ্গনওয়ারি কর্মী না? ভয়ংকর আতঙ্কিত হয়ে ছোটকাকাকে ফোনে ধরার চেষ্টা করলাম। কোথায় ছোটকাকা? ফোন তো ‘সুইচড অফ্’! সেই যে ধরে নিয়ে গেল রমেশকে, তারপর রমেশের কী হলো – কোনোকিছুই তো জানতে পারছি না! খালি ‘সুইচড অফ’ আর ‘সুইচড অফ’।
সবার ফোনই কী এখন সশস্ত্রকারীদের হেফাজতে? নাকি গ্রামে আর হাস্কিং মেশিনও চলছে না, বাজছে না ‘মাইক’, জলসেচের ফ্রিলোস্কার মেশিনের জেনারেটারও অকেজো – চার্জই নেই, একদম লো ব্যাটারি, মোবাইল চালু থাকবে কী করে? নাকি ‘টাওয়ার’ নেই? এখন আগস্ট মাস, যখন তখন আকাশের মুখভার, আকাশের একপ্রান্ত থেকে আরেকপ্রান্তে উড়ে যাচ্ছে মেঘের পাল। ফোনে কাউকে না পেয়ে হতাশ হয়ে জানলায় বসে মেঘের ভেসে যাওয়া দেখছি, অন্যমনস্কভাবে। ‘মেঘদর্শনে সুখীজনের চিত্তও নাকি বিকারযুক্ত হয় – মেঘালোকে ভবতি সুখিনোহ প্যন্যথাবৃত্তি চেতঃ – আমারও যেন তাই হলো। আর, সত্যি সত্যি মেঘগুলো যেন শহর কলকাতা ছেড়ে ভেসে যাচ্ছে সুদূর মফস্বলে জঙ্গলমহলের দিকে। হঠাৎ খেয়াল হলো, ‘পয়োদ, তুমি সন্তপ্তগণের শরণ – সন্তপ্তানাং ত্বমসি শরণং তৎ পয়োদ’ – আমিও তোমার শরণ নিলাম। আমার বার্তাও তুমি আমার বাড়ির লোকেদের কাছে নিয়ে যাও। যে-বাড়ির লোকেরা যৌথবাহিনীর ভয়ে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে আত্মগোপন করে আছে বনে-জঙ্গলে, যে-বাড়ির লোকেরা অকারণে ধৃত হয়ে থানার ‘লকআপে’ কিংবা হাজতে মুখ বুজে সহ্য করে চলেছে ‘থার্ড ডিগ্রি’র নির্যাতন, যারা নিরস্ত্র অসহায়ভাবে ‘পয়েন্ট রেঞ্জ’ থেকে গুলি খেয়ে মরছে – সেই আমাদের গৃহের ছাদে বা দালানে ‘যেখানে পারাবতগণ সুপ্ত আছে, সেখানে সেইরাত্রি যাপন করো – সুপ্ত পারাবাতায়াং কস্যাঞ্চিৎ ভবনবলভৌ তাং রাত্রিং নীত্বা’।
তারপরে না হয় সূর্য উঠলে অবশিষ্ট পথ গমন করো – ‘সূর্যে দৃষ্টি পুনঃ অপি অধ্বশেষং বাহয়েৎ।’ মেঘদূত থাক! কুবেরের শাপগ্রস্ত সেই যক্ষ না-হয় মেঘ দ্বারা নিজের কুশলবার্তা পাঠিয়েছিল, এখন তো ‘স্যাটেলাইটের’ মাধ্যমে বার্তা যাচ্ছে ফোনে ফোনেই – ফের নাম্বার টিপে ‘কল’ করলাম। – ‘হ্যালো!’ ‘হ্যাঁ, ছোট কাকা, আমি।’ কী যেন বললেন – ঠিক বোঝা গেল না। বললাম, ‘আজকাল আপনাকে পাওয়াই যায় না। যখনই ফোন করি হয় ‘নট রিচেবল’ আর নয়তো ‘সুইচড অফ’ – ফোনটা ‘অন’ করে কী কাছে রাখেন না?’ – ‘কাছে কাছেই তো থাকে। কিন্তু খোল বাজাতে গেলে -’ খোল? তার মানে মৃদঙ্গ? যেখানে দিনে রাতে আলোয় অন্ধকারে কী শোয়ার ঘরে কী রান্নাঘরে বর্ষায় উঠে আসা পোকামাকড়ের মতো উঠে আসে ভারী বুটের আওয়াজ, ‘পার্টি’র মাতববররা এসে চোখ রাঙা করে জওয়ান ছেলেদের হাতে গছিয়ে যায় ‘ট্রেনিং ক্যাম্পের’ বন্দুক, যেখানে রাস্তায়-ঘাটে-জঙ্গলে-বাড়ির উঠোনেই পড়ে থাকে ‘পুলিশের চর সন্দেহে নিহত’ মানুষের গুলিবিদ্ধ মাথা, থ্যাঁতলানো লাশ, বাঘে-কুমিরে হঠাৎ হঠাৎ টেনে নিয়ে যাওয়ার মতো অপহৃত হয়ে যায় কঁই-হাগরী-গুজরী-অকই-বড়কই-বেসরা-টুকু-হেমব্রম-মাহাতোরা, কলকাতার খবরের কাগজের প্রথম পাতায় ‘রক্তশয্যায়’ শিরোনামে ‘লিড স্টোরি’ হিসেবে ছাপা হয় যেখানকার খুন হয়ে যাওয়া মেয়েদের শুধু শাঁখা-পলা-পরা-মুষ্টিবদ্ধ হাত, যেখানে ‘মৃগয়ায় বেরিয়ে মরা বন্যপশুর পরিবর্তে বাঁশে-দড়িতে হাত-পা বেঁধে ঝুলিয়ে আনা হয় মানুষের মৃতদেহ, যেখানে সন্ধে নামলেই জঙ্গলের গা-ঘেঁষে ‘ওরা’ এসে দাঁড়ায়, রাত বাড়লে ক্রমশ এগিয়ে আসে গ্রামের দিকে, অধিক রাত্রিতে বড়জোর ‘কে-রাঁ-ও’ করে ডেকে ওঠে একটি-দুটি মোরগ – সেখানে এখনো খোল-কত্তাল, মৃদঙ্গ? ঝাঁ-ঝাঁ করে বেজে ওঠে শ্রীখোল – ঊরু ঝাঁ তেত্তা ধাতিনা তাকিটি ধাউর তা? ‘খোল বাজাচ্ছেন কোথায়?’ অবাক বিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করলাম ছোটকাকাকে। ছোটকাকা বললেন, ‘এসেছি নিচু-পাতিনায়। আমাদের দল, এসেছে। গাওনা চলছে চৌধুরীদের ছোটতরক্ষের বাড়িতে। বৈঠকি কীর্তন -’ বলতে গেলাম, ‘আপনার ছেলে যে এখন ‘লকআপে’, আপনার বউমা একজন অঙ্গনওয়ারি কর্মী, আশঙ্কা আছে -’ বলা হলো না। আর বললেই বা কী! আমাদের ছোটকাকা ছোটকাকাই। চুপ করে আছি। কাকা বললেন, ‘কী করলি?’ ‘কীসের কী?’ ‘বা রে! ভুলে গেলি?’ ‘কী বলুন তো?’ ‘তুই-ই তো বলেছিলি – দিবি -’ মনে পড়ছে না, চুপ করে আছি। কত কিছুই তো দিতে বলেন ছো্টকা – এন্ডির চাদর, ঘোড়ার ল্যাজের চুল, হারগিলের ঠোঁট, রাক্ষুসে মুলোর বীজ, কাশীরাম দাশের মহাভারত – ‘বেশ ত! বলুন না!’ কাকা কিঞ্চিৎ ভৎর্সনার সুরেই বললেন, ‘কতবার মনে করিয়ে দেবো তোকে! তোর কিছু মনে থাকে না – গ্রাম ‘ফন্ডে’ একটা হারমোনিয়াম দিবি বলেছিলি -’ ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, হারমোনিয়াম! মনে পড়ছে। দেব যখন বলেছি – দেবই -’।
কাকা খুব আশ্বস্ত স্বরে বললেন, ‘দিস, তোর যেমন সুবিধা।’