আমার আশি বছরের মিলা মায়ের এখনো বেশ টন্কো স্মৃতি। আর সেই স্মৃতি বেয়ে মা প্রায়ই চলে যায় তাঁর সেই আশ্চর্য দেশের বাড়ি আর মামার বাড়ি। সেসবই এখন বিদেশ।
মায়ের একখানি পুরনো হারমোনিয়াম আছে। তার বাবা সেটি কন্যের সাত বছর বয়সে কিনে এনে দিয়েছিলেন তখনকার কলকাতার এক সাহেববাড়ি থেকে। এই যন্ত্র ধরেই মা একদা গাইয়ে। এখন গলায় বয়সা ধরে গানটান সেসব কোথায়। ফলে যন্ত্রটা মার তক্তপোশের তলে একখানা কাঠের বাক্সে বন্দি হয়ে পড়ে রয়। তার বদলে মার কানের পাশে দিনরাত ট্রানজিস্টার বাজে।
ওটি নিয়ে মাঝে মাঝে আমি প্যাঁ-পোঁ করতাম। তারপর আমার
মেয়ে। মেয়ে আমার এখন ভালোই গান গায়। হেথা-হোথা জলসা করে। পাঁচজনে তার গান শোনে রীতিমতো টাকা দিয়ে। তাই নিয়ে আমার মার কী গর্ব। বলে, ওর মধ্যে মা নাকি তখনকার মিলাকে খুঁজে পায়।
সামনের অঘ্রানে আমার মেয়ে টুনুর বিয়ে। মেয়ে মানে একটিমাত্র। ছেলেটি বালক বয়েসে পিতৃহারা। বিধবা মা, রীতিমতো সাজুগুজু থাকেন। আর থাকবেন নাই বা কেন। বয়স তো আমারই মতো পাঁচের কোঠায়। টুনু যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে ইতিহাস নিয়ে এমএ করলেও নিজের পছন্দের বর খুঁজে পায়নি। ফলে কাগজ দেখে যোগাযোগ করে এই সম্বন্ধ। কলকাতার এই দখিনে সরকারি কোয়ার্টার থেকে এমন কিছু দূর নয় মেয়ের হবু শ্বশুরবাড়ি। তবু ভাবি, মেয়েটা এবার বুঝি সত্যি সত্যি পরের হয়ে যাবে। মা তখন পানের ডিবে খুলে ছোট্ট ছোট্ট পান সাজতে সাজতে গুনগুন করে, কিশোরগঞ্জে মাসির বাড়ি, মামার বাড়ি চাতলপার, বাপের বাড়ি বামুনবাইড়া, নিজের বাড়ি নাই আমার…।
এই গানখানা শুনলে আমার বুকের মধ্যে কী রকম হু-হু বাতাস হয়। মারও যে কতরকম হয়, সে-কথা কাউকে ডেকে বলতে পারি না। অথচ সেই দেশটি আজ পর্যন্ত আমার দেখা হয়নি। সেই রচনা করা বিদেশটির সঙ্গে আমার যা কিছু পরিচয়, সেসবই বই-পুস্তক বরাবর আর মার মুখে মুনে।
মা বলে, মেয়ের বিয়ে হয়ে যাবে বলে মন খারাপ করবি না। সব মেয়েরই বিয়ে হয়। স্বামী-সংসার হয়। আমারও তাই হয়েছিল।
কথাটুকু বলে মা একফোঁটা লম্বা শ্বাস রাখে। সে-শ্বাসপতনে যে-বাতাসটুকু ঘটে, তা কি নিজের অসুখী বিবাহিত জীবন, নাকি ওপার-বাপের বাড়ির দেশের জন্যে, তা বুঝতে পারি না। তবে মনে মনে যুক্তি হয়, আমার সবে ক-বছর চলে যাওয়া বাবা দীর্ঘ ত্রিশ-চল্লিশ বছর একত্রে রইলেও প্রায় মায়ের মুখদর্শন করেননি। এর কারণের চেয়ে অকারণই বেশি। তবে আমার মায়ের দিক থেকে প্রবল কারণ হলো বাবার অপরিমিত মদ্যপান। তাই আমি বুঝতে পারি না, মায়ের জন্যে তার নিজের সংসারটির উদাহরণ এখানে কতখানি খাটে।
মা এবার বলে, ছেলেমেয়ের বিয়ে না হলে সংসার এক জায়গায় থমকে থেকে থাকত। কে জানে – হয়তো একদিন মানুষ বলে কিছু থাকত না। চারদিকে শুধু গাছপালা, নদীনালা, পাহাড় এইসব। পাখ-পাখাল বা অন্যসব প্রাণী হয়তো আছে; কিন্তু কোথাও মানুষ বলতে কিছু নেই। অবস্থাটা একবার ভাব দেখি।
আমি শুধু বলি, তাই তো।
কিন্তু মনে মনে বলি, তাহলে সংসার কথাটা আর সংসার থাকত না। মা যেন আমার মনের কথা টের পেয়ে যায়। বলে, সংসার না থাকলে দেশ-বিদেশ বলে কোনো কথা থাকত না। আমাদের মনের এপার-ওপার বলে কিছু রইত না।
আমি খানিক অবাক গলায় বলি, বাহ্, তাহলে আমার মেয়ের বিয়ে বলতে কোনো ব্যাপার থাকত না।
মা, এসব তো আবোল-তাবোল চিন্তা। কোনো মানে হয়?
আমি হাসি, কথাটা বললে কিন্তু তুমি।
মা অন্যমনস্ক মুখে চশমার ওধার থেকে আমায় একবার দেখে। তারপর আবার ছোট একখিলি পান সাজার জোগাড় করে। পানের বুকে আঙুল দিয়ে চুন লেপতে লেপতে নিচু গলায় বলে, তোর মেয়েটার ভারি মিষ্টি গলা। ওই বয়েসে আমারও অমনি গলা ছিল; কিন্তু আমি তো কিছু করে উঠতে পারলাম না। মানে, গান যেন নিজেকে শোনানোর জন্যেই। এটাই আমার কপাল হলো। এই বা মন্দ কী।
আমি মনে মনে বলি, হয়তো মন্দের ভালো।
মা বলে যায়, আমার মামার বাড়ির দেশে একজন গ্রামতুতো দাদা ছিল। তার নাম শান্তিদাদা। কী যে চমৎকার বাঁশি বাজাতো। যেমন পাকাপোক্ত কালো মানিক গড়ন, ঝাঁকড়া চুল আর তেমনি তার বাঁশির সুর। অনেক রাতে নদীর ধারে বসে একলা একলা বাজাতো। কখনো আবার নিঝুম উঠোনের একধারে মস্ত তেঁতুলতলায় বসে।
– কী গান বাজাতো?
– অত কী আর মনে আছে। তবে বেশিরভাগই ভাটিয়ালি বা ওই ধরনের গান।
– কিশোরগঞ্জে মাসির বাড়ি?
মা হেসে ফেলে, হ্যাঁ, ওটা তো ছিলই। আরো সব কত গান, কী মিষ্টি সুর সে-বাঁশির।
– তোমার সেই শান্তিদাদার কী হলো?
– কী আবার হবে। অল্প বয়েসে টিবি হয়ে মারা গেল। লোকে বলে, বাঁশি বাজানোই তার কাল হয়েছিল। তেমন ভালো করে খাওয়া-দাওয়া তো জুটতো না। গরিবের সংসার হলে যা হয় আর কী।
গোলপার্কের এই তিনতলার টঙে বাঁধা দুকামরার মোটামুটি ঘরের সামনে লম্বা আর অতিরিক্ত সরু বারান্দা। নিচে ঝকঝকে পরিষ্কার পায়ে চলার জন্যে বানানো পিচের পথ, যার ওধারে প্রকান্ড পার্ক। মস্ত মস্ত গাছ। বেল, কৃষ্ণচূড়া, বট, ছাতিম – কী নেই। পার্কের একধারে এক টুকরো নিপল খাটিয়ে জোরালো বাল্ব জ্বেলে কয়েকজন ছেলে ক্যারমবোর্ড পিটে চলেছে। আমি জানি ওই খেলার আবডালে পাশে রাখা ফ্লাস্ক থেকে ঢুকু-ঢুকু পান করা চলে। তবে সম্ভ্রান্ত এলাকার কথা মাথায় রেখে ওরা কোনো গোলমাল-হইচই করে না। কতক নিরিবিলি আপস করেই থাকে ওরা।
মা এবার ছোট্ট পান মুখে দেয়। তারপর আরো খানিক জর্দা নেয়। দূরে কোথায় জনসভার চিৎকার হয়। পাশের রাস্তা বরাবর ঢাকুরিয়া ব্রিজের দিকে প্রচন্ড শব্দগর্জনে বাস, লরি ইত্যাদি হুড়মুড়িয়ে ছুটে যায়। পাশের হসপিটালের দিকে বিকট হুটার ককিয়ে অ্যাম্বুলেন্স ধাওয়া করে।
আমি বলি, মা, মাঝখানে তো আর কটা দিন। তারপরেই টুনুর বিয়ে হয়ে যাবে। আমরা তিনজনে এ-বাড়িটায় থাকবো কী করে বল তো!
মা হাসে, সবাই যেমন করে থাকে, তেমনি করেই থাকবো। এ আবার নতুন কী কথা।
মাকে কেমন যেন নিরুত্তাপ আর নির্মম বলে মনে হয় আমার। কেমন সাধারণভাবে আমার কথাটা তুলে নিয়ে কিরকম উড়িয়ে দিলো।
আমি বলি, অবশ্য একটা ব্যাপারে আমি একটু নিশ্চিন্ত আছি। ওদের বাড়িতে মেয়েটার গান-বাজনা নিয়ে কোনো আপত্তি হবে না। এখন এতো আধুনিক সময়; কিন্তু এখনো অনেক বাড়িতে বউয়ের পেশাদারি গান করা নিয়ে আপত্তি থাকে।
মা তোরা বলিস – সময় নাকি অনেক এগিয়েছে; কিন্তু এখনো বেশিরভাগ বাড়িতেই এ নিয়ে গোঁড়ামি আছে। আসলে আমরা অনেক ব্যাপারেই এখনো গোঁড়া হয়ে বসে আছি। আমাদের সময়ের সঙ্গে এখনকার তফাৎ কতটুকু!
আমি মাথা তুলে মায়ের চোখের দিকে তাকাই। তারপর গলা নিচু করে বলি, মা, আমার বাবাও তো তোমার গান করা নিয়ে সন্তুষ্ট ছিল না।
মা মুখ লুকিয়ে হাসে, হ্যাঁ, সেও তো এতো আধুনিক মানুষ। কিন্তু তার কাছে গান মানেই বউয়ের পাশে ভিন্ন বেটাছেলের আবির্ভাব। কে বললে আমরা আধুনিক হয়েছি। মানুষ চাঁদে জল খুঁজলেও বউ মানে শুধু বউই। আর কিছু নয়।
নিচেকার পার্কে ছেলেদের ক্যারম খেলার খটাস্-খটাস্। লম্বা লম্বা গাছেদের পাতায় হাওয়ার ঠেলা। সেইসঙ্গে ওই গাছগুলোর বাসিন্দা অগুনতি কাক এই রাতের বেলায়ও নাগাড়ে কা-কা করে চলেছে।
পাশের জমজমাট রাস্তা বরাবর হুন্টার গর্জাচ্ছে। সেইসঙ্গে অগুনতি যানবাহনের হইহই গর্জন। দিনরাত এমন পরিবেশে বাস করে মনের ভেতরকার নির্জনতাটুকু যেন মরে যাচ্ছে দিনদিন।
মা বলে, শান্তিদাদার কথা মাঝে মাঝেই মনে হয়। কেন মনে হয়, কে জানে।
আমি একটু বক্র হাসি, সেটা কি শুধুই তোমার ফেলে আসা দেশের কারণে। নাকি অন্য কোনো কিছু!
মা, আর কী কারণ থাকবে! কী বলতে চাস বল দেখি?
আমি মুখ এড়াই, না না, আর কী কারণ। তবে আমার বাবা তো তোমার গান গাওয়া পছন্দ করত না – তাই –
মা হেসে ফেলে, কিসের সঙ্গে কী, পান্তা ভাতে ঘি।
মেয়ের বিয়ের নেমন্তন্ন প্রায় বারো আনা সেরে ফেলেছি। মাঝখানে আর মাত্র আট দিন। আমার স্ত্রী সীমাও একই সঙ্গে নেমে পড়েছে। কেনাকাটার দিকটা ও সামলাচ্ছে মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে। সঙ্গে অবশ্য আছে আমার বড় ভায়রা। তার হাতে বিয়েবাড়ি ভাড়া করা থেকে ধরে বড় বড় যত কাজ।
দিনভর অফিস করে বিকেল থেকে পথে নামি আমি। রাতে যখন ফিরি, তখন আর শরীর চলতে চায় না।
সীমা আর টুনুরও সেই একই অবস্থা। তবে মেয়েরা পুরুষদের চেয়ে কতখানি আলাদা, সেটা রোজই টের পাই। আমি যদি বাড়ি ফিরে বিয়ের ফর্দ নিয়ে বসি তো ওরা রান্না-বান্না, বিয়ের খরচপাতি এইসব নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আমার বুড়ি মিলা মা যথারীতি কানের পাশে ট্রানজিস্টার খুলে ধারাবাহিকভাবে চ্যানেল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে হরেক গান শুনে যায়। পান খায়।
রেডিওয় এখন পুরনো দিনের শচীন কর্তা গাইছেন, ‘নিশিথে যাইও ফুলবনে রে ভ্রমরা, নিশিথে যাইও ফুলবনে…’
মা গানটা শুনতে শুনতে মাথা দোলাচ্ছে। চোখজোড়া চশমার ওপারে হাসি হাসি হচ্ছে।
মা বলছে, শান্তিদা অবশ্য এই গানটা বাজাতো না। মনে হয় তখনো এই রেকর্ডটা বেরোয়নি।
আমি বলি, হবে।
– হবে নয়, সত্যিই মনে হয়। তবে শান্তিদাকে আমার আধপাগলা জ্যাঠাবাবু খুব ভালোবাসতো।
– কিরকম?
– যেদিন আমরা প্রথম মামার বাড়ি গেলাম, সেদিন গোয়ালন্দ ঘাটে শান্তিদা আমাদের নিতে এসেছিল। জ্যাঠাবাবু তো এক পয়সায় চার সের দুধ বিক্রি দেখে আরো উন্মাদ। শান্তিদা অনেক বারণ করল ব্যস্ত না হতে; কিন্তু তিনি দশসের দুধ কিনে ফেললেন। আর অত দুধ নেবেন কোথায়। বাধ্য হয়ে শান্তিদা সবটুকু দুধ পদ্মায় ঢেলে দিলো।
– জলে দুধ! বাহ্, খাসা কান্ড। কিন্তু তার চেয়ে কান্ড হলো তোমার শান্তিদা।
– কেন! তার আবার কি কান্ড!
আমি হেসে মুখ লুকোই। – না, এমনি বলছিলাম।
মায়ের মুখে সামান্য কালো ছটা পড়েই হারিয়ে যায়। তারপর আবার কথা।
– একদিন হয়েছে কী – আমার দাদুভাই এসে বললেন, দিদিমণি, কী মাছ খাইবা কও। আমি বলি, পুঁঠি, বাটা। দাদু তো পাকা সাদা দাড়ি দুলিয়ে হেসে খুন। সামনে ছিল শান্তিদা। দাদুভাই তাকে ডেকে বলেন, শোন শান্তি, কী কয় ছেমড়ি। শান্তিদা আমায় নিয়ে উঠোন পেরিয়ে পুকুরধারে নিয়ে গেল। তারপর করল কী, এক লাফে পুকুরে নেমে পড়ল। কোমর থেকে গামছা না খুলে জলে বিছিয়ে দিলো। গামছাটা ডোবা মাত্র দুহাত দিয়ে সামনে টেনে নিলো। দেখি ভেতরে কিলবিল করছে বাটা, মৌরলা, কই আরো কতসব মাছ। এইভাবে চার-পাঁচবার গামছা ফেলে তুলে নিতে নিতে রাজ্যের ছোট মাছ যোগাড় হয়ে গেল।
আমি বিয়ের ফর্দ থেকে অবাক মুখ তুলে মাকে দেখে যাই। দেখতে পাই মায়ের প্রাচীন চোখে-মুখে রূপকাহিনির মায়া ঝকঝক করছে। মনে হচ্ছে যেন বা এই তো সেদিনের কথা – মা তার পুরনো পানের বাটা থেকে একটা একটা করে তুলে নিচ্ছে। আলগোছে নেড়েচেড়ে দেখছে। টের পাচ্ছে জর্দার চেয়েও প্রিয় কোনো সুগন্ধ।
অনেক রাতে গোলপার্কের ব্যস্ত রাস্তায় গাড়ির হুটোপুটি জুড়িয়ে গেলেও মাঝে মাঝে অসুস্থ হুন্টার ধাওয়া করছে পাশের হসপিটালের দিকে। মায়ের পাশে – মাঝখানে খানিক ছাড় দিয়ে আর একটি খাটে আমি আর সীমা। শুয়ে শুয়ে ঘুম নেই দুজনের চোখে। মাঝে মাত্র আর কটা দিন। টুনু চলে যাবে শ্বশুরবাড়ি। সেটা বুঝি তার নিজের বাড়ি।
টুনু পাশের ঘরে শুয়েছে। একটু আগে ওর ঘরের টিভি বন্ধ হয়েছে। কে জানে, মেয়ে ঘুমিয়েছে কি-না। ওর চোখেও হয়তো আর পাঁচ মেয়ের মতো খানিক স্বপ্ন, কিছুটা দ্বিধা আর চিন্তা।
আমার মা নিত্যি ঘুমের ওষুধ খেলেও আজ যেন এখনো ঘুমোতে পারেনি। ঘুম আসেনি বুঝি।
মায়ের শ্বাস পড়ছে এড়িয়ে-এড়িয়ে, এলিয়ে-এলিয়ে। সেই ঝড়ো বাতাসের সমে ফাঁকে বাঁশি বাজছে পদ্মার এপারে-ওপারে। এপার থেকে ওপার বরাবর। বাঁশির সুর বলছে, আমি কই আমার আমার, তারা কয় না, চিঠি নাই পত্র নাই, খপরও লয় না… কিশোরগঞ্জে মাসির বাড়ি …