বড় মা নিঃস্বন্তান বলেই বাবা বিয়ে করেছেন আমার মাকে।বাবা কিন্তু বিয়ে করতে চাননি। তিনি বড় মার দু’ হাত মুঠো করে ধরে একদিন বলেছিলেন,’নূরজাহান, আমার কোন সন্তান প্রয়োজন নাই। আমি জানি, আমার বিপদের দিনে তুমিই আলো হয়ে এগিয়ে যাবে আমার সামনে সামনে।আর আমি সেই আলোতে পা ফেলে বিপদ পেরিয়ে চলে যাবো গন্তব্যে।’বড় মা তখন বললেন,’আপনি আমায় ভালোবাসেন তো?’ ‘বাসি। এই আকাশ এবং জমিন সাক্ষী। আমি তোমায় ভালোবাসি নূরজাহান।’ ‘কতটুকু ভালোবাসেন আপনি আমায়? আমি যদি আপনার কাছে কিছু একটা চাই তবে তা এনে দিতে পারবেন?’ ‘পারবো। আকাশের চাঁদ হলেও এনে দিতে পারবো।’ বড় মা বললেন,’এটা অসম্ভব বস্তু। চাঁদের কাছে যাওয়া যায় কিন্তু চাঁদ সঙ্গে করে নিয়ে আসা যায় না। আপনার কাছে যা চাইবো তা আপনার সামর্থ্যের ভেতর আছে। আপনার একটা নতুন বউ চাই আমি। আপনি আমার জন্য আপনার একটা বউ এনে দিবেন?’
বড় মা পায়ে পড়ে গিয়েছিলেন বাবার।বাবা তাকে টেনে উপরে তুলে সামনে এনে দু হাতে বড় মার দূ্টো বাহু আঁকড়ে ধরে বলেছিলেন,’বড় কঠিন কিছু আবদার করে ফেলেছো তুমি! তবুও এনে দিবো। আমি তো তোমার একটি চাওয়াও আজ অবধি অপূর্ণ রাখিনি। কিন্তু একটা কথা বলবে? কেন তুমি এমন কষ্টের জীবন চেয়ে নিচ্ছ নূরজাহান?’
বড় মা হেসে বললেন,’কষ্টের জীবন না এটা। আমি সুখের জীবন চেয়েছি। আমার সামনে আপনাকে কেউ আঁটকুড়ে বললে আমার সহ্য হয় না। আর আমি জানি আপনার এ বুক কতটুকু খাঁ খাঁ করে সন্তানের কাছ থেকে বাবা ডাকটি শোনার জন্য। আপনি বাবা হলে আমিও তো মা হবো!’ আব্বা সেদিন কেঁদে ফেলেছিলেন। জড়জড় করে কেঁদে বলেছিলেন,’হে আল্লাহ, তুমি আমার জন্য এই দুনিয়াতেই জান্নাতী রমণী দান করেছো। তুমি মহান। তুমি শ্রেষ্ঠ।’ আমার মায়ের পড়াশোনা কম।কম বলতে পড়াশোনা নাই বললেই চলে।নানাজান গরীব চাষা।তার কাছে যখন আমাদের এক ফুপু বাবার বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে গেলেন তখন আর তিনি না করতে পারলেন না। বাবার সাথে মার বিয়ে হলো। গরীব নানাও আমার হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন।
কিন্তু সমস্যা হলো আমার জন্মের পর। আমি বড় মাকে অসম্ভব পছন্দ করি ছোট বেলা থেকেই। এই কারণেই সব সময় তার আঁচল ধরে থাকতাম। কোন কিছুর প্রয়োজন হলে বড় মার কাছেই চাইতাম। কিন্তু আমার গর্ভধারিনী মায়ের তা একদম পছন্দ ছিল না। তিনি চাইতেন না আমি যেন বড় মার কাছে যাই। কিন্তু আমি তার নিষেধ মানতাম না। আমি তার কাছে যেতাম।আমায় ঠেকাতে না পেরে মা বড় মাকে নিষেধ করে দিলেন আমায় যেন তার কাছে ঘেঁষতে না দেন। বড় মা তখন মাকে বললেন,’আমার সন্তান আমার কাছে আসবে না তো কার কাছে আসবে?’
‘তোমার সন্তান? তুমি জানো মা হতে হলে গর্ভধারণ করতে হয়। সন্তান প্রসব করতে হয়। তুমি করেছিলে প্রসব?’
বড় মা হেসে বলেছিলেন,’ভুল কথা বললে। সন্তান প্রসব করলেই শুধু কেউ মা হয় না। কোন সন্তানের জন্য বুকে দরদ থাকলেই মা হওয়া যায়।’ ‘তোমার এসব জাদুকরী কথা আমি বুঝি। আমি জানি, তুমি আমার ছেলেটাকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে চাইছো। আমি এটা হতে দিবো না।’ তারপর মা বাবার কানে কথা লাগাতে শুরু করলেন। কিন্তু বাবা সেসব শুনেন না। অবশেষে একদিন বাবাকে মা বললেন,’আপনার আগের স্ত্রী যদি এই বাড়িতে থাকে তবে আমি এখানে আর থাকবো না।’
‘কেন থাকবে না?’
‘সে আমার ছেলেটাকে কেড়ে নিচ্ছে আমার কাছ থেকে?’
‘কেড়ে নিলে তার কী লাভ হবে?’
‘আমার সন্তান আমায় দেখবে না। আমার কাছে আসবে না।মা ডাকবে না।এটাই তার লাভ।সে আমায় সহ্য করতে পারছে না।’
‘কেন সহ্য করতে পারছে না?’
‘কারণ সে বন্ধ্যা । কিন্তু আমি তা নয়।’
‘মূর্খ মানুষের মাথা আসলেই মোটা।’
মা কেঁদে ফেললেন। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বললেন,’ওই বাজা মেয়েটার জন্য তুমি আমায় মূর্খ বললে?’ বাবা হেসে বললেন,’বাজা! ‘শুধু বাজা নয় শয়তান। শয়তান একটা।’ ‘শয়তান ডাকছো কেন?’ ‘কারণ সে আমার সুখ সহ্য করতে পারছে না।সে চেয়েছিল এ বাড়িতে একা রাজ রানী হয়ে থাকতে।’বাবা ফের হাসলেন। তারপর বড় মাকে ডেকে কাছে এনে বললেন,’এই দেখো, তুমি নাকি চেয়েছিলে একা এই বাড়িতে রাজরানী হয়ে থাকতে।আমি জানতাম আরেকটা বিয়ে করলে এমন কিছুই হবে। তুমি তো শুনো নি।
আর এই মেয়েটাও জানে না যে শুধু তোমার কথা রাখার জন্য তাকে এ ঘরের বউ করে এনেছি। নয়তো তার মতো মেয়ে এ ঘরের দাসী হওয়ারও যোগ্য ছিল না।আর আজ সে চাইছে তোমাকে এ বাড়ি থেকে যেন আমি বের করে দেই।মানে তুমি যাকে এ বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছো সে চাইছে এখন তোমায় এ বাড়ি থেকে বের করে দিতে!’
বড় মা বাবার কথাগুলো শুনে বললেন,’ছিঃ! এভাবে কাউকে বলতে নেই। তাছাড়া সে আপনার স্ত্রী। স্ত্রীদের সাথে কোমল গলায় কথা বলতে হয়।সে জানে না বলেই হয়তো ভুল করে এমন বলেছে। আল্লাহ তাকে বোঝ দান করুন।’
বড় মার কথা শুনে মা কাঁদছে। কেন কাঁদছে কী জানি! হয়তোবা সে বুঝতে পেরেছে এই বাড়ির বউ হয়ে আসার জন্য বড় মার অবদানটাই বেশি। তাছাড়া বড় মার মতো একজন ভালো মানুষের সাথে তার খারাপ আচরণ করার কথা ভেবে তার খারাপ লাগছে!
সে রাতেই মা বড় মার কাছে গিয়ে তার দুটো হাত ধরে বলেছেন,’আপা,আমি ভুল করে ফেলেছি। আপনাকে অনেক কটু কথা বলেছি।আমায় আপনি মাফ না দিলে আল্লাহও মাফ দিবেন না!আর এই সন্তান আপনার। আপনাকে দিয়ে দিয়েছি আমি।’ বড় মা বললেন,’বোন বোনের অপরাধ কখনো মনে রাখে না।আমরা দুজন তো বোন।আর তুমি আবারও একটা কথা ভুল বললে। এই সন্তান আমায় দিয়ে দিবে কেন? এই সন্তান তো আমার একার নয়। এই সন্তান আমাদের।’ মা এবার হেসে ফেললেন।হাসতে হাসতেই চোখে হাত দিয়ে দেখেন তার চোখ ভেজা।কী অদ্ভুত কান্ড!
গল্পের বিষয়:
গল্প