বেশ কয়েকমাস ছেলে বাড়ি ফেরেনি, তখন ল্যান্ড-লাইনে ফোনটা এসেছিল। ঘ্যাসঘেসে কণ্ঠ – ‘ছেলের দাঁত ঠিক হইছে?’
স্বাভাবিক স্বরেই পাল্টা জানতে চেয়েছি, – ‘ঠিক হলে কী?’গলা শুনে কিছু বোঝা যায় না। রাস্তার লোক হতে পারে, আবার মনে হয় কোনো
অফিসের রিভলভিং চেয়ারে বসে কথা বলছে। সারাজীবন রান্নাবান্না আর দু-চারটা গল্পের বই পড়া মানুষ আমি, প্যাঁচঘোচ বুঝতে সময় লাগলেও এই ফোনের কারণ বুঝলাম, কিন্তু লোকটাকে তো জানি না।
ভাঙা দাঁত আর দাঁতের ব্যথা নিয়ে সেই যে গেল, ছেলে তো আর আসেনি।
– ‘আবার ভাইঙ্গা দিমু’ – এইবার পুরুষ কণ্ঠস্বরটাকে কোমরে ছুরি গুঁজে রাখা রাস্তার লোক মনে হয়। লোকটা ফোন রেখে দিলে ঘূর্ণিপাকের তোড়ে শত শত প্রশ্ন আমার মাথায় ঘোরে। সিলিং ফ্যানের বাতাস দ্বিগুণ গরম হয়ে নামে। অবচেতনে ততক্ষণে এ-ধরনের ফোনকল আবার রিসিভ করার জন্য তৈরি হয়ে গেছি; কিন্তু ফোন আর আসেনি, আমার ছেলেও সহসা বাড়ি এলো না। ক্রমে ক্রমে ফোন আসা বা না আসার বিভীষিকার ভারও ফিকে হয়ে গেল।
ওপর-নিচের পাটি মিলিয়ে মুখের কয়েকটা দাঁত ভেঙে এসেছিল ছেলে। মুখ-ঠোঁট ফুলে পানিভরা পলিথিনের মতো হয়েছিল, ফ্যাকাশে, পাতলা যেন সেফটিপিনের খোঁচা পেলে চুপসে যাবে। এমন ঘটনা ঘটলে চিৎকার করে কান্নাকাটি করা মানায় না। স্বামীর ফুপাতভাইয়ের ছেলেকে ডেকে আনি, সদ্য পাশ করা ডেন্টিস্ট। তাকে বিভ্রান্ত দেখায় – ‘এই দাঁত ঠিক করতে বিদেশ নিতে হবে।’
– ‘কুচ পরোয়া নেহি, বিদেশ যাবো, তোমরা দেশি ডেন্টিস্টরা বাল ফালাও।’ ফোলা মুখের ভেতর থেকে জড়ানো আমার ছেলের কথাবার্তা অচেনা লাগে।
দাঁতের ডাক্তার করুণা আর অাঁতে ঘা-লাগানো হাসি হাসে। পিরিচের কিনারে বিস্কিট রেখে চা শেষ না করে উঠে পড়ে। অন্ধকার রাস্তায় তার হোন্ডার আলো শোরগোল তুলে মিলিয়ে যায়। তারপর আমার ছেলের চোখের মতো অন্ধকার ঘেরাও করে আমাদের বাড়ি।
হাই ডোজের পেইনকিলার খেয়ে ছেলে ঘুমায় মরার মতো। আমি বারান্দার চেয়ারে বসে বসে পাহারা দিই। আশপাশের বাড়ির স্কুলপড়ুয়ারা ঘ্যান-ঘ্যান করে পড়া পড়ে। তাদের বিচ্ছিন্ন স্বর ক্রমে মিলিত কোরাস হয়ে যায়। কান সতর্ক করে থাকি, এই কোরাসের আড়ালে আরো কোনো শব্দ আছে? যা শুনতে পাই না। কোনো পদশব্দ, চকিত ঝাঁপ, কোনো অতর্কিত আক্রমণ। আসলে যে কী, নিজেই জানি না। একদঙ্গল জোনাক-পোকার সোচ্চার হয়ে-ওঠার ঝিলিক দেখা যায় শুধু।
ছেলের যুবক বয়স, বাড়ি ফেরার ঠিক-ঠিকানা নেই। প্রতীক্ষায় থেকে থেকে আমার ভেতরে একজন মা কখনো মুখিয়ে থাকে, কখনো নেতিয়ে পড়ে। এ বয়সী ছেলের কী পরিমাণ ভালোবাসার বরাদ্দ প্রয়োজন, বুঝে কুলিয়ে উঠতে পারি না।
ময়লা জিন্স, খোঁচা-খোঁচা দাড়ি, কাদাঘাঁটা চেহারা বানিয়ে বাড়ি ফেরে প্রতিবার। তারপর বেঘোর ঘুম। ঘুমিয়ে হঠাৎ-হঠাৎ স্বপ্ন দেখে। গাগ্-গাগ্ শব্দ হয়, ভয় পেয়ে পাশের ঘরে গিয়ে ধাক্কা দিয়ে ঘুম ভাঙাই। আমার মনে হয় দুঃস্বপ্ন; কিন্তু সে স্বীকার করবে না। মাথার পেছনে থ্যাবড়ানো চুলে অপ্রকৃতিস্থ ভঙ্গিতে ঘুম থেকে জেগে আবার শুয়ে পড়ে। ঘুম ভাঙিয়ে দিলেও সে স্বপ্ন ছেড়ে উঠবে না।
সেবার এসেছে ঠান্ডা লাগিয়ে। শুকনো কাশির দমকে পিঠ বেঁকে যায়, শোয়া থেকে শিরদাঁড়া খাড়া করে উঠে বসে, আবার নুয়ে যায়। মনে হয় অনন্তকাল ধরে কাশির সঙ্গে ওর মল্লযুদ্ধ চলছে। ফুসফুস থেকে জোর শোঁ-শোঁ আওয়াজ শুনতে বুকে কান ঠেকাতে হয় না। প্রথম-প্রথম কয়েক রাত ঘুমাইনি, ঠায় পাশে বসে থেকেছি। টোটকা ওষুধের জোগান দিয়েছি। তুলসীপাতা, আদাকুচি। তারপর কয়দিন ওর মাথার কাছে থম ধরে বসে থাকি, ঘুম-জাগরণে রাত পার হয়। ছেলে ঠেলে সরিয়ে দেয়, বলে – ‘সেরে যাবে’, ওর নাকি এমন হয় মাঝেমধ্যে, দিনকয় ভোগে তারপর ফুরফুরে ভালো হয়ে যায়!
এমন ভয়াল কাশি প্রায়ই হয়! নিজের ত্বক ফুঁড়ে বেরিয়ে আসা আমার অস্তিত্বের ধরন বুঝি না, কি আশ্চর্য! ওর কখন অসুখ হয়, হয়ে সেরে যায়, তা আমি টের পাই না! কে জানে, এমনই হয়তো হবার কথা ছিল। কাশির দমক থামলে স্থিরমুখে দেখি ওর চোখের বন্ধ পাতায় এ-বয়সেই কলান্তি জমে আছে।
সারারাত কেশে সকালে ক্লান্ত ঘুম ঘুমায়। আমি নাস্তা নিয়ে বসে থেকে হাঁপিয়ে গেলে ওকে ডাকি।
– ‘শাশ… শেষ করতে দাও স্বপ্নটা।’ আমি তবু ঠেলতে থাকি।
সকাল ফুরিয়ে যাচ্ছে। – ‘ওঠ্ পাগলা’।
আতকা আসা ঢেঁকুরের মতো ও আবার আমাকে ধাক্কা দেয়। সামলে নিই।
– ‘কী স্বপ্ন দেখতেছিলা বাবা?’ কাশিটা থিতিয়ে এসেছে মনে হচ্ছে।
– ‘একটা বাসস্ট্যান্ড, ছোট্ট ছোট্ট নাকবোচা উপজাতি পোলাপান, তুমি ওদের সঙ্গে ঠেলাগাড়িতে বইসা আড্ডা মারতেছ। তুমি যেন একটা বাচ্চা মেয়ে আম্মা…’ ছেলের চোখের মণি ঝলসে উঠে নিভে যায়। ওকে বলতে ইচ্ছে করে যে, এমন জায়গায় আমি কখনো যাইনি।
– ‘গাছে ছাওয়া ঠান্ডা একটা রাস্তা। তোমাকে নিয়া যাবো আম্মা। ওইখানে গ্রামটার অর্ধেক ঘরবাড়ি নদীতে ভাইঙ্গা গেছে। আমরা একটা ঘরে ঢুকছিলাম, কিচ্ছু নাই, চকি নাই, লেপ-তোষক নাই। ঘরের মাটি উইপোকা খায়া ভুড়ভুড়া করে রাখছে। মানুষগুলি জানে না, উইপোকা কেমনে মারতে হয়। ঘরের চালে কয়টা শুকনা ধুন্দুল, ওইগুলি পুইড়া যাওয়ার ভয়ে আগুন দিয়া উইপোকাও মারে না। আশপাশে গাছটাছ নাই, ধুন্দুলগুলি গায়ে-গায়ে বাড়ি খাইলে বিনবিন আওয়াজ হয়। ঘরে একটা বুড়ি, দুই-তিনটা বাচ্চাকাচ্চা। কই থেইকা জানি আইনা একথাল মুড়ি খাইতে দিলো। কিচ্ছু নাই তাও আপ্যায়ন করে, বুঝো একবার! আমার লাগছে খাসির মাথা দিয়া বুটের ডাইলের ক্ষিদা। শুকনা মুড়ি খাইতে ভালস্নাগে!’
– ‘ওইখানে কেন গেছিলি বাবা?’
– ‘পলায়া থাকতে আম্মা, ঘটনার পরে লিডারের অর্ডার ছিল।’
এর পরেরবারে ফেরা একটু অন্যরকম – ওর স্বভাবের বাইরে। দরজায় দাঁড়িয়েই হুকুম, বলল – ‘ঝাল পেঁয়াজ দিয়ে মুড়ি মাখো, আজকে খাবো।’ বলেই বাথরুমে, ঝপঝপিয়ে পানি ঢালছে, সাবান ঘষার ঘ্রাণ পাই রান্নাঘর থেকে।
– ‘আম্মা, খাসির মাথা দিয়ে বুটের ডাল রানতে পারবা না?’
বলে কি ছেলে! গুচ্ছের ছোলার ডাল কেনা আছে। আর খাসির মাথা? সে তো রোজই ঝুলে থাকে মোড়ের কসাইয়ের দোকানে। লোহার আংটায় ঝুলে থাকতে থাকতে টসটসে রক্ত টুপ করে সিমেন্টের মেঝেতে পড়ে যায়। রক্তচোষা গামছা লোহিত বর্ণ। সাবান-গরম পানি দিয়ে ধুয়েও লাল। লোকটা পিঁড়ির ওপরে বসে বড় গোল গাছের গুঁড়িতে কোপ দিয়ে থোক-থোক মাংস পলিথিনে ভরে দিতে গিয়ে কোমর চাগিয়ে লাল গামছা দিয়ে নিজেই মেঝে মোছে। কাঁচা মাংসের গন্ধে নাক চেপে দাঁড়িয়ে থাকি আমি। খাসির কলস্না থেকে ছেঁড়া তারের মতো আধা-ঘ্যাঁচড়া রগ বেরিয়ে আছে, জবাই করার সময় কি ছুরিতে ধার ছিল না! আমি সেদিকে তাকালে লোকটা কিছু একটা বলবে, মনোযোগ ঘুরিয়ে দিতে চায়। ও জানে, আমি কার মা; কোন বাড়িতে থাকি। এত চেনে বলে বিরক্ত হই সেটা বুঝে ফেলে কিনা কে জানে, বহুব্যবহৃত কাপড়ের মতো মুখ নরম করে আনে লোকটা।
বাসা থেকে বাজার হাঁটাপথে দশ-বারো মিনিট। নিজেই যাই। কাঁকরোল, সবুজ পটোল, লাল ইন্ডিয়ান পেঁয়াজের পাশে খাসির মগজ আর মাথাভর্তি ব্যাগ রিকশার পাদানিতে বসিয়ে ফিরে আসি। ছেলে যখন থাকে না, তখনো সব কিনে ফ্রিজ ভরে রাখি। রান্নাবান্না দেখলে ওর চোখের মণি উদ্ভাসিত হয়। এই একটা কারণে ওর হাসি দেখি আমি। অন্য সময়? নাহ্ থাক, সে-প্রসঙ্গে না-ই বলি। কোথায় যেন শুনেছিলাম – বাপ, স্বামী আর পুত্রকে বশীকরণের প্রকৃত স্থান হলো খাওয়ার টেবিল, অন্তত আশিভাগ ক্ষেত্রে।
গোসল সেরে, কলার-তোলা গেঞ্জি পরে ছেলে এসে ভেজা চুল আঙুলে ঝাড়ে, খাবার টেবিলের ওপরে শিশিরবিন্দু তৈরি হয়। ছেলে চেয়ার টেনে বসে খাবার নেয়, আমি ওর তৃপ্ত মুখ দেখি। সে তারিয়ে তারিয়ে আমড়ার টক থেকে অাঁশঅলা অাঁটি খায়। আমি ওর গা ছুঁয়ে দেওয়া দূরত্বে বসি। পেঁপেবাঁটা দিয়ে ভুনা মাংসের হাড়-চিবানো দাঁতের শব্দ শুনতে পাই। অকারণে টেবিলের কোনা হাত দিয়ে মুছি। খেতে-খেতে ওর ভেজা চুল শুকিয়ে আসে। ও একগাল হেসে দিলে ওর তৃপ্তি দৃশ্যমান হয়, দাঁতের কালো মাড়ি দেখা যায়। জন্ম থেকেই খাড়া নাক আমার ছেলের। আমি বলতাম – নাক উঁচু। আমার না, গাত্রবর্ণ পেয়েছে ওর বাবার। আড়াল থেকে আমি দু-একবার শুনেওছি, স্বামীর দিকে আড়চোখে চেয়ে মানুষ বলেছে, – ‘এইটা কী বিয়া করছে! কিছু হইল? যেমন কালো তেমন ‘ডি’ শেপের বউ’। আমার স্বামীর সম্ভবত আমাকে নিয়ে কোনো শঙ্কা, দ্বিধা ছিল না, ভালোবাসাপ্রসূত ঈর্ষা তো একদম না। পথ আটকানোর মতো সুন্দরী ছিলাম না যে। আর আমার অভ্যাস হয়ে গেছে, সর্বত্র যাতায়াতের, একা।
চাচাতভাইদের বাড়ি গিয়ে তাস পেটানো বাবার ছেলের সখ্য সংযোগ ঘটেনি। অথচ আমি চাইতাম ছেলেটার মধ্যে ভালোবাসার বান ডাকুক, বাপের মতো ব্যবধান আমাকেও বৃত্তবন্দি করে না ফেলুক; কিন্তু আমি সবসময় ভুল প্রমাণিত হই। একটা চাছা ঝিনুক শিলে ঘষে-ঘষে ধারগুলো ভোতা আর মসৃণ, ওই দিয়ে দুধ গেলানো অবধি টান ছিল। জোরে কষে তারের দুধার বেঁধে রাখার মতো, আঙুলের টোকায় প্রিং করে শব্দ তৈরি করত সে-টান, সে-শব্দের মধ্যে জের থাকত, জ্বর থাকত আর থাকত জেদ-অভিমান। দুধদাঁত পড়ে গিয়ে যখন আধলা করে দাঁত উঠছে, দুশ্চিন্তায় আমার ঘুম হারাম। আমার মতো যদি ছেলেরও হাসলে মাড়ি দেখা যায়! যদি দাঁতেও কালচে ছোপ লাগানো থাকে!
ও জন্মাবার দুদিন পরে দাই যখন আরেকবার আমার তলপেট ঘি দিয়ে মালিশ করতে এসেছিল, আশ্বস্ত করেছে – না, বুজান আপনের ছেলে পরম সুন্দর, একদম রাজকুমার। এখন এতদিন পরেও একটা গোপন আক্ষেপ মাথা থেকে ঝেটিয়ে বিদায় করতে পারি না। তা হলো, ও হাসলে দাঁতগুলো মিচমিচে কালো দেখায়। ওর ঝকঝকে দাঁত কী করে এমন হলো, প্রাপ্তবয়স্ক সন্তানকে এ-প্রশ্ন করা যায়; কিন্তু ওর সঙ্গে সেতু তৈরি হতে হতে ভেঙে যায় আমার, ছেলের প্যান্টের পকেট সাফ করতে গেলে, ছেলের ব্যাগ ঘাঁটলে ভেঙে খানখান হয় সে-সেতু।
ছেলে যেদিন জামিন পেয়ে বাড়ি ফিরেছে, তার চেহারা থেকে কাঠিন্য ঠিকরে বের হচ্ছিল। আমি ওর কনুই টেনে ঝুঁকে থাকি – ‘চিন্তা করিস না বাবা’…
– ‘কে বলল, আমি চিন্তা করতেছি? আম্মা তুমি বরং একদম চিন্তা কইরো না, আমাদের পার্টির লোক আছে। পুলিশের বারোটা বাজায়া দিবে।’
খাওয়া শেষে পেস্নটে হাত ধোয় ও। আমি এঁটো পেস্নট নিয়ে ঘরের বারান্দায় এসে উঠানে পানি ফেলি। হাত ধোয়া পানির মধ্যে আলগা দু-একটা ভাত দেখে রাতা মোরগটা দৌড়ে আসে। খুঁটে খায় ম্রিয়মাণ পোকার মতো ধূলিমাখা হলদে ভাত। ছেলেকে ঘিরে তৈরি হওয়া জটিলতা এভাবে ছড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করে, মোরগটা খুঁটে-খুঁটে খেয়ে ফেলত!
আরেকটা ঘটনা ছিল। ভাঙা দাঁত সারাতে ছেলে ঢাকা গেল, তখন একদিন মেয়েটা এসেছিল। একসঙ্গে এখানকার কলেজে পড়েছে। আমার ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে গেল, ও যাওয়ার সুযোগ পায়নি। টোপা গাল, চোখদুটো বড় না মোটেও, সেটা অবশ্য গৌণ বিষয়। আমি ছেলের চোখ দিয়ে নিজের পছন্দ দেখতাম হয়তো। ভেবেছিলাম বাঙ্ময় চক্ষু, শ্যামলা, ঠোঁটে ইষৎ ভাঁজ আছে এমন একটা মেয়ে আসবে। তা ছেলের এমন লালচে ফর্সা পছন্দ, টের পাইনি। মেয়েটার গড়ন মোটা ঘেষে। আমার ছেলে তার বন্ধ এ-সুবাদে সপ্রতিভ হয়ে কথা বলল। কোল্ড ড্রিংক্স আনিয়ে খেতে দিলাম। দু-একবার খিলখিল হাসে শুনে পাশের বাড়ির বুয়া উঁকি দিলে ধমকে দিলাম। যাওয়ার সময় প্রশ্ন – ‘দাঁত কি সেরেছে? ব্যথা কমেছে, জোড়া লাগাতে পেরেছে ভাঙা দাঁত?’
– ‘দাঁত না সারলে কী?’
– ‘না সারলে একটু ভাত খাওয়া, ভাতের সঙ্গে হাড়হাড্ডি চিবানো, এইতো। সমস্যা না। না, আরো আছে। দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা বোঝা ছেলে পাত্র হিসেবে উত্তম।’
মেয়েটার পরনে কালো জর্জেটের ওড়না। টিভি সিরিয়ালের নায়িকাদের মতো ঝুলানো কানের দুল।
মেয়েটার জামার চিকন ফিতা ঘাড়ের কাছে এসে গিঁঠ খেয়ে গেছে, হার্ট শেপের ফোকর গলে মসৃণ তরল পিঠ। মেয়েটা কী করে জানে, আমার ছেলের দাঁত ভেঙেছিল। কারা ভেঙেছিল?
ওকে তিলের খাজা খেতে দিয়েছিলাম। সঙ্গে সঙ্গে খায়নি। একটা কাগজে মুড়িয়ে দাঁড়িয়ে বলল – ‘আপনাকে দিয়ে হবে আন্টি, শক্ত মনের মানুষ তো, তাই ভেঙে পড়েননি। আমার মা হলে এতদিনে শেষ’…
সেদিন আমার মন তীব্রভাবে এই মেয়ের মা হতে চাইল।
ছেলে ঘুম থেকে উঠে বারান্দায় এসে মগে পানি নিয়ে চোখে ছিটায়। চুলের কিছুটা ভিজে যায়।
– ‘আম্মা হালিম বানাতে পারো? বানাইছ কোনোদিন? কী কী লাগে?’
এখন তো হালিম মিক্স পাওয়া যায়, শুধু মাংস লাগবে, খাসির মাথা হলে ভালো হয়। মোড়ের কসাইয়ের দোকানে যাব। গামছা থেকে চুঁইয়ে ফ্যাকাশে লাল রং গড়াবে!
– ‘কাকে মারছিলা বাবা? একদম মরে গেছে? হাসপাতালে নিলে ভালো হবে না?’
– ‘চুপ থাকো তো আম্মা! আমি কোনো খুনটুন করি নাই, তবু আমার দাঁতগুলি ভাঙছে’, দাঁত ঘষে আমার ছেলে। একপাটির সঙ্গে আরেক পাটির দাঁতে অনেক ফোকর, খুব কাছে গেলে নিশ্বাসের ফাঁপা আওয়াজ টের পাওয়া যায়।
হালিম মিক্স আর মাংস কিনে আমি দ্রুত হাঁটি, তাড়াতাড়ি করতে হবে। হঠাৎ আতঙ্ক লাগে, দোকানের কসাইটা মনে হয় লাফ দিয়ে আমার পিছু নিয়েছে। ওর হাতে ভারী ছুরি। ছুরিটা নাড়ালে লৌহময় ঠান্ডা বাতাস ধেয়ে আসে।
বিকেলবেলায় বারান্দায় বসে ছেলে তার হালিমের বাটিতে আদাকুচি বেশি করে নেয়। পাশে আমি ধোঁয়া-ওঠা খাবারে পুরনো পেপার দিয়ে হাওয়া করি।
– ‘পার্টি কি বলছিল একদম মাইরা ফেলতে?’
– ‘আম্মা তুমি কী শুরু করলা! সারাক্ষণ টিভি দেখো? নাকি তোমার মাসুদ রানা সিরিজপড়া বিদ্যা ঝালাইতেছ?’ – মুখ থেকে এক টুকরো হাড় থুক করে বারান্দার রেলিংয়ের নিচে মাটিতে ছুড়ে মারে।
ছোটবেলায় ছেলেটাকে কত গল্প যে শোনাতাম! যুদ্ধের গল্প, প্রীতিলতা, কল্পনা দত্ত, বেগম রোকেয়া, মেয়েদের কথা বেশি বলতাম। বিদ্যার দৌড় বাদ দিলে নিজের উৎসাহে যা পারা যায়। পরে ছেলে ইতিহাসে অনার্স ভর্তি হলো, নিজে নিজে পড়ে ভারতীয় ইতিহাস, ইউরোপের ইতিহাস, ইসলামের ইতিহাস। দু-একবার সঙ্গে আনা থান ইটের মতো বই আমিও উলটে-পালটে দেখেছি।
আমার চুলে দুই বেণি দেখলে ছোটবেলায় খুব খুশি হতো ছেলে, ভালোবাসত। হাইজাম্পে প্রাইজ পাওয়া আমার মেডেলটা গলায় ঝুলিয়ে ঘুরত। স্কুলের ছাদ থেকে লাফ দিয়ে পড়লেও আমার হাত-পা ভাঙত না শুনে ছেলের চোখের মণি ঠিকরে বেরুত, গর্বে, খুশিতে। বাপ-চাচাদের দিকে কচি হাতের বাইসেপ ফুলিয়ে মল�যুদ্ধে আহবান করত।
– ‘আম্মা, নামটা বদলায়ে ফেললে আর ঝামেলা নাই।’
– ‘কার নাম? পার্টি কি একদম মাইরা ফেলতে বলছিল?’
– ‘কী মুশকিল, পার্টি কি এ-নির্দেশ সরাসরি দেয় নাকি? নিজের বিবেচনা লাগে।’
– ‘একা তো করিস নাই।’
পেপার কাটিংগুলি সাবধানে রেখে দিয়েছি। স্টিলের আলমারির সেইফটি লকের ভেতরে। আশপাশের বাড়ি থেকে বাচ্চাকাচ্চা, আত্মীয়দের কেউ-কেউ হুটহাট ঘরে ঢুকে যায়। কাগজপত্র আমি সাবধানে রাখি। ওইদিন বা তার পরও যত পেপারে খবর ছেপেছে, সব কিনেছি। তিনজনের ছবিতে দৌড়ের মধ্যেও আমার ছেলের চেহারা বেশি স্পষ্ট।
গতবার যেদিন দুজন মানুষের কাঁধে ভর দিয়ে এলো, দেখলাম ওর ডানপায়ে সব আঙুল পচা জামের মতো থ্যাঁতলানো, ঘিনঘিনে বেগুনি রং। অবচেতন আমাকে ধাক্কা দিয়ে দূরে ফেলে দিলো। কে জানে কীভাবে কোমরের কাছে পাওয়া ব্যথা অনেকদিন নীলবর্ণ থাকল, পেয়ারাগাছে এসে বসে যে ছোট্ট পাখিটা, তেমন নীল; ব্যথা ওর মতো তিড়িক-তিড়িক লেজ নাড়ে।
গোঙাতে-গোঙাতে ছেলে বলল – ‘খাওয়া-দাওয়ার খুব কষ্ট। আর এত মাইর দেয়, পরে চোখের সামনে থাল ভইরা ভাত দিলেও আর ঢোঁক গেলার শক্তি থাকে না। ছালা বাইন্ধা লোহার শক্ত রড দিয়া পিটায়। এই যাত্রা আর দুই-চাইরটা বাড়ি বেশি খাইলে আর টিকতে হইতো না… শরীলের ভিতরে রক্তও যখন থ্যাঁতলায়া যায়, তখন ক্ষিদাটিদা উধাও হয়া যায়। আর কী একটা কলাইয়ের ডাইলের সাথে লাল আটার রুটি দেয়, মনে হয় খেড় চাবাইতেছি। একটু ভাত পাক করবা আম্মা?’
জামিনে ছাড়া পাওয়ার আগ পর্যন্ত কতবার যে গেলাম, ছেলের সঙ্গে দেখা হয় না। আজকে এখানে তো কালকে অন্য জায়গায়। যেন কেউ আমার ছেলেটাকে পিচকিরির মধ্যে পুরে দিগ্বিদিক ছুড়ে দিচ্ছে। আর আমি লোফালুফি খেলায় নিরন্তর হেরে যাচ্ছি।
ওর আববার বস হেড অফিসে ট্রান্সফার হয়েছে। তদ্বির নিয়ে তার বসের কাছে গেলাম। আমার স্বামীর নামটাকে চিনতে প্রথমে কষ্ট হলেও মৃত সাব-অর্ডিনেটের স্ত্রীকে চিনলেন ভদ্রলোক। টেবিলের ওপাশে পুরু কাচের চশমার কাছে ছেলেকে ছাড়িয়ে আনার কথা বলতে জোর পেলাম না। তার বদলে বন্দি ছেলের জন্য একটা চাকরি চাইলাম। মা-ছেলের যাতে চলে যায়। ইতিহাসে অনার্স শুনে ভ্রূ বাঁকা হলো সামান্য। যা হোক কিছু একটা – টাইপিস্ট, কেরানি। ইন্স্যুরেন্স দালাল, ব্রোকার, টেলিফোন অপারেটর কিছু একটা। একটা কোনা খুঁজে পেলে ছেলেকে থিতু করে বসিয়ে দেবো।
ঢাকা শহরে তদ্বির করতে আসাটাও আমার জন্য সংগ্রাম। থাকতে হয় খালাতবোনের বাসায়। পাঁচ-ছয় ঘণ্টার বাসজার্নি করে নামি, সঙ্গে বোনকে খুশি করার সরঞ্জামাদি, চালের গুঁড়া, মুড়কির মোয়া। বাসায় ঢুকেই ত্বরিত বেরিয়ে যাই।
দুমাস পরে যখন জামিনে ছাড়ল। ছেলে শুকিয়ে গেছে, যেন ভেজা কচি কাঠ রোদ্রে ফেটে গেছে। বলল, তার খুব ক্ষিদে পেয়েছে। যে-রেস্টুরেন্টে ঢুকলাম তার চারদিকে আয়না। খাবারের অপেক্ষায় থেকে ও আঙুলে চেপে ঠোঁট উঁচিয়ে ভাঙা দাঁত দেখে। আমি মাথা নিচু করে ওর হাতের আঙুল দেখি, শুষ্ক চামড়া। ফাটা পায়ের গোঁড়ালি, ধূলিমাখা চুল। ছেলেকে ডলে গোসল করাতে ইচ্ছে করে, ওর কিশোরবেলার মতো ঘষে-ঘষে। সাবানের ফেনায় নিমজ্জমান হাসি দেখতে ইচ্ছে করে।
আমাদের পাশের টেবিলে একটা মেয়ে একা-একা খায়। বুঝতে পারি, রাস্তার মেয়ে। ফুঁপিয়ে কেঁদে-কেঁদে ভাত খাচ্ছে, সঙ্গে মাছের দোপেঁয়াজা। আমি ওর দিকে পেছন ফিরে বসি। জানালা গলে আসা রোদের অাঁচও মৃদু হয়। নিজেকে ফেলে আর কারো দুঃখ দেখতে আগ্রহ হয় না। ছেলেকে যদি ওর সব যাতনা ভুলিয়ে দিতে পারতাম! বলি – ‘ঢাকা আসছি, চল একটা সিনেমা দেইখা বাড়িতে যাই, মধুমিতা হলের নাম কত শুনছি!’
– ‘ওই হলটা তো মনে হয় বন্ধ হয়ে গেছে আম্মা!’
– ‘বন্ধ হয়ে গেল! কারা বন্ধ করল?’
– ‘কেন তুমি কিছু খবর রাখো না? রায়ট লাগার আগে এইসব বন্ধ হইলে ভালো না?’
তাই বলে সিনেমা বন্ধ হবে! আমার দমবন্ধ লাগে, নিজেকে পাউরুটি-সেঁকা তন্দুরের ভেতর বন্দি আবিষ্কার করি। একটা ফোকর গলে চিলতে চাঁদের আলো ছুরির মতো তেড়ে আসে, ভীষণ গরম সে-চাঁদের আলো।
– ‘আমাকে বিদেশ পাঠায়া দেও। এইখানে কোনো ভবিষ্যৎ নাই। পার্টি আর আমাকে বাঁচাইতে পারবে না। রাঘব বোয়ালরা নিজেরাই লুকায়া যাইতেছে।’
ছেলের ফিসফিস শুনে আমি কথা ভুলে যাই। তীব্র গরম থেকে ডিপ ফ্রিজে ঢুকে যাই। জগভর্তি বরফ খাই কচকচ করে। মাথার কোষসুদ্ধ জমাট বেঁধে যায়।
– ‘কীভাবে যাবি? ওইখানে যা না, ওই যে গ্রামটা, উপজাতি মহিলা তোরে মুড়ি খাইতে দিছিল, উইপোকা মারতে জানে না, ওইখানে গিয়া লুকায়া থাকতে পারবি না বাবা?’
– কী সব ফালতু কথা বলতেছ আম্মা, আমি কখন ওই জাগায় গেলাম!’ ছেলে হঠাৎ ওঠা রাগ সংযত করতে শিখেছে।
– ‘একজন আছে আম্মা, ভালো ছাত্র, বুয়েটে পড়ে। আমার জন্য ভিসা নিয়া দিবে। আমার সঙ্গে চেহারার মিল, সাদা-কালো পাসপোর্ট সাইজ ফটো, কেউ বুঝতে পারবে না এইটা আমি না আমার যমজভাই!
আমার কি যমজ সন্তান ছিল! হারিয়ে ফেলেছি নার্সিংহোমে, উত্তম-সুচিত্রার কোনো সিনেমার মতো, লালু-ভুলু, দুই ভাই? সেই ছেলে বড় ব্যারিস্টারের ঘরে মানুষ হচ্ছে, সন্ধ্যাবেলা ঘরে ফিরে সেতারে ঝংকার তোলে, তার চক্ষু বোজা! বড় হয়ে জজ হবে, আর আমার ছেলের নামে সত্য বা মিথ্যা মামলা খারিজ করে দেবে। আমি সিনেমাটা দেখতে চাই; কিন্তু মধুমিতা সিনেমাহল আর নেই।
ছেলে জামিনে ছাড়া পেলে মনে হয়েছিল সব ঠিক। আবার চারপাশ জুড়ে নির্লিপ্তের মতো শীতকাল নামে চারপাশে। বাতাসের গা নরম, আদুরে।
তখন একদিন হন্তদন্ত হয়ে ছেলে ফেরে, একা। মাথায় হলুদ পস্নাস্টিকের টুপি। দমকল বাহিনীর কর্মীরা যা সারাক্ষণ পড়ে থাকে, সেরকম। গোসল করে মাথা ভেজায় না। খেতে বসে একহাতে মাথা চেপে থাকে। ঘাড়ের কাছে রক্তের ছ্যাকরা ছিঁটা দেখি। জিজ্ঞেস করলে – হা-হা করে হাসে। দাঁতগুলি আগের মতো সমান, ঝকঝক করছে।
– ‘দাঁত ঠিক করে দিছে আম্মা; কিন্তু তারপর হইল মুশকিল, মাথার খুলিটা আলগা হয়ে গেল। একটা পাইলে আরেকটা যায়। এইটা আমি বুইঝা গেছি, সবকিছু একসঙ্গে ঠিকঠাক আমি পাবো না। আমারে তুমি বিদেশ পাঠায়া দেও আম্মা। নাইলে কিন্তু পেস্ননের চাক্কার সঙ্গে নিজেরে দড়ি দিয়া বাইন্ধা নিমু।’
– ‘বাতাসে তোর খুলি উইড়া যাবে। আর মগজ জইমা যাবে বাবা।’
– ‘না, আম্মা তুমি বুঝো নাই, ওড়ার আগে আবার পার্টির লিডারদের কাছে যাবো। দুইটা অফার আছে, ভাঙা দাঁত ভালো করতে চাইলে মাথার খুলি আলগা হয়ে যাবে। আর সব দাঁত দিয়া যদি নকল দাঁতের দুই পাটি পরি, তাইলে খুলি ফেরত পাবো। আমি আমার দাঁত খোয়াইতে চাই নাই, দাঁতের মর্যাদা… এখন ভাবতেছি দাঁত দিয়ে দিবো, কী আছে জীবনে। খালি এইখান থেইকা সরতে হবে।’
অমাবস্যার সন্ধ্যায় আমরা বারান্দায় বসে থাকি। ছেলে গুনগুন করে গান গায়। একহাতে মাথা চেপে আরেক হাত দিয়ে সিগারেট জ্বালায়। লাইটারে অসুবিধে হয় না, দেশলাই হলে মুশকিল হতো, হাত দিয়ে হাওয়া আটকাতে হতো। সিগারেটের লাল আগুন হ্রস্ব-দীর্ঘ রেখা বানিয়ে অদৃশ্য হয়। আমি অকারণে একটা জোনাক পোকা খুঁজতে থাকি। অনির্দিষ্ট মতিভ্রম কোনো জোনাকি পথ ভুলে চলে এলে কি হয়!
ছেলে আমাকে বোঝায়, মাথার খুলি গেলে হাতও অকেজো, অন্তত একটা।
আমি আর বলি না যে, দাঁত গেলে আঁতও যায়। প্রাপ্তবয়স্ক ছেলের দুধদাঁতগুলির কথা মনে পড়ে। মুখের ভেতর কি সুন্দর মাখন মাখন গন্ধ থাকত!
অনেকদিন বাড়ি না ফেরা ছেলের প্রতীক্ষা করতে করতে যখন-তখন ক্লান্তিতে ঘুম পায় আমার, আবার ঘন গরমে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে। পানিপিপাসা পায়। রাস্তার মুখে গেটের কাছে দাঁড়াতে দাঁড়াতে হাত-পা ভেঙে আসে আমার। মাথায় অাঁচল দিলেও রোদ তালু ভেদ করে মগজের কোষে ঢুকে পড়ে। ছুরির মতো ব্যথা বোধ হয়। ছেলেকে মনে হয় দেখি মোড়ের কসাইয়ের দোকানে ঝোলে, কলস্না নিচের দিকে, ছেঁড়া তারের মতো রগ বেরিয়ে আছে। ছেলের খুলি-খোলা মাথা মেঝেতে রাখা, মায়াময় চোখে তাকিয়ে আছে। দোকানি চিৎকার করে ডাকছে – ‘মগজ নিবেন মগজ, ফ্রেশ আছে।’
এই স্বপ্ন আমি আগেও দেখেছি। ভয় লাগে না, বুঝি যে-স্বপ্ন। নিজের বাহুতে অন্য হাত বুলিয়ে দিই, সান্ত্বনার মতো। স্নেহের মতো বলি – এ কেবল স্বপ্ন। ঘরে এসে বেশি করে পানি খাই, জানালা খুলে দিই, কসাইয়ের দোকানের সামনে কুকুরগুলির তারস্বরে ডাক এত দূরে থেকেও ভেসে আসে।
পরের দিন ছেলে ফোন করে। সে আসবে, কিন্তু কখন তা জানে না।
অনিশ্চিত সময় পার করার উপায় খুঁজি। টেলিভিশন দেখতে, ছাপার অক্ষর দেখতে ভালো লাগে না। ভাবি, একটা কাঁথা বুনতে বসে গেলে হয়। বড় কাহিনি থাকবে। রাজা, রাজপুত্র, কোটালপুত্র, নৌবহরের বাইচ, বেশ বাঁকা করে সেলাই করব বৈঠাগুলি। নদীর ঢেউ। কল্পনায় ভর করে ভেতরের ভয় খানিকটা উৎপাটিত হয়। কাঁথার জন্য কাপড় খুঁজি, পুরনো শাড়ি, নরম একরঙের থান।
সন্ধ্যার আগে আগে একটা মোটরসাইকেল বাড়ির পেছন দরজায় থামে। অনেকদিন পর ছেলে ফিরল, তার মুন্ডিত মাথা চকচক করে, গৌতমবুদ্ধের শিষ্যের মতো, ‘বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি’ গেয়ে উঠবে। ছেলে মাথায় টোকা দিয়ে দেখাল, তার মাথার খুলি জোড়া লেগে গেছে। শুধু কিছুদিন একটা হেলমেট পরে থাকতে হবে।
কোনোরকম খাবারের বায়না ছাড়াই এবার অসময়ে ঘুমোতে চলে যায় ছেলে। আমি এই ফাঁকে আয়েশ করে রান্না চাপাই। দেরি হলে হোক, কতদিন পর ছেলে খাবে! মা-ছেলে কতদিন পরে একসঙ্গে বসব।
রাত বাড়লে আমি ছেলেকে ঠেলে উঠিয়ে দিই, টেবিলে ধোঁয়া-ওঠা ভাত। হাত ধুতে যাবার আগে বাড়ির সামনে পুলিশের ভ্যান। হাতে বন্দুক নিয়ে তারা দরজার কড়া নাড়ে। জোরে জোরে। আমি ছেলের ভেজা হাত ধরে টানি।
সে উলটো জেদ করে, বাড়ির পেছনে মোটরসাইকেল পার্ক করা। হেলমেট ছাড়াই লাফ দিয়ে ওঠে।
– ‘আম্মা, পুলিশ আমাকে চিনবে না, আমি সকালে ফিরা আসব। দাঁতগুলি নেও, গেলাসে কুসুম গরম পানিতে ডুবায়া রাখো, আর আমার জন্য একটু পাতলা জাউ রান্না করো, এখন আর শক্ত হাড্ডি খাওয়া যায় না।’ আমার দিকে ছুড়ে দেওয়া দুই পাটি দাঁত লুফে নিই। ছেলের গাল চুপসে গেছে। বুড়োটে দেখাচ্ছে। আমি সামনের গেটে কড়া নাড়া শুনি। মোটরসাইকেল স্টার্ট দিয়ে আমার ছেলে লক্ষ্মণ সেনের মতো পালিয়ে যায়।