খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে যান আমিন সাহেব।ফজরের নামাজ পড়েই পরিবারের সকলের সাথে সকালের খাবারটা খেয়ে বেরিয়ে পড়েন নৌকার খুজে।টানা চৌদ্দ বছরের চাকরির স্থল আজ ছেড়ে যাচ্ছেন। যতটা খারাপ লাগার কথা ততটা লাগছেনা।কেন জানি আজ তার মনে অনেক আনন্দ হচ্ছে।একজন ইমাম সাব তাকে গতকাল নৌকা ম্যানেজ করে দেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।তাকে খুজে বের করলেন তিনি।
অত্যন্ত সাদাসিধা আর খুব নেক কার মানুষ ইমাম সাহেব।আমিন সাবকে খুব পছন্দ করেন।তিনি পড়েছেন দুটানায়।একদিকে প্রিয় মানুষটিকে বিদায় জানাতে বুক ফেটে যাচ্ছে, অন্য দিকে এই প্রিয় মানুষটি অনেক চেষ্টা করে নিজ এলাকায় ভালো একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উচ্চতর পদে চাকরি পেয়েছেন জেনে খুব খুশিও হয়েছেন।দীর্ঘদিন এই এলাকায় থাকাতে আমিন সাবের কাছে এই ইমাম সাহেবের পরিবারের ও আত্মীয় স্বজনদের ঘরের লোকজন লেখাপড়া শিখেছে। যে সব ঘরে কোনো লেখাপড়ার ছিটাফোঁটাও ছিলোনা সেসব ঘরেও ছেলেমেয়েরা উচ্চ শিক্ষিত হয়েছে। আমিন সাব এই ইমাম সহেবের পিছনে নিয়মিত নামাজ পড়তেন।বাসায় মিলাদ পড়াতেন তাকে দিয়ে।অবসরে নানা বিষয়ে তারা মতবিনিময় করতেন।উভয়ের ধ্যান ধারণা কাছাকাছি হওয়ায় তাদের সম্পর্কটা বেশ মজবুত ছিলো।
ইমাম সাব তার কথামতো মাঝারি সাইজের একটা ট্রলার রিজার্ভ করে দেন।ট্রলার নিকটস্থ ঘাটে নোঙর ফেললে কয়েকজন শ্রমিক এসে সমস্ত মালামাল ট্রলারে তুলে দেয়।তারপর সকলের পারিশ্রমিক দিয়ে সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বিমর্ষ বদনে নৌকায় উঠলেন আমিন সাব। ট্রলারের সিড়ি বেয়ে ছাদে গিয়ে বসলেন তিনি।ভিতরে বেগম সাহেবা একমাত্র কন্যাকে নিয়ে আর উপরে আমিন সাব দুই ছেলেকে নিয়ে বসলেন।চতুর্দিকে কেবল পানি আর পানি।জুন মাসের মাঝামাঝি, বাংলা আষাঢ় মাসের শুরু।অর্থাৎ বর্ষাকাল।সৌভাগ্যক্রমে দিনটি ছিলো আলোকোজ্জ্বল।
কোনোরকম মেঘ বৃষ্টি কিছুই নেই। সকাল থেকে তারা সবাই আল্লাহ আল্লাহ করছেন যেন কোনো মেঘ বৃষ্টি না হয়।কাকতালীয় ভাবে আল্লাহ হয়তো তাদের প্রার্থনা শুনেছেন। ছাতা মাতায় নৌকার হাল ধরা মাঝির পাশে বসে বসে স্মৃতির ঢালি মেলে ধরেন আমিন সাহেব।আজ আর তিনি কোনো তিক্ত অতিত মনে করতে চাননা।শুধু ভালো ভালো কথা মনে করতে চান।যা পেয়েছেন তার কথা মনে করতে চান।কোনো দুঃখ কষ্টের কথা মনে করবেন না।আজ থেকে চৌদ্দ বছর আগে ত্রিশ বছরের এক টগবগে তরুণ হয়ে এসেছিলেন এই হাওরের দেশে।
চলনে বলনে,আর পোশাক পরিচ্ছদে খুবই স্মার্ট ছিলেন আমিন সাহেব।তখন তিনি এসেছিলেন একা।পরিবার সাথে আনেননি।এসেই একটা বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গণিত ও বিজ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে চাকরি নেন।এম,পিওভুক্ত থাকায় তার বেতন ভাতা সরকারি কোষাগার থেকেই দেওয়ার বন্দোবস্ত হয়।তখনও এলাকায় শিক্ষার হার তেমন বলার মত হয়নি।প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী ছিলো হাতে গোনা অল্প সংখ্যক। আমিন সাব যোগ দেয়ায় রাতারাতি শিক্ষার্থী সংখ্যা অনেক বেড়ে যায়।সকাল থেকে রাত পর্যন্ত সারাবেলা শিক্ষার্থী নিয়ে পড়ে থাকায় এলাকায় একটা জাগরণের সৃষ্টি হলো।শিক্ষার্থীদের চাঙা রাখতে আমিন সাব গান বাজনা,সাহিত্য সংস্কৃতি, খেলাধুলা আর সাপ্তাহিক আনন্দ জলসার ব্যবস্থা করেন।তার সকল সৃজনশীল কাজে ছাত্র শিক্ষক আর অভিভাবকদের সহায়তা পান।
সবচেয়ে বেশি সহায়তা পান এলাকার চেয়ারম্যান সাহেবের। যিনি টানা কয়েক যুগ ধরে নিরবচ্ছিন্ন ভাবে চেয়ারম্যান হিসেবে জনগণকে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন। যিনি আমিন সাহেবের সকল কাজে নিঃশর্তভাবে সমর্থন দিয়ে গেছেন।আমিন সাহেবকে তিনি বলতেন আমি সকল শিক্ষককে ছাড়তে পারি কিন্তু আপনাকে কখনও ছাড়বোনা।আপনি অন্য কোনো দিকে চলে যাওয়ার চিন্তাও করবেন না।তার সুরে সুর মিলিয়ে এলাকার লোকজনও আমিন সাবকে একইরকম কথা বলতেন।আমিন সাব যখন এলাকায় আসেন তখন কলেজের ছাত্র খুজে পাওয়া কঠিন ছিলো।চৌদ্দ বছর পর এলাকায় তার হাতে গড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীও পাওয়া যায়।কলেজের শিক্ষার্থীতো শত শত হয়েছে। প্রতিবছর একশত-এর উপর শিক্ষার্থী এই এলাকার দুটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হতে এস,এস,সি পাশ করে বের হয় এখন।একদিন চেয়ারম্যান সাব কথায় কথায় আমিন সাবকে বলতেছিলেন,
ঃআমি ব্যক্তিগতভাবে আপনার উপর কৃতজ্ঞ।
ঃতার কারন কি জানতে পারি জনাব?
ঃকারনটা হলো,
আপনি আসার আগে এখানে কোনো গণিত -বিজ্ঞানের শিক্ষক আসতে চাইতোনা,কিংবা এলেও কিছুদিন থেকে নিজের সুবিধা করে চলে যেতো।কেউই ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ায় আন্তরিক ছিলেননা।আপনি এসে একটা জোয়ার এনে দিলেন।ছেলেমেয়েদের ভিতরে প্রেরণা জাগালেন।দুটো প্রতিষ্ঠানে একটা প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হলো।এই উপজেলায় বোর্ড পরীক্ষায় সর্বপ্রথম জিপিএ পাঁচ পেলো আপনার শিক্ষার্থী।আপনার গাইডেন্সে পোলাপান এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাচ্ছে। জনগণ এখন আপনার নামটা বেশি করে উচ্চারণ করছে।তাই আমি আপনার প্রতি এতটা কৃতজ্ঞ।আপনার জন্য সাত খুন মাফ।
ঃচেয়ারম্যান সাব,আমিতো কেবল আমার ডিউটি পালন করেছি মাত্র। এখানে কৃতজ্ঞতা দেখানোর কি আছে?
ঃ মাস্টার সাব,এভাবেই ডিউটি করতে থাকুন।আপনার কাছে আমার এতটুকুই চাওয়া।আপনি এসে আমার আন্ধার ঘরে বাতি জ্বালিয়ে দিসেন।
সব কথা মনে পড়ছে আজ আমিন স্যারের।এরপর একে একে প্রিয় মুখগুলো তার চোখের সামনে ভেসে উঠতে থাকে।বিভিন্ন সনে পাস করে যাওয়া মেধাবী ছেলেমেয়েদের মুখগুলো ভেসে উঠতেই তার চোখদুটো ছলছল করে উঠে।আরও মনে পড়ে প্রিয় সহকর্মীদের মুখগুলো।যারা তাকে মায়ের পেটের ভায়ের মতো ভালোবেসেছিলো।আজ তাদের ছেড়ে একরকম লুকিয়েই চলে যাচ্ছেন। তাদের কারো কাছ থেকেই বিদায় নেওয়া হয়নি।বাড়ি ফিরে হয়তো ফোনে কথা বলে বিদায় নেবেন।তার ভাবনায় ছেদ পড়ে স্মার্ট ফোনের রিংটোনে।তার ঘনিষ্ঠ সহকর্মীর ফোন।যার সাথে সকল ব্যক্তিগত বিষয় শেয়ার করা হতো।
ঃস্যার কি চলে যাচ্ছেন? কোন পর্যন্ত গেসেন?
ঃজ্বী ভাই, আমরা এখন নৌকায়।ঘন্টা খানেক আগে ছেড়েছে।
ঃআপনি এভাবে হঠাৎ চলে যাচ্ছেন, বিশ্বাস করতে পারছিনা।দুঃস্বপ্নের মত মনে হচ্ছে।
ঃভাই আমাদের জন্য দোয়া করবেন।বলতে বলতে আমিন স্যারের চোখ হতে অঝোরে অশ্রু ঝরতে থাকে।
ঃআসলে কি বলবো যে ভাষা খুজে পাচ্ছি না।
আপনি আমার এতটাই কাছের মানুষ ছিলেন,যার উপর ভরসা করতাম,বিপদে পড়লে যখনই ভাবতাম যে আমিন স্যার আছেনতো,এমনিই সব টেনশন দূর হয়ে যেতো,সেই লোকটা আজ চলে যাচ্ছে চিরদিনের জন্য। পোড়া কপাল আমার।স্যার ক্ষমা করবেন,অনেক ভুল আর বেয়াদবি করেছি আপনার সাথে।তার শাস্তিটা আজ পাচ্ছি, বলেই কাঁদতে থাকেন তিনি।
ঃএভাবে বলবেন না প্লিজ।বলেই কাঁদতে কাঁদতে বুক ভাসান আমিন সাব। তারপর একে একে ফোন আসতে থাকে তার চেনাজানা নানাজনের কাছ থেকে।কিছু কিছু ফোন তিনি রিসিভ না করে কেটে দেন।কিছু ভক্ত ছেলেমেয়ে ফোন দিয়েই সেকি কান্নাকাটি করতে শুরু করে।সান্ত্বনা দেওয়াও যায়নি তাদের।সবাই শেষ করার আগে কমন একটা কথা বলতে ভুলেন নি।স্যার মাঝে মাঝে ছুটি নিয়ে এসে বেড়াইয়া যাবেন। আজ বিশ বছর পর সব কথা মনে পড়ছে আমিন সাহেবের।লিখতে বসে হাত কাঁপছে। দুচোখ ঝাপসা হয়ে আসছে।ইচ্ছে করছে পাখির মত উড়ে যেতে। আহা,একটি বার যদি ফিরে যেতে পারতেন সেই দিনগুলোতে। শুধু একটি বার।
গল্পের বিষয়:
গল্প