একবার এক বিকেলবেলায় ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামে এই শহরে, তারপর তা থেমে গিয়ে হালকা প্রসন্ন রোদ ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু সে-রোদের ওপর এমন এক ঝোড়ো হাওয়া পাক খেয়ে চলে যে, পাতাঝরা ফাল্গুনের বিষণ্ণ আকুলতা পথে পথে বলকে উঠতে থাকে। মনে হয় এখনই রাস্তায় নেমে আসবে এলোমেলো কিশোরের দল, যারা ঘুরে ঘুরে দেখে নেবে কোথায় কোন বাড়ির বাগানে ফুল ফুটেছে এবং কীভাবে সে-ফুল ছিঁড়ে আনা যাবে প্রভাতফেরির আগেই। সেই দিন সবুজ, সাদা অথবা আর যেমনই হোক না কেন, প্রতিটি ফুলকেই টকটকে লাল মনে হতে থাকে। বিভ্রম জাগে, রক্তলাল চোখ উপচেপড়া একটি নদী এখনই বয়ে যাবে বিষণ্ণ শহরের ভেতর দিয়ে। আর সেই রক্তলাল চোখ উজিয়ে হঠাৎ উঠে আসবে অজস্র ষাঁড় ও গরু, আসবে ঘোড়া ও মহিষ; তাদের পেছনে পেছনে আসবে দ্রুত ধাবমান রাখালেরা – যেন বাথানের খোলা প্রান্তরে তারা হাইলা নড়ি হাতে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে খোঁয়াড়ে ঢুকতে অনিচ্ছুক ষাঁড়-গরু-ঘোড়া-মোষকে।
আমি এ-শহরে আসি এরকম বিকেলে – স্বপ্নের ঘোরে অস্ফুট স্বরে ভাবে স্বাতী। যদিও এভাবে বললে প্রথমেই মনে হয়, অন্য কোনো শহর থেকে এরকম এক বিকেলে সে এ-শহরে এসে বৃষ্টি-রোদ-ঝড় দেখেছে। অথচ এ-শহরেই জন্ম হয়েছে তার, এখানেই বড় হয়েছে সে এবং এ- শহরের বাইরে কোনোখানে সে কোনোদিন যায়নি। যাওয়ার প্রয়োজনও হয়নি। কলেজে ভর্তি হওয়ার পর একবার তাদের সবাই দল বেঁধে জয়সাগর দেখতে গিয়েছিল, কিন্তু সে যেতে পারেনি। বাবার থমথমে মুখের দিকে একবার চোখ তুলে তাকানোর পর দ্বিতীয়বার আর চেয়ে দেখার সাহসও পায়নি সে। অনার কিলিংয়ের দুঃস্বপ্ন নিয়ে সেদিন সে সন্ধ্যামালতির দিকে তাকিয়েছিল দুপুর-বিকেল। তারপর সূর্য ডুবে গেলে সারারাত জেগে থেকেছে দুঃস্বপ্নের ভয়ে। সে কেবল যেতে পারে নানাবাড়ি অবধি, তাও যদি মা সঙ্গে থাকে। কিন্তু নানাবাড়ি তো শহরের উপকণ্ঠেই! সে শুধু গল্পই পড়েছে শহর থেকে দূরে যাওয়ার, শহর থেকে শহরে ঘুরে বেড়াবার। অন্য কোনো শহরের সূর্য-চাঁদ সে বোধহয় কোনোদিনই দেখতে পাবে না। তবু তার মনে হয়, বৃষ্টি-রোদ-ঝড়ে দোলা এক বিকেলে এ-শহরে এসেছিল সে। এসেছিল – মানে জন্ম নিয়েছিল এবং জন্মের খানিক পরেই টলোমলো পায়ে উঠে দাঁড়িয়েছিল। হাসিকান্না কোনো কিছুই তার চোখে ছিল না, ছিল খানিকটা বিস্ময় আর কৌতূহলের ছায়া – যেমন থাকে কেবলই উঠে দাঁড়ানো শাবকের চোখেমুখে।
এরকম ভেবে স্বাতীর স্বস্তি জাগে, ঘাড় কাত করে সে কান থেকে নীল দুল খুলতে থাকে। বিকেলের নরম আলোয় ঘরের মধ্যে সেটি কেঁপে-কেঁপে নীল দ্যুতি ছড়াতে থাকে। অকস্মাৎ তার সারা শরীরে মেরুভালুকের তৃষ্ণা জাগতে থাকে, আর তাই বিছানার সাদা চাদরে একা একাই গড়াগড়ি খায়। তারপরই অলসভঙ্গিতে অপেক্ষা করতে থাকে, যেন তুষারের ওপর দিয়ে হেঁটে-হেঁটে ওজন হারাতে হারাতে তার দিকেই এগিয়ে আসছে ৯০ কিলোমিটার দূরের আরো এক তৃষ্ণার্ত মেরুভালুক। অথচ অলসতার বিবরে থিতু হতে হতে তার আর ভালো লাগে না গত রাতে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিতে দেখা সেই মেরুভালুকের কথা ভাবতে – এত যে তাদের উত্তেজনা, থরথরানো ভালোবাসা, তার সবই কি বংশরক্ষার জন্যে!? ভালোবাসা নয়, স্তব্ধ তুষারে পায়ের চিহ্ন নিশ্চিহ্ন করতে করতে, উত্তেজনায় ডুবতে-ডুবতে প্রশান্তির কাছে যেতে নয়, নিজেকে শূন্য শূন্য করে এতদূর ছুটে আসা তাহলে হারিয়ে যাওয়ার আগে একবিন্দু নিজেকেই রেখে যেতে? তাহলে তার শহরে আসাও তেমনিভাবেই – একবিন্দু মেরুভালুক ছিটকে পড়েছে কোনো এক বিকেলে, বিন্দু থেকে সিন্ধু হয়ে উঠেছে একটু একটু করে। মা তখন মাসদশেক নাকি মাছ-মাংস কিছু কাটেনি। পেটে বাচ্চা এসেছে জেনে শাশুড়ি তাকে মানা করেছিল মাছ-মাংস কাটাকাটি করতে। তখন বাবার ওপরেও ছিল নিষেধাজ্ঞা, কোনো প্রাণীকে জবাই করা দূরে থাক, লোমও নাকি তোলা যাবে না। এতকিছুর পরও বৃষ্টি থামার পর প্রসন্ন রোদ-ছড়ানো বিকেলে শুরু হলো ঝড়ো হাওয়া – এবং সে ওইদিন বিকেলে এই শহরে এলো। আর একদিন এসব ভেবে ভেবে মনে হলো তার, এখানে কেউ আসলে চায়নি তাকে। কয়েক বছর পর শাহেদ জন্ম নিলে দাদিদের উদ্বেগ দূর হওয়াতেই বোধহয় খানিকটা আদর পেয়েছে সে। আবার কখনো মনে হয়, ইচ্ছে করেই দাদা-দাদির কথা উপেক্ষা করে মা-বাবা ছুরি চালিয়েছিল কোনো প্রাণীর গলায়। না হলে তার জন্ম হবে কেন! এভাবে সে দুঃখ-বিলাসে ডুবসাঁতার দিতে থাকে, কুসংস্কারের আগুনে হাত-পা সেঁকে চলে। পাতাঝরা এক বিকেল তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়, সর্ষে তেলের ঘ্রাণে ডুবে যায় তার পুরো শরীর।
আজকের এই বিকেল অবশ্য পাতাঝরানো নয়। অনেক দূর থেকে পোড়া টায়ারের গন্ধ ভেসে আসছে। নিশ্চয়ই কাল কেউ হরতাল ডেকেছে! তাই আগের দিন থেকেই শুরু হয়েছে ভাংচুর আর জ্বালাও-পোড়াও। শঙ্কিত না হলেও মানুষজন অফিস থেকে বাড়ি ফিরে আসার ছুতো খুঁজে পায়। আবার রাস্তায় নামার সঙ্গে সঙ্গে সেই ছুতো হারিয়ে মিছিল আর আগুনের ধাওয়া খেয়ে বিপন্ন পায়ে দৌড়ে পালাতে থাকে। এখানে, সড়কঘেঁষা তাদের এই ছোট পাড়াটুকুতে হরতাল অবশ্য ছাপ ফেলে না। ভট ভট শব্দ তুলে স্কুটারগুলো ছুটে যায় গন্তব্যের দিকে। ছাত্রবয়সীরা রাস্তার ধারেই ক্যারম খেলতে থাকে। তাদের বাসার জানালা দিয়ে তাকালেই দেখা যায়, রাস্তার ওপাশের চা-সিগারেটের দোকান ঘিরে ভিড় জমেছে, যেমন আজো জমেছে। কেউ দাবা নিয়ে বসলে আরো বেশি ভিড় জমে। পাশেই একটা মনোহারি দোকানের আধোভাঙা রেডিওতে গান হচ্ছে – ‘যদি আমাকে জানতে সাধ হয়, বাংলার মুখ চুমে জেনে নিও…’। আর কোথাও খালি ড্রাম গড়ানোর শব্দ সেই গানকে ঢেকে দিচ্ছে। দোতলার জানালার পাশে দাঁড়িয়ে অনেক চেষ্টা করেও সে-গান আর স্বাতীর জানা হয় না।
বাদশার এ-দোকানে টিভি আছে একটা। দোকানের মুখের পাশেই চায়ের কেটলি-বসানো মাটির চুল্লিটাকে পাশ কাটিয়ে ভেতরে ঢুকলেই কয়েক সার বেঞ্চি পাতা। এককাপ চা অথবা একটা সিগারেট নিয়ে এখানে বসে টিভি দেখা যায়, গান শোনা যায়। চা-সিগারেট না নিলে দাঁড়িয়ে দেখতে হয়। আচানক কেক-ড্রিংকস খাওয়ার তাগিদ দেখা দিলে মোতালেবও এখানে আসে। আর দাঁড়িয়ে খাওয়া-দাওয়া করা তো শরিয়তে নিষেধ, বিশেষ করে পানি খাওয়ার সময় দাঁড়িয়ে থাকা তো একেবারেই হারাম। অতএব সে ভেতরের বেঞ্চে বসে। এভাবে হরেদরে জুনিয়র-সিনিয়র সবার সঙ্গে বসে থাকতে মোতালেবের খারাপই লাগে; কিন্তু মুম্বাইয়ের (বোম্বের) নায়িকা বলে কথা! কখনো মাথা নিচু করে, কখনো আড়চোখে তাকিয়ে, কখনো আবার সরাসরিই মুম্বাইয়ের নায়িকাদের দেখতে দেখতে সেভেনআপ খায় সে। নেশা করা হারাম, সে তাই পান চিবোয়। তখন দোকানের বাইরে থেকেই উঁচু গলায় সিগারেট দিতে বলে প্রথম শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তা লতিফ জোয়ারদার। মোতালেবের ওপর বিরক্তি লুকানোর জন্যে সে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে থাকে অন্যদিকে। ওদিকে দোকানের মধ্যে গরম লাগায় নাজিম গা থেকে জামা খুলে ফেলে, ঘাম মোছে গামছা দিয়ে। আর দোকানের ডানপাশে ডাববোঝাই ভ্যানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে তালতলার নজু। তালতলায় অবশ্য কোনো তালগাছ নেই। অথবা তালগাছও আছে, কিন্তু বাবুইপাখির দল হারিয়ে গেছে, ডানায় শীতের কুয়াশা নিয়ে বাবুইপাখিরা আর উড়ে আসে না, বাসা বাঁধে না। গাছগুলোও তাই কারো চোখে পড়ে না। ডাব না থাকলে নজুর ভ্যানে কলা থাকে, কখনো ডাবের সঙ্গে কলাও থাকে। কিংবা কোনো কোনো দিন সে আনারস নিয়ে আসে, গরম নামলে নিয়ে আসে কাঁচা আম, এঁচোড় বানানোর মতো কঁচি কাঠাল। নিয়ে আসে পাকা আম-কাঁঠাল। কড়মচা, আমড়া আর কামরাঙা থাকলে নজুর ভ্যান ঘিরে ছাত্রীদের ভিড় জমে যায় আর মোতালেবের চোখজুড়ে জমতে থাকে ঈর্ষা ও অস্বস্তি। বাদশা এসব জানে, ভালো করেই জানে, আড়চোখে তাড়িয়ে তাড়িয়ে সে স্বাদ নিতে থাকে মোতালেবের সেই ঈর্ষা ও অস্বস্তির।
আজ অবশ্য ঈর্ষা, অস্বস্তি কোনোটাই নেই। লোকজন আজ নাচ-গান-সিনেমা দেখা বাদ দিয়ে টায়ার পোড়ানোর সংবাদ দেখছে। বোমার ধোঁয়ায় ঢেকে-যাওয়া পথ দেখছে। মরে যাওয়া পুলিশের বউ-বাচ্চারা হাউমাউ করে কাঁদছে এখন। সকালে কাজে যাওয়ার আগে পানি খেতে চেয়েছিল, কিন্তু আনতে দেরি হওয়ায় না খেয়েই সে কাজে চলে গেছে আর এখন তার মৃত্যুর পর পানি খাওয়াতে না পারার আক্ষেপে তার বউ মাথা ঠুকছে। লোকজন স্তব্ধ হয়ে তাকে দেখতে থাকে। এমনকি সংবাদবিরতিতে হাস্যোজ্জ্বল তরুণীর দল নেচেগেয়ে মোবাইল দেখিয়েও তাদের স্তব্ধতা ভাঙতে ব্যর্থ হয়। অপলক তারা তাকিয়ে থাকে, এরপর কী ঘটবে তা দেখার আশায়। সংবাদপাঠক তাদের জানাতে থাকে, ঢাকার শাহবাগে মানুষের ঢল নেমেছে। রাস্তাজুড়ে বসে পড়েছে মানুষ। আলো জ্বলছে, হৃদয়ের আলো। সে-আলো ফুটে উঠেছে কেবল মানুষের চোখেমুখে। আলো জ্বলছে, মোমের আলো। কখনো বাতাস এসে দুলিয়ে দিচ্ছে তাকে, বাতাসে দুলতে দুলতে সে আলো-ছায়া ফেলছে মানুষের চোখেমুখে, রাস্তার ওপরে, শূন্যতাতে।
এবং তখন বোঝা যায় যে, মোতালেব এ-দোকানে এখনো আছে। কেননা, তার আক্ষেপ করে চলে ৪২ বছর নতুন করে বিচার শুরু হওয়ায়। এত বছর চলে যাওয়ার পরও মানুষ এসব মনে রেখেছে ভেবে তার ঘাড়ের চুল খাড়া হয়ে ওঠে, তীক্ষ্ণ স্বরে সে বলে চলে, বাদি নাই, বিবাদি নাই – হুদাই এক মামলা!
বলে প্রতিক্রিয়ার জন্যে খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে সে। কিন্তু কেউ নাড়তে যায় না তাকে। হ্যাঁ-হু বলে না, না-ও বলে না। মোতালেব উশখুশ করতে থাকে। আর বাদশা চুল্লিঘেঁষা ক্যাশবাক্সের কাছ থেকেই রিমোট চালিয়ে মুম্বাইয়ের নায়িকাদের নিয়ে আসার চেষ্টা করে। মোতালেবের চোখের পাতা ঘনঘন নড়তে থাকে এবং বাদশা মুম্বাইয়ের নায়িকাদের হটিয়ে দিয়ে সিংহ, বাঘ, জিরাফ নিয়ে এলে তার দুচোখে অন্ধকার নেমে আসে। যদিও সে কিছু বলে না এবং মনে হয় পান নয়, তার চোয়ালের নিচে শক্তপোক্ত গরুর হাড় পড়েছে এবং বৃথাই সে চেষ্টা করছে সেটাকে কড়মড় করে ভাঙবার। এই পর্যায়ে বাদশার চোখে চোখ পড়তেই অনেকটা অসহায়ের মতো বলে ওঠে সে, এহানের ক্যাবল অপারেটররা কি করে! এত চ্যানেল দেহায়, খালি পিস টিভিটাই আনবার পারে না…
শুনে মনে হয়, পিস টিভি যেহেতু নেই, সেহেতু বাঘ, সিংহ, জিরাফ না দেখে মুম্বাইয়ের নায়িকাদের দেখাই ভালো! কিন্তু মোতালেবের ভালো বাদশার আবার ভালো লাগে না। রিমোট কন্ট্রোল নিয়ে সে খবর খুঁজতে থাকে। তেমন চ্যানেল খুঁজে পেতে দেরি হয় না। টিভির পর্দাজুড়ে সহসাই দেখা যায় এলোমেলো জুতো আর ছেঁড়া স্যান্ডেল ছড়িয়ে আছে, পড়ে আছে একটি নিঃসঙ্গ বাজারের ব্যাগ, টায়ার পুড়ছে রাস্তার মধ্যে এবং অকস্মাৎ তাদের সকলের নাকে এসে তার গন্ধ লাগে। তারা মুখ ঘুরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। যদিও বুঝতে পারে না, পোড়া টায়ারের গন্ধ এই শহরের মধ্যে থেকেই ভেসে আসছে, নাকি টিভির পর্দা থেকে ছুটে আসছে। তখনই আবার টিভির পর্দাজুড়ে অসংখ্য নারী-পুরুষ, ছেলেমেয়ে তাদের খানিকটা স্বস্তি দিতে মুহুর্মুহু স্লোগান দিতে থাকে।
তাও ভালো, আমাগারে শহরে এসব হয় নাই – মোতালেবের থরথরানো ঠোঁট পেরিয়ে এই স্বস্তি দোকানে বসা সকলের কানে ছড়িয়ে পড়ে। খানিক পরে খানিকটা অস্বস্তিও তার থরথরে ঠোঁট পেরিয়ে সকলের কানে ছড়িয়ে পড়ে, জুয়ান জুয়ান ছেলেমেয়ে, সন্ধ্যার পরও কীভাবে বইসা থাকে!
সবাই হেসে ওঠে। তা কি তার কথা শুনে নাকি টিভিতে কোনো কিছু দেখে, মোতালেব সেটা আর ধরতে পারে না। ফলে রাগ আর অস্বস্তি তাকে কাবু করে ফেলে, হাসির কথা না… এইসব হাসির কথা না… দেশ কোনদিকে যাইতেছে চিন্তা করে দেখেন…
মোতালেব এবার ঠোঁটের কোণে খানিকটা নরম হাসি নিয়ে সবার দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। কেউ কিছু বললেই সে তার মুখ খুলতে পারে, জানিয়ে দিতে পারে শরিয়তে কি এভাবে ছেলেমেয়ে একসঙ্গে বসে থাকার অনুমতি দেওয়া হয়নি, হাসাহাসি করার অনুমতি দেওয়া হয়নি। সরকারের উচিত এসব ছেলেমেয়েকে পিটিয়ে তুলে দেওয়া। বছরখানেক আগে হলেও মোতালেব রেগেমেগে গালাগালি শুরু করত। তা ঠিকই করত। তখন তো তার বোন ব্যাংকে চাকরি করত না। কিন্তু এখন কোনো কিছু বললে কেউ আবার উল্টো বলতে পারে, আপনার বোন ব্যাংকে কাজ করে কেন? ওইটাও তো পুরুষে বোঝাই। এরকম কথা যদি সত্যিই কেউ কখনো বলে?! সে তাই তার উত্তর ঠিক করে, সে তো চাকরি করে! কিন্তু এরা তো লেখাপড়া করে, বাপের হোটেলে খায়… ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু তারপরই তার ভয় হতে থাকে, কেউ যদি বলে বসে, এখানে তো খালি ছাত্রছাত্রীই না, চাকরি-বাকরি করে এমন মানুষও আছে। আর ছাত্রছাত্রীরাও আজকাল চাকরি করতে করতে লেখাপড়া করে… এসব উত্তর শুনতে শুনতে, আবারও নতুন যুক্তি দাঁড় করাতে করাতে, ফের কোনো নতুন প্রশ্ন শুনতে শুনতে সে রেগেমেগে গালিগালাজ করার যুক্তি খুঁজে পায়; কিন্তু সে রাগারাগি করে না, সামনে সে কমিশনার ইলেকশন করার তালে আছে – ঠান্ডা গলায় কথা বলাই ভালো।
দোকানের একেবারে কোণে, দিনদুপুরেও যেখানে অনেকটা অন্ধকার জমে থাকে, ফাচুক লাবু সেখান থেকে ফোঁড়ন কাটে, তা ঠিক – সন্ধ্যার পরও একসঙ্গে বইসা থাকে, এইটা কি ঠিক? সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত থাইকলে তাও একখান কথা আছিল। না কি কন?
সবাই খবর দেখা বাদ দিয়ে পেছন ফিরে একচোট হেসে নেয়। মোতালেবের অস্বস্তি বাড়ে। এখন আর কিছুতেই নরম হাসি ধরে রাখা যাচ্ছে না ঠোঁটের কোণে। আজ বাদে কাল সে কমিশনার ইলেকশন করবে, লোকজন তার কথা শুনে হাসলে কি ভালো লাগে! তাও থাকা যেত, বাদশা যদি চ্যানেল পাল্টাতো। কিন্তু বাদশা তো খবর দেখছে না, চোখ দেখে মনে হচ্ছে, টেনে টেনে কাদের মোল্লার দাড়ি ছিঁড়ছে। কেন যে রাজাকাররা খালি খালি এইটাকে বাঁচিয়ে রেখেছিল! বাপ-মাকে মেরেছিল, সঙ্গে তো বাদশাকেও হিসাব-নিকাশ করে দিতে পারত। তা না করে দয়া দেখাতে গেছে! এখন শয়তানটা বড় হয়েছে, আর কান দুটো হয়েছে আরো বড়। কোথাও কেউ ‘রাজাকার’, ‘আলবদর’, ‘আলশামস’ ‘শান্তি বাহিনী’ এইসব বললেই কানগুলো খাড়া করে শোনে। এখনো শুনছে, খালি শুনছে না, চোখ দেখে মনে হচ্ছে, কাদের মোল্লাকে ফাঁসিতে ঝোলাচ্ছে আর ঝাড়ু দিয়ে জড়ো করছে গোলাম আযম, নিজামীদের। মোতালেব আর বসে থাকে না, উঠে দাঁড়িয়েও থাকে না, প্রচন্ড রাগ নিয়ে দোকান থেকে বেরিয়ে হাঁটতে থাকে।
কিন্তু গানটা শোনা গেল না, ছেঁড়া ছেঁড়া দু-চার লাইন এখনো স্বাতীকে আনমনা করছে, আর সুরটা ঢেউয়ে ঢেউয়ে রুপালি মাছ হয়ে ভাসছে… ডুবে যাচ্ছে, ভেসে উঠছে, কিছুতেই আটকানো যাচ্ছে না দৃশ্যপটে। বিকেল নেমে আসছে – বাইরে বের হতে হতে সে বাবার নাক ডাকার শব্দ শোনে, খুব নিঃশব্দে বেসুরো গলায় গানটি গাওয়ার চেষ্টা করে, ‘যদি আমাকে জানতে সাধ হয়…’। কলাপসিবল গেট পেরুতে গিয়ে একঝলক রোদ তার গাল ছুঁয়ে যায়। রাস্তায় এসে নারকেলগাছটার নিচে সে ফাঁকা রিকশার জন্যে দাঁড়িয়ে থাকে। স্টেশন রোডের দিকে যাওয়ার এ-রাস্তাটা শূন্য পড়ে আছে। উল্টোদিকে, তার হাতের বাঁদিকে, টার্মিনালের পথ। বেশি দূরে নয়, হাঁটলে বড়জোর মিনিটসাতেক। তারপর রাস্তা শেষ, কিংবা নতুন পথের শুরু – কোনো বাস এসে ঢুকছে টার্মিনালে, কোনো বাস আবার চেষ্টা করছে হাইওয়েতে যাওয়ার, বাসের গায়ে জোরে জোরে হাত থাবড়ে হেলপাররা শেষবারের মতো চেষ্টা করছে আরো দু-চারজন যাত্রীকে তুলে নেওয়ার, রিকশাওয়ালারা চিৎকার করে ডাকছে যাত্রীদের। অথচ ফাঁকা রিকশা দূরে থাক, যাত্রী নিয়েও রিকশা আর ফিরছে না সেদিক থেকে। আগে এই সময় সিনেমাহলের কাছে রিকশার ভিড় জমত; কিন্তু সিনেমা দেখা মানুষ দিন দিন কমে আসছে। হলও তাই বন্ধ হওয়ার পথে। একেবারেই নতুন সিনেমা না এলে বিশাল হোর্ডিংবোর্ডটার ওপর আর বড় ব্যানার লাগানো হয় না, তার বদলে সিনেমার একই পোস্টার বারবার সেঁটে দেওয়া হয়। এখন যেমন হোর্ডিংবোর্ডটায় সেঁটে রাখা হয়েছে প্রাপ্তবয়স্কদের পোস্টার। শহরের পবিত্রতা রক্ষার জন্যে সেসব পোস্টারের স্পর্শকাতর স্থানগুলোয় লাগানো ‘এক টিকিটে দুই সিনেমা’ লেখা ছোট স্টিকারগুলো চোখ দিয়ে ভস্ম করে ফেলার মতো কেউ অবশ্য এ-মুহূর্তে নেই আশপাশে। বাবা-মায়ের ঘর থেকে এসব সরাসরি চোখে পড়ে। মা তাই পারতপক্ষে জানালাগুলো বন্ধ রাখে। কতবার ড্রেসিং টেবিলের সামনে সিনেমার নায়িকাদের মতো টান হয়ে দাঁড়ানোর ইচ্ছে হয়েছে তার। বাথরুমে আয়না থাকলে নিশ্চয়ই ইচ্ছেটার সদ্ব্যবহার হতো। কিন্তু বাসার কারো কাছেই বাথরুমে আয়না থাকার গুরুত্ব নেই। বাথরুমে নয়, বারান্দার রেলিংয়ের কার্নিশে ছোট আয়না রেখে দাঁড়ি কামায় বাবা, শাহেদও এখন সেরকমই করে। অবশ্য একবার স্বাতী ওই দাঁড়ি কামানোর আয়নাটাই বাথরুমে নিয়ে গিয়েছিল। এই সামান্য অতীত তাকে স্বস্তির সঙ্গে সামনের দিকে ঝুলে থাকা হোর্ডিংবোর্ডের দিকে চোখ তুলে তাকাতে বাধা দিতে থাকে। তখন আরো মনে পড়ে, তার ঠিক পেছনে নারকেলগাছের সঙ্গেও পোস্টার আছে একটা। স্বাতী গাছের নিচ থেকে আরো একটু এগিয়ে দোকানের দিকে তাকায়। যাক, ছেলেটা নেই! আগে কলেজে দেখত, এখন এই দোকানেও দেখা যায় প্রতিদিন। আকাশবাণীতে উচ্চাঙ্গসংগীত শুরু হয়, ছেলেটা তখন এখানে এসে বসে। স্বাতী তখন কলেজ থেকে ফিরে হয়তো হাতমুখ ধুয়ে গামছাটা মেলে দিচ্ছে বারান্দায়। নাকি তখন তার মনে পড়ছে, আকন্দ পাতা ছিঁড়ে নিলে টপটপ করে দুধের ফোঁটা গড়িয়ে পড়ে! মিনিট ১৫ বাদে ছেলেটাকে আর দেখা যায় না। আবারো দেখা যায় ঘণ্টাখানেক বাদে। ছেলেটা কি ওই নিরালা মেসে থাকে! কিন্তু কয়েকদিন হলো সে আর এইখানে বসে না। সে ভ্যানিটি ব্যাগের মধ্যে নকশাওয়ালা খাতা, কাঠপেনসিল, কার্বনপেপার, এমব্রয়ডারির কাপড় আর রিংয়ের অস্তিত্ব খুঁজে নিতে নিতে ছেলেটা আশপাশে না থাকার আনন্দে রিকশা না পাওয়ার বেদনা হারিয়ে ফেলে।
কিন্তু এইচএসসি পেরুলেও এ-শহর ছাড়া হলো না – যত না আনন্দ তারও বেশি এই বেদনার ঝাপটায় আনমনা স্বাতী আবারো নারকেলগাছের নিচে গিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। আর চায়ের মধ্যে বিস্কুট ডুবিয়ে খাওয়ার তৃষ্ণা জাগে। অনার্স – অনার্স নিয়ে তার আর পড়া হলো না। আর্টস ও কমার্সের কোনো অনার্স সাবজেক্ট এখনো চালু হয়নি এখানের কলেজে। অতএব অনার্স তার আর পড়া হলো না। ডিগ্রি পাশ করার পর সে ভার্সিটিতে গেলে ক্লাসমেটরা তাকে পিলু বলবে। দুঃখে সে সন্ন্যাসিনী হয়ে পথে পথে ঘোরে, অপঘাতে মরে ভূত হয়ে যায়, নারকেলগাছের মাথায় উঠে হাসে আর চুল শুকায়। তারপরও এভাবে কি ডিগ্রি নিয়ে পড়াশোনার গ্লানি ঢাকা যায়! সে তার সারা শরীরে স্কুলে পড়া প্যাসকেলের সূত্র দেখতে পায়। শরীরের যেখানে চোখ পড়ে সেখান থেকেই তার ফিনকি দিয়ে রক্ত উঠে আসে। দ্রুত, দ্রুত তার রেবেকা আপার বাসায় যাওয়া দরকার। প্রতিদিন চারটার মধ্যে পৌঁছে যায়, অথচ আজ ঘড়ির কাঁটা পৌনে পাঁচটা ছুঁইছুঁই করছে। কিন্তু এখানে, এই সিনেমাহলের কাছে, ক্ষণিকার কাছে আগের মতো আর রিকশা মেলে না। না গেলে তার বিকেলটা ভালো যাবে না, এমব্রয়ডারি শেখা হবে না। শেখার জন্যে যেতে হবে তাকে – আবার শেখাবার জন্যেও। একেবারেই নতুন যারা আসে, সে আর নাদিয়া তাদের সুই-সুতার কাজ বুঝিয়ে দেয়। আর রেবেকা আপা তাদের শেখায় নতুন ডিজাইন তোলা – নতুন অর্ডার নিয়ে হিমশিম খায় সে, নাদিয়া আর সে তাকে সাহায্য করে আর গল্প করে। কোনটায় বেশি মজা? শাড়ি-কামিজে, পাঞ্জাবি-ফতুয়াতে নতুন নকশা তুলতে নাকি কখনো নিচু স্বরে, কখনোবা উঁচু স্বরে গল্প করে মৃদু-উচ্চ হাসিতে ভেঙে পড়তে? জানে না সে, জানার ইচ্ছেও হয় না। হিসাব করলে এসব কাজের পারিশ্রমিক নিশ্চয়ই কম নয়। অন্য কোনো শহরে থাকলেও সে কি এরকমই করত? ভার্সিটিতে ভর্তি হলে? নাকি তখন আর সময় হতো না এসব করার? সময়, অথবা রুচি! সে কি তাহলে কোনো বিজ্ঞাপনের মডেল হওয়ার পেছনে দৌড়াতো এর বদলে?
তবে কি হবে সেসব ভেবে। তা ছাড়া এ-শহর স্বাতীর খারাপও তো লাগে না। এমনকি মাঝে মাঝে এত ভালো লাগে যে, চিন্তাও করা যায় না। তারপরও মনে হয়, অন্য কোথাও থাকলে এ-শহরে ফিরে ফিরে আসা যেত। দেবদারুর পড়ে যাওয়া নিঃসঙ্গ পাতাকে কুড়িয়ে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কোথাও গিয়ে চা খাওয়ার কথা ভাবা যেত। এতদিন থেকেও এ-শহর তো ভালো করে চেনা নয় তার, তাহলে এ-দোকানেই কি আসত সে চায়ের টানে? যত দিন যাচ্ছে, দোকানটা তত গমগমে হয়ে উঠছে। টিভিতে কখনো ‘এক নদী রক্ত পেরিয়ে’ গানটা শুরু হলে বাদশা শব্দের ভল্যুম বাড়িয়ে দেয়। মোতালেব থাকলে চেঁচামেচি করে, ‘সিভিক সেন্স নাই, এত জোরে বাজাস ক্যান? মানুষজনের অসুবিধা হয় না?’ কমিশনার হতে চায় সে, অতএব কণ্ঠে তার নেতা নেতা ভাব থাকে। কিন্তু বাদশাও তো ভোটার, সে ছেড়ে দেবে কেন? জোরে জোরে বলে সে, ‘মেরে সেকেন্ডহ্যান্ড জওয়ানি’ হইলে ভল্যুম বাড়াইতে কন ক্যা? এত জোরে এসব কথাবার্তা হয় যে বাসায় থেকেও সে স্পষ্ট শুনতে পায়। আর শুনতে শুনতে হাসে। এখন আবার ছেলেটা এখানে বসে চা খায় মাঝেমধ্যে। অনার্সের ছাত্র, তাও অন্য কোনো কলেজ থেকে আসা – সেজন্যেই কি বেশি অসহ্য লাগে ওকে? ছেলেটা তার পিছু নেয়নি, ছেলেটি তার সঙ্গেও পড়ে না – ছেলেটি এখন নিশ্চয়ই নেই আশপাশে; নিশ্চিন্তেই বলতে পারে সে, কয়দিন হলো কলেজ কিংবা এই দোকান কোনোখানেই সে দেখেনি ওকে। সেই সেদিন অনার্স বিল্ডিংয়ের কাছ থেকে কয়েকজন ছেলেমেয়ে ‘যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার/ ফাঁসি চাই, দিতে হবে’ স্লোগান দিতে দিতে চলে গেল শহীদ মিনারের দিকে, তারপর আর দেখা যায়নি ওকে। তার আগে ওরা ছোটখাটো একটা সভাও করেছিল – ছেলেমেয়েগুলো দাঁড়িয়েছিল চোরকাঁটাওয়ালা মাঠের ভেতর, আর তাদের সামনে একটু উঁচু বারান্দার কোণে দাঁড়িয়ে হাত উঁচিয়ে বলছিল ছেলেটি, ‘এ দেশের মানুষ মানবতার বিরুদ্ধে সেসব অপরাধের ন্যায়বিচার চায়, যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি চায়। সর্বোচ্চ শাস্তি চায়। এমনকি যুদ্ধাপরাধীদের সন্তানেরাও চায় না পূর্ব প্রজন্মের সেসব অপরাধের দায় বইতে। এর মধ্যেই শুনেছেন আপনারা, শাহবাগে হাজার হাজার মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে পিতা আনোয়ার হোসেন মাঝির জঘন্য যুদ্ধাপরাধের ইতিহাস তুলে ধরেছে সাহসী কন্যা নাজমা আকতার …’
শুনতে শুনতে স্বাতী জানালার পাশ থেকে কমনরুমের একেবারে ভেতরে চলে এসেছিল। দরকার নেই, এসবে কোনো দরকারই নেই তার। কারো সাতেপাঁচে নেই সে। শহিদ মিনারে নাকি মঞ্চ হয়েছে, রাত ১২টা অবধি সেখানে গান হয়, আবৃত্তি হয়, বক্তৃতা হয়, মোমের আলোয় আলোকিত হয়ে থাকে পুরো মিনার। কিন্তু কোনোখানেই তার যাওয়া হয়নি। সে কেবল গল্প শুনেছে অনেক ফুলের গাছ আছে কালীবাড়িতে, সে কেবল শুনেছে ভোরবেলা অনেক পাখি খানিকক্ষণের জন্যে এসে বসে নদীর পাড়ে, সে কেবল জানে অনেক আগে, তার জন্মেরও আগে, যুদ্ধের সময় বিহারিরা শহর থেকে পালাতে-থাকা অনেক মানুষকে ধরে এনে খুন করে ফেলে দিয়েছিল রেলস্টেশনের পরিত্যক্ত ইঁদারার মধ্যে; কিন্তু সে কোনোদিনই ওইসব জায়গায় যায়নি। কোনোদিন হয়তো যেতেও পারবে না। অথবা সে যাওয়ার আগেই কালীবাড়ির গাছগুলো থেকে সব ফুল ঝরে পড়বে, পাখিরা নদীর পাড়ে আসতে ভুলে যাবে, রেলস্টেশনের পরিত্যক্ত ইঁদারাটি মিলিয়ে যাবে। আর তার নিজের সারা শরীরে ততদিনে গজিয়ে উঠবে শিকড়ের পর শিকড় – শহর ছেড়ে এমনকি নানাবাড়িতেও কোনোদিন তার আর যাওয়া হবে না। সে শুধু মাঝেমধ্যে রেবেকা আপার বাড়ি যাবে। রেবেকা আপার – অথবা রেবেকা আপার মতো অন্য কারো বাড়ি। সেখানে মোড়ায় বসতে বসতে সে খুঁজে পাবে ঝরনার পাড় আর অকস্মাৎ তার কণ্ঠ থেকে বেরিয়ে আসবে কোনো গানের কলি। তা শুনতে শুনতে আনমনে রেবেকা আপা বলবে – তুমি কিন্তু এখনো শিখতে পারো…
স্বাতী লম্বা চোখ মেলে রাস্তার এদিক-ওদিক দেখে। নরম রোদ মুছতে মুছতে দীর্ঘ ছায়া নামছে রাস্তার ওপরে। কসাই বদরুল চাচা নরম হাড় কুচি করছে চাপাতি দিয়ে। কসাইয়ের দোকানের পাশেই ছোট পাগাড়, ম্লান ধুলোমাখা ভাঁটফুল গাছগুলো সেটিকে ঘিরে রেখেছে। আর তারপরই নিখিলেশের সেলুন – নিখিলেশ সেটার ঝাপ তুলছে দুপুরের খাওয়া-দাওয়া সেরে এসে। আলসেমি ভাঙতে শুরু করেছে বিকেল। কিন্তু কর্মব্যস্ত হয়ে উঠলেও শহরের এই জায়গাটুকু গ্রামের মেঠো হাটের মৃদু কলরবের বেশি ঢেউ তোলে না। মনেই হয় না, এত কাছে একটা বাসের টার্মিনাল – সারাদিন-সারারাত সেখানে বাস-মিনিবাস থেকে শুরু করে হোটেলওয়ালা, রিকশাওয়ালা, ফেরিওয়ালা ও যাত্রীদের বিচিত্র সব শব্দ ও হাঁকাহাঁকির মিশেলে কান পাতা দায়।
দরোজা পেরিয়ে করিডোর দিয়ে যেতে যেতে স্বাতী দেখে, মোতালেব এসেছে। কখন এলো লোকটা! রাস্তার পাশেই তো সে দাঁড়িয়েছিল রিকশার জন্যে। লোকটা কি ভূত! বাসা থেকে বেরুনোর আগে দেখেছিল সে, বাদশার দোকান থেকে বেরিয়ে মোতালেব নিজের বাড়ির দিকে হাঁটছে। তাহলে সে কি ভুল দেখেছে! একটু এগিয়ে করিডোরে দাঁড়ালেও স্পষ্ট শোনা যায়, সিটিংরুমে কী কথা হচ্ছে। বাবা তো ঘুমাচ্ছিল, এখন কি তাহলে জেগে উঠেছে? আর তারই সঙ্গে মোতালেব কথা বলছে, জানতে চাইছে অথবা জানবার ভঙ্গিতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দিচ্ছে, এতটুকু এই শহরে, যেখানে সবাই সবাইকে চেনে, একজন আরেকজনকে জানে, সেখানে কি কোনো প্রয়োজন আছে এরকম কোনো কিছু করার!? শহীদ মিনারে মোমবাতি জ্বালিয়ে রাত্রি জাগার!?
কী করার মানে আছে, বোঝা যায় না। কেননা, কোনো উত্তর আসে না। তাই এও বোঝা যায় না, বাবার ঘুম ভেঙেছে কিনা। তবে মোতালেবের কথা বলা থেমে থাকে না। সে এবার ব্যাপারটা চিন্তা করে দেখতে বলছে বাবাকে। বলছে, এই যে আপনের শমসেরভায়ের কথাই ধরেন, আপনেরই তো ভাই –
বাবা নিশ্চয়ই ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়েছে, বুঝতে পারে স্বাতী; নইলে মোতালেব আবার অস্থির গলায় যুক্তি দিতে যাবে কেন, চাচাতো-খালাতো ভাই হলেও তো সে ভাই-ই তার বাবার। আর সে শান্তি কমিটিতে ছিল যুদ্ধের সময়ে। ভ্রূ-কুঁচকানো বাবাকে উপেক্ষা করে সে-কথা বলতে থাকে মোতালেব উত্তেজনা দোলানো স্বরে, খলিলভায়কে যখন চোখে গামছা বাইন্ধা শ্মশানের বটগাছতলায় নিয়া গেছিল, শমসেরভাই তখন তারে জানে বাঁচায় নাই?
মোক্ষম যুক্তি নিশ্চয়ই! নইলে বসার ঘরের প্রত্যুত্তরহীন বাতাস ছাপিয়ে কেন আবার শুধু মোতালেবের স্বরই ভেসে আসবে, দ্যাশের মধ্যে শান্তি কমিটিই তো মুক্তিযোদ্ধাগারে শেল্টার দিছে।
এবার বাবা কথা বলে, স্বাতী তাই নিশ্চিত হয় – বাবার তাহলে ঘুম ভেঙেছে, এসব আজগুবি কথা তুমি কোনখানে পাও? খলিল শমসেরের বোনের জামাই। আত্মীয় আত্মীয়রে বাঁচাইছে, এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের শেল্টার দেওয়ার কী দেখছো?
আমিও তো তাই কই মিয়াভাই। আত্মীয় যদি আত্মীয়রে না দেখে, কে দেইখবে? কে রাজাকার আর কে মুক্তিযোদ্ধা, তা নিয়ে থাকলি হবে?
কিন্তু বাবা মোতালেবের কথা কানে না তুলে বলে, শোন, খলিলকে বাঁচালেও শমসের কিন্তু লক্ষ্মী, কানিজ আর রুপাদের রেপ করেছে, পাকিস্তানিদের ক্যাম্পে দিয়ে এসেছে। হিন্দুদের তো মেরেছেই – আবেদীন, ফয়জুল আর শাজাহানদেরও ধরে নিয়ে খুন করেছে।
মোতালেব নিশ্চয়ই হতাশ হচ্ছে এসব শুনে। সে নিশ্চয়ই ভেবে এসেছে, যুদ্ধ যায়নি বলে বাবা বোধহয় সায় দেবে তার কথায়। বাবা কি সত্যিই নয় মাস জবাই করেনি কোনো প্রাণী? মাঝে মাঝে সেরকমই মনে হয় তার, যেমন এখন। মনে হয়, বাবা পারলে তাকে ঢাকাতেই পড়াত। দাঁড়িয়ে না থেকে স্বাতী চলে যায় করিডোর থেকে।
তারপর সন্ধ্যা আসতে না আসতেই জানালার পাশে দাঁড়িয়ে স্বাতী দেখে, শহরে উৎসব লেগেছে। শহীদ মিনারে মিছিল করে যাচ্ছে মানুষ, ফিরেও আসছে মিছিল নিয়ে। কারো কারো হাতে মোমবাতি, কেউ আবার জ্বেলেছে মশাল। আজ আর রাস্তায় অন্ধকার জমতে পারছে না, রিকশাগুলোও থেমে পড়েছে। মাইকে ভেসে আসছে কখনো গান, কখনো স্লোগান, কখনো কবিতা, কখনো কেবলই বৃক্ততা। এখন আর শহিদ মিনারে কোনো অনুষ্ঠান হলে এখান থেকে পরিষ্কার শোনা যায় না। তারপরও ছেঁড়া-ছেঁড়া শব্দগুলো থেকে বোঝা যাচ্ছে, কেউ একজন বলছে শহরের পুরনো হত্যাকান্ডের কথা। হিন্দুদের মুসলমান বানিয়ে গরু খাওয়ানোর কথা।
বাদশা দোকানের বাতি নিভিয়ে দেয়। সন্ধ্যা হওয়ার আগেই বাজার থেকে কয়েক বাক্স মোমবাতি নিয়ে এসেছে সে। এখন প্যাকেট খুলে সেগুলো দোকানের এখানে-ওখানে লাগাতে থাকে। অস্পষ্ট বাতাস এখন আর মোমবাতির শিখাকে দোলাতে পারছে না। মোমের আলোকে প্রলেপ দিচ্ছে দোকানের শেষপ্রান্তে টেবিলে রাখা টেলিভিশনের পর্দা থেকে ঘুরেফিরে উঁকি দেওয়া মোমের আলো। নজু মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে মোমবাতি প্রজ্বালনের দৃশ্যের দিকে। বিশাল এক পতাকা থেকে লাল-সবুজের আলো এসে এবার ধুয়ে দিয়ে গেল সারা দোকানকে। ফলে দোকানের বাইরেই থমকে গেল মোতালেব। কী একটা চ্যানেলে দৈনিক এই সময় একেকদিন একেক মেয়ে সমুদ্রের ধারে ঘুরে বেড়ায়, সাঁতার কাটে, বোট চালায় – এই অনুষ্ঠান দেখা তার নেশা হয়ে গেছে। আহ্, এরা যে খাওয়া-দাওয়া করে, সেই খাওয়া দেখেও কত সুখ পাওয়া যায়! ‘এসব নেংটিনুংটি আর দুধপোশাক কোনখানে পাওয়া যায়?’ নিজেই নিজেকে সে প্রতিদিন এ-প্রশ্ন করে ফোঁসফোঁসিয়ে, আর প্রতিদিনই বউয়ের চেহারাটা মনে পড়ায় তার ফুঁসে-ওঠা প্রশ্নের ফণা আপনাআপনিই নিচে নেমে আসে। অতৃপ্ত চোখমুখ নিয়ে সে আবারো পরের দিনের অনুষ্ঠান দেখার প্রস্ত্ততি নেয়; কিন্তু কী যে হয়েছে বাদশার! আজকাল চার-পাঁচবার বলার পরও চ্যানেল আর পাল্টায় না সে। আর আজকে তো দেখা যাচ্ছে, দোকানজুড়ে মোমবাতি জ্বালিয়ে বাতি নিভিয়ে বসে আছে!
কী রে বাদশা, তুই কি হিন্দু হয়্যা গেলি নাহি? মোম জ্বালায়া পূজা কইরতে বসছিস?
বাদশা শূন্য চোখে তাকে তাকিয়ে দেখে। তারপর আবারো স্যাটেলাইটের খবর দেখতে থাকে। যথেষ্ট নীরবতা পার করে মোতালেবের দিকে না তাকিয়েই ইচ্ছাকৃত উদাস গলায় বলে, কী আর কইরবেন? ধইরা নিয়া গিয়া আমার পক্ষীটার চামড়া কাইটা কলমা পড়ায়া মুসলমান বানায়া দ্যান।
মোতালেবের শরীর জ্বলে। বাসায় পোলাপানের সঙ্গে বসে সে টিভি দেখে না। সে তখন আদর্শ স্বামী, আদর্শ পিতা, খোদার পরহেজগার বান্দা – বাড়িতে একা থাকলেও টিভির উরামতারাম চ্যানেল দেখতে রাজি নয় সে। কিন্তু দুনিয়া এতদূর এগিয়ে গেছে, এসব একেবারে না দেখলে চলে কেমনে! সৃষ্টিকর্তা কি বোঝে না, বান্দার মনের কথা? সৃষ্টিকর্তা কি জানে না, বান্দা কখন নিরুপায় হয়ে পড়ে? অথচ এসব দেখতে এসে কত কথাই না শুনতে হয় তাকে! তখন কতজন যে শয়তানি বুড়ি হয়ে যায়, চলার ক্ষমতা না থাকলেও কাঁপা-কাঁপা হাতে কাঁটা বিছাতে থাকে তার এসব দেখতে আসার পথে!
ধৈর্য, ধৈর্য ধরতে হবে, একদিন না একদিন সে নিশ্চয়ই বাদশাকে ন্যাড়া করতে পারবে, মাথায় ঘোল ঢেলে দিতে পারবে, জানতে চাইতে পারবে, চার কলেমা জানে কিনা ও – মোতালেব শান্ত হয়ে বেঞ্চে বসে। টিভির দিকে তাকাতে ভয়ানক বিরক্তি ও কষ্ট লাগে। কতক্ষণ আর চলবে মোনাফেকদের এসব কর্মসূচি! আর কী অদ্ভুূত, কোনো মোমই ফুরাচ্ছে না, একদিকে গলছে তো জমাট বাঁধছে অন্যদিকে… আর জ্বলছে তো জ্বলছেই!
আজ অবশ্য রিকশা পাওয়া গেল। সেই পাতাঝরা বিকেলেই, এই শহরে তার প্রথম আসা দিনটির মতো বিকেলেই… রিকশায় উঠতে উঠতে আবারো কসাইয়ের দোকানটার দিকে চোখ গেল তার। চাপাতি উঠছে, চাপাতি নামছে, চাপাতি উঠছে, চাপাতি নামছে… কিসের সঙ্গে যেন সাদৃশ্য আছে এই দৃশ্যের, তা মনে হতে গিয়েও মনে না আসার অস্থিরতা স্বাতীর চোখে লাল কাপড়ের ওপর লাল কাপড় বেঁধে দিতে থাকে, আর সে তার স্মৃতিঘরে তন্ন তন্ন করে খুঁজতে থাকে সেই দৃশ্য। সবকিছু ঝাপসা হয়ে আসে, কুয়াশায় ঢেকে যায়, কুয়াশার ওপর বিচ্ছুরিত হতে থাকে সূর্যের নরম আলো এবং তারপরই সবকিছু স্পষ্ট হয়ে ওঠে ভোরের শুয়ে থাকা জনপদের মতো – এদিকেই একদিন দৌড়াতে দৌড়াতে এসে হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়েছিল এক ছাত্র – ‘নারায়ে তকবির, আল্লাহু আকবর’ স্লোগান দিতে দিতে তার ওপর হামলে পড়েছিল তিনতলা মেসের ছেলেগুলো, যাদের কারণে মেসটি এখন সারা শহরে পরিচিতি পেয়েছে ‘শিবিরের মেস’ নামে। তাদের হাতে ধরা রামদা, চাপাতি উঠছে আর নামছে হোঁচট খেয়ে উবু হয়ে পড়ে যাওয়া ছেলেটির শরীরে। রক্ত ছলকে উঠল আকাশ ছুঁতে, ছিটকে পড়ল চারপাশে, যেন ছুঁয়ে দেবে তার চোখমুখ। ভয় ও আতঙ্কে সে দ্রুত মুখ সরিয়ে নেয় জানালা থেকে। রিকশায় উঠতে উঠতে সে ফিরে আসে বর্তমানে, স্মৃতিঘর মুহূর্তে উবে যায় কোনখানে। বাদশার দোকানে ছেলেটিকে কয়দিন হলো আর দেখাই যাচ্ছে না! আজো নেই তাহলে?! ভাবতে ভাবতে স্বস্তির নিশ্বাস ছেড়ে পিছে ফিরে তাকাতেই অস্বস্তি ফিরে আসে তার। ছেলেটিকে দেখা যাচ্ছে – বাদশার দোকান থেকে তাকে ঠেলতে ঠেলতে বের করে নিয়ে আসছে কয়েক ছেলে। মোতালেব আছে তাদের সকলের পেছনে, তারস্বরে সে বলছে, নাস্তিক না তো কী? নাস্তিক না তো কী?
কারা যেন বাদশার দোকানে আগুন জ্বালাচ্ছে! নাকি গানপাউডার দিয়েছে? রিকশাওয়ালা একবার পিছে ফিরে দেখে, তারপর দ্রুত প্যাডেল করতে থাকে। হুডতোলা রিকশার ভেতর থেকে স্বাতীর আর কিছু দেখা হয় না। দম তার আটকে আসে। এই শহরে সে কি এরকম বিকেলেই এসেছিল? আজ আর তা ঠিক মনে হয় না। কবে শেষ হবে এরকম খুনোখুনি? মিছিল, হরতাল আর অবরোধ? বাসা থেকে বেরুনো আজ বোধহয় ঠিক হলো না। কিন্তু এমব্রয়ডারি শিখতে বাইরে বেরুনোর এই একটু সুযোগ – মারামারি হচ্ছে বলে বাড়ি ফিরে যাওয়া ঠিক হতো না। বাবা কি তাহলে বেরুতে দিতো আবার, মারামারি শেষ হওয়ার পর? সেই কবে থেকে, মনেও পড়ে না কবে থেকে – নিশ্চয়ই জ্ঞান হওয়ার আগে থেকেই তো ইচ্ছেমতো বাড়ি থেকে বেরুতে পারে না সে। জয়সাগর দিঘি দেখা হলো না, নানাবাড়ি ছাড়া আর কোনো জায়গা দেখা হলো না। আজ যদি শহরে খুব মারামারি শুরু হয় – ভালোই তো হয়। এরকম ভাবা ঠিক নয়, তবু সে ভাবতেই থাকে – তাহলে সে বাড়িতে টেলিফোন করে বলতে পারে, রাস্তায় বেরুনো ঠিক হবে না। হয় তোমাদের কেউ এসে নিয়ে যাও, না-হয় রেবেকা আপার বাড়িতেই থাকি। আর নিশ্চয়ই বাবা কিংবা শাহেদ তাকে নিতে আসবে না আপার বাড়ি থেকে। আহ্, যদি খুবমতো মারামারি হতো আজ!
ভাবতে ভাবতে সে রেবেকা আপাদের বাড়ির গেট ঠেলে ভেতরে ঢোকে। নাহিদ, ফারজানা, ঝুমুর, রিফাতরা আগেই এসে গেছে। রেবেকা আপা মোড়ার ওপর বসে বসে কাজ বুঝিয়ে দিচ্ছে নাহিদকে। তাকে দেখেই খুশিতে উঠে দাঁড়ায় মোড়া থেকে, তুমি আসছো স্বাতী! আমি তো ভাবছিলাম, তুমি আজো আসবা না। যা গন্ডগোল বাইরে –
মনে হয়, সারা পৃথিবীতে ইচ্ছেমতো নিশ্বাস নেওয়ার জায়গা এই একটুই – স্বাতীও তাই প্রায় ছুটে এগুতে থাকে তার দিকে। রিফাত, এই এতটুকুন, এতটুকুনই তো – ক্লাস নাইনে পড়া মেয়েকে ডিগ্রিপড়া সে তো এতটুকুনই বলবে, হাতটা একটু তুলে কেমন মিষ্টি সুরেলা কণ্ঠে ‘শুভেচ্ছা’ বলে ওঠে তাকে। আর সেও ‘শুভেচ্ছা’ বলে রিফাতের চুল ছুঁয়ে পাশ দিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ ওর হাতে ধরা এমব্রয়ডারি রিংয়ে চোখ আটকে গেলে তাকিয়ে থাকে… তাকিয়েই থাকে…
লাল সুতো দিয়ে রিফাত সাদা কাপড়ের ওপর লিখছে – ‘ফাঁসি চাই’।
স্বাতীর মনে হয়, আজকেই শেষ নয়। ছেলেটি হয়তো মারা যায়নি, কিংবা মারা গেছে। কিন্তু তাতে কিই-বা আসে যায়! আরো কেউ তৈরি হচ্ছে, ছেলেটির স্তব্ধ কণ্ঠ ছাপিয়ে তার স্বর এখনই ছড়িয়ে পড়বে আকাশটাতে।