‘পিঠ চুলকানোর জন্যও একজন মানুষ লাগে’, টেলিফোনের অপর প্রান্ত থেকে একটু ম্লান হেসে বললো মুনা।
তার কণ্ঠস্বর কেমন বিষাদগ্রস্ত মনে হলো জহিরের কাছে।
এখন প্রায় সকাল হয়ে গেছে। দেয়ালঘড়িতে সাড়ে চারটা। সাধারণত তারা এতো সময় নিয়ে কথা বলে না। দুজনেরই সকালবেলা অফিস আছে। রাতের অন্ধকার আস্তে আস্তে ধোঁয়াটে হয়ে আসছে। জানালা দিয়ে শীতল বাতাস বইতে শুরু করেছে। সেই বাতাস মুখমন্ডল ছুঁয়ে গেলে সতেজতা অনুভব করে জহির। সে চাঙ্গা হয়ে ওঠে। সেই রাত এগারোটা থেকে সোফায় বসে, কখনো বিছানায় আধশোয়া হয়ে মুনার সঙ্গে অনর্গল কথা বলে চলেছে সে।
জহির মুনার কথার রেশ ধরে বললো, ‘তোমার পিঠ চুলকানোর লোক তো হাজির। আদেশ করলেই হয়।’
‘না লাগবে না, হাতা আছে। বাজারে কিনতে পাওয়া যায়’, জবাব দেয় মুনা।
জহিরের স্ত্রী মারা যাবার পর দুই বছরের মাথায় তার অনেকদিনের বন্ধু মোবারক মুনার টেলিফোন নম্বর দিয়ে তাকে বলেছিলো আলাপ করার জন্য। মুনা মোবারকের পরিচিত বাবরের ছোট বোন। সত্তরের আগে করাচিতে তারা পাশাপাশি বাসায় ছিলো। সেই থেকে তাদের সখ্য এবং অন্তরঙ্গতা।
দেশে আসার পরও মোবারকের সঙ্গে বাবরদের পরিবারের সম্পর্ক বজায় আছে; বরং বলা যায় সেটা আরো নিবিড় হয়েছে। এখন মোবারক যেন বাবরদের পরিবারেরই একজন। বাবর পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। তারা দুই ভাই এক বোন। ঢাকার শান্তিনগরে তাদের পৈতৃক বাসস্থান। চারতলা বাড়ির তৃতীয় তলার ফ্ল্যাটটা মুনার নিজের। মুনার জানালার পাশে একটা কামিনী ফুলের গাছ আছে।
মোবারক বলেছিলো বাবর এখন গুরুতর অসুস্থ। যে-কোনো সময় কিছু একটা ঘটে যেতে পারে। বাবরই তাদের একমাত্র অভিভাবক। তাদের মা-বাবা দুজনেই মারা গেছেন। ফলে, মোবারকের ধারণা মুনার এখন বিয়ের কথা ভাবা উচিত এবং সম্ভবত মুনা এ-ব্যাপারে মনস্থির করে ফেলেছে।
মোবারক বলেছে মুনার বিয়ে হয়েছিলো পনেরো-ষোলো বছর আগে; কিন্তু সেই বিয়ে টেকেনি। বরের সঙ্গে মুনার মতের অমিল হচ্ছিলো। যেমন তার বর কখনো পারিবারিক অথবা অন্য কোনো অনুষ্ঠানে তাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে চাইলে মুনার আগ্রহ না থাকলে সে যেতে চাইতো না। অথবা মুনার স্বশুরবাড়িতে থাকা নিয়ে তার আপত্তি কিছুতেই বদলাতে পারেনি তার বর। এসব ছাড়া আরো নানাবিধ সাংসারিক খুঁটিনাটি বিষয়ে বিয়ের কিছুদিনের মধ্যেই মুনার সঙ্গে তার বরের বিরোধ চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায়। তখন একদিন তার বর তাকে চড় মেরেছিলো। সেই চড়ের আঘাতই তার স্বল্প সময়ের সাংসারিক জীবন ভেঙে দিয়েছে।
মগবাজার কাজী অফিসে যেখানে তাদের বিয়ে রেজিস্ট্রি হয়েছিলো সেখানেই তাদের বিবাহ-বিচ্ছেদ হয়।
সেদিন তার বর মুনার সবচেয়ে প্রিয় খাবারের বস্ত্ত ‘আইসক্রিম কেক’ নিয়ে আসে। তার চোখে মুনা তখন কয়েক ফোঁটা পানি দেখতে পেয়েছিলো।
জহির মোবারকের কাছে শুনেছে মুনার বয়স এখন চল্লিশের কোঠায়। দেখতে একটু খাটো, বড় বড় গভীর চোখ, গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যামলা, ঠোঁট দুটো কমলালেবুর কোয়ার মতো দেখতে, আর চুল ছোট করে ছাঁটা। তবে চেহারাটা খুব মিষ্টি। মোবারকের মতে মুনার ব্যক্তিত্ব তার সবচেয়ে বড় আকর্ষণের জায়গা।
মোবারকের বর্ণনা শুনে জহির মিটমিট করে হাসতে থাকে। দেখে মোবারক গম্ভীর হয়ে যায়। সে দৃঢ়তার সঙ্গে বলে ওঠে, সে একবিন্দুও মিথ্যা বলছে না। জহির তাকে দেখলেই সেটা বুঝতে পারবে। সে বেশভূষা এবং স্বভাবে যথেষ্ট মার্জিত। সে ফালতু মেয়ে নয়।
জহির তখন খুব কৌতূহলী হয়ে ওঠে মুনাকে দেখার জন্য।
মোবারক আরো বলেছে, মুনা বরাবরই ভালো ছাত্রী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনশাস্ত্রে এমএ। মাত্র চার নম্বরের জন্য সে প্রথম হতে পারেনি; সে-আফসোস এখনো কিছুটা রয়েছে তার মধ্যে।
মুনা একটা বেসরকারি ডেন্টাল হাসপাতালের এমডির একান্ত সহকারীর চাকরি করে। সে কম্পিউটিংয়ে সিদ্ধহস্ত। তার বসও ডাক্তার এবং ভালো ছাত্র। তিনি এসএসসি পরীক্ষায় স্ট্যান্ড করেছিলেন। তিনি মুনার কর্মদক্ষতার জন্য তার ওপর খুবই খুশি। অফিসের অন্যান্য স্টাফ – অশোক, মাসুদ ওরাও তার গুণমুগ্ধ। তারা মুনার শিক্ষা, রুচিবোধ এবং মেধার জন্য তাকে সমীহ করে।
একবার হাসপাতালের এক তরুণ ডাক্তারকে মুনা নিজের একক উদ্যোগে জাপানের স্কলারশিপ পাইয়ে দিয়েছিলো। যাওয়ার আগে মুনার আশীর্বাদধন্য ডাক্তারটি একটি চায়নিজ রেস্তোরাঁয় কয়েকজনকে নিমন্ত্রণ করে। তবে মুনা সেই নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে যায়নি। তখন হয়তো সেই প্রিয় ডাক্তারের চলে যাওয়ার জন্য মুনার কষ্ট হচ্ছিলো অথবা সে চেয়েছে তার পবিত্র ভালোবাসাসিক্ত প্রচেষ্টার শুভ্রতা অমলিন আর অটুট থাকুক।
ডিভোর্স হওয়ার পর মুনা বলা যেতে পারে সবখানি উজাড় করে চাকরিতে মনোনিবেশ করলো। যেন অফিসটাই তার সংসার। তার বাসার দৈনন্দিন ব্যবহার্য অনেক জিনিসপত্রই ঠাঁই পেলো অফিসে তার জন্য নির্দিষ্ট কক্ষের ড্রয়ার অথবা আলমারিতে।
মুনা অফিস থেকে ফিরে এসে নিজের একার জন্য রান্নাবান্নার কাজ সে নিজেই করে। কখনো ঝামেলা মনে হলে শুধু নুডলস খেয়ে রাত কাটিয়ে দেয়। ভাইদের ছেলেমেয়েরা অবসর সময়ে কখনো আসে তার কাছে; কিন্তু তারা অথবা মুনা নিজেও তাদের সঙ্গ বেশিক্ষণ উপভোগ করে না। একমাত্র বড় ভাবি ছাড়া আর কারো সঙ্গে মুনার তেমন দেখা বা কথাবার্তা হয় না। সে নিজের ঘরে একাকী থাকতেই বেশি পছন্দ করে।
স্ত্রী মারা যাওয়ার পর জহির গ্রামের বাড়ি থেকে মাকে তার কাছে নিয়ে এসেছে তার একমাত্র সন্তান অয়নকে দেখাশোনার জন্য। তার মায়েরও এখন বয়স হয়ে গেছে এবং তিনি কিছুটা অসুস্থ। তিনি গ্রামের বাড়ির সংসার ছেড়ে অনন্যোপায় হয়ে ছেলের সংসারের হাল ধরেন। দাদির সঙ্গে অয়নের সম্পর্কটা বেশ আন্তরিক – এটা দেখে জহির অনেকখানি আশ্বস্ত হয়। অয়ন তখন ক্লাস নাইনে উঠেছে। সবে কৈশোরে পা রাখা অয়নের জন্য এরকম একজন অভিভাবকই দরকার ছিলো। যদিও জহিরের সঙ্গে তার দাদির সম্পর্ক কখনোই ভালো ছিলো না। বলতে গেলে জহির তাকে পাত্তাই দিতো না। কারণ তার প্রচন্ড প্রতাপশালী রাশভারী দাদু সংসারের বড় ছেলে বলে জহিরকে অত্যধিক স্নেহ করতেন এবং আশকারা দিতেন।
যত দিন যায়, জহির আস্তে আস্তে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব আর তার ব্যাংকের কলিগদের এক ধরনের আনুকূল্য টের পায়। সে অনুভব করে, অয়নের মা মারা যাওয়ার পর সে যে একটা কষ্টকর আর অস্বাভাবিক জীবন যাপন করছে – এজন্য প্রায় সবাই তার প্রতি একটু বেশি মাত্রায় বাৎসল্যপ্রবণ। সে কখনো হঠাৎ কোনো ভুল করলেও তারা দ্বিতীয় বিবেচনায় সেটাকে লঘু করে দেখতে ভালোবাসে এবং অধিকাংশ সময় তার দন্ড রহিত হয়ে যায়। তবে জহিরের মনে হয় তাদের এরকম আচরণের মধ্যে সহমর্মিতার সঙ্গে হয়তো কিছুটা করুণা মিশ্রিত আছে।
জহিরের নিজেকে প্রায় অপাঙ্ক্তেয় মনে হয় কোনো পারিবারিক অনুষ্ঠানে উপস্থিত হলে। সেখানে সে নিষ্প্রভ হয়ে পড়ে এবং অনেকটা বেখাপ্পা মনে করে নিজেকে যখন সে দেখে, অন্যরা সবাই স্বামী-স্ত্রী সমভিব্যহারে সেখানে হাজির। যদিও তখন সবার এক প্রকার অতিরিক্ত মনোযোগ উপভোগ করে সে।
তবে তার সবচেয়ে কষ্টের জায়গাটা হলো স্ত্রী-অভ্যাসবর্জিত জীবনযাপন। তার বয়স এখনো পঞ্চাশের নিচে। অন্য অনেক অভাবের চেয়েও স্ত্রী-সঙ্গ বঞ্চিত হওয়াটা তার জন্য বেশি পীড়াদায়ক।
তার একজন দূর-সম্পর্কের খালাম্মা তাকে একদিন বললেন, ‘সংসারে ভাত বেড়ে দেওয়ার জন্যও একজন মানুষ দরকার।’
তার ফুপাতো ভাই আলম বললো, ‘আরে বাসায় কথা বলার জন্যও তো একজনকে প্রয়োজন।
প্রবাসী খালুজান একদিন হাসতে হাসতে বললেন, ‘লাইফ স্টার্টস অ্যাট সিক্সটি।’
এসব শুনে জহির পুনরায় বিয়ে করার কথা ভাবতে অনুপ্রেরণা পায় এবং এটাকে তেমন কোনো গর্হিত কাজ বলে মনে হয় না তার কাছে। যদিও জহিরের কাছে এরকম উদাহরণ আছে যে, স্ত্রী বিয়োগের পর তার চেনা একজন ভদ্রলোক বাকি জীবন অবিবাহিত থেকে একমাত্র মেয়েকে নিজের হাতে রান্নাবাড়া করে খাইয়ে মানুষ করেছেন।
সেই ভদ্রলোকের কথা মনে হলে জহির দ্বিধায় পড়ে যায়। মনে হয় সে তার প্রাণপ্রিয় সন্তানের কথা না ভেবে স্বার্থপরের মতো শুধু নিজেকে নিয়েই বেশি ব্যাকুল। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো, অয়নই বা ব্যাপারটা কীভাবে গ্রহণ করবে?
কিছুদিন আগে তার এক কবিবন্ধু অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলো। একদিন তাকে দেখতে যায় জহির। সেই কবিবন্ধুটি তখন তাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘এখন তোমার কীভাবে কাটবে?’
‘এভাবেই, কষ্টেশিষ্টে কেটে যাবে‘, উত্তর দিয়েছিলো জহির। তখন সে তাকে বুঝিয়েছিলো, ‘বিয়ে করলে এমনও তো হতে পারে যে, তুমি তোমার ছেলেকে নিয়ে যেরকম সমস্যার কথা ভাবছো, সেটা নাও হতে পারে। যিনি আসবেন তিনি হয়তো তোমার ছেলেকেও আপন করে নিতে পারবেন…।’
এসবের বেশ কিছুদিন পর জহিরের মনে হয় – না, এভাবে আর চলছে না। তাছাড়া একটাই তো মাত্র জীবন, এটাকে বঞ্চিত করে লাভ কী?
রাতের পর রাত বিছানায় নির্ঘুম এপাশ-ওপাশ করে প্রবল কামপীড়িত জহির নিষ্ফল সময় কাটিয়ে অবশেষে সিদ্ধান্ত নেয়, সে বিয়ে করবে।
মোবারকের দেওয়া ল্যান্ড ফোনের নম্বরে জহির টেলিফোন করে। অপর প্রান্ত থেকে মুনার কণ্ঠস্বর ভেসে আসে। ‘হালো, কে বলছেন?’
জহির নিজের পরিচয় দেয়। টেলিফোন নম্বর পাওয়ার ঘটনাটি বলে। তখন কারণটাও স্পষ্ট হয়ে যায় মুনার কাছে। সে তখন জোরে প্রাণখোলাভাবে দীর্ঘক্ষণ ধরে হাসে। তার গভীর ভরাট কণ্ঠস্বরে বুনো মাদকতা রিনঝিন করে ঝরে পড়তে থাকে তখন, যার সামগ্রিকতার রেশ যেন সহজে শেষ হতে চায় না গোপন আরো কে কোন রহস্য উন্মোচনের অভিপ্রায়ে!
মুনার সঙ্গে কথা বলে জহির বুঝতে পারে, সে এরকম একজনকেই মনে মনে খুঁজছিলো।
সেই থেকে ফোনে মুনার সঙ্গে জহির প্রাসঙ্গিক-অপ্রাসঙ্গিক অনেক বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরে কথাবার্তা বলে আসছে।
একটু পরেই ফজরের আজান দেবে। মুনা কামক্লিষ্ট স্খলিতকণ্ঠে বললো, ‘অনেকক্ষণ কথা হলো… বাইরের কামিনী ফুলের ঘ্রাণ নিয়ে বাতাস ঢুকছে ঘরে… সকাল হয়ে এলো প্রায়।’ হঠাৎ সে কী মনে করে একটা গোপন বিষয় প্রকাশ করার মতো অস্ফুট স্বরে বলে উঠলো, ‘জানেন, আমার বাঁ-পাশের বুকের চূড়ার কাছে একটা তিল আছে।’
মুনা এরকম খোলামেলাভাবে কখনো কিছু বলে না। সেটা তার স্বভাববিরুদ্ধ। জহির অবাক আর রোমাঞ্চিত হয়। কল্পনায় সে মুনার স্তনের উপরিভাগে তিলের অবস্থান বোঝার চেষ্টা করে।
জহির অধৈর্য হয়ে উঠেছে। সে বলে উঠলো, ‘তোমার সঙ্গে এখনো দেখাই হলো না। আজকে দেখা করি।’
মুনা বললো, ‘না, আজ না। পরে।’
আরো একদিন জহির মুনাকে দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠে। মুনা তখন বললো, এর মধ্যে একদিন সে আসবে দেখা করার জন্য। জহির বলেছিলো, সে তার অফিসে গিয়ে দেখা করতে পারে। মুনা রাজি হয়নি। আর জহির চোরের মতো পালিয়ে মুনাকে দেখার বিষয়টি অরুচিকর এবং অপমানকর মনে করে। মুনা নিজের থেকে যেতে না বললে সে কী করে যায়?
মোবারকের সঙ্গে দেখা হলে সে প্রায়ই বলে, ‘আপনি যান, গিয়ে দেখা করেন। মেয়েরা একটু ওরকমই হয়।’
জহির নিজেকে যেটুকু জানে তাতে সে বুঝতে পারে এ-কাজটাই সে কখনো করবে না। এজন্যে একই শহরে বাস করে দীর্ঘ প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও তার সঙ্গে মুনার দেখা হলো না।
কিন্তু কথা থেমে নেই। মুনা ফোন করে বাসায়, জিজ্ঞেস করে, ‘মা কেমন আছেন?’
: ‘ভালো না, প্রেসার বেড়েছে।’
: ‘ডাক্তার দেখিয়েছেন?’
: ‘না, এখনো ডাক্তার ডাকা হয় নাই।’
: ‘আমার মনে হয় এখনই ডাক্তার দেখানো উচিত; কারণ তার ফলে ওনার মধ্যে এক ধরনের আস্থার সৃষ্টি হবে, যেটা ওনাকে মানসিকভাবে ভালো থাকার জন্য যথেষ্ট সহায়ক হবে।… তিনি নির্ভরতা খুঁজে পাবেন, জানবেন চিকিৎসা শুরু হয়েছে… যেটা খুব জরুরি….।’ মুনা থেমে থেমে সময় নিয়ে বুঝিয়ে বললো।
কথাগুলো শুনে জহির যেন মুনাকে নতুনভাবে আবিষ্কার করে। এই জানা বিষয়গুলো মুনা কত সহজে আবার তাকে মনে করিয়ে দিলো।
বস্ত্তত জহির সারাক্ষণ নিজের অভাববোধ নিয়ে একপেশে অনুভূতিতে আচ্ছন্ন থাকে। সে মুনার বুদ্ধিমত্তার তারিফ না করে পারে না। এমনকি মানুষের আচার-আচরণে সংযমী হয়ে ভদ্রতা বজায় রাখা অথবা কী বলা উচিত আর কী বলা উচিত নয়, কী করা উচিত আর কী করা উচিত নয় এসব বিষয় এই বয়সে এসেও সে নতুনভাবে শিখতে শুরু করেছে। যেমন কেউ যদি নিজের থেকে কিছু বলতে না চায় তাহলে তাকে সেটা বলানোর জন্য চাপ দেওয়া। জহিরের এ-অভ্যাসটি আছে।
মুনার সঙ্গে ফোনে কথা বলার সময় বলা যেতে পারে, জহিরের অনেক বিষয়ে তার নিজের আচরণ অথবা চিন্তা-ভাবনায় লেগে থাকা ভুলগুলো যেন ধীরে ধীরে খসে পড়তে থাকে। এসব কারণে জহির তার নাম দিয়েছে ‘দার্শনিক’।
বিভিন্ন সময়ে নিজের বাবার কথা বলতে গিয়ে মুনা তার কাছে বাবা সম্পর্কে একটা ব্যাপক ধারণা তৈরি করেছে। তার মতে বাবা হবেন সন্তানের কাছে এমন একজন আদর্শ ব্যক্তিত্ব, যার চরিত্র হবে কালিমামুক্ত। যিনি উদার, সাহসী আর সুউচ্চ নির্ভরতার প্রতীক; যেখানে সন্তান পরম নিরাপত্তায় নির্বিঘ্নে সুস্থ-স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠতে পারবে।
জহির মুনার কথাগুলোর সঙ্গে বাবা হিসেবে নিজেকে মেলাতে চেষ্টা করে; কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই তার কাছে ঘাটতি পরিলক্ষিত হলো। তখন অয়নের কাছে নিজেকে অপরাধী মনে হয় তার।
তবে এসবের মধ্যেও সব বিবেচনার ঊর্ধ্বে উঠে জহির এখন মুনাকে নিয়ে নতুন করে সংসারের স্বপ্ন সাজাতে সচেষ্ট হয়। তাকে নিয়ে বিছানায় পাশে শোয়ায়, সারারাত কথা বলে। পিঠ চুলকিয়ে দিতে চায়। তার বুকের তিলটা খোঁজে।
অথবা কখনো মুনাকে নিয়ে আত্মীয়-স্বজন বা বন্ধু-বান্ধবদের বাসায় যায়। তারা সবাই মুনার বুদ্ধিমত্তা আর ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ। এজন্যে জহির গর্ব অনুভব করে। আগের স্ত্রীর কথা এখন আর তার তেমন মনে পড়ে না।
রাতে এ-সময় নিশ্চয়ই মুনা নামাজ পড়ে, খাবার খেয়ে ‘বুদ্ধদেব বসু’ নিয়ে বসেছে অথবা টেলিভিশন দেখছে।
জহির টেলিফোনটা নিজের ঘরে নিয়ে মুনাকে ফোন করে। অয়ন তার ঘরে পড়াশোনা করছে। মা হয়তো নামাজ অথবা খবরের কাগজ পড়ছেন।
: ‘হ্যালো’।
: ‘হ্যাঁ, কেমন আছেন? এ কদিন কোনো খবর নাই যে।’
: ‘ভাবলাম তুমি ফোন করো নাকি দেখি। অবশেষে তুমি যখন করলেই না, তখন আমাকেই করতে হলো।’
: ‘আচ্ছা, ভালো কথা, আপনি তো সিটি ব্যাংকে আছেন, আপনার সঙ্গে টেলিটকঅলাদের কোনো যোগাযোগ আছে?’
: ‘কেন’?
: ‘আমার একটা সিম দরকার। ভাবি চেয়েছিলো, তাকে দেবো।’
: ‘আচ্ছা, চেষ্টা করে দেখবো।’
: ‘আপনি পেলে জানাইয়েন। আমি মাসুদকে দামটা দিয়ে আপনার অফিসে পাঠিয়ে ওটা কালেক্ট করবো।’
: ‘মাসুদ কেন? আমি নিজেই দিয়ে আসবো।’
: ‘না, মাসুদই যাবে ওটা আনতে।’
এরপর জহির আর কথা বাড়ায় না। সে জানে মুনা সেটা পছন্দ করবে না।
টেলিটক কোম্পানি যখন যাত্রা শুরু করে, তখন তার এক-একটা সিম যেন ছিলো সোনার হরিণ। বৃষ্টির মধ্যে মানুষ সারারাত লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও অনেকেই সিম পায়নি – এরকম একটা ছবি খবরের কাগজের প্রথম পাতায় দেখেছিলো সে। তখন দামও ছিল বেশ চড়া।
তো, ব্যাংকে চাকরি করার সুবাদে জহির একটা সিম জোগাড় করতে পারলো। যদিও এটা তার অবশ্যকরণীয় কাজ বলে সে বিবেচনা করেছিলো। এই সামান্য উপকারটুকু করতে না পারলে তবে আর কী?
মুনা তার কাছে কখনো কিছু চাওয়া তো দূরে থাক, জহির কোনো উপহার সামগ্রী মোবারকের মাধ্যমে অথবা ক্যুরিয়ারে পাঠাতে চাইলেও মুনার নিষেধাজ্ঞায় তা হয়ে ওঠে না।
তবে জহিরদের বাড়ি টাঙ্গাইলে এজন্যে মুনা শুধু একবার টাঙ্গাইলের নীল রঙের একটা শাড়ির কথা বলেছিলো। তাও ঠাট্টা করে।
সেদিন তারা অনেকক্ষণ কথা বলেছিলো। বাবা-মা-ভাইবোনদের কথা। মুনা বলেছিলো, তার বাবা ছিলেন বিশাল হৃদয়ের মানুষ। তিনি মুনাকে খুবই আদর করতেন। জহির তাকে বিস্তারিতভাবে বলেছিলো, কীভাবে তার বাবা মারা গেলেন এবং তাঁকে বাড়িতে নিয়ে এসে দাফন করা হলো।
বেশ কয়েক বছর আগে এক ভারতীয় ভদ্রলোক এখানে ইন্ডিয়ান হাইকমিশনে চাকরি করতেন। তাঁর নাম স্বাগত ঘোষ। তাঁর সঙ্গে জহিরের পরিচয় থেকে কিছুটা বন্ধুত্ব তৈরি হয়েছিলো। তিনি একদিন বললেন, তাঁর স্ত্রী টাঙ্গাইলের শাড়ির অনেক সুনাম শুনেছেন। এজন্যে তিনি তাঁর স্ত্রীর জন্য টাঙ্গাইলের শাড়ি কিনতে চান।
জহির বললো, এটা আর এমন কী? টাঙ্গাইল যেতে হলে তাদের গ্রাম ঘেঁষে সড়ক দিয়েই যেতে হবে। সেক্ষেত্রে, তারা উভয়ে পরিকল্পনা করলো, এক ছুটির দিনে সকালবেলা ঢাকা থেকে গাড়িতে যাত্রা শুরু করবে। জহিরের মা আছেন বাড়িতে। তারপর দুপুরে তাদের বাড়িতে খাওয়া-দাওয়া করে বিকেলের মধ্যে টাঙ্গাইল পৌঁছে যাবে তারা। তারপর শাড়ি কিনে সন্ধ্যার আগেই আবার ঢাকার উদ্দেশে রওনা দিতে পারবে।
যেই কথা সেই কাজ। জহির স্বাগতদাকে নিয়ে দুপুরের আগেই বাড়িতে পৌঁছালো। তারা বসেছিলো বাইরের উঠোনে একটা আমগাছের নিচে। একটু দূরেই বাঁধানো কবর। সেখানে বড় আরো একটা আমগাছ আর ছোট ছোট ফুলের চারা কবরের ভেতরের চারপাশ ঘিরে রেখেছে। সেটা দেখিয়ে স্বাগতদা জিজ্ঞেস করলেন, ‘ওটা কার কবর?’
জহির জবাব দিলো, ‘ওখানে দুটো কবর। একটা তার বাবার আরেকটা বাবার দাদির।’
সে একটু ব্যাখ্যা করে বললো, বাবার দাদি বাবাকে খুব ভালোবাসতেন। এজন্যে দাদির কবরের পাশেই তার বাবাকে সমাহিত করা হয়েছে।
স্বাগতদা একটু উসখুস করছিলেন। তিনি বললেন, ‘এতে বাড়ির ভেতরে ঢোকার জন্য জায়গাটা কমে গেলো না?’
: ‘হ্যাঁ, তবে অসুবিধা হয় না। আমরা তো ঘরের ভেতর দিয়েই ওপাশের উঠোনে যাওয়া-আসা করি।’
: ‘তবু, জায়গার অপচয় হলো না কী?’
শুনে জহির খুব বিচলিত ও অবাক হয়। তার আকাশ থেকে পড়ার মতো অবস্থা। স্বাগতদা বলেন কী! সে মনে মনে ভাবে, নিজের বাবাকে তারা সবাই কতটা আবেগ আর মমতায় ওখানে তাদের শোয়ার ঘরের এতো কাছে শুইয়ে রেখেছে; আর উনি কি-না বললেন, জায়গার অপচয় হয়েছে। আরে এই জায়গা তো আমরা বাবার কল্যাণেই পেয়েছি, নাকি?
স্বাগতদা জহিরের মনোভাব টের পান। যদিও তিনি জানেন, জহির শিক্ষিত লোক। সে কী বলছে এবং কেন বলছে – সেটা জহির বুঝতে পারবে।
তিনি বললেন, ‘দেখুন, সবচেয়ে বড় কথা হলো, কোনো প্রাণীরই মৃতদেহের জার্ম নষ্ট হয় না। এভাবে কবর দেওয়ায় সেই বডির জার্ম অক্সিজেন পায় বলে আর মরে না, জীবিত থাকে। তাই সবচেয়ে ভালো হলো পুড়িয়ে ফেলা।’
তখন জহির হো-হো করে হেসে ওঠে – ‘সেজন্যে তো এক এক ধর্মে এক এক বিধান আছে।’
: ‘সেটা আছে, কিন্তু এর বায়োলজিক্যাল আসপেক্ট উড়িয়ে দেওয়া যায় না।’
কথাটা জহির একেবারে নাকচ করে না দিলেও সে একটা সাময়িক ধন্ধের মধ্যে পড়ে।
যাহোক, দুপুরের আহারের পর বিকেলে তারা টাঙ্গাইল শহরে পৌঁছে শাড়ি, মিষ্টি এসব কিনে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দিলো।
দীর্ঘক্ষণ ধরে মুনা জহিরের কাছ থেকে শাড়ি কেনার অভিযানের ইত্যাকার কথাগুলো মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনলো। তারপর বললো, ‘আপনার কাছে আমার একটা টাঙ্গাইলের শাড়ি পাওনা হয়ে গেছে, নীল রঙের।’
জহির বললো, ‘আচ্ছা ঠিক আছে; কিন্তু তোমাকে সেটা পৌঁছাবো কী করে?’
‘আমি নিজেই পৌঁছে যাবো’, মুনা অভয় দেয়।
আরেকদিন জহির বললো, ‘আচ্ছা আমার মনে হয় আমার অবস্থা সেই বানরটার মতো হয়েছে… একটা তৈলাক্ত পিচ্ছিল বাঁশ বেয়ে ওঠার চেষ্টা… উঠতে উঠতে আবার সুরুৎ করে নিচে নেমে আসে…। কবে তোমার ডাক পাবো। কবে দেখা হবে। তোমার সঙ্গে এই জীবনে আমার দেখা হবে কিনা কে জানে?’
শুনে মুনা হি-হি-হি করে অনেকক্ষণ ধরে হাসে। জহিরও হেসে ওঠে এরকম একটা তুলনা দেওয়ার জন্য।
একবার মুনা বললো, সে পুরুষ মানুষদের সিগারেট খাওয়া দেখতে পছন্দ করে। তার ভাবনাটা এরকম – সে সকালবেলা অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে। জহির এখনো বিছানায় আধশোয়া হয়ে আয়েশ করে সিগারেট খাচ্ছে। মুনা ড্রেসিংটেবিলের সামনে হাল্কা প্রসাধন সেরে নিচ্ছে। লিপস্টিক লাগানোর পর জহির উঠে এসে তাকে আলতোভাবে জড়িয়ে ধরে ঠোঁটে একটা চুম্বন এঁকে দিলো।
এসব শুনে জহিরের বুকের ভিতরে ঝড় ওঠে। উত্তেজনায় তার শরীর কাঁপতে থাকে।
ঈদের দিন বিকেলবেলা। জহির মোহাম্মদপুর থেকে মালিবাগ এসেছে এক আত্মীয়ের বাসায়। সে ভেবেছে ঈদের দিন বলে কথা আর এতো কাছাকাছি যখন এসেছে তখন নিশ্চয়ই আজ মুনার সঙ্গে দেখা হবে। তাছাড়া গত রাতে ঈদ মোবারক জানানোর সময় মুনা এতো মৃদু মধুর আর গভীরভাবে তাকে উইশ করলো, যেন মুনা তার সামনেই দাঁড়িয়ে হাত দিয়ে তার বুকের জামা খামচে ধরেছে আর তার নতমুখী মুখটা খুব কাছে, যে-মুখের একটা অবয়ব ইতোমধ্যে জহিরের মনের মধ্যে আবছাভাবে তৈরি হয়েছে। দূরে কোথাও বিদ্যমান আমেজের প্রেক্ষাপটে সম্পূর্ণ বেমানান ‘রূপবান’ সিনেমার গান বাজছে। কিন্তু সেই গানটাই জহিরের কানে এখন অবিশ্বাস্যভাবে খুব তাৎপর্যপূর্ণ এবং রোমান্টিক মনে হলো। সে দুরুদুরু বক্ষে মুনাকে ফোন করে জানালো : সে মালিবাগ এসেছে। মুনা বেশ গম্ভীর, সে বললো, ‘আচ্ছা পরে কথা বলবো। এখন আমি একটু বেরুচ্ছি…।’
জহির তখন কী হয়েছে বা মুনা কোথায় যাচ্ছে – এসব বিষয়ে প্রশ্ন করার সাহস পেলো না। মুনা তাহলে মাইন্ড করবে।
মুনাকে কখনো কখনো এরকম একটু অচেনা মনে হয় জহিরের কাছে। যদিও দেখা না হলেও দীর্ঘদিন কথা বলার কারণে তার মনোজগতের বিষয়গুলো জহিরের কাছে এখন অনেকটাই বইয়ের খোলা পাতার মতো স্পষ্ট। তবু একজন মানুষ কি আর একজনকে সবটা পুরোপুরি বুঝতে পারে? জহিরের মনে হয় মানব-মানবীর সম্পর্কের ক্ষেত্রে কিছু অস্পষ্টতা থাকবেই। সেই অন্তর্গত আড়াল চিরজীবন একসঙ্গে বাস করেও অতিক্রম করা যায় না।
অফিসে মুনা খুব ব্যস্ত থাকে। বাসায় তার ল্যান্ড ফোন এনগেজ্ড পেলো জহির। সে মোবাইলে ফোন করলো। মুনা ফোনটা রিসিভ করে বললো, ‘একটু ধরেন।’
মুনা বরাবরই তাকে আপনি বলে। সে ‘তুমি’ বলতে বলেছিলো। মুনা শোনেনি।
জহির শুনতে পেলো, মুনা ব্যাকুলভাবে অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে কাকে যেন বলছে, ‘ও আচ্ছা, এখন গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছেন… বাসা থেকে বেরুলেন… ঠিক আছে আমি পরে ফোন করবো। খুব সাবধানে ড্রাইভ করবেন, কেমন?’ শেষদিকে মুনার কণ্ঠে আকুতি ফুটে উঠলো।
তখন ওপাশ থেকে কী যেন শুনলো মুনা। সে-সময় তার সেই নিজেকে উজাড় করা হাসি। ওই হাসিটা জহির মনে করে শুধু তার নিজের। এখানে অন্য কারো অধিকার নেই।
অভিমান আর সংশয়ে কাতর জহির জিজ্ঞেস না করে পারলো না, ‘কার সঙ্গে কথা বলছিলে?’
: ‘ও আচ্ছা, ফিরোজ সাহেবের সঙ্গে।’
: ‘ফিরোজ সাহেব আবার কে?’
: ‘ওকে আপনি চিনবেন না। খুব স্মার্ট আর ভদ্র। আমার বসের বিজনেস পার্টনার। প্রায়ই আসে অফিসে।’
জহিরের কাছে মুনাকে কেমন অনেক দূরের আর রহস্যময় মনে হলো। তাকে বুঝতে তার কষ্ট হচ্ছে। তার গলা শুকিয়ে এসেছে। সে জানতে চাইলো, ‘তার সঙ্গে এতো মিষ্টি করে কথা বললে…?’
মুনা যেন একটু অপমানিত আর বিরক্ত হলো। তারপর অবলীলায় বললো – ‘হ্যাঁ, তাতে কী হয়েছে… আপনার সঙ্গেও তো বলি… কী বলি না?’
জহিরের বুকের ভিতরটা লন্ডভন্ড হয়ে যায়। সে ভেঙে পড়তে থাকে নিজের মধ্যে। নিঃশব্দে তার চোখ ভরে ওঠে জলে।