আমার বাবার গায়ের রঙ ধবধবে ফর্সা। এই নিয়ে তার প্রকাশ্য গর্ব আছে। আমার ছোট চাচা ম্যাট্রিকে (!) খুব ভালো ফল করলেন। বাবা নাকি মুখ বাঁকিয়ে বলেছিলেন – ঘরে বসে তো সারাদিন পড়তেই দেখলাম গায়ের রঙের তো কোন হেরফের দেখলাম না। যেই শ্যামলা আছিল সেই শ্যামলাই টেনেটুনেও ফর্সা বলা যায় না। বাবা আমার খেতে পছন্দ করেন। উনার পছন্দের তালিকায় প্রথমেই রয়েছে বড় মাছের পেটি। খুব অল্প ভাত দিয়ে উনি প্লেটের এপাড় ওপাড় বয়ে যাওয়া পেটি দিয়ে ভাত খাওয়া যখন শুরু করেন, মনে হয় তার চেয়ে সুখী এই পৃথিবীতে কেউ নেই। যে খেতে পছন্দ করে সে খাওয়াতেও পছন্দ করে। আমার বোনেরা যে যেখানেই থাকুক বাসায় এলে আমাদের বাড়িতে ঈদ লেগে যায়। খাওয়া, হইচই, গান এটা আমাদের নিত্যসঙ্গী।
এখন সবাই যদিও ঢাকা কেন্দ্রিক হয়ে গেছে। তবুও ঈদ পালা পার্বণে সবাই বাড়ি আসতেই পছন্দ করে। সেই ছোট্টবেলা থেকে আমার আব্বু চাঁদ রাতে পিকনিক করেন। আব্বু ছাত্র থাকা অবস্থায় সেই পিকনিক ছিল ভয়াবহ রকমের। মাইক টাইক এনে সবার কানের পর্দা ফাঁটিয়ে যাচ্ছেতাই অবস্থা। আমার দাদা যত বকেন উনি ততবার মাইকের মুখ ঘুড়িয়ে দেন কিন্তু গান বন্ধ করেন না। রাত বারোটার পর থেকে উনারা ( আব্বু ও তার বন্ধুরা) নিজেদের প্রতিভার বিকাশ ঘটান। মানে নিজেরাই গান গাইতে থাকেন। এভাবে চলে রাত দুটো তিনটে পর্যন্ত। সেবারে দাদার কাছে ১০০ টাকা চাঁদা চেয়েছিলেন। দাদা দিয়েছিল ১০ টাকা। তারঃস্বরে মাইক বাজছে।
কারো ঘুমানোর উপায় নেই। অবস্থা বেগতিক দেখে দাদিয়া দাদাকে বললেন – আপনার ফর্সা গরুটাকে থামান। এখন পুরা এলাকার মানুষ নালিশ নিয়ে আসবো। দুইএকবার বড় চাচ্চুও না করলেন তবু গান থামাথামির কোন কারবার নেই। অবশেষে দাদা রাত একটায় আব্বুকে ডেকে বললেন ‘বাপজান মাইক বাজানোর জন্য ১০০ টাকা চাইছিলা না? এই নাও ১০০ টাকা এইবার মাইক বন্ধ করো। আব্বু মাথা নিচু করে বললেন, ‘ মাইক বন্ধ করতে ১৫০ লাগবে আব্বা দরাদরি চলবে না। বহুত কষ্টে ১১৫ টাকায় রফা হলো। রাত দুটোয় তার গানের মাইক বন্ধ হলো। এলাকাবাসী শান্তিতে ঘুমাতে গেল। এলাকাবাসী ঘুমালে কী হবে আমাদের বাসায় তো ঘুম থেকে উঠেই বড় আম্মা আর দাদির চিল্লামিল্লি। কী হয়েছে? ঈদের জন্য আগের দিন বেঁটে রাখা কোন মশলা নেই। কে যেন ফ্রিজ থেকে চুরি করেছে। বড় আম্মা ঠিক বুঝে ফেললেন এটা কার কাজ।
আব্বুর কান ধরে তুলে বললেন – এত্তো এত্তো মশলা সব গেলো কই? আরে সব নিয়েছি না-কি? অল্পসল্প নিয়ে আবার নর্মাল ফ্রিজে রেখে দিয়েছি। কী সব বাটাও তোমরা কোনটা আদা, কোনটা, রসুন কে জানে? জিড়া না গরমমসলা কিছুই বুঝি না। এরপর থেকে মশলার বাটির উপরে কাগজ দিয়ে লিখে রাখবে। বড়মা কী তখন সেখানে আছেন? তার সাধের মশলা নরমাল ফ্রিজে সেমাইয়ের বাটির পাশে রেখে কোন সর্বনাশ করেছেন দেখতে দৌঁড়ে চলে গেছেন। আগেও বলেছি আমার বাবা গান পাগল মানুষ। ভালো গান হচ্ছে শুনলে সেখানে যাবেনই যাবেন। নিজেও গাইবেন। পরিস্থিতি অনুযায়ী গান গাওয়াতে উনার জুড়ি নেই। কয়েকটি উদাহরণ দিচ্ছি। আমাদের পাশের বাসার এক ফুপু আছেন নাম চুমকি। দেখতে খুবই সুন্দরী। শহরের সব ছেলেদের হৃদয় ভেঙ্গে দিয়ে উনি এক প্রবাসীকে বিয়ে করেন।
প্রবাসী বিয়ের দুমাস পরে চলে গেলো ফিরে এলো চার বছর পরে, সাথে বউ আর দুই বাচ্চা। এদিকে বেচারি চুমকি ফুপুতো বড়লোক স্বামীর অহংকারে দিনরাত সাজগোজ করে থাকতেন। স্বামী নিতে এলে তিনি ঝাড়ুপেটা করে তাকে বিদেয় করলেন। কার দোষ জানি না, তবে উনি স্বামীর নাম শুনলেও রেগে যান। উনি ঈদ আসলেই বাচ্চা মেয়েদের মতো সেজেগুজে সবার কাছ থেকে সালামি চান। আব্বুর কাছে সালামি চাইলেই আব্বু বলেন – চুমকি শোন, আমি ১৫ বছরের উর্ধে কাউকে সালামি দেই না। আসছো যখন একটা গান শোন। ‘চুমকি চলেছে একা পথে, সঙ্গী হলে দোষ কী তাতে ভয় পেও না সুন্দরী গো। ‘ এটুকু বলেই আর দেরি করেন না জায়গা ছেড়ে উঠে দৌঁড় লাগান। একদিন আম্মার সাথে তার ভীষণ ঝগড়া লেগেছে। ঝগড়ার কারণ আব্বু রাস্তায় একজনকে শার্ট খুলে দিয়ে বাসায় খালি গায়ে ফিরে এসেছে। আম্মা বারেবারে চোখের পানি মুছছে আর বলছে ‘ তুমি কী মনে করে সবার সামনে দিয়ে খালি গায়ে ফিরলা! সবাই কী ভাবলো? আব্বু চুপচাপ শুনলেন।
রাতে দেখি আম্মা শুয়ে আছে। আব্বু বিছানায় আম্মুর পাশে আমাদের বাড়ির দলিল রেখে, বারান্দায় বসে গান গাইছে। ‘ আমার রাত জাগা তারা, তোমার আকাশ ছোঁয়া বাড়ি, আমি পাই না শুতে বিছানায়, আমার একলা লাগে ভারি। ‘ ( বি দ্র – আমাদের বাড়ি আম্মুর নামে ) বুঝুন অবস্থা। আমার আর হৃদির মাঝে ছোটবেলায় পার্থক্য করা একটু কঠিন ছিল, সবাই ভাবতো টুইন আমরা। আমরা কেউ যদি আব্বুর চোখ চেপে ধরতাম, সাথে সাথে আব্বু গাইতেন – ‘ তুমি যে আমার কবিতা। আমার বাঁশির রাগিণী। আমারই স্বপন আধো জাগরণ, চিরদিন তোমারে চিনি। আমার আব্বু খুব ভালো শিকারি। সেই ছেলেবেলা থেকে আমাদের বন্দুক, রাইফেল এসব চালানো শিখিয়েছেন। নদীতে নৌকায় সবাই শিকারে যাচ্ছি।
আমার কোমড়ে থাকতো গুলির বেল্ট। আব্বু আমাদের শিখিয়েছেন কখন কোন পয়েন্টে গুলি করতে হয়। এখন অসুস্থ হবার কারণে অবশ্য শিকার বন্ধ আছে। একদিন আব্বু রাজশাহীর এক অফিসে গিয়েছেন কী একটা কাজে। রাস্তা দিয়ে দুটি মেয়ে হেঁটে যাচ্ছে। সবাই এক পলক হলেও দেখছে তাদের। আব্বুকে একজন বলছে আপনি দেখলেন না? আব্বু হেসে উত্তর দিলেন – ‘না আমার দেখবার দরকার নেই। এরচেয়ে অনেক সুন্দরী তিনজন মেয়ে প্রতিদিন আমার অপেক্ষায় থাকে। সবাইতো অবাক। বলেন কি তিনজন? ‘ হুম তিনজন, আমার দুই কন্যা আর তাদের মা, মানে আমার স্ত্রী, এই নিয়ে তিনজন। আমার চোখে এরাই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুন্দর। অন্যের মেয়ের দিকে তাকানোর আমার সময় আছে কি?
সব মিলিয়ে এই হচ্ছেন আমার বাবা, সর্বক্ষণ চা খান। সিগারেটও বাদ যায় না। একটু জ্বর হলেই বাড়ি তোলপাড় করেন। কারো বিপদ শুনলে ঘরের শেষ টাকাটিও দিয়ে আসতে এক মুহূর্ত দ্বিধা করেন না। আজ আমার আব্বুর জন্মদিন। সবাই আমার আব্বুর জন্য দোয়া করবেন। আর হ্যাঁ – আমি তাকে সকালে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আব্বু এবার তোমার কততম জন্মদিন? উনি হাসতে হাসতে বললেন – মাগো আমি ছাব্বিশে আঁটকে আছি আজ ছাব্বিশ বছর। বাবাদের বয়স জিজ্ঞেস করতে নেই।
গল্পের বিষয়:
গল্প