আফসানা খানম কাঁদছেন।
সাত মাস ধরে তিনি নিয়মিত কাঁদছেন। না, তার কান্না কেউ শুনতে পাচ্ছে না। মনের ভেতরে গুমরে গুমরে কাঁদছেন। না কেঁদে উপায় কী? তার চারদিকে ভীষণ বিপদ। একমাত্র ছেলে বাড়ি নেই। স্বামী কোথায় আছে, কেমন আছে জানেন না। আদৌ বেঁচে আছে কি-না…। আর ভাবতে চাইছেন না। কিন্তু কোত্থেকে ভাবনা আর মনকান্না এসে সমগ্র দেহটাকে বিবশ করে ফেলছে।
মাত্র কয়েক মাসে চিরপরিচিত দেশটা কেমন অপরিচিত হয়ে গেল! পাশের বাড়ির মানুষকেও বিশ্বাস করা যায় না। তাকায় বিষচোখে। চোখ তো নয়, যেন অগ্নিশলাকা। একবার গেঁথে গেলে ভেতরের কলিজা এফোঁড়-ওফোঁড় করে দেবে। বাসায় কোনো বাজার নেই। কারেন্ট এই থাকে তো সেই থাকে না। নিজে বাজারে যেতে ভয় পান আফসানা খানম। ওখানেও যে-কোনো সময়ে চলে আসতে পারে মৃত্যুদানব। ওদের মাত্র একটা শব্দ, ফায়ার…। ব্যস, নিমিষ মাত্র, ঝাঁকঝাঁক বুলেট এসে সুন্দর শরীরটাকে গেঁথে ফেলবে। আর বুলেটের গ্রাস নিয়ে শরীর লুটিয়ে পড়বে নিজেদের মাটির ওপর। নিজেদের মাটি – অথচ বলার কোনো অধিকার নেই।
মাটি এখন দখলদারদের দখলে।
পত্রিকায় পড়েছেন, জেনারেল নিয়াজি ঘোষণা দিয়েছে, পূর্ব পাকিস্তানে সে বাঙালি চায় না, চায় মাটি। দাঁতে দাঁত ঘষেন আফসানা খানম অসহায় আক্রোশে – নমরুদ, ওরা নমরুদ। নিজের দেশের মানুষের ওপর এমন অত্যাচার করো, তোরা কী মায়ের পেটে জন্মাস নাই? তোরা নাকি মুসলমান? মুসলমান হলে নিজের দেশের মুসলমানদের ওপর এমন গজব নামাও কেমনে? ইবলিশ। মোনাফেক… আফসানা খানম নিজের মনে কথা বলতে বলতে সামনের ঘর থেকে রান্নাঘরে এলেন। না, চুলোয় কিছুই নেই। তিনি ফ্রিজ থেকে দুটো ডিম বের করে ছোট পাতিলে পানি দিয়ে চুলোয় দিলেন।
রাত এখন, প্রতি রাতে আফসানা খানম কিছু না কিছু রান্না করে রাখেন। খেতে পারেন না। খেতে গেলে বমি আসে। গলা ফুলে ওঠে। আসলে নিজে খাবার জন্য রান্না করেন না। তার মনে হয়, রাতের যে-কোনো সময়ে খোকন, কিংবা খোকনের বাবা আলী আমজাদ আসতে পারে। যদি আসে, নিশ্চয়ই পেটে খিদে থাকবে। চাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যাতে খাবার দিতে পারেন, সেই প্রস্ত্ততি নিয়ে রাখেন। তরিতরকারিও পাওয়া যাচ্ছে না। মাছ মাঝেমধ্যে সামান্য কিছু মেলে কিন্তু দাম বেশ চড়া। চড়া হবে না, কে এই মুমূর্ষু সময়ে মাছ ধরতে নামে খালে, বিলে, নদীতে কিংবা পুকুরে? জীবনের খুব দায় না হলে মাছ আজকাল কেউ ধরে না। তারপরও আফসানা খানম যেভাবেই হোক রান্নার আয়োজন করেন। সকালে উঠে দোতলা বাড়ির ছাদে রেখে আসেন। কাক সব খাবার একবারে সাফ-সুতরো করে খায়।
আলী আমজাদ অফিসে যেতে চাননি। সকালে উঠে দাঁত ব্রাশ করতে করতে বলেছেন – আমি অফিসে যাবো না।
কেন?
আমার ভয় লাগে। যেতে যেতে শালাদের অন্তত পাঁচ-ছয়বার ডান্ডি কার্ড দেখাতে হয়।
দেখাতে হলে দেখাও। অসুবিধা কী?
তুমি বুঝবে না। এই ডান্ডি কার্ড দেখানোও একটা সূক্ষ্ম অপমান।
আফসানা খানম অবাক চোখে তাকিয়ে থাকেন। বেসিনে হাত-মুখ ধুয়ে তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে আলী আমজাদ বসেন টেবিলে – তুমি আমার কথা বুঝতে পারোনি বোধহয়। পাকিস্তানি হার্মাদগুলো প্রতিদিন আমাকে দেখে, আমার আইডেন্টিটি কার্ড দেখে। জানে, আমি পাকিস্তান সরকারের একজন সেবক। তারপরও কেন প্রতিদিন আমাকে কার্ড বের করতে হয়? বের করিয়ে আমাকে কার্ড দেখাতে বাধ্য করে ওরা প্রমাণ করে, তুমি যে-ই হও, যতই পাকিস্তান সরকারের চাকরি করো, আসলে তুমি বাঙালি। তুমি জয় বাংলার লোক। তোমাকে বিশ্বাস করা যায় না।
বুঝলাম, ওরা তোমাকে অপমান করছে কিন্তু অফিসে না গেলে – থেমে যান আফসানা খানম।
অফিসে না গেলে, কী?
তোমার ছেলেকে ধরে নিয়ে যাবে, ভুলে গেলে?
দুম করে টেবিলের ওপর থাপ্পড় বসিয়ে দেন আলী আমজাদ – আমি যাবো না, যাবো না। থাপ্পড়ে টেবিলের ওপরের থালা-বাটি, গ্লাস নিচে পড়ে ভেঙে টুকরো-টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। আর আলী আমজাদ টেবিলে মাথা রেখে ডুকরে কাঁদতে শুরু করেন। তাগড়া স্বাস্থ্যের আলী আমজাদের শরীর কান্নার দমকে কেঁপে কেঁপে উঠছে। আফসানা খানম তার স্বামীকে এই প্রথম কাঁদতে দেখছেন। তিনিও কাঁদতে শুরু করেন। আসলে তিনি কাঁদতে চাননি। নিজেকে পাথরের মতো শক্ত করতে চান, কিন্তু পারেন না। কোত্থেকে কান্না এসে জড়িয়ে ধরে, না কেঁদে পারেন না। আফসানার মনে হচ্ছে চারপাশটা দেয়ালে মুড়ে দেওয়া হয়েছে।
দরজা খুলে বের হয়ে আসে খোকন। বাবা ও মাকে কাঁদতে দেখে অবাক তাকায়। কাছে এসে দাঁড়ায় – তোমাদের কী হয়েছে?
কিছু না, তুমি তোমার ঘরে যাও – বলেন আফসানা।
কিন্তু তোমরা কাঁদছ কেন? ওরা কী আবার এসেছে?
না।
তাহলে?
তোর বাবা অফিসে যেতে চায় না।
খোকন বাবার দিকে তাকায়। আলী আমজাদ নিজেকে সামলে নিয়ে দাঁড়ান। চোখে চোখ পড়ে পিতা ও পুত্রের। খোকন দৃষ্টি অন্যদিকে ফিরিয়ে নেয়। আলী আমজাদ শোবার ঘরে চলে যান। সময়টা তীক্ষ্ণ তীরের মতো মা ও পুত্রের মধ্যে গেঁথে থাকে।
মা, আমাকে খেতে দাও। খোকন নিজের রুমে চলে যায়। আফসানা খানম রান্নাঘরে ঢোকেন। নাস্তা বানাতে শুরু করলেন। কাজের মেয়ে রোমেলা তিনদিন আসছে। কী হয়েছে কে জানে? রোমেলার কাছে শুনছেন, বস্তির ওপর ওদের চোখ আছে। কারণ বস্তির লোকদের মধ্যে জয়বাংলার সমর্থক বেশি। গুলিস্তানের কাছে রেললাইনের পাশের বস্তিতে আগুন দিয়েছে সৈন্যরা, গত শুক্রবার দুপুরে। ছেলে বুড়ো বাচ্চা-কাচ্চা যারাই বের হয়ে এসেছে সামনে পজিশন নিয়ে থাকা সৈন্যরা গুলি করে হত্যা করেছে। লাশগুলো দাফনও করতে দেয়নি। এক পাকিস্তানি মেজর এসে প্রত্যেক লাশের ওপর হাসতে হাসতে প্রস্রাব করেছে। প্রস্রাব করতে করতে বলেছে – পবিত্র পাকিস্তানি মেজরের প্রস্রাবের কারণে এই মালাউনরা বেহেশতে চলে যাবে।
রোমেলারা থাকে কলাবাগানের কাছেই। বাসা থেকে ওদের বস্তি দশ মিনিটের পথ। আসছে না কেন? ওর জামাই নাকি জয়বাংলার মানুষ। এই দেশে কে জয়বাংলার লোক না? অল্প কয়েকজন কুলাঙ্গার ছাড়া; কিন্তু অস্ত্রের মুখে কেউ কোনো কথা বলতে পারছে না।
খোকন আর শেখ জামাল এক স্কুলে এক ক্লাসে পড়েছে। কলাবাগান আর বত্রিশ নম্বর তো গলাগলি। ছোটবেলা থেকে একসঙ্গে বড় হয়েছে। শেখ মুজিবের সঙ্গে কত দেখা হয়েছে। রেণু ভাবির হাতে কত খাবার খেয়েছে। মিছিলে স্লোগানে জামাল আর খোকন কত ঘনিষ্ঠভাবে মিশেছে। সারাটা মার্চ মাস পাড়ার ছেলেরা মিলে পতাকা উড়িয়েছে। চারদিকে নানা প্রশ্ন ভয় দ্বিধা সন্দেহ থাকলেও পঁচিশে মার্চ রাতে নেমে এলো কেয়ামত। বত্রিশ নম্বর নয়, কলাবাগান নয়, সারা ঢাকা, সমগ্র দেশ ঢেকে গেছে শ্বাপদের কালো থাবায়। শেষ মার্চে ঢাকা শহর কোথায় যেন পালিয়ে গিয়েছিল। কোথাও মানুষের সাড়া পাওয়া যাচ্ছিল না। কয়েক দিনের মধ্যে শহরটা মৃত মানুষের শহরে পরিণত হয়েছে। অথচ এই শহর কয়েকদিন আগেও কেঁপে উঠত স্লোগানে, মিছিলে…।
এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহেই সকালে, এই রকম সকালে দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। অফিসে যাওয়ার জন্য প্রস্ত্তত হচ্ছেন আলী আমজাদ। তিনিই দরজা খোলেন। সামনে দাঁড়ানো পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন মমিন। পেছনে দশ-বারোজন সৈন্যের একটি দল। প্রত্যেকের মুখে টাটকা রক্তের বলক দেখতে পাচ্ছেন। ওদের দেখেই থরথর কেঁপে ওঠেন আলী আমজাদ।
তুমি আলী আমজাদ?
জি। আমিই আলী আমজাদ।
তোমার বাড়ি সার্চ করব।
কেন?
তোমার বাড়িতে গাদ্দার শেখ মুজিবের ছোট ছেলে লুকিয়ে আছে – বলতে বলতে আলী আমজাদকে ঠেলে ভেতরে ঢোকে সবাই। ভেতরের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছেন আফসানা খানম। বাড়িতে হঠাৎ পাকিস্তানি আর্মি দেখে তিনি হতভম্ব। তার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। পাকিস্তানিরা ঢুকে গেছে বাড়ির রুমে-রুমে। খোকনের ঘর থেকে কয়েকজন আর্মির চিৎকার ভেসে আসে। ক্যাপ্টেনের মুখে কিম্ভুত হাসি। খোকনকে প্রায় পাঁজাকোলে করে নিয়ে আসে আর্মিরা ড্রয়িংরুমে। একজন সেপাই খোকনের চুল ধরে ধাক্কা দেয় – স্যার, ইয়ে হ্যায় শেখ মুজিবকা লারকা।
না, আলী আমজাদ ভয়ে শুকিয়ে যাওয়া ঠোঁট চাটতে চাটতে জবাব দেয় – না না। ও আমার ছেলে। ওর নাম আলী সাজ্জাদ খোকন। আমি পাকিস্তান সরকারের একজন কর্মকর্তা। পকেট থেকে আইডেন্টিটি কার্ড বের করে দেখায়। ক্যাপ্টেন কার্ড হাতে নেয়, আলী আমজাদ, সেকশন অফিসার, তথ্য মন্ত্রণালয়, পূর্ব পাকিস্তান সচিবালয়, ঢাকা, পাকিস্তান। কার্ডে সিগনেচার করেছে কর্নেল শামস। কর্নেল সচিবালয়ের নিরাপত্তার দায়িত্বে। সন্তুষ্ট হয়ে কার্ড ফেরত দেয় ক্যাপ্টেন মমিন। তাকায় দেয়ালে। দেয়ালে টানানো রয়েছে পাকিস্তানের মোহাম্মদ আলি জিন্নাহর ছবি। ক্যাপ্টেন মমিন দোটানায় পড়ে – আমার কাছে খবর আছে, তোমার ছেলের সঙ্গে শেখ জামালের যোগাযোগ আছে।
এক পাড়ায় থাকলে তো থাকতেই পারে; কিন্তু পঁচিশে মার্চের পর আর কোনো যোগাযোগ নেই। শেখ জামাল কোথায় আমরা জানি না। আমি পাকিস্তান সরকারের এক পদস্থ অফিসার। আমি এবং আমার পরিবার কেন দেশের বিরুদ্ধে গিয়ে বিপদ ডেকে আনব? আমরা পাকিস্তানকে ভালোবাসি – ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির তুখোড় ছাত্র আলী আমজাদ চমৎকার ইংরেজিতে কথা বলেন।
বিভ্রান্তিতে পড়ে ক্যাপ্টেন মমিন, তাকায় নিজের সঙ্গে আসা সৈন্যদের দিকে। প্রত্যেকের চোখ-মুখ পাথর দিয়ে খোদাই করা, চৌকো মুখ।
ওকে, বলে ক্যাপ্টেন মমিন – আমি তোমাকে বিশ্বাস করলাম। কিন্তু প্রতিদিন অফিসে যাওয়ার সময়ে এবং আসার সময়ে তোমার এলাকায় আমার ক্যাম্পে এই কার্ড দেখিয়ে আসবে। যদি একদিন না দেখাও, তোমার এই ছেলেকে আমরা তুলে নিয়ে যাব। দরজার দিকে এগিয়ে আবার ফিরে তাকায় – পাকিস্তান সাচ্চা মুসলমানের দেশ। এই দেশে কোনো মালাউন থাকতে পারবে না। শেখ মুজিব আর তার লোকেরা পাকিস্তানের শত্রু। এই কথাটা মনে রাখবে মি. আলী আ…
আলী আমজাদ – নিজের নামটা নিজেই বলেন তিনি।
হ্যাঁ মি. আলী আমজাদ – বুটের তলায় গোটা বাড়িটা দলেমলে পিষে একাকার করে চলে যায় ক্যাপ্টেন মমিন এবং তার দল। ভয়ে-আতঙ্কে বরফের মতো শীতলতায় দাঁড়িয়ে থাকে তিনজন মানুষ – আলী আমজাদ, আফসানা খানম ও আলী সাজ্জাদ খোকন।
সেই সকাল থেকে বাড়িটার সব সুখ, আনন্দ, উচ্ছ্বাস হাওয়ায় উড়ে গেছে। বাড়িটার মধ্যে তিনজন মানুষ – রুটিনমতো কথা বলে, খায় আর কোনোভাবে ঘুমায়। এপ্রিলের মাঝামাঝি যখন শুনল প্রবাসী মুজিবনগর সরকার গঠন হয়েছে তাজউদ্দীন আর সৈয়দ নজরুল ইসলামের নেতৃত্বে, আলী আমজাদ খুশিতে পাগলের মতো ঘরের মধ্যে নাচতে থাকে আর বলে – এইবার এইবার ব্যাটারা বুঝবে, তাজউদ্দীন শেষ দেখে ছাড়বে…। আফসানা খানমও দারুণ খুশি। না, একটা সরকার যখন গঠন হয়েছে, নিশ্চয়ই একটা কিছু হবে। পাকিস্তানিরা এত সহজে পার পাবে না।
মসজিদে নামাজ পড়তে গেছে খোকন ওর বাবার সঙ্গে মে মাসের প্রথম শুক্রবার। নামাজ থেকে এসেই খোকন নিজের ঘরে ডাকে আফসানাকে – মা, একটু আমার ঘরে আসবে?
আফসানা ছেলের এই স্বর চেনেন। গুরুতর একটা কিছু ঘটলেই খোকনের গলার স্বরে আলাদা একটা টোন টের পান তিনি। ভাত বাড়ছিলেন, সব ফেলে ঢুকলেন ছেলের ঘরে। সঙ্গে সঙ্গে খোকন জড়িয়ে ধরে আফসানাকে – মা, তুমি না করতে পারবে না। বলো, তুমি না করবে না।
অবাক আফসানা খানম, অনেক কষ্টে ছেলের বেষ্টন থেকে নিজেকে মুক্ত করেন – কী হয়েছে আগে বলবি তো।
মা!
হ্যাঁ বল। এক অজানা আশঙ্কায় তার বুক কাঁপছে। কেন জানি মনে হচ্ছে ছেলে ভয়ংকর বিপদের কথা বলবে। নইলে এতক্ষণে বলে ফেলত – কী বলবি বল খোকন।
মা, আমি যুদ্ধে যাব। পাড়ার শামীমভাই, সোহেলভাই, দীপঙ্করদা, মজনুভাই সবাই চলে গেছে।
কোথায় গেছে?
ক্ষেপে ওঠে খোকন, তুমি জানো না বাঙালি ছেলেরা এখন কোথায় যায়? সবাই যুদ্ধে গেছে।
যুদ্ধটা হচ্ছে কোথায়? ঘরে ঢোকেন আলী আমজাদ।
– যুদ্ধ কোথাও এখন হচ্ছে না, যুদ্ধের জন্য ট্রেনিং দরকার। সেই ট্রেনিং নিতে সবাই ভারতে যাচ্ছে। ভারত সরকার বাংলাদেশের যোদ্ধাদের ট্রেনিং দিচ্ছে। আসামে, পশ্চিমবঙ্গে, আগরতলায়, ত্রিপুরায় – সব জায়গায় ট্রেনিং ক্যাম্প হয়েছে। হাজারো বাঙালি তরুণ ট্রেনিং নিচ্ছে। দুই-একদিনের মধ্যে আরো অনেকে যাবে, পা জড়িয়ে ধরে খোকন – আমাকে যেতে দেবে মা?
তোকে এসব কে বলল? প্রশ্ন করেন আমজাদ।
– আমার ক্লাসমেট রফিক।
– কখন বলল?
– আমরা যখন সিজদায় যাই, তখন আমাদের মধ্যে এসব কথা হয়েছে। আমরা এক সারিতে ছিলাম – আমি, রফিক, কিসলু, ফারুক।
বিস্মিত আফসানা খানম – তোমরা সিজদায় গিয়ে যুদ্ধের কথা বলেছ?
উপায় কী মা? একসঙ্গে দাঁড়িয়ে কথা বললে যদি ওরা সন্দেহ করে, তাই সিজদায় গিয়ে বলেছি। মা, আল্লাহ সব জানেন। দেশের জন্য যুদ্ধ করাও ইবাদত। এখন বলো – আমাকে যেতে দেবে?
তুমি যুদ্ধে গেলে আমি কী নিয়ে বাঁচব? আফসানা খানম আরো বলেন – বেশ তুমি যুদ্ধে যাবে, যাও। কিন্তু তোমার বাবা? তোমার যুদ্ধে যাওয়ার খবর চাপা থাকবে না। সঙ্গে সঙ্গে ওরা এসে এই লোকটাকে আমার চোখের সামনে থেকে ধরে নিয়ে যাবে। তখন আমার সবই যাবে। এখন তুমি যা ভালো মনে করো – তোমার ইচ্ছে।
আফসানা খানম নিজেকে সামলানোর জন্য খোকনের রুম থেকে চলে আসেন। পেছনে পেছনে আসেন আলী আমজাদ। খোকন একা বসে থাকে, ভাবে – মা ঠিক বলেছে। আমি যুদ্ধে গেলে বাবাকে ওরা নিয়ে যাবে। হয়তো মেরে রাস্তার ধারে ফেলে রাখবে। বাবার শরীর কুকুরে খাবে, শিয়ালে খাবে। মা সব হারিয়ে পাগল হয়ে যাবেন; কিন্তু দেশের জন্য যুদ্ধ করার সুযোগ কী আর আসবে?
পরের শুক্রবার মসজিদে যায় না খোকন। রফিকের সঙ্গে কথা হয়েছিল – সব ঠিক করে এই শুক্রবারে নামাজের সময়ে কখন কোথায় কীভাবে যেতে হবে, জানা যাবে। কিন্তু খোকন অভিমানে বাসায় বসে থাকে। ডায়েরি লেখে। জানালায় দাঁড়িয়ে আকাশ দেখে আর নিঃশব্দে কাঁদে। কবিতা লেখে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা। রাতে মা-বাবা মিলে খুব অল্প ভলিউমে শোনে স্বাধীন বাংলা বেতার। মে মাসের একদিন অফিস থেকে এসে আফসানা খানম আর খোকনকে ডেকে আলী আমজাদ তোতলাতে তোতলাতে বলেন – খেইল শুরু হয়ে গেছে।
– কী শুরু হয়েছে?
উত্তেজনায় টগবগ ফুটছে আলী আমজাদ – যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে।
টচজলদি প্রশ্ন করেন আফসানা – তোমাকে কে বলল?
– অফিসে শুনেছি। আরো শুনলাম, গতকাল হোটেল কন্টিনেন্টালে গেরিলারা আক্রমণ করে তিনজন পাকিস্তানি সৈন্য হত্যা করেছে – এমনভাবে বলছে আর হাত ছুড়ছে আমজাদ, মনে হচ্ছে গেরিলা দলের হয়ে গ্রেনেড সে-ই ছুড়েছে। হাসে আফসানা খানম। খেয়াল করে না আমজাদ – দেখো তো কী সাহস? বলে কি-না বাঙালিরা ভীতু জাতি? এখন বুঝবে ঠেলা, কাকে বলে বাঙালি! আর শোনো, গেরিলারা নাকি ঝাঁকে ঝাঁকে দেশের ভেতরে ঢুকতেছে।
কে বলল? জানতে চায় খোকন।
– অফিসের লোকেরা বলাবলি করছে।
গেরিলা আক্রমণের সংবাদে খোকনের মন আরো খারাপ। সেইসঙ্গে নিজের ওপর প্রচন্ড রাগ হচ্ছে। কারা ছিল রক্ত টগবগ করা অসম সাহসী এই অপারেশনে? এই গেরিলা অপারেশনে সেও তো থাকতে পারত। কিন্তু পারল না, ইচ্ছা করলেই যেতে পারত। কিন্তু – ক্রোধে শরীর কাঁপছে খোকনের। সামনের রুমে এসে জিন্নার ছবিটা নামিয়ে থুতু দিয়ে আবার টানিয়ে রাখে। আশ্চর্য, খোকনের রাগ অনেক কমে গেছে। ভাবছে, এখন থেকে রাগ হলে জিন্নার ছবিটায় এসে থু-থু দেবে।
বাইশ মে বিকেল তিনটার পরও বাসায় আসেন না আলী আমজাদ। এমনিতে আলী আমজাদ খুব সময় মেনে চলেন। যুদ্ধের এই সময়টায় আরো মেনে চলেন। ঠিক সময়ে অফিসে যান, ফেরেনও ঠিক সময়ে। সকাল আটটায় অফিস শুরু, ছুটি দুটোয়। ঠিক আড়াইটায় বাসায় ফেরেন আমজাদ। অথচ তিনটা পার হয়ে সাড়ে তিনটা, মানুষটা এখনো ফিরছে না। উৎকণ্ঠায় শরীর কাঁপছে আফসানা খানমের। পাশের বাসা থেকে ফোন করেন অফিসে, রিং হচ্ছে কেউ ধরছে না। ধরবে কী করে? অফিস তো বন্ধ। আফসানা ফোন করেন – আলী আমজাদের বস নেয়ামুল করিমের বাসায়। ফোনে নেয়ামুল করিম যা শোনায়, তার জন্য প্রস্ত্তত ছিলেন না আফসানা খানম।
ফোন রিসিভ করে করিস প্রশ্ন করেন – ভাবি, আমজাদ এখনো বাসায় ফেরেনি?
না। আপনি কিছু জানেন ভাই?
সকালে আমাদের অফিসে আর্মি এসে আমজাদসহ সাতজনকে নিয়ে গেছে। যাওয়ার সময়ে বলেছে যায় ঘণ্টাখানেক জিজ্ঞাসাবাদ করে সবাইকে ছেড়ে দেবে। এতক্ষণে তো আমজাদের ফিরে আসার কথা – থেমে যায় নেয়ামুল করিম। ভাবি, আমরা সবাই এখন বিপদের মধ্যে আছি। আপনাকে যে মন খুলে কিছু বলব, তারও উপায় নেই। কারণ, ফোনে আড়ি পাতা আছে। আমি আমার মতো চেষ্টা করছি। আমজাদ তো নিপাট ভালো মানুষ। আশা করি ফিরে আসবে – কোনো কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ফোন রেখে দেয় নেয়ামুল। পাথরের শোক বুকে নিয়ে বাসায় আসেন আফসানা খানম। ঢাকা শহর, শহরের মানুষ, প্রতিবেশী যারা খুব কাছের ছিল, তারা খুব দূরে চলে গেছে। সবার চোখে অবিশ্বাস। কেউ কাউকে বিশ্বাস করছে না।
ঘরের মধ্যে ছটফট করেন আর এ-ঘর ও-ঘর করেন আফসানা। আমজাদের না ফেরার ঘটনা জানতে দিতে চান না খোকনকে। কিন্তু কতক্ষণ আর চেপে রাখবেন? নিজেই একসময় খোকন ডেকে বলেন, তোর বাবা তো ফিরছে না।
মানে?
তাকে পাকিস্তান আর্মি ধরে নিয়ে গেছে অফিস থেকে।
আশ্চর্য, খোকন কোনো কথা বলে না। চুপচাপ মায়ের নিষ্পেষিত মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। আফসানা খানম ডুকরে কাঁদেন। তার এই নির্মম সর্বনাশের ঘটনা কাকে বলবেন? কে আছে তাকে সান্ত্বনা দেবে? তাহলে মানুষটি আর ফিরবে না? পাকিস্তান বাহিনীর গুলি বুকে ধারণ করে এই শহরের কোনো এক জায়গায় মুখ থুবড়ে পড়ে থাকবে? কুকুর আর বিড়ালে তাকে একটু একটু করে ছিন্ন করবে আর খাবে। মিরপুরে আফসানা খানমের এক চাচা থাকে। তার সঙ্গে নাকি আর্মির একটা কানেকশন আছে। মানুষটা আস্ত মুসলিম লীগার। চাচা খয়বরকে পছন্দ করত না আলী আমজাদ। দেখলে বলত – খচ্চর। বোরকা পরে কলাবাগান থেকে রিকশায় যান মিরপুর। খয়বার চাচাকে সব বলে মিনতি জানায় আফসানা – আপনার জামাইকে ফিরিয়ে দিন চাচা।
পানের পিক ফেলে হালকা সফেদ দাড়িতে হাত বুলায় খযবার – অস্তাগফিরুল্লাহ। আমি ফিরাইয়া দেওনের কে? ফিরাইয়া দিতে পারে আল্লায়। আবার পিক ফেলে – আর তোমার জামাইয়ের রেসালাত তো ভালো আছিল না। আমজাদ মিয়া মজিবারের দল করত না? তোমার ছেলের তো শ্যাক মজিবারের ছেলের লগে খুব খাতির – আমরা সব খবরই রাহি বুঝলা?
পাশাপাশি বাড়ি তো – এক স্কুলে পড়ে, কৈফিয়ত দেওয়ার চেষ্টা করে আফসানা খানম।
যেই হোক, যে আমার দেশের বিরুদ্ধে কাম করে, হের লগে মিশবা কেন? আবার পিক ফেলে তীর্যক চোখে তাকায় – তুমি যাও। আমি দেহি কী করতে পারি।
আফসানা চলে আসে। আসতে আসতে নিশ্চিত, তার খয়বর চাচা কিছুই করবে না। বরং বাড়ি বয়ে এসে লোকটার কুঁচকানো মুখের ঝামটা নিয়ে গেল। নিজেকে বড় নিঃস্ব আর অপমানিত লাগছে। খয়বরের কাছে না গিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্পে গেলে হয়তো ভালো হতো। মিরপুর থেকে আসতে আসতে সন্ধ্যা। বাসায় ফিরে দেখে খোকন ঘুমুচ্ছে। এই অসময়ে ছেলেটা ঘুমুচ্ছে কেন? তিনি দগ্ধ মনে কয়েকটা চাল চড়িয়ে দেন চুলোয়। যাই হোক, ছেলেটার মুখে তো কয়টা ভাত দিতে হবে।
রাতটা কীভাবে কাটল, বুঝতে পারছেন না আফসানা খানম। অনেক বছর পর আলী আমজাদকে ছাড়া একটা বিছানায় রাত কাটল তার। রাতে কিছু খাননি, খাবেন কী, খাওয়া মনেই ছিল না। খুব ভোরে বিছানা ছাড়লেন। নিজেকে তিরস্কার করছেন। হায় হায়, ছেলেটাও কিছু খেতে দিইনি। খোকন, নিজের হাতে কিছুই করতে পারে না। এক গ্লাস পানিও তাকে ঢেলে হাতে তুলে দিলে খায় খোকন। দ্রুত তিনি খোকনের রুমে যান কিন্তু রুম শূন্য। কেউ নেই। আফসানা খানমের মনের ভেতর কু ডেকে উঠল – খোকন চলে গেছে।
তার হাতের পানির গ্লাস, ভাতের প্লেট মেঝেতে পরে খানখান হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। পরে যেতে যেতে নিজেকেও সামলে নেন আফসানা। দেয়াল ধরে দাঁড়ান। একটু শক্তি সঞ্চয় করে ড্রয়িংরুমে আসেন, নেই। বাসার তিনটি বাথরুম খোঁজেন, নেই। বারান্দায় যান, নেই। শরীর অবশ হয়ে আসছে। সকালটা তার জীবনে বুঝি ঘন অন্ধ অন্ধকার নিয়ে এসেছে। প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে ছাদে উঠলেন, নেই। আফসানা খানম ছাদে সিঁড়ির মুখে একতাল ময়দার মতো লুটিয়ে পরলেন। রোদ তেতে উঠলে তিনি আর থাকতে পারলেন না, ধীরে নিচে নেমে এলেন। কিন্তু কোথায় এলেন? ঘরে? যে-ঘরে তার আঠাশ বছর ধরে একত্রে বসবাস করা মানুষটি নেই, যে-ঘরে তার নাড়ি ছিঁড়ে এসেছিল খোকন – সেই পঁচিশ বছরের খোকনও নেই – সে-ঘরে তিনি থাকবেন কী করে? তিনি দেয়াল ধরে ধরে ঘরময় ঘুরতে ঘুরতে কাঁদতে লাগলেন গুমড়ে গুমড়ে।
মে, জুন, জুলাই, আগস্ট, সেপ্টেম্বর, অক্টোবর, নভেম্বর, ডিসেম্বর গেল আফসানা খানমের কাঁদতে কাঁদতে। মাঝখানে এক ধুম বর্ষার রাতে তিনটি ছেলে এসেছিল ঘরে। দিয়ে গিয়েছিল খোকনের একটি চিঠি।
মা,
বাবাকে যখন ওরা বেঁচে থাকতে দিলো না, তখন আমাকেও দেবে না। আমি নিশ্চিত। কারণ, যুদ্ধ কোনো মানবিকতা মানে না। আমার ধারণা, আমি যুদ্ধে চলে আসার পর ওরা আমার খোঁজে এসেছিল। যদি এসে থাকে, আমাকে পেলে কি ছেড়ে দিত, বলো? হয়ত তোমার সামনেই আমাকে গুলি করত। আমারই টাটকা রক্তে ভেসে যেত তোমার সুন্দর পবিত্র দুটি পা।
সুতরাং যুদ্ধে এসে ভালোই করেছি। মা, পালিয়ে ভারতে এসে আশ্রয় পেয়েছি ত্রিপুরার একটি ক্যাম্পে। এখানে মানুষের কষ্ট দেখলে তুমি পাগল হয়ে যাবে। কেবল বেঁচে থাকার জন্য মানুষের এমন নির্মম আত্মত্যাগ পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল।
একটি ছোট্ট কুঠুরিতে, যেখানে একটি গরু থাকতে পারে – সেখানে বাবা-মা, ছেলেমেয়ে, দাদা-দাদি নিয়ে হাড়-জিরজিরে কঙ্কালসার মানুষদের দেখলে তুমি নিজেকে মানুষ পরিচয় দিতে লজ্জা পাবে। এক বেলা খাবার জোটে তো তিন বেলা উপোস দিতে হয়। তবু প্রতিদিন মানুষ আসছে বানের মতো, নিঃস্ব মিছিলের মতো।
আমরা থামব না মা। দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাব। ট্রেনিংয়ে অনেক কিছু শিখেছি। সকালে ট্রেনিংয়ের সময়ে আমাদের সবুজে লাল পতাকার দিকে তাকিয়ে আমরা গাই… আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি…। আমার সোনার বাংলা গান গাইতে গাইতে সব মুক্তিযোদ্ধা হাউমাউ করে কাঁদেন। আমিও চোখের পানি ধরে রাখতে পারি না। মনে হয়, আমি তোমাকে জড়িয়ে গাইছি। তুমি আমাকে জড়িয়ে আছ। এমন পবিত্র অনুভূতি যুদ্ধে না এলে পেতাম না। এখানে খাবারের খুব কষ্ট। ডাল তো ডাল নয়, পাতলা পানির হলুদ রং আর কী। ভাতের লোকমায় লোকমায় পাই কাঁকর, বালি; কিন্তু খাই মজা করে। শরীরে শক্তি আনতে হবে তো…।
আমার সহযোদ্ধা এরা, যারা চিঠি নিয়ে যাচ্ছে। ওদের অনেক কাজ। পারলে ওদের পেট ভরে খাইয়ে দিও… কতদিন ওরা ভালো-মন্দ খেতে পায় না।
চিঠি পড়া বন্ধ করে তাকান আফসানা খানম। ওরা নেই। চলে গেছে। বুক চেপে চাঁপা আর্তনাদে ফেটে পড়েন তিনি। আর্তনাদে আর্তনাদে সময় কেটে যায়। একমাত্র অস্ত্র সাদা কাগজে খোকনের লেখা চিঠি। একখানি প্রতিদিন পড়েন। বারবার পড়েন। আহা, ছেলেটা রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল, তলস্তয়, ভিক্টর হুগো খুব পড়ে তো। যুদ্ধের মধ্যে কী পড়তে পারে? চিঠিতে কী চমৎকার লিখেছে –
মা, ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় – কোনো দেশ যদি ন্যায়ের জন্য যুদ্ধ করে, তারাই বিজয়ী হয়। আমরাও ন্যায়ের জন্য দেশের স্বাধীনতার জন্য লড়ছি – এ-যুদ্ধ ন্যায়সংগত। সুতরাং আমরা জিতবই। বিজয়ী হয়ে তোমার কাছে ফিরে আসব একটি স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিকের অপার আনন্দ বুকে নিয়ে। তুমি অপেক্ষায় থেকো।
তোমার খোকন
ত্রিপুরা মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প, ১৯৭১।
অপেক্ষায়ই তো ছিলেন আফসানা খানম। ডিসেম্বরের প্রথম থেকেই বোঝা যাচ্ছিল, পাকিস্তান হেরে যাচ্ছে। পাকিস্তান আর্মি শেয়ালের মতো সারা বাংলা থেকে ঢাকার দিকে আসছে লেজ গুটিয়ে। শেষ ভরসা – আন্তর্জাতিক রেডক্রস। যদিও পাকিস্তান ইস্টার্ন কমান্ডের প্রধান আর্মির হেড কোয়ার্টারে জেনারেল নিয়াজি শরীরে মৃত বাঘের চামড়া জড়িয়ে হুঙ্কার দিচ্ছে – আমি একা হলেও যুদ্ধ শেষ পর্যন্ত চালিয়ে যাব।
মুক্তিযোদ্ধারা চারদিক থেকে ভীমরুলের চাকের মতো আসছে। বাতাসের গতিকেও হার মানিয়ে আসছে গেরিলারা। খোদ ঢাকা শহরে গেরিলারা যুদ্ধ করছে। পাকিস্তানিরা পালাচ্ছে বেশুমার। ক্ষণ, মিনিট, ঘণ্টা, দিন পার হয়ে এলো ষোলো ডিসেম্বর। রেসকোর্সে বাঙালি বিজয়ী জনতার সামনে আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করল নিয়াজি। সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ স্বাধীন। চারদিকে জয় বাংলা স্লোগান। আর মুহুর্মুহু গুলির শব্দ। অনেক দিন পর আফসানা খানম ঘর ছেড়ে বাইরে এলেন। রাস্তায় এসে দেখলেন, তিনি একা নন – এতদিন যারা কঠিন মুখে লুকিয়ে ছিল, তারাসহ ছেলে-বুড়ো, বাচ্চা-কাচ্চা সবাই বের হয়ে আসছে রাস্তায়। কেউ কাঁদছেও। আফসানা খানমও কাঁদছেন। কাঁদতে ভালো লাগছে। অনেক মুক্তিযোদ্ধা রাস্তায় গুলি করতে করতে চলে যাচ্ছে। নিশ্চয়ই এভাবে ফিরে আসবে খোকন।
পুরো ডিসেম্বরও যায়, ফিরে আসে না খোকন। কেউ কোনো হদিসও দিতে পারছে না। আফসানা আরো বিষণ্ণ আরো বিপন্ন বোধ করেন। সময় কাটে না, পাথরের মতো তার প্রতিটি মুহূর্ত। নাওয়া-খাওয়া একেবারে বন্ধ। বোধশক্তি নেই। পরে আছেন বিছানায় নির্জীব একজন মানুষ।
হঠাৎ শুনতে পান আবার স্লোগান। পাশের বাসার আতিকা বেগম এসে জানান – আপা শুনছেন?
কী? তিনি কোনোভাবে সাড়া দেন।
উনি ফিরে আসছেন।
কে ফিরে আসছেন?
বঙ্গবন্ধু।
বঙ্গবন্ধু ফিরে আসছেন? আফসানা খানমের শরীরে বিদ্যুৎ বয়ে যায়। উঠে বসেন তিনি – কে বলল আপনাকে?
রেডিওতে বলছে। পাকিস্তান সরকার তাকে মুক্তি দিলে তিনি লন্ডন হয়ে ভারতে আসেন আজ সকালে। এই তো কিছুক্ষণ আগে বিমানে করে ঢাকা তেজগাঁও এয়ারপোর্টে নেমেছেন। ওই মিছিল আর স্লোগান শুনতে পাচ্ছেন না? সব মানুষ তো তাকে বরণ করতে গেছে। ঢাকা শহরের কোনো বাড়িতে একটিও ছেলে নেই। সবাই গেছে ওনাকে বরণ করতে। আর রেডিওতে ধারাভাষ্য দিচ্ছে, শোনেন।
আতিকা চলে যান দ্রুত। কিন্তু রেখে যান জীবনের বার্তা। আফসানা খানম দ্রুত বিছানা থেকে নামেন। অনেক দিনের অব্যবহৃত রেডিও সেট নিয়ে বসেন। নব ঘুরাতেই শোনা যায় শব্দ সৈনিকের আবেগি গলা – বঙ্গবন্ধুকে বহন করা গাড়ি এখন ফার্মগেট অতিক্রম করছে। চারদিকে লাখ লাখ মানুষ। গাড়ি এগোতে পারছে না। বঙ্গবন্ধু কাঁদছেন। তার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন তাজউদ্দীন আহমেদ, তোফায়েল আহমেদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, শাহজাহান সিরাজ, আ স ম আবদুর রব। আরো আছেন বঙ্গবন্ধুর বড় ছেলে শেখ কামাল। গাড়ি ধীরে ধীরে এগোচ্ছে রেসকোর্স ময়দানের দিকে। সেখানে বঙ্গবন্ধু ভাষণদান করবেন।
আফসানা খানমের মনে হলো – তার শরীরে কোনো জড়তা নেই। তিনি বাথরুমে গেলেন। ফ্রেশ হলেন। শাড়ি পাল্টালেন দ্রুত। সামান্য প্রসাধনও নিলেন। রেসকোর্সে যাবেন। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি, জাতির এই শ্রেষ্ঠ সময়ের তিনি সাক্ষী থাকতে চান।
দ্রুত দরজা বন্ধ করে তিনি রাস্তায় নামেন।