সদ্য মা হওয়া এই নারীকে দেখে কে বলবে আরেকটু আগে তার স্বামী গোসলখানায় নিয়ে তাকে বেধরক পিটিয়েছে? কি সুন্দর ব্যাথায় জর্জরিত শরীর আর মুখে অভিনয়ের হাসি নিয়ে অতিথিদের আপ্যায়ন করে চলেছে! তার কি এমন দোষ ছিল? না হয় স্বামীকে বলেছিল, “মেহমান এতোজন আর মুরগী মাত্র দুইটা? আরেকটা আনলে ভালো হতো না?” এটাই ছিল তাকে পেটানোর কারণ। আজ খুশির দিন। তাই কোনভাবেই দিনটাকে মাটি করা চলবে না। আজ যে তার প্রথম সন্তান হওয়ার খুশিতে ঘরভর্তি মানুষ। লোকটা সবেমাত্র বাবা হয়েছেন, বাড়তি দায়িত্বের কারণে হয়তো হাত তুলেছেন। ব্যাপার না, সময়ের সাথে সাথে সব ঠিক হয়ে যাবে।
কাজে যাওয়ার আগেই সকাল সকাল নাস্তা তৈরি করে উনার সামনে হাজির করা, নিজে খেয়ে না খেয়ে সারা ঘর ঝাড়ু দেওয়া, রাতের থালাবাসন গুলো পরিস্কার করা। আবার ছেলেটা কেঁদে উঠলে তাকে নিয়ে বসা, স্তনপান করানো তারপর ঘুমিয়ে পড়লে দুপুরের রান্নার জন্য মাছ, তরকারি কাটাকুটি করা, বাচ্চার ময়লা কাঁথা ধোয়া, আবার উনার ময়লা শার্ট, লুঙ্গি ধোয়া এসব করতে অনেকটা বেগ পেতে হয়। ছেলেটাও কিছুক্ষণ পরপরই কান্না করে, তারও আর কি দোষ? এই বয়সী বাচ্চাদের তো মায়েরা কোলছাড়াই করেনা। আর আমি সংসার গোছাতে গিয়ে বাচ্চাটাকে নিয়ে দুদণ্ড বসতে পারি না। উনি যদি নিজের কাপড়গুলো ধুয়ে ফেলে তাহলে একটু সুবিধা হতো! দুপুরে ভাত খেতে আসলে তাকে এই ব্যাপারে বলবো! তিনি নিশ্চয় অমত করবেন না। উনি এলেন। অন্যান্য দিনের মতই গোসল করে নিজের পরনের লুঙ্গিটা বাথরুমে রেখেই খাবার খেতে বসলেন।
-‘কষ্ট করে লুঙ্গিটা না রেখে এই কয়েকদিন একটু ধুয়ে আনবেন। আমার একটু সর্দি লেগেছে, যদি বাচ্চারও সমস্যা হয়?’
উনাকে কেন এসব বললাম, ভাত তরকারি সহ খাবারের প্লেটটা ফ্লোরে ফেলে দিলেন। তার ভাষ্যমতে আমি আর কি এমন করি যে সর্দি লাগবে? সংসারটাই তো সামলাই। আর সংসারের কাজ কি আবার কোন কাজ? সংসার মানে তো পুতুল খেলা! কষ্ট তো পুরুষদের কাজেই হয়। ফ্লোরে পরে থাকা ভাঙ্গা প্লেট আর খাবারগুলো পরিষ্কার করতে করতে বলেই ফেললাম,
-‘এভাবে কথায় কথায় খাবারের উপর রাগ দেখালে আল্লাহ অসন্তুষ্ট হবেন। এই খাবার অনেকে খেতেও পায় না, আর আপনি অহেতুক এভাবে ফেলে দেন, এটা কি ঠিক?’ এই কথায় কারো তেলে বেগুনে জ্বলে উঠার কথা না থাকলে তিনি গর্জে উঠলেন,
-‘আমার রক্তে-মাংসে কামানো টাকায় কেনা খাবার আমি ফেলছি এটা নিয়ে আবার আমাকে কথা শোনাস?’
বলেই আমার কোল থেকে বাচ্চাটাকে খাটে রেখে আবারও ইচ্ছেমত মারলেন। আজ আর কাঁদলাম না। তিনিও মনের খায়েশ মিটিয়ে ক্ষান্ত হলেন। তারপর বাসা থেকে বের হয়ে গেলেন। জানি না, ক্লান্ত হয়ে নাকি অনুশোচনায়। ব্যথায় জর্জরিত শরীরটা টেনে নিয়ে গেলাম আমার ছেলেটার কাছে। প্রাণভরে কাঁদতেও পারলাম না, যদি ও জেগে যায়? নাহ! ছেলেটা ঘুমাক! কিছুক্ষণ আগেই তো কেঁদে কেঁদে ঘুমিয়েছে। ওকে রেখে গোসল করতে গেলাম। হালকা ঈষৎ গরম পানিতে লবণ দিয়ে গোসল করবো। বড্ড ব্যাথা শরীরটায়। সারা শরীর রক্তজমাট বাঁধা দাগে ক্ষতবিক্ষত। ক্ষুধা থাকলেও দুপুরের খাবারটা আর খাওয়া হলো না। ছেলেটাকে কোলে নিয়ে কাঁদতে গিয়ে হেসে ফেললাম! তার ছোট্ট হাতটা দিয়ে আমার কনিষ্ঠা আঙ্গুলটা কত শক্ত করে আঁকড়ে আছে!
দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা। সন্ধ্যা গিয়ে রাত নামতেই উনি এলেন। কিন্তু তার চোখেমুখে বিন্দুমাত্র অনুশোচনা নেই। ক্ষমা চাওয়া তো দূরের কথা একটিবারও জিজ্ঞাসা করলেন না, ‘আমি খেয়েছি কিনা?’ টেবিলে আসলেন, নিজেই ভাত নিয়ে খেয়ে কিছুক্ষণ টিভি দেখে শুয়ে পড়লেন। আমাকে একটিবার ডাকলেন না, খাবার খাওয়ার জন্য বললেন না। আমিও অভিমান করে বাচ্চাকে নিয়ে অন্য রুমে শুয়ে পড়লাম। তখন অনেক রাত। হঠাৎ মনে হলো কামুক স্পর্শে কেউ যেন ছুঁয়ে দিচ্ছে। ঘুম ভাঙতেই দেখলাম তিনি পাশে বসে আছেন। চারদিকে অন্ধকার থাকলেও তার স্পর্শে স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম তিনি স্বামীর অধিকার ফলাতে এসেছেন। দুপুরে এতোকিছু হওয়া স্বত্ত্বেও লোকটার এমন ব্যবহারে অবাক যতটা হয়েছি তারচেয়ে ঘৃণা হচ্ছিলো বেশি। প্রথমে অনিচ্ছা জাহির করলেও পুরুষের শক্তির কাছে যে নারী নেহাতই অসহায়। রীতিমতো ঝাঁপিয়ে পড়লেন, নিজের কামুকতা চরিতার্থ করতেই ছুঁড়ে ফেলতেও দেরি করলেন না!
নিজেকে খুব অপবিত্র লাগছে। মনে হচ্ছিলো আমি যেন শুধু একটা খেলনাই! ইচ্ছে হলে গায়ের জোর দেখাবে, যখন ইচ্ছে নিজের ক্ষুধা নিবারণ করবে! নিথর নগ্ন শরীরটা নিয়ে জুবুথুবু হয়ে ভাবছি, ‘আচ্ছা, এই নগ্ন শরীরের বামপাশে যে হৃদয় নামক এক টুকরো মাংসপিণ্ড থাকে তার খোঁজ কি সে কখনো নিবে না? তার হাতে কামুক স্পর্শের বদলে কোনদিন কি একগুচ্ছ বেলীফুল দেখতে পাবো না?’ এভাবে দিন যায় আর উনার অত্যাচারও বাড়তে থাকে। সেই সাথে আমারও সহ্য ক্ষমতা যেন দিনকে দিন বাড়তেই লাগল। মা-বাবা এসেছেন তাদের নাতিকে দেখতে! রান্নাঘরে মা আর আমি। রান্নায় টুকটাক সাহায্য করছিলেন আমাকে। রান্নার তোরজোরে কখন যে ঘোমটা মাথা থেকে সরে গেলে বুঝতেই পারলাম না। মা তার আঁচলটা মুখে টেনে ডুকরে কেঁদে উঠলো। ধবধবে সাদা চামড়ায় উনার মারার দাগ যে এখন জমাট হয়ে গাঢ় সবুজ বর্ণ ধারণ করেছে। আমিও আর লুকানোর বৃথা চেষ্টা করলাম না। আমার কান্না না হয় আমার মায়ের চোখ হয়েই ঝরুক!
-মা, তুমি বাবাকে কিছু বলো না! বললে বাবা কষ্ট পাবে। তুমি তো জানোই তোমার একটু রাগী…
-তাই বলে পাষণ্ডটা এভাবে তোকে মারবে? তাও এই কাঁচা শরীরে?
আমি মাকে এখন কি বলবো? কিভাবে নিজের স্বামীর এই অপকর্মের সাফাই গাইবো? বাবাকে তো দেখি নি মায়ের শরীরে কখনো হাত তুলতে! নাহলে বলতে পারতাম- আমার কপালেই তো শুধু এমন স্বামী জোটেনি, তোমাকেও তো বাবা পেটাতেন। কিন্তু বলতে পারি নি। কপালেরই কি দোষ দিবো? সব দোষ তো আমার মত ঘরের বউদের!
ব্যবসায় মন্দাভাব চলছে তো আমার দোষ, রাতে বাচ্চা কেঁদে উঠলে আমার দোষ, ঘুম থেকে উঠতে একটু দেরি হলেই আমি অপয়া, রান্নায় একটু এদিক সেদিক হলে আমার মা-বাবার দোষ! তারা কেন মেয়েকে রান্না শিখিয়ে পাঠালেন না? মাঝে মাঝে মনে হয় এত দোষ নিয়ে সংসারটা টিকিয়ে রাখতে পারবো তো? ‘আচ্ছা পরিবারটা তো আমারও, তাই না? পরিবারের ভালোমন্দ নিয়ে কি আমার কোন কথা থাকতে পারে না? নাকি আমি শুধু দাসীর মত খেটে দুইবেলা খাবার খেতে এসেছি?’
উত্তর পাইনি তাতে কি? ঘর ছেড়ে চলে যাবো? সম্পর্ক নষ্ট করবো? নাহ! আমাদের মত নারীরা একবার স্বামীর ঘরে বউ সেজে আসে ঠিকই কিন্তু তার বিদায় শুধু সাদা কাফনেই হয়! বিদায় বেলায় বাবা মুখে আর মা মুখ লুকানো কান্নায় দোয়া দিয়ে যায়। এই দোয়াই আমার এতসব অত্যাচার সহ্য করার ইন্ধন! বাবার হাতে দুই হাজার টাকা গুজে দিয়ে খানিকটা ধার করা হাসি হেসে বললাম, ‘তোমাদের জামাই দিতে বলছিল। কি একটা কাজ নাকি আছে তার জন্য তাড়াতাড়ি চলে গেছে, না হলে তিনিই তোমাদের দিতেন।’ তারা চলে যায়। যাওয়ার পর ভাবছি তার অনুমতি ছাড়া মানিব্যাগ থেকে টাকা নিয়েছি জানতে পারলে আবারো হয়তো গায়ে হাত তুলবেন। স্বামীকে যে বড় করতে হবে প্রয়োজনে আরেকটু সহ্য না হয় করলাম! স্ত্রীর কাছে স্বামীর সম্মানই বড়।
এসব ভাবতে ভাবতেই ছেলেটা কেঁদে উঠলো। ছেলেটাও হয়েছে বদমেজাজি একদম তার বাবার মত। ঘুম ভাঙলে কিংবা কোল থেকে নামালেই কান্না করে। সে কি কান্না! তার বাবাও খুব বিরক্ত হয়ে যায়। কিন্তু মায়ের কি আর বিরক্তি আসে? সে তো পরম যত্নে কোলে তুলে নিয়ে বাচ্চার কপালে কাজলের কালো টিপ এঁকে দেয়, চুমু দিয়ে বুকে আগলিয়ে নেয়, যেন দুনিয়ার দূষিত কোন নজর তার উপর না পড়ে! বাচ্চাটাই যে তার একমাত্র আশা, আরেকটা দিন বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা।
সদ্য মা হওয়া এই নারী হয়তো সন্তানকে বুকে আগলে নিয়ে স্বপ্ন দেখে, ‘একদিন এই সন্তানই তার দুঃখ কষ্টগুলোর প্রতিদান দিবে। এই সন্তান যেন তার স্বামীর মত হবে না। সে মানুষের মত মানুষ হয়ে নারীকে তার প্রাপ্য সম্মান দিবে! অভাগী এই মায়ের বুকের প্রতিটা দুধের ফোঁটার দামে তার ছেলেটা আজীবন নারী জাতির কাছে ঋণী থাকবে!’
আসলে একজন স্ত্রীর জায়গা স্বামীর পায়ে নয় তার বুকে। কিন্তু সবার বেলায় হয়তো তা হয়ে না উঠলেও এই নারীর ঔরসজাত সন্তানের জন্য নারী শুধু চাহিদা না হয়ে হোক মা, বোন, প্রথম মেয়ে কিংবা প্রথমা (স্ত্রী)।
গল্পের বিষয়:
গল্প