স্কুলের অফিস রুমে ঢোকার আগেই থেমে গেলাম। শুনতে পেলাম কথপোকথন
– স্যার আর কতদিন চলবে এভাবে?
– স্যার বাড়িতে বউ বাচ্চা কে ঠিকমত খাওয়াতে পারছি না।
– স্যার এভাবে তো চলতে পারে না। কারোর কাছে হাত পাততে পারি না৷ টিউশনিও তো বন্ধ। আগে কোনো রকমে সংসার চলত। কিন্তু এখন তো…
– স্যার কিছু একটা উপায় বের কথা করুন। আমরা তো শিক্ষক। আমরা তো লাইনে দাঁড়িয়ে ত্রান নিতে পারি না। ২ টা ঈদ চলে গেল। খুব কষ্ট করে কেটেছে। বাচ্চাদের মুখের দিকে তাকাতে পারি না। সব শুনে থেমে রইলাম। বুঝতে পারছি প্রধান শিক্ষক স্যারের সাথে সকলে পরামর্শ করছে৷ আর উনি চুপ করে আছেন। সকলের প্রশ্ন শুনে বললেন
– কি আর করার? সৃষ্টিকর্তা আমাদের কিসের শাস্তি দিচ্ছে জানি না। অভিভাবকরা বেতন দিচ্ছেন না। তবে আমাদেরও তো সংসার আছে এবার আমি দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। আমায় দেখেই উনি বললেন
– আরে বাবা তুমি? আসো। দেরি করে ফেললে যে?
– আসলে,,,, স্যার,,, আসতে একটু,,,
– ঠিক আছে বস।
আমি বসলাম। সবাই বিভিন্ন উপায়ের কথা বলছে। কিন্তু একমত হতে পারছে না৷ অবশেষে সবাই একমত হল৷ স্কুলের আসবাবপত্রসহ স্কুল বিক্রি করতে৷ কথাটি শুনে কিছুক্ষন চুপচাপ রইলাম। প্রধান শিক্ষক কে দেখে মনে হচ্ছে উনি খুব কষ্ট পাচ্ছেন।
স্কুলের মাঠে দাঁড়িয়ে আছি। ছোট মাঠ। তবে স্মৃতিগুলো বড়। এই মাঠেই স্কুল জীবনের ৭ টি বছর কাটিয়েছি৷ কতশত স্মৃতি জড়িত এই স্কুল! আর সেটাই আজ বিক্রি করে দিতে হচ্ছে! প্রিন্সিপাল স্যার কে দেখলাম স্কুলের চারদিকে ভাল করে দেখছেন৷ দেয়ালগুলো হাত দিয়ে ধরছেন। উনার চোখে স্কুলটি নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল। সব স্যারেরা মিলে স্কুলটি খুলেছিলেন। আমরাই ছিলাম স্কুলের প্রথম ব্যাচ। সকলের চোখেই পানি দেখতে পাচ্ছি৷ শিক্ষিকারা একটু বেশিই কাঁদছেন। নারীদের চোখে জল দেখা যায়। পুরুষদের কাঁদতে নেই। তাই হয়ত স্যাররা জোরে কাঁদছেন না৷ কিন্তু চোখ থেকে জল ঠিকই গড়িয়ে পড়ছে। আর রহমত চাচা? উনি তো গেইট জড়িয়ে ধরে কান্না করছেন৷ প্রিন্সিপাল স্যার আমার কাছে এসে বললেন
– বাবা, তোমার চাকুরিতে জয়েন কবে করবে?
– করোনা সংকট কেটে গেলেই৷ করোনার জন্য জয়েন করতে পারছি না৷
– অনেক ভাল কিছু কর বাবা, দোয়া করি।
– জ্বী স্যার, আপনাদের জন্যই এতদূর আসতে পেরেছি। স্যার হাসি মুখে আমার দিকে একটা খাম এগিয়ে দিয়ে বললেন
– এটা রাখো। ২মাস আমাদের এখানে ক্লাস নিয়েছো। সামান্য কিছু…..
– থাক না,স্যার। আমিও তো এখানে পড়েছিলাম। লাগবে না।
– না বাবা, বিক্রি করে যা পেলাম সকলেই নিলাম । তুমিও নাও।
আমার হাতে খামটি গুজে দিলেন। তখন একটি বাচ্চা আমাদের কাছে দৌড়ে এল। মুখে মাস্ক পড়া। চিনতে পারছি না। স্যার কে বলল
– স্যার আপনারা আর ক্লাস নিবেন না? স্যার হাসি মুখে বললেন
– না বাবা, তোমাদের জন্য নতুন স্যার আসবেন বলেই উনি মুখ ঘুরিয়ে যেতে লাগলেন। হয়ত আর কিছুক্ষন এইদিকে মুখ ফিরে থাকলে বাচ্চাটিকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতেন। উনার ফোনটা বেজে উঠল৷ উনার মুখ থেকে শুনতে পেলাম
– আমি এখনই সব কিনে বাড়ি ফিরছি। আর না খেয়ে থাকতে হবে না। আজ শিক্ষকরা তাদের স্বপ্নটিই হয়ত বিক্রি করে দিলেন। সাথে বিক্রি করলেন রোজগারের নাম মাত্র ঠিকানা। আমার মত হাজারো শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ তৈরি করে দেয়া অনেক শিক্ষকদের ভবিষ্যতই যেন বড্ড অনিশ্চিত। গেইটের দিকে এগিয়ে গেলাম৷ দেখলাম রহমত চাচা উনার সবকিছু গুছিয়ে নিয়েছেন৷ আর গেইট ধরে কাঁদছেন৷ এ কান্না কি শুধুই স্কুল বিক্রির? নাকি ঠিকানা বিক্রির? নাকি আবার স্বপ্ন বিক্রির?
গল্পের বিষয়:
গল্প