মাতালের কান্ড, পাগলের খেয়াল, বজ্জাত ছেলেপিলের বাঁদরামি – সবরকম ভাবা হয়ে গেলে বোঝা গেল আওয়াজটা আসলে কান্নার। কেউ গলা ফাটিয়ে তারস্বরে সুর করে কাঁদছে। পুরুষের গলা। কতকটা বাঁধপুল বাজারের কাদেরের মতো শুনতে।
এশার নামাজের পর থেকেই আওয়াজটা সকলের কানে আসতে থাকে। প্রথম প্রথম, যেমন হয়, কে না কে কাঁদছে মনে করে কেউ সেরকম পাত্তা দেয়নি। খুব জোরও ছিল না আওয়াজে। ঈদ গেছে কয়দিন আগেই। রোজই কেউ না কেউ বাড়ি ছেড়ে কাজের জায়গায় ফিরে যাচ্ছে। দুর্গাপুর-আসানসোল-ধানবাদ থেকে শুরু করে দিল্লি-মুম্বাই-চেন্নাই কোথায় না কোথায় রাজমিস্ত্রির কাজ করতে চলে যায় সব। বাড়ির মরদ কি বেটাটা বছরভরের জন্য চলে যাওয়ায় রোজই নানা বাড়ি থেকে মেয়েছেলেদের ফোঁপানোর আওয়াজ পাওয়া যায়। কখনো কখনো তা শুধু ফোঁপানিতে থেমে থাকে না। তাছাড়া দুমাস পরে বকরি ঈদ। অনেক কমবয়সী ছেলেপিলে, যারা বহুদূরে লেবার কি মিস্ত্রির কাজ করতে গেছিল, আর তো দুমাসের ব্যাপার বলে বাড়িতেই থেকে গেছে, তারাও অনেক সময় দলবেঁধে নানারকম খচরামি করে থাকে। মারধর-খুনখারাবিও বাড়ে। বয়সের জোশ। তাছাড়া কাঁচা পয়সা।
এমনিতে সন্ধে হলেই সবাই আজকাল টিভির মধ্যে ঢুকে পড়ে। নেই নেই করে গাঁয়ের অনেক বাড়িতেই আজকাল ছোটোবড় কালার টিভি। যাদের নেই তারা বড় রাস্তার ধারে ধারে যেসব চায়ের দোকান গজিয়ে উঠেছে, সেগুলোতে গিয়ে ভিড় জমায়। ক্যাবল টিভির দৌলতে রোজই মিঠুন কি বচ্চনের সিনেমা চলে কোনো না কোনো চ্যানেলে। ব্যস, সব সেঁটে থাকে একেবারে। কিন্তু শুধু বসে থাকলে চলবে না। চা বলো লেড়ো বলো আধ পাউন্ডের পাউরুটি বলো – সব ধাই-ধাই করে উড়ে যেতে থাকে। মিঠুনের নাচ, বচ্চনের মারপিটের সঙ্গে কখন যে তিরিশ-চল্লিশ টাকা পকেট থেকে বেরিয়ে গেছে আর রাত গড়িয়ে গেছে এগারোটার দিকে, খেয়ালই পড়ে না।
আশরাফুল হাজির বাড়িতে শুধু টিভির পাট নেই। কিনতে পারে, কেনে না। একটা আদ্যিকালের রেডিও ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বুড়ো ঘসঘসে আওয়াজে কী যে শোনে! তার কানেই প্রথম আওয়াজটা যায়। দুই ছেলে সারাদিন মুনিশদের সঙ্গে ভূতের মতো খেটে এখন তারাপদর চায়ের দোকানে আড্ডা দিতে গেছে। হাজিসাহেব রেডিও বন্ধ করে কান পাতেন। বেশ স্পষ্ট কান্নার আওয়াজ। সবল পুরুষগলার বিলাপ। বড়ো পোতা বারান্দায় বসে পড়ছিল। তাকে ডাকেন। সামনে মাধ্যমিক। সে বিরক্ত হয়। তা সত্ত্বেও তাকে নিয়ে লাঠি ঠুকঠুক করে টর্চ নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। বাড়ির মেয়েরা ছুটে আসে
– কুথাকে যেছেন জি?
– দেখি আসি কে কাঁদতেছে?
বাড়ির বাইরে বেরিয়ে মনে হলো, আওয়াজ পশ্চিমদিক থেকে আসছে। কেউ কি এন্তেকাল করল? কিন্তু তাহলে তো মসজিদে আগে খবর যাবে। মসজিদে খবর গেলে কেউ না কেউ তাকে এত্তেলা করবেই। মাসছয়েক হলো বড়ো ইমাম সাহেব গত হয়েছেন। সেই থেকে মসজিদে কোনো ইমাম নেই। মোয়াজ্জেম আয়নুলই ঝাঁটপাট দেওয়া থেকে শুরু করে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ানো, সব কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। ঈদে-শবেবরাতে কি কারো এন্তেকাল হলে সেই হায়দারপুর থেকে ইমাম এনে তবে গোর আজাবের কাজ কি ঈদগাহর নামাজ আদায় সব করতে হয়। সত্যি বলতে কী, গাঁ-দেশে মরদ আর কই! সব তো বাইরে। ক্ষেতের কাজে মুনিশ পাওয়া যায় না। যে-কটাকে পাওয়া যায়, রোজ-মজুরির বহর শুনলে মনে হয় কেয়ামতের দিন বুঝি এসেই গেল। ধান লাগানোর সময়, ধান কাটার সময় বর্ডার পার করে বাংলাদেশ থেকে কিছু লোকজন মুনিশ খাটতে আসে; কিন্তু তাদের তো আর সারাবছর পাওয়া যায় না। এসব ভাবতে ভাবতে হাজিসাহেব মসজিদের দিকেই যাচ্ছিলেন। রাস্তায় আয়নুলের সঙ্গে দেখা। এদিকে কান্নার বিরাম নেই।
– কাঁদতেছে কে হে আয়নুল?
– হামিও বুঝতাছি না জি। চলেন একবার গিয়ে দেখে আসি।
রাস্তায় আরো কিছু লোক জুটে যায়। তারাও কান্নার আওয়াজ শুনেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছে। কান পেতে পেতে এগিয়ে গিয়ে জগন্নাথ সাহার পোড়ো বাড়িটার পেছনে যে বিরাট চাষ না দেওয়া মাঠ, সেখানে লোকটাকে দেখা যায়। দেখা যায় বলা ঠিক না। একে রাত, তায় শুক্লপক্ষ হলেও আকাশে মেঘ। দুপুর থেকে দফায় দফায় বৃষ্টি হয়ে গেছে। এখন গুমোট করে আছে। মাঠের মাঝামাঝি পোঁটলামতন কালো কী একটা পড়ে আছে। নড়াচড়া করছে কি-না বোঝা যাচ্ছে না। আওয়াজটা সেখানে থেকেই আসছে।
কান্না। টানা টানা। জড়ানো। সুর করে। মাঝে মাঝে কিছু কথাও আছে। ঝিঁঝির ডাক, ব্যাঙের ডাক ছাপিয়ে এই তীব্র বিলাপে, যারা এসেছিল, তারা খানিক থমকে যায়। গোরাই প্রথমে টর্চ মারে। পুরুষ মানুষই বটে। পুরোদস্ত্তর জামাপ্যান্ট পরা। কাদায় মাখামাখি। হাঁটুগেড়ে সেজদা করার ভঙ্গিতে বসে। পিঠ ঝুঁকে আছে। মুখ মাটিতে প্রায় সাঁটানো। ওই অবস্থায় অমানুষিক জোরে কাঁদছে।
প্রথমে কিছু বোঝা না গেলেও, একটু ধাতস্থ হলে পরে বোঝা গেল, কান্নার মধ্যে টুকরো টুকরো কথাও রয়েছে। মোয়াজ্জেম, আয়নুল যে-সুরে মসজিদের মাইকে আজান দেয়, প্রায় সেই সুরে একগাদা কান্না ঢেলে লোকটা যা বলে চলেছে তা জোড়া লাগালে খানিকটা এরকম দাঁড়াবে – ইয়া আল্লাহ, তুমি হামার কথা শুনলা না, আলহামদুলিল্লাহ, কথা রাখলা না জি। দীন দুনিয়ার মালিক তুমি, দুনিয়ার কষ্ট বুঝলা না। আল্লাহ হামাকে ক্ষমা করলা না, তুমি আমার গুনাহ, আল্লাআআআ…
ভাদ্রের গুমোট সন্ধ্যা রাতের দিকে গড়াচ্ছে। অচেনা একটা লোকের প্রাণফাটা বিলাপে ব্যাপার দেখতে আসা লোকগুলোকে থম্ মেরে দাঁড় করিয়ে রাখে। ভূষণ মাস্টারের ছেলে নীহার আর গাছকাটা তারেক প্রথম জলকাদা ভেঙে মাঠের মধ্যে নেমে পড়ে। দেখাদেখি আরো কয়েকটা জোয়ান ছেলে নামে।
এতগুলো লোক তার দিকে এগিয়ে আসছে। তার গায়ে টর্চ মারছে। ‘ও ভাই, কে আপনি, কী হয়াছে, কাঁদতেছেন কেনে?’ – এসব বলে ডাকাডাকি করছে। লোকটার কোনো ভ্রূক্ষেপই নেই। সে নিজের মতো তারস্বরে কেঁদে চলেছে। সকলে এগিয়ে গিয়ে তাকে ঘিরে ধরে। কিন্তু তার গায়ে হাত দিতে কি জিজ্ঞাসা করতে কি দুটো সান্ত্বনার কথা বলতে কারো সাহস হয় না? যেন শেতলাতলার ভর-ওঠা ষষ্ঠীকে দেখছে। তারা নিজেদের মধ্যে গুনগুন করে। এগিয়ে যায় না।
তারেকই পরে দাবি করে, এভাবে প্রায় দশ মিনিট কেটেছিল; কি তারও বেশি হতে পারে। লোকটার কান্নার বেগ কমে আসে। সে সেজদা থেকে রুকুর ভঙ্গিতে উঠে আসে। ওই অবস্থায় বেশ কিছুক্ষণ থাকে। কান্না সামলায়। কয়েকবার হেঁচকি তোলে। চোখ মোছে। নাকে টানে। খ্যা-থু করে থুথু ফেলে। তারপর ওই জলকাদা-ভরা ধানের নাড়া উঠে থাকা মাঠের মধ্যে একেবারে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে। নড়াচড়া বন্ধ।
এতক্ষণ যারা তাকে ঘিরে উজবুক বনে দাঁড়িয়েছিল, তারা একেবারেই ভড়কে যায়। মরে-টরে গেল নাকি? সারের দোকানদার বুল্টন আস্তে আস্তে গিয়ে একটু নাড়া দেয়। – ও ভাই!
তারপর আরো জোরে – এ যি ভাই, শুনছেন?
এবার প্রায় সবাই মিলে লোকটাকে ঝাঁকাতে শুরু করে। কেউ লাঠি দিয়ে খোঁচা মারে। মিনিট কয়েক এসব হজম করার পরে, যখন সবাই ভাবছে গাঁয়ের একমাত্র ভরসা নীলু কম্পাউন্ডারকে ডাকবে কি-না, লোকটা উঠে বসে। সকলের দিকে মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তাকায়। একটাও কথা বলে না। খালি হাত দুটো জোড় করে সকলের দিকে একবার দেখায়। টর্চের আলোয় মুখের ভাব যেন – হামাকে একটু একা থাকতে দেন।
আবার ধপাস করে শুয়ে পড়ে।
ইতোমধ্যে কখন যেন আশেপাশের বাড়ির মেয়েরা দাঁতে আঁচল চেপে আলের ধারে ধারে এসে জড়ো হয়েছে। যারা মাঠের মধ্যে জলকাদায় নেমেছিল, কিছুই জানতে না পেরে ফিরে আসে। যে যার বাড়ির মেয়েছেলেদের ধমক-ধামক দিতে দিতে বাড়ির রাস্তা ধরে। কারণ লোকটা সেই যে শুলো, আর ওঠেনি। নড়াচড়াও করেনি।
যত্তোসব পাগলাখ্যাঁচার কান্ড! কামকাজ নাই। সন্ধেরাতে ধু-ধু মাঠের মধ্যে বসে হাউমাউ কান্না জুড়েছে। আমরা যে অতগুলো লোক গেলাম, অত করে সাধাসাধি করলাম, তা গেরাহ্যিই নেই বাপু! – এই মর্মে নানারকম ভাষায় আগামী কয়েকদিন আশেপাশের সবকটা বাঁধানো বটতলায়, হাটে-মাঠে আলোচনা চলে। যাদের একেবারেই কোনো কাজকাম নেই আর যারা কোনো ব্যাপারে একবার মাথা ঘামিয়ে ফেললে তার আঁটি বের না করে ছাড়ে না, তারা অবধি হাজার চেষ্টা করে জানতে পারেনি লোকটা কে। পরদিন অনেকেই বড়ো বাইরে না সেরে ঝুঁঝকো ভোরে মাঠের ধারে গিয়ে হাজির হয়। দেখে সব ভোঁ-ভাঁ। লোকটার চিহ্নমাত্র নেই।
নানারকম ঘটনার ঢেউয়ে এই ব্যাপারটা মুছে যায়। এমনিতেই হাজারটা ঝামেলায় মানুষজনের পেছনের কাপড় খুলে যাওয়ার জোগাড়। আকাশে মেঘ নেই, শ্যালোতে জল নেই, সারের দাম আকাশ ছাড়াচ্ছে, এদিকে ফসলের দাম নেই, আলু করো কি ধান, সব শালা মাঝখানে ওই পাইকারের আর হিমঘরের মালিকের পেটে যাচ্ছে। বিএসএফ-বিজিবির টানাপড়েনে মাঝেমধ্যেই এর-ওর বাড়ির মানুষ মারা পড়ছে, মহাজনের উৎপাত, পার্টির দখলদারি – মানুষের নিজেরই ভেতরে এতো আর্তনাদ জমে আছে যে, কে কবে মাঠের ধারে বসে কেঁদেছিল, কারো আর মনে রাখার ফুরসত হয় না। মাঝে মাঝে কথা ওঠে। তখন সবাই স্বীকার করে, হ্যাঁ, কেঁদেছিল বটে লোকটা। চারিদিকে যা অবস্থা, ঘরসংসার চালাতে গিয়ে আমাদেরই মনে হয় ওরকম ডাক ছেড়ে কাঁদি। ক্ষ্যাপা ক্ষ্যাপা লাগে। কেবল আশরাফুল হাজির সারাদিন কোনো কাজ নেই। তিনি রেডিওর নব ঘোরান। এপাড়া-ওপাড়া করেন। আর মাঝে মাঝে একে-ওকে শুধান, লোকটা কে ছিল কিছু জানতি পারলা? কাঁদছিল কেনে ওরকম?
নামাজ শেষে মোনাজাত করার সময় মাঝে মাঝে লোকটার কথা মনে পড়ে তার। তিনি দোয়া করেন। লোকটা যে-ই হোক, তার দুঃখ যেনে কেটে যায়। বালা-মুসিবত থেকে যেনে রেহাই থাকে। আল্লাহ মালিক। কারো যেন কষ্ট না থাকে।
তবু মনের ভেতর, গাঁয়ের বাকি লোকদের মতোই চাইতে থাকেন, লোকটা যেন আরেকবার আসে। যেভাবে কেঁদেছিল, আহা, রুহ অবধি কেঁপে গেছিল। সাচ্চা বান্দা একটা। আরেকবার চোখের দেখা হবে না?
হাজিসাহেবের দোয়া কবুল করেই হোক কি এই নাদান কাহিনিটার খাতিরে, লোকটা আবার আসে। আবার জগন্নাথ সাহার পোড়ো বাড়ির পেছনের চাষ না পড়া জমি, এশার নামাজের ঠিক পরে – সব একেবারে খাপে খাপ।
পঞ্চায়েত ভোটের পরপর। মদ-মুরগির ফোয়ারা থিতিয়ে এসেছে। মারদাঙ্গা যে দু-একটা হয়েছিল, তাও লোকে ভুলতে বসেছে। এমন সময় সন্ধের পর গোটা গ্রাম কান পেতে বলে উঠল – ওই যে, আবার এস্যা গেলছে। দুজন ছোটে আশরাফুল হাজি আর আয়নুল মোয়াজ্জেমকে ডাকতে। বাকিরা মাঠের দিকে যায়।
সেই সেজদা করার ভঙ্গি, সেই হাউ-হাউ করে বিলাপ – আল্লাহ তুমি আমার দোয়া কবুল করলা না হে… আমার গুনাহ মাফ করলা না… হামি এত করি দোয়া মাঙলাম আল্লাহ হে… ইত্যাদি।
এর সঙ্গে আরো কিছু নতুন কথা যোগ হয়েছে দেখা গেল – আল্লাহ আফনে খাইরুল ভায়ের বিটিটাকে কেনে কেড়ে লিল্যা, হামি বুললাম আফনারে, উয়ার একটাই বিটি, এখুন উ কি কইরবেক… মাঠে পানি নাই আল্লাহ হে, আসমানে পানি নাই… হামারগে কথা আফনে রাখলা না…
আরি বাস্! মালটা কে রে! ফেরেশতা-টেরেশতা নাকি? অন্য লোকের সমস্যা নিয়ে আল্লাহর কাছে সরাসরি দরবার করছে! দোয়া কবুল না হলে আবার অভিযোগ করছে! একেবারে ইয়ার দোস্তি সম্পর্ক মনে হচ্ছে। মাঠে জল নেই। ধুলোয় ভর্তি। সকলে হুড়মুড় করে নেমে তার দিকে এগিয়ে যায়। পাছে এবারও পালায়।
যে লোক অন্যের ভালোর জন্য অমন করে কেঁদে কেঁদে ওপরঅলার কাছে প্রার্থনা করে, পাবলিক কি আর তাকে সাধারণ মানুষ বলে মনে করে! নিশ্চয় কোনো ফকির-মিসকিন কিছু একটা হবে। আর রোগবালাই কার ঘরে নেই। নিশ্চয় এর কাছে জলপড়া- তেলপড়া কিছু একটা পাওয়া যাবে। লোকটা সোজা হয়ে উঠে বসতেই ভিডিও অফিসের ক্যাজুয়াল স্টাফ লাল্টু খপ করে একটা হাত ধরে ফেলে। ওর মেয়েটার কী যে রোগ! দুবছর বয়স থেকে হাত-পা বেঁকে যাচ্ছে। ডাক্তার-কবিরাজ ভেলোর চেন্নাই কিছুই বাদ দেয়নি। মেয়ে যে কে সেই। মাঝে মাঝে ফিট হয়ে যায়। মুখ দিয়ে ফেনা ওঠে। লাল্টু হাউমাউ করে গিয়ে ধরে – আমার বাড়িতে একবার চলেন ভাই, আমার মেয়েটাকে একবার দেখেন, কত জায়গায় দেখালাম, কিচ্ছু হলো না, একবার চলেন আপনি, দোয়া-দরুদ যা হয় করেন, চলেন ভাই…
লোকটা কে, কোথা থেকে এসেছে সেসব বাদ দিয়ে লাল্টুর মেয়েই এখন প্রধান হয়ে ওঠে। সবাই মিলে তাকে বলতে থাকে, চলেন ভাই, একবার চলেন…। যতটা না লাল্টুর মেয়ের জন্য, তার চেয়ে বেশি ম্যাজিক দেখার আশায়। তার ওপর লোকটা যখন লাল্টুর সঙ্গে চলতে থাকে, লোকের বিশ্বাস আরো পোক্ত হয়।
লাল্টুর ছোট্ট ঘরের চৌকির ওপর লোকটা উবু হয়ে বসে থাকে। ঘর পেরিয়ে রাস্তা অবধি থিক্থিক্ করছে ভিড়। নানারকম কথা শোনা যাচ্ছে, মহিলারা বলছে, আহা রে কীরকম প্রাণফাটা কান্না কাঁদে দেখো, তাও নাকি অন্য লোকের জন্য। আজকাল কে আর অন্য লোকের কথা ভাবে! লাল্টুর মেয়েটা যদি ভালো হয়ে যায়, আমার ননদের ছেলেটা জানো, ঠিক ওরকম। সেই সেবার…। সকলে অবশ্য অতটা ঢলে পড়তে রাজি নয়। তাদের মতে, লাল্টু লোকটাকে একেবারে ঘরে এনে না তুললেই পারতো। কে না কে তার ঠিক নেই। পুলিশ কি বাইরের দেশের স্পাই হতে পারে। এই তো গত বছরই, যে সতু পাগলাকে তিন বছর থেকে সকলে চেনে, হাফপ্যান্ট পরে অখাদ্য-কুখাদ্য খেয়ে বেড়ায়, তাকে কিনা পুলিশ ধরে নিয়ে গেল! সে নাকি বিদেশি চর!
লোকটা লাজুক মুখ করে বসে থাকে। যেন দোজবরে মেয়ে দেখতে এসেছে। লাল্টু মেয়েকে আনতে ভেতরে গেছে। আশরাফুল হাজি মুরুবিব লোক বলে তাকে লোকটার পাশে বসানো হয়েছে। হাজিসাহেব জিজ্ঞাসা করেন, তুমার নাম কী বেটা?
– জি, গোলাম। গোলাম শেখ।
– বাড়ি কতি?
– বাহাদুরপুর।
– আববার নাম?
– খাইরুদ্দিন শেখ।
লোকটা সাধারণ মানুষের মতোই কথা বলছে। আস্তে। নম্রস্বরে। বাহাদুরপুর এখান থেকে মেলা দূর। এ-গ্রামের খুব বেশি লোকের সেখানে যাতায়াত-কুটুম্বিতা নেই। কেউই গোলাম শেখ আর তার আববা খয়রুদ্দিন শেখকে চিনতে পারলো না।
ব্যাপারটা আসল দিক ছেড়ে অন্যদিকে যাচ্ছে দেখে হাজিসাহেব সবাইকে থামিয়ে প্রশ্ন করলেন, তা অমন করে কাঁদতেছিলা কেনে বাপ? কী হইয়ছে?
গোলাম শেখ খানিক চুপ করে থাকে। ঘ্যাসঘ্যাস করে পা চুলকায়। এদিক-ওদিক তাকিয়ে খানিক আনমনেই বলে, কাউরে না কাউরে তো কাঁদতে হবেক, লয়?
লাল্টু মেয়েকে নিয়ে আসে। বাচ্চাটার দিকে খানিকক্ষণ একভাবে তাকিয়ে থাকে গোলাম। তারপর বেরিয়ে যেতে থাকে। লাল্টুর বউ এসে জিরিবিরি করে ধরে – আমার মেয়াটা কি ভালো হবেক না ভাই!
গোলাম একটু থেমে বলে, দোয়া করে দেখি। আল্লাহ মালিক।
বলে বেরিয়ে যায়।
যে-তিনমাস গোলাম আসে না, সকলে মনে মনে হলেও তার রাস্তা দেখে। তা বলে সন্ধে হলে হাইরোডের ধারের চায়ের দোকানে সিনেমা দেখার ভিড় কিছু কম হয় না। মনি রায়ের বাংলা মালের ঠেকও যেমন চলত, তেমনি রমরম করে চলতে থাকে। ছিপলি ঘাট কি রামনগর ঘাট দিয়ে মাল যাতায়াত চলতেই থাকে। তবে সন্ধে হলে কেউ না কেউ কোথাও না কোথাও একবার হলেও গোলামের কথা তোলে। ছেলেটা কবে আসবে। কবে শোনা যাবে মরদের গলায় প্রাণফাটা বিলাপ। লাল্টুর মেয়ে ভালো না হলেও আর খারাপের দিকে যায় না। এটাকেই সবাই গোলামের ক্ষমতার প্রকাশ বলে ধরে নেয়। বিশ্বাস করে শান্তি পায়।
গোলাম আসে। তিনমাস-চারমাস ছমাস পরপর আসে। পড়ে পড়ে কাঁদে। সকলে জড়ো হয়। জড়ো হয়ে শোনে, সন্ধ্যার আকাশ চিড়ে তারাদের চিড়ে কোনো বেহেশতের দিকে তার আর্তচিৎকার চলে যাচ্ছে – হামার গুনাহ্ মাফ করো আল্লাহ… হামার দোয়া কবুল করো… অমুকের বেটাটাকে ভালো করে দাও… তমুকের বিটিটার কোলে বেটা দাও… ইয়া আল্লা… সকলকে ভালো রাখো…
গোলাম সকলের ঘর-গেরস্থালির সঙ্গে জুড়ে যায়। অন্তত গ্রামের লোক সেটাই দাবি করে। যদিও সে নিজে কিছু বলে না। কান্নাকাটি সারা হলে কেউ না কেউ তাকে ঘরে নিয়ে যায়। তাদের সমস্যার কথা বলে। গোলাম শোনে। কিছু বলে না। কখনো বলে, দোয়া করবু। দেখা যাক। আল্লাহ মেহেরবান। এই রকম সমস্ত আবছা কথা। কিন্তু কেউ কখনো তাকে এই গ্রামের কারো সমস্যার প্রতিকার চেয়ে কান্নাকাটি করতে দেখেনি। এর থেকে এটাই চাউর হয়ে যায় যে, গোলাম যে-গ্রামে কাঁদে, কখনো সেই গ্রামের সমস্যার কথা তোলে না। এতে নাকি আল্লাহর কাছে গুনাহ হয়।
কথায় বলে, মানুষের বয়স হয়ে গেলে মউত ছুতো খোঁজে কোনো না কোনোভাবে পাকড়াও করার। হাজিসাহেব, কথা নেই বার্তা নেই কলতলায় পা পিছলে পড়ে গেলেন। পায়ে যতো না লাগলো, ঝাঁকুনির চোটে একটা মাইল্ড অ্যাটাক হয়ে গেল। বয়স বেশি, তাই লোকাল হাসপাতালের ডাক্তাররা রিস্ক নিতে চাইলো না। কিছুদিন কলকাতায় বড়ো হাসপাতালে কাটিয়ে হাজিসাহেব বাড়ি ফিরে এলেন। মুশকিলটা হলো, বাড়ি ফিরে আসা ইস্তক তিনি গোলাম গোলাম করে সকলকে অস্থির করে দিচ্ছেন। গোলাম কই, গোলাম কবে আসবে, কেন আসছে না। গোলাম এলে আমার আর কোনো মুসিবত থাকবে না। ও একবার দোয়া করলেই আমার সব তকলিফ শেষ হয়ে যাবে। ফেরেশতারা এসে আমার রুহুটা নিয়ে যেতে পারবে। আর আমাকে এই জীবন্ত দোজখে থাকতে হবে না। আল্লাহ করুণাময়।
ব্যাপারটা সকলেরই মনে ভুড়ভুড়ি কাটছিল। হাজিসাহেবের কথায় হিসাব করে দেখা গেল, প্রায় আট-নয় মাস হলো গোলাম এদিকে আসে না। সেই যেবার মদন উকিল ওর বউদিকে নিয়ে পালিয়ে যায়, তার আগে-পরেই তো এলো। কী হলো ছেলেটার? এতদিন না আসা তো করে না। যা আদাড়ে-বাদাড়ে ঘুরে বেড়ায়। সাপটাপে কাটলো না তো! নাকি অন্য কারো জন্য দোয়া করতে এত ব্যস্ত হয়ে পড়লো যে, এ-গাঁয়ের কথা, এখানকার লোকদের কথা তার মনেই পড়ে না আর!
আর যদি না আসে ছেলেটা? আর যদি সেরকম প্রাণফাটা সুরে আল্লাহর কাছে দরবার না করে? লাল্টুর মেয়ে এর মধ্যে আরো দু-একবার ফিট হয়েছে। দীনু ঘোষের ছেলে ফালতু একটা হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়ে সায়দাপুরের একটা ছেলেকে হাঁসুয়ার কোপ মেরে বসলো। এখন অ্যাটেম্পট টু মার্ডার চার্জে ভেতরে বসে আছে। গোলাম মাস্টার মেয়েটার বিয়ে দিয়েছিল, বছর যেতে না যেতে মেয়েজামাই সব মিলে বাস নদীতে পড়ে তলিয়ে গেল, আসগরের ছোট বিটিটাকে তুলে নিয়ে গিয়ে রেপ করে ফেলে রেখে গেল, তারা যে কারা তা আজো জানা গেল না। এছাড়া রাক্ষসী পদ্মার পেটে জমি-জিরেত বসতভিটে তো ঢুকতেই আছে।
সকলের ভেতর চিৎকার থম হয়ে ঘুরপাক খায় গ্রামের মাথায়। সাঁজালের ধোঁয়ার মতো ভারী হয়ে আসে। সকলে মিলে একবার বাহাদুরপুর যাবে কিনা ভাবছে। কিন্তু গিয়ে কী বলবে, আপনাদের গাঁয়ের ছেলে আর কেন আমাদের গ্রামে গিয়ে কাঁদে না? সে যে অন্য জায়গায় গিয়ে সত্যি সত্যি কান্নাকাটি করে, সে-কথাও তো শোনা যায়নি কখনো। এই সমস্ত কথা বাতাসে ঘুরে বেড়াচ্ছে, এমন সময়ে এক বিকেলে গোলাম গ্রামে ঢোকে।
জগন্নাথ সাহার পোড়োবাড়ির পেছনের জমিতে আছড়ে পড়ে চিৎকার করে সকলের জন্য দোয়া চাইতে চাইতে নয়, ঢোকে মসজিদের পাশ দিয়ে গাঁয়ে ঢোকার যে সদর রাস্তা সেখান দিয়ে। ফর্সা জামাকাপড়। চুল পাট করে আঁচড়ানো। সাইজ করে ছাঁটা দাড়ি। হাতে একখানা বাজারের ব্যাগ। হাজিসাহেবের বারান্দার পাশে গিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে।
তাকে এ-অবস্থায় কে প্রথম দেখেছিল তা নিয়ে পরে অনেক ঝগড়াঝাটি হয়। আমরা সেসবের মধ্যে আর ঢুকবো না। মোদ্দা কথা হলো, আধঘণ্টার মধ্যে প্রায় গোটা গ্রাম হাজিসাহেবের উঠোনে যাকে বলে ভেঙে পড়ল। ততক্ষণে গোলামকে ঘরের মধ্যে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
হাজিসাহেব এখন অনেকটাই ভালো। কাছে বসিয়ে গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে গোলামকে জিজ্ঞেস করলেন, এতোদিন আসোনি কেনে বাপ? কুথাকে ছিলা? তুমিও আর আসো না, হামরাদের কী হাল দেখো তো! এমনি আরো অনেক কথা এক তোড়ে বলে যান।
সকলে ধরেই নিয়েছে হাজিসাহেবের অসুখের খবর কোনো অলৌকিক পথে গোলামের কাছে পৌঁছেছে। আর তাতেই সে ছুটে এসেছে। তবে কীভাবে সে খবরটা পেলো, সেটা নিয়ে নানাজনের মধ্যে নানা মত শোনা যেতে থাকে।
এতগুলো লোককে তার দিকে নজর করে থাকতে দেখে গোলাম লাজুকভাবে বলে, জি হামি সাদি কর্যালছি।
গোলামের পেছনে পেছনে ঢোকা ঘোমটা-দেওয়া মেয়েমানুষটিকে কেউ এতক্ষণ খেয়াল করেনি। সে এসে জড়োসড়ো হয়ে এক কোণে দাঁড়ায়।
গোলাম বলে, এই ধরেন গে আর তিন-চার মাস হলো। ঘরকে গেছলাম তো আম্মি-আববা ছাড়লো না। তারপর ধরেন কামকাজ তো কিছু করতে লাগে, তা খাইরুর মিস্ত্রি বুললে, চ হামারগে সাথে, লেবার খাটবি। তো বর্ধমান গেল্যাম। উকানেই ছিল্যাম বুঝলেন। পইসা করে লিলো এই মিস্ত্রি গুলান। কত করি বুললাম, পাঁচশোটা টাকা দেন, ঘরকে যাই। দুশোর বেশি দিলে না কিছুতেই! কী করি বুলেন, যা দেয় তাই লাভ। উ হল গে সাইদা। আপনাদের বঁহু। ভাবলাম, আপনারা কতো সুখে-দুখে হামাকে কতো দেখ্যালছেন। একবার যাই, দেখিয়ে লিয়ে আসি। দোয়া করিয়েন। যাতে ভালো হয়। আপনারা মালিক।