অন্তরের তাগিদটা ঘণ্টাখানেক আগেই হাওড়া স্টেশনে পৌঁছে দিয়েছে ফজলকে। যাত্রীছাউনিতে অপেক্ষা। সঙ্গে আছে পঞ্চাশোর্ধ্ব দূরসম্পর্কের ভাগনা সামাদ। একটি ডেকোরেটর সংস্থার ম্যানেজার। পাশাপাশি গ্রামে বাড়ি। প্রায়ই ঢাকা থেকে দেশে ফেরে। সব পথঘাট চেনা, তাই তাকে সঙ্গে নেওয়া। মনে পড়ে পঞ্চাশ বছর আগে দশ বছরের এক বালক এই স্টেশন দিয়ে শেষবার গেছে, আর কোনোদিন এখানে পা পড়েনি। আজ ২০০১ সাল। বাংলাদেশে তার কলেজ-চাকরিজীবনের অবসর। মনে পড়ে নিজ গ্রামের কথা। এবার তো যাওয়া যায়! কোনো টেনশন নেই।
সরকারের অনুমতি নাও। কেন যাচ্ছ? ব্যাখ্যা চাইতে পারে। সন্তোষজনক উত্তর, না হলে ছুটি নামঞ্জুর। এখন ওসব বালাই নেই। ঝাড়া হাত-পা। কিন্তু সবই তো বাল্যস্মৃতি। রাস্তা চিনবে কী করে? মোটা দাগে একটা মেন্টাল রোডম্যাপ আছে, কিন্তু তার কতটা অদল-বদল হয়েছে, কে জানে!
আমরা এখন কোথায় যাব? ফজলের প্রশ্ন। আমরা প্রথমে ট্রেনে যাব তারকেশ্বর। তারপর ওখান থেকে বাসে রাজহাটি। তারপর রাজহাটি থেকে অটো নিয়ে সবলসিংহপুর।
রাজহাটি! আরে ওই হাটে তো প্রতি সপ্তাহে আমি আর ফনুচাচা মানে আমার ছোটচাচা বাজার করতে যেতাম। ওখানে পাকা একতলা দোতলা সব বাড়ি। দোতলা কোনো কোনো বাড়ির ছাদে আবার ডানাঅলা পরীর মূর্তি ছিল। আমার খুব ভালো লাগত ওগুলো দেখতে। হাট থেকে তরিতরকারির সঙ্গে কেনা হতো জিলিপি। আর চৈত্র-সংক্রান্তির দিন হতো পাঁপড়ভাজা… বেগুনি… আর পকৌড়া… এগুলো কেনার জন্যে মা আলাদা পয়সা দিতেন… তবে ঘরে নিতে নিতে সব ঠান্ডা হয়ে যেত।
এখন রাজহাটি থেকে অটো চলে, চলে রিকশা…
আমরা তখন হেঁটে চলাচল করতাম। ওসব ছিল না। একদিনের কথা এখনো আমার খুব মনে আছে। তখন হেমন্তকাল হবে। নিচু মাঠে খুব একটা জল নেই। বড় রাস্তার পাশে একটা নিচু জমিতে কিছু জল জমে আছে। একটা বারো-তেরো বছরের ছেলে জল ছেঁচছে, হয়তো মাছ ধরবে। এই কাজ করতে করতে সে উচ্চৈঃস্বরে গান ধরেছে… হরে মুরারে, হরে মুরারে… পরের সর্বনাশ ভালো করে করো রে… সে জপ করার মতো বলেই চলেছে… আর ঝপাৎ ঝপাৎ করে একটা ছোট বালতি করে জল আলের ওপারে ফেলছে।
ছেলে তো দেখছি ওস্তাদ! বলে সামাদ। হ্যাঁ। মনে হয় চার্বাক দর্শনের অনুসারী। স্টেশনে থেকে থেকে মাইক্রোফোনে ঘোষণা আসছে নানা নির্দেশনার। একসময় তাদের পালা এসে গেল। দুজন প্ল্যাটফর্মের দিকে এগোয়।
গাড়ি ছাড়ল ১০টায়।
সোয়া ঘণ্টার মধ্যে তারকেশ্বর। বিদ্যুৎচালিত ট্রেন। গতি দ্রুত। কোনো স্টেশনে এক মিনিটও দাঁড়ায়নি। লোকজন চটপট অভ্যস্ত।
তারকেশ্বর স্টেশনটি বেশ ফাঁকা। মনে হয় যেন কোনো লোকালয়ের বাইরের স্টেশন। অথচ পাশেই কোলাহলমুখর দেখা যাচ্ছে।
টাটকা ডাবের কাঁদি দেখে তেষ্টা পেয়ে গেল ফজলের।
মামা, গলা শুকনো লাগছে…
ডাব খাবেন? দেখছি।
দশ টাকা জোড়া। খুব সস্তা মনে হলো ফজলের। বাদামি রঙের ডাব।
জানেন মামা, এই বাদামি রঙের ডাবকে আমরা ছোটবেলায় কী বলতাম?
কী বলতেন?
ব্রাহ্মণডাব। দেখছেন গাত্রবর্ণ কেমন আলাদা?
তা বটে।
খুব উচ্ছ্বাস ফজলের।
বলে ওঠে, মামা, ডাব খেয়ে জু তর হয়ে গেল।
তা যা বলেছেন মামা। দেশের টাটকা জিনিসের স্বাদই আলাদা।
ফজলের কানে দেশ কথাটা ভিন্ন ব্যঞ্জনা তৈরি করে। সামাদ মামা ঢাকায় কাজ করে, তার স্টাবলিশমেন্ট সব নিজ গ্রাম সবলসিংহপুরের পাশে মাড়োখানায়। দুই ছেলে কলকাতায় চাকরি করে। ফজল ভাবে, সে তো ঢাকায় বসে গেছে। তার দেশ কোনটা? তার মনে রবীন্দ্রনাথের ‘পুরানো সেই দিনের কথা…’ গানটা বাজতে থাকে… হায়… মাঝে হল ছাড়াছাড়ি, গেলেম কে কোথায় – আবার/ দেখা যদি হল, সখা, প্রাণের মাঝে আয় ॥ তার চোখ দিয়ে কেন জানি আপনা-আপনি জল গড়ায়।
এবার বাস ধরার পালা। একজন কুলির মাথায় বোঝা উঠিয়ে দুজন বাসস্ট্যান্ডের দিকে এগিয়ে চলে।
রাজহাটির বাস তখনো ভরেনি। কন্ডাক্টর হেঁকে চলে, রাজহাটি… রাজহাটি…
আরো মিনিট পনেরো গেল, বাসের পেট পুরো ভরেনি; কিন্তু সময় হয়ে গেছে। ফলে ছাড়তে বাধ্য হয়।
রাস্তা খুব ভালো নয়। কিছু ঝাঁকুনি বরাদ্দ। আস্তে আস্তে বাস ভরে গেলে ঝাঁকুনি কমে।
চৈত্র মাস। বাতাস গরম। তবে হাওয়া থাকায় অসুবিধে নেই।
প্রায় ১টার দিকে পৌঁছাল রাজহাটি।
বাজারটা একটু দেখব? বলে ফজল। আজ থাক মামা, দুপুর হয়ে গেছে… আরেকদিন সকালে এসে দেখে যাওয়া যাবে। রাস্তার পাশে একটা ভালো মিষ্টির দোকান দেখে সামাদ বলে, মামা, ভাগনে-ভাগনির জন্যে কী মিষ্টি নেবেন। এখান থেকে নিয়ে নিন। রাস্তায় আর দোকান পড়বে না।
দোকানে ঢুকে ফজল দানাদার দেখে উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। আরে, এটা ছিল আমার সবচেয়ে প্রিয় মিষ্টি… বাংলাদেশে পাওয়া যায় না…
বছর পনেরো আগে রাজশাহীতে পাওয়া যেত… এখন ওরাও করে না, বলে সবাই হেলথ কনশাস হয়ে গেছে। এই চিনির কোটিং দেওয়া মিষ্টি খেতে চায় না…
নানা মিষ্টি কেনে ফজল। তবে দানাদার একাই দু-কিলো।
দানাদার এত! বলে সামাদ।
আরে, আমি একাই এর অর্ধেক সাবাড় করে দেব। এত আর থাকবে না।
তাহলে ঠিক আছে।
একটা অটো পাওয়া গেল। তাতে উঠে বসে ফজল বলে, চলো হে, সবলসিংহপুর।
আরে মামা দাঁড়ান, আরো লোক নেবে তো! আমাদের পাঁচ টাকা করে দিতে হবে। না হয় পুরো প্যাসেঞ্জারের ভাড়া গুনতে হবে।
ঠিক আছে।
অল্পক্ষণের মধ্যে আরো চারজন পাওয়া গেল।
অটো সচল হয়। এদিকে রাস্তা পাকা নয়। সুরকিমোড়া। রাস্তা পাকা হবে কবে?
হবে। এই মোরাম দিয়ে কয়েক বছর গাড়ি চালান হয়, এভাবে রাস্তাটাকে বসিয়ে নেওয়া হয়। তারপর পিচ ঢালা হবে।
দুদিকের গেরস্থবাড়ির কিছুই চিনতে পারে না ফজল। আগে এত বাড়ি ছিল না। ফাঁকা ফাঁকা লাগত। আজ বেশ বসতি গড়ে উঠেছে।
সবলসিংহপুরের বসত এলাকায় অটো প্রবেশ করার পর আবছা সবকিছু মনে পড়ে ফজলের। বাঁয়ে বল খেলার মাঠটা আছে। মাঠের পর কাজীদের দিঘি। এটায় তারা দুপুরের স্নানে আসত। মনে পড়ে, বড়দাদা আর কাকা দুজন শীতকালে তাদের নাকে-কানে ও নাভিতে সর্ষের তেলের ফোঁটা মাখিয়ে দিতেন। দিঘির পাড়ে এসে ঝপাৎ করে লাফিয়ে পড়া। আস্তে আস্তে নামলে শীত কামড় মারত। তাই ঝাঁপিয়ে পড়া, দিঘির তলে বালি থাকায় কোনো দিন জল খোলাটে হতো না। ছোট ছোট শালুক ফুটে থাকত – কোনোটা সাদা, কোনোটা নীল। আর ছিল প্রচুর হাঁজ, মানে জলজ সব উদ্ভিদ। খুব ঘন হয়ে থাকত। ওদের মাঝ দিয়ে সাঁতার দেওয়া যেত না। গা চুলকাত। জল স্বচ্ছ। মাঝে মাঝে কুঁচোচিংড়ির দেখা মিলত। তবে ধরা যেত না। ওরা তিড়িং করে পেছনে সটকে পড়ত। অটো ঠিক তাদের ভিটের চৌহদ্দির সামনে থেমে গেল। এবার বেশ চেনা মনে হচ্ছে ফজলের। রায়মণির ডাঙ্গাটা বেশ উঁচু। আগে বেশ বড় মনে হতো। এখন দেখে ছোটই মনে হয়। এদিকে তালগাছের সারি ছিল। সেটা উধাও। একটা দোকান হয়েছে রাস্তার ডানপাশে… কাপড়ের দোকান। এক বয়স্ক ভদ্রলোক এসে পরিচয় দিলেন, আমি কাইয়ুম… আপনার ছোট বোন আমার স্ত্রী।
হাত মেলায় ফজল।
ততক্ষণে ভিটের ওপর জটলা তৈরি হয়ে গেছে। ফজল ফুপুকে চিনতে পারে। তার মায়ের বয়সী। ফর্সা, শীর্ণ একহারা চেহারা। ফুপাতো বোনকেও দেখল… ছোটবেলায় ও খুব নাদুস-নুদুস ছিল… এখন বেশ রোগাটে লাগল।
ভিটেয় উঠতেই ফুপু আমিনা ফজলকে জড়িয়ে ধরে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলে, এতদিনে ঝিকে মনে পড়ল বাবা!
চাকরি-বাকরি শেষ, এখন আসা যাবে। শামসুন নাহার, তুই এত রোগা হয়ে গেছিস কেন? তোকে বেশ মোটাকাটা দেখে গিয়েছিলাম।
ও তো বড় একটা অসুখ থেকে উঠল। এখনো অত ভালো নয়।
কী হয়েছে?
আলসার।
ও ভালো হয়ে যাবে। আজকাল আলসার কোনো অসুখই নয়।
রায়মণির ডাঙ্গার পর নতুন পুকুর। পুকুরটা আগে অনেক ভরাট ছিল। এখন জল অনেক নিচে। পাড়ের গাছপালা ঝুঁকে পড়ে আঁধার করে ফেলেছে। জলের ওপর ছোটপানাও বাসা বেঁধেছে। পুকুরের বাঁ পাড় ধরে তারা এগোয়। ডানে গিয়ে ভিটের শুরু। মোজাম্মেল চাচাদের ঘরটা পার হতেই ফজলদের নতুন ঘরটা পড়ার কথা। ওটা পুরনো হয়ে গেছে। এরপর ছিল দোতলা বাড়িটা। ওটা নেই।
ফুপু, আমাদের দোতলা ঘরটা কী হলো?
ওটা ১৯৭৮-এর বানে বসে গেল। একমাস বানের জল জমে ছিল। মাটির বাড়ি কত সহ্য করবে। আস্তে করে বসে গেল। দেয়ালের মাটি সব গলে গিয়েছিল।
দোতলার জায়গায় একতলা টানা একটা ঘর। সামনে বারান্দা। মাটির লেপা পরিচ্ছন্ন। তার আসার কথা শুনে আরো সুন্দর করে লেপা হয়েছে। একটা কাঁচা গন্ধ উঠছে।
মাঝের ভেতর ঘরে ঢুকে ফুপু বলে, বাবা, জুতো খুলে পা উঠিয়ে বসো।
ফজল ভেতর ঘরে ঢুকে দেখে একটা বড় তক্তপোশ। কমদামি তবে সদ্য পাটভাঙা চাদরঢাকা। বালিশের ওয়্যারও পরিষ্কার। সে জুতো খুলে পা তুলে বাবুকেটে বসে। মনে পড়ে ছোটবেলায় এভাবে বাবুকেটে বসত।
দাদারা ছিল চার ভাই।
সে দু-দাদাকে দেখেছে। বড়দাদা আর তার নিজের দাদা। বড় পরহেজগার মানুষ ছিল এঁরা। বড়দাদা তো তার বাবাকে পুরো বাড়িটাই উপহার দিয়ে দিলো। তার বাবা আর বড়দাদার একমাত্র ছেলে করিমচাচা ছিল সমবয়সী। করিমচাচা যক্ষ্মায় মারা যান। তখন বয়স হয়েছিল চব্বিশ। করিমচাচা মারা যাওয়ার পরে বড়দাদা সংসার-বিবাগী হয়ে যান। সব সম্পত্তি ভাইয়ের ছেলেকে দান করে এ-পরিবারেই খাওয়া-দাওয়া করতেন। নিজের সন্তান মনে করতেন বাবাকে।
বাবা চাকরি উপলক্ষে কলকাতায়। মা আর ভাইদের নিয়ে তারা থাকত বড়দাদার বাড়ির দোতলায়। আর নিচে দাদারা দুভাই। দুভাই সুর করে যখন নামাজ পড়তেন, তার কানে সব আসত। বিশেষ করে সুরা ফাহিতা তার মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গে তারা বলত সুরা ফাতেহা। ইদানীং বাংলাদেশে তা ফাতিহা। যেমন পশ্চিমবঙ্গে বলে রেজাক, বাংলাদেশে রাজ্জাক। এভাবে দুবাংলায় নানা অদল-বদল ঘটে চলেছে আরবি শব্দের উচ্চারণে।
বাইরে সামাদ তখনো দাঁড়িয়ে। ফজল বলে, আরে সামাদ, আপনি বাইরে কেন? ভেতরে আসুন।
মামা, আমি এখন যাব।
তা কি হয়? খেয়েদেয়ে যাবেন।
হ্যাঁরে ভাই সামাদ, এ কী কথা, না খেয়ে যাবি কী করে? বলে ফজলের ফুপু।
অগত্যা সামাদ ভেতরে ঢুকে জুতো খুলে চেয়ারে বসে। ঘরে একটিই ছিল চেয়ার। ফজলের ফুপু তক্তপোশের ওপর ভাইপোর পাশে বসে পিঠে øেহের পরশ দিতে থাকে।
ফজল ভাবে, আরো আগে এক-আধবার আসা উচিত ছিল।
বাবা, বেলা হয়ে গেল… খাবে-দাবে না?
ফুপু জানতে চায়।
খাবার দাও। সকালেই øান সারা।
ঠিক আছে।
এবার সব নাতিদের এক-এক করে পরিচয় করিয়ে দেয়। অন্যদেরও পরিচয় দেয়।
একসঙ্গে এতজনের পরিচয়, কিছুই মনে থাকে না ফজলের। শুধু নামের সঙ্গে মুখগুলোর দিকে দৃকপাত।
পাড়ার অন্যরা চলে যায়।
উঠোনে একটা ছোট চৌকির ওপর বসে ফজল আর সামাদ হাতমুখ ধুয়ে নেয়। ঝাড়নে হাতমুখ মুছে তারা আবার ভেতর ঘরে। সেই বিছানায় বসতে হলো, তবে পুরনো খবরের কাগজ পাতা হয়েছে। একটা ভর্তা ফজলের নজরে পড়ে। কুঁচোচিংড়ি আর পেঁয়াজ দিয়ে ভর্তা। তাতে পাতিলেবুর রস মাখানো। ভর্তা মুখে দিয়ে ফজল বলে, কতদিন পর এমন স্বাদ পেলাম।
আমি করেছি, ফজলের ফুপু উৎসাহ নিয়ে বলে।
আরে, আমার মনে হচ্ছিল দাদির হাতে তৈরি। দাদি ছোটখাটো জিনিস দিয়ে কী সুস্বাদু সব সালুন তৈরি করত, তার ইয়ত্তা নেই। মনে পড়ে পুঁইশাকের ফুল, কচু আর বেগুন দিয়ে একটা চচ্চড়ি করতেন, অপূর্ব। দাদির হাতের সব খাবার অমৃত মনে হতো। হয়তো গরিবদের মুখে সব খাবারই অমৃত মনে হয়। বাবার একার রোজগারে অত বড় সংসার চলত…
দীর্ঘশ্বাস পড়ে ফজলের ফুপুর। বড়ভাইয়ের কথা মনে পড়ায় তার চোখে জল আসে।
তোমার বাবা আমাকে বড় ভালোবাসত। পুরো সম্পত্তিটা আমার নামে লিখে দিলে… আমি বারবার বললাম, ভাই নিজের ছেলেমেয়ের নামে অর্ধেক রেখে দাও। যদি ওরা এখানে কিছু করতে চায়? ভাই বললে, আমার ছেলেমেয়েরা যদি কিছু করতে চায় তুমি তখন দিয়ে দিও। কোনোমতেই আমার কথা শুনলেন না।
এখানে কেউ আর আসবে না ফুপু। তবে হ্যাঁ, একটা ছোট দুরুমের ঘর করে রাখলে কখনো যদি কেউ আসে সময় কাটিয়ে যেতে পারবে। মূলত ব্যবহার করবে তোমরাই।
সে তো ভালো কথা। তুমি সব ভাইবোনকে বলে তেমন ছোট একটা ঘর তুলে নাও।
আমরা সবাই মিলে দেখাশোনা করব। বলো তো আমি থাকতে থাকতে তোমাদের নামে জায়গা লিখে দেব।
আরে না, জায়গা লিখতে হবে না। আর এ তো ভাবছি মাত্র। সত্যি কাজ করলে তখন দেখা যাবে।
খাওয়া শেষে সামাদ বিদায় নিলেন। এখন বিশ্রাম নাও বাবা, বিকেলে বেরিও Ñ বলে ফুপু।
সাড়ে ৫টার দিকে ফুপুকে নিয়ে বেরোয় ফজল। বাড়ির পেছনে যে ফাঁকা জায়গাটা ছিল ওখানে দাদি পুঁইমাচা করত। ওটা ভরাট হয়ে গেছে, ছোটদাদার একমাত্র ছেলে মর্তুজাচাচা পাকাবাড়ি করেছে। চাচার সঙ্গে দেখা। ফজলের মনে পড়ে চাচার বিয়েতে সে হয়েছিল মিতবর। এক পালকি চড়ে তারা মমকপুর গিয়েছিল। সাদা সেরোয়ানি, সাদা পাজামা আর জরিদার টুপি পরে চাচাকে বড় মানিয়েছিল। চাচা এখন প্রায় এক পা পরপারে দিয়ে ফেলেছে। ম্লান হেসে বলে, ভালো আছো বাবা?
ভালো আছি চাচা। তোমাদের কথা খুব মনে পড়ত। কিন্তু জানো তো সরকারি চাকরি… আর পাসপোর্ট-ভিসার ঝামেলা, তারপর পকেটে তো কিছু জমতে হবে। এখন এটা তো আর আমার দেশ নয়, বিদেশযাত্রা বলে কথা।
তা তো বটেই বাবা। তোমার চাচির শরীরও ভালো যাচ্ছে না।
এই সময় তার চাচিও বেরিয়ে আসে। বয়সের ভার সারা অবয়বে।
কেমন আছো বাবা?
এই তো ভালো।
বারেক এসেছো বাবা, আর কয়েকদিন পরে এলে বুড়ো-বুড়ি কাউকেই আর দেখতে পেতে না। তোমার মা কেমন আছেন?
তারও অবস্থা ভালো নয়। হাঁটুর ব্যথায় কাতর।
বার্ধক্যের এ-অসুখ থেকে কারো মুক্তি নেই। ঠিক আছে বাবা, পাড়াটা দেখে নাও, তারপর কথা হবে। আর দেখবেই বা কী। ছিল বারোটা পরিবার, আজ সাড়ে তিনখানা Ñ বলেন মর্তুজাচাচা।
আসি চাচা, ওদিকটা ঘুরি। কবরস্থানটা দেখতে হবে।
ও আর কী দেখবে বাবা। এখন লোকজন নেই, সব পোড়োভূমি হয়ে রয়েছে। দেখাশোনার কেউ নেই। তোমরা এক-আধজন যদি এদিকে থাকতে তাহলে সংস্কারের আশা থাকত।
তা ঠিক, বলে ফজল ফুপুকে সঙ্গে নিয়ে এগোয়।
এ-পাড়ায় পাকাবাড়ি ছিল একমাত্র হাফেজ ফুপাদের। ফুপু আনসুরা ছিল তার মেজদাদার মেয়ে। ফুপু ছিল ফর্সা, লম্বা; মুখে ছিল কিছু বসন্তের দাগ। দুজনই বাংলাদেশে চলে যায়। ফুপুর শাশুড়ি দাদি একা ছিল ঘর পাহারায়। তিনি মারা যাওয়ার পর থেকে ঘর পড়ে আছে। সব ভেঙে ভেঙে পড়ছে। থাকার দেখার কেউ নেই।
পাশে করিমভাইদের দোতলা মাটির ঘরটাও পড়ে গেছে। ওরা চার ভাই ঢাকায় মোহাম্মদপুরে। ওদের মধ্যে করিমভাই মারা গেছেন। বাকিরা বেঁচে আছে কিনা তারও হদিস নেই। যোগাযোগ নেই কারো সঙ্গে।
এর পাশে লাগালাগি ছিল কালোর নানাবাড়ি। ওটারও ভগ্নদশা। কালো বেঁচে আছে। সে এখানে থাকছে না। ছোটবেলায় নানার সঙ্গে থাকত। একটু হাবাগোবা ছিল কালো। তাই ওকে নিয়ে সবাই রঙ্গ-তামাশা করত।
পুরো পাড়া ঘুরে ফজলের মনে হয়, একসময় কলেরা আর দুর্ভিক্ষে যেমন গ্রামের অবস্থা হতো, দেশভাগের পর হয়েছে তেমনি। এ-বাংলায় মুসলমানদের ভিটা শূন্য। ও-বাংলায় হিন্দুর ভিটেয় ঘুঘু চরছে। আটশো বছর একসঙ্গে থেকেও বাঙালি বাঙালি হতে পারল না।
পাড়ার ভিটা ছাড়িয়ে তারা করবস্থানে হাজির। পুরো জায়গাটা বাঁশগাছ ছাওয়া। শুকনো পাতায় ভরে রয়েছে। ফজলের মনে ভাসে পুরনো দৃশ্য… বয়স্ক মহিলারা পাতা ঝাঁট দিয়ে থলি ভরছে। তার দাদিদের দেখেছে এই কাজ করতে। অবশ্য বাড়ির বউরা এই কাজ করত না। তাদের শাশুড়ি হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতো।
ফুপু একটা কবর দেখিয়ে বললে, এটা তোমার দাদার কবর। আর ওর পাশেরটা তোমার বড়দাদার, দুভাইয়ে খুব ভাব ছিল। তাই পাশাপাশি কবর দেওয়া হয়েছে। দুজন কীভাবে মরেছে তো জানো?
জানি। ম্যালেরিয়ায়।
হ্যাঁ।
সে আমরা এদেশে থাকতেই। আমি তখন ছিলাম মামাবাড়ি।
হ্যাঁ। প্রথম মরল তোমার বড়দাদা। তার পনেরো দিন পর তোমার দাদা। সংসারটা একেবারে খালি হয়ে গেল। ওরা ছিল সংসারের শোভা।
তা ঠিক বলেছ। বয়স্করা সংসারের একটা কেন্দ্রবিন্দু হয়ে থাকে।
তারপরে তোমরা গেলে চলে। ঘরে শুধু তোমার দাদি আর ছোটচাটা ফনু। তারপর তো বড়ভাই সবাইকে নিয়ে গেল। যাওয়ার সময় আমাকে ডেকে ভিটা আর সব সম্পত্তি দেখার ভার দিয়ে দিলো। আমি তখন নিজের ভিটা ছেড়ে এখানে চলে আসি।
যাক, ভালোই হয়েছে। তোমরা ভোগদখল করা মানে আমাদের হাতেই থাকল।
দু-দাদার কবরের মাথার দিকে একটা ফলক দেওয়া যায় না? একটা পাথরের ফলকে দুজনের নাম আর মৃত্যুর বছরটা লেখা থাকল?
তা তো ভালোই হয়। রাজহাটিতে পাথরের ফলকে নাম খোদাইয়ের দোকান আছে। দেখি কাল রাজহাটি যেতে হবে।
দেখতে দেখতে সন্ধ্যা নেমে এলো।
বাঁশঝাড় জায়গাটাকে একটা ভুতুড়ে চেহারা দেয়।
কবরস্থান থেকে তারা ঘরে ফিরতে থাকে। কারো মুখে কোনো কথা নেই।
ঘরে ঢুকে ফুপু বাতি জ্বালিয়ে দেয়।
যখন বিদ্যুৎবাতি ছিল না সবাই হারিকেন জ্বালাত এই সময়, সন্ধ্যা-দীপ দেওয়া বাঙালির চিরকালের রীতি। এখন তা বিদ্যুৎবাতিতে রূপান্তরিত। ফজল খেয়াল করেছে, তার মাও ঢাকায় সন্ধ্যা হলেই ফ্ল্যাটবাড়িতে সব কামরায় বাতি জ্বালিয়ে দিত। মায়েরা সেই চিরকালের মা। তাদের হৃদয়ে পরিবারের সবার জন্যে মঙ্গল কামনার বাতি জ্বলছে।
অনেকদিন পর সামনে সরুচাকলি পিঠে পেয়ে সে তার শৈশবে ফিরে গেল। বারবার তার দাদির কথা মনে হচ্ছিল।
দাদির হাতের সব পিঠেই ছিল মজার। তার মধ্যে চিতই আর সরুচাকলি ছিল সবার ওপরে।
চা-পর্ব শেষে ফজল গ্রামের সবকিছুর খবর নিতে থাকে।
রাত ৮টার দিকে ফুপু ভাত দেওয়ার ব্যবস্থা করে। গ্রামে ৮টাই বেশ রাত।
খাবার এসে গেলে ফজল ভাতের থালায় হাত লাগায়।
এই সময় দরজায় এক মহিলা এসে দাঁড়ায়।
চমকে ওঠে ফজল। সে তার প্রথমদিককার শৈশবস্মৃতিতে ফিরে যায়। এমনিই তো সে দেখতে ছিল। ফর্সা, লম্বা, কটা চোখ…
তখন তার তিন-চার বছর বয়স হবে। পাশের পাড়ায় মা তাকে নিয়ে গেছে সমবয়সী কাজিবাড়ির বউয়ের সঙ্গে আলাপ করতে। মায়ের কোল থেকে কাজিমা তাকে কোলে করে রাখে। কথাবার্তা সেরে মা ফিরবে। তাকে কোলে নিতে গেলে সে মায়ের কাছে যেতে চায় না। কাজিমাকে জড়িয়ে ধরে। তখন কাজিমা বলে, ভাবি তুমি যাও। আমি পরে নিয়ে আসছি। ফজল আজো এর রহস্য ভেদ করতে পারেনি, কেন সে মায়ের কাছে যেতে চায়নি এবং কাজিমাকে এমনভাবে জড়িয়ে ধরেছিল। সেই থেকে কাজিমা তাকে বলত আমার ছেলে এবং সময়ে-অসময়ে প্রায়ই তার ছেলের কাছে আসত এবং আদর করে যেত।
ফুপু এই সময় ফজলকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে।
বলে, ওকে চিনতে পারবে না বাবা। তোমার কাজীমাকে মনে আছে? ও তোমার কাজীমার মেয়ে সালমা।
তাই তো, আমি যেন কাজিমাকেই সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখছিলাম।
সালমা ভেতরে ঢুকে ফজলের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে।
বলে, আপনি এসেছেন শুনেছি… আসব আসব করে সময় করতে পারিনি… রাত হয়ে গেল।
কাজীমা কেমন আছেন?
মা!
ওর মা তো বছরখানেক হলো মারা গেছে। জানায় ফুপু।
মা না, সালমা বলে, বড়ভাই, তোমার কথা খুব বলত। খালি বলত, আমার ছেলেকে খবর দাও যে তার মায়ের খুব শরীর খারাপ… খবর পেলে সে নিশ্চয় আসবে… আপনার সঙ্গে আমাদের আর যোগাযোগ করা হয়ে ওঠেনি। মা বারবার বলত, আমার ছেলেকে খুব দেখতে ইচ্ছা করছে। বলতে বলতে গলা ধরে আসে সালমার।
ভাতের থালা থেকে হাত উঠিয়ে নেয় ফজল। ভাবে, বছরখানেক আগে যদি আসতে পারত তাহলে কাজিমার সঙ্গে দেখা হতো।
কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থেকে ফজল ভাতের থালাটা ঠেলে দিয়ে বলে, ফুপু, খাবারটা রেখে দাও… পরে খাব।