এ-অঞ্চলে খুন কিংবা গুম নতুন কিছু নয়। মাঝেমাঝেই ঘটে এমন ঘটনা। অধিকাংশ ক্ষেত্রে চরের জমিজমা ও পারিবারিক রেষারেষি নিয়ে বিরোধ হয়। বিরোধ গড়িয়ে যায় হত্যাকাণ্ড পর্যন্ত। হত্যাকাণ্ড হলে পুলিশের পকেট ভারী হয়। তারা দায়ী ব্যক্তিকে ধরে আদালতে চালান করে দেয়। আবার পয়সাও খায় তার কাছ থেকে। যে খুন বা গুম হয়, তার স্বজনের কাছ থেকেও ভালো টাকাকড়ি পাওয়া যায়। পুলিশকে টাকা না দিলে নিহত ব্যক্তির জন্য ন্যায়বিচার পাওয়া যায় না। ন্যায়বিচার মানে টাকা।
থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সালাউদ্দিন মিয়াকে লোকে বলে শালাউদ্দিন। এমন বদখত মানুষ পুলিশের মধ্যে আর দুটি আছে কিনা কে জানে! টাকা ছাড়া সে আর কিছু বোঝে না। না, না কথাটা ঠিক হলো না। টাকা ছাড়া সে আরো দুটো জিনিস বোঝে। একটা মদ,
অন্যটা মেয়েমানুষ।
জেলার এসপি থানা পরিদর্শনে এসেছিলেন। অপরাধের চার্ট দেখে তিনি রীতিমতো ক্ষুব্ধ। ওসিকে বললেন, আপনার এখানে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড এতো বেশি কেন?
কোথায় স্যার? সালাউদ্দিন বলল, এসব তো এখানকার রেগুলার ঘটনা। আমার এলাকায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নেই বললেই চলে।
আপনার এলাকায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নেই!
না স্যার। এখানে যা হচ্ছে তাকে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বলা যায় না।
কি আশ্চর্য!
আশ্চর্যের কথাই বলতে হবে। এ-এলাকায় যারা খুন করে এবং যারা খুন হয় তারা কেউ সন্ত্রাসী নয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের বিরুদ্ধে থানায় একটা জিডিও নেই। এখানে যা হয় তা হচ্ছে, চরের জমির মালিকানা নিয়ে মারামারি কিংবা পারিবারিক বিষয় নিয়ে রেষারেষি, এমনকি খুন পর্যন্ত।
পারিবারিক বিষয় নিয়ে খুন!
জি স্যার! এ-অঞ্চলে পরকীয়া খুব বেশি চলে। পরকীয়া মানে হচ্ছে –
আমাকে অর্থ বোঝাতে হবে না।
রাইট স্যার। বিষয়টা কী, আপনি নিশ্চয়ই তা জানেন। এখানকার অনেক লোক আবার বিদেশে চাকরি করে। তখন তাদের স্ত্রীরা দেশে একা থাকে। স্বামী বিদেশে আর স্ত্রী দেশে থাকলে যা হওয়ার তাই হয়।
থাক, থাক। আমাকে আর এসব শোনাতে হবে না। এসপি কাগজপত্র দেখতে দেখতে গম্ভীর মুখে বললেন, আপনার এলাকায় যে-হারে অপরাধ বেড়ে যাচ্ছে, তা উদ্বেগজনক।
অপরাধের সংখ্যা বাড়ার আরেকটা কারণ আছে স্যার।
কী কারণ?
আমরা সব অপরাধই থানায় রেকর্ড করি। অন্যান্য থানায় তো সব ঘটনার রেকর্ডই হয় না। ওসব থানায় ডাকাতি হলে লিখে রাখে চুরি। এজন্য আমার এলাকায় ডাকাতির কেসও বেশি।
কিন্তু এমন হলে তো আমি আপনাকে এখানে রাখতে পারব না।
সেটা আপনার মেহেরবানি স্যার। আমি নিজেও এখানে থাকতে ইচ্ছুক নই। যদি ঢাকায় একটা পোস্টিং পাওয়া যেত।
আপনি না এর আগে ঢাকায় ছিলেন!
ছিলাম স্যার! আমার ফ্যামিলি এখনো ঢাকায়। আপনি স্যার একটু দয়া করে –
এসপি কথাটার কোনো উত্তর দিলেন না। থানা পরিদর্শনের নোট লিখতে শুরু করলেন।
এসপি থানা থেকে প্রস্থানের পর নিজের চেয়ারে বসে আপনমনে হাসল সালাউদ্দিন মিয়া। পুলিশের বড়কর্তাদের কার কতটুকু ক্ষমতা জানা আছে তার। এখানকার এমপি ক্ষমতাসীন পার্টির হাইকমান্ডের সদস্য। তার হুকুম ছাড়া গাছের পাতাটিও নড়ে না। ওসির সঙ্গে যে তার দহরম-মহরম তা বোধহয় এসপি বাহাদুর জানে না। এসপি তো দূরের কথা, আরো ওপরের কর্মকর্তা হলেও সালাউদ্দিন মিয়াকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে বদলি করা সম্ভব নয়।
থানার সেকেন্ড অফিসার জমির মল্লিক ওসির অফিসকক্ষে ঢুকে বলল, আবার সেই ঘটনা স্যার।
কী ব্যাপার? জিজ্ঞাসা করল সালাউদ্দিন মিয়া।
একজন প্রায় খুন, আরেকজন পলাতক।
প্রায় খুন মানে?
মানে লোকটা পলাতক ব্যক্তির হাতে মারাত্মকভাবে জখম হয়েছে। বাঁচবে বলে মনে হয় না। আমি নিজে ওখানে গিয়েছিলাম। আহত লোকটাকে উপজেলা হাসপাতালে পৌঁছে দিয়ে এলাম। লোকটা না বাঁচলে আমাদের থানায় মার্ডারের সংখ্যা আরো বেড়ে যাবে।
আহত ব্যক্তি নিহত না হলে তাকে মার্ডার হিসেবে ধরা যায় না। কিন্তু ঘটনাটা কী নিয়ে?
সেই একই কারণ স্যার। পলাতক ব্যক্তির সুন্দরী স্ত্রীর সঙ্গে আহত ব্যক্তির আশনাই ছিল। এসব নিয়ে প্রথমে কথাকাটাকাটি ও ঝগড়া। তারপর উভয়ের মধ্যে মারামারি। পলাতক ব্যক্তি ধারালো অস্ত্র ব্যবহার করেছে।
অস্ত্রটি এখন কোথায়?
সেটা আমি আলামত হিসেবে নিয়ে এসেছি। একটু হেসে জমির মল্লিক বলল, বারো বছরের চাকরি স্যার! এসব ব্যাপারে আমার কোনো ভুল হয় না।
কেউ কি মামলা করতে এসেছে?
আহত ব্যক্তির ভাই মামলা করতে চায়। আমি বলেছি, আগে ওসি সাহেব কী বলেন দেখি।
ঠিক আছে। আপনি এজাহার লিখে নিন।
জি স্যার।
সেকেন্ড অফিসার চলে যেতে সালাউদ্দিন মিয়া একটা সিগারেট ধরাল। সেন্ট্রিকে বলে দিলো এখন যেন কেউ তার ঘরে না ঢোকে। এর একটা কারণ আছে। এই থানাপ্রাঙ্গণকে ধূমপানমুক্ত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। ঢাকা থেকে একবার দু-তিনজন ফিল্মস্টার এসেছিল মাদকবিরোধী প্রচারকার্য চালাতে। তাদের উদ্যোগেই এমপি সাহেব থানাকে, মানে থানাপ্রাঙ্গণকে ধূমপানমুক্ত এলাকা বলে ঘোষণা করলেন। পত্রিকায় তার ছবিও বেরিয়েছিল। ভাগ্যিস ওরা থানাটাকে মদমুক্ত এলাকা ঘোষণা করেনি। মাদকমুক্ত অভিযান বলেই নিজেরা প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে।
অকস্মাৎ ঘরের দরজা ঠেলে যে ঘরে ঢুকল, তাকে দেখে সালাউদ্দিন মিয়া রীতিমতো চমকিত। একজন সুন্দরী মহিলা তার টেবিলের কাছে এসে দাঁড়াল। সেন্ট্রিও ঘরের ভেতর এসেছিল তার পেছনে পেছনে। বোঝাতে চাচ্ছিল, মহিলা তার নিষেধ অমান্য করে অফিসে ঢুকে পড়েছে। সালাউদ্দিন ইঙ্গিতে সেন্ট্রিকে সরে যেতে বলল। তারপর ইশারায় বসতে অনুরোধ করল মহিলাকে। বলল, কী করতে পারি বলুন।
করতে তো পারেন অনেক কিছু। কিন্তু কিছুই করছেন না।
কী করছি না?
বলছি। আগে এক গ্লাস পানি খেয়ে নিই।
অবশ্যই। সালাউদ্দিন মিয়া বেল টিপে পানি আনতে হুকুম দিলো।
অতঃপর মহিলা সবিস্তারে যা বর্ণনা করল, তার মর্মার্থ হলো : কয়েক ঘণ্টা আগে নদীর পারে যে মারামারির ঘটনা ঘটেছে, সেটা নিজেদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি ছাড়া আর কিছু নয়। এ-বিষয় নিয়ে থানায় মামলা দেওয়া হলে পুলিশেরই বদনাম হবে। থানার পুলিশ সারাদেশেই কত মহৎ দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। তারা ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামালে দেশটার কী হবে? ওসি সাহেব দয়া করে তার বাড়িতে এলে বিষয়টা সে আরো ভালোভাবে বুঝিয়ে বলতে পারবে। বকুলের বাড়ি বললে সবাই তাকে চিনিয়ে দেবে।
কয়েকদিন পর বকুলের বাড়ি থেকে ফিরে সালাউদ্দিন মিয়া ডেকে পাঠাল সেকেন্ড অফিসারকে। বলল, এ কী করেছেন?
কী করেছি স্যার?
দুইপক্ষের মধ্যে পারিবারিক বিরোধ। আর আপনি মামলা করেছেন একপক্ষের। এসব নিয়ে মামলা করার কী আছে?
তাহলে কি ফাইনাল রিপোর্ট দিয়ে দেব? মামলা খতম করে দেবো স্যার?
একটু ভেবে সালাউদ্দিন বলল, আমি সেটা বলছি না। আপনি বরং অপরপক্ষেরও একটা মামলা নিয়ে নিন।
কী মামলা স্যার?
বকুলের স্বামীকে গুম করা হয়েছে।
গুম!
অবশ্যই গুম। লোকটার এতদিন ধরে খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। এটা গুম ছাড়া আর কী?
ঠিক আছে স্যার। তাই হবে।
জমির মল্লিক চলে যাচ্ছিল। ওসি পেছন থেকে ডাকল, শুনুন।
জি স্যার।
লোকটা তো হাসপাতালে ভালো হয়ে উঠেছে। আপনার কথামতো খুন হয়নি।
হ্যাঁ স্যার।
ওর বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। সালাউদ্দিন বলল, অপরপক্ষের মানুষ গুমের মামলায় তাকে শ্যোন অ্যারেস্ট দেখিয়ে দিন। পাহারার ব্যবস্থা করুন, যাতে পালিয়ে না যায়।
জমির মল্লিক কথা না বলে মাথা নাড়ল। মনে মনে ভাবল, ওসি ব্যাটা বড় মতলববাজ। কখন যে কী বলে তার ঠিক নেই।
দুই
আবুল কালাম খুব একটা রাগী লোক নয়। তবে রাগ একবার মাথায় উঠে গেলে তার কোনো দিশা থাকে না। বকুলের সঙ্গে যে হামিদ ব্যাপারীর আশনাই হয়েছে, এমন একটা কানাঘুষা আগেই শোনা গিয়েছিল। তবে বকুল বিষয়টা ঝেড়ে অস্বীকার করায় তাকে বিশ্বাস করে সে এতদিন চুপ ছিল। অবশেষে নিজেই ফাঁদ পেতেছিল আসল সত্য উদ্ঘাটনের জন্য। গতরাতে বকুলকে বলে রেখেছিল সে জেলাসদরে যাবে। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে সেখানে। বকুলও সঙ্গে যাওয়ার জন্য আবদার ধরেছিল। কিন্তু দুদিন থাকতে হবে বলে তাকে যেতে বারণ করল। বরং ভবিষ্যতে তাকে নিয়ে ঢাকায় বেড়াতে যাওয়ার প্রতিশ্র“তি দিলো।
একটা দিনের তর সয়নি বকুলের। হামিদ ব্যাপারীকে খবর দিয়ে জানিয়েছে দুপুরবেলাতেই। নিজের হাতে মুরগি রান্না করে খাইয়েছে। তারপর বিকালবেলায় ওরা দুজন যখন বিছানায়, ঠিক তখনই বাড়ি ফিরল আবুল কালাম। প্রায় হাতেনাতে ধরা পড়ল হামিদ ব্যাপারী। দৌড়ে পালাতে চেয়েছিল নদীর পার ধরে। আবুল কালামও অস্ত্রহাতে নিয়ে ধাওয়া করেছিল তাকে। এরপর যা হওয়ার তাই হয়েছে।
আবুল কালামের অস্ত্রের আঘাতে মারাত্মকভাবে জখম হয়েছে হামিদ ব্যাপারী। পুলিশ এসে তাকে তুলে নিয়ে গেল উপজেলা হাসপাতালে। অন্যদিকে আবুল কালাম পালিয়েছিল কুড়ি মাইল দূরে অচেনা এক গ্রামে। আসার সময় পরিচিত একজন খবর দিয়েছিল, হামিদ ব্যাপারী মারা গেছে। চারদিকে চাউর হয়ে গেছে কথাটা। এরপর অচেনা গ্রামকেও নিরাপদ মনে হয়নি আবুল কালামের। সীমান্ত পেরিয়ে সে আগরতলায় আশ্রয় নিয়েছিল। চোরাচালানকারীদের দলে নাম লেখাতে তার তেমন অসুবিধা হয়নি। কিন্তু যা-ই করুক না কেন, দেশের সীমানার এপারে আর কখনো নয়।
প্রথম কিছুদিন মন খারাপ হয়েছিল আবুল কালামের। মা-বাবা আত্মীয়-স্বজন কেউই ছিল না তার। পৃথিবীতে একমাত্র আপনজন বলতে তার বিয়ে করা বউ বকুল। বকুলকে পেয়ে সুখ কাকে বলে সেই উপলব্ধি জমেছিল তার মনে। কখনো ভাবতে পারেনি তার সুখের সংসারে ঘুণপোকা বাসা বেঁধেছে। বিশ্বাসের ঘরে এভাবে আগুন লাগবে, তা স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি সে। সবই তো উজাড় করে দিয়েছিল বকুলকে। গঞ্জের দোকানের আয়, জমিজমার ফসল বিক্রির টাকা নির্বিবাদে তুলে দিয়েছে সে বকুলের হাতে। কিসের অভাব ছিল তার? হয়তো আবুল কালাম তাকে কোনো সন্তান দিতে পারেনি। সেজন্যে তো বকুলও দায়ী হতে পারে! এতবড় বিশ্বাসঘাতকতা কী করে করতে পারল বকুল!
বিদেশ বিভূঁইয়ে এসে আবুল কালাম মনে মনে ভাবল, আর কখনো দেশে ফিরবে না সে। টাকা-পয়সা কিছু হাতে এলে তা দিয়ে আগরতলাতেই একটা দোকান দিয়ে বসবে। তারপর জীবনের আর কোনো পরিকল্পনার কথা মনে হয়নি তার। কিংবা বলা যায়, আর কিছু ভাবতে ভয় পেয়েছে সে। মাঝে মাঝে নিজেকে যখন হত্যাকারী মনে হয়েছে, তখন তার সেই ভয় প্রবলভাবে জেঁকে বসেছে মনের ভেতর।
অন্যদিকে বকুলের জীবনে শুরু হয়েছে ভিন্ন নাটক। থানার কর্মকর্তার সঙ্গে সে দেখা করতে গিয়েছিল প্রতিবেশীদের প্ররোচনায়। তাকে বোঝানো হয়েছিল আবুল কালাম আর হামিদ ব্যাপারীর মধ্যে মারামারি যা-কিছু ঘটেছে, তা এখনই চাপা দিতে না পারলে হুজ্জত অনেক বেড়ে যাবে। আইন-আদালত হলে বকুলও তাতে ফেঁসে যেতে পারে। এ-অবস্থায় ওসি সাহেবকে গিয়ে ধরতে পারলে সবদিক রক্ষা হয়। বকুল শুনেছে ওসি লোকটা খুবই ভালো। মহিলাদের দিকে সবসময় সুনজর তার।
থানার সিপাই আদিল এসে খবর জানাল, ওসি সাহেব ঘটনাটা সরেজমিন তদন্ত করতে এসেছেন। তার আগমনবার্তা পেয়ে বকুল একটা মুরগি জবাই দিলো। উপজেলা সদরের ওসি বলে কথা। তাকে ঠিকমতো আদরযতœ না করা হলে কোথাকার পানি কোথায় গড়িয়ে যাবে, কে জানে! আদিল অবশ্য কানে কানে বলেছে, মুরগির মাংসটা যেন কষা কষা হয়, স্যার বোতল নিয়ে আসবে। দুপুরবেলা খাওয়ার পরে ওসি স্যার বিশ্রাম নেবে এখানে। তখন তাকে কেউ বিরক্ত করতে পারবে না। খুন আর গুমের মামলা সাংঘাতিক ব্যাপার। মামলার বাদী হিসেবে বকুল ছাড়া আর কারো সঙ্গে কথা বলবে না স্যার।
ওসি সালাউদ্দিনের আগমনে গ্রামে দু-চারজন মাতবর গোছের লোক কথা বলতে এসেছিল। আদিল তাদের হটিয়ে দিয়ে থানায় গিয়ে দেখা করতে বলল। এবারের মামলাটা একটা গোপন বিষয় নিয়ে। সেটার তদন্ত গোপনেই করতে হবে। বাইরের লোকের কাছে এসব বিষয় জানাজানি হলে গ্রামের বদনাম, থানারও বদনাম। এসব বদনাম একেবারেই পছন্দ করে না ওসি স্যার।
দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর বকুল পানের খিলি সাজিয়ে সামনে ধরল সালাউদ্দিনের। মামলার প্রসঙ্গ তুলে পান চিবুতে চিবুতে ওসি বলল, খুব বিপদ হয়েছে এই মামলা নিয়ে।
কার বিপদ স্যার?
কার আবার! তোমার। একদিকে খুন আর আরেকদিকে গুমের মামলা। একদিকে হামিদ ব্যাপারী, আরেকদিকে আবুল কালাম। তুমি কার দিকে বলো?
আমি মধ্যখানে স্যার। আমার কোনো পক্ষ নেই। বকুল বুদ্ধি করে বলল কথাটা।
না, তোমার মধ্যখানে থাকাও ঠিক হবে না। খুন কিংবা গুমের মামলায় তুমি নেই। আমি তোমাকে কোথাও জড়াতে চাই না বলে আচমকা সালাউদ্দিন জড়িয়ে ধরল বকুলকে।
এ কী করছেন আপনি? লোকজন কেউ এলে –
এখন কেউ আসবে না। এখন এজাহার লেখার সময়। ঘরের বাইরে আদিল পাহারা দিচ্ছে। তোমার কোনো ভয় নেই।
আপনি থাকতে আমার আবার কী ভয়?
ঠিক বলেছ। আমি থাকতে – হুঁ! আমি চিরকাল থাকব তোমার সঙ্গে। বকুলকে বুকের ওপর টেনে নিয়ে ওসি বলল, একটু মদ খাও না আমার সঙ্গে। বিদেশি মাল। একা একা খেলে কিছুই জমে না।
মদ খেলে আমার মাথা ঠিক থাকে না। একদিন খেয়েছিলাম।
আজ আবার খাও। সালাউদ্দিন নিজের গ্লাসটাই তুলে ধরল ওর মুখের দিকে। বলল, মাথা ঠিক থাকার দরকার কী? আমারও তো মাল খেলে মাথা ঠিক থাকে না। আর মাথা ঠিক না থাকলে কী যে করে ফেলি! নিজেকে তখন ধরে রাখতে পারি না। আরেক ঢোক খাও না তুমি।
বকুল আরেক ঢোক খেল। শরীরে কেমন কেমন লাগছে। সেটা কি মদ খাওয়ার জন্য, না লোকটার আলিঙ্গনের জন্য, ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। পুরুষ মানুষগুলো আসলে একই রকম। হাতের কাছে মেয়েলোক পেলে পাগল হয়ে যায়। তবে ওদের শান্ত করার কৌশল জানা আছে বকুলের। পুরুষ মানুষ তো আর কম দেখা হলো না জীবনে।
সারাবিকাল এজাহার দিয়ে আর এজাহার লিখে কাটল দুজনের। একসময়ে বকুল বলল, আপনি যে বললেন খুনের মামলা! কিন্তু শুনলাম হামিদ ব্যাপারী চিকিৎসায় ভালো হয়ে উঠেছে হাসপাতালে।
এসব ব্যাপারে তোমার চিন্তার কারণ নেই। আমি তাকে গুমের মামলায় ফাঁসিয়ে দেব। দু-চার বছর জেল খাটাব তাকে।
তাকে জেল খাটাবেন কেন?
জেল না খাটালে সে সুস্থ হয়ে আবার তোমার সঙ্গে আশনাই শুরু করবে। আমি তা চাই না। এখন থেকে তুমি শুধু আমার।
কিন্তু আবুল কালাম যদি ফিরে আসে? সে তো আর সত্যি সত্যি খুন করেনি।
পুলিশের খাতায় সে গুম হয়ে গেছে। আবার যদি ফিরে আসে, তাহলে সত্যি সত্যি গুম করে ফেলা হবে।
স্যার! আপনি খুব কড়া লোক।
কড়া বলেই তো এই থানায় এতদিন ধরে টিকে আছি। আমার থানায় কোনো খুন-খারাবি নেই, সন্ত্রাসী নেই। আমার ভয়ে বাঘে-গরুতে একঘাটে পানি খায়।
তাহলে আপনি কী? আপনি কি সিংহ? বনের রাজা?
বনের রাজা না হই, আজ থেকে আমি তোমার মনের রাজা। আর তুমি আমার রানি।
রানি তো বললেন। কিন্তু রানির সোনাদানা আর অলঙ্কার কই?
আমি তোমাকে সোনা দিয়ে মুড়িয়ে দেবো। সালাউদ্দিন বলল, শুধু মনে রেখো, আবুল কালাম বা হামিদ ব্যাপারী যেন তোমার ত্রিসীমানায় ভিড়তে না পারে। ওদের খোঁজখবর পেলে আমাকে সঙ্গে সঙ্গে জানিয়ে দেবে। আমি দুটোকেই দড়ি দিয়ে ঝুলিয়ে রাখব।
আপনি খুব হিংসুটে। বকুল রসিকতা করে বলল, তাদের দোষ কী?
দোষ কী মানে! সালাউদ্দিন দাঁতে দাঁত ঘষে বলল, তোমাকে কেউ নষ্ট করবে, আমি তা হতে দেব না।
তিন
হামিদ ব্যাপারী আসলেই খুব ভাগ্যবান। ভাগ্যবান না হলে অবধারিত মৃত্যুর হাত থেকে এভাবে কেউ বেঁচে যায়? একটা কিরিচ দিয়ে আবুল কালাম বুক বরাবর পাড় দিয়েছিল তার। ওটার বেশ খানিকটা ঢুকে গিয়েছিল শরীরের ভেতর। কিন্তু কিরিচটা যে বুকের ভেতরে ঢোকেনি, তা বুঝতে পারেনি আবুল কালাম। হামিদ ব্যাপারী মাটিতে পড়ে যাওয়ার পর যখন রক্তে সারা শরীর ভিজে উঠল, তখন আবুল কালাম কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিল। বাড়িতে ফিরে বকুলকে বলল, ওটাকে মেরে ফেলেছি।
এ তুমি কী করলে?
মাগি তোকেও আজ শেষ করব। বলে সে এগিয়ে গেল বকুলের দিকে। বকুল তখন প্রাণপণে চিৎকার করে উঠেছে ‘বাঁচাও বাঁচাও’ বলে। আশেপাশের লোকজন ছুটে এলো। আবুল কালামের হুঁশ হলো, বকুলকে আঘাত করার জন্য তার কাছে অস্ত্র কিছু নেই। সে বকুলের গলা টিপে ধরতে গেল। কিন্তু প্রতিবেশীরা প্রতিহত করায় তা সম্ভব হলো না। সে হামিদ ব্যাপারীকে খুন করেছে বলে দুজন তাকে ধরে রাখতে চাইল। ততক্ষণে তার মনে হয়েছে, এখন আত্মরক্ষা করা প্রয়োজন। আবুল কালাম তাদের হাত থেকে ছুটে পালিয়ে গেল।
অন্যদিকে হামিদ ব্যাপারীকে থানা হাসপাতালে নেওয়ার পর দেখা গেল, কিরিচটি যে-স্থানে বসেছে, তাতে তার মারা যাওয়ার সম্ভাবনা নেই বললে চলে। তবে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। রক্তের গ্র“প বি-পজিটিভ। ফলে এই গ্র“পের রক্ত পাওয়া সহজ হলো। বেশ কিছুদিন হাসপাতালে কাটিয়ে আরোগ্য লাভ করে বাড়িতে ফিরল সে।
হামিদ ব্যাপারী শারীরিক সমস্যা থেকে রেহাই পেলেও পারিবারিক সমস্যা থেকে রেহাই পাওয়া গেল না। তার স্ত্রী হুমায়রা সামনে এসে বলল, ঘরে ফিরেছ তো? এবার আমি চললাম।
চললাম মানে?
আমি বাপের বাড়ি চলে যাচ্ছি। তোমার মতো লোকের সঙ্গে ঘর করা আমার পোষাবে না। ছি! ছি! সারা গায়ের লোকের মুখে মুখে তোমার কীর্তিকলাপের কথা। তুমি মরলে না কেন?
আমি মরলে বুঝি সুবিধা হতো?
লজ্জার হাত থেকে বাঁচতাম। আমার তো একটা মানসম্মান আছে।
হুমায়রার ওই এক দোষ। কথায় কথায় সে মনে করিয়ে দিতে চায় যে, সে বড় মোড়লের মেয়ে। বড় মোড়ল এ-অঞ্চলের নামকরা লোক। গঞ্জে তার ভালো ব্যবসা আছে। উপজেলাতেও অনেক দোকান আছে। হুমায়রা সবসময় তার খানদানের বড়াই করে। হাসপাতালে হুমায়রা তাকে একবারও দেখতে যায়নি। ফিরে আসার পর কোথায় আল্লাহর কাছে শোকর গুজার করবে, তা না করে বাপের বাড়ির দাপট দেখাচ্ছে।
রেগে গেলে হামিদ ব্যাপারীর মাথা ঠিক থাকে না। তুই সম্বোধন করে হুমায়রাকে বলল, যা। এখনই বেরিয়ে যা। তোর বাপে বিয়ে দিয়েছিল কেন তোকে?
আমার বাপ তো জানতো না তুমি পরের বউয়ের সঙ্গে সাঙ্গা করবে।
আমার যা ইচ্ছা করব, তাতে তোর বাপের কী?
বাপ তুলে কথা বলার পর এ-বাড়িতে আর থাকার প্রশ্ন ওঠে না। একটা সুটকেসে নিজের পোশাক-পরিচ্ছদ ভরে সে রওনা হয়ে গেল। একমাত্র ছেলে ঢাকায় হোস্টেলে থেকে লেখাপড়া করে। তার কথা এখন আর ভাবার অবকাশ নেই। বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় হামিদ ব্যাপারী উঠান পার হয়ে এলো পেছনে পেছনে। বলল, যাস যখন জন্মের মতো চলে যা। আমি তোরে তালাক দিলাম।
তুমি আমাকে কী তালাক দেবে? তালাকের কথায় আমি ভয় পাইনি। আমি তোমাকে জেলের ভাত খাওয়াব। আবুল কালামের গুমের মামলা আছে তোমার নামে।
বাড়ির পাশে বড় রাস্তায় উঠে রিকশা ধরে হুমায়রা বাপের বাড়ি চলে গেল।
হুমায়রা চলে যাওয়ার পর এক ধরনের স্বস্তি বোধ করল হামিদ ব্যাপারী। ওকে বিয়ে করেছিল শ্বশুরবাড়ি থেকে সম্পত্তি পাওয়ার আশায়। সে-আশায় গুড়ে বালি। বাপের বাড়ি থেকে তেমন কিছু আনতে পারেনি হুমায়রা। বরং উলটো বলেছে, হামিদ ব্যাপারী তো ঘরজামাই নয় যে শ্বশুরবাড়িতে থাকতে যাবে। আর ওর বাপটাও হয়েছে তেমনি। এক নম্বরের কঞ্জুস বলা যায়। দুটো নয়, চারটা নয়, একটিমাত্র জামাই, বিয়ের পর তাকে উপজেলার মার্কেটে মাত্র দুটো দোকান লিখে দিয়েছে; তাও একসঙ্গে হুমায়রা ও তার নামে। তাছাড়া স্ত্রী হিসেবেও হুমায়রা একবারে পানসে। বকুলের মধ্যে যে রং-ঢং আছে, তার একশ ভাগের এক ভাগও নেই তার মধ্যে।
বকুলের কথা মনে পড়তেই মনটা অন্যরকম হয়ে গেল। বকুল শুধু চোখে কথা বলে না, বিছানায় ওর সারাশরীরই কথা বলে ওঠে। এমন একটা মেয়েমানুষই তো সে চেয়েছিল জীবনে। আবুল কালামের কাছে সুখ পায় না, এ-কথা বকুল নিজের মুখেই বলেছিল। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, একটা সন্তানের জন্য আকাক্সক্ষা ছিল বকুলের। আবুল কালামের তা দেওয়ার ক্ষমতা নেই। বকুলকে সে কথা দিয়েছিল, বকুল যদি তার সঙ্গে নিয়মিত মেলামেশা করে, তাহলে এটা কোনো ব্যাপারই না। মনে মনে স্মৃতির জাবর কাটল হামিদ ব্যাপারী।
দুদিন পরে থানার সিপাই আদিল এসে দেখা করল তার সঙ্গে। বলল, আরে! আপনি এখানে?
কেন? কী হয়েছে তাতে?
আপনার বিরুদ্ধে তো গুমের মামলা। পুলিশ আপনাকে খোঁজ করছে।
আমি আবার কাকে গুম করলাম?
সেটা আদালতে গিয়ে বলবেন।
আমি নিজে থানায় যাব। থানার ওসি সাহেবকে সব কথা খুলে বলব।
সর্বনাশ! ওসি সাহেব আপনার ওপর খুব ক্ষেপে আছেন। আপনি বকুল বিবির ইজ্জত নষ্ট করছেন। আবার তার স্বামী আবুল কালামকে গুম করেছেন। বকুল নিজে ওসি সাহেবের কাছে এজাহার দিয়েছে।
বকুল থানায় গিয়েছিল বুঝি?
আমি অতসব বলতে পারব না। ওসি সাহেব মাঝে মাঝে তার বাড়িতে এসে এজাহার নিয়ে যান। আপনাকে পেলে সোজা জেলহাজতে চালান করে দেবেন। তারপর রিমান্ড তো আছেই। রিমান্ড অর্থ বোঝেন?
আমি তাহলে কী করব আদিলভাই।
আর যাই করেন, বকুলের ঘরমুখী হবেন না। আমি বলি কী, আপনিও কিছুদিনের জন্য গুম হয়ে যান। নইলে ওসি সাহেবই আপনাকে গুম করে ফেলবে।
ঘনিষ্ঠ দু-চারজনের সঙ্গে আলাপ করল হামিদ ব্যাপারী। বকুলের কথা নয়, পুলিশ যে তার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়েছে, সে-বিষয়ে তাদের মতামত চাইল। সবাই বলল, থানার ওসি ব্যাটা খুবই খতরনাক। প্রায়ই সে বকুলের বাড়ি আসে। মামলার নাম করে সেখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটায়। ব্যাপারটা এবার খোলাসা হলো হামিদ ব্যাপারীর কাছে। বকুলের আওতা থেকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্যই তার এই কৌশল।
ইতোমধ্যে আরো একটা খবর পাওয়া গেছে। গ্রামেরই একজনের সঙ্গে আবুল কালামের সাক্ষাৎ হয়েছে জেলাশহরে। হামিদ ব্যাপারী বেঁচে আছে শুনে সে স্বস্তিবোধ করেছে। শিগগিরই গ্রামের বাড়িতে ফিরে আসবে বলে আবুল কালাম জানিয়েছে। কথাটা অবিশ্বাসের কারণ নেই। খবরটা শুনে হামিদ ব্যাপারীও খানিকটা স্বস্তি পেল। আর যাই হোক, আবুল কালামকে গুম করার মামলা কেউ দিতে পারবে না।
সত্যি সত্যি একদিন গ্রামে ফিরে এলো আবুল কালাম। নীরবে-নিঃশব্দেই গ্রামে ফিরল। যেন কিছুই হয়নি এমন ভাব দেখাল বকুলের কাছে। বকুলও তাকে একই ভাব দেখাল যেন কিছুই ঘটেনি।
দুদিনের মধ্যে থানার সিপাই আদিল দেখা করতে এলো তার বাড়িতে। আবুল কালামকে একান্তে ডেকে নিয়ে বলল, আপনার তো সাহস কম না।
আমি কী করেছি? আবুল কালাম জানতে চাইল।
আপনি খুনের আসামি। আপনি নিজেও গুম হয়ে ছিলেন। এখন বাড়িতে ফিরলেন কী মনে করে?
নিজের বাড়িতে ফিরব, তাতে মনে করাকরির কী আছে?
কিন্তু থানায় আপনার নামে খুনের মামলা।
আমি খুন করি নাই। যাকে খুন করার কথা বলা হচ্ছে, সে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে।
আইন তো কিছুই বোঝে না, তাই এসব কথা বলছেন। খুন করা আর খুনের জন্য ছুরি মারা একই ব্যাপার। ৩০২ ধারা। ধরা পড়লেই ফাঁসি। আমার কথা শোনেন।
কী কথা?
বাড়িঘর আর বউকে ফেলে আপনি এই অঞ্চল ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যান। ওসি সাহেব খুব ক্ষ্যাপা আপনার ওপর। আপনি খুনের আসামি। ধরা পড়লে আপনাকেই তিনি খুন করে ফেলবেন।
আমি আর ওসিকে ডরাই না।
তওবা, তওবা। এসব কী কথা! আমার পরামর্শ শোনেন। আজ সন্ধ্যায় ওসি সাহেব নিজে আসবেন আপনাকে গ্রেফতার করার জন্য। আপনার ঘরে ওঁৎ পেতে থাকবেন, কখন আপনি বাড়ি ফেরেন। ব্যাপারটা খুবই গোপনীয়। কিন্তু আপনাকে প্রাণে বাঁচাতে কথাটা বলে দিলাম। আপনি ভাই রাতটা অন্য জায়গায় কাটিয়ে সকালবেলা চলে আসেন। ওসি সাহেব তখন থাকবেন না।
কথাগুলো শুনে আবুল কালাম চুপ করে রইল। বোঝা গেল সন্ধ্যাবেলা সে বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে। প্রাণের ভয় কার না আছে!
চার
সালাউদ্দিন মিয়ার মনমেজাজ আজকাল খুব খারাপ। আবুল কালাম আর হামিদ ব্যাপারী, দুটো লোকই তার মন বিগড়ে দিয়েছে। একজন পলাতক ছিল, তা একরকম ভালোই ছিল। আরেকজন হাসপাতাল থেকে রোগমুক্ত হয়ে ফিরে এলো। খুনটা হয়ে গেলেই ভালো হতো। মার্ডার আর অ্যাটেম্পট টু মার্ডারের মধ্যে অনেক ফারাক। দুটো লোকই এখন বিষফোঁড়ার মতো মনে হচ্ছে তার কাছে।
অথচ কিছুদিন ধরে তার মন জুড়ে আছে বকুল বিবি। মেয়েমানুষ তো আর কম দেখা হলো না জীবনে। তবে ওর মতো আরেকজন কাউকে আর পাওয়া যাবে না। এসব মাল দুনিয়াতে এক পিসই হয়। ঢাকা ছেড়ে এই গণ্ডগ্রামে পোস্টিংয়ের খবর শুনে সে খুবই হতাশ হয়ে পড়েছিল। কিন্তু ভাগ্য যে তার জন্য বকুলের সুবাস নিয়ে অপেক্ষা করছে তা ধারণা করা যায়নি। পরিবার-পরিজন ঢাকায় ফেলে রেখে দিনগুলো একা একা কীভাবে কাটবে, তা নিয়ে চিন্তার অন্ত ছিল না। তার বেগম সাহেবা তো এখানে আসার জন্য একপায়ে খাড়া। সালাউদ্দিন প্রথমদিকে তাকে নিয়ে আসার প্রতিশ্র“তি দিলেও বকুলের সঙ্গে যোগাযোগের পর মাথার চিন্তা থেকে তা ঝেড়ে ফেলেছে। একদিকে বেগম সাহেবা, আরেকদিকে বকুল বিবি। পরের দিকের পাল্লাই এখন ভারী। ভেবেছিল এখানকার বাকি দিনগুলো বকুলকে নিয়েই কেটে যাবে। কিন্তু উটকো ঝামেলা জুটেছে ওরা দুজন। ও-দুটোকে ফাঁসিয়ে দিতে না পারলে আর শান্তি হচ্ছে না মনে। ভেবেচিন্তে তাদের বিষয়ে একটা ব্যবস্থা নিতে হবে।
আজ সকাল থেকে মনটা উথাল-পাথাল করছে বকুলের জন্য। সন্ধ্যাবেলা তার ওখানে যাবে বলে বকুলকে জানিয়ে দিয়েছে। তার আগে আদিলকে দিয়ে খবর পাঠিয়েছে আবুল কালামকে। মামলা থেকে বাঁচতে চাইলে অন্য কোথাও তার চলে যাওয়াই ভালো। একই সঙ্গে হামিদ ব্যাপারীকে দূরে সরিয়ে দিতে হবে। এসব কাজে সিপাই আদিল খুবই সেয়ানা। কাকে কী বলে কীভাবে কাজ উদ্ধার করতে হবে, তা আদিলের চেয়ে ভালো কেউ বোঝে না। এসব কাজের জন্য আদিলকে কিছু টাকা-পয়সার ভাগ দিতে হয়। টাকা-পয়সা নিয়ে সালাউদ্দিনের তেমন খাই নেই। তবে ‘জো আপসে আতা হ্যায়, ও হালাল হ্যায়।’ সালাউদ্দিন কারো ওপর জোর-জুলুম করে টাকা নেয় না, কথাটা সবাই জানে। তার চাওয়ার জিনিস দুটো, তাও সবাই জানে।
বিকেলবেলা আদিল থানায় ফিরে বলল, স্যার! সব ব্যবস্থা পাকা করে এলাম। বিবি সাহেবাকেও বলে এসেছি।
বিবি সাহেবা কে?
বকুল বিবি সাহেবা। আপনার সঙ্গে যার সম্পর্ক, তাকে তো আর শুধু নাম ধরে ডাকতে পারি না।
কিন্তু ওই লোক দুটোর কী করলে?
এ্যায়সা ভয় দেখিয়েছি যে, ওরা আর এই তল্লাটেই নেই। একজনকে খুনের ভয়, আরেকজনকে গুমের ভয়।
তাহলে সব ঠিক আছে। কী বলো?
একেবারে ঠিক। খুনি আবুল কালামকে ধরার জন্য আপনি ঘরে অপেক্ষা করবেন। আমি বাইরে থেকে আপনাকে পাহারা দেব।
চমৎকার! এজন্যই তো তোমাকে আমি পছন্দ করি।
রাতের বেলা বকুলের সঙ্গে থাকা ওই প্রথম। একটু বিশেষভাবে সাজগোজের ইচ্ছা ছিল তার। প্রতিবার পুলিশের পোশাকে ওখানে যেতে ইচ্ছা করছিল না। সাদা ধবধবে পাজামা আর আদ্দির পাঞ্জাবি গায়ে পরল। সুগন্ধিও ¯েপ্র করল গায়ে। বকুল নিশ্চয়ই নতুনরূপে খুব পছন্দ করবে তাকে। রাতটা ওর সঙ্গে কেমন কাটবে, ভাবতে বারবার রোমাঞ্চিত হলো সে। সন্ধ্যাবেলা খাওয়ার কথা থাকলেও যেতে যেতে কিছুটা রাত হয়ে গেল।
কী ব্যাপার! একেবারে নওশার সাজে সেজেছেন দেখছি। বকুল রসিকতা করল।
সবসময় ইউনিফর্ম পরতে ভালো লাগে না। তাই আজ অন্যরকম পোশাকে এলাম।
আপনার জন্য আজ কবুতরের মাংস রান্না করেছি।
আজ আমার পেটের খিদা নেই, শুধু মনের খিদা।
তাহলে শুধু মন নিয়ে থাকেন, শরীরের দরকার নেই।
শরীরই তো আসল। শরীর না থাকলে মন থাকবে কোথায়?
এত যতœ করে কবুতরের মাংস রাঁধলাম, তার কী হবে?
সেটা খাবো না বলেছি নাকি? আজ আমি সব খাব। সালাউদ্দিন মিয়া বলল, দুটো গ্লাস নিয়ে এসো। আজ যে মদ এনেছি তার নাম কি জানো?
কী?
ব্ল্যাক ডগ। কালো কুত্তা।
আপনি কালো কুত্তা খাবেন নাকি?
এর চেয়ে ভালো খাবার আর কিছু নেই। তোমার কবুতরের মাংস আর আমার ব্ল্যাক ডগ। দুজনে মিলে খাব। মদ না খেলে খেলা জমে না।
আপনি খুব খারাপ লোক। কথা দিয়ে কথা রাখেন না।
কেন?
সারাক্ষণ কেবল খাই-খাই। আমাকে যে সোনার অলঙ্কার দেবেন, তার কী হলো?
আজ কেবল গলার হার এনেছি। পকেট থেকে নেকলেস বের করে বকুলের গলায় পরিয়ে দিলো সে। বলল, এরপর কানের দুল আর হাতের চুড়ি আনব।
কথা শুনে বিগলিত হয়ে গেল বকুল। গ্লাসে মদ ঢেলে দিয়ে বলল, নাও। খাও।
তুমিও এসো। তাকে টেনে বিছানায় তুলে নিল সালাউদ্দিন।
প্রায় সারারাত তারা দুজন যখন মদে ও অবসাদে আচ্ছন্ন, তখন খাটের তলা থেকে বেরিয়ে এলো এক ছায়ামূর্তি। হারিকেনের স্বল্প আলোয় তাকে ঠিক চেনা গেল না। বিছানার এপাশে শায়িত সালাউদ্দিনকে দেখে নিল একবার। তারপর হাতের ধারালো ছোরা বসিয়ে দিলো সালাউদ্দিনের গলায় অনেকটা পশু জবাইয়ের মতোই। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছড়িয়ে পড়ল বকুলের শরীরে। ভীতসন্ত্রস্ত বকুল চিৎকার করে উঠল। বাইরে পাহারারত সিপাই আদিল দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকল। হাতের টর্চ জ্বেলে বিছানায় রক্তাক্ত সালাউদ্দিনকে দেখে ছুটে গেল তার দিকে। ইত্যবসরে ধীর পায়ে ঘরের ভেতর থেকে নিঃশব্দে বাইরে বেরিয়ে গেল আততায়ী।
পরদিন সকাল না হতেই জেলা-উপজেলার সর্বত্র হুলস্থূল পড়ে গেল সালাউদ্দিনের মৃত্যুর খবরে। পুলিশ ও প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ছুটে এলেন। রাজধানী ঢাকাতেও খবর গেল এমন নৃশংস হত্যাকাণ্ডের। জেলার এসপি ও অন্যান্য পুলিশ কর্মকর্তা থানার পুলিশদের সঙ্গে ঘটনার বিস্তারিত জানতে বৈঠকে বসলেন। এসপি সাহেব বললেন, একটা বিষয় আমি বুঝতে পারলাম না। ওসি সাহেবের গ্রামের একটা বাড়িতে গিয়ে খুন হওয়ার কারণ কী?
থানার সেকেন্ড অফিসার জমির মল্লিক বলল, উনি একজন আসামিকে ধরতে গিয়েছিলেন স্যার।
আসামি ধরতে গেছেন ভালো কথা। ইউনিফর্ম পরে যাননি কেন?
উনি একরকম প্লেইন ড্রেসে সেখানে গিয়েছিলেন, যাতে আসামি বা তার পক্ষের কেউ টের না পায়।
হুঁ। উনি কি একাই গিয়েছিলেন? নাকি কেউ সঙ্গে ছিল?
সিপাই আদিল সঙ্গে ছিল স্যার।
সে এখন কোথায়?
গতরাত থেকে তার কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।
মানে?
মানে, হত্যাকারীরা তাকে সম্ভবত গুম করে ফেলেছে।
হত্যাকারীরা বলছেন কেন? তারা কি একাধিক?
আমাদের সন্দেহ দুজনের দিকে। একজন আবুল কালাম আর অন্যজন হামিদ ব্যাপারী। বকুলকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তার কাছ থেকে প্রকৃত ঘটনা জানা যাবে।
বকুল কে?
আবুল কালামের স্ত্রী।
তাকে জিজ্ঞাসা করে দেখুন হত্যাকারী কে? কীভাবে এবং কেন এই হত্যাকাণ্ড ঘটল।
তাকে জিজ্ঞাসা করছি স্যার। সে বলছে আবুল কালাম বিছানায় হামিদ ব্যাপারী শুয়ে আছে মনে করে তাকে খুন করেছে। তা না হলে হামিদ ব্যাপারীই পূর্বশত্র“তাবশত বিছানায় আবুল কালাম শুয়ে আছে মনে করে তাকে খুন করেছে। জমির মল্লিক বলল, হত্যাকারী এদের দুজনের একজন হবে। তবে ওসি সাহেবেকে খুন করার ইচ্ছা তাদের কারোরই ছিল না। তাকে খুন করার মতো কোনো কারণও নেই স্যার।