লোক টা নিজের ফোনের স্কিন আমার সামনে ধরে বলল,
-এইযে আমার মেয়ে! ফোনের স্কিনে একজন মহিলার কোলে একটা বাচ্চা মেয়েকে দেখা যাচ্ছে। বাচ্চা আর মহিলা দুজনেই বেশ সুন্দর। নিশ্চয় মা মেয়ে।চেহারায় অনেক টা মিল আছে! আমি স্কিন থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে লোকটার দিকে তাকিয়ে বললাম,
-মাশআল্লাহ,আপনার মেয়ে অনেক কিউট। পাশের জন কে,আপনার ওয়াইফ?
–নাহ,আমার বাচ্চার মা। আমি উত্তর শুনে চমৎকৃত হলাম। বাচ্চার মা শব্দটা সব সময় মহিলাদের সম্মান বৃদ্ধি করে।
-ছবিতে আপনি থাকলে বেশ মানাতো। লোক টা হাসলো,সে হাসির মানে বুঝলাম না। উনি বললেন,
-আপনি আমার কথা বুঝতে পারেন নি?
-কোন কথা?
-আমার বাচ্চার মা সে,আমার ওয়াইফ নয়।
–ডিভোর্স?
-জি, আমি আর কিছু বললাম না। তবে খানিক বাদে কি ভেবে যেন জিজ্ঞেস করে ফেললাম,
-কিভাবে হয়েছে? সমস্যা না থাকলে বলবেন।
-তেমন কিছুই না,সাধারণ ব্যপার স্যপার যেগুলো।শুনে তেমন মজা পাবেন না,
-মজার জন্য শুনতে চাচ্ছিনা। খানিক টা আগ্রহ থেকে। লোক টা কিছু বলবে ঠিক সে সময় বাসের সুপারভাইজার সামনে এসে বলল,
-চাকা ঠিক হয়েছে উঠে পরেন।এমনিতেই অনেক সময় নষ্ট হয়েছে।
দেরী করলাম না আর উঠে পরলাম বাসে।আমার পাশেই লোকটার সিট। কি যেন নাম বলেছিল ভুলে গেছি. বড় একটা নাম,ছোট নাম হলে মনে থাকতো। কেউ শুনলে হাসবে বলবে কলেজে তুমি ইতিহাস পড়াও আর একটা নাম মনে রাখতে পারোনা। বিষয়টা যদিও দুঃখজনক৷ তবে কিছুই করার নেই, বয়স হচ্ছে। বয়স ব্যপার টা যদিও সান্তনা। ঢাকা যাচ্ছি,ঈদের ছুটি শেষ হয়েছে দুদিন আগে।দুদিন পর কেন আসলাম এই কারণ কতৃপক্ষ কে কি বলবো ভাবিনি এখনো! আম্মা অবশ্য ছাড়তেই চাচ্ছিল না,আরো কয়েক দিন থাকতে বললো।উনি চান যেন আমার এই জব টা চলে যায় আর আমি সব সময় বাসাতেই থাকি। বাসে উঠেই লোকটার সাথে কথা। বাসের চাকা যখন নষ্ট হলো তখন নিচে নেমে ওনাকে জিজ্ঞেস করলাম,
-ভাই,এটা কোন জায়গা?
-ঠিক জানিনা বগুড়ার দিকে,
-ওহ,ফুড ভিলেজ আসতে এখনো তো ভাল দেরী আছে,
-তা আছে, প্রস্রাব করলে পাশে করে ফেলেন!
-না তা সমস্যা নাই!
-বাচ্চা কাচ্চাদের প্রবলেম হয়,গত বছর আমার ভাগিনারে নিয়ে আসছিলাম ছয় বছর বয়স। কয়েক বার বাস থামাইতে হইছে কি এক অবস্থা! আমি হেসে উঠলাম এমন পরিস্থিতিতে আমাকেও পরতে হয়েছে। আমি বললাম,
-আমি নিজের জন্যই কত বাস থামিয়েছি।
-বাচ্চা কাচ্চা সাথে থাকলে বুঝতেন!
-আপনার বাচ্চা কাচ্চা সমন্ধে ভাল আইডিয়া দেখি
-তা তো আছে,আমার মেয়ে আছে একটা। তারপরেই উনি ওনার মেয়ের ছবি টা দেখিয়েছিলেন,সাথে নিজের প্রাক্তন স্ত্রীর ও।
-ভাই কি ঘুমালেন? আমি চোখ বন্ধ করে ছিলাম।চোখ খুলে বললাম,
-না ভাই বাসে ঘুম আসেনা।
-আমার গল্প টা বলি তাহলে,
-তার আগে আপনার নাম টা আরেক বার বলেন?
-আশাফাকুর রহমান।
-আচ্ছা, এখন বলেন।
-ওর নাম রেহানা।আমি ডাকতাম রেনু।চার বছরের প্রেম করে বিয়ে করেছিলাম আমরা!
-এরেঞ্জ ম্যারেজ?
-নাহ,পালিয়ে বিয়ে করেছিলাম! আমাদের ফ্যামিলির অবস্থা খুব খারাপ ছিল। ওর বাসায় মেনে নেয়নি!
-তারপর,
-পড়াশোনা শেষ হয়ে গেছিলো,একটা কোম্পানির সুপাইভাইজার পোস্টে ছিলাম!বেতন ও ভাল ছিল,ভালই দিন কাঁটছিলো! বছর দুয়েক পর মেয়েটা হলো! তখন মনে হতো আমি পৃথিবীর সব চাইতে সুখী মানুষ। মেয়ে রে কোলে নিতে কি যে আনন্দ হতো। বাসের হালকা আলোতেও আশফাকুর সাহেবের হাসি আমার দৃষ্টি এড়ালো না।
-মেয়েটার বয়স যখন ছয় মাস তখন কোম্পানি লস খায়! চাকুরী চলে যায়! মেয়ের দুধ কেনার মত টাকাও ছিল না হাতে! মাস দুয়েক পর রেনুকে বললাম,একটু বাবার বাড়ি থেকে ঘুরে আসো! এর মধ্য ব্যবস্থা করি। এটুকু একটানা বলে আশফাকুর সাহেব থেমে গেলেন। বোতল থেকে এক চুমুক পানি খেয়ে সিটে হেলান দিলেন!
আমি জিজ্ঞেস করলাম,
-পরে কি চাকুরী পেয়েছেন?
-চাকুরী আর পেতে হয়নি,
-মানে?
-কদিন জন্য যাওয়া রেনু আর ফিরলো না। মাঝে একবার ডিভোর্স লেটার টা পাঠিয়ে ছিলো সাথে একটা চিঠি তাতে লেখা ছিল সে আমার দেনমোহর টাকা মাফ করে দিয়েছে আমি যেন কোন ভেজাল না করি!
-আপনি কি করলেন?
-ভেজাল করিনি!
-এখন কি করছেন?
-গাজীপুর এ একটা ছোট খাটো জব করি।
-আপনার মেয়ে কোথায়?
-ওরা চিটাগং এর দিকে আছে!
-আপনার ওয়াইফ বিয়ে করেছে আবার?
-জি,
এই প্রশ্ন টা করে একটু কেমন যেন লাগলো! তবে আর কিছু জিজ্ঞেস করলাম না তাকে। চোখ বন্ধ করে রইলাম,আশফাকুর সাহেবও একই কাজ করলেন! ঘন্টা খানেক বাদে ফুড ভিলেজ আসলো। আশফাকুর সাহেব আমাকে ছাড়লেন না। এমন কি খাওয়ার বিল অব্ধি দিতে দিলেন না। সহজ সরল লোক টাকে বেশ ভাল লাগলো। খাওয়া শেষে যখন বাস ছাড়লো তখন আশফাকুর সাহেব জিজ্ঞেস করলেন,
-আপনি কি করেন?
-আমি?
-হ্যাঁ,
-আমি এইতো ঢাকায় বেসরকারী একটা কলেজে পড়াই!
-শিক্ষক?
-হ্যাঁ,বলতে পারেন?
-বউ বাচ্চা সহ থাকেন ঢাকায়!
-অত সৌভাগ্য হয়নি
-মানে?
-এখনো বিয়েটা করা হয়নি!
-কেন?
-যে সময় ইচ্ছা ছিল,সে সময় করলে আপনার মত অবস্থা হতো!
-বুঝিনি!
-যখন ইচ্ছা ছিল তখন চাকুরী ছিল না!
-প্রেমিকা ছিল,
-সবারই থাকে,
-তারপর
-বিয়ে হয়ে গেছে,
-কিভাবে?
আমি আর কিছু বললাম না,এসব প্রশ্নের উত্তর দেয়ার প্রয়োজন মনে হলো না।সবার কিছু গোপন দুঃখ আছে। আশফাকুর সাহেব তার দুঃখ প্রকাশ করতে পেরেছেন আমি পারিনা।এটাকেই হয়ত স্বকীয়তা বলে। গাজীপুর নামার আগে আশফাকুর সাহেব আমার নাম্বার নিয়ে গেলেন!যাওয়ার আগে বলে গেলেন উনি আছেন ভূমি অফিসে। আমি ভাবিনি উনি সরকারী জব করেন! উনি নেমে যাওয়ার পর আমার চোখ লেগে গেলো! জ্যাম না হওয়ায় তাড়াতাড়ি আসা হয়েছে! রোদ ওঠার আগেই ঢাকা পৌছাতে পারলেই হয়। ঢাকায় এমনিতেই বেশি গরম।
ভ্যাপসা গরমে ঘুম ভেঙে গেলো,চোখ বুজে ছিলাম কখন মনে নেই।কতক্ষন ঘুমিয়েছি তাও জানিনা। বাসে কখনোই ঘুমাইনা,আজ ঘুম ধরে গেছে,পরিশ্রান্ত মন বলেই হয়ত বা৷ চোখ খুলে দেখলাম বাস থেমেছে,কল্যানপু র এসে গেছে।বাস থামার কারণেই গরম লেগেছে। চারপাশে তাকিয়ে দেখি বাস প্রায় ফাঁকা,দু একজন আছে তারা ব্যাগ পত্র নামাচ্ছে। আমিও দেরী করলাম না,ব্যাগ নামিয়ে নেমে পড়লাম। ঢাকায় আসলে আমার ভাল লাগে,যদিও এ শহরের অনেক খারাপ দিক আছে।ভাল লাগার কারণ হচ্ছে এ শহরে অনেক মানুষ।দূর থেকে দেখলে মনে হয় এ শহরে কেউ একা নয়, হয়ত ভিতরে ভিতরে একা!
গল্পের বিষয়:
গল্প