ভরদুপুরের ভরারোদে শাহজাহান সাহেব দাঁড়িয়েছিলেন আসাদ গেট বাসস্ট্যান্ডের আধা আলো, আধা ছায়ায়। পুরো ছায়ার জায়গা তিনি খুঁজে পেতে জোগাড় করতে পারেননি। ছায়া-সন্ধানী লোকের বড় ভিড় আজ। বৈশাখের মাঝামাঝি। এ-সময়ে কমপক্ষে দু-চারবার বৃষ্টি হয়ে যাওয়ার কথা। অথচ হয়নি। পারদকলাম উঠছে তো উঠছেই। তা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছুঁইছুঁই।
শাহজাহান সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন বাসের অপেক্ষায়। হাতে তাঁর বাজারের ব্যাগ। মোহাম্মদপুর বাজার তাঁর প্রিয়। এখানে তিনি ঘুরেফিরে বাজার করতে স্বচ্ছন্দবোধ করেন। তাঁর বহুদিনের চেনাজানা মেছো, তরকারিওয়ালা, মুদিদোকানি আছে। যাদের কাছ থেকে কেনাকাটা করে তাঁকে ঠকে যাওয়ার অশান্তি পোহাতে হয় না। তাঁর বাড়ির ধারেকাছের ফার্মগেটে বাজার-সওদার কমবেশি আয়োজন আছে।
তা তাঁর পছন্দ নয়।
লাইনের বাস জ্যামে পড়ে গেলে, যা আজকালকার ঢাকা শহরের এক নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার, তখন যাত্রী-জমায়েত ক্রমেই বাড়তে থাকে। আর অপেক্ষায় থাকা যাত্রীদের নানা ধারার খিস্তিঝাড়ার বোলচালের ধ্যানধরনও লাগামছাড়া হয়ে পড়ে। সেই হালকা থেকে তীব্রতম গালাগালির উষ্ণতর আঁচ সাধারণের মাত্রা ছাড়িয়ে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়কে ঘায়েল করে ফেলার জন্য যথেষ্ট।
শাহজাহান সাহেব পথেঘাটে চলতে-ফিরতে নিত্যকার এইসব অপ্রীতিকর পরিস্থিতির মাঝখানে থেকেও এসবে যোগদান তো দূরের কথা, শোনা থেকেও বিরত থাকেন। প্রয়োজনে স্থান পরিবর্তন করে অন্য পাশে গিয়ে দাঁড়ান। যেদিকে আজ মহিলা যাত্রীদের ছোটখাটো একটা জটলা। তারাও গলাবাজিতে কম যায় না। তাদের কথাও শাহজাহান সাহেবের কানে পৌঁছায় না। তাঁর খেয়াল বাজারের ব্যাগের দিকে। ব্যাগের ভেতরে তাঁর রয়েছে যথেষ্ট চিন্তা-ভাবনা করে কেনা বাজারসামগ্রী। আজ তিনি কিনেছেন, লকলকে তাজা ডাঁটা আর দুধকচুর শাক। তিনি ভাবছিলেন, ডাঁটা-কাঁঠালের বিচির চ্যাপা-শুঁটকির চর্চরির মতো কম্বিনেশন আর হয় না। তা জিহ্বায় কেন হাতেও লেগে থাকে দেড়-দুদিন। এটা কাঁঠালের সিজন নয়। তারপরও ইশার মায়ের দূরদর্শিতার কারণে এই সুস্বাদু আইটেমটি তাঁদের ঘরে প্রায় সারাবছরই থাকে। এর আরেকটা কারণ, তাঁদের একমাত্র মেয়ে (দুই সন্তানের মা) ইশরাত যশোরে থাকে, তারও এটি খুব পছন্দের। তার স্বামী জুবায়ের সরকারি চাকুরে। অডিট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টসে। উপরি আয় যথেষ্ট। জামাই মানুষ ভালো। সময়-সময় শ্বশুর-শাশুড়িকে টাকা পাঠায়। তখন শাহজাহান সাহেবের বাজারের ফিরিস্তিও বেড়ে যায়। এমনিতে তিনি অবসরপ্রাপ্ত কর্মজীবী। সরকারি মৎস্য বিভাগে ছিলেন। পেনশন মানি ব্যাংকের নানা স্কিম ও সঞ্চয়পত্রে নিয়োগ করে তাঁদের ভালোভাবেই মাসকাবার হয়ে যায়।
বাস এসে যায়। কন্ডাক্টরের ফার্মগেট-মালিবাগ-গুলিস্তান… গুলিস্তানের গলাবাজিতে যাত্রীদের মধ্যে এক হুড়োহুড়ি প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হয়। কার আগে কে উঠবে? একটা সময় ছিল, পুরুষ যাত্রীরা মেয়ে যাত্রীদের আগে ওঠার সুযোগ করে দিত। এখন সেসব উঠে গেছে। শাহজাহান সাহেব তাঁর কিছুটা লম্বাটে বাজারের ব্যাগ, কিছুটা বয়সের কারণে আগে ওঠার প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে থাকেন। একপর্যায়ে তাকে কে যেন হাত ধরে টেনে তুলতে সাহায্য করাতে তিনি সফল হন। এবং কন্ডাক্টরের কড়া ধমকি-শাসনের জের ধরে তাঁকে বেশ ভেতরের দিকে বাসের হাতল ধরে দাঁড়াতে হয়। এতে শাহজাহান সাহেব সন্তুষ্ট। অন্তত ওঠা তো গেল। শাহজাহান সাহেব মোটামুটি আশ্বস্ত হয়ে বাঁহাতে বাজারের ব্যাগটা সামলিয়ে হাতল ধরে দাঁড়িয়ে থাকেন। ফার্মগেট আসতে আর কতক্ষণ।
কন্ডাক্টর পয়সা নিতে আসেন। শাহজাহান সাহেব সাবধানে দুপায়ে বাজারের ব্যাগ চেপে ধরে মানিব্যাগের জন্য পকেটে হাত দিয়ে প্রচণ্ড এক হোঁচট খান। পকেট খালি। তাতে মানিব্যাগ নেই।
কন্ডাক্টরকে ব্যাপারটা বলতে গিয়ে আরো বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে যান শাহজাহান সাহেব।
কন্ডাক্টর ধমকে ওঠে।
প্যাসেঞ্জারগোর এইসব টালবাহানা হুনতে হুনতে আমগোর কান ঝালাপালা…। পয়সা না দেওয়ার যতসব কারসাজি। হগলের ব্যাগ রইল আর আপনারটা পকেটমার লইয়া গেছে। রাহেন এইসব ঝাড়িঝুড়ি। পয়সা বার করেন। ভাড়া বাড়ছে… ফার্মগেট পাঁচ টাকা।
শাহজাহান সাহেবের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। সবাই তাঁর দিকে ঘুরে তাকায়।
কন্ডাক্টর নাছোড়বান্দা।
‘আরে মশাই এই বুইড়া মানুষগুলোই বেশি শয়তান। খালি মিছা কতা…। দুইদিন পরে কবরে যাইবো কিন্তু…।’
ততক্ষণে বাস মানিক মিয়া অ্যাভিনিউর মোড়ে এসে থামে। কিছু যাত্রী নামার প্রস্তুতি নেয়। তখন হঠাৎ করেই যেন শাহজাহান সাহেবের পেছন থেকে এক মহিলার হাত তাঁকে এইমাত্র খালি হয়ে যাওয়া সিটে টেনে বসায়।
যাত্রীর নামা-ওঠা শেষ হতে না হতে আবার কন্ডাক্টর ফিরে আসে।
‘কই গেল জোউ¹া বুড়া?’
শাহজাহান সাহেবের পাশে বসা ভদ্রমহিলা কন্ডাক্টরকে ডাকেন, ‘জোউ¹া বুড়া কী? বলো ভদ্রলোক। তিনি মানিব্যাগ হারিয়েছেন। তোমার বাসে পকেটমার ওঠে না? এই নাও তোমার টাকা।’
কৌতূহলী হয়ে আশপাশের কয়েকজন যাত্রী তাঁদের দেখে। শাহজাহান সাহেবও বিস্মিত হয়ে ভদ্রমহিলাকে দেখেন।
‘আপনি… আপনি!’
‘হ্যাঁ আমি। আমি তনীমা খন্দকার। আপনার ক্লাসমেট। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা একসঙ্গে পড়তাম। মনে আছে?’
শাহজাহান সাহেব অপ্রস্তুত হয়ে তাঁকে পরখ করেন। তীক্ষè দৃষ্টি দিয়ে।
‘হ্যাঁ মনে পড়ছে। আমরা কেমিস্ট্রির প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসের পার্টনার ছিলাম।’
‘এই তো মনে পড়েছে আপনার।’
‘সেইসব দিন… আমরা ভালোই ছিলাম। আজকাল বড় মিস করি সেইসব। সময় দ্রুত গড়িয়ে যায়।’
দীর্ঘশ্বাস চেপে রাখার চেষ্টা করেন তনীমা।
ফার্মগেটে বাস থামে। শাহজাহান সাহেব উঠতে গেলে তাঁর হাতে এক টুকরো কাগজ ধরিয়ে দেন তনীমা।
‘এটা আমার ঠিকানা… মালিবাগ চৌধুরীপাড়ায় থাকি। চলে আসেন না, গল্প করা যাবে।’
শাহজাহান সাহেবও অনেকদিন আগেকার, কাছের পরিচিতজনকে পেয়ে কিছুটা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন।
‘অবশ্যই আসবো।’
‘কালই চলে আসেন না।’
‘দেখা যাক।’
রাতে খেয়েদেয়ে শাহজাহান সাহেব দোতলার অল্পপরিসরের বারান্দায় চেয়ার টেনে অনেকক্ষণ বসে থাকেন। এর মধ্যে ইশার মা দুবার এসে ঘুরে গেছেন।
‘আজ ঘুমাও না যে। অন্যদিন তো এ-সময়ে তোমার নাকের বাঁশি নানা সুরে বাজতে থাকে। আর একটা পান খাবে?’
‘দাও।’
ধীরেসুস্থে পান চিবুতে চিবুতে শাহজাহান সাহেব অতীতে চলে যান। তিনি প্রায় সব সময়ের ব্যাক-বেঞ্চার। তবে লেখাপড়ায় অমনোযোগী ছিলেন না। তাঁদের ক্লাসে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা মোটামুটি কম ছিল না। তাদের মধ্য থেকে অনেক ছেলেমেয়েই মন দেওয়া-নেওয়ার খেলা খেলতো। সাহসী যারা তারা প্রকাশ্যে। অন্যদল গোপনে-আবডালে, চিঠি-চিরকুট আদান-প্রদানের মধ্য দিয়ে। শাহজাহান কোনো দলেই পড়েননি কোনোদিন। তাঁর সাহসে কুলায়নি। তবে তাঁর যে সেসবে ইচ্ছে হয়নি তা নয়।
এমএসসির শেষ বছরে কেমিস্ট্রি ল্যাবওয়ার্ক করার জন্য প্রফেসর রোল নম্বর ধরে দুজন দুজন করে দল বেঁধে দিলেন। শাহজাহান ও তনীমা পড়ে গেল এক দলে। এই সিদ্ধান্তে ক্লাসের ছেলেরা ঈর্ষান্বিত হয়েছিল। তনীমা হাতের কাজে ভালো। তাই শাহজাহান হয়ে রইল তার হেলপার। ফাইনালে পরীক্ষা অবধি।
তনীমা-শাহজাহানের শেষ পরীক্ষা আশানুরূপ হয়নি। তনীমার মন খারাপ। ল্যাব থেকে বের হয়ে তাঁরা পাশাপাশি হাঁটছিলেন। আর শাহজাহানের মনের দীর্ঘদিনের গোপন ইচ্ছাটা সামনে এগিয়ে আসে। তিনি ভাবেন, এটাই তো শেষ সুযোগ। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শেষ। আর তো দেখা-সাক্ষাৎ হওয়ার কথা নয়। তাই শাহজাহান ভাবছিলেন, ‘একটা যোগসূত্র বজায় রাখার চেষ্টা করলে কেমন হয়? ভবিষ্যতে…।’
তনীমা রিকশা ডাকছিলেন। এটাই শেষ সুযোগ ধরে নিয়ে শাহজাহান বলে ফেলেন, ‘তনীমা আর একটু এগিয়ে কার্জন হলের ওইপাড়ের চটপটির দোকানে একটু বসলে হয় না। এখানকার ফুচকাটা খুব ভালো হয়।’
তনীমা যেন তাঁর কথা শুনতে পাননি, এমনি ভাব করে রিকশায় উঠে পড়তে গেলে শাহজাহান তাঁর হাত ধরে আবার বলার চেষ্টা করেন।
‘তনীমা…।’
এবার তনীমার ধৈর্যচ্যুতি ঘটে এবং শাহজাহানের গালে এক থাপ্পড় বসিয়ে দিয়ে রিকশা হাঁকিয়ে চলে যান। সেদিন দারুণ মনঃকষ্ট নিয়ে হলে ফিরে গিয়েছিলেন শাহজাহান।
তনীমার সঙ্গে শাহজাহানের সেটাই শেষ দেখা। তারপর হঠাৎ আজকে। মাঝখানে হয়তো ২৫-৩০ বছর পেরিয়ে গেছে।
পরীক্ষা শেষের সপ্তাহখানেকের মধ্যে শাহজাহান নিজ বাড়িতে চলে যান। সাতক্ষীরায়। এর মাসখানেকের মধ্যে তিনি স্থানীয় বেসরকারি ডিগ্রি কলেজে শিক্ষকতা শুরু করে দেন। পরবর্তী তিন মাসের মধ্যে ইশার মা আসেন তাঁর ঘরনি হয়ে।
রাতে শাহজাহান সাহেবের ভালো ঘুম হয়নি। কারণ, এই নানা ভাবনা আছে আবার ভাবনা নেই এমনি একটা মানসিক পরিমণ্ডল তাঁকে কিছুটা অস্বস্তিতে ফেলে রাখে। গতদিনে হঠাৎ বাসে তনীমার সঙ্গে দেখা হয়ে যাওয়াটা স্মৃতিকাতর করে রাখে।
যথারীতি অন্যদিনের সকালের মতো শাহজাহান সাহেব বেরিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলে ইশার মা তাকে স্মরণ করিয়ে দেন, ‘ঘরে কাঁচামরিচ নেই। সাথে কিছু ধইন্না পাতাও নিয়ো।’
শাহজাহান আজ ফার্মগেট থেকে আসাদ গেটের বাস না ধরে, ধরেন মালিবাগ-চৌধুরীপাড়া-গুলিস্তান রুটের বাস। বাসে তিনি বসার জায়গা পেলেন। এই অবসরে তিনি তাঁর বুক পকেটে রাখা তনীমার দেওয়া ঠিকানাটা চেক করে নেন আবার।
মালিবাগ নেমে তনীমার চৌধুরীপাড়ার বাড়ি খুঁজে পেতে খুব একটা সময় লাগে না তাঁর। ছোট্ট দোতলা বাড়ি। কলিংবেল বাজাতে তনীমা নিজেই দরজা খুলে দাঁড়ান। তিনি উৎফুল্ল হয়ে ওঠেন।
‘কী সৌভাগ্য আমার? তুমি এসে পড়বে আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। আসো…আসো…।’
প্রায় হাত ধরে তনীমা তাঁকে দোতলায় নিয়ে ড্রইংরুমের কুশনে বসিয়ে ভেতরে চলে যান। তিনি প্রস্তুত ছিলেন না। তাই তড়িঘড়ি করে ঘরে পরার জামাকাপড় পালটে সালোয়ার-কামিজ পরে পরিপাটি হয়ে ফিরে আসেন তনীমা।
‘বাড়ি চিনতে অসুবিধা হয়নি তো?’
‘না। খুব সহজেই পেয়ে গেছি।’
‘ভালো।’ তিনি ঘনিষ্ঠ হয়ে শাহজাহান সাহেবের পাশে গা-ঘেঁষে বসেন।
‘কী খাবে বলো, ঠান্ডা না গরম?’
‘কিছুই না। মাত্র নাস্তা খেয়ে এলাম।’
‘তাহলে ঠান্ডা পানি খাও। পথ ভেঙে এসেছ। বাইরে গরম। পরে চা-নাস্তা খাওয়া যাবে।’
শাহজাহান সাহেব সায় দেন।
‘তাই হোক।’
‘আচ্ছা… বলো তো… অনেকে বলে, দৈবচক্র-অদৃষ্ট এসব কুসংস্কার। আমি বলি, না, এসব সত্য। তা না হলে গতকাল আমাদের দেখা হলো কেমন করে? এত বছর পর…।’
শাহজাহান সাহেব হাসেন।
‘সংস্কার-কুসংস্কার এসব আমি ভালো বুঝি না।’ তনীমা প্রসঙ্গ পালটান।
‘তোমাকে কিন্তু আমি অনেক খুঁজেছি। ব্যাচমেটদের সঙ্গে দেখা হলে তোমার কথা জানতে চেয়েছি। কোনো খোঁজখবর পাইনি। অবশেষে ওই যে আমার ঘনিষ্ঠ বান্ধবী পাপিয়া… তোমার মনে আছে হয়তো… আমরা এক ক্লাসেই পড়তাম, সে একদিন জানালো তুমি সাতক্ষীরার এক বেসরকারি কলেজে আছো এবং বিয়ে করে সংসারধর্ম পালন করছ। এরপর আমি আর তোমার খোঁজখবর করার চেষ্টা করিনি।’
‘আমাদের ফাইনাল পরীক্ষার শেষের দিন আমি তোমাকে একটা থাপ্পড় মেরেছিলাম। মনে আছে?’
‘হ্যাঁ।’
‘এরপর বাড়ি ফিরে আমার ভীষণ মন খারাপ হয়ে গেল। থাপ্পড় খাওয়া তোমার চেহারাটা বারবার আমার চোখের সামনে ভাসছিল। সেদিন কী সকরুণ, কী কায়ক্লিষ্টের একটা চেহারা হয়েছিল তোমার। আমি ভুলতে পারি না।’
একটু থেমে আবার তিনি বলতে থাকেন, ‘তুমি তো এমন কিছু চাওনি আমার কাছে? সহপাঠী হিসেবে পরীক্ষা শেষে একসঙ্গে একটু চটপটি খাওয়া… এই তো। এটুকুন চাওয়ার অধিকার তোমার ছিল বইকি। তোমার গায়ে হাত তুলে আমি অন্যায় করেছিলাম। সেই অন্যায়বোধ থেকে তোমার প্রতি আমার আকর্ষণ বেড়েছিল। বেড়েছিল দুর্বলতাও।’
শাহজাহান সাহেব তনীমাকে থামানোর চেষ্টা করেন।
‘এতদিন পরে দেখা, থাক না এসব সামান্য কথা।’
তনীমা শাহজাহান সাহেবের আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে বসেন।
‘আমি লজ্জিত।’ এটুকুন বলে তনীমা শাহজাহান সাহেবের গালে হাত বুলিয়ে দেন।
‘এখানে মেরেছিলাম, তাই না?’
‘আমার মনে নেই।’ মৃদু হাসেন শাহজাহান সাহেব।
তনীমা উঠে চা-নাস্তা আনতে যান। শাহজাহান সাহেব পুরো পরিস্থিতিটা স্বাভাবিক সহজ করে তোলার চেষ্টা করেন।
‘ভালো কথা। ভাইসাহেব কোথায়? তোমার সন্তান-সন্ততি?’
তনীমাকে আনমনা দেখায়।
‘আমার স্বামীর কথা বলছো? ওর নাম তোবারক আলী মজুমদার। তিনি বন্ধুর সঙ্গে কার ইমপোর্ট, বেচাকেনার ব্যবসা করেন। তিনি সেই সুবাদে বেশির ভাগ সময় চিটাগাংয়ে থাকেন। আর আমার এক ছেলে এমবিএ করে কোম্পানি জব করে। বিয়ে করেছে। বড়লোকের মেয়ে। এ ছোট্ট বাড়ি বউয়ের পছন্দ নয়। তারা গ্রিনরোডে বাড়ি ভাড়া নিয়েছে।’
‘আমার জীবনবৃত্তান্তও অতি সহজ-সরল। এক মেয়ে। জামাই যশোরে সরকারি চাকুরে। আমি অবসরপ্রাপ্ত। ফার্মগেটের ছোট্ট বাড়িতে বুড়া-বুড়ি মিলে দিন গুজরান করি। আমার প্রধান কাজ বাজার করা, খাওয়া-ঘুমানো।’
তনীমা বাধা দেন।
‘সন্তান-সন্ততি বিয়ে দিলেই মানুষ বুড়িয়ে যায়, আমি মানি না। বয়স জিনিসটা মনের। মন দুর্বল হলেই এটা বাড়ে, না হলে এটা বাড়ে না।’
শাহজাহান সাহেবের কাছে তাঁর বক্তব্যটা কঠিন মনে হয়। তারপরও তিনি তাতে সম্মতি জানান, ‘হতে পারে।’
শাহজাহান সাহেব ঘড়ি দেখেন। তিনি উঠে দাঁড়ান।
‘এবার যেতে হয়। বেলা হয়েছে।’
‘আচ্ছা যাও। আরেকদিন এসো। দুপুরে খাবে আমার সঙ্গে। এমনিতে আমি খুব একটা রান্নাবান্না করি না। তুমি এলে রাঁধবো। কেমন?’
‘ঠিক আছে আসবো।’
তনীমা গেট খোলার আগে তাকে জড়িয়ে ধরে গালে চুমু খায়।
‘এখানেই তোমাকে মেরেছিলাম আমি।’ শাহজাহান সাহেব কিঞ্চিৎ জড়িয়ে যান।
দুপুরে শাহজাহান সাহেব ঘরে ফিরলে ইশার মা দৌড়ে আসেন। তোয়ালে নিয়ে।
‘ঠান্ডা পানি দিয়ে হাতমুখ ধুয়ে খেতে বসো। বাইরে যা গরম পড়েছে।’
খেতে বসে শাহজাহান সাহেব বানানো একটা কৈফিয়ত শোনান ইশার মাকে।
‘আর বোলো না। ব্যাংকে গিয়ে এক ভেজালে পড়ে গেলাম। বাজারে যেতে পারলাম না।’
‘কাল করলেই হবে।’ ইশার মাকে শান্ত শোনায়।
রাতের খাবার খেয়ে শাহজাহান সাহেব বারান্দায় গিয়ে বসেন। আশপাশের গলি থেকে ঠান্ডা বাতাস বইছে। পাশের লাইটপোস্ট ঘিরে অসংখ্য কীটপতঙ্গ মেলা বসিয়েছে। তিনি চুপচাপ বসে থাকেন। আধো অন্ধকারে। ইশার মা দ্বিতীয় খিলি পান দিয়ে যান। চলে যেতে থাকা শরীরের দিকে চেয়ে তাঁর মনে হতে থাকে, ইশার মায়ের রূপলাবণ্য তিনি কখনো মনোযোগ দিয়ে দেখেননি। অথচ এক দেখাতেই তনীমার অনেক কিছু লক্ষ করেছেন। তিনি গুছিয়ে কাপড়-জামা পরেন, চুল বাঁধেন। সুন্দর করে কথা বলেন। তাঁর দেহে বয়সের ছাপও তেমন পড়েনি। শাহজাহান সাহেব বুঝতে পারছেন, তিনি নিজের মধ্যে নিজে জড়িয়ে যাচ্ছেন। মনে স্বস্তি নেই একেবারে। উতলা, আনমনা হয়ে আছেন। তিনি স্পষ্টত ধরে নেন, এর মূল কারণের কেন্দ্রবিন্দুটা হলো, তাঁর জীবনে নতুন করে তনীমার উপস্থিতি। তিনি অনুভব করেন, তাঁর সহজ-সরল জীবনে মানসিক জটিলতা বাড়ছে। তনীমার সংস্রব ত্যাগ করতে না পারলে ভবিষ্যতে তা আরো বাড়বে। এর একটা উত্তরণের কথা ভাবতে থাকেন। এবং এক পর্যায়ে তিনি ধরে নেন, সমাধানটা তেমন কঠিনও নয়। তনীমার কাছে আর না গেলেই হলো। সব অস্থিরতা, মন কেমন করার অবসান হয়ে যাবে।
ভেবেচিন্তে অবশেষে শাহজাহান সাহেব অনড় সিদ্ধান্ত নেন যে, তনীমার বাড়ি আর তিনি যাবেন না।
সপ্তাহখানেক পর শাহজাহান সাহেব মোহাম্মদপুর বাজারে যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বের হন। কিন্তু তিনি অনেকটা নিয়ন্ত্রণহারা হয়েই যেন রাস্তা ক্রস করে মালিবাগ-চৌধুরীপাড়া-গুলিস্তান রুটের বাসে চড়ে বসেন। আজকাল রাস্তাঘাট তাঁর ভালো মনে থাকে না। তারপরও তিনি ধরে নেন, চৌধুরীপাড়ার রাস্তা ধরে সোজা এগিয়ে গিয়ে তনীমার বাড়ি খুঁজে নিতে তেমন অসুবিধা হবে না তাঁর।