কৃতঘ্ন

অর্জুনের কথা
‘আপনার স্ত্রী তো সুন্দরী?’
‘হ্যাঁ স্যার, লোকে বলে।’
‘আপনি বলেন না?’
‘এ্যাঁ হ্যাঁ, তিষা দেখতে খারাপ নয়।’
‘আমি জানি, আপনার স্ত্রী দুর্দান্ত সুন্দরী। আপনি বলছেন দেখতে খারাপ নয়!’
‘একসময় আমার চোখে ও দুর্দান্ত সুন্দরী ছিল স্যার। এখন আর তেমন সুন্দরী মনে হয় না তাকে।’
‘কেন, কেন মনে হয় না?’
‘নিত্যদিন দেখার জন্যে বোধ হয়। সবসময়ের দেখাদেখিতে অপরূপ সৌন্দর্যও সাধারণ পর্যায়ে নেমে আসে। আমার স্ত্রীর ক্ষেত্রেও হয়তো তাই হয়েছে। হয়তো সে-কারণেই এখন আর তাকে সুন্দরী মনে হয় না স্যার।’
‘তাহলে একসময় আপনার স্ত্রীকে সুন্দরী মনে হতো?’
‘হ্যাঁ স্যার, সে বিয়ের আগে। শুধু বিয়ের আগে কেন, বিয়ের পরও প্রথম দিকে তিষার সৌন্দর্য নিয়ে অহংকার করতাম আমি। ও হ্যাঁ স্যার, তিষাকে এখন আকর্ষণীয় মনে না হওয়ার আরেকটা কারণ থাকতে পারে।’
‘কী কারণ?’
‘‘মানুষ এমন তয় একবার পাইবার পর নিতান্ত মাটির মনে হয় তার সোনার মোহর।’ সৈয়দ হকের কথাটিই বোধ হয় লাগসই আমার জন্যে।”
‘কী আশ্চর্য! কবিতাও গড়গড় করে বলেন দেখি! কবিতা পড়েন নাকি?’
‘একসময় পড়তাম স্যার। হেলাল হাফিজ আমার মুখস্থ। শামসুর রাহমান, গুণ, সুনীল আমার প্রিয় কবি। ঠাকুরও আমার প্রিয় কবি স্যার।’
‘কোন ঠাকুর?’
‘ও হো স্যার। আমি রবিঠাকুরের কথা বলছি না, টোকন ঠাকুরের কথা বলছি স্যার।’
‘বেশ রসবোধ আছে দেখি আপনার। কবিতা পড়া লোক হয়ে এ-কাজ করতে গেলেন কেন?’
‘সে আমার দুর্ভাগ্য স্যার।’
‘দুর্ভাগ্য নয়, বলেন আপনার নষ্টামি। আপনি নষ্টলোক অর্জুনবাবু।’
‘আমি অস্বীকার করি না স্যার। আমি খারাপ লোক। খারাপ লোক না হলে স্ত্রীকে এরকম কষ্ট দেয় কেউ!’
‘স্ত্রীকে তো ভালোবাসতেন, একসময়।’
‘ভীষণ।’
‘এখন বাসেন না?’
‘বাসি স্যার। কিন্তু তিষা আমার ভালোবাসার মূল্য দেয় না ইদানীং।’
‘মানে আপনাকে একসময় তিষা দেবী ভালোবাসতেন। এখন বাসেন না। এই তো?’
‘একজেক্টলি স্যার।’
‘কেন আপনার মনে হলো তিষা দেবী আপনাকে ইদানীং ভালোবাসেন না?’
‘ওই যে স্যার, আমি একজন হারামি। তিষাকে আমি পাত্তা দিতাম না ইদানীং। তিষাও আমাকে ঘৃণা করে সেটা পুষিয়ে নিত।’
‘আপনাদের লাভ ম্যারেজ?’
‘হাফ লাভ, হাফ সেটেল্ড স্যার?’
‘অদ্ভুত ব্যাপার তো! সে কেমন? আমরা জানি হয় লাভ ম্যারেজ, নয় সেটেল্ড ম্যারেজ। হাফ লাভ, হাফ সেটেল্ড ম্যারেজের কথা শুনি তো আগে!’
‘আমাদের বিয়েটা একটু অদ্ভুতই স্যার।’
‘খুলে বলবেন কি একটু?’
‘প্রথমদিন থেকে শুরু করে আপনার আগ পর্যন্ত অনেককে বলেছি স্যার, এর আগে।’
‘আবার একটু বলেন।’
‘তার আগে একটু পানি খেতে চাই স্যার।’
‘ঠিক আছে, আমি ব্যবস্থা করছি।’
‘পানি তো খেলেন। এখন বলুন ঘটনাটা কী? আই মিন আপনাদের লাভ আর হাফ বিষয়ে।’
‘আমাদের বিল্ডিংটা স্যার চট্টেশ্বরী রোডে, ৪৯ চট্টেশ্বরী রোড। আমাদের বিল্ডিং মানে যেটাতে আমরা থাকি স্যার। এছাড়াও আমার বাবার আরো পাঁচ-সাতটা বিল্ডিং আছে এই শহরে। ওসব বিল্ডিংয়ের ফ্ল্যাটগুলো ভাড়া দেওয়া হয়েছে।’
‘বাই দি বাই, ভাড়া কে তোলে?’
‘আমার বড় ভাই-ই তুলত একসময়। বড় ভাই ইন্ডিয়ায় চলে যাওয়ায় আমার দাবু তোলে।’
‘দাবু! দাবু আবার কে?’
‘আমার বড় বোনের হাজব্যান্ড। আমার দুজন বোন। শুচিতা আর সুমিতা। শুচিতা সবার বড়। ইতালিতে থাকে। ওর হাজব্যান্ড ইতালিয়ান।’
‘আর সুমিতা?’
‘সুমিতা আমার মেজদি। তাকে বাবা ভুল জায়গায় বিয়ে দিয়েছিল।’
‘মানে!’
‘মানে স্যার আমাদের পরিবারের মেয়েকে যেরকম ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া উচিত ছিল, অমলেশ সেরকম ছেলে ছিল না।’
‘ও, তাহলে আপনার দাবুর নাম অমলেশ?’
‘হ্যাঁ স্যার। অমলেশ আমাদের অফিস ম্যানেজার রতনবাবুর ছেলে। আমাদের বাড়িতে অবাধ যাতায়াত ছিল অমলেশের, সেই ছোটবেলা থেকে।’
‘আসতে-যেতে আপনার মেজদির সঙ্গে দেখা হতো। তারপর মন দেওয়া-নেওয়া।’
‘একজেক্টলি স্যার। আপনি বুঝলেন কী করে স্যার?’
‘এরকম হরহামেশা হচ্ছে। সিক্সথ সেন্স বলল এরকম কিছু একটা।’
‘অমলেশ লেখাপড়া তেমন করেনি। বিএটা টেনেটুনে পাশ করেছে। ওর বাবা আমার বাপকে বলেকয়ে খাতুনগঞ্জে পিঁয়াজের একটা আড়ত খুলে দিয়েছিল।’
‘তো, ওই অমলেশ চৌধুরী বিএ-ই আপনাদের ফ্ল্যাটভাড়া আদায় করার অধিকার পেয়েছিল আপনার বাবার কাছ থেকে।’
‘ঠিক তা-ই স্যার। অমলেশ দাব্ইু ভাড়া তুলত। এতগুলো বিল্ডিংয়ের ভাড়া তো আর কম নয়! ব্যাগ ভরে টাকা আনত বাবার কাছে। পায়ের কাছে বসত। যেমন রামের পায়ের কাছে হনুমান।’
‘ভাড়া আদায়ের অধিকারটা আপনি পেলেন না কেন? ছেলেকে অধিকার না দিয়ে জামাইকে দেওয়া! বিষয়টা একটু গোলমেলে নয় কি?’
‘স্যার আপনার এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে আগের প্রসঙ্গটা শেষ করি!’
‘শিওর শিওর। করুন করুন।’
‘পায়ের কাছে বসে বসে দাবু বাবার এমন বিশ্বাস অর্জন করল যে, বছরখানেক পরে বাবা তার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নম্বরটা দাবুর দিকে এগিয়ে ধরে বলল টাকা মাসে মাসে আমার কাছে আনার দরকার নেই। ব্যাংকেই জমা দিয়ে দিও। খুব খুশি হয়েছিল স্যার সেদিন দাবু।’
‘এসব কথা জানলেন কী করে আপনি?’

‘আমি তো স্যার সবসময় বাইরে বাইরে থাকি। দায়িত্বহীনও বলতে পারেন, বাউণ্ডুলেও বলতে পারেন আমাকে। আপনি ঠিকই বলেছেন। আমার জানার কথা নয়। নাটকটি আমার স্ত্রীই দেখেছে স্যার। ঘটনাচক্রে ওইসময় ড্রইংরুমে চা দিতে গিয়েছিল শ্বশুরকে।’
‘তারপর?’

‘এক রাতে সে আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলেছিল, সর্বনাশ হতে যাচ্ছে এই পরিবারের। সব শুনে প্রচণ্ড খেপে গিয়েছিলাম আমি। বলেছিলাম পারিবারিক সম্প্রীতিতে ভাঙন ধরাতে চাইছ? তিষা চুপ মেরে গিয়েছিল।’
‘কোনো ফ্রডবাজি করেছে কি আপনার দাবু, এরপর?’
‘ন্না স্যার। দাবু অনেক ভালো মানুষ। আমার বাপ অনেক চালাকচতুর মানুষ। ওই ঘটনার পর এতদিন চলে গেল বাবা কোনোদিন দাবুর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ করেনি।’
‘বুঝলাম, অমলেশবাবু অত্যন্ত সৎলোক। নিজের ব্যবসা সচল রেখেও শ্বশুরকুলের সেবা করে গেছেন।’

‘ঠিকই বলেছেন স্যার, যেমন দাবু, তেমনি মেজদি। সবসময় আমাদের মঙ্গল চায়।’
‘আচ্ছা, আপনার কি একবারও মনে হয়নি, যে দায়িত্বটা মানে বিশ্বস্ততার দায়িত্ব, আপনার পালন করার কথা, সেই অধিকার আপনার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে আপনার বাবা অমলেশবাবুকে দিয়েছেন। রাগ লাগেনি আপনার?’
‘না স্যার, রাগ লাগেনি। আমি তো ফ্রডবাজ স্যার। ফ্রডবাজকে কেউ বিশ্বাস করে! করে না। আমার বাবাও করেনি।’
‘খুলে বলুন ব্যাপারটা, বুঝতে পারছি না।’
‘আপনাকে একটা কথা মিথ্যে বলেছি। ভাড়া তোলার দায়িত্ব, বড়দা ইন্ডিয়ায় চলে যাওয়ার পর, বাবা আমাকেই দিয়েছিল।’
‘পরে আপনার কাছ থেকে সেই অধিকার কেড়ে নিয়েছেন। নিয়ে আপনার দাবুকে দিয়েছেন  এই তো?’
‘হ্যাঁ স্যার।’
‘কেন কেড়ে নিলেন?’
‘ভাড়ার অধিকাংশ টাকাই আমি উড়িয়ে দিতাম। এই মদ-গাঁজা-ফেনসিডিল এসবে আর কি। বাবা একদিন, তাও বেশ কমাস পরে, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট চেক করতে গিয়ে দেখে আমি প্রতিমাসে সব টাকা জমা দিইনি।’
‘আচ্ছা যাক, আপনার বিয়ের প্রসঙ্গে ফিরে আসি। না থাক, আজকে অনেকটা সময় আপনার সঙ্গে কথা বললাম। আজ আর না। দু-একদিন পরে আবার আসব আমি।’
‘ঠিক আছে স্যার। স্যার, আমি কখন ছাড়া পাব?’
‘এই মুহূর্তে বলতে পারছি না। আগে তো প্রমাণিত হতে হবে যে আপনি আপনার বাবাকে খুন করেননি।’
‘বাবাকে খুন! বাবাকে তো আমি খুন করিনি স্যার।’
‘ধরা পড়লে সব অপরাধী এরকমই বলে। ডিআইবি ব্রাঞ্চ আমাকে দায়িত্ব দিয়েছে আসল খুনিকে বের করতে।’
‘আমি কি আসল খুনির তালিকায় আছি স্যার?’
‘শেষ কথা বলার সময় আসেনি এখনো। ও হ্যাঁ, আপনার হাফ লাভ হাফ সেটেল্ড ম্যারেজের কথা তো শোনা হলো না। আচ্ছা আজ থাক, আরেকদিন শুনব।’

তিষার কথা
‘তিষা দেবী, আমি আশরাফ, আশরাফ উল্লাহ। ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চে চাকরি করি। আপনার সঙ্গে দু-একটা কথা বলা প্রয়োজন। মানে দু-একটা বিষয়ে জানতে চাই। ঠিকঠাক জানতে পারলে আপনার শ্বশুরের খুনের ব্যাপারটির সুরাহা হবে।’
‘দাঁড়িয়ে কেন? বসুন। ওপাশের সোফায় বসুন। বলেন কী জানতে চান।’
‘বলছিলাম কী আপনাদের ফ্ল্যাটে কে কে থাকে বললে একটু ভালো হয়। ’
‘আমি, আমার শাশুড়ি, কাজের মাসি। শ্বশুর তো থাকতেনই। নিচে থাকে দারোয়ান। ও হ্যাঁ, আমাদের মানে আমার শ্বশুরের এক নিকটাত্মীয়াও থাকে এই ফ্ল্যাটে। রতন তার নাম। ডিভোর্সি।’
‘আর কেউ থাকে না?’
‘সবার কথাই তো বললাম। এরা ছাড়া আর তো কেউ থাকে না এখানে। আই মিন পারমানেন্টলি। হেসে উঠলেন কেন?’
‘হাসার কারণ তো আছেই। যার সঙ্গে ঘর করেন, তার কথা তো বললেন না!’
‘অর্জুনের কথা বলছেন? অর্জুন তো থাকেই।’
‘ভালো কোনো ব্যাপারে মানুষ যখন নামের তালিকা করে বা বলে তখন প্রিয়জনের নামই আগে আসে।’
‘আপনি বলতে চাইছেন অর্জুন আমার প্রিয়জন নয় কেন, স্বামী হয়েও?’
‘আপনার আইকিউ তো অনেক সার্প দেখছি তিষা দেবী। আচ্ছা বলুন তো, অর্জুনবাবুর সঙ্গে আপনার সমস্যাটা কোথায়?’
‘কই, কোনো সমস্যা তো নেই তার সঙ্গে!’
‘সমস্যা তো আছেই। নইলে তার নাম করলেন না কেন? ঘৃণাও করতেন নাকি তাকে, ইদানীং।’
‘ঘৃণা! কে বলেছে অর্জুনকে আমি ঘৃণা করি!’
‘অর্জুনবাবুই বলেছেন আপনাদের নাকি হাফ লাভ হাফ সেটেল্ড ম্যারেজ। প্রথম প্রথম বেশ আনন্দে ছিলেন। তারপর এমন কী হলো যে, অর্জুনবাবুকে আপনি ঘৃণা করতে শুরু করলেন।’
‘ও তো ঘৃণারই যোগ্য।’
‘ভালোবাসার নয়?’
‘একসময় ভালোবাসতাম তাকে।’
‘এখন নয় কেন?’
‘গাঁজারু, দায়িত্বহীন একজন স্বামীকে কে পছন্দ করে বলুন। তাও তো মেনে নিয়েছিলাম।’
‘মেনে নিয়েছিলেন! তাহলে দুজনের মধ্যে সমস্যাটা কোথায়?’
‘যেদিন ফেনসিডিলের বোতলসহ ধরা পড়ল পুলিশের হাতে, সেদিন থেকে ঘৃণা করা শুরু করি আমি অর্জুনকে। সে অ্যাডিক্টেড। শুধু অ্যাডিক্টেড নয়, বিকৃত রুচিরও।’
‘সে কেমন?’
‘খুলে বলতে পারব না। তার মোবাইলের ভিডিও অংশ চেক করলে বুঝতে পারবেন।’
‘আপনি বলছেন অর্জুনবাবু মাদকাসক্ত। মাদক কেনার জন্যে তো টাকার দরকার। উনি টাকা পেতেন কোথা থেকে? শুনেছি, আপনার শ্বশুর তাঁকে ব্যবসার কোনো দায়িত্ব দেননি। তার হাতে তো টাকা আসার কথা নয়।’
‘তার মা মানে আমার শাশুড়ি টাকার জোগান দিত অর্জুনকে। তাছাড়া বন্ধুদের কাছ থেকে টাকা ধার করত সে। এক-দুই টাকা নয়, লাখ লাখ টাকা। খারাপ ছেলেদের সঙ্গে মিশত সে। ওই নষ্টদের কেউ মাঝেমধ্যে দলবেঁধে এসে আমার শ্বশুরের কাছে টাকা দাবি করত।’
‘টাকা দাবি করত! কী আশ্চর্য!’
‘আশ্চর্যের কিছু শোনেননি তো এখনো। ওরা বলত ব্যবসার নাম করে আমাদের কাছ থেকে দু-লাখ টাকা ধার নিয়েছে আপনার ছেলে। এখন টাকা ফেরত দিচ্ছে না। আপনি শোধ না দিলে অর্জুনের ক্ষতি হবে।’
‘আপনার শ্বশুর কী করতেন তখন?’
‘ওখানেই আমার অবাক হওয়ার পালা। দ্বিরুক্তি না করে টাকা দিয়ে দিতেন শ্বশুর।’
‘অর্জুনবাবুকে কিছু বলতেন না?’
‘তাকে জিজ্ঞেস করলে ঋণ নেওয়ার কথা স্বীকার করত। কেন নিয়েছ এই প্রশ্নের জবাবে চুপ থাকত। এ নিয়ে একদিন খুব গোলমাল হলো।’
‘কী গোলমাল?’
‘শ্বশুর একদিন হাতের কাছে যা পেলেন, তা-ই দিয়ে পেটালেন অর্জুনকে। অশ্লীল গালিও বেরিয়ে এসেছিল সেদিন শ্বশুরের মুখ দিয়ে।’
‘এরপর নিশ্চয় অর্জনবাবু সংযত হয়ে গিয়েছিলেন। নেশা করা ছেড়ে দিয়েছিলেন।’
‘ছেড়ে তো দিত স্যার। কিন্তু পারল কোথায়!’
‘কেন পারল না?’
‘পারল না আমার শাশুড়ির জন্যে। পেটানোর সময় মাঝখানে এসে দাঁড়ালেন তিনি। গলা ফাটিয়ে বললেন আমার ছেলের গায়ে হাত! আরে বিয়ে করেছে সে! ঘরে বউ আছে তার। শ্বশুর মিউমিউ করে কী যেন বলতে চাইলেন। শাশুড়ি ধমকে উঠলেন তোমার তো টাকার পর্বত, দু-চার লাখ টাকা এমন কী টাকা যে ছেলেকে মারলে তুমি!’
‘আপনার শ্বশুর কী করলেন তখন?’
‘আমার শ্বশুর জরু কা গোলাম। চুপসে গেলেন।’
‘আর অর্জুনবাবুর স্ত্রী-আনুগত্য ছিল না?’
‘ছিল। প্রথম প্রথম। শেষের দিকে বিগড়ে গেল অর্জুন।’
‘আচ্ছা, প্রেমের বিয়ে নাকি আপনাদের। একটু খুলে বলবেন।’
‘আমরা একদিন ভাড়াটে হয়ে এলাম চট্টেশ্বরী রোডে। অর্জুনরা যে-গলিতে থাকত। অর্জুনরা থাকত রাজপ্রাসাদে। আমার বাবা পোস্ট অফিসের চাকুরে। আয় বুঝে ঘরভাড়া নিয়েছিল বাবা।’
‘আসা-যাওয়ার পথে দেখাশোনা আপনাদের।’
‘ঠিক বলছেন। লোভে পড়েছিলাম আমি। মা-ও উসকেছিল আমাকে। বলত ফিরাস না অর্জুনকে। কত বড় ব্যবসা, কত বড় বাড়ি! কত কত ধন-সম্পদ! কপাল ফিরে যাবে তোর।’
‘প্রেম করেননি চুটিয়ে?’
‘বিয়ের আগে এধার-ওধার ঘোরা হয়েছে, অনুরাগের সময় যা যা হয় তা-ও করেছি আমরা।’
‘বাঃ! বেশ তো গুছিয়ে বলেন আপনি! তারপর।’
‘বিয়ের কথা উঠলে গাঁইগুঁই করা শুরু করলেন অর্জুনের বাবা। বললেন অর্জুনকে বিয়ে করাব না এখন। আমার বাবা খুব খেপে গিয়েছিল। নিজের ঘরে গর্জাতে গর্জাতে বলেছিল  ছেলের প্রেমকাহিনিতে ভিলেন হয়ে দাঁড়াচ্ছে বাবা! ব্যবসায়ীদের যেমন আক্কেল! যৌতুক নিতে পারবে না তো আমার কাছ থেকে!’
‘বিয়েটা কি ফেঁসে যাচ্ছিল?’
‘তা বলতে পারেন। বাবা আমার শ্বশুর সম্পর্কে যে-অভিযোগ তুলেছিল, সেটা ঠিক নয়। বিয়েতে শ্বশুর এক টাকাও যৌতুক নেননি। তারপরও শেষ পর্যন্ত তিনি গড়িমসি করেছেন।’
‘তাহলে বিয়েটা হলো কী করে?’
‘শাশুড়ির চাপে। শাশুড়ি বলেছিলেন বড়টা থেকেও নেই। অর্জুনের আবদার পূরণ না করলে গলায় দড়ি দেবে নাকি সে।’
‘আপনি তো সুন্দরী। আপনার বাবা একেবারে ফেলনা চাকরি করতেন না। আমি যদ্দুর জানি, হেড অফিসে সেকেন্ড পোস্টমাস্টারের পদ থেকে পিআরএলে গেছেন তিনি। তারপরও গড়িমসি কেন আপনার শ্বশুরের?’
‘কারণ আমার শ্বশুর জানতেন  অর্জুন বখে গেছে, জানতেন ও গাঁজা-ফেনসিডিল ধরেছে। তিনি চাননি আমার জীবনটা বরবাদ হয়ে যাক।’
‘অর্জুনের ব্যাপারটি আপনি জানতেন না? বিয়ের আগে, প্রেম করার সময়?’
‘ঘুণাক্ষরেও না। ভালো ভালো জামাকাপড় পরে, গায়ে দামি সেন্ট মেখে হোন্ডা নিয়ে দেখা করতে যেত আমার সঙ্গে। কলেজগেটে অপেক্ষা করত সে, ছুটি হওয়া পর্যন্ত। আমার সঙ্গে তো আর নিত্যদিন দেখা হতো না। দেখা করার আগে হয়তো এসব ছাইপাশ খাওয়ার ব্যাপারে সতর্ক থাকত।’
‘বিয়ে তো হলো, শেষ পর্যন্ত। বিয়ের পর অর্জুনবাবু এসব ছেড়ে ব্যবসার কাজে মন দেননি?’
‘বাবা তাকে কখনো বিশ্বাস করেননি। বিয়ের পর প্রথম প্রথম অফিসে নিয়ে যেতেন। সেখানেও নাকি বিরাট অঙ্কের একটা ঘাপলা করেছে সে। শ্বশুর তাকে অফিসে যাওয়া নিষেধ করেছেন।’
‘তারপর, চলতেন কেমন করে অর্জুনবাবু? মানে গাঁজা, হেরোইন এসবের টাকা পেতেন কোথা থেকে? আগের মতো আপনার শাশুড়ি টাকা জোগাতেন?’
‘না স্যার। একদিন গভীররাতে বাথরুম ধরেছে। বাথরুম থেকে ফিরে বিছানায় উঠতে যাব, শ্বশুরের হুংকার শুনলাম। পাশাপাশি বেডরুম আমাদের। তারপরও শ্বশুরের হুংকার শুনতে পাওয়ার কথা নয়। সে-রাতে অসতর্কতাবশত দরজা বন্ধ করিনি। আমি পায়ে পায়ে শ্বশুরদের বেডরুমের দিকে এগিয়ে গিয়েছিলাম। শ্বশুরের গর্জন শুনলাম আর যদি ওই হারামজাদাকে একটি টাকাও দাও, তাহলে থাকতে পারবে না এ-বাড়িতে।’
‘আপনি শুনলেন, আপনার শ্বশুরের তর্জন-গর্জন, অর্জুনবাবু শোনেননি?’
‘ও শুনেছে কিনা জানি না। ও তো ওই কোনার বেডরুমে শোয়।’
‘মানে! আলাদা থাকেন নাকি অর্জুনবাবু? মাথা নিচু করে রাখবেন না তিষা দেবী।’
‘সে বেশ কিছুদিন আগে থেকে। যখন দেখলাম সে মানুষ হওয়ার নয়। আমিই বাধ্য করেছি তাকে, আলাদা থাকতে।’
‘তাতে উনি কোনো রিঅ্যাকশন দেখাননি?’
‘ও কি রিঅ্যাকশন দেখাবে! প্রথমে একটু চোখটোখ রাঙাতে চেয়েছিল, আমার দৃঢ়তার কাছে মাথা নোয়াতে বাধ্য হয়েছিল শেষ পর্যন্ত।’
‘আপনার শ্বশুর-শাশুড়ি! তাঁরা কিছু প্রতিক্রিয়া দেখাননি এ-ব্যাপারে!
‘শাশুড়ি তাঁর স্বভাবসুলভ হইচই তো করেছেন! ছেলের পক্ষ নিয়ে কথাও বলেছেন। কিন্তু আমার শ্বশুর আমাকেই সাপোর্ট করেছেন। বলেছেন যে-হারামি স্বামীর দায়িত্ব পালন করে না তার আবার দাবি কিসের রে! হারামজাদাকে বেডরুম থেকে বের করে দিয়ে বউ ঠিক কাজই করেছে।’
‘অর্জুনবাবু পিতার কথাকে মেনে নিয়েছেন?’
‘এ নিয়ে বাপে-পুতে লড়াই হয়েছে। শ্বশুর তাঁর সিদ্ধান্ত বদলাননি। আমাকে সমর্থন করে গেছেন।’
‘পিতা আর পুত্রের মধ্যে তাহলে মনোমালিন্য হয়েছে?’
‘তুমুল মনোমালিন্য। অর্জুন গর্জেছে। সময়ে দেখে নেওয়ার ধমকও দিয়েছে পিতাকে।’
‘তাই নাকি?’
‘ওইদিন থেকে বাপে-ছেলে কথা বলাবলি বন্ধ?’
‘কতদিন কথা বলাবলি বন্ধ ছিল?’
‘শ্বশুর খুন হওয়ার আগের দিন পর্যন্ত।’
‘আচ্ছা, আপনার কাছ থেকে আরেকটা কথা জানতে চাই, অর্জুনবাবুকে আপনার শাশুড়ি টাকা দেওয়া বন্ধ করেছিলেন। কিন্তু আমি যদ্দুর জানি অর্জুনবাবু ফুল্লি অ্যাডিক্টেড হয়ে পড়েছেন। যতক্ষণ চেতনা থাকে তাঁর, কিছু না কিছু খান তিনি। এই গাঁজা, চরস, ফেনসিডিল, হেরোইন।’
‘আগে তো রেখেঢেকে খেত। ইদানীং ঘরে বসেই খাওয়া শুরু করেছিল সে, নিচে দারোয়ানের ঘরে বসেই খেত সে।’
‘আপনার শ্বশুর জানতেন না?’
‘জানিয়েছি তাঁকে অনেকবার। কিছু করার শক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন তিনি। ওইদিনের বেয়াদবির পর ভয় করতে শুরু করেছিলেন শ্বশুর অর্জুনকে।’
‘আই সি। বাই দি বাই আরেকটা কথা জিজ্ঞেস করতে চাই। যদি কিছু মনে না করেন।’
‘বলুন।’
‘আপনাদের মধ্যে সেক্সচুয়াল অ্যাটাচ্মেন্ট হতো না?’
‘অনেকদিন নয়।’
‘ও আচ্ছা। আচ্ছা তিষা দেবী, আপনার শ্বশুরের ধমক খেয়ে শাশুড়ি তো টাকা বন্ধ করেছিলেন। পরবর্তীকালে অর্জুনবাবুকে কে টাকা জোগাত বলে আপনার মনে হয়।’
‘সে তো আমি বলতে পারব না। তবে বেশ কবছর ধরে দাবুই শ্বশুরের সকল জমাখরচের হিসাব রাখত।’
‘বলতে চাইছেন আপনাদের দাবু অমলেশবাবুই অর্জুনবাবুকে মাদকের টাকা সরবরাহ করত।’
‘আপনি ভুল ব্যাখ্যা করলেন স্যার আমার কথার। ওরকম কথা বলছি না আমি। জানতে চাইলেন তাই বললাম।’
‘আচ্ছা তিষা দেবী, আপনার অনেকটা সময় নিয়ে নিলাম আমি। আজ যাই। প্রয়োজনে আবার আসব। ও আচ্ছা, ভুলে গিয়েছিলাম, আপনার শ্বশুরকে তো পানির সঙ্গে বিষ খাইয়ে মারা হয়েছে। পোস্টমর্টেমের রিপোর্টে তাই বলা হয়েছে। এ-ব্যাপারে আপনার কোনো বক্তব্য’
‘শ্বশুর প্রতি সকালে ঘুম থেকে জেগে বিছানায় বসা অবস্থায় এক গ্লাস জল খেতেন স্যার। জল রাখাটা আমার ডিউটি ছিল স্যার, বিয়ের পর থেকে। শ্বশুরকে ভালোবেসেই এই কাজটা করতাম আমি। রাতেই ওঁর মাথার পাশের টুলে ঢাকনা দিয়ে জলের গ্লাসটা রেখে আসতাম আমি। প্রতিদিন ভোর সকালে উঠতে পারতাম না বলে রাতে জল রাখা।’
‘ওই গ্লাসের পানিতেই বিষ ছিল। ওই পানি খেয়েই তিনি মারা গেছেন।’
‘কী বলতে চাইছেন স্যার আপনি।’
‘বলছি, আমাদের তর্জনীটা আপনার দিকেই তিষা দেবী। আচ্ছা যাই এখন।’

আবার অর্জুনের কথা
‘অর্জুনবাবু, আপনার সঙ্গে তো আপনার বাবার ভালো সম্পর্ক ছিল না।’
‘কে বলল?’
‘ইনভেস্টিগেশনের কাজে নানাজনের সঙ্গে কথা বলতে হয় আমাদের। ধরে নিন আপনাদের পরিবারের কেউ না কেউ বলেছেন।’
‘হ্যাঁ, বাবার সঙ্গে খুব একটা ভালো সম্পর্ক যাচ্ছিল না আমার।’
‘কেন বলুন তো?’
‘এপারে মানে বাংলাদেশে আমিই তো তার একমাত্র পুত্র। ব্যবসা-বাণিজ্য দেখার, টাকা-পয়সা নাড়াচাড়া করার সকল অধিকার তো আমারই, কী বলেন স্যার।’
‘তো!’
‘বাবা আমাকে সেই অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে। তাছাড়া…’
‘স্ত্রীর অধিকার থেকেও বঞ্চিত করেছেন। কী বলেন।’
‘তাও জেনে গেছেন দেখি স্যার।’
‘আপনি তো অ্যাডিক্টেড। বাবার টাকা নয়ছয় করেন। আপনার হাতে আপনার বাবা সব সঁপে দেবেন কোন ভরসায়!’
‘অ্যাডিক্টেড মানলাম স্যার। আমাকে ভালো করার জন্যে তো মা-বাবা কোনো চেষ্টা করেনি। শুধু মারধর আর গালাগাল!’
‘এতে আপনি আপনার বাবার ওপর খুব খেপেছিলেন।’
‘এরকম বঞ্চিত হলে আপনিও তো তা-ই করতেন স্যার।’
‘এই যে আপনার কাছ থেকে ঘরভাড়া তোলার বা ব্যবসা-বাণিজ্যের অধিকার ধীরে ধীরে আপনার বাবা কেড়ে নিয়ে আপনার দাবুকে দিলেন, খারাপ লাগেনি আপনার?’
‘প্রথম প্রথম লাগত। শেষের দিকে লাগত না?’
‘কেন কেন?’
‘শেষের দিকে দাবুই তো আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন।’
‘মানে! বুঝলাম না। খুলে বলুন।’
‘গাঁজা, ফেনসিডিল, হেরোইন কেনার টাকা দিতেন আমাকে। চাহিদার চেয়ে বেশি দিতেন।’
‘তা-ই নাকি! আপনার অ্যাডিকশনের টাকা জোগাতেন তিনি!’
‘তা-ই স্যার।’
‘আচ্ছা, আরেকটা ব্যাপারে তো আপনি আপনার বাবার ওপর রেগে ছিলেন, তাই না?’
‘কোন ব্যাপারে স্যার?’
‘আপনাকে বেডরুম থেকে পারমানেন্টলি বের করে দেওয়া। স্ত্রীর সঙ্গে আপনার সেক্সচুয়াল কানেকশন বন্ধ হয়ে যাওয়া।’
‘আমার বড় ভাইটি বউ দ্বারা প্ররোচিত হয়ে ইন্ডিয়ায় চলে গেছে স্যার। ওখানেও বাবার ঘরবাড়ি আছে। কৌশলে ওসব দাদা নিজের নামে করে নিয়েছে। বাবা তাকে অনেকটা ত্যাজ্য করেছে। এপারের সকল সম্পত্তির মালিক বাবার অবর্তমানে আমি। আমার খুব অভিমান বাবার ওপর। বাবা আমাকে সুস্থ করে তুলবার কোনো চেষ্টা করল না। উপরন্তু ঘৃণা, মারধর এসব করতে লাগল। এবং টাকা-পয়সা সংক্রান্ত সকল কাজে দাবুকে ব্যবহার করল। এখন শুধুমাত্র উত্তরাধিকারিত্ব ছাড়া সবকিছুর অধিকার দাবুর, এই পরিবারের।’
‘আপনার বাবাকে তো বিষ খাইয়ে মারা হয়েছে। পানির সঙ্গে।’
‘তা-ই নাকি!’
‘কেন, জানতেন না আপনি?’
‘কী করে জানব স্যার? যেদিন বাবা খুন হলো, ওইদিন সকালেই তো আমাকে অ্যারেস্ট করা হলো। বিছানা থেকে তুলে হাতকড়া লাগিয়ে থানায় নিয়ে আসা হয়েছিল আমাকে। তারপর থেকে তো জেলে। কেমনে বাবাকে মারা হলো জানব কী করে স্যার?’
‘মারা হলো বলছেন কেন? হত্যা তো আপনিও করতে পারেন। আপনি তো এ দায় এড়াতে পারেন না।’
‘সাদা চোখে বিচার করলে আমি খুনির দায় থেকে মুক্তি পেতে পারি না। বাবার সঙ্গে আমার মতের অমিল ছিল অনেক জায়গায়। গাঁজা-হেরোইন খেতাম আমি, বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে বাবার ওপর চাপ সৃষ্টি করতাম। এককথায় আমি কুলাঙ্গার স্যার। তবে বাবারও তো দায় ছিল আমাকে সুস্থ করে তোলার। একজন তরুণের স্ত্রী-বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকা যে কী কষ্টের, তা আপনার মতো বয়সীরা বুঝবেন না। মানুষের জীবনে নারী একটা বিরাট ফ্যাক্টর স্যার। বাবা আমাকে সেখান থেকেও বঞ্চিত করেছে। আই মিন তিষা যখন আমাকে বেডরুম থেকে বের করে দেয়, বাবা কোনো উচ্চবাচ্য করেনি। বরং নীরব থেকে সমর্থন জানিয়েছে তিষাকে। তার ওপর আমার ক্ষোভ থাকা তো স্বাভাবিক। তবে স্যার, এ-কথা ঠিক যে, বাবাকে আমি খুন করিনি।’
‘সব খুনিরা আপনার মতোই বলে। আচ্ছা আসি অর্জুনবাবু।’

অমলেশের কথা
‘আপনিই তো অমলেশবাবু? সদানন্দবাবুর জামাই!’
‘কে আপনি? কথা নেই, পারমিশন নেই, হুট করে ঢুকে গেছেন অফিসে! একেবারে মালিকের পারসোনাল রুমে!’
‘জি, আমি একজন ডিআইবি কর্মকর্তা। যেখানে-সেখানে ঢোকার অধিকার আমার আছে। কোনো একটা খুনের ইনভেস্টিগেটের দায়িত্ব পেলে সেই অধিকার আরো পোক্ত হয়।’
‘বুঝলাম না।’
‘আমার নাম আশরাফ উল্লাহ। আপনার শ্বশুরের খুন হওয়ার ব্যাপারে ইনভেস্টিগেটের দায়িত্ব পড়েছে আমার ওপর। খুনের ব্যাপারে দু-চারটি কথা বলতে চাই আপনার সঙ্গে। আ-হা-হা! এভাবে কেঁদে উঠলেন কেন আপনি?’
‘স্যার উনি আমার শ্বশুর ছিলেন না, আমার বাপ ছিলেন, বাপ। শ্বশুর মারা যাননি আমার, বাবা মারা গেছেন স্যার। আমার জন্মদাতা খুন হলেও আমি এরকম শক্ড হতাম না স্যার।’
‘কেন এরকম শকড্ হতেন না?’
‘বাবা আমাকে জন্ম দিয়েছেন স্যার। শ্বশুরবাবা আমাকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন। অফিসের এই যে শান-শওকত, আমার ব্যবসার রমরমা সবই তো শ্বশুরেরই দান স্যার।’
‘আপনাকে খুব বিশ্বাস করতেন আপনার শ্বশুর। এমন বিশ্বাস করতেন যে, ওঁর ব্যাংকের লেনদেন পর্যন্ত আপনাকে দিয়ে করাতেন। তাই না?’
‘জি স্যার।’
‘ছেলে থাকতে সকল কিছুর দায়িত্ব আপনার ওপর চাপিয়েছিলেন আপনার শ্বশুর। বিষয়টা একটু ভাবনার নয় কি?’
‘ভাবনার কিনা জানি না স্যার। তবে শ্বশুর আমাকে খুবই বিশ্বাস করতেন, যে-বিশ্বাস অর্জুনকে করতেন না। অর্জুন ডিরেইল্ড হয়ে গিয়েছিল স্যার। শ্বশুরের কথা শুনত না। আজেবাজে ছেলের সঙ্গে মিশত। মদ ভাঙ গাঁজা হেরোইন…।’
‘থামেন থামেন। সব জানি আমি। আপনি শুধু বলুন অর্জুনের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কেমন?’
‘ভালো। ভালো স্যার।’
‘আপনার শ্বশুর-শাশুড়ি টাকা দেওয়া বন্ধ করে দেওয়ার পর আপনি কি অর্জুনবাবুকে টাকা জোগাতেন?’
‘ঠিক জোগানো নয় স্যার, মাঝেমধ্যে হাত পাতত সে আমার সামনে। ছোট শ্যালক স্যার, আবদার তো পূরণ করতেই হতো। তাছাড়া আমার এই ধন-ঐশ্বর্য তো অর্জুনের বাবার কারণেই।’
‘এমনভাবে আবদার পূরণ করতেন মানে এত বিপুল পরিমাণ টাকা দিতেন যে অর্জুনবাবু আরো বেশি অ্যাডিক্টেড হয়ে পড়ার সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে গিয়েছিল। ইদানীং তো এসব খেয়ে খেয়ে দিনরাতের অধিকাংশ সময়েই বেহুঁশ হয়েই থাকতেন অর্জুনবাবু।’
‘কী যে বলেন স্যার! এত বেশি টাকা কোথায় স্যার! সামান্য টাকা দিতাম।’
‘আচ্ছা অমলেশবাবু, আরেকটা কথা বলেন শ্বশুরের টাকা লেনদেনের ব্যাপারে কোনোদিন তাঁর সঙ্গে কোনো মনকষাকষি হয়েছিল আপনার? আই মিন ফ্রডবাজি, জোচ্চুরি এসব নিয়ে।’
‘কী বলছেন স্যার, বুঝতে পারছি না! শ্বশুরের সঙ্গে ফ্রডবাজি করতে যাব কেন স্যার! শ্বশুরই তো আমার সবকিছু স্যার। উনি আমার দেবতা স্যার। হিঃ হিঃ হিঃ।’
‘কাঁদবেন না অমলেশবাবু। কাঁদবেন না। কাঁদার তো এখনো অনেক সময় পড়ে আছে। আচ্ছা, আপনি আমার আরেকটা প্রশ্নের জবাব দিন, ২৭ মে আপনার শ্বশুর খুন হন। সেদিন বা তার আগের দিন আপনি কি শ্বশুরের ফ্ল্যাটে গিয়েছিলেন?’
‘শ্বশুর খুন হয়েছেন প্রায় তিন মাস হতে চলল স্যার। আমি ঠিক মনে করতে পারছি না, ওই তারিখে বা তার আশপাশের তারিখে শ্বশুরের ফ্ল্যাটে গেছি কিনা।’
‘মনে করার চেষ্টা করতে থাকুন। আচ্ছা যাই অমলেশবাবু। আবার দেখা হতেও পারে।’

মাসিমার কথা
‘নমস্কার মাসি। মাসিই ডাকলাম আপনাকে। আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনি আমার মাসির বয়সীই হবেন। কিছু মনে করবেন না। আপনার বেডরুমেই আসতে হলো আমাকে। এই বিছানাতেই তো আপনার স্বামী খুন হয়েছেন? রুমটা আমার একটু দেখার দরকার ছিল। আর আপনার সঙ্গে একটু কথা বলাও।’
‘আমার তো সব শেষ হয়ে গেল রে বাবা। আমার শ্যামও গেছে, কুলও গেছে।’
‘আমি আপনার কষ্টটা পুরোপুরি হৃদয়ঙ্গম করতে না পারলেও অনেকটা বুঝি। এই বয়সে স্বামী হারানোর কী যে বেদনা সে আমার মাকে দেখে বুঝেছি মাসি। আপনার তো দু-দুটো ছেলে, দুটো মেয়ে, তাদের দেখেশুনে কষ্টটা ভোলার চেষ্টা করুন।’
‘ছেলের কথা বলছ বাবা! বড়টা তো দুর্যোধন। ছোটটা যুধিষ্ঠির হবে ভেবেছিলাম, কিন্তু সেও হয়ে গেল দুর্যোধনের ভাই দুঃশাসন। বাপের কথা মানল না, পরামর্শ শুনল না, ব্যবসা দেখল না, পড়ে থাকল মদ-গাঁজা নিয়ে! এই সুযোগে সুই হয়ে ঢুকল অমলেশটা। হরে কৃষ্ণ! কপালে কী আছে জানি না বাবা!’
‘মাসি, সুচ হয়ে ঢুকল কথাটার মানে বুঝলাম না মাসি!’
‘অর্জুন যদি ঠিকঠাক মতো চলত, নেশা ছেড়ে দিত, তাহলে তো ও-ই হতো এই সেনবাড়ির কর্তা। নেশাখোর সে। সুযোগ পেয়ে অমলেশের হাতে চলে গেল সব ক্ষমতা। জানি না আমাদের ভবিষ্যৎটা কীরকম হবে! আর আমার স্বামী! তাকে বেঘোরে প্রাণ দিতে হলো। হায় ভগবান…।’
‘নিজেকে সংযত করুন মাসি। যা হওয়ার হয়ে গেছে। এখন আমাদের কর্তব্য খুনিকে খুঁজে বের করে উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া। এজন্য আপনার সাহায্য চাই। আপনি চোখ মোছেন মাসিমা।’
‘বলো বাবা কী জানতে চাও।’
‘সদানন্দবাবুর সঙ্গে অমলেশবাবুর আই মিন আপনার জামাইয়ের টাকা-পয়সা, চেকফেক নিয়ে কোনোদিন কোনো মনোমালিন্য হয়নি?’
‘কই না তো! সেরকম তো কিছু মনে পড়ছে না।’
‘একটু ভেবে বলুন মাসি।’
‘এ্যাঁ হ্যাঁ! একবার একটু গণ্ডগোল, ঠিক গণ্ডগোল না ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল।’
‘কী রকম?’
‘একবার শ্বশুরের সই করা দশ লাখ টাকার একটা চেক নিয়ে ব্যাংকে গিয়েছিল অমলেশ। ম্যানেজারের একটু সন্দেহ হয়েছিল স্বাক্ষরে। ফোনে ম্যানেজার জানাতেই রেগে গিয়েছিল অর্জুনের বাবা। বলেছিল অমলেশ আমার মেয়ের জামাই বটে, কিন্তু ছেলের বাড়া। আমার স্বাক্ষরে সন্দেহ করার কোনো কারণ নেই। খুব সোজা স্বাক্ষর। প্যাঁচগোছ নাই। বেশ কদিন অসুস্থ আমি। তাই স্বাক্ষরে সামান্য গরমিল হতে পারে। ম্যানেজার মাফ চেয়ে নিয়েছিল ওঁর কাছে।’
‘ও আচ্ছা। আর কোনো ঘটনা। এরকম জাতীয় কিছু।’
‘হুম! এক রাতে, খুন হওয়ার বেশিদিন আগে নয়, খুব চোটপাট করছিল অমলেশের সঙ্গে। কারণ জিজ্ঞেস করেছিলাম। অভ্যেস ভেঙে আমার ওপর খেপে গিয়েছিল। বলেছিল মাইয়া মানুষ! সব কথায় নাক গলাও কেন? খুব মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল আমার। অভিমানে চুপ মেরে গিয়েছিলাম।’
‘আচ্ছা মাসি, খুনের দিন বা তার আগের দিন অমলেশবাবু কি আপনাদের ফ্ল্যাটে এসেছিলেন?’
‘এসেছিল তো। খুন হওয়ার দিন ভোরসকালেই তো এসেছিল।’
‘মানে!’
‘হ্যাঁ তো। আমার খুব বাথরুম পেয়েছিল। বাথরুমে যাচ্ছিলাম আমি। ওই সময় অমলেশ ঢুকেছিল আমাদের বেডরুমে। আমাকে বলেছিল আজ গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে বেতন দিতে হবে। চেকে বাবার সই দরকার। আমি বলেছিলাম – ও তো ঘুম থেকে জাগেনি এখনো। তুমি ওই চেয়ারে বসো। এখনই জেগে যাবে। আমি একটু আসি বলে বাথরুমে ঢুকে পড়েছিলাম।’
‘বাথরুম থেকে ফিরে অমলেশবাবুকে দেখতে পেয়েছিলেন কি?’
‘না, এর আগেই সই নিয়ে চলে গিয়েছিল অমলেশ।’
‘আপনার স্বামীকে কি জাগা অবস্থায় পেয়েছিলেন, টয়লেট থেকে ফিরে?’
‘না তো! ও তো ঘুমেই ছিল? তাহলে অমলেশ স্বাক্ষর নিল কার কাছ থেকে!’
‘আচ্ছা মাসিমা, আরেকটা প্রশ্ন। আপনার স্বামীর শিয়রের পাশে তো গ্লাসভর্তি পানি থাকত।’
‘হ্যাঁ, সকালে ঘুম থেকে উঠেই পানি খাওয়া ওর আজীবনের অভ্যাস। ওইদিনও জলভর্তি গ্লাস ছিল ওই টুলটার ওপর।’
‘আপনার পুত্রবধূই তো পানি দিয়ে যেত রাতে?’
‘হ্যাঁ, এটা ওর দায়িত্ব বলে ধরে নিয়েছিল তিষা। বিয়ের পর থেকেই জল দিয়ে আসছিল সে।’
‘আচ্ছা মাসি, কাউকে কি সন্দেহ হয় আপনার? সদানন্দবাবুর খুনের ব্যাপারে?’
‘কাকে সন্দেহ করব বাবা। যারা সন্দেহের, তারা তো সবাই আমার আপনজন। মেয়ের জামাই, ছেলে, ছেলের বউ!’
‘ঠিক আছে মাসিমা। যা জানার জেনে গেছি। আজ যাই। শিগগির হয়তো আবার দেখা হবে আপনার সঙ্গে।’

আশরাফ উল্লাহর কথা
‘বসুন আপনারা সবাই। চেয়ারে সোফায় যার যেখানে ইচ্ছে বসতে পারেন। সদানন্দবাবু এমন ড্রইংরুম বানিয়েছেন পঞ্চাশজন মানুষ ইজিলি বসতে পারবে। ও হ্যাঁ, আপনাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই  ইনি পাঁচলাইশ থানার ওসি। আপনিও বসেন ওসি সাহেব। আপনারা দেখতে পাচ্ছেন অর্জুনবাবুকেও কাস্টডি থেকে আনা হয়েছে। বসুন তিষা দেবী, অমলেশবাবু আপনিও। আর আপনি তো সদানন্দবাবুর মেজ মেয়ে মেনকা দেবী? আপনিও বসুন। আর মাসিমা আপনি ওই নরম সোফাটায় বসুন। আমার পরিচয় তো আপনাদের আর দিতে হবে না। এতদিনের আলাপে-সাক্ষাতে আমাকে চিনে গেছেন। যেদিন কেসটা ডিআইবিতে গেল, সেদিনই দায়িত্বটা পড়ল আমার ওপর। কেসটাকে আমি সিরিয়াসলি নিয়েছি। শহরের এরকম একজন গণ্যমান্য মানুষ! বেঘোরেই প্রাণ গেল তাঁর!’
‘বাবা, আমার খুব টেনশন লাগছে। তুমি একটু সংক্ষেপে তাড়াতাড়ি বলো বাবা।’
‘ঠিক আছে মাসিমা, আমি ডিটেইলসে যাব না। সংক্ষেপেই বলছি। তিষা দেবীকে আমি খুনের দায় থেকে মুক্তি দিচ্ছি। শিক্ষিত মহিলা। দায়িত্বশীল। মনে যা-ই কষ্ট থাকুক, শ্বশুরের প্রতি শ্রদ্ধা পোষণ করতেন ভীষণভাবে। স্বামীসুখবঞ্চিত। দাম্পত্যসুখহীন একজন নারী ঠোঁট চেপে সংসার করে যাচ্ছিলেন। শাশুড়ির কাছেও তেমন করে আশ্রয় পাননি। শ্বশুরই তাঁকে যা একটু আশ্রয়-ভালোবাসা দিয়েছিলেন। ওই শ্বশুরকে তিষা দেবী খুন করতে পারেন না।’
‘খুনের দায় এসে পড়ে অর্জুনবাবুর ওপর। তাঁরই সদানন্দবাবুকে খুন করার সম্ভাবনা বেশি। অর্জুনবাবু মাদকাসক্ত। মাদকাসক্তরা একরোখা হয়। হিতাহিত জ্ঞান থাকে না তাদের। অর্জুনবাবু বঞ্চিত হয়েছিলেন নিজের অধিকার থেকে। অবশ্য বঞ্চিত হওয়ার দায় তাঁরই বেশি। এত বড় পরিবারের ছেলে হয়েও তিনি কুসঙ্গে মিশেছেন, বন্ধুদের দিয়ে বাবাকে এক্সপ্লয়েট করিয়েছেন। আর যাঁকে প্রেম করে বিয়ে করেছেন, তাঁকে তিনি যথার্থ মর্যাদা দেননি। প্রয়োজনের সঙ্গী বানাতে চেয়েছেন। তিষা দেবী বাদ সেধেছেন। সদানন্দবাবু তাঁকে সমর্থন করেছেন। ফলে বাবার ওপর অর্জুনবাবুর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠার কথা। এই ক্ষোভটা আরো বেড়ে গিয়েছিল সেদিন, যেদিন সদানন্দবাবু ভাড়া তোলার অধিকারটা অমলেশবাবুকে দিয়ে দিলেন। এসব ক্ষোভ-বঞ্চনার কারণে মাদকাসক্ত অর্জুনবাবু নিজের বাবাকে খুন করতেই পারেন। আর পানিতে বিষ মেশানো তাঁর জন্য খুব কঠিন কাজ নয়। তিনি এই ফ্ল্যাটেই তো থাকতেন। কিন্তু তিনিও খুন করেননি। করেননি এজন্য যে, তিনি একজন ভীতু মানুষ। তাছাড়া, সদানন্দবাবু তাঁর পিতা। পিতাকে খুন করার মতো মনের জোর অর্জুনবাবুর নেই। তাছাড়া তিনি হয়তো এ-ও ভেবেছিলেন, পিতার স্বাভাবিক মৃত্যুর পর তো সকল সম্পত্তির মালিক তিনিই হবেন। খুন করার দরকার কী? সদানন্দবাবু দুটো ভুল করেছিলেন?’
‘কী ভুল? কী ভুল করেছিলেন শ্বশুরমশাই?’
‘একটু ধৈর্য ধরুন তিষা দেবী। বুঝিয়ে বলছি। সদানন্দবাবু যে পরিমাণ টাকা অর্জুনবাবুর জন্যে গচ্চা দিয়েছিলেন, তার অনেক কম টাকায় অর্জুনবাবুকে ভালো করে তুলতে পারতেন। ছেলেকে সুস্থ করে তোলার ব্যাপারে তাঁর সদিচ্ছার অভাব ছিল। যদি সদিচ্ছা থাকত, অর্জুনবাবুকে কোনো নিরাময় কেন্দ্রে পাঠাতেন।’
‘আর দ্বিতীয় ভুলটা বাবার?’
‘উভয় ভুলের জন্যে আপনিও দায়ী মাসিমা। আমি জানি সদানন্দবাবু একগুঁয়ে প্রকৃতির ছিলেন, কারো কথা শুনতে চাইতেন না তিনি। আপনাকে খুব বেশি পাত্তা দিতেন না তিনি। তারপরও সদানন্দবাবুকে বলেকয়ে নিরাময় কেন্দ্রে পাঠাতে পারতেন অর্জুনকে। যে জোর খাটিয়ে অর্জুনবাবুকে বিয়ে করিয়েছিলেন তিষা দেবীকে, সে-জোরটা যদি অর্জুনবাবুর নিরাময়ের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতেন, তাহলে খুন হতেন না সদানন্দবাবু।’
‘খুন হতেন না!’
‘না তিষা দেবী, খুন হতেন না আপনার শ্বশুর। অর্জুন যদি সুস্থ থাকতেন, অফিস-ব্যবসার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতেন, তাহলে টাকা-চেক লেনদেনের সুযোগটা পেতেন না অমলেশবাবু। কী বলেন অমলেশবাবু?’
‘আমি আর কী বলব! শ্বশুর ইচ্ছে করে আমার ওপর দায়িত্ব বর্তিয়েছেন, আমি দায়িত্ব পালন করেছি শুধু।’
‘না আপনি শুধু দায়িত্ব পালন করেননি, শ্বশুরকে ঠকিয়েছেনও।’
‘কী আজেবাজে বকছেন আপনি!’
‘আজেবাজে নয়, আমি ঠিক কথাই বলছি মেনকা দেবী। অমলেশবাবু আপনার বাবার দুর্বলতার সুযোগ নিয়েছেন পুরোদমে। তিনি একটা বিরাট পরিকল্পনা নিয়ে কাজে নেমেছিলেন। জানি না সে-পরিকল্পনায় আপনার হাত আছে কিনা। চাইলে তা-ও বের করতে পারব আমি। যা হোক, পিতা পুত্রের ওপর বিরূপ এই সুযোগটা প্রথম কাজে লাগালেন অমলেশবাবু। অতি শ্রদ্ধা ও আনুগত্য দেখিয়ে শ্বশুরের মন জয় করে নিলেন। ব্যাংকে টাকা লেনদেনের অধিকার পেয়ে গেলেন তিনি। মা-বাবার কাছ থেকে টাকা না পেয়ে অর্জুনবাবু তখন দিশেহারা। বোনজামাইয়ের কাছে হাত পাততে দ্বিধা করলেন না অর্জুন। সুযোগ পেয়ে গেলেন অমলেশবাবু। প্রয়োজনের অধিক টাকা দেওয়া শুরু করলেন তিনি অর্জুনকে। উদ্দেশ্য আরো বেশি করে মাদকাসক্ত হয়ে পড়–ন অর্জুনবাবু। তাহলে পিতার কাছে আরো বেশি নিকৃষ্ট প্রাণী হিসেবে গণ্য হতে থাকবেন অর্জুনবাবু। মাদকাসক্তরা একদিন না একদিন তো অকালে প্রাণ হারায়। অর্জুনও একদিন মারা যাবে। তারপর শ্বশুরের এই বিশাল সাম্রাজ্য, এই ধনসম্পদ তো শুধু তাঁরই। কী বলেন অমলেশবাবু?’
‘আপনি কী আবোল-তাবোল বকছেন কিছুই তো বুঝতে পারছি না।’
‘বুঝবেন। একটু পরে বুঝতে পারবেন। এখানে শেষ নয়। অমলেশবাবু মস্ত বড় একটা ভুল করে বসলেন। একদিন শ্বশুর মারা গেলে সকল সম্পত্তি তো তাঁর হাতে আসতই। বড় ছেলে ত্যাজ্য! অর্জুনবাবুর কোনো সন্তান নেই। সদানন্দবাবুর বড় মেয়ে বিদেশে। নির্লোভ। সুতরাং অর্জুনকে শেষ করতে পারলে সকল কিছুর মালিক তো অমলেশবাবুই হবেন। কিন্তু ধৈর্য ধরলেন না অমলেশবাবু। জালিয়াতি করে বসলেন তিনি।’
‘কী জালিয়াতি বাবা?’
‘বলছি মাসিমা। একদিনের ঘটনা আপনাকে স্মরণ করিয়ে দিই। আপনি বলছিলেন দশ লক্ষ টাকার চেকে স্বাক্ষর ঠিক আছে কিনা জানতে চেয়ে একদিন ব্যাংক ম্যানেজার সদানন্দবাবুকে ফোন করেছিলেন। তিনি ওজিএল দিয়ে দিয়েছিলেন অমলেশবাবুর নামে। বলেছিলেন অমলেশ খুব বিশ্বাসী। তাঁর স্বাক্ষরটা যে সহজ, সেটাও জানিয়েছিলেন সদানন্দবাবু, ব্যাংক ম্যানেজারকে। আরেক রাতের কথা কি মনে আছে আপনার মাসিমা? খুব চোটপাট করছিলেন অমলেশবাবুর সঙ্গে। কারণ জিজ্ঞেস করায় আপনি ধমক খেয়েছিলেন সদানন্দবাবুর কাছ থেকে?’
‘হ্যাঁ, মনে পড়েছে। তা বাবা, ওই ধমকের সঙ্গে আমার স্বামীর খুন হওয়ার সম্পর্ক কী?’
‘বলছি। সদানন্দবাবুর বিশ্বাসকে পুঁজি করে অমলেশবাবু পাঁচ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে বসলেন।’
‘মানে!’
‘ঠিক বলছি অর্জুনবাবু। সই জাল করে আপনার দাবু আপনার বাবার অ্যাকাউন্ট থেকে পাঁচ কোটি টাকা সরিয়েছিলেন। একটা চেকে করেননি। চার-পাঁচটি চেকের মাধ্যমে আত্মসাতের কাজটি সম্পন্ন করেছেন তিনি। প্রথম দিনের কথার ওপর আস্থা রেখে ম্যানেজার সাহেব আপনার বাবার পরামর্শ নেননি। তো আপনার বাবার হাতে একদিন ধরা পড়লেন অমলেশবাবু। আপনার বাবা খুব খেপে গেলেন। তাঁর বিশ্বাসের জায়গায় প্রচণ্ড আঘাত লেগেছিল। পরে খুব হতাশায় ডুবে গেলেন তিনি। অমলেশবাবুকে পাঁচদিনের সময় দিলেন সদানন্দবাবু। বললেন এই পাঁচদিনের মধ্যে পাঁচ কোটি টাকা ব্যাংকে জমা না দিলে থানায় জানাব আমি। তোমাকে অ্যারেস্ট করিয়ে জেলের ভাত খাওয়াব।’
‘তাতেই মাথা খারাপ হয়ে গেল অমলেশবাবুর। টাকা ফেরত দেবেন না তিনি। নিজের ব্যবসায় অনেক টাকা ইনভেস্ট করে ফেলেছেন। তাছাড়া এই টাকার ওপর তাঁর হক আছে বলে তিনি বিশ্বাস করতেন।’
‘সদানন্দবাবু যখন খুব চাপাচাপি শুরু করলেন, শ্বশুরকে সরিয়ে দেওয়ার মনস্থ করলেন অমলেশবাবু। চুলচেরা পরিকল্পনা করলেন। তিনি জানতেন সকালে শ্বশুরের শিয়রের পাশে পানিভর্তি গ্লাস থাকে। এবং শয্যাত্যাগ করার পরপরই ওই পানি তিনি খান। চেক সইয়ের কথা বলে ২৭ তারিখ তিনি উপস্থিত হলেন শ্বশুরের বেডরুমে। ভাগ্য তাকে হেল্প করল। শাশুড়ির বাথরুম ধরল। শাশুড়ি টয়লেটে গেলে অমলেশবাবু বিষ মিশিয়ে দিলেন পানিতে। ওই পানি খেয়েই মারা গেলেন সদানন্দবাবু। কী অমলেশবাবু মিথ্যে বলছি? মাথা নিচু করে থাকবেন না। আপনি ভেবেছেন পোস্টমর্টেমে যখন প্রমাণিত হবে যে বিষ-মেশানো পানি খেয়েই সদানন্দবাবু মারা গেছেন, তখন সকল দায় তিষা দেবীর ওপর বর্তাবে। কারণ পানি দিয়েছেন তিষা দেবী। তিষা দেবী কোনো রকমে যদি পার পেয়ে যান তাহলে অর্জুনবাবুর ঘাড়ে এসে পড়বে অভিযোগটা। কারণ অর্জুনবাবুর সঙ্গে পিতার অহি-নকুল সম্পর্ক। আপনি থেকে যাবেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা হলো না। হলো না শুধু আপনার একটি ভুলের কারণে। আপনি একটা ভুল করেছিলেন শাশুড়ি বাথরুম থেকে বের হওয়া পর্যন্ত আপনার অপেক্ষা করা উচিত ছিল। আপনি অপেক্ষা করেননি। কাজ সমাধা করেই বেরিয়ে পড়েছিলেন। শাশুড়ি আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করে, শ্বশুর না জাগার দোহাই দিয়ে, পরে আসবেন বলে শাশুড়ির কাছ থেকে স্বাভাবিক বিদায় নিয়ে গেলে আমার পক্ষে আপনাকে সাসপেক্ট করা মুশকিল হতো। চেকে সই না নিয়ে আপনার চলে যাওয়ার তথ্যটা আপনার শাশুড়ি আমাকে দেওয়ার পর আমি সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেলাম। সদানন্দবাবুকে আপনিই খুন করেছেন। তারপর অন্যান্য তথ্য জোড়া দেওয়ার পর, আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠল যে, আপনিই ঠান্ডা মাথায় শ্বশুরকে খুন করেছেন।’
‘ওসি সাহেব, আমার কাজ শেষ। আপনার কাজ শুরু করুন।’

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত