এটা ছিল সেই সময়,
যখন মৃতেরাই কেবল সুখে হাসতে পারতো
শেষ পর্যন্ত নিষ্কৃতি মিলেছে এই বোধে
আন্না আখমাতভা
তখনো আমরা হাফপ্যান্ট পরি। আমি পরি ইংলিশ প্যান্ট। ইংলিশ প্যান্টের তখন অনেক দাম, দশ-বারো টাকা সব বাড়ির ছেলেরা পরতে পারে না। আবিদ, মিজান, সন্তোষ আমার বন্ধুরা তাজু খলিফার কাছে বানানো লংক্লথের প্যান্ট পরে। সন্তোষের বাবা বাজারের বড়ো ব্যবসায়ী; চাল-ডাল, আটা-লবণ, গুড়-চিনি, সুপারি-জর্দা, নালি-কেরোসিন মালপত্রে ঠাসা তার দোকান। কেউ-কেউ বলে, আমরা বিশ্বাস করি বা না করি, তাতে কিছু আসে যায় না; কিংবা আমাদের বয়স কম; শোনা কথায় কান দেওয়ারই বয়স হয়নি;
সুনীলকাকার নাকি সুদের ব্যবসাও আছে। অর্থাৎ সন্তোষের বাবা ম্যালা টাকার মালিক, যাকে বলে টাকার কুমির। সে ইচ্ছে করলে সন্তোষকে ইংলিশ প্যান্ট একটা কেন, একসঙ্গে দু-তিনটে কিনে দিতে পারে। কিন্তু দেবে না। ছেলের প্যান্ট কিনে দশ-বারো টাকা খরচ! সন্তোষদের বয়সে তারা নেংটি পরে থাকতো। বেহারাবাড়ি, পালবাড়ির ছেলেরা তো এখনো নেংটিই পরে। নাকি, কেউ বলতে চান, তারা কেউ এখন আর নেংটি পরে না? দেশ স্বাধীন হয়ে সব কেমন বদলে যাচ্ছে…!
আমরা তখন বাছিরন নেছা উচ্চ বিদ্যালয়ের নিচু ক্লাসের ছাত্র। সন্তোষ একদিন করলো কী, গোঁ ধরল বাড়িতে তাকে ইংলিশ প্যান্ট কিনে না দিলে স্কুলে যাবে না। কাকিমা এটা-সেটা বলে বোঝাচ্ছে। কলাপাতায় মুড়িয়ে নাড়–-মোয়া সাধছে স্কুলে যাওয়ার জন্য; কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। সন্তোষের এককথা ইংলিশ প্যান্ট চাই আগে। তারপর স্কুল, তারপর লেখাপড়া…।
আমি, আবিদ, মিজান, মহুয়া আমরা সন্তোষদের উঠোনে দাঁড়িয়ে আছি। সন্তোষকে নিয়ে স্কুলে যাবো। প্রত্যেকদিন আমরা একসঙ্গে স্কুলে যাই। সন্তোষের জন্য দেরি হচ্ছে। আমরা উসখুস করছি। সন্তোষ হঠাৎ কেঁদে ফেললো। কাঁদতে-কাঁদতে বললো, সুমিতের বাবা একটা হাইলাচাষা। অগরে কি বাজারে দোকান আছে? বাবার মতো ট্যাকা আছে অর বাবার? অরে ইংলিশ প্যান্ট কিনা দিছে…।
সন্তোষের কথা শুনে কাকিমার আক্কেলগুড়–ম। হা-হা করে উঠলো সে, যেন বাড়ির আড়ে বসে একঝাঁক কাক কা-কা করছে…।
এইডা কী কস তুই। সুমিতরে ইংলিশ প্যান্ট কিনা দেয় অর দাদা Ñ মণ্ডল সাব। হে-ই তো গেরামের জমিদার। বাড়িতে দশ-বারোটা গরু। নে বাবা, নাড়–-মোয়া নিয়া স্কুলে যা। তর বাপেরে আমি কমুনি…।
বাবারে আমি চিনি, দুনিয়ার কিপটা…।
সন্তোষ কলাপাতায় মোড়ানো নাড়–-মোয়া ছাইকুড়ে ছুড়ে মারলো…।
সুনীলকাকা যে-বাড়িতেই ছিল, এতক্ষণ আমরা বুঝতে পারিনি। ঘরের ভেতরে ভাত খাচ্ছিল। ভাত খেয়ে দোকানে যাবে। কাঁসার ঘটি হাতে বারান্দায় এলো। কলকুচো করলো। জল খেলো ঢকঢক করে। একবার তাকালো আমাদের দিকে। ঠাণ্ডা চোখ। মৃত মাছের চোখের মতো। ইংলিশ প্যান্ট ছাড়া স্কুলে যাবে না সন্তোষ, নাড়–-মোয়া ছাইকুড়ে ফেলে দিয়েছে Ñ সুনীলকাকার চোখ-মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই, এসব নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথা আছে। অথচ এই লোকটি, কোনো রাও-শব্দ না করে হঠাৎ তার হাফপ্যান্ট-পরা ছেলেকে শূকর পেটানোর মতো পেটাতে শুরু করলো…।
সন্তোষের ‘মা গো, বাবা গো, মরলাম গো…’ চিৎকার উঠোন পেরিয়ে বাড়ির সামনের চালতাতলা কালীমন্দির পেছনে রেখে যাত্রা শুরু করলো নদীর দিকে। ভরা নদী। সন্তোষের চিৎকার লাফিয়ে পড়লো নদীতে…।
আমি একবার আমার ইংলিশ প্যান্টের দিকে, একবার সন্তোষ ও কাকিমার মুখের দিকে তাকাই। সুনীলকাকা নেই। চলে গেছে। দোকান খুলতে দেরি হয়ে যাচ্ছে। সন্তোষ স্কুলে যাবে কি যাবে না, আমরা ওর জন্য আরো কিছুক্ষণ দেরি করবো নাকি চলে যাবো এসব যখন ভাবছি, আমার চোখ আটকে গেল সন্তোষদের বড়ো ঘরের পুব কোনায়। একটা বিড়াল চোখ বড়ো-বড়ো করে ওঁৎ পেতে বসে আছে, সামনে একটা ইঁদুরছানা; ভীতসন্ত্রস্ত, দূর থেকেই বোঝা যায় ছানাটির লেজ কাঁপছে, ভয়ে। পালাবার সুযোগ খুঁজছে ইঁদুরছানাটি কিন্তু বিড়ালটির থাবার নিচেই তার অবস্থান, পালানোর সুযোগ কোথায়? মৃত্যুর মুখে পড়ে ইঁদুরছানাটি ভাবছে, তাকে খপ্ করে মুখে পুরতে কেন সময় নিচ্ছে তার আজরাইল…?
দুই
সন্তোষও তখন ইংলিশ প্যান্ট পরে। শেষ পর্যন্ত সুনীলকাকা ওকে ইংলিশ প্যান্ট কিনে দিয়েছে। পনেরো টাকা দাম। আমার প্যান্টের চেয়ে দামি। বেল্ট আছে। আমার প্যান্টে বেল্ট নেই। দাদাকে বলতে হবে…।
ইংলিশ প্যান্টের দুঃখ ছিল সন্তোষের, ইংলিশ প্যান্ট পেয়েছে; প্যান্টের দুঃখ এখন নেই। কিন্তু সন্তোষের মনে আরো অন্য কোনো দুঃখ ছিল কিনা, কিংবা কোনো বকুলচারার মতো বড়ো হতে হতে, কোনো দুষ্টু বালকের হাতে হঠাৎ সেই গাছটির একটা ডাল ভেঙে পড়ার মতো ওর মনে কোনো কষ্টের জন্ম নিয়েছিল কিনা, তা আমাদের জানা ছিল না। ক্লাস নাইনে ওঠার পর, একদিন আমরা টের পেলাম Ñ সন্তোষের বুকভরা দুঃখ-কষ্ট ছিল, কিংবা ছিল ভরা নদীর মতো অভিমান। না-হলে সে শেওড়া গাছের ডালে ঝুলে পড়ে! দুঃখ-কষ্ট যখন সহ্যের অতীত হয়ে যায়, মানুষ তখনই আত্মহননের পথ বেছে নেয়…।
নাকি…?
যাহোক, ইংলিশ প্যান্ট পেয়ে ভীষণ খুশি সন্তোষ। অথচ দেখুন, কী মারটাই না খেল সেদিন? ওর মার খাওয়া দেখে আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল। আমার ইংলিশ-প্যান্ট-পরা দেখেই তো ওরও ইংলিশ প্যান্টের সাধ জেগেছিল…।
ওই সময়, হঠাৎ একদিন, নতুন দুটি শব্দের মুখোমুখি হই আমরা…।
নদীর ওপার আমাদের বাড়ি। আবিদ, মিজান আমাদের…। নদীতে দীর্ঘ সাঁকো। মিজান বলে পুলসেরাতের পুল। মোল্লাবাড়ির ছেলে ও। ওর বাবা মসজিদের ইমাম। বড়োভাই কাশেম আলিয়া মাদরাসায় পড়ে। বেহেস্ত-দোজখের গল্প ভালোই জানে মিজান। পুলসেরাতের পুল পার হয়ে বেহেস্তে যেতে হয়। পাপী লোকরা টোটা সুতার মতো সরু এই পুল পাড়ি দিতে পারবে না। পুলে ওঠার পরই ঝুপ করে পড়ে যাবে দোজখে। দোজখে দাউদাউ আগুন…। দুরুদুরু বুকে সাঁকো পাড় হই আমরা। বেহারাপাড়া, দাসপাড়া, পালপাড়ার মধ্য দিয়ে স্কুলের পথ। পথেই সন্তোষদের বাড়ি। ওদের বাড়ির সামনে কালীমন্দির। পাকা দালান। মন্দিরের দেয়ালে পোস্টার সাঁটানো। পোস্টারে আমার চোখ আটকে যায়। কালো কাগজ। লাল কালিতে লেখা ‘জোতদার-মজুদদার হুঁশিয়ার শ্রেণিশত্র“ খতম করো আঞ্চলিক কমান্ডার গণবাহিনী…।’
‘জোতদার’, ‘মজুদদার’, ‘কমান্ডার’, এসব শব্দ পরিচিত। স্কুলের পাঠবইয়ে আছে, পড়েছি। কিন্তু ‘শ্রেণিশত্র“’! তাও আবার খতম করার আহ্বান? ‘মুক্তিবাহিনী’, ‘পাকবাহিনী’ শব্দ দুটোও পরিচিত। মাত্র কবছর আগেই পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনী যুদ্ধ করেছে। সেটা ছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। যুদ্ধে পাকবাহিনী পরাজিত হয়। আমরা পাই স্বাধীন দেশ। ক্লাসে, আহাদ স্যার মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলেন। স্যারের মুখে শুনে-শুনে অনেক নতুন শব্দ মুখস্থ হয়েছে। বাংকার, ফ্রন্ট, প্যারাসুট সবই যুদ্ধকেন্দ্রিক শব্দ। কিন্তু স্যারের মুখেও ‘গণবাহিনী’ শব্দটি কোনোদিন শুনেছি বলে মনে পড়ে না…।
‘শ্রেণিশত্র“’ আর ‘গণবাহিনী’ শব্দ দুটো আমার করোটির ভেতর দাপাদাপি শুরু করে। শব্দদুটোর অর্থ না জানা পর্যন্ত যে আমার স্বস্তি নেই, সে আমি জানি। নতুন কোনো শব্দ পেলে, তার অর্থ খুঁজে বের করা; আপনাদের কারো কারো হয়তো ইতোমধ্যে জানা হয়ে গেছে এটা আমার আরো ছোটবেলাকার অভ্যাস। দু-চার কথায় সেই গল্পও আপনাদের একটু শোনাই…।
যারা, আমার এই গল্প আগেও শুনেছেন শুনতেই পারেন, কবুল করি; এই গল্প আমি বহুবার বলেছি; তাদের আর শোনার দরকার নাই।
লেখাপড়া জানতেন না আমার দাদা। কিন্তু তাঁর মতো সাহিত্যের সমঝদার আমি এখন পর্যন্ত আর কোথাও দেখিনি। তিনি হাটবাজার থেকে, কিংবা শহরে গেলে বইয়ের দোকান থেকে নানা ধরনের বই কিনে আনতেন। বেশিরভাগই পুঁথি-সাহিত্যের বই। কালু-গাজী-চম্পাবতী, দাতা হাতেমতাঈ, বিষাদসিন্ধু ইত্যাদি। তাঁকে বই পড়ে শোনাতে হতো। আমার বড়ো বোনেরা পড়ে শুনিয়েছে। আমি দাদার সর্বকনিষ্ঠ নাতি। আমিই সবচেয়ে বেশিদিন তাকে বই পড়ে শুনিয়েছি। এ-কথা বলে আমি গর্ববোধ করি যে, দাদাকে বই পড়ে শোনাতে-শোনাতেই আমার ভেতর লেখক হওয়ার স্বপ্ন জাগে। বিষাদসিন্ধু পড়তে-পড়তে মনে-মনে বলতাম Ñ ইস! আমিও যদি এরকম একখানা বই লিখতে পারতাম…!
মনের আনন্দে পড়তাম বিষাদসিন্ধু। কিন্তু একটু পরপরই হোঁচট খেতাম। অনেক শব্দের অর্থ বুঝি না। পড়া বন্ধ করে দাদার কাছ থেকে শব্দের অর্থ বুঝে নিতাম। অর্থ না-বুঝলে পড়ার আনন্দ নষ্ট হয়ে যেতো…।
‘ক্বাসেদ ঘোড়া ছুটিয়ে চলছে মদিনার পথে…।’
‘ক্বাসেদ’ অর্থ কী দাদা?
দূত বা বার্তাবাহক।
‘বাটী’ অর্থ যে ‘বাড়ি’, ‘লহু’ অর্থ ‘রক্ত’, ‘জঙ্গ’ অর্থ যুদ্ধ এসব তো দাদার কাছ থেকেই শেখা। শব্দের অর্থ খোঁজার সে-অভ্যাসটা আমার ভেতর এখনো আছে…।
কী রে, হাঁ করে কী দেখছিস? স্কুলে যেতে হবে না? সন্তোষ বাড়ি নেই…।
আবিদ আর মিজান সন্তোষকে ডাকতে বাড়ির ভেতর গিয়েছিল। আমি ‘শ্রেণিশত্র“’ আর ‘গণবাহিনী’র অর্থ খুঁজছিলাম মন্দিরের কাছে দাঁড়িয়ে। কারা শ্রেণিশত্র“? কেন তাদের খতম করার আহ্বান…?
চল্…।
দ্রুত হাঁটছি স্কুলের পথে। আহাদ স্যারের কাছ থেকে শব্দ দুটোর অর্থ জেনে নিতে হবে। ক্লাসেই জিজ্ঞেস করবো, নাকি ক্লাসের বাইরে Ñ একা, একা Ñ এসব ভাবতে-ভাবতে ক্লাসে ঢুকি। হরিপদকাকা বেল বাজায়। ক্লাস শুরু হবে। প্রথম ক্লাসই আহাদ স্যারের। ক্লাসে আসেন হেড স্যার…।
হেড স্যার কেন…?
আহাদ স্যারের অসুখ। তিনদিনের ছুটি নিয়েছেন…।
তিন
গ্রামে বেহুলা-লখিন্দরের দল গড়ছিলেন মানু বয়াতি। দাদা প্রধান পৃষ্ঠপোষক দলের। রাতে আমাদের বারবাড়ি কাচারি ঘরে হ্যাজাকবাতি জ্বালিয়ে রিহার্সেল হয়। হ্যাজাক কিনে দিয়েছেন দাদা। তেলখরচও দেন। সামনের দুর্গাপূজায় উদ্বোধনী পালা। অষ্টমীর রাতে শুরু করে বিজয়া দশমী পর্যন্ত পরপর তিনরাত গাওয়া হবে। হঠাৎ করে রিহার্সেল বন্ধ হয়ে গেল। পালা নাকি গাওয়া হবে না…!
রিহার্সেল বন্ধ কেন? পালা গাওয়া হবে না কেন?
দাদার কান ঝালাপালা করে ফেললাম। দাদা স্পষ্ট করে কিছুই বলেন না। মাঝখানে থেকে মায়ের বকুনি খেতে হয় ‘ইস কী আমার মাস্টার রে…!’
রিহার্সেল বন্ধ, বেহুলা-লখিন্দরের পালা গাওয়া হবে না ভেঙে পড়েছেন মানু বয়াতি। তারই লেখা পালা। দিনরাত পরিশ্রম করে সুর বাঁধছিলেন। বিভিন্ন জায়গা থেকে বায়নাও আসা শুরু হয়েছিল। রিহার্সেল শুরু হওয়ার পর থেকে বয়াতিকাকার বেহুলা-লখিন্দর পালার সুনাম ছড়িয়ে পড়েছিল…।
সুনাম ছড়াবে না কেন…? তাঁর শহিদে কারবালার সুনাম তো মানুষের মুখে মুখে। সখিনার গান শুনে হাজার-হাজার দর্শক-শ্রোতার বুক ভাসে চোখের জলে। সেই মানু বয়াতি নতুন পালা লিখেছেন বেহুলা-লখিন্দর মানুষের উৎসাহের শেষ নেই…।
বয়াতিকাকা টোকে বসে একা-একা কাঁদেন…।
সাজিদভাই, শাজাহানকাকারও কষ্ট কম না। সাজিদ আমার বড়োভাই। বেহুলা সাজে। বুকে নারকেল মালাই বেঁধে শাড়ি পরলে তাকে দেখতে সুন্দরী তরুণী-নারীর মতোই লাগে। গানও গাইতে পারে চমৎকার। শাজাহানকাকা সাজে লখিন্দর। গ্রামের মানুষ বলাবলি করে, শাজাহানকাকা দেখতে নাকি সিনেমার নায়ক ফারুকের মতো…।
বয়াতিকাকা, শাজাহানকাকা, সাজিদভাই মায় গ্রামের সব মানুষের, বেহুলা-লখিন্দর পালা গাওয়া হবে না শুনে বুক ভেঙে আসছে, কিন্তু আমার মনে হয়, কেউ আমার কথা বিশ্বাস করুন বা নাই করুন আমার কষ্টটাই সবচেয়ে বেশি। আমি যে ছিলাম প্রমোট মাস্টার…।
আমাদের সিনিয়র আমজাদ, বাতেন, কৃষ্ণ আরো কেউ কেউ প্রমোট মাস্টার হওয়ার চেষ্টা করছিল। কিন্তু কাউকে বয়াতিকাকার মনে ধরছিল না। কেউ যেন তাঁর মনের মতো করে সংলাপ ও সুর বেহুলা-লখিন্দরের মুখে ধরিয়ে দিতে পারছিল না। আমি একদিন চেষ্টা করতেই, আমার পিঠ চাপড়ে বয়াতিকাকা বললেন, ‘এই তো মনের মতো মাস্টার পাইয়া গেছি। তুইই পারবি ব্যাটা…।’
আমি বেহুলার মুখে গান ধরিয়ে দিতাম ‘কী না কালনাগে দংশিল আমার জাদুরে…।’
কদিনের মধ্যেই রহস্য উদ্ঘাটিত হলো। সব নষ্টের মূল ওই পোস্টার। সন্তোষদের বাড়ির সামনে, কালীমন্দিরের দেয়ালে সাঁটানো যে পোস্টারে লেখা ছিল ‘শ্রেণিশত্র“ খতম করো…।’ কে কার শত্র“? কে কাকে খতম করবে…?
এখন, গ্রামের মসজিদের দেয়ালে, মন্দিরের দেয়ালে, স্কুল-বিল্ডিংয়ের দেয়ালে মাঝেমধ্যেই ওই পোস্টার পড়ে! রাতের অন্ধকারে, কে জানে কে লাগায় ওই পোস্টার…!
আহাদ স্যার একদিন বললেন, ‘পাইকড়ার হরমুজ বিএসসি গণবাহিনীর লিডার…।’
বিএসসি! আমাদের মজিবর স্যার বিএসসি, শ্যামল স্যার বিএসসি। হরমুজ বিএসসি কি স্কুলের টিচার…?
টিচার কিনা ঠিক জানি না। হয়তো আসল নাম হরমুজ আলী। বিএসসি করেছে। তাই ‘হরমুজ বিএসসি’ হিসেবে পরিচিত…।
কিন্তু স্যার, আমাদের এলাকায়…।
কেউ হয়তো গণবাহিনীর সদস্য হয়েছে। গোপনে কার্যক্রম চালাচ্ছে। না-হলে এতদূর থেকে এসে পোস্টার লাগানো কঠিন…।
গ্রাম জুড়ে আতঙ্ক। কখন কী হয়, কারো জানা নাই! সন্দেহও ভেসে বেড়ায় গাঁয়ের বাতাসে। গ্রামের কে যে গণবাহিনীতে নাম লিখিয়েছে, আর কারা যে রাতের অন্ধকারে পোস্টার লাগাচ্ছে দেয়ালে-দেয়ালে, কেউ তো তা জানে না। এ-কারণেই একজন আরেকজনকে সন্দেহ করার প্রবণতা বাড়ছে। কিন্তু কে যে কার সন্দেহের তালিকায়, তাও বোঝার উপায় নাই। প্রকাশ্য শত্র“কে মোকাবেলা করা যায়, গোপন শত্র“র মোকাবেলা করা দুষ্কর। বিভীষণের ষড়যন্ত্রেই তো ঘটে রাবণের মৃত্যু…।
গ্রামের মানুষ ফিসফিস করে কথা বলে। সামান্য একটু আড়াল পেলেই একজন আরেকজনের কাছে জানতে চায় ‘ভাই, জানো নাকি কিছু কার কার নাম আছে অগরে তালিকায়?’
আসলে, সবাই জানতে চায়, নিশ্চিত হতে চায় তার নিজের নামটি শ্রেণিশত্র“র তালিকায় আছে কি নেই! থাকলে নির্ঘাত এলেঙ্গার হাকিম তালুকদারের মতো মৃত্যু! আহা রে…! কদিন আগেই, দুপুরবেলা; খেতে বসার আগে-আগে, হাকিম তালুকদার নিজের প্রতিষ্ঠিত কলেজের একটি রুমে থাকতেন, নিজেই রান্না করে খেতেন; সেদিনও রান্না শেষ করেছিলেন, বেতের পাটি বিছাচ্ছিলেন মেঝেতে; তখন তাকে ধরে নিয়ে, কলেজের অদূরেই নদীর টোকে গুলি করে মারলো গণবাহিনীর সদস্যরা। কেউ-কেউ বলে, হরমুজ বিএসসি নিজেই পরপর দুটো গুলি করে। মৃত্যু নিশ্চিত হলে হাকিম তালুকদারের মুণ্ডুুটা কেটে নদীতে ভাসিয়ে দেয়…।
বড়বাশালিয়া, বাঁশি, স্বরূপপুর তারপরই এলেঙ্গা। গণবাহিনীর হাতে, দিনেদুপুরে হাকিম তালুকদার খুন হয়েছেন আমাদের গ্রামে খবর আসতে দেরি হয় না। ভয় জেঁকে বসে গ্রামে। রাতে তো কারো চোখে ঘুম নেইই; দিনেও প্রাণটা যেন হাতে ধরে বসে থাকে…।
এতদিনে, এটা প্রায় পরিষ্কার গণবাহিনীর চোখে কারা শ্রেণিশত্র“! গ্রামের কেউ-কেউ ফিসফিস করে বলে, আওয়ামী লীগ নেতা অধীর তালুকদার, ধনী গৃহস্থ রাজ আলী মণ্ডল, মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার শওকত আলী, বড়ো ব্যবসায়ী সুনীল দাশ এই চারজন, গ্রামে গণবাহিনীর প্রথম টার্গেট…।
গণবাহিনীর টার্গেটের মধ্যে থেকে পালা গানের দল গড়ার পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া যায়, আপনারাই বলুন? দাদা সকালেই তালুকদারবাড়ি যায়। তারা দুজনে কী শলাপরামর্শ করে, তারাই জানে। বেহুলা-লখিন্দর তো দূরস্থ, দুর্গাপূজাও নাকি হবে না। পূজা তো হয় অধীর তালুকদারের বারবাড়ি। ওরা পূজার মণ্ডপে হামলা চালাতে পারে। গণবাহিনীর মতোই আরেকটা গ্র“প, ওদের নাম ‘সর্বহারা’ ওরা নাকি ঈদের মাঠে গুলি করে মানুষ মেরেছে…।
কী দুর্ধর্ষ ডাকাত রে বাবা…!
স্কুলে যেতে ভাল্লাগে না। তবু যাই। কাউকে বুঝতে দিতে চাই না Ñ আমার মন ভালো নেই। আমার মন ভালো নেই টের পেলে, মা-দাদির যন্ত্রণা আরো বাড়ে। এমনিতেই দাদার চিন্তায় বাড়ির সবার ঘুম হারাম…।
ওরা দিনেদুপুরে মানুষ খুন করছে, কেউ ওদের ধরে না কেন স্যার? পুলিশ কী করে…?
আহাদ স্যারেরও যেন কী হয়েছে! ক্লাসে আগের মতো গল্প করতে চান না; কিন্তু আমি নাছোড়বান্দা। ছাড়ি না…।
ওরা প্রকাশ্য দিবালোকেই হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছে, এটা ঠিক। কিন্তু তারপরও কেউ ওদের দেখে না…।
মানে? ওরা ভূত-প্রেত, জিন-পরী? জাদু জানে? অদৃশ্য হতে পারে…?
না। তা না। ওদের হাতে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র আছে। পুলিশের অস্ত্রের চেয়েও ভয়ংকর অস্ত্র। পুলিশ ওদের নাম শুনলে থরথর করে কাঁপে। তাই কেউ ওদের দেখেও দেখে না। যে দেখবে, তারই বিপদ হবে। এই যে, আমি তোমাদের সঙ্গে ওদের নিয়ে কথা বলছি, আমারও বিপদ হতে পারে…।
আহাদ স্যারের কথা শুনে আমাদের চোখ-মুখ আমের ফলসির মতো শুকিয়ে গেল। তাই তো! এটা কী করছি আমরা? কেন এসব গল্প শুনতে চাচ্ছি স্যারের কাছে…।
শোন, ওরা প্রকাশ্যে হামলা করে, কাউকে কাউকে ধরে নিয়ে খুন করে; আবার কখনো কখনো বিড়ালের মতো ওঁৎ পেতেও থাকে। সুযোগ বুঝে আক্রমণ করে। আমাদের স্কুলের চারপাশে ওদের কেউ যে ওঁৎ পেতে নেই, তাও কিন্তু বলা যাবে না। সুতরাং…।
আমরা তখনো রক্ষীবাহিনীর নাম শুনিনি। তারা যে আরো ভয়ংকর, তা জানা থাকলে, হয়তো আহাদ স্যারকে জিজ্ঞেস করতাম Ñ ‘রক্ষীবাহিনীও কি ওদের নাম শুনলে ভয় পায়? থরথর করে কাঁপে! ওরাও কি গণবাহিনীকে দমন করতে পারে না…।’
চার
এই আখ্যানপর্ব বর্ণনা করতে, এখন, আমার নিজেরই হাত কাঁপছে। কলম ধরতে পারছি না…। একই দিনে দুটো খুন করলো ওরা। কেউ নিশ্চয়ই ভুলে যাননি সেদিনের সেই মর্মছেঁড়া ঘটনার কথা। কোনো-কোনো ঘটনা তো মানুষের সামনে ঘটে যে-ঘটনা তাদের পবিত্র আত্মায় গেঁথে যায়, এটা তাদের মৃত্যুর পরও সতত মনে পড়ে…! আমরা তো পাগল হয়ে গিয়েছিলাম আহাদ স্যারের খুন হওয়ার খবর শুনে। স্যার ক্লাসে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন, তিনি যে ওদের নিয়ে কথা বলছেন, তার বিপদ হতে পারে। স্যারের কথাই ফলে গেল…!
আহাদ স্যার খুন হলেন সকালে, স্কুলে আসার পথে বাইলারছার চকে। শওকতভাই নিজের বাড়িতে, ডুবন্ত বিকেলে, ভাবির সামনেই…।
সাইকেল চালিয়ে স্কুলে আসেন আহাদ স্যার। চকের মাঝখান দিয়ে পথ। পথে, কিছু অংশ আখক্ষেত। বড়ো বড়ো মিছরিদানা, পিয়াসী আখ। পথের ওপর দুপাশের ক্ষেতের আখ ঝুঁকে পড়েছে। ঘনছায়া পথ জুড়ে। ‘ও আমার দেশের মাটি/ তোমার ’পরে ঠেকাই মাথা’ গুনগুন করতে করতে সাইকেল চালাচ্ছেন আহাদ স্যার। প্রতিদিনই তিনি এই পথে স্কুলে যাতায়াত করেন। কোনো কোনোদিন দু-চারটে শেয়াল ছাড়া আর কিছু তার চোখে পড়ে না। সেদিন, হঠাৎ স্যারের সামনে দাঁড়ালো পাঁচ-ছয়টি ছেলে। সবাই মুখোশ পরা…।
স্যার নামেন…।
ছেলেগুলোর বয়স বেশি না। দুটো তো দেখতে নাইন-টেনের ছেলের মতো। লিডার গোছের যে-ছেলেটি সামনে দাঁড়িয়েছে, ডানহাত প্যান্টের পকেটে সে কলেজে পড়তে পারে…।
ডান হাত পকেটে ঢোকানো কেন? হাতে অস্ত্র…?
তোমরা…?
সাইকেল থেকে নেমে জিজ্ঞেস করলেন স্যার।
লিডার ছেলেটি বলল, ‘স্যরি স্যার। আপনি খুব বাড়াবাড়ি শুরু করেছেন। স্কুলের ছেলেদের ক্ষেপিয়ে তুলছেন আমাদের বিরুদ্ধে। আপনি আমাদের শ্রেণিশত্র“…।’
শ্রেণিশত্র“? আমি…? তোমাদের বয়স কম। তোমরা ভুল করছো। ভুল রাজনীতির ফাঁদে আটকা পড়েছো। এখনো সময় আছে…।
আমাদের হাতে আর সময় নেই। গণবাহিনীর হাইকমান্ড আপনার মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে। এখনই কার্যকর হবে। ইউ বি রেডি…।
ছেলেটি প্যান্টের পকেট থেকে হাত বের করলো। হাতে টু-বোর রুশ পিস্তল। আহাদ স্যার মনে মনে পড়তে লাগলেন ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু …।’
এই দলটিই, নাকি অন্য কোন দল¬ বিকেলে শওকতভাইকে খুন করে আমরা তা জানি না। আমাদের বয়স কম, আমাদের তা জানার প্রশ্নও ওঠে না। তারচেয়ে বড়ো কথা, শুধু আমরা কেন, গ্রামের কেউই জানে না খুনি কারা? সবারই বুকের ভেতর বলক ওঠে গ্রামের কেউ না কেউ গণবাহিনীতে যোগ দিয়েছে। না-হলে, এইভাবে, একদিনে দুটো খুন…!
স্কুলে, আহাদ স্যারের লাশ নিয়ে আসে চকের কামলারা। গুলির শব্দ শুনে কিছুক্ষণ পর; কোথাও গুলি হলে, সঙ্গে-সঙ্গে সেখানে যাওয়ার উপায় নেই; গেলে তাকে গুলি খেতে হবে Ñ কামলারা গুলির উৎসস্থলের দিকে এগিয়ে যায়। একটু এদিক-সেদিক চোখ ফেরাতেই আহাদ স্যারের লাশ তাদের চোখে পড়ে। আর কিছু? শেয়াল-বাঘডাশা? অন্য কেউ? না, আর কিছুই তাদের চোখে পড়েনি। … আর শওকতভাইয়ের লাশ তো উঠোনেই পড়ে ছিল। ভাবির ডাক-চিৎকার শুনে, প্রতিবেশী কেউ-কেউ যখন এগিয়ে আসে, তখন তারা হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে; বাড়ির পাশের নদীতে ভাসছে মাঝিবিহীন একটি ডিঙ্গি নৌকা…। শওকতভাই আমাদের হিরো ছিলেন। মুক্তিযোদ্ধা; কত গ্রেনেড যে ছুড়েছেন শত্র“র বাংকারে…!
সেদিন হাটবার ছিল। হাটে, অন্য হাটবারের মতো সেদিন ক্রেতা-বিক্রেতার ভিড় ছিল না। সকালে আহাদ স্যার খুন হয়েছেন। পুরো গ্রাম শোকে মুহ্যমান। যাদের খুব জরুরি, যেমন Ñ চাল-ডাল কিনতে হবে; না-হয় রাতে উপোস থাকতে হবে, তারাই হাটে এসেছে। দূর-দূরান্তের যারা হাটে এসেছে, আহাদ স্যারের খুনের ঘটনা শুনে তারাও চোখের পানি ফেলছে…।
কী যে শুরু হলো দেশে! কে কার শত্র“, ভাই জানেন কেউ…? কারো জানা থাকলে বলুন দয়া করে…।
শওকতভাই হাট করে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে এসেছেন। ভাবি পোয়াতি। পোয়াতি বউ বাড়িতে একা রেখে কোথাও দেরি করা ঠিক নয়। শওকতভাইয়ের মা-বাবা কেউ নেই। মুক্তিযুদ্ধের সময় তাদের দুজনকেই মেরে ফেলেছে পাকিস্তানি হানাদাররা। ছোটভাই শাহেদ তখন বাড়িতে ছিল না, তাই বেঁচে গিয়েছিল। এখন ক্লাস টেনে পড়ে…।
ভাবি চুলা পরিষ্কার করছিলেন। শওকতভাই বাজারের ব্যাগ তার সামনে রেখে বললেন, ‘কাটা-ইলিশ আর কুমড়া আনছি। তুমি পাক করো, আমি তোমারে পাহারা দেই…।’
মুচকি হাসি ভাবির মুখে। ‘আমারে পাহারা দিওন লাগবো ক্যান…?’
চোর-ছিনতাইকারী আসতে পারে না?
না। সবাই জানে, তুমি গ্রেনেড ছোড়া মুক্তিযোদ্ধা। তোমার বউয়ের দিকে কেউ নজর দিবো না…।
রান্না প্রায় শেষ। কাটা ইলিশের ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়েছে বাড়িতে। বিকেল ডুবতে বসেছে। সূর্য, এই, এখনই বিদায় নেবে; ভাবি বললো, ‘তুমি আবার গোসল করবা নাকি; করলে কইরা আস…।’
নদীতে যাই…।
শওকতভাই উঠে দাঁড়াতেই একঝাঁক গুলি এসে লাগলো তার বুকে। ব্রাশফায়ার। ওরা এতক্ষণ শওকতভাইয়ের ঘরের পেছনেই ওঁৎ পেতে বসে ছিল…।
পরদিন সকালে, ঘুম থেকে উঠে শুনি Ñ সুনীলকাকারা রাতে ইন্ডিয়া চলে গেছে। বাড়ির সব ঘরে বড়ো বড়ো তালা। উঠোনের আঁড়ে ঝুলছে সন্তোষের ইংলিশ প্যান্ট। প্রাণ বাঁচানোর তাগিদ তখন জরুরি। পালানোর সময় প্রিয় ইংলিশ প্যান্টের কথা মনে পড়েনি সন্তোষের …।
পাঁচ
আমি তখন আক্ষরিক অর্থেই স্কুল ছেড়ে দিয়েছি। স্কুলে গেলে, স্কুলটাকে জেলখানার মতো মনে হয়। দমবন্ধ হয়ে আসে। কারো মুখের দিকে তাকাতে ইচ্ছে করে না। যে-স্কুলে আহাদ স্যার নেই, সন্তোষ নেই সেটা আর স্কুল আছে কিনা, সেখানে যাওয়ার আদৌ কোনো দরকার আছে কিনা ধন্দে পড়ে যাই আমি। আহাদ স্যার বলতেন, ওরা বিড়ালের মতো ওঁৎ পেতে থাকে। স্কুলের চারপাশে কোথাও এখনো যে নেই ওরা, তাই বা কে জানে…!
স্কুলে যাই না, দাদির মিছরির দলার লোভেও না। সারাদিন উন্তের মতো ঘুরে বেড়াই। যেন আমার বাবা আর বড়োভাই খুন হয়েছে। আমি এখন এতিম এবং স্বাধীন। সারাদিন রোদে ঘুরে বেড়ালেও আমাকে ধমক দেওয়ার কেউ নেই। দাদা যে আছে, ধমক দিতে পারে; জোর করে স্কুলে পাঠাতে পারে তা আমার মনেই পড়ে না। কোনোদিন আবিদ সঙ্গে থাকে, কোনোদিন থাকে মিজান। কোনো-কোনোদিন কেউ থাকে না আমি একা। একা-একা ঘুরতেই আমার ভালো লাগে। প্রত্যেকদিন, অন্তত একবার বাইলারছার চকে, আহাদ স্যার যেখানে খুন হয়েছেন, সেখানে যাই। স্যারের রক্তের দাগ শুকায়নি…।
এই সময়, আমাদের বাজারে এক নতুন পাগলের আগমন ঘটলো। নতুন বলছি, কারণ; আগে থেকেই বাজার দখল করে রেখেছে ভাদুড়ি পাগল। সব বাজারেই নাকি একজন করে পাগল থাকে, থাকতে হয়; যেমন আমাদের বাজারে ভাদুড়ি পাগল আছে। কিন্তু জেনে-শুনে, এক পাগল থাকতে আরেক পাগলের আগমন নাকি পাগলটা কিছু না জেনেই এসে পড়েছে, কে জানে! এখন, বাজার কমিটির নেতাদের মাথায় একটাই চিন্তা, দু’পাগলে মিলেমিশে থাকলে ভালো; কিন্তু দুজনের মধ্যে মারামারি লেগে না-যায়! এক বনে দুই বাঘ থাকতে পারে না…।
ভাদুড়ি পাগলকে আমরা জন্মের পর থেকে দেখছি। আমার বাবাও হয়তো তার জন্মের পর থেকেই দেখছে। দাদাও ভাদুড়ি পাগলকে তার জন্মের পর থেকে দেখে থাকতে পারে। মোদ্দা কথাটা এই, ভাদুড়ির বয়স কত, কেউ তা জানে না। তার বয়স আশিতে আটকে রয়েছে, বাড়ে না আর। মুখে বড়ো-বড়ো দাঁড়ি। পরনে, সবসময়ই, রঙিন কাপড়ে শতেকতালি দেওয়া ছালার শার্ট। হাঁটুর সামান্য নিচ পর্যন্ত। দুহাতেই পাঁচটা করে লোহার বয়লা…।
নতুন পাগলের বয়স কম। পঁয়ত্রিশ, চল্লিশ; বড়োজোর পঁয়তাল্লিশ হতে পারে। মুখে খোঁচা-খোঁচা দাড়ি, মাথায় বড়ো বড়ো জট। হাতে বয়লা আছে, পায়েও বয়লা পরে। শরীর জুড়ে লোহার চেন পেঁচানো। কপালে ত্রিশূল আঁকা। হিন্দু হবে হয়তো…।
কিন্তু মুশকিল হচ্ছে নতুন পাগল হিন্দু না মুসলমান তা বের করা যাচ্ছে না। নাম-পরিচয়ই জানা যাচ্ছে না তার…।
আপনি লোকটির নাম জিজ্ঞেস করুন। ‘ভাই, আপনার নাম কী?’ দেখুন কী বলে। হাসি হাসি মুখে বলবে ‘যে যা বোঝে…।’
কেউ জিজ্ঞেস করুন ‘ভাই, আপনার বাড়ি কোথায়?’ একই উত্তর ‘যে যা বোঝে…।’
সারাদিন, বাজারের বটতলা লোকটি চুপচাপ বসে থাকে ধ্যানী সারসের মতো। ভাদুড়ি পাগল তবু এদিক-সেদিক একটু ঘোরাঘুরি করে। খুচরা পয়সা তোলে কিছু। তারপর সন্ধ্যার আগে-আগে পয়সাগুলো বাজারের কুয়ায় ফেলে দেয়, বলে, ‘মাছের পোনা ছাড়লাম, বংশবৃদ্ধি হবে…।’ কিন্তু নতুন পাগলটা কিছুই করে না। সারাদিন বটতলা বসে থাকে। তাকে কেউ খেতেও দেখে না। শৌচকর্ম করতেও দেখে না। কেউ তাকে রুটিটা বা কলাটা কিনে দিলে, সেগুলো পাশে রেখে বলবে ‘যে যা বোঝে…।’
‘যে যা বোঝে’ এই কথার অর্থ কী? বাজারে এ-নিয়ে গবেষণা হয়। ফলাফল অশ্বডিম্ব…!
লোকটা খুনের আসামি হইতে পারে। পুলিশের চোখ ফাঁকি দিতে পাগল সাজছে…।
পুলিশের স্পাই কি হইতে পারে না…?
হ্যাঁ। তাও হইতে পারে। কথা মিছা কও নাই…।
কে যেন একজন বলে ‘লোকটি রক্ষীবাহিনীর এজেন্ট হতে পারে। রক্ষীবাহিনীর টিকটিকিতে ভরে গেছে সারাদেশ…।’
রক্ষীবাহিনীর টিকটিকি! শব্দযুগল আমাদের কাছে নতুন…!
ছয়
দুদিন পরের ঘটনা। এ-জাতীয় কোনো ঘটনা জীবনে কোনোদিন আমাদের দেখতে হবে, তা আমাদের কল্পনায়ও ছিল না। কিন্তু ঘটনাটি ঘটেছে; না-দেখে উপায় আছে, বলুন…?
ভোরবেলা। মেঘাচ্ছন্ন আকাশ। যে-কোনো সময় বৃষ্টি নামতে পারে। তারপরও স্কুলমাঠে মানুষ ভেঙে পড়েছে। ভূঁইয়াবাড়ির ছোট ছেলে মেহেদি হাসানকে অ্যারেস্ট করেছে রক্ষীবাহিনী। এখনই গাড়িতে তুলবে। তিনি নাকি গণবাহিনীর সদস্য…!
আহাদ স্যার বলতেন, যারা এযাবৎকাল স্কুল থেকে এসএসসি পাশ করে বেরিয়েছে তাদের মধ্যে সবচেয়ে ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র ভূঁইয়াবাড়ির মেহেদি হাসান। এখন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে। স্যারের কথা শুনে। আমরা স্বপ্ন দেখতাম মেহেদিভাইয়ের মতো ভালো ছাত্র হতে হবে। সেই মেহেদিভাই…!
এর মধ্যে একদিন মেহেদিভাইয়ের সঙ্গে কথা হয়েছে। কলেজ বন্ধ। আরো মাসখানেক থাকবেন বাড়িতে। উপদেশ দিলেন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে চাইলে এখন থেকেই ভালো করে পড়তে হবে। নাইনে উঠেই ম্যাথ আর ফিজিক্সের ওপর জোর দিতে হবে বেশি…।
সেই মেহেদি হাসান গণবাহিনীতে নাম লিখিয়েছেন? এখন গুলি করে মানুষ মারেন? খুন করলেন নিজের শিক্ষককে…?
হাতকড়াপরিহিত মেহেদিভাইকে দেখেও আমি ঘটনা বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। তার মতো ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র গণবাহিনীতে যোগ দেবে কেন? আমার মাথার মগজ যেন গলতে শুরু করেছে। এ আমি কী দেখছি! মেহেদিভাই…? আমি দৌড় শুরু করলাম বাজারের দিকে। দেখি, নতুন পাগলটা কী বলে? পাগলরা নাকি মানুষের মনের কথা জানে…।
বটতলা শূন্য। কোথাও কেউ নেই। একটা বিড়াল শুধু ছপন ধরে বসে আছে…।