ঝিলু চাচি

ঝিলু চাচি
সিদ্দিক চাচা বিয়ে করে বাড়িতে বউ নিয়ে এসেছে। সে সময় আমি সবে মাত্র মেট্রিক পরিক্ষা দিয়েছিলাম। সবাই মিলে নতুন বউকে দেখতে গেলাম। বউয়ের নাম ঝিলু। বয়স হয়তো ১৪ অথবা ১৫ হবে। উচ্চতা ৫ ফুট হবে, দেখতে শ্যামলা বর্ণের। বড় ঘোমটার মধ্য ছোট একটা মুখ। এলোমেলো শাড়ি তে কি যে মায়া লাগছিল। বড় বড় চোখ দিয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছিল। আমাকে দেখে হাত নাড়িয়ে বলছে তার পাশে আসার জন্য।আমি তার পাশে যাওয়ায় পর, আমার কানে ফিসফিস করে বললো, “ফুফু আমার শাড়ি খোলে যাচ্ছে”।
নিজেকে ফুফু ডাকছে শুনে একটু বিব্রত হলাম এবং বললাম, “চাচি আপনি চাইলে আমাকে নাম ধরে ডাকতে পারেন আমি কিছু মনে করবো না” তখন চাচি মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে বললো, ” এটা আমার শাশুড়ির আদেশ। এটা আমার পক্ষে অমান্য করা সম্ভব না” আমি তার হাসিতেই আটকা পড়ে আছি। কি সুন্দর হাসি। এমন হাসি মনে হয় আমি আগে কখনো দেখিনি। আমি আর কিছু না বলেই শাড়ি ঠিক করে দিলাম। সিদ্দিক চাচার বয়স ৩০ এর কাছাকাছি হবে। দেখতে মোটামোটি ঠিক আছে। তবে মানুষটা খুব ভালো। ঝিলু চাচির শাশুড়ি আমার ছোট দাদি হয়। খুব শক্ত মনের মানুষ। সিদ্দিক চাচা ছাড়া তার আরো দুইটা ছেলে আছে।
দাদিকে দেখতাম ঝিলু চাচিকে সব সময় চাপের মধ্য রাখতো। চাপের মধ্যেও তার চঞ্চলতা কোথাও হারিয়ে যায়নি। ঘরের মধ্যে বাচ্চার মতো এদিক থেকে ওদিক শুধু দৌড়াদৌড়ি করে কাজ করতো। যে কোনো কিছু নিয়ে খুব আওয়াজ করে হাসতো। আমি শুধু সেই হাসি মুগ্ধ হয়ে দেখতাম। হাসির আওয়াজ শোনে দাদী চিল্লিয়ে বলতো, “মেয়ে মানুষের এতো আওয়াজ করে হাসতে নেই” সাথে সাথে হাসি বন্ধ হয়ে যেতো, মন খারাপ করতো কিন্তু মুখে কিছু বলতো না। সিদ্দিক চাচার বিয়ের কিছু দিন পর আমার পরিক্ষার রেজাল্ট দেই। ভালো রেজাল্ট করাতেই বাবা আমাদের শহরে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। ছোট দাদি ব্যাপারটি জানতে পেরে বাবাকে খুব তাচ্ছিল্য মুখ করে বলেছিল, “মেয়ে মানুষের এতো কিসের পড়ালেখা। বিয়ে দিয়ে সংসার করাই তাদের ধর্ম” জবাবে বাবা কিছুই বলে নি।
এরপর চলে আসি শহরে। মন দিয়ে পড়তে থাকলাম। ইন্টারে পর মিডিকেল ভর্তি পরিক্ষায় সিলেট মেডিকেল কলেজে সিট পেলাম। পেছনে আর দেখতে হয়নি। চলে গেলাম সিলেটে। বাড়িতে আর যাওয়া হয়নি। এরপর ইন্টার্নি চলা কালীন বিয়ে হলো। দিনগুলো খুব ভালোই যাচ্ছিল। বিয়ের ১০ বছর পর বাবা চলে গেল না ফেরার দেশে। বাবার চল্লিশার সময় বাড়িতে গেলাম। আসার আগ মূহুর্তে দাদির সাথে দেখা করতে গেলাম। দাদি পাশে দেখলাম, একটা মেয়ে দাদির পা টিপে দিচ্ছে। মেয়েটিকে আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি, অবিকল ঝিলু চাচির মতো।
দাদিকে সালাম দিলাম। দাদি আমাকে দেখে খুব খুশি হয়ে বললো, “রুমু তুই এসেছিস। আমাদের কথা কি তোর একটুও মনে পড়ে না। দেখ রুমু আমার নাতনী। দেখতে তোর চাচির মতো তাই না? আমি হেসে মাথা নাড়িয়ে বললাম, ” হ্যা দাদি” মেয়েটি আমাকে সালাম দিল। আমি সালামের জবাব দিয়ে তার সাথে পরিচিত হলাম। ওর নাম শিউলি। ছোট করে শিলু ডাকে। এবার মেট্রিল পরিক্ষা দিয়েছে।
এরপর দাদি বললো, যা শিলু তোর রুমু আপুর জন্য চা নিয়ে আয়। “জানিস রুমু তোর ঝিলু চাচি আমার ইচ্ছা পূরণ করতে গেয়ে নিজের জীবন টাই দিয়ে দিল। তিন বছরে তিন টা মেয়ে হওয়ার পরও আমি তুর চাচিকে একটা ছেলের জন্য চাপ দিয়েছিলাম। চার নম্বর বাচ্চা দিতে গিয়ে সে এই দুনিয়া থেকেই চলে গেল। তোর চাচি যাওয়ার সময় সে আমাকে বলে গেল, সে নাকি আমার ইচ্ছা পূরণ করতে পারে নি” এটা বলার পর দাদি কান্না করে দিল। “জানিস রুমু আমার মনে হয় আমি আমার ছেলের বউকে মেরে ফেলেছি। তোর চাচা কে বললাম বিয়ে করার জন্য। কিন্তু সে রাজি না। কিভাবে রাজি হবে বলতো। আমি নিজেই আমার বউমাকে ভুলতে পারছি না। তোর চাচা কিভাবে ভুলতে পারবে?
দাদি শাড়ির আঁচলে চোখ মুছে আবার বলা শুরু করলো, “তুর চাচাকে বললাম শিলুকে বিয়ে দিয়ে দিতে, নাত জামাই দেখেই মরবো” তুর চাচা বললো,” মা নাতনীকে বিয়ে দিলে একসময় বলবে তুমি পতীন জামাই দেখেই মরতে চাও” কথাটির অর্থ বুঝলি রুমু?আমি আর তোর চাচাকে কিছুই বলি নি। তার ইচ্ছা মেয়েদের তোর মতো ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার বানাবে” এবার দম নিয়ে আবার বললো, “সত্যি কথা বলতে আমারো কিন্তু এটাই ইচ্ছা। আমার নাতনি গুলো পড়া লেখাই অনেক ভালো” এরপর চা নাস্তা নিয়ে শিলু রুমে আসলো। ওকে দেখে ঝিলু চাচির জন্য আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল। আমি কোনোমতে চা খেয়ে দাদির রুম থেকে বের হয়ে গেলাম। পাশের রুমে চিদ্দিক চাচার সাথে দেখা হলো। চাচা আমাকে দেখে বললো,
” আরে রুমু যে!কেমন আছিস? তো ডাক্তারি কেমন চলছে। আমি হেসে বললাম, “এইতো চাচা ভালো। আপনি কেমন আছেন চাচা?”
“এই তো কোনোমতে দিন যাচ্ছে। তুর জামাইকে নিয়ে আসিস একদিন এখানে”
“ইনশাল্লাহ একদিন নিয়ে আসব। চাচা, শিলুর সাথে দেখা হলো। বাকিরা কোথায়?”
“ওরা প্রাইভেটে গেছে”
চাচা কিছুক্ষন চুপ থেকে বললো, “রুমু, তুর চাচি সব সময় তুর গল্প করতো আমার সাথে। বলতো, আমার মেয়েদের নাকি তোর মতো বানাবে। যখন সে মৃত্যুর সাথে লড়াই করছিল, তখন কি বলেছে জানিস? বলেছে আমার মেয়ে গুলো মধ্যে কেউ একজন যেন গাইনী ডাক্তার হয়। এবং গ্রামের মহিলাদের যেন গর্ভবতী অবস্থায় মরতে না হয়। এটা শুনার পর বুক ফেটে কান্না আসছিল। খুব কষ্ট লাগছিল আমার। কোনো মতে বাড়ি থেকে বের হয়ে গাড়িতে বসে পড়লাম। কিছু রাস্তা যাওয়ার পর চেপে থাকা কান্না বের হয়ে আসলো। আমার কান্না দেখে পাশ থেকে হঠাৎ মা চমকে উঠলো। সাথেসাথে বললো, ” কি হলো রুমু তুই এভাবে কাঁদছিস কেন?
আমি কেঁদে কেঁদে বললাম, “মা আমি কেন ডাক্তার হলাম? আমার ডাক্তার হয়ে লাভ কি হলো, যখন প্রিয় মানুষদের জন্যই কিছু করতে পারলাম না যেখানে আমার জন্ম সেখানেই কিছু না করে আমি দেশ বিদেশে সেবা দিয়ে যাচ্ছি। আজ যদি আমি তাদের পাশে থাকতাম, তাহলে হয়তো অনেক মানুষ বেঁচে যেত।নিজেকে খুব নিচু মনের মানুষ মনে হচ্ছে। ঝিলু চাচি বয়সে ছোট তার চিন্তাধারা আমার চেয়ে অনেক বড়। আমি পড়া লেখা করে ঠিকই ডাক্তার হয়েছি, কিন্তু সঠিক মন মানষিকতা আমার হয় নি
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত