বদহজম

খুব আশা ছিল, এবার হবেই। যারা অফিসের বড় কর্তাদের সঙ্গে উঠবোস করে, তারাও ইঙ্গিত দিয়েছিল এবার আর কিছুতেই সোনার হরিণ হাত থেকে ফসকাবে না, এতদিন ধরে আটকে থাকা প্রমোশনটা পেয়ে আরেকটু উচ্চপদে এ-বছর নিশ্চয়ই যাবে সে। উন্মুখ অপেক্ষা আর অপেক্ষা। কিন্তু হলুদ খামে ‘অতি জরুরি’ ছাপ দেওয়া সেই কাক্সিক্ষত চিঠিটি আর এলো না। নিজের সামর্থ্যরে ওপর সন্দেহ জাগল তার, হতাশা ঘিরে ধরল, তারপর মনে হলো জগতের সবাই শত্র“, সবচেয়ে বড় শত্র“ তার বস, যে মাথার ওপর বসে খেয়াল-খুশিমতো ছড়ি ঘোরাচ্ছে আর তার চলার পথে অদৃশ্য সব কাঁটা বিছিয়ে রাখছে, কিছুতেই সামনে এগোতে দিচ্ছে না।

কিন্তু কী এমন দোষ তার? হয়তো লোক-দেখানো সপ্রতিভ স্মার্টনেস নেই, হয়তো অযথা বিনয়ে নুয়ে পড়ে হাত কচলানোর স্বভাব নেই, হয়তো ভক্তিতে গদগদ ভাব নেই, আর হয়তো এসব না থাকার কারণেই বস নামের ওই মানুষটা অপছন্দ করে তাকে, হয়তো ঘৃণাও করে। এসব ভেবে তার রাগ হলো খুব, তবে নিষ্ফল রাগ, জেদ হলো, অসমর্থের জেদ, ক্রোধ হলো ভীষণ রকমের আর শেষ পর্যন্ত বিষণ হয়ে পড়ল সে, হলুদ পাতার মতো বিমর্ষ ভঙ্গিতে ঝুলে রইল বিবর্ণ চাকরিটাতে।
তার এই মনমরা ভাব চোখে পড়ল অনেকেরই।
‘হঠাৎ কী হলো গো তোমার? মুখে হাসি নেই, মনে আনন্দ নেই…’ বউ মাথার চুলে হাত বুলিয়ে নরম সুরে জানতে চাইলে সে হাসার চেষ্টা করে আর বলে, ‘কই নাহ্্, কিছু তো হয় নাই।’

তারপর পাশ ফিরে শুয়ে চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়ার ভান করে সে। দুঃখের সঙ্গে উপলব্ধি করে, দুর্বৃত্তদের জয়-জয়কার চারপাশে, অযোগ্য মানুষেরা সমানে পদোন্নতি পেয়ে উঁচুতে উঠে যাচ্ছে, নির্লজ্জ, চাটুকারের দল তথাকথিত সফলতা পাচ্ছে। সর্বত্রই যেন যোগ্যতার চেয়ে সম্পর্ক বড় হয়ে গেছে, দক্ষতার চেয়ে, সিনসিয়ারিটির চেয়ে তেলবাজির মূল্য বাড়ছে, পদোন্নতি চাইলে পদলেহন বিদ্যায় পারদর্শী হতে হবে, কে যেন একদিন বলেছিল! কিন্তু কেন? কেন এমন হবে? কেন? তার খুব কষ্ট হয়, অসহায় লাগে, মন খারাপ হয়। অসম্পূর্ণ ঘুম আর দুঃস্বপ্নের রাত পেরিয়ে সকাল হলে ছেলে এসে আধো আধো বোলে ডাক দেয়।
‘বাবা, ও বাবা, দেখো তোমার আগে সূর্যমামা জেগে গেছে, আমিও জেগেছি …’

ছেলেকে কোলে তুলে নেয় সে। নিজের না-পাওয়াগুলো ভুলে হাসার চেষ্টা করে। বউ টেবিলে নাস্তা সাজিয়ে ডাক দেয়। আর তখনই পেটে তীব্র ব্যথা মোচড় দিয়ে ওঠে তার। তাড়াতাড়ি ছেলেকে কোল থেকে নামিয়ে রেখে বাথরুমে দৌড়ায়, কমোডে নরম পিচ্ছিল আমযুক্ত মল ফ্ল্যাশ করে একটু চিন্তিত হয়ে পড়ে সে। ব্যাপারটা চরম অস্বস্তির আর সেইসঙ্গে ভয়ানক বিব্রতকরও বটে। এই চৌত্রিশ বছরের চেনাজানা পাকস্থলীটা কয়েকদিন ধরে কেন যে তার সঙ্গে এমন শত্র“তা শুরু করে দিলো, ভেবে পায় না সে। কথা নেই, বার্তা নেই, হঠাৎ করে পেট কামড়ানো শুরু হয়ে যায়। হয়তো বসের সামনেই বসে আছে, কোনো মিটিংয়ে, চেয়ারম্যান স্যারের কাছ থেকে থেকে আসা কোনো জটিল চিঠির উত্তর কী হবে তা নিয়ে গুরুগম্ভীর আলোচনা চলছে, তখনই আচমকা মুখ শুকনো করে তাকে বলতে হয় – ‘এক্সকিউজ মি, আমি একটু ওয়াশরুম থেকে ঘুরে আসছি।’

তারপর বসের কুঁচকানো ভ্রু আর সহকর্মীদের বিস্মিত দৃষ্টি উপেক্ষা করে রীতিমতো ঘেমে দৌড়ে বাথরুমে আসার পর কোথায় কী? ভুটভাট শব্দ তুলে কিছু বাতাস বেরিয়ে যায়। পেট নিয়ে এরকম ভোগান্তিতে জেরবার হয়ে শেষ পর্যন্ত ডাক্তারের শরণাপন্ন হলে কিছু ওষুধ আর একগাদা টেস্ট দিয়ে দেন ডাক্তার। বউ দেশি চিকিৎসা হিসেবে বেলের শরবত, জাউ ভাত আর তেলবিহীন তরকারির ব্যবস্থা করে। কিন্তু সুফল মেলে না।

এদিকে বসের অত্যাচারও ক্রমাগত বাড়ছে। সবার সামনে যা-নয়-তা বলে অপমান করা, অফিসটাইম শেষেও হাতে একগাদা কাজ ধরিয়ে দেওয়া, সেই কাজেও অযথাই ছোটখাটো ভুল ধরা, ছুটির দিনেও মিটিং রাখা – অসহ্য। এর মধ্যে একটা জাপানি ট্রেনিং স্কলারশিপ এলো ডিপার্টমেন্টে। যেরকম যোগ্যতা চাওয়া হয়েছে, তার সবই আছে তার। স্কলারশিপটার জন্য দরখাস্ত করল সে। ভাবল, এটা হলে ভালো, কিছুদিন বসের চেহারা অন্তত দেখতে হবে না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সিনিয়র একজনকে তারচেয়ে বেশি অভিজ্ঞতাসম্পন্ন দেখিয়ে জাপান পাঠানো হলে বেশ মুষড়ে পড়ল সে। মনে হলো, এসব প্রতিকারহীন অন্যায় আর অত্যাচার, যা অমানুষিক নির্যাতনের শামিল। আর এসব নির্যাতনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকল তার বদহজম, কিছু খেলেই এখন প্রবল অস্বস্তি শুরু হয়। মনে হয়, পেটের ভেতর হুড়ম-গুড়ম শব্দ করে কেউ ছোটাছুটি শুরু করেছে। কখনো পেট নরম আবার কখনো প্রচণ্ড শক্ত। শেষমেশ নিরুপায় হয়ে ছুটি নিয়ে বাড়িতে। উদ্বিগ্ন বউ প্রতি বেলা কাঁচা কলার ভর্তা, পেঁপে আর শিং মাছের মশলাবিহীন ঝোল রেঁধে রেঁধে স্বামীর পেট-সেবা করতে গিয়ে প্রায় জেরবার।

কয়েকদিন পর ব্লাড, স্টুল আর ইউরিন টেস্টের রেজাল্ট আসে, সেসব দেখে ডাক্তারের কপালে চিন্তার গাঢ় ভাঁজ – ‘না তেমন কোনো বড় সমস্যা তো দেখছি না। টেনশন করেন নাকি খুব? অনিদ্রা হয়? বিষণœ থাকেন?… এসব দূর করে দেন, সব ভালো হয়ে যাবে।’
বউ বাড়িতে এসে রিলাক্সেশন মিউজিক ছেড়ে দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে জানতে চায়, ‘কিসের এত চিন্তা তোমার বলো তো, আমরা মোটে তো তিনটা মানুষ। মা-বাবাকে নিয়ে ভাবো? তোমার অন্য ভাইবোনরা আছে না, প্রয়োজনে তারা দেখবে ওনাদের…’

বুকের মধ্যে বিঁধে থাকা কাঁটার কথা বউকে সে বলে বোঝাতে পারে না। নিজেই ভাবে, নাহ্্, জগতে আরো অনেক কাজ আছে, প্রয়োজনে এই চাকরি ছেড়ে অন্য কাজ করব, তবু এই বিচ্ছিরি নির্যাতন আর সইব না। এসব ভেবে ভেবে একদিন নিজের মনে অনেক প্রস্তুতি নিয়ে বসের কাছে যায় সে, আর ঠান্ডা শীতল কণ্ঠে বলে, ‘আমার কাজ আপনার পছন্দ না হলে আমাকে অন্য ডিপার্টমেন্টে বদলি করে দেন।’

বস ক্রূর, নিষ্ঠুর চোখে তাকায়। যেন তার সামনে কোনো তুচ্ছ কীট বসে আছে। তারপর সাপের মতো হিসহিস করে – ‘কোম্পানি যেখানে বলে সেখানে কাজ করতে বাধ্য আপনি, বললেই হলো অন্য ডিপার্টমেন্টে…’
‘আমি এখানে অসুস্থ হয়ে পড়ছি।’ সে মরিয়া হয়ে বলে।
‘হুম, এসব ভড়ং আমার সঙ্গে করবেন না।’ বস বলে। আর তখনই আবার পায়খানার বেগ হয় তার। পেটে মোচড় দিয়ে ওঠে অসহ্য ব্যাথা।
‘এক্সকিউজ মি, আমি একটু ওয়াশরুম থেকে ঘুরে আসছি।’
এই বলে দ্রুত উঠে যায় সে। কমোডে বসলে হুশহাশ কিছু বায়ু বেরিয়ে পেট ঠান্ডা হয়ে আসে। এই তবে তার অমোঘ নিয়তি? এভাবে প্রতিদিন পাহাড়ি শকুন এসে ধারালো চঞ্চুতে তাকে ক্ষত-বিক্ষত করবে, দিনের শেষে আবার সে যখন সমস্ত ক্ষত সামলে নেবে, তখনই মাথার কাছে শকুনের তীক্ষ্ চিৎকার, পাখা ঝাপটানি! আবার ছিন্নভিন্ন হওয়া ! অত্যাচারের তো সীমা-পরিসীমা আছে। সে গোপনে অন্য অফিসে চাকরির জন্য দরখাস্ত করে, ইস্ত্রি করা শার্ট পরে ইন্টারভিউ দিতে যায়। যদিও জানে, তার জন্য কোথাও অপেক্ষা করে নেই অমল ধবল বিশুদ্ধ চাকরি। সবখানেই শুধু মন্দ মানুষের দৌরাত্ম্য। অযোগ্যদের হম্বিতম্বি। ধূর্তদের সুচিক্কন হাসি। তেলবাজদের উল্লাস।

তবু বিকল্প চেষ্টা তো করতেই হবে। রিজিকের মালিক তো আল্লাহ! মুখ বুঁজে আর কত সহ্য করবে সে? আরেকটা হয়, যদি ওই অত্যাচারী বসকেই এখান থেকে বদলি করা যায়, অথবা, একেবারে সরিয়ে দেওয়া যায় দুনিয়া থেকেই, কোনো পেশাদার খুনি ভাড়া করবে নাকি? খারাপ না আইডিয়াটা, এটাকে নিয়েই সে চিন্তাভাবনা করে খানিকটা। কল্পনায় দেখতে পায়, একটা বুলেট বাতাসে শিস কেটে প্রচণ্ডগতিতে ছুটে আসছে বসের বুকের দিকে, কিংবা একটা ঝকঝকে ছুরি বিদ্ধ করছে তার রক্তাক্ত হৃৎপিণ্ড। এসব ভয়ংকর দৃশ্য কল্পনা করে বিমল আনন্দ পায় সে। কয়েকদিন পেটের অশান্তিটা থেকে মুক্ত থাকে।

কিন্তু ওপরওয়ালার ইচ্ছায় এসব কিছুই করতে হয় না, বছরের শেষদিকে নিয়মমাফিক তাকে বদলি করে দেওয়া হয়, অন্য ডিপার্টমেন্টে একটা গুরুত্বহীন প্রকল্পে। এখানে সে নিজেই বস। তার সঙ্গে দুজন সহকর্মী। একজন নারী, অন্যজন পুরুষ। এক রুমে গাদাগাদি করে রাখা তিনটা টেবিল-চেয়ার। ঊর্ধ্বতন, অধস্তন সব এখানে একাকার। এটা কেমন ব্যবস্থা? একি আবারো তাকে অপদস্থ করার জন্য তৈরি করা কোনো ফাঁদ? খারাপ বসের আওতামুক্ত হয়ে যে-আনন্দটুকু হয়েছিল তা যেন আবারো ম্লান হয়ে যায় তার, আবারো বিমর্ষ হয়ে পড়ে সে। মনে হয়, এটাও ওই বসেরই ষড়যন্ত্র, পুরো অফিসের সামনে তাকে ব্যর্থ প্রমাণ করার চেষ্টা। আবার পেটের যন্ত্রণা শুরু হয় তার।

‘স্যার, ডিপার্টমেন্টে আপনাকে ওয়েলকাম।’ চটপটে নারী সহকর্মী চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে তাকে স্বাগত জানায়। ‘স্যার এখানে জায়গা অল্প, কিন্তু আমরা টেবিল-চেয়ারগুলো যদি একটু রি-অ্যারেঞ্জ করে নিই, তাহলে স্যার, কথায় বলে না, যদি হয় সুজন তেঁতুল পাতায় ন’জন। আমরা তো স্যার মোটে তিনজন।’ মেয়েটি হড়বড় করে বলে উঠলে সে তার বসসুলভ গাম্ভীর্য বজায় রেখে মাথা দোলায়।

মেয়েটি তক্ষুনি গিয়ে পিয়ন ডেকে আনে আর সঙ্গী পুরুষ সহকর্মীকে নিয়ে সত্যি সত্যিই টেবিল-চেয়ারগুলো এমনভাবে সাজায় যে, রুমে বেশ খানিকটা জায়গা ফাঁকা থেকে যায় আর বস হিসেবে তার বসার জায়গাটাও খানিকটা স্বাতন্ত্র্য পায়।

‘আমার নাম স্যার, জয়া জোনাকি। আমি নইকো সূর্য, নয় তো চন্দ্র, আমি আপন আলোয় আপনি পূর্ণ।’ মেয়েটি হাসিমুখে বলে।

জোনাকি বুদ্ধিমতী হলেও কথা একটু বেশিই বলে, সে মনে মনে ভাবে। একে বেশি পাত্তা দেওয়া যাবে না। তাহলে মাথায় চড়ে বসবে। তার বিপরীতে ছেলেটি, যার নাম জয়নাল, সে কথা প্রায় বলেই না। ‘মিচকি শয়তান’ – জয়নাল সম্বন্ধে মনে মনে এমন ধারণা করে প্রকল্পের ফাইলপত্র দেখতে শুরু করে সে। দেশজুড়ে চলতে থাকা তাদের বিভিন্ন প্রকল্পের অগ্রগতি প্রতিবেদনের ডকুমেন্টেশন করা এই বিভাগের মূল কাজ। জোনাকি আর জয়নালের দায়িত্ব তথ্যগুলো কমপাইল করা আর বস হিসেবে তার দায়িত্ব এগুলোকে সুপারভাইজ করে অ্যাপ্র“ভাল দেওয়া। সহজ সাধারণ কাজ। কাজের প্রক্রিয়া গতিশীল করতে সে কয়েকটা কর্মপরিকল্পনা নেয়, ঢাকার বাইরে ফোন করে তাড়াতাড়ি তথ্য পাঠানোর তাগিদ দেয়। জোনাকি একটু বেশি কথা বললেও কাজে বেশ দক্ষ, চটপট হাতের কাজ সেরে ফেলতে পারে। মুশকিল জয়নালকে নিয়ে, মুখ বুঁজে থাকা ভেতর-গোঁজা ধরনের মানুষ সে। সাত চড়ে রা’ নেই টাইপ। কাজেকর্মে ভালো হলেও গতি একটু ধীর।
তার একটু অবাকই লাগে এই দুই বিপরীতধর্মী কর্মীর শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান কীভাবে সম্ভব হলো তা ভেবে। জয়নাল যদি জমাট বরফ হয় তো জোনাকি একেবারে ফুটতে থাকা গরম পানি। সারাক্ষণই জোনাকির মাথায় নানা রকম আইডিয়া কিলবিল করতে থাকে। সেদিন হঠাৎ করেই বলে বসল, ‘স্যার, আমরা কি এই রুমে একটা কফি কর্নার করতে পারি না? কেটলিতে গরম পানি থাকবে, কফির কৌটা থাকবে, টি-ব্যাগ থাকবে, যার যখন ইচ্ছা সে নিজেই বানিয়ে খাবে… এই জয়নাল, আপনি কালকেই একটা ইলেকট্রিক কেটলি কিনে আনবেন। স্যার, এক বাক্স বিস্কিটও সঙ্গে রাখা যায়, বিস্কিটটা কিন্তু স্যার এই মাসে আমি স্পন্সর করব। পরের মাসে আপনি।’

জোনাকির উদ্যোগে অল্পদিনের মধ্যেই ‘কফি কর্নার’ চালু হয়ে গেল। অন্য ডিপার্টমেন্টের লোকজনও সেটা দেখতে এলো। একদিন সে খেয়াল করল, জানালার ধারে একটা কাচের বোতলে লতানো সতেজ সবুজ মানি-প্ল্যান্টের শাখা বাতাসে দুলছে। নিশ্চয়ই জোনাকির কাজ। একটা সামান্য সবুজ পাতাও যে এই কাঠখোট্টা অফিসটাকে এত স্নিদ্ধতা দিতে পারে, আগে তা জানা ছিল না তার। ক্রমশ অফিস তার ভালো লাগতে শুরু করল, আস্তে আস্তে পেটের বাজে সমস্যাটাও কাটিয়ে উঠল সে। রাতে ঘুম ভালো হলো। বউ টিপ্পনী কেটে বলল, ‘এই তোমার স্বাস্থ্য কিন্তু বেশি বেশি ভালো হয়ে যাচ্ছে। ব্যাপার কী?’
‘কী যে বলো না! আমি মরি আমার জ্বালায়। যে-ডিপার্টমেন্টে কেউ যেতে চায় না সেখানে ডাম্প করেছে আমাকে।’ সে বলে।
‘কিন্তু তাতে তুমি খুব যে অখুশি, তা তো মনে হয় না। লেডি কলিগ কি খুব সুন্দরী নাকি?’
‘দূর! তোমার চেয়ে সুন্দরী আমার চোখে কেউ নেই।’
বউকে আশ্বস্ত করে সে। ভাবে, এই জীবনে খুব বেশি কিছু কি চেয়েছিলাম আমি? নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করে সে, বসের সদয় ব্যবহার – আরেকটা ন্যায্য পদোন্নতি – এই তো, কিন্তু সেটাও পেলাম না। ইচ্ছাকৃতভাবে আমাকে বঞ্চিত করা হলো। পুরনো দিনের বঞ্চনার কথা মনে করে আবার ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে সে, ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। আর বিক্ষিপ্ত মনে অফিসে ঢুকে দেখে জয়নালের সিট খালি। সে এখনো অফিসে এসে পৌঁছায়নি।
‘এরকম দেরি করে এলে কি অফিস চলে?’
ঘণ্টাখানেক পর জয়নাল রুমে ঢুকতেই উচ্চকণ্ঠে চেঁচিয়ে ওঠে সে।
‘স্যার, যাত্রাবাড়ী হয়ে আসি তো, ওখানে অনেক জ্যাম।’ জয়নাল মিনমিন করে।
‘না, না, এভাবে চলবে না। এরপর থেকে দেরি করলে বেতন কাটা যাবে।’ সে ঘোষণা দেয়। পরদিন আবারো জয়নালের সঙ্গে রাগারাগি হয় তার। একটা দরকারি চিঠি তৈরি করার কথা ছিল, করেনি।
‘জয়নালের শরীরটা মনে হয় ভালো নেই, স্যার। নইলে কাজে ও কখনো গাফিলতি করে না। জয়নালের রেজাল্ট কিন্তু খুব ভালো স্যার, অলথ্রু ফার্স্ট ক্লাস।’

জোনাকি সহকর্মীর হয়ে সাফাই গাওয়ার চেষ্টা করলে সে আরো রেগে যায়। ‘ফার্স্ট ক্লাস ধুয়ে পানি খাব আমি? আমার চাই চটপট কাজ।’ মনে মনে ভাবে সে, ‘নিশ্চয়ই ফার্স্ট ক্লাস পাওয়ার অহঙ্কারটা ভুলতে পারে না জয়নাল।’ আরেকটা জিনিসও লক্ষ করেছে সে, জয়নাল আর জোনাকির মধ্যে ইদানীং বেশ খাতির হয়েছে, কাজের ফাঁকে কুটুর-কুটুর গল্প করে দুটিতে, হাসাহাসি করে, অফিস শেষে একসঙ্গে বেরিয়ে যায়। জয়নালের মতো বোবা টাইপের একটা ছেলের সঙ্গে এত কী কথা থাকতে পারে জোনাকির? এত কিসের গুজুর-গুজুর ফুসুর-ফুসুর? অফিসের শৃঙ্খলা বজায় রাখার কথা ভেবে চিন্তিত হয়ে পড়ে সে। দুজন যাতে একসঙ্গে বেরুতে না পারে সেজন্য পরপর বেশ কয়েকদিন অফিস ছুটি হওয়ার আগে আগে প্ল্যানমাফিক জয়নালের হাতে একগাদা কাগজ ধরিয়ে দেয় সে। গম্ভীর গলায় বলে, ‘আজকেই ইনফরমেশনগুলো এন্ট্রি করে হেড অফিসে পাঠিয়ে দিয়ে তারপর যাবেন।’
জয়নাল মাথা নিচু করে কাগজগুলো হাতে নিয়ে নিজের ডেস্কে চলে যায়। রাত ৮টার আগে এই কাজ শেষ হবে না, আর জয়নালও অফিস থেকে বেরুতে পারবে না, জানে সে। জোনাকি একা একা অফিস থেকে বেরিয়ে যায়। জুটিটা ভেঙে দিতে পেরে অদ্ভুত মজা লাগে তার। আরো কীভাবে মিচকাটাকে শায়েস্তা করা যায়, সেসব নিয়ে ফন্দি আঁটে। জয়নালের নির্লিপ্ত উদাসীনতাকে মনে হয় ঔদ্ধত্য। এই ঔদ্ধত্য চূর্ণবিচূর্ণ করে দিতে হবে, সে ভাবে। সালাম-আদাবের বালাই নেই, কথা বললে জবাব দেয় না। বেয়াদব একটা। এবারের বার্ষিক প্রতিবেদনে ওর বিরুদ্ধে কড়া একটা রিপোর্ট লেখার কথা ভাবে সে। অধস্তনদের ওপর কর্তৃত্ব আর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা ছাড়া অফিস চালানোর কোনো বিকল্প নেই।

এরই মধ্যে পরপর কয়েকদিন অফিস কামাই করে জয়নাল। ফোনে জানায়, অসুস্থ, তাই আসতে পারছে না। মহাবিরক্ত হয় সে। জয়নাল যে কাজ ফাঁকি দিতে এসব অজুহাত দেখাচ্ছে তা নিয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ থাকে না তার।

এক সপ্তাহ পর শুকনো মুখে অফিসে ঢোকে জয়নাল। জবুথবু হয়ে মলিন চেহারা নিয়ে ডেস্কে বসে থাকে।
‘কী ব্যাপার জয়নাল সাহেব? কী হয়েছিল আপনার?’
সে ক্যাজুয়াল ভঙ্গিতে প্রশ্ন করে। জয়নাল শূন্যদৃষ্টিতে এদিক-সেদিক তাকায়। তারপর আবার মাথা নিচু করে বিড়বিড় করে কিছু বলে। কিছু কথা বোঝা যায়, কিছু বোঝা যায় না।
‘স্পষ্ট করে কথা বলেন। জোরে বলেন। কী সমস্যা আপনার?’
সে প্রায় ধমকে উঠলে জয়নাল জড়ানো গলায় থেমে থেমে বলে, ‘আমার স্যার পেটে খুব সমস্যা, বদহজম, আমাশা, খুব ব্যথা হয় পেটে, গুড়গুড় করে শব্দ হয়, পেট ফেঁপে-ফুলে যায়, পায়খানার বেগ আসে কিন্তু পায়খানা হয় না, কত টেস্ট করলাম, তবু ডাক্তার কোনো কিছু ধরতে পারছে না…। ’
জয়নালের অসহায় চেহারাটা হঠাৎ যেন ম্যাজিকের মতো ভেঙেচুরে বাঁকা হয়ে পালটে যেতে থাকে। আর তার সামনে কঠিন চেহারা নিয়ে বসে থাকা ঊর্ধ্বতনের হঠাৎ মনে হয়, জয়নালকে নয়, বরং পারদ-ওঠা আয়নায় নিজেরই কয়েক মাস আগের ভাঙাচোরা বিধ্বস্ত মুখ দেখছে সে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত