পাঁচ বছরের মেয়ে নিতুকে সাথে নিয়ে শ্বশুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলাম। আমার এখন কী করা উচিত বুঝতে পারছি না। কোন মুখে বাবা-মায়ের সামনে যাব আমি? যাদের ছেড়ে সাত বছর আগে চলে এসেছিলাম। এখন বুঝতে পারছি মা বাবা কখনো সন্তানের খারাপ চায় না।
আমার মেয়েটিকে মানুষ করার চিন্তা মাথার মধ্যে অবিরত ঘুরপাক খাচ্ছে। এই রোদের মধ্যে রাস্তার পাশ দিয়ে হেঁটে চলেছি আমি আর নিতু। এখন অবশ্য কেউ রোদের মধ্যে হাঁটতে চাই না। তবুও হাঁটতে হয় কখনো শখ করে আবার কখনো বাধ্য হয়ে। রোদের মধ্যে হাঁটতে গিয়ে ঘেমে একাকার হয়ে গেলাম। হঠাৎ নিতু বলল, আম্মু খিদে পেয়েছে। ব্যাগে হাত দিয়ে দেখলাম সামান্য কিছু টাকা পড়ে আছে। মিতুকে নিয়ে একটা টঙের দোকানে বসলাম। এক কাপ চা আর একটি পাউরুটি নিতুকে খাইয়ে আবার হাঁটা শুরু করলাম। জানিনা গন্তব্য স্থল কোথায়। অনেকক্ষণ হাঁটার পরে একটি গাছের নিচে বসলাম বিশ্রাম করতে। হালকা বাতাসে চোখটা বুজে এলো। চোখ বন্ধ করতেই আজ থেকে সাত বছর কথা মনে পড়ে গেল। ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার এক বছরের মাথায় সাজিদের সাথে প্রথম আলাপ হয়েছিল। দুই বছরের সিনিয়র ছিল সে। একদিন ভার্সিটির পুকুর পাড়ে বসে বাদাম খাচ্ছিলাম। হঠাৎ কেউ এসে আমার পাশে বসলো। পাশে তাকিয়ে দেখলাম একটি অচেনা ছেলে। কয়েক মিনিট পরে ছেলেটি বলল, আমি সাজিদ এ ভার্সিটিতে পড়াশোনা করি। এবার তৃতীয় বর্ষে। আপনি? আমি উত্তর দিলাম ” আমি অরুনিমা। এবার প্রথম বর্ষে পরীক্ষা দেব।
– আমি জানি।
– কীভাবে জানেন?
– প্রায় আট মাস তোমাকে ফলো করছি। তোমার সম্পর্কে সব কিছুই জানি, এমনকি তোমার বাসাও চিনি।
– তাহলে আমাকে শুধু শুধু জিজ্ঞেস করলেন কেন?
– তোমার মুখ থেকে শুনবো তাই।
ওর কথা শুনে বেশ অবাক হলাম। আমার সম্পর্কে কীভাবে এত কিছু জানলো? সে বলে উঠল, মনে মনে ভাবছো এত কিছু কীভাবে জানলাম? আমি বললাম,” হ্যাঁ” তখন সে মুচকি হেসে বলল, তোমার নাম জেনেছি বান্ধবীর থেকে। আর তোমাকে ফলো করে তোমার বাসা পর্যন্ত গিয়েছি। হঠাৎ ভাবলাম আর কত চুপিচুপি তোমাকে ফলো করবো এবার না হয় সামনে গিয়ে কথা বলি। আমি কিছু না বলেই চুপ করে ছিলাম। বেঞ্চে রাখা বাদাম গুলো নিয়ে সে খেতে শুরু করলো। আর আমাকে বললো, একা একা খেতে হয় না। পাশের জন কে দিয়ে খেতে হয়। না হলে পাশের জনের আত্মা ওই খাবারের মধ্যে ঢুকে পড়ে তখন যে খায় তার পেট খারাপ হয়।
আমি তার কথা শুনে প্রচুর আসলাম। সে মুগ্ধ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো। আমি উঠে চলে আসলাম। তারপর থেকেই সাজিদ এর সাথে প্রায়ই কথা হতো। আস্তে আস্তে ওর পাগলামি গুলো আমার মনে জায়গা করে নিলো।এক বছর না যেতেই বাসা থেকে আমার বিয়ে ঠিক করলো। আমি বাসায় সাজিদের কথা বলেছিলাম কিন্তু বাবা মা রাজি হয়নি। সাজিদকে জানালাম আমার বিয়ের কথা। সাজিদ সবকিছু শুনে বলল, তাহলে আমরা পালিয়ে বিয়ে করি। আমিও সেদিন ওর কথায় সাই দিলাম। ওকে বিয়ে করে শশুর বাড়ি চলে আসলাম। বিয়ের কিছুদিন পরে সাজিব পড়াশোনা বাদ দিয়ে ইতালি চলে গেল। ওখানে একটি ভালো কোম্পানিতে জব পেলো। প্রতিবছর ছুটিতে দেশে আসতো। বেশ ভালোই চলছে দিনকাল। এর মাঝে বাবা মা আমার খোঁজ নেয়া বন্ধ করে দিলো। সরাসরি বলে দিলো আমার মত মেয়ে দরকার নেই তাদের। প্রথমে খারাপ লাগলেও শ্বশুরবাড়িতে বেশ ভালোই ছিলাম। দুই বছর পরে যখন সাজিদ আসলো। তার কিছুদিন পরে বুঝতে পারলাম আমাদের ঘরে নতুন অতিথি আসছে। সেদিন সাজিদ বাবা হওয়ার খুশিতে কেঁদেই ফেলল। সেদিন পৃথিবী সমান আনন্দ দেখেছিলাম ওর হাসিতে। দুই মাস পরে সাথে চলে গেল সাজিদ।
পুনরায় এক বছর পরে ফিরে আসলো দেশে। এতদিনে আমার ঘরে ছোট্ট নিতুর জন্ম হয়েছে। তারপর বিদেশে ফিরে গিয়ে প্রতিদিন নিয়ম করে তিন থেকে চার বার ভিডিও কল দিয়ে মেয়েকে দেখতো, মেয়ের খোঁজ রাখত। সব ভালই চলছিল। নিতুর বয়স যখন সাড়ে তিন বছর তখন থেকেই সাজিদ কেমন যেন পরিবর্তন হয়ে গেল। আমার আর মেয়ের ঠিকমতো খোঁজ নেয় না, কথা বলে না। ফোন দিলে নানান অজুহাতে ফোন রেখে দেয়। এভাবে এক বছর পার হয়ে গেল। একদিন সাজিদ বলেই ফেলল, আমি অন্য কাউকে ভালোবাসি আর তাকেই বিয়ে করবো। তোমার যদি সমস্যা হয় তুমি চলে যেতে পারো। সেদিন প্রচুর কান্না করেছিলাম। শাশুড়িকে সবটা খুলে বললাম। শাশুড়ি শুনে বলল, আমার ছেলে যখন তোকে চাচ্ছে না যেহেতু তুই চলে যা। আমি ওদের অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছি কিন্তু কেউ আমার কথা শোনেনি। কিছুতেই বুঝতে পারছি না সাজিদের এমন পরিবর্তন হলো কীভাবে? আমার মেয়েটার কথাও চিন্তা করল না। আজ আমাকে বের করে দিলো। ব্যাগে সামান্য কিছু টাকা ছাড়া কিছুই নেই। নিতুকে সাথে নিয়ে চলে আসলাম। হঠাৎ নিতুর ডাকে হুশ ফিরলো। মেয়েটির হাত ধরে একটি হোটেলে গেলাম। হোটেলের ম্যানেজারকে বললাম, আমাকে একটা কাজ দিবেন? ম্যানেজার বলল, এখানে মেয়েদের রাখা হয় না।
এই কথা শুনে নিতুকে সাথে নিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। পেছন থেকে ম্যানেজার ডেকে বলল, আপনি চাইলে আমার বাসায় কাজ করতে পারেন। রান্নাবান্না আর ছোট্ট মেয়েটিকে দেখাশোনা করবেন। আমি রাজি হয়ে গেলাম। শর্ত দিলো, এদের বাসায় থাকতে দিবে কিন্তু কাজের টাকার অর্ধেক আমাকে দিবে। একটা বছর এই বাসায় কাজ করার পরে একটি গার্মেন্টসে জয়েন করলাম। একটা বাসা ভাড়া নিলাম, নিতুকে স্কুলে ভর্তি করলাম। এখন আপাতত বেশ ভালোই আছি। সাজিদের কথা এখনো মনে পড়ে কিন্তু আগের মত কষ্ট হয়না। মানিয়ে নিয়েছে সবটা। যে আমার কথা ভাবে না আমি তার কথা কেন ভাববো? এটা বলে নিজেকে মিথ্যা সান্ত্বনা দিতাম এখন দেখি এটাই সত্যি। এখন বেশ ভালোই আছি আল্লাহর কাছে হাজার শুকরিয়া আমার এই পরিবর্তনের জন্য। এখন আমার একটাই লক্ষ্য নিতুকে মানুষের মত মানুষ করা।
রাতে নিতুকে পড়ানো শেষ করে বললাম, খাবার টেবিলে যাও আমি আসছি। নিতু চলে গেল। ওর বইগুলো ব্যাগে ভরে পড়ার টেবিলে রেখে দিলাম। রুম থেকে বের হবো এমন সময় ফোন বেজে উঠলো। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলাম অচেনা নাম্বার। ফোন রিসিভ করতেই আমার বুকের ভেতর তোলপাড় শুরু হয়ে গেল। এটা তো সেই চেনা কন্ঠ। এতদিন বাদে সাজিদ কেন ফোন করলো? নিজেকেই প্রশ্ন করলাম। আমাকে চুপ থাকতে দেখে সাজিদ জিজ্ঞেস করলো, কথা বলছো না যে? আমি বললাম, কিছু বলার নেই তাই।
– নিতু কেমন আছে?
– যেমনটি থাকার কথা।
-আমার উপর রেগে আছো তাই না?
– রাগ করার কোনো প্রশ্নই আসে না। বিয়ে করেছেন?
– না।
– কেন?
– সে অন্যজনকে বিয়ে করেছে।
ওর মুখে এই কথা শুনে বেশ অবাক হলাম। যার জন্য আমাকে ছেড়ে দিলো আজ সেই মেয়েই অন্য কারোর। পাশের ঘর থেকে নিতুর ডাক শুনতে পেলাম। ফোনটা রেখে মুচকি হেসে নিতুকে খাবার দিতে চলে গেলাম,,,,,,,!!
গল্পের বিষয়:
গল্প