বান্ধবীদের সাথে ফুচকা খেয়ে বিল দিতে গিয়ে দেখি ব্যাগে টাকা নাই। সারা ব্যাগ তন্নতন্ন করে খুঁজেও টাকা পেলাম না। অথচ এদিকে আমার মাথা কাটা যাওয়ার মত অবস্থা। প্রত্যেকবার বান্ধবীদের সাথে আড্ডা কিংবা ঘুরাঘুরি খাওয়াদাওয়া ইত্যাদি আমি এড়িয়ে চলি। চলি বলতে বাধ্য হই চলতে। কারণ প্রত্যেকবার ওদের কাছ থেকে খাওয়াটাও লজ্জাকর। আর আমিও তো সবাইকে সবসময় খাওয়াতে পারব না তাই ইচ্ছা করে ই এড়িয়ে চলি এই বিষয়গুলো। তবুও পড়ালেখা নোটস গ্রুপ ওয়ার্কের কাজে না চাইলেও অনেক সময় যাওয়া হয়ে যায়। তাই টিউশনির টাকা থেকে কিছুটা বাঁচিয়ে অল্প অল্প করে জমা করে বান্ধবীদের খাওয়াতে নিয়ে আসি।
এই অল্প অল্প করে জমাতেও আমার অনেকদিন লেগে যায়। কোনো রকম জায়গা থেকে উঠে ফুচকাওয়ালা আঙ্কেলের সামনে গেলাম। অন্যদিকে বান্ধবীরা গল্পগুজবে ব্যস্ত। আমি আড়াল করে আঙ্কেলকে বললাম আমি কাল এসে বিল দিয়ে যাব। যেহেতু আমি ওই কাছের কলেজে ই পড়ি সেহেতু একটু চেনা বা পরিচিত মুখ। সবসময় এই রাস্তা দিয়ে আসা যাওয়া আমার। আঙ্কেল ১ম মানা করলেন। আমি আবারো জোর করে বললাম কাল সকাল ১১ টার আগে ই আমি বিল এসে দিয়ে যাব। কিন্তু আমি তখনো জানি না ২৩০ টাকা কাল ১১ টার মধ্যে কোথায় হতে আসবে.! অনেকটা বলে কয়ে রাজি করালাম।
খাওয়া শেষে সবাই যার যার বাসায় ফিরছে। আমিও টেক্সিতে বসে ভাবছি এই ব্যাগে ই তো টাকাটা রেখেছি গেল কোথায়..! টাকার ব্যাগটা আবার হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করে দেখছিলাম। তখনি একটা কাগজ চোখে পড়ল। ভাঁজ খুলতে ই দেখলাম লেখা, আপু.. আজ আমার স্কুলের বেতনের লাস্ট ডেট যদিও আরো আগে ডেইট চলে গেছে আমি আবেদন করে আরেকটু সময় নিয়েছে তোমাকে বলেছিও। হয়ত তোমার মনে নেই বা টাকা ম্যানেজ করতে পারো নি পুরোটা। আমি টিফিন থেকে বাঁচিয়ে টাকা জমিয়েছি অল্প কিছু বাকি।
কিন্তু লজ্জা করে তোমাকে বলতে পারিনি তাই না বলে ই টাকাটা নিয়ে নিলাম। না নিলে আজ ক্লাসে ঢুকতে দেওয়া হবে না আমাকে। জানি কত পরিশ্রম করো তুমি সারাদিন কি করে বলি বল। বলতে পারিনা যে..! লেখাটা পড়ে ই চোখ ঝাপসা হয়ে আসল। সাথে মোবাইলে টুংটাং আওয়াজে চোখ ফিরাতেই দেখলাম এলার্ম দেওয়া আজকের। রিয়াদের বেতনের ডেইট লিখে। খুব খারাপ লাগছিল। নিজের একটু আনন্দের জন্য আমার ভাইয়ের বেতনের কথা ই ভুলে গেলাম। নিজেকে খুব স্বার্থপর মনে হল। এই পিতৃহীন মধ্যবিত্ত পোশাক পড়া ছদ্মবেশী জীবনে আমরা সবাই লজ্জিত।
আমি আমার বান্ধবীদের কাছে লজ্জিত। একটা ভাই তার বোনের কাছে লজ্জিত একজন স্টুডেন্ট তার শিক্ষকের কাছে লজ্জিত। এই লজ্জার শেষ নাই। তবুও দিন শেষে ওই যে পরিবারের কাছে এই ভাইবোনের মধ্যে মন বুঝার যে ‘মায়া-শক্তি’ তা হয়ত অন্যকোথাও মিলে না এই মায়ায় স্বর্গ সুখ থাকে। সৃষ্টিকর্তা আর কিছু না দিলেও এই মায়া এই বন্ধন টা অনেক বেশি করে দিয়ে দেন।
গল্পের বিষয়:
গল্প