ছোটবেলায় খেয়াল করতাম আমাদের পাশের বাড়ির রমজান চাচা প্রায় সময়ই উনাদের বাড়ির পিছনে বসে একটা বাঁশের লাঠিতে তেল দিয়ে মালিশ করতেন। আমি অবাক হয়ে একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম, চাচা লাঠি দিয়ে কি করেন? উনি মুচকি হেসে উত্তর দিয়েছিলো, লাঠি দিয়ে শয়তান মারি। কয়েকদিন পর বুঝতে পারি, সেদিন উনি আমাকে মিথ্যা বলেছিলো। আসলে উনি লাঠি দিয়ে শয়তান মারেন না, উনি লাঠি দিয়ে উনার স্ত্রী আমেনা চাচীকে মারেন। প্রায় সময় দেখতাম রমজান চাচা লাঠি দিয়ে আমেনা চাচীকে দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে মারছে আর আমেনা চাচী “আল্লাহ গো, আল্লাহ গো আমারে বাঁচাও”- এই বলে চিৎকার করছে আর দৌঁড়াচ্ছে ।
বছর দুয়েক পর রমজান চাচা অসুস্থ হয়ে যান। আর এতটাই অসুস্থ হয়ে যান যে উনি আর বিছানা থেকে উঠতেই পারতেন না। বিছানায় মধ্যেই প্রস্রাব পায়খানা করতেন। আমেনা চাচীকে সবসময় দেখতাম, হাসি মুখে স্বামীর প্রস্রাব পায়খানা পরিষ্কার করতেন, স্বামীর সেবা করতেন। আমি খুব অবাক হতাম এই ভেবে, যে মানুষটা উনাকে এত মারতেন, এত কষ্ট দিতেন সেই মানুষটার প্রতি উনি বিন্দু পরিমাণ অবহেলা করে নি। অথচ উনি চাইলেই কত কিছু করতে পারতেন। ২১ বছর বয়সী আমেনা চাচী অসুস্থ চাচাকে ফেলে অন্য একজনকে বিয়ে করতে, অন্য একজনকে নিয়ে সুখে থাকতে পারতেন। কিন্তু উনি সেটা না করে চাচার পিছনেই নিজের জীবনটা কাটিয়ে দিলেন।
মামুন নামের আমার এক বন্ধু ৫ বছর প্রেম করার পর অনেক কষ্টে প্রেমিকাকে বিয়ে করেছিলো। বিয়ের পর সব কিছু ঠিকঠাক চলছিলো। একদিন মামুন ওর স্ত্রীকে নিয়ে বাইকে করে ঘুরতে বের হয়েছিলো। দূর্ভাগ্যবশত মামুন বাইক এক্সিডেন্ট করে। আল্লাহ রহমতে মামুনের কিছু না হলেও ওর স্ত্রীর পায়ের উপর দিয়ে গাড়ির চাকা যাওয়ার কারণে পাগুলো কেটে বাদ দিতে হয়। এক্সিডেন্টের মাস তিনেক পর মামুন আমার অফিসে এসে একটা বিয়ের কার্ড আমার হাতে দেয়। আমি অবাক হয়ে বললাম,
— কার বিয়ের কার্ড? মামুন মুচকি হেসে বললো,
– আমার বিয়ের কার্ড। আমি চমকে গিয়ে বললাম,
— তাহলে ভাবীর কি হবে? মামুন বিরক্ত হয়ে উত্তর দিলো,
– এই পঙ্গু মেয়ের কি হবে আমি কি জানি? ঐ পঙ্গু মেয়ের জন্য তো আমি আমার লাইফ নষ্ট করবো নাকি? আমিও তো একটা মানুষ আমারও তো একটা চাহিদা আছে। ঐ পঙ্গু মেয়ে কি আমার চাহিদা পূরণ করতে পারবে? তাই আমি ওরে ওর বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছি আর ডিভোর্সও দিয়ে দিয়েছি। আমি চেয়েছিলাম দেনমোহরের পুরো টাকাটা ওরে দিয়ে দিতে কিন্তু ও নেয় নি। আমি মুচকি হেসে উত্তর দিলাম,
— তোকে কে বলেছে তুই মানুষ? তুই তো একটা অমানুষ। তুই ভালোবাসার মানে বুঝিস শুধু যৌনতা। তোদের মত পুরুষরা কেন বিয়ে করে জানিস? ওরা বিয়ে করে শুধু স্ত্রীর সাথে আনলিমিটেড ফ্রি সেক্স করার জন্য কারণ পতিতালয়ে গেলে টাকার বিনিময়ে সেক্স করতে হয়।আরে তুইকি পারতি না এইসময় তোর অসুস্থ স্ত্রীর পাশে থাকতে, ওর একটু সেবা করতে? যার হাতটা ধরে এতটা পথ হেঁটে এসেছিস তাকে কোলে করে নিয়ে জীবনের বাকি পথটা হেঁটে যেতে পারতিস না? আর তুই কাকে পঙ্গু মেয়ে বলছিস? বাইকটা কিন্তু তুই চালিয়েছিলি মেয়েটা না। তাই অন্তত একটু মেয়েটা সম্মান করে কথা বলিস। আমার কথা শুনে মামুন চুপচাপ চলে গেলো। আমি ভাবতে লাগলাম দিনশেষে মামুনও হয়তো কোন মেয়েকে বারোভাতারী বলে গালি দিবে আমাদের অফিসের কেশিয়ার ছিলেন রকিবুল হাসান নামের একজন ভদ্রলোক। উনি সবসময় আমায় বলতেন,
-পিয়াস সাহেব, আজীবন যদি সুখে থাকতে চান তাহলে বিয়ে করেন না যেন। বিয়ে করেছেন তো মরেছেন। বউকে সোনা দিয়ে মুড়িয়ে রাখলেও বউয়ের মন পাবেন না। বউয়ের আজ এটা লাগবে, কাল ওটা লাগবে। আমার ছোট শালী যদি একটা আংটি কিনে তাহলে আমার বউকে দুইটা আংটি কিনে দিতে হয়। শালী একটা স্বর্ণের চেইন বানালে আমাকে স্বর্ণের হার কিনে দিতে হয়। কারণ এইগুলো কিনে না দিলে বড় বোন হিসাবে আমার বউয়ের নাকি ইজ্জত থাকে না। শালী ১০ হাজার টাকা দিয়ে কিছু কিনলে আমার বউকে ২০ হাজার টাকা দিয়ে জিনিস কিনে দিতে হয়। খুব বাঁচা বেঁচে গেছেন ভাই বিয়ে না করে। সেদিন দুপুরের খাওয়া শেষে আফিসের ছাদে উঠলাম একটা সিগারেট খাওয়ার জন্য। ছাদে উঠে দেখি রকিবুল সাহেব ছাদের কার্ণিশ ধরে দূরে তাকিয়ে আছে। আমি উনার দিকে একটা সিগারেট বাড়িয়ে দিয়ে মুচকি হেসে বললাম,
— আজকেও ভাবী নতুন কিছু বায়না করেছে নাকি? রকিবুল সাহেব জ্বলন্ত সিগারেটে টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বললো,
– পিয়াস সাহেব, আপনাকে খুব গোপন একটা কথা বলি। আফিসে আমার প্রায় ৩ লাখ টাকার হিসাব মিলছিলো না। এত টাকা গড়মিল দেখলে কোম্পানি আমাকে জেলে পাঠাবে আর চাকরিটাও যাবে। তাছাড়া আমার কাছেও এত টাকা ছিলো না। এই চিন্তায় আমি ঘুম,খাওয়া-দাওয়া সব ছেঁড়ে দিয়েছিলাম । সেদিন রাতে ঘুমাচ্ছিলাম না দেখে আপনার ভাবী খুব জোর করলো আমার কি হয়েছে বলার জন্য। আমিও আপনার ভাবীকে সবটা খুলে বলি। সব শুনে আপনার ভাবী আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো, আমি যেন চিন্তা না করি টাকার ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
আজ সকালে আমার বউ আমার হাতে ৩লাখ টাকা দিলো। আমি জিজ্ঞেস করার আগেই বুঝে গিয়েছিলাম আমার বউ কোথায় এত টাকা পেলো। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
— কিভাবে বুঝেছিলেন? উনি চোখের কোণে জমে থাকা চোখের জলটা মুছে বললো,
– আপনার ভাবীর হাত কান গলা সব খালি ছিলো। ও ওর সমস্ত গহনা বিক্রি করে দিয়েছিলো।
আমি এই মুহুর্তে কি বলবো ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। এমন সময় রকিবুল সাহেব আমার কাঁধে হাত রেখে বললো,
-পিয়াস সাহেব আমি ভুল বলেছিলাম। এই জীবনে একটা বিশ্বস্ত হাতের খুব প্রয়োজন। যে হাত হাজার কঠিন সময়েও আপনার হাত ছেড়ে যাবে না। যার অর্ধেকটা শরীরজুড়ে শুধু আপনি থাকবেন আর আপনার অর্ধেকটা শরীরজুড়ে ও সে থাকবে রকিবুল সাহেব চলে গেলে আমি আরেকটা সিগারেট ধরালাম আর খোলা আকাশে নিকোটিনের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে ভাবতে লাগলাম, আমি কখনো দেখি নি কোন স্ত্রী তার অসুস্থ স্বামীকে রেখে চলে যেতে বরং আমি দেখেছি অসুস্থ স্ত্রীকে ফেলে স্বামী নতুন কাউকে নিয়ে সংসার করতে।
মেয়েরা বারোভাতারী হয়, কালনাগিনী হয়, চরিত্রহীন হয় কিন্তু সেই মেয়েরাই মমতাময়ী হয়,ঘরণী হয়, আত্মত্যাগী হয়। জন্মানোর পর থেকে একটা মেয়ে যে মানুষগুলোকে দেখে বড় হয় সেই মেয়েই বড় হয়ে এই মানুষগুলোকে পর করে সম্পূর্ণ অচেনা অজানা একটা পরিবারকে আপন করে নিতে হয়। এর চেয়ে বড় আত্মত্যাগ হয়তো আর পৃথিবীতে নেই। এতকিছুর পরেও মেয়ে তুমি খারাপ..
গল্পের বিষয়:
গল্প