বাসর রাতে মরিয়মের গালে থাপ্পড় পড়লো। তার স্বামী সোজাসাপটা বলে দিয়েছে সে অন্যজনকে ভালোবাসতো যতদিন না ওই মেয়েকে ভুলতে না পারি ততদিন আমার আশেপাশে ঘুরঘুর করলে থাপ্পড় পাইবা ভসলোবাসা না। দুজন একত্রে থাকতে পারবে না। মেয়েটা বুঝে গেলো যে এক খাটে দু’জনে একত্রে থাকতে পারবে না তাই নিচে বিছানা করে শুয়ে পড়লো। মরিয়ম স্বামী রাসেদ বলে উঠলো,,
– আমি আবারো বলে দিচ্ছি তোমাকে আমি স্ত্রী হিসাবে স্বীকৃতি দিতে পারবো না।
– আপনি যা বলবেন! আপনি আমার স্বামী যেইটা বলবেন সেইটা পালন করব।
– আজ থেকে সবার সামনে নাটক করবা যে তুমি আমার স্ত্রী কিন্তু আলগা পিরিত দেখানোর চেষ্টা করবা না বলে দিলাম।
মরিয়ম মাথা নেড়ে উত্তর দিলো। আর চুপ করে নিচে শুয়ে পড়লো। মরিয়ম ছোট থেকে অনেক কষ্ট নিয়ে বড় হয়েছে। যখন সে ছোট ছিল তখন তার মায়ের উপর খুব অত্যাচার করতো তার নিজের বাবা। শুধু একটা কারনে তা হলো মরিয়ম। কারন তার বাবা মেয়ে পছন্দ করতো না। আর এখন তার স্বামী তাঁকে পছন্দ করে না। তার জীবন টা অপছন্দের মাঝে হারিয়ে গেলো। সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে মরিয়ম রান্নার কাজে চলে গেলো। সকালের নাস্তা তৈরি করে টেবিলে রেখে দিলো। সবাই তৈরি হয়ে নাস্তা করতে আসলো কিন্তু কেউ একটু অবাক হয়ে ও জিজ্ঞেস করলো না তুমি নতুন বউ এইসব কেন করতে গেছো। সবাই নাস্তা করে চলে গেলো কিন্তু কেউ জিজ্ঞেস করলো না মরিয়ম খেয়েছে কি না। মরিয়মের স্বামী মরিয়ম কে ডাকলো….
– তোমাকে কে বলছে সকাল সকাল এইসব করার জন্য?
– সবাই শুয়ে ছিলো তাই ভাবলাম।
– তোমার ভাবনা সব কিছু হবে?
– জ্বি না….
– আমি তোমাকে বিয়ে করে এনেছি শুধু আমার দেখাশোনা করার জন্য এইসব ছাইপাঁশ করার জন্য না। তুমি শুধু আমার কাজের লোক। আর ওইসবের জন্য বুয়া আছে বুয়া করবে।
– জ্বি
– এখন আমার সামনে থেকে যাও।
মরিয়মের স্বামী এইরকম আচরন দেখে মরিয়ম একটু খুশী হলো। আমাকে কোনো কাজ করতে দিবে না হয়তো ধীরে ধীরে আমাকে একদিন অনেক ভালোবাসবে। সারাদিন ঘরে বসে থাকে আর শশুরের খেদমত করে। মরিয়মের শাশুড়ী ৪ বছর আগে মারা যায়। এইভাবে পুরো দিন চলে যায়। রাত যখন হয় তখন মেয়েটার অনিচ্ছায় অনেক কিছু হয়। তার স্বামী প্রতিদিন নেশা করে ঘরে ফিরে। নেশার বাহানায় মেয়েটার উপর অত্যাচার করতো প্রতি রাতে। প্রতিদিনের মতো আজ ও নেশা করে ঘরে ফিরলো। মরিয়ম টেবিলে বসে আছে খাবার নিয়ে,
– আপনি খাবেন না?
– নাহ আমি খেয়ে এসেছি।
– ওহ তাহলে খাবারগুলো ফ্রিজ রেখে দেই?
– এইদিকে আসো… বলে দিয়েছে একবার যে আলগা পিরিত না দেখাতে।
মরিয়ম গালে হাত দিয়ে দাড়িয়ে রইলো। শুধু শুধু আবার থাপ্পড় দিলো ওই পাশ থেকে শশুর সবকিছু শুনতে পাচ্ছে কিন্তু কিছু বলার সাহস নাই। পাশের রুমে তার ছোট ভাই বসে আছে সব কিছু শুনতে পাচ্ছে যদি কিছু বলে তাহলে বাড়ি থেকে বের করে দিবো রাসেদ। রাসেদের মনে একটু মায়া মমতা নাই।
মরিয়ম কে জোর করে টেনে ঘরে নিয়ে গেলো। মরিয়ম কে এক ধাক্কায় বিছানায় ফেলে দিলো। দরজা বন্ধ করে স্বামী হয়ে ও জোর করে মরিয়ম সাথে শারীরিক সম্পর্ক করলো। মরিয়ম চোখ দিয়ে টপাটপ পানি ঝড়ে যাচ্ছে। রাত ঘনিয়ে ভোর হলো সকাল হতে মরিয়ম গোসল করে ফ্রেশ হয়ে গেলো। অবহেলা, অবজ্ঞা প্রতিনিয়ত থাপ্পড় এই নিয়ে চলছে মরিয়মের জীবন এইভাবে পার হয়ে যায় ৬ টা মাস। একদিন সকালে মরিয়মের খুব শরীর খারাপ করে বাসায় শুধু মরিয়মের শশুর ছিলো আর কেউ না। শশুর সাথে সাথে রাসেদ কে কল দিলো কিন্তু সে তার বাবার কল দেখে কেটে দিলো। তারপর ছোট কে কল দিলো,,
– বাবা এই সময় কল দিলা?
– তুই জলদি বাসায় ডাক্তার নিয়ে আস তোর ভাবির শরীর বেশী খারাপ।
– বাবা তুমি ফোন রাখো আমি এখনই আসতেছি।
ছোট কল কেটে জলদি একজন ডাক্তার নিয়ে বাড়িতে চলে আসলো। সোজা তার ভাবির রুমে চলে গেলো। গিয়ে দেখে ভাবি সোজা শুয়ে আছে। ডাক্তার চেক করলো তারপর জিজ্ঞেস করল সকালে কি বমি হয়েছে? মরিয়ম মাথা নিচু করে জবাব দিলো হ্যাঁ। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ডাক্তার বলল খুব খারাপ হয়েছে এই কথা শুনে সবাই স্তব্ধ হয়ে রইলো। পরে ডাক্তার বলল আপনি যে মা হতে যাচ্ছেন তাঁদেরকে বললেন না সেজন্য খুব খারাপ হয়েছে। এই কথা শুনার পর মরিয়ম মলিনভাবে ছোট আর শশুর দিক তাকিয়ে মনমরা হয়ে আছে। ডাক্তার সাহেব বলে উঠলো মিষ্টি থাকলে মিষ্টি খাওয়ান। ডাক্তার সাহেব কে বিদায় দিয়ে ঘরে আসলো ছোট। তিনজন চুপচাপ করে বসে আছে সকাল ঘনিয়ে বিকাল হয়ে আসলো ঠিক তখনই রাসেদ অফিস থেকে বাসায় আসলো। আসার পর পর মরিয়ম চুপ করে আছে বাবা চুপ করে আছে ছোট উঠে গিয়ে রাসেদ কে মিষ্টি দিলো,,
– ভাই মিষ্টি খাও।
– আগে বল কিসের মিষ্টি?
– ভাই তুমি তো বাবা হতে যাচ্ছ।
এই কথা রাসেদ শুনা মাত্র বড় বড় চোখ করে মরিয়ম এর দিক তাকিয়ে রইলো। সবকিছু যেমন মূহুর্তে মধ্যে উল্টা পাল্টা হয়ে গেলো। রাসেদ খুশী তে মরিয়ম কে জড়িয়ে ধরে বলল সরি আমার ভুল হয়ে গেছে আমাকে মাফ করে দেও। মরিয়ম নিজের চোখ কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না সত্যি কি বলছে রাসেদ? উল্লাস করার ক্ষানিক পর রাসেদ বলে উঠলো,,
– মরিয়ম আজ থেকে আমি সবসময় তোমার পাশে থাকবো যা করেছি সব কিছুর জন্য সরি।
– আপনি আমার স্বামী যা ইচ্ছে করতে পারেন এইটা আপনার অধিকার।
– খুব সুন্দর করে কথাটা বলেছ। তবে একটা কথা মনে রেখো যদি তোমার পেটের বাচ্চা ছেলে না হয়ে মেয়ে হয় তাহলে ওই দিন একসাথে দুই টা খুন হবে এক তুমি আর দ্বিতীয় তোমার বাচ্চা।
এই কথা শুনে সবার উল্লাস মূহুর্তের মধ্যে স্তব্ধ হয়ে যায়। মরিয়ম এই কথার শুনার পর তার সামনে পুরো পৃথিবী থমকে যায়। মলিন ভাবে তাকিয়ে রইলো রাসেদের দিক তার একটু ও মায়া হলো না। রাসেদ রুমে ফ্রেশ হতে চলে গেলো। তারা তিন জন একে অপরের দিক অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। চুপচাপ করে রইলো আর সবাই এই দোয়া আর প্রত্যাশা করলো যানি ছেলে হয়। রাসেদ এখন মরিয়মকে অনেক ভালোবাসে কোনো কাজ করতে দেয় না খুব ভালো ভাবে যত্ন নিচ্ছে কারন যেভাবে হোক এইটা রাসেদের ছেলে হতে হবে। যতই দিন গড়াচ্ছে ততই মরিয়ম ভয় পাচ্ছে এইভাবে পার হয়ে গেলো ৯ মাস আজ মরিয়মের ডেলিভারি কি যানি হয়? ছোট এবং শশুর দোয়া করে যাচ্ছে আল্লাহ মেয়েটার উপর রহম করো। আল্লাহ তোমার যা ভালো মনে হয় তাই করো কিন্তু মেয়েটাকে আল্লাহ হেফাজত করো। ডেলিভারি শেষ করে ডাক্তার আসলো রাসেদের কাছে,,
– ডাক্তার সাহেব আমার ছেলে কেমন আছে?
– আপনি জানেন কি করে যে ছেলে হবে?
– আমার ঘরে ছেলে দরকার সেই জন্য ছেলে হবে।
– আপনি একজন শিক্ষিত মানুষ হয়ে কিভাবে এইসব ভাবেন আজকাল মেয়েরা ছেলেদের কে ছাড়িয়ে কতো উন্নত করছে।
একবার কি ভেবে দেখেছেন আমাদের দেশে বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী মেয়ে আরো বড়ো বড়ো পদে মেয়েরা রয়েছে আর আপনি এখনো এতো নিচু মনের হয়ে আছেন। মেয়েরা হচ্ছে মা জাতি আপনি মেয়েদের কে ঘৃণা করেন কিন্তু একবার ভেবে দেখেছেন যে আপনার মা একজন মেয়ে ছিলো। আর সেই কারনে আজ আপনি এতো সুন্দর পৃথিবী দেখতে পারছেন। আর আপনাদের মতো পুরুষদের লজ্জা হওয়া উচিত যারা এখনো মেয়েদেরকে নিয়ে এমন ভাবনা নিয়োজিত। রাসেদ মাথা নিচু করে চোখের জল মাটিতে ফেলে যাচ্ছে। কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল,
– সরি আমি অনেক বড় ভুল করেছি প্লিজ একবার আমার স্ত্রী কে দেখতে চাই।
– সরি স্যার আপনার মেয়েকে জন্ম দিয়ে পৃথিবী ত্যাগ করেছে আপনার স্ত্রী।
রাসেদ আকস্মিকভাবে তাকিয়ে আছে ডাক্তারের দিক। দু পা পিছে সরে বসে পড়লো রাসেদ। চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি বের হচ্ছে। রাসেদ তাৎক্ষণিক উঠে মরিয়মকে দেখতে গেলো। রাসেদ সাদা কাপড় টা সড়িয়ে দেখে কি মায়া মেয়েটার মুখে মলিন করে মুখখানি ঘুমিয়ে আছে। তার পাশে ছোট্ট ফুটফুটে বাচ্চা টা। মরিয়মের কপালে একটা চুমু একে দিয়ে বাচ্চা টা কে কোলে নিয়ে নাম দিলো মারিয়া। দরজার আড়াল থেকে কেঁদে যাচ্ছে ছোট আর রাসেদের বাবা। এই অবহেলিত পৃথিবীতে থাকার চাইতে না থাকাই উত্তম মনে করে হয়তো মরিয়ম সুখে আছে। মরিয়মের মতো হাজারো মেয়ে আছে যারা প্রতিনিয়ত এর স্বীকার হচ্ছে। মুখ ফুটে কিছু বলতে পারছে না ভয়ে। চুপ করে সহ্য করতে করতে একদিন এই স্বার্থপর পৃথিবী ছেড়ে চলে যায়। প্রশ্ন টা আপনাদের কাছে রয়ে গেলো মেয়ে হওয়া টা কি অভিশাপ?
গল্পের বিষয়:
গল্প