জারিনের সংসার

জারিনের সংসার
নিজেকে আজ কাল বড্ড বোঝা মনে হয়। স্ত্রীর ইনকাম ঘরে বসে খেতে কারোরই ভালো লাগার কথা নয়। বেশ কয়েক মাস ধরে আমি ঘরে পড়ে আছি। মাস কয়েক আগে বাইক এক্সিডেন্টে আমার বাম পা প্যারালাইজড হয়ে যায়। ডাক্তার বলেছেন স্পাইনাল কর্ড ইনজুরিতে এই প্যারালাইসিস সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে, পাশাপাশি আরো বেশকিছু জটিলতা রয়েছে। ভালো হতে কতদিন লাগবে কেউ বলতে পারেনি, আদৌ ভালো হবে কি না এমন প্রশ্নেও ডাক্তাররা ছিলেন নির্বাক।
স্বজনদের সবার মুখে সহজ পরামর্শ ছিলো ইন্ডিয়া চলে যাও। যতটা সহজ পরামর্শ ততটাই কঠিন ছিলো তা কার্যকর। দেশের বাইরে যাওয়ার মতন অর্থকড়ি এবং জনবল কোনোটাই আমার সাধ্যের নাগালে ছিলো না। একটি নামীদামী কোম্পানিতে ছোটখাটো চাকুরী করতাম আমি। বাবা অনেক তদবির করে সেই পোস্টে আমাকে ঢোকানোর ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। মাস পেরুলে যা পেতাম মাসের হিসেব মাসেই ফুরিয়ে যেত। ঢাকা শহরে থাকা খাওয়া, বাড়িতে টাকা পাঠানো এসবের পেছনে দিতে দিতে জমানো অর্থের ঝুলির খুব একটা উন্নতি হয়নি।
এরমধ্যেই জারিনের সাথে আমার বিয়ে হয়ে যায়। সম্পূর্ণ পারিবারিক ভাবে এই বিয়ে। বিয়ে করে এক মাস পরেই ঢাকা শহরের ভীরে শুরু হয়ে যায় আমাদের চড়ুই পাখির সংসার। এক ছাদের নিচে দুই মাস ঝলমলে রাত্রি যাপনের পর অমাবস্যার রাতটা যেন ঘনিয়ে এলো, এলোমেলো করে দিলো সাজিয়ে গুছিয়ে তোলা জীবনের ছন্দ। এক পর্যায়ে তদবিরে অর্জিত চাকুরীটাও আমাকে হারাতে হলো। আমি চাকুরীতে বহাল থাকার চেষ্টা করিনি তা কিন্তু নয়। মধ্যবিত্ত ছেলেদের ঘরে বসে থাকতে নেই, এক্সিডেন্টের দু’মাস বাদেই ক্রাচে ভর করে অফিসে যাতায়াত শুরু করেছিলাম৷ সাত দিন অফিস করেছি। অফিসের বস বিরক্তির চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকতেন। কিছু একটা বলতে গিয়েও বলতে পারতেন না। একদিন তারা আমাকে কক্ষে ডেকে নিলেন। আমতাআমতা করে বলতে লাগলেন..
– মিস্টার সাজিদ আমার মনে হয় আপনার রেস্টে থাকা প্রয়োজন, এভাবে যাতায়াত করাটা আপনার জন্য ক্ষতিকর, চাকুরীটা বন্ধ রাখাটাই মনে হচ্ছে ভালো অপশন
– না না স্যার, চলাফেরা কষ্ট হলেও করতে পারি, আমি ম্যানেজ করে নেব
– কিন্তু সাজিদ.. আমরা আসলে চাচ্ছিলাম না আপনি এভাবে যাতায়াত করুন, তাছাড়া আপনি যে পোস্টে আছেন বিভিন্ন বায়ারের সাথে মিটিং করতে হয়, এভাবে আসলে, দুঃখিত আমাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না অনুনয় করে বললাম..
– দেখুন স্যার বুঝতেই পারছেন চাকুরীটা যেন না হারাই এজন্যই মূলত অসুস্থ শরীরেও অফিস চালিয়ে যাচ্ছি, দ্রুতই সুস্থ হয়ে যাবো আশাকরি
– উই আর সরি, এমডি স্যার প্যারালাইসিস সমস্যা শুনে আর দেরি করেনি, সুস্থ হওয়া দীর্ঘদিনের ব্যাপার, তিনি অন্য লোক নিতে বলেছেন, আমরা এর মধ্যে নিয়েও নিয়েছি! কথা শুনে চট করে মাথাটা এলোমেলো হয়ে গেল। আমি এবার রেগে গিয়ে বলে উঠলাম..
– লোক নিয়েই যেহেতু ফেলেছেন তাহলে এত ভণিতা করার কি দরকার আছে? সরাসরি বললেই হয় আপনাকে বের করে দেওয়া হয়েছে
– এভাবে বলবেন না প্লিজ, একটি বছর আমাদের সাথে ছিলেন, কিন্তু আমাদেরই বা কি করার আছে
– জ্বী স্যার একটি বছর গাধার মতো খেটেছি আর আমার বিপদে এখন কলার খোসার ন্যায় ছুড়ে ফেলে দিলেন, চমৎকার! লোক নেওয়ার আগে একটিবার আমার সাথে কথা বলার প্রয়োজন বোধ করলেন না!
স্যার চুপ করে আছে। দীর্ঘ শ্বাস ফেলে আবার বললাম.. “সিদ্ধান্ত যেহেতু ক’দিন আগে নিয়েই ফেলেছেন তবে আমাকে ফোনে বলে দিলেই হতো এভাবে অফিসে ঘুরিয়ে তবে কি আপনারা আমার তামাশা দেখতেছেন!? আরে স্যার এই পা নিয়ে পাবলিক বাসে ঝুলে কতটা ধকল সয়ে অফিস করতে আসি সেটা কি বুঝেন? যদি বুঝতেন তবে এভাবে ডেকে এনে তামাশা করতেন না। ভালো থাকবেন স্যার, আসি” সেদিনই প্রথম স্যারের মুখের উপর উচ্চকণ্ঠে কথা শুনিয়েছিলাম, তিনি চুপ করে শুনে গিয়েছেন। চেয়ার ছেড়ে উঠে যাওয়ার সময় বলেছেন “আপনি সুস্থ হোন, এখানে ব্যবস্থা না হলে আমার বন্ধুর কোনো কোম্পানীতে চেষ্টা করে দেখবো” আমি আর পেছন ফিরে তাদের দিকে তাকাইনি, রুমের দরজাটা ঠাস করে মুখের উপর লাগিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে বাসায় চলে এসেছি।
জারিনকে কিভাবে বলি কথাটা ভেবে কুল পাচ্ছিলাম না। আজ এত দ্রুত অফিস থেকে ফিরেছি কেন এমন প্রশ্নের কোনো জবাব ছিলো না। এমনেতেই জারিনের বাবার বাড়ি থেকে ঝড়তুফান বয়ে যাচ্ছে। সবার কানাঘুঁষা একই কথা বিয়েটা ছাড়াছাড়ি করে নিলেই পারে, মাত্র অল্প দিনের সংসার, এখনি সময় ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়ার, দিন যতই যাবে মায়া ততই বেড়ে যাবে। এভাবে এত সুন্দর মেয়েটা পঙ্গু স্বামী নিয়ে ধুকে ধুকে জীবন কাটাবে তা হতে পারে না। আত্মীয় স্বজনরা আরও কয়েক ডিগ্রি বেশি বলা শুরু করে দিলো।
মেয়েটার কত ভালো বিয়ে হতো, আমার অমুকের তমুক ছেলে ছিলো, অনেক ভালো ভালো সোনার টুকরা ছেলেরা ছিলো কত করে বললাম দিলেন না, দিলেন তো এক গরীব ঘরে যার এখন চিকিৎসা করারো ঠিকমতো সামর্থ নেই। কি এক ঘটকের পাল্লায় পড়ে মেয়ের জীবনটা নষ্ট করে দিলেন। এখনো ছাড়িয়ে এনে মেয়েটাকে বিয়ে দিলে এর থেকেও ভালো জামাই পেয়ে যাবেন। শর্ট ডিভোর্সি ভালো ভালো ছেলে আছে, যদি বলেন তবে আমরা দেখতে পারি। এভাবে কখন কে কি বললো এসব কথা গুলো জারিনের পরিবার কল দিয়ে জারিনকে দিন রাত শুনিয়ে যেত। জারিনের এই ব্যাপারে কোনো বক্তব্য নেই, এক কান দিয়ে শুনে অন্য কানে ঝেড়ে ফেলে দিত৷ কিন্তু আমি আজ চাকুরী হারিয়ে এসেছি এই সংবাদ জানার পর মেয়েটার প্রতিক্রিয়া কেমন হবে খুব ভয়ে ভয়ে ছিলাম। হাত ধুয়ে খেতে বসে বললাম চাকুরীটা আর নেই, তারা এই অবস্থায় আমাকে অফিসে রাখতে চাচ্ছে না। জারিন খাবার বাড়তে গিয়ে দু’সেকেন্ডের জন্য থেমে যায়। এরপর স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে এনে চুপচাপ পাশে খেতে বসে।
একরাশ নিস্তব্ধতা পুরো টেবল জুড়ে ঘিরে ধরেছে, চুপচাপ যে যার যার মতো খাবার খেয়ে যাচ্ছি। খেতে খেতে জারিনকে আবার বললাম.. “জারিন, আমার মনে হয় তোমার বাসা থেকে যা বলছে মন্দ বলেনি, ভেবে দেখতে পারো, এভাবে আর কতদিনই বা চলে…” এটুক বলতেই জারিন অগ্নিমূর্তির ন্যায় ফুঁপিয়ে উঠে.. “তুমিও সেই একই কথা! সারাদিন এসব শুনে শুনে আমি ক্লান্ত আর তুমিও শুরু করছো এখন!” জারিনের কণ্ঠস্বর ভারি হয়ে আসে, রাগে প্লেট ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে খাবার রেখে উঠে যায়, রুমের দরজা বন্ধ করে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগে। কাঁদতে কাঁদতে চিৎকার করে বলতে থাকে.. “থাকলাম না আমি এই সংসারে, আমার ঠেকা পরে নাই বসে বসে তোমার সেবা করার, যার জন্য সবার কথা ফেলে কান বন্ধ করে বসে আছি সেই এখন তাড়াতে চাচ্ছে, ওকে থাকলাম না আমি” এভাবে ঘন্টাখানেক চিল্লাপাল্লা করে ঘর মাথায় তুলে নিল।
সেই রাতে দুজনের খাওয়া দাওয়া একদম বন্ধ। স্ত্রীর বাঁধ ভাঙা কান্নার শব্দেও যে শান্তি লুকিয়ে থাকে সেদিনই প্রথম উপলব্ধি করেছিলাম! আমাকে হারানোর ভয়ে জারিনের কান্না দেখে নিজেকে অনেক সৌভাগ্যবান মনে হচ্ছিলো। মুখে যতই বলি তোমার যেটা ভালো মনে হয় সেটাই করো, আমি আপত্তি করবো না, কিন্তু মনে মনে আমিও তাকে গভীর ভাবে চাইতাম। এই মেয়েটাকে পাশে নিয়ে যেন সারা জীবন কাটাতে পারি নীরবে প্রতিমুহূর্তে দুয়া করে যেতাম। ইচ্ছে করে নিজের আবেগ লুকিয়ে রাখতাম যেন আমার মনের দুর্বলতা জারিনের সিদ্ধান্তে প্রভাব না ফেলে। সে যেন নিজ ভাবনায় সিদ্ধান্ত নিতে পারে৷ সে সেচ্ছায় চলে যেতে চাইলে শত কষ্ট উপেক্ষা করে আমি তার সিদ্ধান্ত হাসিমুখে মেনে নেব।
এক পর্যায়ে আমরা গ্রামে ফিরে যেতে চেয়েছিলাম, জারিন মানা করে দেয়। সেখানে গেলে হাত পা গুটিয়ে বসে থাকতে হবে এরচেয়ে বরং ঢাকা থেকে কিছু করা যায় কি না সেই চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া উচিৎ। বাড়ি ভারা খরচ কমিয়া আনার জন্য আমরা বাসার একটি রুম সাবলেট ভারা দিয়ে দেই। এরপর মাস দুয়েক ঘুরে ঘুরে জারিন নিজের জন্য একটি চাকুরী জুটিয়ে নেয়। পাশাপাশি চাকুরি শেষে ফেরার পথে দুটো টিউশনি চালিয়ে যায়। এভাবে প্রতিদিন ক্লান্ত দেহে মেয়েটা কর্মব্যস্ততা শেষে বাড়ি ফেরে। জারিনের কথা হচ্ছে বাবা মা তাকে পড়াশোনা শিখিয়েছে সেই পড়াশোনা যদি আজ বিপদে কাজে লাগাতে না পারি তবে এতদিনের কষ্টে অর্জিত শিক্ষার মূল্য রইলো কই? জারিন হাল ছাড়তে একদমই নারাজ। তার কথাতে সাহস নিয়ে ঢাকা রয়ে গেলাম। জানিনা আমার সুস্থ হতে আর কতদিন লাগবে, নাকি এভাবেই বছরের পর বছর পেরিয়ে যাবে, কে জানে।
আমি কষ্ট হলেও চলাফেরা করতে পারি, বাম পা ছাড়া বাকি সবকিছুর কর্ম দক্ষতা ঠিকঠাক রয়েছে শুধু চলাফেরাতে সময় একটু বেশি লাগে এই আর কি। আস্তে-ধীরে ঘরের কাজ গুলো নিজে নিজে গুছিয়ে নিতে পারি। জারিনকে রান্নাবান্নায় কাজ এগিয়ে দিতে পারি। আমার ব্যাংক ব্যালেন্স যা কিছু রয়েছে চিকিৎসার খাতে প্রতিনিয়ত ব্যয় হয়ে যাচ্ছে, ব্যালেন্স আর কতদিন পর্যন্ত চলবে নির্দিষ্ট হিসেব নেই, খুব হলে আর কয়েকমাস। এরপর কি হবে জানা নেই। বর্তমানে জারিনের উপার্জনের দিকে চাতক পাখির ন্যায় তাকিয়ে রয়েছে আমাদের এই ঘর সংসার। একা চলতে গিয়ে মেয়েটার অনেক ধকল সইতে হচ্ছে। দুশ্চিন্তা, শঙ্কা, ভয় পদে পদে তাকে বাধাগ্রস্ত করেছে। এর পরেও মেয়েটা থেমে যায়নি। আমি যতটুকু পেরেছি তার পাশে থেকে গিয়েছি। তবুও একা মেয়ের পথচলায় ছোট বড় বিপদ হরহামেশা লেগেই রয়েছে।
সেদিন হঠাৎ জারিনকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হয়ে যাচ্ছে জারিন বাসায় ফিরছে না! সেদিন বাহিরে আবহাওয়া ছিলো জঘন্য টাইপের খারাপ। দিন রাতব্যাপী অবিরত ঝড় বৃষ্টি বইছে। বৈরী আবহাওয়ার সাথে পাল্লা দিয়ে কিছু মানুষের মনগুলোও জঘন্য খারাপ হয়ে যায়। কিছুতেই শান্তি খুঁজে পাচ্ছিলাম না। জারিনের স্টুডেন্টের নাম্বারে কল করলাম শুনি তাদের বাসাতেও যায়নি! অজানা শঙ্কা মাথায় চেপে বসে। হঠাৎ অপরিচিত নাম্বার থেকে জারিনের কণ্ঠস্বর ভেসে আসে। জারিন উৎকণ্ঠা নিয়ে তার অফিস ঠিকানায় আমাকে দ্রুত আসতে বলে। নেটওয়ার্ক খারাপ থাকায় কথা ভেঙে ভেঙে আসছিলো, পুরো কথা ঠিকঠাক বুঝতে পারিনি। জারিন যেহেতু আমাকে যেতে বলছে এরমানে নিশ্চয়ই সে কোনো বিপদে পড়েছে! নয়তো সে কখনোই এভাবে কল করে আসতে বলতো না। আমি বার বার সেই নাম্বারে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে গেলাম কিন্ত কিছুতেই সংযোগ স্থাপন করতে পারলাম না। আমি উন্মাদের মতো ছুটে চললাম জারিনের অফিসের ঠিকানায়।
বাহিরে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। উবারে করে রওনা দেই জারিনের অফিসে। অফিস বিল্ডিং এ পৌঁছে দেখি জারিন নিচে কাছুমাছু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আরও বেশ কিছু মানুষ বৃষ্টির আশ্রয়ে সেখানে জটলা বেঁধে আড্ডা দিচ্ছে। কেউ চা খাচ্ছে, কেউ সিগারেট ফুঁকছে। ঝড়বাদলে রাস্তা একদম ফাঁকা, এলাকায় রিক্সা সি এন জি খুব একটা যাতায়াত নেই। গাড়ির দরজা খুলে জারিনকে ডাকলাম, বৃষ্টির শব্দ ভেদ করে আমার ডাক জারিনের কানে পৌঁছাতে পারলো না, দ্বিতীয় ডাকে জারিন মুখ ঘুরে তাকালো। আমাকে দেখে সে দ্রুত গাড়ির দিকে ছুটে আসে।
গাড়িতে ঢুকেই বলা শুরু করলো চলো এখান থেকে। আমি স্থির চোখে জারিনের দিকে তাকিয়ে রইলাম। “কী হইছে তোমার? কেউ কিছু বলছে? বলো আমাকে??” জারিন কোনো কথা বলছে না, আবার বলে গেলাম.. “বলো তুমি, আমাকে দুর্বল ভাবার কিছু নেই, আল্লাহ এখনো আমার শরীরে যে শক্তি সামর্থ রাখছে যথেষ্ট, না বললে আমি এক চুল নরবো না এখান থেকে, বলো তোমাকে কে কি বলছে?” “আরে বাবা তেমন কিছু হয় নাই তো, তুমি চলো আগে পরে বলতেছি” এই বলে টেনে আমাকে গাড়িতে উঠিয়ে নেয়। এরপর জানতে পারি অফিস মিটিং শেষ হতে আজ একটু বেশিই দেরি হয়ে যায়। এর মাঝে কীভাবে যেন জারিনের মোবাইলটা অফিসরুম থেকে হারিয়ে যায়, কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিলো না। এদিকে বাহিরে আবহাওয়া অনেক খারাপ, থেমে থেমে ঝড় বৃষ্টি হচ্ছে, এভাবে সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত ঘনিয়ে আসে।
এক কলিগ তাকে বার বার রিকুয়েষ্ট করে যাচ্ছিলো আমার সাথে চলুন আপনার বাসার পথেই যাচ্ছি নামিয়ে দিয়ে যাবনি। জারিন রাজি হয়নি৷ কেন যেন তার কাছে সব উলোটপালোট লাগছিলো। বারবার জোড়াজুড়িতে জারিন এক পর্যায়ে তাকে বলে দেয় হাসব্যান্ড নিতে আসবে আমাকে। এর পরেও লোকটা অফিস ছেড়ে যায়নি, তার কথা মোটেও বিশ্বাস করেনি, ভেবেছে অজুহাত দিচ্ছে তাকে। অফিসের অনেকেই ভাবে জারিন অবিবাহিত। সব কর্মীরা চলে গেলেও সেই কলিগ ইচ্ছে করে রয়ে যায়। আশেপাশের পরিবেশ, তার চাহনি কোনো কিছু সুবিধার মনে হচ্ছিলো না। কিছুক্ষণ বাদে বেশ কিছু অচেনা লোকজন আশেপাশে দেখতে পায়, প্রতিমুহূর্তে মনে হচ্ছে সবাই তাকে ফলো করে যাচ্ছে। তৎক্ষণাৎ অফিস ফ্লোর থেকে নেমে সোজা নিচে চলে আসে। এদিকে বাহিরে যাতায়াতের কোনো কিছুই পাওয়া যাচ্ছিলো না। নিস্তব্ধ রাস্তা ধরে একা হেঁটে যাওয়ার সাহসটাও পাচ্ছিলো না।
সে আরো বেশি ঘাবরে যায়। সবকিছু মিলিয়ে মেয়েটা সাংঘাতিক ভয় পেয়েছে। গাড়িতে পুরোটা সময় জুড়ে জারিন আমাকে জড়িয়ে ধরে ছিলো। তার দেহ অনবরত কাঁপছিলো। আমার দেহের উষ্ণতা পেয়ে ধীরে ধীরে মেয়েটা শান্ত হয়ে আসে। জারিনকে আচ্ছামত কথা শুনিয়ে দিলাম.. “তোমাকে কতবার বলছি কোনো কারণে দেরি হলে কিংবা মিটিং থাকলে আমাকে কল দিয়ে আগে থেকে জানাবা, প্রয়োজনে আমি লবিতে বসে থাকবো এরপর একত্রে যাবো, যতই পারবো পারবো করো না কেন বিপদ একটা ঘটে গেলে তখন কি ফিরিয়া আনা যাবে? প্রতিমুহূর্তে সাবধানে থাকা লাগবে। নেক্সট টাইম দেরি হবে বুঝতে পারলে আগে থেকেই আমাকে জানিয়ে দিবা, আমি রিসিভ করে নিয়ে যাবো, মনে যেন থাকে” জারিন শুধু কাঁধে মাথা রেখে হুম হুম করে যাচ্ছিলো। একপর্যায়ে সে ক্লান্ত দেহে আমার কোলে মাথা ঠেকিয়ে শান্তির ঘুমে ডুবে যায়।
চলন্ত গাড়ি ছুটে চলেছে, থেমে থেমে ল্যাম্পপোস্টের হলদে আভা জারিনের মুখ ছুয়ে যাচ্ছে। কী অপূর্ব তার ঘুমকাতুরে ঐ ক্লান্ত দুটি চোখ। শুধু সেদিন নয়, আমি মেয়েটির দিকে প্রায়শই বিস্মিত চোখে তাকিয়ে থাকি। দু’দিনের পরিচয়ের একটি মেয়ে তার সর্বস্ব দিয়ে কিভাবে এই সম্পর্কটা টিকিয়ে রাখতে যুদ্ধ করে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে আমার মাথায় প্রশ্ন চেপে বসে.. অল্পদিনে এতটা ভালবাসায় দুজন ডুবে গেলাম কিভাবে! আমাদের তো বিয়ের পূর্বে কোনো পরিচয় ছিলো না, ছিলো না বছরের পর বছর গড়ে তোলা কোনো নান্দনিক প্রেমের গল্প। একদম সাদাসিধে পারিবারিক ভাবে বিয়ে করে এনেছিলাম তাকে, বিয়ের সম্পর্কটাও গড়িয়েছে মাত্র কয়েক মাস, এর মাঝেই সে আমাকে কতটা আপন করে নিয়েছে, ভাবতে বেশ অবাক লাগে। জারিনকে কাছে পেয়ে একটা জিনিস উপলব্ধি করেছি। বাঙালি মেয়েরা জামাকাপড়ের মতন প্রেমিক পরিবর্তন করলেও স্বামীকে তারা আগলে রাখে সোনার গহনার মতন!
যত সমস্যা শুরু হতে থাকে জারিনের পরিবার থেকে৷ সেই সমস্যা মুহূর্তেই পরিবার থেকে পরিবারে সংক্রামণের মতো ছড়িয়ে পড়ে। শুরু হয়ে যায় একে অপরের উপর কাঁদা ছোড়াছুড়ি। আমার আব্বা আম্মা তাদের কথাবার্তায় এখন বিরক্ত। কল দিয়ে জারিনের পরিবার আমার বাবা মাকে যা তা শুনিয়ে দেয়। আমি নাকি তাদের মেয়েকে ইমোশনাল করে ধরে রেখেছি। আপনার ছেলের স্ত্রীর ভরনপোষণের সামর্থ নেই, ঘরে পড়ে আছে, তাদের মেয়ের ইনকামে চিকিৎসা চালাচ্ছে ইত্যাদি ইত্যাদি। মোট কথা চাকুরিটা হারানোর পর তারা এই বিয়ে ভাঙার জন্য আদাজল খেয়ে নেমেছে। আমার বাবাকে টাকার খোটা দিতেও তারা পিছপা হয়নি।
“বেয়াই সাহেব.. সারাজীবন সরকারি চাকুরী করে কী করলেন? একটামাত্র ছেলে তার চিকিৎসাটাও ঠিকমতো করাতে পারছেন না। আগে জানলে এমন ঘরে কোনদিনও মেয়ে বিয়ে দিতাম না। আমার মেয়েকে কোনদিন অভাবে বড় করিনি, অভাব কি জিনিস সে কখনো চোখেও দেখেনি। সেই মেয়ে এভাবে ঘরে বসা অসুস্থ স্বামী নিয়ে কষ্ট করে যাবে এটা আমরা সহ্য করতে পারবো না। যা হওয়ার হয়ে গেছে, মাত্র কয়েক মাসের ব্যাপার, এবার ছেলেকে একটু বুঝিয়ে ব্যবস্থা একটা করে ফেলুন, দুশ্চিন্তার কিছু নাই আপনাদের কাবিনের টাকা দেওয়া লাগবে না, শুধু আমাদের মেয়েটারে মুক্তি দেন। আর যদি আপনার ছেলে মনে মনে ভেবে থাকে শ্বশুর বাড়ির সম্পদে ভবিষ্যৎ পারি দেবে! তবে কিন্তু ভালো হবে না বলে দিলাম।
আব্বা তখন রেগে গিয়ে বলে উঠেন.. “বেয়াই সাহেব, বলতে বলতে এবার কি একটু বেশিই হয়ে যাচ্ছে না? আমার ছেলে কি আপনার কাছে দুই পয়সা চেয়েছে?” শ্বশুর আব্বা উত্তর দেন.. “তা চায়নি, বিয়ে করেছে ছেলে হীন পরিবারে, এতকিছু কি আর মুখ ফোটে চাওয়া লাগে নাকি! সময়ে সব দিয়ে দেয়, রাজনীতি করে করে চুল পাকিয়েছি এসব বুঝার কি আর বাকি আছে নাকি!” আব্বা বললেন.. “ভাই আপনার রাজনীতি আপনার নীতিতেই রাখেন, আমরা হইলাম গণ্ডমূর্খ মানুষ, সারাজীবন সরকারি চাকরগিরি করে এসেছি এসব রাজগিরির ভাবনা আমাদের নাই। যা যা বললেন ছেলেকে আমি বুঝিয়ে বলবো, প্রয়োজন নেই আপনাদের মেয়েকে রাখার। এরপর ভালোমন্দ তারাই ভেবে দেখবে।
আর হ্যা ভাই শুনুন, কাবিনের টাকা মাফ করার জিনিস না, আপনার মেয়ের প্রাপ্য জিনিস, ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলে প্রয়োজনে ভিটা বিক্রি করে হলেও শুধরে দেব এ নিয়ে আমাদের কোনো আপত্তি থাকবে না” আব্বা সেই রাতে এসব কথাগুলো আমাকে বলতে বলতে ক্রন্দনরত কণ্ঠে বলে উঠলেন.. “বাপ রে.. ভুল জায়গায় সম্মন্ধ কইরা ফালাইছি, আমার শিক্ষকতার জীবনে কেউ আমারে কোনোদিন এত ছোট করে নাই। যাই হোক তোদের সংসার, বৌমার সাথে বোঝাপড়া করে দেখ, যেতে চাইলে ছেড়ে দে, কারো জীবন কারো জন্যে থেমে থাকে না” বাবাদের কান্নার শব্দে ছেলেরা চাইলেও আবেগ লুকাতে পারে না। আমার দুচোখ বেয়ে গড়গড়িয়ে বারিধারা বয়ে যায়। কতটা কষ্ট পেলে আমার আব্বার মতো শক্ত মানুষটা এভাবে চোখের পানি ফেলতে পারে তা অনুমান করতেই দম আটকে আসছিলো। জারিন আমার পাশেই ছিলো, কি নিয়ে আব্বার সাথে কথা হচ্ছিলো বুঝতে তার বাকি নেই। দুই পরিবারে কেমন ঝড় বয়ে যাচ্ছে জারিনের সবটাই জানা।
নতুন করে তাকে জানানোর কিছু নেই। জারিন সেই রাতে আমার হাতে হাত রেখে অনুরোধ করে বললো.. “আমি যদি কোনো ভুল করে বসি আমাকে ক্ষমা করে দিবে?” আমি প্রশ্নটা বুঝেও বুঝে উঠতে পারিনি। প্রশ্ন চোখে নিয়ে তাকিয়ে রইলাম। মেয়েটা বলে উঠলো.. “মানে আমি যদি একা কোনো সিদ্ধান্তে চলে যাই…” এটুক বলতেই জারিনকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, তোমার যেকোনো সিদ্ধান্তকে আমি সাধুবাদ জানাই, তুমি যাই করো আমি বিন্দুমাত্র মন খারাপ করবো না। জারিন আমাকে আর কিছু বলে না, আমিও আর জিজ্ঞেস করার সাহস পাইনি৷ জারিন যা বলতে চাচ্ছে নিজের মতো করে অনুমান করে নিলাম। ডিভোর্স সংক্রান্ত কথাবার্তা জারিনের মুখ থেকে শুনার সাহস হচ্ছিলো না। এরচেয়ে বরং চুপচাপ থাকি, মেয়েটা যা ভালো মনে করে সিদ্ধান্ত নিতে চায় নিয়ে নিক।
এরপর প্রায় দুই তিন সপ্তাহ পার হয়ে যায়। জারিনের ভেতর বেশ কিছু পরিবর্তন দেখতে পাই৷ মেয়েটা আগের মতো আর মন খুলে আমার সাথে কথা বলে না। সব সময় মন মরা হয়ে বসে থাকে৷ তার আচরণে বেশ পরিবর্তন লক্ষণীয়। জারিন ইদানিং তার পরিবারের সাথে কথাবার্তা বাড়িয়ে দেয়। যে মেয়েটা কোনোদিন আমাকে জিজ্ঞেস করেনি আমার চাকুরীর বেতন কত ছিলো, সেই মেয়েটা হুটকরে ইদানিং আমার সম্পত্তির হিসেব চাইছে। কোথায় কোথায় জায়গা জমি আছে সেগুলোর বাজার মূল্য কত, ব্যাংকে আর কত টাকা জমা আছে এসব এলোমেলো সব প্রশ্ন। আমি পাল্টা প্রশ্ন না করে যা যা সত্য সব বলে দিতাম।
হঠাৎ মেয়েটা একদিন আমাকে না বলে কাকডাকা ভোরে বাহিরে বেরিয়ে যায়। বেশ বেলা করা বাসায় ফিরে আসে। তার দু’হাত ভর্তি বাজার। এত বাজারঘাটের রহস্য কি জানতে চাইলে উত্তর আসে কাল তার কাজিন আসবে তাকে নিতে। সে বাবার বাড়ি যেতে চাচ্ছে! বহুদিন ধরে যাওয়া হয়না, মনটা নাকি তার খুব বাড়ির দিকে টানছে। বাবা বাড়ি যেতেই পারে কিন্তু এভাবে হুটহাট না জানিয়ে চলে যাওয়াটা মোটেও স্বাভাবিক লাগছিলো না। আমাদের সংসার ভাঙনের অধ্যায় শুরু হওয়ার পর থেকে এই পর্যন্ত জারিনকে হাজার বলেও কেউ তাকে বাবার বাড়ি পাঠাতে পারেনি, সে জানে এই মুহূর্তে সেখানে গেলে তারা আর তাকে ফিরতে দেবে না।
যেভাবেই হোক ব্রেইন ওয়াশ করে প্রয়োজনে ধরে বেঁধে তাকে রেখে দিবে। সেই মেয়েটাই এখন হুটকরে বাড়ি যেতে চাচ্ছে! কঠিন সিদ্ধান্ত এবার বোধহয় নিয়েই ফেলেছে। শেষ পর্যন্ত আমি কি তাহলে জারিনকে সত্যি সত্যি হারাতে বসেছি! জারিন সেদিন আমার প্রিয় প্রিয় আইটেম গুলো রান্না করে খায়িয়েছে। এক এক করে ঘরের সবকিছু পরিপাটি করে গুছিয়ে রাখছে। ডাক্তারের নির্দেশনা গুলো পূণরায় বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছে, আমি যেন ঠিক ভাবে থাকি, ঠিকমতো ওষুধ খাই, নিয়মিত ব্যায়াম গুলো চালিয়ে যাই। আমি শুধু হাসিমুখে তার সঙ্গ দিয়ে যাচ্ছি। “কবে ফিরবে তুমি? নাকি আমাকে ফাঁকি দিয়ে চলে যাচ্ছো?” প্রশ্নগুলো করতে গিয়েও সাহস পাচ্ছিলাম না।
সন্ধ্যা বেলায় জারিন আমার পাশে মাথা নিচু করে বসে আছে। নীরবতা ভেঙে সে নিজ থেকেই এবার বলে উঠলো.. “তোমাকে কিছুদিন আগে বলেছিলাম না? আমি কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছি? পরিস্থিতি ভেবে চিন্তে আমি সেই সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেলেছি, (আমতা-আমতা করে বলছে) আসলে পারিপার্শ্বিক সবার কথা ভেবে বাধ্য হয়ে ভুলটা” এটুকু বলতেই আমি জারিনকে থামিয়ে দিয়ে বললাম.. “প্লিজ, বার বার ভুল শব্দটা উচ্চারণ করবা না, তুমি এই পর্যন্ত যা যা করছো যতটুকু করছো যথেষ্ট, আমি যেকোনো সিদ্ধান্তে তোমার পাশে আছি, আমিও চাই সবাই ভালো থাকুক” নিজেকে স্বাভাবিক দেখাতে মেকি হাসি দিয়ে বললাম আমি একটু আসছি ওয়াশরুম থেকে” এই বলে ওয়াশরুম ঢুকে যাই।
বেসিনের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নীরব চিৎকারে কান্নায় ভেঙে পড়ি। মনে হচ্ছিলো রুমের চার দেয়াল ক্রমশ আমার দিকে এগিয়ে আসছে, আমার দুনিয়াটা ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হয়ে যাচ্ছে, কিছুক্ষণের মধ্যে আমি দেয়াল চাপায় দম আটকে মারা যাবো। মাথাটা উঁচিয়ে আয়নাতে অবেলায় হেরে যাওয়া এক পঙ্গুকে দেখতে পাই, যার শুধু পা নয় আজ থেকে হৃদয়টাও পঙ্গু হয়ে গেলো। প্রচণ্ড ক্ষোভে অবস পা টা ভেঙে ফেলতে ইচ্ছে করছিলো। দুবার দেয়ালে লাথি মারার বৃথা চেষ্টা চালাই, কোনো লাভ হয়নি.. এক ইঞ্চি নাড়ানোর ক্ষমতাও যে আমার নেই!
চোখে মুখে পানি দিয়ে রুমে ফিরে আসি৷ দেখি বিছানার উপর মেডিসিন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। পাশে ডাক্তারের ফাইল পড়ে আছে। জারিন আমার হাতে প্রেসক্রিপশন ফাইল তুলে দিয়ে বললো, ডাক্তার কিছু নতুন মেডিসিন এড করে দিয়েছে এগুলো ঠিকঠাক ভাবে বুঝে নাও। আমি ফাইল খুলে প্রেসক্রিপশনে তাকিয়ে স্ট্যাচু হয়ে গেলাম। প্রেসক্রিপশনে রোগীর নাম লিখা রয়েছে জারিয়া তাবাসসুম জারিন! হুমরি খেয়ে অপর পৃষ্ঠায় চোখ বুলাতে লাগলাম, বিস্তারিত পড়তেই হাত ফসকে ফাইলটা নিচে পড়ে গেলো। কি সাংঘাতিক কারবার! সেখানে স্পষ্ট হরফে লিখা রয়েছে জারিন প্রেগন্যান্ট! এসব কি! আমি হা করে তাকিয়ে আছি। জারিনের ঠোঁটের কোণে সুপ্ত হাসি উঁকি দিচ্ছে। অস্পষ্ট ভাঙা কণ্ঠে বলছে.. “কি ভাবছিলে তুমি? এত সহজেই ছেড়ে যাবো? লুকিয়ে কেঁদে কেঁদে চোখটাতো ফুলিয়ে ফেলছো! ভাবছো আমি কিছুই বুঝি না? আমার সামনে কাঁদলে কি হয়, হ্যাঁ? সেদিন বলেছিলাম না একা একা সিদ্ধান্ত একটা নিয়েই ফেলবো।
এটা ছাড়া আমি আর কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছিলাম না। সারাদিন একেক জনের মুখে ছাড়াছাড়ি ডিভোর্স এসব শুনে শুনে আমি অতিষ্ঠ হয়ে গেছি। আমার পরিবার আত্মীয়স্বজনরা একেকটা যা চিজ তোমার কোনো ধারণাই নেই। আমি বাবা বাড়ি এমনি এমনি তো যাচ্ছি না, সংসারের শিকলটা বেঁধে রেখেই যাচ্ছি। এবার আসুক একেকজন আমাকে জ্ঞান দিতে, যেই প্যানপ্যান করতে আসবে সবার মুখে একটা করে মিষ্টি ঢুকিয়ে চিৎকার দিয়ে বলবো “নতুন অতিথি আসতেছে! আর কিছু বলবেন?” হা হা আইডিয়াটা দারুণ না? খুশিতে আমার আওয়াজ বন্ধ হয়ে আছে। জারিনের হাত দুটো শক্ত করে ধরে ক্রাচ বিহীন দাঁড়িয়ে আছি। খুশির মাঝেও সংশয় নিয়ে বললাম “কিন্তু এই সময়ে এমন সিদ্ধান্ত! আমরা নিজেরাই চলতে হিমসিম খেয়ে যাচ্ছি এরমধ্যে বেবি!”
“তুমি না বেশি বেশি চিন্তা করো, আচ্ছা এত হিসেব করে কি হয় বলোতো? তুমি কি বিয়ের সময় ভেবে রাখছিলা এভাবে ঘরে বসে থাকবা? সবকিছু এত হিসেব করে চলে না। সংসারটা টেকানো সবার আগে প্রয়োজন। তাছাড়া আমি তো একটা জব এ আছি, এখানে গর্ভকালীন ছুটি আছে, নারীদের নিয়ে তারা কাজ করে, চাকরি হারানোর ভয় নেই, নিয়মিত বেতন পেয়ে যাবো, পাশাপাশি প্রাইভেট পড়াচ্ছি। আরেকটু সুস্থ হলে তুমিও কিছু না কিছু করতে পারবে। তাছাড়া একটা বাচ্চা পালতে কি পাহাড় সমান টাকা লাগে নাকি! চিন্তা করা বাদ দেও এবার। দেইখো তুমিও কয়দিন পর ঠিক হয়ে যাবা। তখন আর এত কষ্ট করা লাগবে না। উপর ওয়ালা বিপদ দিছে তিনিই সব ঠিক করে দিবেন। জারিনের কথা গুলো সবসময় হয়ে থাকে স্ফটিকের ন্যায় স্বচ্ছ। তার মাঝে হায় হায় করার স্বভাব একদমই নেই। বিপদে সে থমকে যায়, ভয় পেয়ে ঘাবড়ে যায় অথচ সুস্থির ভাবনাশক্তি দিয়ে রাস্তা একটা না একটা ঠিকই বের করে নেয়। জারিন কাল বাড়ি যাচ্ছে, সবাইকে এবার মুখের উপর জবাব দিয়ে তবেই নাকি ঘরে ফিরবে। জারিন সবাইকে ম্যানেজ করে ঘরে ফিরবে আমিও এমন আশায় বুক বেঁধে অপেক্ষায় আছি…।
জারিনের বাসা ত্যাগের চারদিন পার হয়ে যায় সে একটিবারের জন্যেও আমাকে কল দেয়নি। বাড়ি গিয়ে ঠিকঠাক পৌঁছেছে সেই খবরটাও শুনতে হয়েছে তার কাজিনের মুখ থেকে। জারিনের মোবাইল খোলা পাইনি। শ্বশুর শাশুড়ির নাম্বারে কল দিলেও তারা আমার ফোন রিসিভ করছে না। তারা কি জারিনকে আটকে রেখেছে! কিন্তু রেখেই বা লাভ কি? জারিনের গর্ভে আমার সন্তান, ছাড়াছাড়ি কি এতই সহজ বিষয়? তবে মেয়েটা কেন যোগাযোগ করছে না? যতই বিপদে থাকুক আমার নাম্বারে অন্তত কল করে সে জানাবে। কয়দিন পর বাড়ি থেকে বাবার কল আসে। বাবা আমাকে সামনের রবিবার বাড়ি যেতে বলে। আমাকে নিয়ে তারা জারিনদের বাসায় যাবে। কারণ কি জানতে চাইলে উত্তর আসে বেয়াই সায়েব ঘরোয়া মিটিং ডাকছে, তোর আর বৌমার মীমাংসা করে দিবে। আমি অবাক হয়ে বললাম কিসের মীমাংসা? আমরা তো এমন কোনো ডিসিশনে যায়নি। এরপর বাবা যা বললেন তা শোনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। জারিন নাকি আমার নামে নারী নির্যাতনের মামলা করেছে! আজ সকালে নাকি বাড়িতে পুলিশ ঘুরে গিয়েছে! আব্বা তুমি এগুলা কি বলতেছ??
হ রে বাপ, এরা মানুষ ভালা না রে, বেয়াইয়ের সাথে কথা বলছি অযথা কোর্টকাছারির ভেজালে যাওয়ার দরকার নাই আমরাই মীমাংসা করে ফেলি। তিনি রোববারে তোরে নিয়া তাগো বাসায় যাইতে কইছে। বাপ রে, পাগলামি করিস না, আমিতো বুঝি তুই কি চাস। কিন্তু আব্বা এটা কেমনে সম্ভব…! বাবাকে জারিনের প্রেগন্যান্সির ব্যাপারে কিছু বললাম না, সব থেকে ভালো হয় জারিনের সাথে যেভাবেই হোক কথা বলা। আমি বাবাকে বললাম আমি আসবো তার আগে একবার জারিনের সাথে আমার কথা বলার ব্যবস্থা করে দাও, সে যেতে বললে অবশ্যই আমি যাবো। বাবা বললেন.. “আচ্ছা দেখি তাদের সাথে কথা বলে” বাবা কল রাখার আধাঘন্টার মধ্যে জারিনের কল আসে৷ কল রিসিভ করে একের পর এক প্রশ্ন করে গেলাম..
– কেমন আছো? কি হচ্ছে এসব? স্থির কণ্ঠে উত্তর আসে..
– ভালো আছি
– কি শুনতেছি এগুলা?
– যা শুনার শুনেই নিয়েছো, নতুন করে বলার কিছু নেই। রবিবারে চলে এসো
– কিন্তু কেন..??
– আমি এত কথা বলতে পারবো না, তুমি তোমার ফ্যামিলি নিয়ে চলে এসো
– আচ্ছা আমি আসবো, কিন্তু তোমার মোবাইল বন্ধ করে রাখছো কেন?
– আমি কয়েকদিন অসুস্থ ছিলাম, মোবাইল সাথে রাখিনি
– অসুস্থ! কেন কি হইছে তোমার? ঠিক আছো তুমি?
উত্তর না দিয়ে আবার বললো “রবিবার চলে এসো” আমার ভেতরে টর্নেডো শুরু হয়ে যায়, নিজেকে স্থির রাখতে পারছি না। উৎকণ্ঠা নিয়ে জারিনকে আবার প্রশ্ন করলাম “আমার বাচ্চা মানে আমাদের বেবি ঠিক আছে? ওর কোনো সমস্যা হয়নি তো?” জারিন চুপ করে আছে! “অ্যাই মেয়ে চুপ করে আছো কেন?? উত্তর দিচ্ছ না কেন? বলো.. ঠিক আছে সব?”
জারিনের গলা চেপে আসে, উপচে আসা কান্নাগুলো ঢোক গিলে থামিয়ে রাখে। প্রশ্ন এড়িয়ে সেই একই কথা বলে কলটা কেটে দেয়, “রবিবারে বাসায় এসো, রাখলাম” আমি নিশ্চিত ভাবে বুঝে যাই অনেক বড় কোনো ষড়যন্ত্র চলছে। জারিনকে দিয়ে তারা পুলিশ কেস এসব জোর করে করাচ্ছে৷ তাকে বাধ্য করানো হচ্ছে। যত কিছুই হয়ে যাক আমাদের বাচ্চার যদি কোনো ক্ষতি হয়ে থাকে, আর এক বিন্দুও ছাড় দেব না। কোনোরকম বড় ছোট মান্য করবো না, বাজে কিছু একটা ঘটে যাবে। দুই দিন নির্ঘুম রাত কাটালাম। যে বাচ্চার স্পর্শ পেলাম না, যার হৃদস্পন্দন অনুভব করলাম না অথচ তার জন্য কি অদ্ভুত মায়াটানে মনটা ছটফট করছে। ক্ষণে ক্ষণে দুশ্চিন্তা ধেয়ে বেড়াচ্ছে। রক্তের টান বোধহয় একেই বলে। কি হবে, কি হতে যাচ্ছে রবিবার এলেই তা বুঝা যাবে। শনিবার সকালে ডাক্তার পরিচয়ে এক ভদ্র মহিলা আমাকে কল দিয়ে বললেন “আপনি কি জারিনের হাসব্যান্ড বলছেন?” স্বীকারোক্তি দিতেই ফোনটা জারিনের হাতে চলে যায়। তার কণ্ঠে চঞ্চলতায় ভরপুর। ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করার সময় নেই, সরাসরি বলছে…
– কোথায় তুমি এখন?
– বাসাতেই
– তুমি দ্রুত এখনি আমার অফিসে যাও, নাসরিন নামের এক ম্যাডাম আছেন যেভাবেই হোক তার সাথে আমার যোগাযোগ করিয়ে দাও। আমি ডাক্তারের চেম্বারে আছি। হাতে সময় নেই খুব হলে ঘন্টাখানেক থাকতে পারবো।
– তাকে দিয়ে কি হবে? আচ্ছা আমাকে খুলে বলবে কি হচ্ছে ওইখানে? আমাদের বেবি ঠিক আছে?
– তুমি রেডি হয়ে আগে বের হও, যেতে যেতে শোনা যাবে, আমি বেশিক্ষণ থাকতে পারব না
– না, আগে তুমি বলো আমাদের বেবি ঠিক আছে কি না??
– আরে হ্যাঁ, বেবি ঠিক আছে, আমি থাকতে ওর কিছু হতে দিব নাকি! সেদিন ফোন লাউড স্পিকারে ছিলো, মুখ খুলে সব কিছু বলতে পারিনি।
কথাটা শুনে মনে হলো কেউ এইমাত্র আমার উপর এক বালতি বরফ ঢেলে দিল! এই শান্তির খবর শুনে দুদিনের নির্ঘুমের ক্লান্তি এক মুহূর্তেই ভ্যানিশ হয়ে গেল। দেরি না করে জারিনের কথা মতো দ্রুত তার অফিসের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে গেলাম। যেতে যেতে কথা বলে জানতে পারলাম এই কয়দিনে ঘটে যাওয়া সব তিক্ত ঘটনা। জারিনের পরিবার তাকে বাধ্য করে এই বিয়ে ভেঙে ফেলতে। অন্তঃসত্ত্বা শুনেও দুই সেকেন্ডও তারা ভেবে দেখে না, মুহূর্তেই সিদ্ধান্ত দিয়ে দেয় অ্যাবোরশন করিয়ে ফেলার। আত্মীয়স্বজন প্রতিবেশী আর কোত্থাও যেন এই খবর জানাজানি না হয় কড়া ভাবে তার বাবা নির্দেশ দিয়ে দেন। জারিনের সেখানে দ্বিতীয় কোনো কথা বলার সুযোগই নেই। মেয়ে যেন তাদের কাঠের পুতুল। জারিন বড় হয়ে উঠেছে তার বাবাকে বাঘের মতন ভয় পেয়ে, বিয়েও করেছে বাবার কথাতেই, এখন বিয়েও ছাড়তে হবে তার হুকুমেই! জারিনকে বড় করে তুলেছে হুকুমের দাসী বানিয়ে। তার বাবার আর এখন অধিকার নেই মেয়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে দেওয়ার কিন্তু এই সত্যটা তিনি মানতে নারাজ।
জারিন মুখফোটে প্রতিবাদ করতে গিয়ে আরও হিতে বিপরীত ঘটে যায়। তার বাবা সোজাসাপটা বলে দেয় ঐ ছেলে নিয়ে ঘর করলে কোনোদিন আমাদেরকে বাপ মা বলে পরিচয় দিতে পারবি না, ত্যাজ্য করে দিব, এরপর খোঁড়ারেও আমি দেইখা নিব তার ক্ষমতা কত দূর! জারিন তার বাবার সাথে তর্ক চালিয়ে যায়। জারিনের মা তার গালে থাপ্পড় বসিয়ে বলে “বেয়াদব মেয়ে! বাপের মুখের উপরে কথা বলিস!” জারিনও তার মাকে তৎক্ষণাৎ উত্তর দিয়ে দেয়.. “কেন মা? তোমার স্বামীকে কথা শোনাচ্ছি বলে তোমার গায়ে লাগছে? আর আমার স্বামীকে কানা খোঁড়া যা তা বলে যাইতেছে আমার গায়ে লাগে না?” “দেখছো কি মুখপোড়া মাইয়া! এরে বলে আমি পেটে ধরছি! ছিঃ” “হ মা, এরেই পেটে ধরছো আর পেটে ধরার অধিকার দেখাইয়া এখন তার পেটের বাচ্চারেও মারতে চাইতেছো। আমি বুঝি না তোমাদের হিসাব নিকাশ, আমিকি পালাইয়া বিয়ে করছি? নাকি মতের বাইরে বিয়ে করছি? বিয়ে তো তোমরাই দিছ, এখন এত কথা কিসের? আমার ভাগ্যে এটাই ছিল, আমি তো সুখে আছি.. তোমাদের সমস্যা কই?”
জারিনের ফুফু জারিনের ঝগড়া থামিয়ে তাকে আলাদা রুমে নিয়ে যায়। মাথা হাতিয়ে জারিনকে বুঝায়.. “তোর বাপ রাগী মানুষ, অযথা তর্ক করিস না, বাপ মা সন্তানের খারাপ চায় না, ভবিষ্যৎ নিয়া ভেবে দেখ, অনেক ভালো থাকবি তুই, আমাগো সুমন কি খারাপ পোলা নাকি? তোরে সে এখনো চায়, বিয়ে করে আমেরিকা চইলা যাবি, শান্তিতে থাকবি” কথা শুনে জারিনের মেজাজ বিগড়ে যায়, বুঝতে পারে আসল কলকাঠি তাহলে ফুফুই নাড়তেছে! তার বুইড়া ছেলের সাথে বিয়ে দেওয়ার জন্যে উনিই এই পরিবারের মাথা নষ্ট করতেছে! নিজেকে কন্ট্রোলে রেখে চুপ মেরে থাকে। এই প্যাচ থেকে বের হতে হলে খুব কৌশলে পদক্ষেপ নিতে হবে। জারিন চাইলে পালিয়ে আসতে পারতো কিন্তু সে তার বাবাকে ভরসা পায় না, তাকে খেপিয়ে তুললে পরিনতি কি কি হতে পারে খুব ভালো করেই সে জানে, তাই দ্বিতীয় কোনো তর্কে না গিয়ে চুপ করে থাকে। তাল মিলিয়ে চলে সুযোগের অপেক্ষায়।
জারিনকে তার ফুফু নানান কথা বুঝিয়ে হসপিটালে নিয়ে যায়। সেখানে গিয়েই জারিন ডাক্তারকে আড়ালে তার সমস্ত ঘটনা খুলে বলে। অনেক অনুরোধ করে তার কাছে সাহায্য কামনা করে। এরপর ডাক্তার তার ফুফুকে বিভিন্ন জটিলতার অজুহাত দেখিয়ে অ্যাবরশনের তারিখ পিছিয়ে দেয়। ডাক্তার সরাসরি এর প্রতিবাদ করে অযথা রাজনীতির প্যাচে জড়াতে চায় না, কিন্তু নীরবে যতটুকু সাহায্য করা যায় তিনি তা নিয়মিত করে যান। জারিন তার চেম্বারে চেকআপের অজুহাতে এসে বসে বসে তার সাথে পরিকল্পনা করে যায়। জারিন সিদ্ধান্ত নেয় তার অফিস ম্যাডামের সাহায্য নিবে, তারা নারীদের নিয়েই কাজ করে। একমাত্র তারাই সাহসী পদক্ষেপ নিতে পারবে এবং তাদের অভিজ্ঞতা থেকে নিরাপদ উপায়টা বলে দিতে পারবে।
আমি অফিসে পৌঁছে নাসরিন ম্যামকে খুঁজে বের করলাম। বয়সে উনি আমার থেকে অনেক বড়। শাড়ি পরা মধ্যবয়সী মহিলা এসি রুমে একা বসে আছেন। উনি এই অফিস ব্রাঞ্চের ইনচার্জে আছেন। তার সাথে জারিনকে কথা বলিয়ে দেই। তারা দুজন দীর্ঘক্ষণ আলোচনা করে। আলাপচারিতা শেষে ম্যাডাম আমাকে বললেন.. “কাল রবিবার সকালে আমি জারিনদের বাসায় যাচ্ছি, আপনারাও উপস্থিত থাকবেন। কোনো সমস্যা নেই আপনি আপনার বাবা মার সাথে স্বাভাবিক ভাবেই যাবেন, আমরা তার কিছুক্ষণ পর বাড়িতে ঢুকবো, জারিনের পক্ষ হয়ে কথা বলবো। যা করা লাগে, যা বলা লাগে আমরাই দেখে নেব, ঘাবড়ানো কিছু নেই। সব ঠিক হয়ে যাবে। যত বড় প্রভাবশালী লোক হোক না কেন, কার দুর্বলতা কোথায় আমাদের খুব ভালো করেই জানা আছে।”
সেদিন রাতেই আমি আমার বাড়ি চলে আসি। পরেরদিন সকালে বাবা মা ও বড় চাচাকে নিয়ে জারিনদের বাসায় ঘরোয়া মিটিং এ যোগ দেই। জারিনদের পরিবার ধরেই নিয়েছে আজকেই ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবে। আলোচনার এক পর্যায়ে নাসরিন ম্যাম দুজন লোক নিয়ে বাসায় চলে আসেন। পরিচয় জানতে চাইলে বলেন.. “আমরা জারিনের অফিস থেকে এসেছি জারিনের বিষয়ে কিছু আলোচনা করতে” জারিনের বাবা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বলেন.. “এটা আমাদের পারিবারিক বিষয় এখানে আপনাদের নাক গলানোর কিছু নেই, আমাদের মীমাংসা আমাদেরকে করতে দিন” ম্যাডাম উত্তর দিলেন.. “আপনারাদের যেমন অধিকার আছে আপনার মেয়ের সমস্যা মীমাংসা করা, আমাদেরও অধিকার আছে আমাদের অফিস কর্মীর সমস্যা সমাধান করার, আমরা হিউম্যান রাইট নিয়ে কাজ করি, আর আমাদের কর্মিই যদি অন্যায়ের শিকার হয় আমরা অবশ্যই বসে থাকতে পারি না”
জারিনের ফুফু বলে উঠেন.. “এখানে কোনো অন্যায় হয়নি, জারিন সেচ্ছায় এই ছাড়াছাড়ির ব্যাপারে মত দিছে, জারিন তার হাসব্যান্ডের অত্যাচারের শিকার হইছে, বিশ্বান না হলে থানায় জিডি করা আছে সেখানে গিয়ে দেখে আসেন, আপনারা এখন আসতে পারেন” জারিন সবার সামনে উচ্চস্বরে বলে উঠলো.. “ফুফু আপনার লজ্জা করলো এই বৃদ্ধ বয়সে এত বড় মিথ্যাটা বলতে?! মুখে একটুও বাজলো না? আমি সেচ্ছায় রাজি হইছি? নাকি আমাকে বাধ্য করছেন? আপনার ছেলের সাথে আমার বিয়ে দিতে চান নাই? আমার বাচ্চা নষ্ট করতে হসপিটালে নিয়ে যান নাই?!” ফুফুর মুখখানা ফুটো বেলুনের মতো চুপসে যায়। জারিনের বাবা ধমক দিয়ে জারিনকে থামিয়ে দেয়। আমিও ইশারায় জারিনকে শান্ত হতে বললাম।
নাসরিন ম্যাম বলে উঠেন.. “আপনার মেয়েই আমাদেরকে খবর দিয়ে এনেছে, যা যা ঘটছে সবকিছুই আমাদের জানা, কিন্তু বাড়ি এসেতো আমি রীতিমতো অবাক হয়ে গেছি, একজন গণ্যমান্য ব্যক্তি, যিনি কি না এলাকার কমিশনার, সে তার নিজ মেয়ের এতবড় সর্বনাশ করতে যাচ্ছে, আমার ভাবতেও অবাক লাগছে” পাশে বসে থাকা এলাকার চেয়ারম্যান এবার একটু তার তেজ দেখালেন, ম্যাডামকে এটা সেটা প্রশ্ন শুরু করলেন.. “কোন অফিসের কর্মি আপনারা? কার আন্ডারে কাজ করেন? আসেন বাইরে আসেন কিছু কথা বলি আপনার সাথে!” নাসরিন ম্যাম বললেন.. “বাইরে যেতে হবে কেন? আপনি কে?” পাশ থেকে কেউ বলে দিলো উনি এলাকার চেয়ারম্যান। ও আচ্ছা, তবে চেয়ারম্যানের সম্মান তো চেয়ারের মাঝেই শোভা পায়, চেয়ার থেকে উঠে কথা বলার প্রয়োজন তো দেখি না! আমার জানা মতে আড়ালে ভালো মানুষেরা কথা বলে না। আমরা কেউ আড়ালে কথা বলতে আসিনি। বরং আপনার যা বলার সবার সামনেই বলুন, এই যে আমার ডান পাশে দৈনিক পত্রিকার সাংবাদিক আছেন, বাম পাশে মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা হাই কোর্টের এডভোকেট আছেন,, তারাও শুনুক আপনি কি বলতে চান!
চেয়ারম্যানের ফুলেফেঁপে উঠা তেজটা সেখানে আর বেশিক্ষণ টিকলো না। তিনি এবার মিনমিনিয়ে বলা শুরু করলেন.. না আসলে চাচ্ছিলাম একটা সমাধানে তো যাওয়া লাগবে এই নিয়েই বলছিলাম আর কি। এরপর জারিনের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন “মা তুমি কি চাও বলো? সাজিদের সাথে এভাবেই সংসার চালাতে চাও?” জারিন অকপটে স্বিকার করে নেয়, “হ্যাঁ আমি এভাবেই থাকতে চাই” “তাহলে তো হয়েই গেল, আর মিমাংসার কিছু তো দেখছি না।” জারিনের বাবাও এবার নরম স্বরে বাধ্য হয়ে বললেন, ঠিকাছে মেয়ে যেটা চাচ্ছে তার বাইরে তো আর কিছু করা যায় না। আলোচনা এখানেই শেষ দেই, আসুন তাহলে আপনারা সবাই। নাসরিন ম্যাডামও বিদায় নেওয়ার আগে বললেন আমরা থানায় যাচ্ছি এখন, যেহেতু এটা থানা পর্যন্ত গড়িয়েছিলো তাই জিডি করে রাখাটা জরুরী যেন এসব নিয়ে ভবিষ্যতে কোনো সমস্যা না হয়। জারিনও আমাদের সাথে ঢাকার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে এলো। যেতে যেতে জারিনের বাবা জারিনকে নিচু স্বরে শুনিয়ে দিলো “এভাবে সবার সামনে বাপকে অপমান না করলেও পারতি!”
জারিন পুরো রাস্তাজুড়ে কেঁদেছে। তার চোখের পানি কিছুতেই থামছে না, সে তার বাবাকে অনেক ভালোবাসে কিন্তু সত্যিই সে আজ তাকে অপমান করে এসেছে, যা তার বাবা কোনোদিন কল্পনাও করেনি। আমি জারিনের হাতটা শক্ত করে ধরে ছিলাম। জারিন কাঁদতে কাঁদতে বলছে এছাড়া আর কোনো উপায় ছিলো না আমার, যদি আমি লুকিয়ে আসতাম একের পর এক সমস্যা করেই যেত, সব তোমার ফ্যামিলির উপর প্রেসার দিত, নানান ভেজাল করতে থাকতো, এবার তিনিও দেখে নিছে আমরা একা না, কারো শক্ত হাত আমাদের পাশে আছে, তাদের সামনেই মীমাংসা হয়ে গেছে।
এখন আমার পরিবার চাইলেও এসব নিয়ে আর ভেজাল করবে না৷ রাজনীতিবিদরা মিডিয়া, আইনজীবী, প্রভাবশালী মানুষ এদেরকে খুব ভয় পায়। কিন্তু আমার বাবা আজকে সবার সামনে অপমানিত হইছে, আমি মন থেকে চাইনি এভাবে… কিন্তু… এসব বলে বলে আবার কান্নায় ভেঙে পড়ে। জারিন বলে.. আজ এই বাচ্চাটা যদি আমার দেহে জড়িয়ে না থাকতো আমি জীবনেও এমন নিষ্ঠুর হতে পারতাম না, কখনোই বাবার মুখে মুখে তর্ক করার এতবড় দুঃসাহস দেখাতে পারতাম না। প্রতিটা তর্ক, প্রতিটা পদক্ষেপ এই বাচ্চা আমাকে সাহস জুগিয়েছে। আমি তার চোখের পানি মুছে স্বান্তনা দিয়ে যাই.. একদিন দেইখো সব ঠিক হয়ে যাবে, পারিবারিক ক্ষোভ এসব বেশিদিন টেকে না। তোমার বাবা মায়ের ব্রেইন ওয়াশ তোমার ফুফুই করছিলো এজন্য তারা আরও বেশি উষ্কে গেছেন। জারিনও তাল মিলিয়ে বলছে.. হ্যাঁ উনি অনেক বছর ধরে আমাদের পেছনে লেগে আছেন। এভাবে ধীরে ধীরে কথার টপিক ঘুরিয়ে জারিনকে শান্ত করে তুললাম। ফিরে এলাম দুজন চড়ুইপাখির সংসারে।
জারিন পেরেছে তার সংসার টিকিয়ে রাখতে। প্রবল ঝড়ে নিজ শিক্ষাকে ঢাল বানিয়ে অক্ষত রেখেছে এই পরিবারকে। আমার এখনো মনে পড়ে জারিনের সাথে বিয়ে পাকাপাকি হওয়ার সেই মূহুর্তের কথা। সেই একই দিনে আমরা দুটো পাত্রী দেখে এসেছিলাম। দুজনকেই আমাদের পছন্দ হয়েছিল। বাসায় এসে সিদ্ধান্ত নিতে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। অপর যে পাত্রীকে দেখেছিলাম তার বয়স ছিল অল্প, মাত্র কলেজে উঠেছে আর জারিন ছিলো সদ্য অনার্স পাশ৷ আমার বাবা শিক্ষকতা পেশায় ছিলেন, স্বাভাবিক ভাবেই তার শিক্ষিত মেয়েদের প্রতি বিশেষ দুর্বলতা রয়েছে, উনার কথাতেই সিদ্ধান্তটা জারিনের পক্ষে চলে আসে। কিন্তু আমার মায়ের বেশি পছন্দ হয়েছিলো অল্প বয়সী সেই মেয়েটিকে। মায়ের ভাষ্য মতে বেশি শিক্ষিত মেয়েরা খুব বেশি সাংসারিক হতে পারে না, সবকিছুতে নাকি বেশি বুঝে। কিন্তু সেই বেশি বুঝা মেয়েটিই আজ বোঝা টেনে নিচ্ছে!
আমি মাঝেমধ্যে ভাবি যদি সেই অল্প শিক্ষিতা মেয়েটিকে সেদিন বিয়ে করে আনতাম আজ কি তবে সেও আমার পাশে থাকতো? সে কি পারতো জারিনের মতো করে এভাবে সংসারটা টিকিয়ে রাখতে? হয়তো পারতো, হয়তোবা না, পারলেও অভাবের যাতাকলে পিষ্ট হয়ে দিন কাটাতে হতো। হতে পারে সেই মেয়েটা আমাকে জারিনের থেকেও অনেক ভালোবাসতো, হতে পারে সে আমার জন্য নাওয়াখাওয়া বাদ দিয়ে দিন রাত চোখের পানি ফেলে যেতো। কিন্তু জারিনের মতো কঠিন বাস্তবতার সামনে দাঁড়াতে গিয়ে নিজ অযোগ্যতাটুক সে হারে হারে টের পেয়ে যেত। তখন ভাগ্যের দোষারোপে ইতি টেনে রাতভর তাকে বালিশ ভেজাতে হতো।
জারিনের মতন এমন পরিস্থিতিতে যে কেউই পড়তে পারে। কার ভাগ্যের পরিনতি কোনদিকে চলে যায় কেউ বলতে পারবে না। তাই প্রতিটি মেয়ের সেই প্রস্তুতিটা নিয়ে রাখা প্রয়োজন। আমি বলছি না মেয়েদেরকে হুমড়ি খেয়ে চাকুরীর বাজারে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে, বলছি না তাদেরকেও জুতার তলা খসিয়ে যেকোনো মূল্যে চাকুরী পেতে হবে, শুধু এটুকু বলছি সম্মানিত চাকুরী করার যোগ্যতাটুকু অন্তত অর্জন করা উচিৎ। হতে পারে সেটা বাবার বাড়ি থেকে কিংবা শ্বশুর বাড়ি গিয়ে।
জারিনের ব্যক্তিগত কোনো ইচ্ছে ছিলো না সে বিয়ের পর চাকুরী করবে। কিন্তু আজ বিপদের মুহূর্তে তার অর্জিত শিক্ষাটা ছিল বলেই সে স্রোতের বিপরীতে বৈঠা বাওয়ার সাহসটুকু পেয়েছে। দেখতে দেখতে সাড়ে আট মাস পার হয়ে গিয়েছে। জারিনের ডেলিভারির সময়টাও ঘনিয়ে এসেছে। অল্পদিনের মাঝেই দুনিয়ায় আগমন ঘটবে আমাদের রাজকন্যার! জারিন এখন অফিস, টিউশনি, কাজকর্ম সবকিছু থেকে সম্পূর্ণ ছুটিতে আছে। আমি বেশ কয়েকটা টিউশনি করিয়ে যাচ্ছি। যথাসম্ভব জারিনের পাশে থাকার চেষ্টা করছি। এরইমধ্যে জারিনের ফ্যামিলি আমাদের সাথে বেশ কয়েকবার যোগাযোগ করে ফেলেছে। যত যাই হোক তারাতো বাবা মা।
রাগ ঝগড়া করে তাদের আর কোনো লাভ নেই, জারিন এক চুল নড়বে না তারা ভালো ভাবেই বুঝে নিয়েছে। মেয়েকে এই সময়টুক তাদের বাড়ি নেওয়ার জন্য অনেক রিকুয়েষ্ট করেছিল আমার কাছে। আমি রাজি হয়নি। আগে সন্তান দুনিয়াতে আসুক এরপর না হয় তাকে নিয়ে সেখানে ঘুরতে যাবে, তার আগে আর না। এক পর্যায়ে তারা তাদের মেয়ের কষ্টের কথা ভেবে সংসার খরচ চালাতে আমাকে টাকাও সেধেছে। আমি কঠোর ভাবে মানা করে দিয়েছি, এও শুনিয়ে দিয়েছি আমি বেঁচে থাকতে আপনাদের সম্পদ ভান্ডার থেকে এক পয়সাও আমি নিব না। যদি জারিনের প্রাপ্য কিছু তাকে দেওয়ার থাকে সেটা সরাসরি আপনাদের নাতি নাতনিকে ভবিষ্যতে দিয়েন, তাদের ইচ্ছে হলে নিবে নইলে না। আমার সংসারে অন্তত আপনাদের এক টাকাও আমি ঢুকতে দেব না।
এই দীর্ঘ এক বছরে আমার পায়ের অবস্থার চমকপ্রদ কোন উন্নতি ঘটেনি, তবে বেশকিছু শুভ লক্ষণের দেখা পেয়েছি। এই যেমন.. পায়ের আঙুল গুলো এখন নাড়াতে পারি, হাঁটু খুব সামান্য ভাজ করতে পারি, ক্রাচ ছাড়া অল্প সময়ের জন্য ব্যালেন্স করে দাঁড়াতে পারি। গতকাল ডাক্তারের চেম্বার ঘুরে এসেছি। নির্বাক থাকা ডাক্তার মশাই এতদিনে মুখ খুলেছেন, তিনি বলেছেন যেভাবে একটু একটু উন্নতি ঘটছে আশাকরা যায় নিয়মিত নির্দেশনা মেনে চললে খুব দ্রুতই সুফল বয়ে আসবে। খবরটা শুনে আমার আকাশে উড়তে ইচ্ছে করছিল! যদিও এটা অনিশ্চয়তার ভবিষ্যত বাণী, তবুও এই সামান্য আশাও আমার জন্য অনেক বড় কিছু, যেমনটা খরার মাঝে আকাশের কোণে দেখা পাওয়া কালো মেঘ অনেক বড় কিছু।
এই খবরটা যখন বাসায় এসে জারিনকে দিয়েছি, সে ভেংচি কেটে আমাকে বলেছে, “আমার কথা তো বিশ্বাস হয় নাই.. আগেই বলছিলাম না আমি…? দেইখো আমাদের আম্মুটা হাঁটা শেখার আগেই তুমি হাঁটাচলা করতে পারবে”
আমি বলি কি.. এত তাড়াহুড়োর কি আছে? বাপ বেটি দুজন মিলেই না হয় কদম মিলিয়ে হাঁটতে শিখবো! তাতে মন্দ কি?
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত