তখনো আমাদের আকাশে সূর্য ওঠেনি। অন্য কোনো আকাশে ওঠা সূর্যের দু-একটা দুর্বিনীত রশ্মি আমাদের আকাশের অন্ধকারের সঙ্গে কাটাকুটি খেলায় মত্ত হয়েছে মাত্র। বড় আলস্যের সময় তখন। এমন সময় প্রচণ্ড গতিতে দুটি গাড়ির ব্রেক কষার শব্দ শুনে, আমাদের যাদের ঘুম পাতলা তারা, একটু নড়েচড়ে উঠলেও অন্য সময়ের মতো জানালা দিয়ে মাথা বের করি না। গাড়ির সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই এরূপ ভাবতে ভাবতে আমরা আবার তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ি। তবে আকস্মিক এবং ভয়জাগানিয়া শব্দের কারণে ফজরের আজান দিতে ওঠা আমাদের পাড়ার মসজিদের মুয়াজ্জিন আবদুল বাতেন অজু করার মাঝপথে একবার উঠে এসে জানালা দিয়ে মসজিদ-সংলগ্ন রাস্তায় চোখ না রেখে পারে না। সে দেখে – সাদা রঙের দুটি মাইক্রোবাস আমাদের সরু গলিতে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। খুব প্রখর কল্পনাশক্তির অধিকারী না হয়েও আবদুল বাতেন অনুধাবনে সমর্থ হয় যে, কারো পেছনে ছুটতে গিয়ে কিংবা কারো কাছ থেকে ধাওয়া খেয়ে পালানোর সময় এই সরু গলিতে আচমকাই দেখা হয়ে গেছে দুটি বেগবান মাইক্রোবাসের। শেষ মুহূর্তে ব্রেক না কষলে একটা বড় ধরনের দুর্ঘটনায় উপনীত হতে পারত গাড়িদুটি। দুর্ঘটনা হয়তো এড়ানো গেছে কিন্তু এখন কোনো একটি গাড়ি পিছিয়ে না গেলে অন্যটির বের হওয়ার রাস্তা বন্ধ। সার্বিকভাবে বিষয়টি তার কাছে মামুলি ঘটনা বলে মনে হওয়ায় সে আর এ-ঘটনার পেছনে সময়ক্ষেপণ না করে অজুর বাকি অংশ সমাপ্তকরণে মনোযোগী হয়।
আমাদের পাড়ায় বেশকটি গলি-উপগলি আছে। এগুলো মহাসমারোহে বড় কোনো রাজপথে মিলিত হওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও প্রায়শই কোনো বাড়ির গেটে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে। ব্যতিক্রম শুধু এ-গলিটা। এটা কী করে যেন একটা পাকা সড়ক থেকে যাত্রা শুরু করে আরেকটা পাকা সড়কে শেষ হয়েছে। তবে গলিটার রাজপথ থেকে রাজপথে পৌঁছানো এতটাই সর্পিল যে, লুডু খেলার বোর্ডে আঁকা সবচেয়ে প্যাঁচানো সাপটিও গলিটি দেখলে লজ্জা পাবে। প্রচলিত আছে, কোনো এক শীতকালীন মহড়ার সময় ক্ষুদ্র একটি প্রশিক্ষিত সেনাদল সারিবদ্ধভাবে মার্চপাস্ট করে গলির এ-মাথা থেকে ও-মাথায় পৌঁছতে পারেনি। কিন্তু নতুন রেজিমেন্টেড তরুণ সেনা কর্মকর্তা, যিনি গ্রামের মুক্ত বাতাসে বড় হয়ে সরাসরি সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন এবং ঢাকা শহরের অলিগলির সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ লাভ করেননি, তিনি এই উচ্ছৃঙ্খলতাকে মেনে নিতে পারেননি। ফলে সে-সেনাদলকে পাকা রাস্তায় দীর্ঘ সময় দুহাতের কনুইয়ের ওপর ভর করে হামাগুড়ি দিতে হয়েছিল। এখনো উচ্চাকাক্সক্ষী অনেক ড্রাইভার শর্টকাটে গন্তব্যে পৌঁছানোর আশায় এই গলি ধরে গাড়ি চালাতে গিয়ে প্রায়শই বিপদে পড়ে যায়। আবার সন্দেহপ্রবণ কোনো ড্রাইভার গলিতে গাড়ি ঢোকানোর আগে যদি সন্দেহের বশবর্তী হয়ে গলির চওড়া মুখে দাঁড়িয়ে-থাকা কোনো যুবক বা কিশোরকে জিজ্ঞেস করে, ‘কী ভাই, বড় রাস্তায় উডন যাইবো।’ তখন দলবেঁধে আমাদের পাড়ার ছেলেরা বলে, ‘হ-হ, সোজা যানগা ওস্তাদ’।
ড্রাইভার তাদের অতিক্রম করার সঙ্গে সঙ্গে তারা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে। তারা জানে, ইতোমধ্যে কোনো না কোনো গাড়ি গলির আরেক মাথা দিয়ে শর্টকাটে গন্তব্যে পৌঁছানোর আশায় এ-গলিতে ঢুকে পড়েছে। এবং সাপের শরীরের মতো আঁকাবাঁকা এই গলির কোনো একটি মোড়ে যখন দুটি গাড়ি মুখোমুখি হবে, তখন আর কারো এগোনোর উপায় থাকবে না। এহেন পরিস্থিতিতে দুজন ড্রাইভারের কেউই আপসে গাড়ি পিছিয়ে নিতে চাইবে না। কিন্তু যেহেতু একজনকে পেছনে যেতেই হবে, সেহেতু তারা কিছুক্ষণ হর্ন বাজিয়ে এবং পরস্পরের উদ্দেশে অশ্লীল-অশ্রাব্য গালিগালাজ বর্ষণের মধ্য দিয়ে দুজনের মধ্যে তুলনামূলকভাবে কে দুর্বল তা পরিমাপ করবে। অতঃপর যখন পরাজিত ড্রাইভারটি পেছনে যাওয়া শুরু করবে, তখনই আবিষ্কার করবে, তার পেছনে এরই মধ্যে শর্টকাট মারার আশায় আগত আরো কিছু গাড়ি সমবেত হয়ে লম্বা একটি লাইন তৈরি করে ফেলেছে। এ-সময় ড্রাইভার বনাম ড্রাইভার, প্যাসেঞ্জার বনাম ড্রাইভার কিংবা হেলপার বনাম ড্রাইভারের খিস্তি-খেউড়ে আমাদের গলিটা উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। আমাদের পাড়ার কিশোর-যুবকদের বিনোদনের এ এক নিত্য উপাদান। কোনো কোনো বাড়ির মেয়েরাও জানালা খুলে দাঁত কেলিয়ে এ-দৃশ্য উপভোগ করে। বিশেষত এক্ষেত্রে আমাদের গলিতে অবস্থিত ‘মাই ফেয়ার লেডি বিউটি পার্লারে’র কথা বলাই বাহুল্য। খিস্তি-খেউড়ের সময় কাজ কম থাকলে পার্লারের জানালা খুলে দলবদ্ধভাবে একদল বাঙালি ও পাহাড়ি যুবতী মেয়ে যখন এই কোলাহলময় পরিস্থিতিতে চোখ রাখে, তখন আশপাশের যুবকরা পুলকিত বোধ করে। পান-দোকানদার কিংবা হোটেলের বয়-বেয়ারারা উত্তপ্ত পরিবেশ অবলোকনের পাশাপাশি ওই মেয়েদের উদ্দেশে অশ্লীল আকার-ইঙ্গিতও করে বলে শোনা যায়। আবার কোনো কোনো মুরব্বি সূত্রে আমরা অবগত হই যে, ওই পার্লারের মেয়েরা মাথায় হিজাব পরলে এবং বুকের ওড়না গলায় উঠিয়ে না রাখলে যুবকদের ওইরূপ চাঞ্চল্য দেখা দেওয়ার কথা নয়। সুতরাং এ-বিষয়ে এককভাবে পাড়ার যুবকদের দায়ী করা সমীচীন নয়। এ-কারণে আমাদের গলিতে গাড়ি আটকে-পড়া। শুধু গাড়ি আটকে-পড়া নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের পাড়ার মানুষদের জীবনযাপনের একটা নিজস্ব স্টাইল।
আজ ভোর না হতে গলিতে দুটি মাইক্রোবাস মুখোমুখি হয়ে পড়ায় মুয়াজ্জিন আবদুল বাতেন খুব বিচলিত না হয়ে আজান দেওয়া শুরু করে। তার ধারণা ছিল, আজান শেষে সে দেখবে, একটি গাড়ি পিছিয়ে গিয়ে অন্য গাড়িকে জায়গা করে দিয়েছে। অন্য সময় মাঝে মাঝে ফজরের আজানে ছোটখাটো ভুল হয় বলে তার একটা বদনাম প্রচলিত আছে। সেসব ভুল ধরার মতো অবস্থায় কেউ থাকে না বা সবারই চোখে ঘুম থাকায় সাহস নিয়ে কেউ চ্যালেঞ্জ না করায় আজ পর্যন্ত আবদুল বাতেনের চাকরির ওপর তেমন প্রভাব পড়েনি। তবে আজকে কোনো ভুলভ্রান্তি ছাড়াই আজান শেষ করে আবদুল বাতেন খানিকটা তৃপ্তিবোধ করলেও অবাক হয়ে দেখে, গাড়ি দুটি তখনো পরস্পরের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। এমন পরিস্থিতিতে কোনো একটি গাড়ি পিছিয়ে না গেলেও হর্ন বাজানোর কথা; কিন্তু গাড়ি দুটি কিছুই করছে না। মনে হচ্ছে মল্লযুদ্ধে নামার আগে দুই যোদ্ধা পরস্পরকে মেপে নিচ্ছে। ইমাম সাহেব মসজিদের জানালা দিয়ে গাড়িদুটি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ শেষে বলেন, ‘আজব ব্যাপার’।
আবদুল বাতেন ভাবে, ব্যাপারটা আজবই বটে। কেউ পেছনেও যায় না। আবার হর্নও বাজায় না। যেন দুজন দুজনকে চেনার চেষ্টা করছে। একটু পরে হয় যুদ্ধ হবে, না-হয় হবে আলিঙ্গন। কিন্তু ইমাম সাহেব যখন জানালার কাছে ইশারায় আবদুল বাতেনকে ডাকে এবং ফিসফিস করে বলে, ‘দেখছেন, দুইটা গাড়িই সাদা। দুইটা গাড়িই মাইক্রোবাস। গাড়ির মডেলও এক। আবার দুইটা গাড়ির সামনে একই হরফে লেখা – ডিবি পুলিশ।’
তখন আবদুল বাতেন প্রথমবারের মতো বিচলিত বোধ করে। সে অনুভব করতে সমর্থ হয়, এ-বিষয়টি যদি সে আজান দেওয়ার আগে খেয়াল করত, তবে আজানে সে নির্ঘাত ভুল করত। এ আল্লাহপাকেরই ইচ্ছা যে, আজান সমাপ্ত হওয়ার পর ইমাম সাহেবের কৃপায় এই আজব ব্যাপারটি তার নজরে এসেছে। ইমাম সাহেবের অনুকরণে – সে গাড়ির ভেতরে নজর দেয়। দুটি গাড়িরই সামনে বন্দুক-হাতে একজন করে লোক বসা। ভেতরে আছে আরো চার-পাঁচজন। গাড়ির সামনে বসা দুজন অস্ত্রধারীরই অস্ত্র ঈষৎ উত্তোলিত। এই ঈষৎ অস্ত্র উত্তোলনের পেছনে ভয় না আত্মরক্ষা মূল চালিকাশক্তি, তা অনুমান করা বড় শক্ত। গাড়িদুটির দুই ড্রাইভারের মধ্যেও টানটান উত্তেজনা। দুই হাতে স্টিয়ারিং শক্ত করে ধরা। পা সতর্কভাবে এক্সেলেটরে রাখা। যেন কোথাও কেউ রুমাল হাতে দাঁড়িয়ে আছে। হাত থেকে রুমালটা খসে পড়লেই তারা একজন অন্যজনের ওপর গাড়ি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে। গাড়ির আরোহীরা নিজেদের মধ্যে কী যেন আলাপ করে। গাড়ির দরজা-জানালা বন্ধ থাকলেও উভয় গাড়ির আরোহীদের মধ্যে যে এক ধরনের চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছে, সে-বিষয়টি মসজিদের জানালায় মুখ রেখেও বাতেন অনুভব করতে পারে।
ইতোমধ্যে ফজরের নামাজে আসা মুসল্লিরা ইমাম সাহেব এবং মুয়াজ্জিনকে নিবিড়ভাবে জানালার বাইরে তাকাতে দেখে তারাও জানালায় মাথা রাখে। যাদের চোখে চশমা আছে তারা চশমাটি আরেকবার নাড়া দেয়। যারা ঘুম থেকে উঠেছে কিন্তু চোখে এখনো ঘুম ঝুলে আছে তারা চোখ দুটি আরেকবার কচলে নেয়। আনসারের অবসরপ্রাপ্ত অ্যাডজুট্যান্ট আলি আজগর দৃশ্যটি খানিক সময় পর্যবেক্ষণ শেষে আস্তে করে জানায়, ‘এক গাড়িতে আসল পুলিশ; আরেক গাড়িতে ভুয়া।’
সঙ্গে সঙ্গে মসজিদের জানালার মুখগুলোতে চিন্তার রেখা ভেসে ওঠে। তারা নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে আসল এবং নকল পুলিশের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণের চেষ্টা চালায়। এ-সময়ে চিল্লায় নিয়মিত যাতায়াত করা এক যুবক বলে, ‘নকল হইলে তো অন্তত এক দলের রাস্তা ছাইড়া ভাইগ্গা যাওনের কথা। দুই দলের কেউই তো রাস্তা ছাড়ে না।’
অবসরপ্রাপ্ত আনসার অ্যাডজুট্যান্ট আলি আজগর তখন বিজ্ঞের মতো জবাব দেন, ‘সেজন্যই তো কেউ রাস্তা ছাড়ে না। দুপক্ষই দাবি করতে চাইতেছে তারা আসল ডিবি পুলিশ।’
এ-সময় কে যেন তাড়া দেয়, ‘ভাই রাখেন এইসব। আগে নামাজ পইড়া লই। দ্বীনের কাম বাদ দিয়া আসল-নকল পুলিশ খুঁজবার লাগছেন। হাসরের ময়দানে যদি বলেন আসল-নকল পুলিশ খুঁজতে গিয়া নামাজ কাজা করছি – মাফ পাইবেন?’
তার এ-কথায় ইমাম, মুয়াজ্জিন এবং অবসরপ্রাপ্ত আনসার অ্যাডজুট্যান্ট আলি আজগরসহ অন্য নামাজিদের চেতনা ফিরে আসে। তারা ভুয়া পুলিশ শনাক্তকরণ প্রক্রিয়াটি অসমাপ্ত রেখে নামাজ আদায়ের জন্য জমায়েত হয়।
ফজরের নামাজের পর মুসল্লিদের নরম দিলের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ভিক্ষা পাওয়ার আশায় নিত্য আগত দুজন ভিখারি মসজিদের সামনে অ্যালুমিনিয়ামের থালা নিয়ে এ-সময় আসন গ্রহণ করলেও তারা এই উত্তেজনাকর দৃশ্যের দিকে ফিরেও তাকায় না। কে আসল পুলিশ, কে ভুয়া পুলিশ এ-বিষয়টিকে ভিখারিরা নিজেদের ভাবনার পক্ষে উপযুক্ত মনে করে না। কিন্তু ততক্ষণে রাস্তার মোড়ের হোটেল আল-হামজায় নানরুটির আটা বানানো শুরু হয়ে গেছে। স্বামীর কাছে আকর্ষণ হারানোর সম্ভাবনায় কাতর মধ্যবয়সী নারী, ডায়াবেটিসে আক্রান্ত সাবেক আমলা এবং শরীরটাকে সালমান খান-সদৃশ বানিয়ে নারীর মন জয়ে আগ্রহী যুবকরা রাস্তায় নেমে এসেছে। তারা ঘটনার গভীরতা পরিমাপ করতে না পেরে কিংবা ঘটনার গভীরতা পরিমাপে সময় ব্যয় না করে হাঁটতে থাকে। শুধু হোটেলে আগরবাতি লাগিয়ে এবং ক্যাসেটে কোরআন তেলাওয়াত বাজিয়ে ক্যাশবাক্সে বসা ম্যানেজার হেমায়েত ও নানরুটির কারিগর স্বপন আড়চোখে চলতে থাকা নাটকটি উপভোগ করতে থাকে।
সম্ভবত উভয় গাড়ির আরোহীই মনে করে যে, এ-অবস্থায় পিছিয়ে যাওয়া মানে নিজেকে অন্য দলের কাছে ভুয়া পুলিশ প্রমাণের সুযোগ করে দেওয়া। যে আসল পুলিশ সে হবে নির্ভীক। নকল পুলিশ শনাক্তকরণ এবং আইনের হাতে তাকে সোপর্দ করাই আসল পুলিশের কর্তব্য। কেউ যদি বিষয়টিকে পাশ কাটায়, তবে তা উভয়ের জন্য হবে মঙ্গলজনক। কিন্তু দুটি গাড়ির আরোহীই অন্য পক্ষের পদক্ষেপ দেখে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়ার চিন্তায় মশগুল থাকায় ঘটনার চূড়ান্ত পরিণতির জন্য ঘটনায় নজর রাখা লোকদের অপেক্ষা কিছুটা দীর্ঘায়িত হয়। উভয় গাড়ির পেছনে গুটিকয় রিকশা, একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা এবং তরকারিসহ একটি ভ্যানগাড়ি আটকে গেলে একটা সময় দীর্ঘ নীরবতার পরিসমাপ্তি ঘটে অথবা পরিসমাপ্তি ঘটাতে তারা বাধ্য হয়।
দীর্ঘ আলাপ এবং শলাপরামর্শের পর একটি মাইক্রোবাসের সামনের দরজাটি খুলে যাওয়ার শব্দ শুনে উত্তেজনাবশত নানরুটির কারিগর স্বপন একদলা আটার মণ্ড যথাযথভাবে গোল না করেই মাটির চুলার ভেতরে ঢুকিয়ে দেয়। সামনের মাইক্রো থেকে একজনকে নামতে দেখে অন্য মাইক্রোবাস থেকেও একজন নেমে আসে। দুজনেরই চুল ছোট করে ছাঁটা। হাতে দুজনেরই একই মডেলের রাইফেল। দুজন পুলিশের কোমরেই হাতকড়া। হাতকড়ায় খোদাই করে লেখা পুলিশ। হেমায়েতের শৈশব কেটেছে রাজশাহী পুলিশ লাইনের পাশে। ছোটবেলা থেকে পুলিশ দেখে দেখে সে বড় হয়েছে। কিন্তু অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার ব্যবহার করেও ঠিক বুঝে উঠতে পারে না, দুজনের মধ্যে কে আসল পুলিশ আর কে নকল।
রুটি বেলতে বেলতে কারিগর স্বপন বলে, ‘ওস্তাদ, আমার তো মনে হয় দুজনই নকল। কেউর শইলে পুশাক নাই। কী কন?’
হেমায়েত রুটির কারিগর স্বপনের কথায় মুচকি মুচকি হাসে। ‘বেকুব, পুলিশের দুই ধরনের পোশাক আছে। এরা যেইডা পরছে এইটাও পোশাক। তবে এইটারে বলে সাদা পোশাক।’
‘সাদা পোশাক’ কথাটি শুনে কারিগর স্বপন ঝট করে মাথা তুলে গাড়ি থেকে বের হওয়া পুলিশ দুজনকে আরেকবার দেখে নেয়। একজনের পরনে হলুদ গেঞ্জি আর গ্যাবার্ডিনের প্যান্ট। অন্যজনের হাতা-গুটানো লাল-কালো চেকের ফুল শার্ট আর জিন্সের প্যান্ট। নানরুটির কারিগর স্বপন কোথাও সাদা রং খুঁজে পায় না। সাদা পোশাকের মর্মার্থ বুঝতে না পেরে স্বপন আবার হেমায়েতের দিকে তাকায়। তারপর রুটি বেলতে বেলতে ভাবে, আমরা যে-পোশাককে লাল কিংবা নীল কিংবা কালো বলি পুলিশ তা বলে না। পুলিশের কাছে নিজস্ব পোশাক যা ইউনিফর্ম না কী যেন বলে, তা ছাড়া বাকি সব পোশাকই সাদা। স্বপনের মনে হয়, যে একবার পুলিশের খাতায় নাম লেখায়, সে আর কখনো পোশাকহীন থাকতে পারে না। পুলিশ যখন কাপড় খুলে গোসল করে, তখনো কি তার পোশাক হয় সাদা? এ-ভাবনা তার মুখে হালকা একটা হাসির রেখা ফুটিয়ে তোলে। স্বপন মুখ তুলে হেমায়েতের দিকে আবার তাকিয়ে নিজের ভাবনার কথা বলতে গিয়ে দেখে, হেমায়েত তখন সব ভনিতা বাদ দিয়ে সরাসরি সামনে ঘটতে যাওয়া নাটকে মনোনিবেশ করেছে। সম্ভবত নাটকের ক্লাইম্যাক্স পর্ব আসন্ন।
গাড়ি থেকে নেমে এসে হলুদ গেঞ্জি প্রথম কথা বলে, ‘নাম কী?’
‘ইন্সপেক্টর জসিম। আপনি?’
হলুদ গেঞ্জির মুখে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে ওঠে। একজন ভুয়া পুলিশের কাছে নিজের পরিচয় দিতে তার কুণ্ঠাবোধ হয় যেন। সে কোনো কথা না বলে বিদেশি সিনেমার নায়কের আদলে পরিচয়পত্রটি তুলে ধরে।
হলুদ গেঞ্জির ধারণা ছিল, পরিচয়পত্রটি দেখে কথিত ইন্সপেক্টর জসিম ভড়কে যাবে; কিন্তু সে ভড়কে না গিয়ে হাত বাড়িয়ে পরিচয়পত্রটি দেখতে চায়। হলুদ গেঞ্জি আবারো বিব্রত হয়। সারদায় ট্রেনিং নিয়ে দীর্ঘদিন সুনামের সঙ্গে কাজ করে একজন ভুয়া পুলিশের কাছে নিজের পরিচয়ের যথার্থতা নিরূপণ করতে তার অহঙ্কারে লাগে সম্ভবত। প্রতিপক্ষের হাতে যেহেতু অস্ত্র আছে এবং সে-অস্ত্র আসল না নকল তা প্রমাণ করতে গেলে চড়া মূল্য দিতে হতে পারে; তাই মাথা ঠাণ্ডা রেখে সে পরিচয়পত্রটি ইন্সপেক্টর জসিমের কাছে দেয়। ইন্সপেক্টর জসিম খুব মনোযোগ দিয়ে পরিচয়পত্রটি দেখতে থাকে। একবার মুখের কাছে এনে, একবার খানিকটা সরিয়ে এবং কী কারণে যেন একবার উলটো করে ধরে পরিচয়পত্রটি পরীক্ষা করে। ততক্ষণে মসজিদ-ফেরত মুসল্লি এবং ঘাম-ঝরানো যুবকের দল দুটি গাড়ির পাশে ভিড় জমিয়েছে। তারাও ইন্সপেক্টর জসিমের মতামতের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকে।
পরিচয়পত্রটি দেখতে দেখতে ইন্সপেক্টর জসিমের মুখে সে-হাসিটি ফুটে ওঠে যে-হাসিটি হেমায়েত দেখেছিল হলুদ গেঞ্জি পরা পুলিশের মুখে। ‘সারদায় ট্রেনিং নেওয়া পুলিশ আমি। আমার সঙ্গে চালাকি কইরা পার পাবেন না। নাম নিছেন ইন্সপেক্টর সাহাদত। আসলে হইবো কিলার সাহাদত। ঠিক না?’
এই কথা শুনে সাহাদত নামের পুলিশের নাকের বাঁশি ফুলে ওঠে। চোয়ালও শক্ত হতে দেখে কেউ কেউ। তার এই অভিব্যক্তিকে কোনো পাত্তা না দিয়েই ইন্সপেক্টর জসিম বলতে থাকে, ‘নীলক্ষেত থেইকা বানাইন্না পরিচয়পত্র। দেখলেই বোঝা যায়।’
সারদার ট্রেনিং এবং নীলক্ষেতের কথা শুনে আশেপাশের জমায়েতের সন্দেহ অনেকটা দূর হয়ে যায়। সারদায় যে একটা পুলিশ ট্রেনিং অ্যাকাডেমি আছে তা জানতে সাধারণ জ্ঞানের বই পড়তে হয়। সুতরাং রাজশাহী বা বাংলাদেশ বা অন্য কোনো জায়গার অ্যাকাডেমির নাম না বলে একেবারে সুনির্দিষ্টভাবে সারদার কথা বলায় ইন্সপেক্টর জসিমের ওপর ভিড়ের লোকজনের বিশেষত বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে যাওয়া যুবকদের আস্থা অনেক বেড়ে যায়। আর বৃদ্ধদের আস্থা বাড়ে নীলক্ষেতের কথা শুনে। তারা শুনেছে নকল যন্ত্রপাতির জগতে যেমন ধোলাইখাল সুনাম অর্জন করেছে, তেমনি আসলের মতো নকল কাগজ তৈরিতে সুনাম অর্জন করেছে নীলক্ষেত। যে-সার্টিফিকেট অর্জনে মানুষের চার বছর লাগে, নীলক্ষেত সেই সার্টিফিকেট সরবরাহ করে চার দিনে। তারা এও অবগত হয়েছে, কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে নীলক্ষেতের সার্টিফিকেট নিয়ে চাকরি করা লোকজনের পারফরম্যান্স নাকি চার বছরের অরিজিনাল অনার্সের চেয়ে ভালো।
এসব ভাবনা গাড়ির পাশে জমা হওয়া লোকদের ইন্সপেক্টর জসিমকে বিশ্বাস করতে সাহস জোগায়। এবং তারা সন্দেহের দৃষ্টিতে ইন্সপেক্টর সাহাদতের দিকে তাকায়। সাহাদতকে তাদের কাছে একটু বিভ্রান্তও মনে হয় যেন। সে অনেকটা নিরুপায় হয়ে কার সঙ্গে শলাপরামর্শ করার জন্য যেন গাড়ির দিকে হাঁটতে থাকে। গাড়ির জানালা দিয়ে মুখ ঢুকিয়ে কার সঙ্গে যেন কথা বলে। সাহাদতের কথায় গাড়ি আরোহী অন্য সত্য পুলিশ অথবা মিথ্যা পুলিশদের কপালে ভাঁজ দেখা যায়। অল্পবয়সী একজনকে উত্তেজিত হয়ে অস্ত্র-হাতে গাড়ি থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টা করতে দেখা যায়। জানালার ফাঁক গলে আসা কিছু বিচ্ছিন্ন শব্দ থেকে বোঝা যায় – আসল পুলিশ হয়ে নকল পুলিশের কাছে তার সিনিয়র কর্মকর্তাদের পরিচয় প্রদানের এ-প্রক্রিয়াকে সে পুরো পুলিশ বিভাগের প্রতি অপমান বলে মনে করে। এবং এ-অপমানের চেয়ে মৃত্যুকে অধিক সম্মানজনক মনে করে – সে তাদের মোকাবিলা করতে আগ্রহী বলে জানায়। তবে গাড়ির অন্য আরোহীরা তাকে গাড়ি থেকে নামতে দেয় না। আল-হামজা হোটেলের ম্যানেজার হেমায়েত স্পষ্ট শোনে যে, অন্য পুলিশরা আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের পথ বের করতে আগ্রহী। আলোচনার পাশাপাশি নিজেদের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে বয়স্ক ধরনের একজন পুলিশ গাড়ি থেকে নেমে এসে ওয়াকিটকি বের করে কার সঙ্গে যেন কথা বলে বা কথা বলার চেষ্টা করে।
ওয়াকিটকির খর-খর শব্দ আর ব্রাভো, চার্লি প্রভৃতি শব্দ উপস্থিত জনতার চিন্তাজগতে একটা বড় ঢেউ তোলে। তারা ইন্সপেক্টর সাহাদতের দলটিকে ভুয়া পুলিশের দল বলে প্রায় নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল কিন্তু এক্ষণে তাদের মধ্যে একজনের ‘অপমান অপেক্ষা মৃত্যুকে শ্রেয়’ মনে করায় এবং বিশেষত একজনের হাতে ওয়াকিটকি দেখে নিজেদের সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের একটা তাগিদ অনুভব করে। উপস্থিত লোকজনের ভেতরে এক ধরনের ফিসফাস হোটেল ম্যানেজার হেমায়েতের কানেও আসতে থাকে।
উপস্থিত লোকজনের মতামতের পরিবর্তন কিংবা ফিসফাস-কানাকানি ইন্সপেক্টর জসিমের দলটি অনুভব করতে সমর্থ হয়। সময় যত বাড়ছে, আস্তে আস্তে উপস্থিত লোকজনের সংখ্যা বাড়ছে। রাস্তার বাঁকের পাশের দেয়ালে যেখানে লেখা আছে ‘এখানে পেশাব করিলে একশত জুতার বাড়ি’ তার নিচে নিয়মিত জলবিয়োগের ফলে যে-দুর্গন্ধের উদ্রেক হয়েছে, তা অস্বীকার করে চূড়ান্ত পরিণতি দেখতে উদগ্রীব হয়ে আশপাশের জটলাটি ক্রমেই বড় হচ্ছে। এতক্ষণ ঘটনাটি আড়চোখে দেখতে থাকা লোকজনও এখন সরাসরি তাকাচ্ছে। এভাবে লোকজন বাড়তে থাকলে ঘটনায় জনগণ একটা গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে ফেলবে বলে দলটি বিশ্বাস করতে শুরু করেছে। বিশেষত সর্বশেষ পুলিশ সপ্তাহে পুলিশ কর্তৃক ‘জনতাই পুলিশ, পুলিশই জনতা’ স্লোগান চালু করার পর থেকে জনগণের মধ্যে বিভিন্ন নতুন নতুন বিষয়ে নাক গলানোর অভ্যাস দেখা যাচ্ছে। সুতরাং সত্যি পুলিশ হয়েও যদি উপস্থিত জনতার সাপোর্ট পাওয়া না যায় তবে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হওয়ার সম্ভাবনায় ইন্সপেক্টর জসিমের দলটি চিন্তিত হয়ে ওঠে। অতএব তাদের মধ্যে থেকেও একজন গাড়ি থেকে বের হয়ে ওয়াকিটকি হাতে কার সঙ্গে যেন কথা বলে বা কথা বলার চেষ্টা করে।
এহেন পরিস্থিতিতে আশপাশের জমায়েতকে চরম বিভ্রান্ত মনে হয়। তারা ঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। কারা আসল আর কারা ভুয়া। তাদের কেউ কেউ মোবাইলে এ-এলাকায় থানার সোর্স বলে দাবি করা এনায়েতকে ঘটনাটি জানানোর সিদ্ধান্ত নিলেও তা বাস্তবায়ন করতে পারে না। কারণ যে ফোন করবে তাকেই শেষ পর্যন্ত ঘটনার সাক্ষী বানিয়ে ফেলতে পারে এনায়েত। আর সাক্ষী হওয়া মানে ঘটনায় জড়িয়ে পড়া। নামাজ পড়তে এসে কিংবা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করতে এসে এ-ধরনের ঘটনায় জড়িয়ে পড়তে কারো মন সায় দেয় না। সে-কারণে মনে মনে এনায়েতের কথা ভেবেও অনেকে চুপ করে যায়। কিন্তু মসজিদের মুয়াজ্জিন আবদুল বাতেন নিজেকে সামলাতে পারে না। এত বড় ঘটনার সাক্ষী হতে পেরে সে উত্তেজনায় কাঁপতে থাকে এবং ভোলার লালমোহনের বাসিন্দা হওয়ায় এনায়েতকে আপনজন মনে করে তাকে ঘটনাটি জানানোর সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করে ফেলে। কিন্তু মোবাইলে এনায়েতের নাম্বারে ফোন করতে গিয়ে শোনে – আপনার মোবাইলে পর্যাপ্ত পরিমাণে ব্যালেন্স নেই, অনুগ্রহ করে অ্যাকাউন্ট রিচার্জ করুন। অ্যাকাউন্ট রিচার্জ করার জন্য মসজিদের মার্কেটে খোরশেদের দোকানটির দিকে সে তাকায় কিন্তু খোরশেদের দোকান তখন বন্ধ। সে তখন চিল্লায় যাওয়ার প্রস্তুতি হিসেবে বালিশ-কাঁথা নিয়ে আসা এক যুবকের কাছে মোবাইল থেকে একটি ফোন করার অনুরোধ জানালে যুবকটি খুব কড়া গলায় জানতে চায়, ‘আমার মোবাইল নাম্বার দিয়া কারে ফোন করতে চান?’
তাবলিগ-জামাতের লোক হয় নম্রভদ্র। কিন্তু এই যুবকের বুকভরা অবিশ্বাস আবদুল বাতেনকে অনুমান করতে বাধ্য করে যে, এটি এই যুবকের প্রথম চিল্লা-যাত্রা। যুবকের দিলে রহম আসতে আরো কিছু চিল্লা-যাত্রার প্রয়োজন আছে। তথাপি যুবকের মনের সন্দেহ দূর করতে আবদুল বাতেন ফিসফিস করে বলে, ‘এনায়েত ভাইরে।’
যুবকটি বেশ বিরক্ত হয়ে বলে, ‘এনায়েত কেডা?’
এনায়েতের মতো একজন গুরুত্বপূর্ণ লোককে না চেনায় আবদুল বাতেন বেশ বিস্মিত হয়। সে ফিসফিস করে বলে, ‘তারে চেনেন না! হেয় এ-এলাকায় পুলিশের সোর্স।’
এবার যুবক কৌতুক করে বলে, ‘কোন পুলিশের সোর্স? আসল পুলিশের, না ভুয়া পুলিশের।’
আবদুল বাতেন দীর্ঘদিন ধরে জেনে এসেছে এনায়েত পুলিশের সোর্স। কিন্তু আসল পুলিশের সোর্স নাকি ভুয়া পুলিশের সোর্স, নাকি এনায়েত নিজেই ভুয়া সোর্স সে-প্রশ্ন মনে আসেনি। তার মনে হয় আজকের এ-ঘটনা অত্র পাড়ার মানুষের জীবনে বড় রকমের প্রভাব ফেলতে পারে। এরপর যদি সে কারো কাছে পরিচয় দেয়, সে আমতলা মসজিদের মুয়াজ্জিন, তাহলে লোকে জিজ্ঞেস করবে – আসল মুয়াজ্জিন না ভুয়া মুয়াজ্জিন?
এমন ভাবনার বশবর্তী হয়ে আবদুল বাতেন আপাতত ভোলার লালমোহনের দেশি ভাই এবং পুলিশের সোর্স এনায়েতকে ফোন করার সিদ্ধান্ত স্থগিত রেখে পুলিশদের দিকে নজর দেয়। ইন্সপেক্টর জসিম এবং ইন্সপেক্টর সাহাদত একজন আরেকজনকে নিয়ে একটি মাইক্রোর পেছনে গিয়ে খুব আন্তরিকভাবে এবং সম্পূর্ণ গোপনীয়তা রক্ষা করে কী যেন আলাপ করে। তাদের মধ্যে একজন আরেকজনকে কী যেন বোঝাতে চায়।
হেমায়েত তখন নানরুটির কারিগর স্বপনকে বলে, ‘বুঝলি, দুপক্ষই ভেজালে পড়ছে। যারা আসল পুলিশ তাদের এখন নকল পুলিশ চেনার পর চইলা যাওনের উপায় নাই। আইনমতে তাদের অ্যারেস্ট করন লাগে। আবার নকল পুলিশও ধরা দিতে চাইবো না। যদি উভয় পক্ষ ছাড় না দেয় তবে একটা বড় ধরনের গোলমাল হইবো।’
স্বপন রুটি-বেলা বন্ধ করে চিন্তিত গলায় জানতে চায়, ‘ওস্তাদ, হোটেলের শাটার কি নামায় দিমু?’
হেমায়েত মাথা দুলিয়ে বলে, ‘না, হেই সম্ভাবনা কম। কারণ জানের মায়া কারো চে’ কারো কম না।’
স্বপন কিছুক্ষণের ভেতর টের পায়, হেমায়েতের কথাই সত্য। দীর্ঘ আলাপ শেষে আসল পুলিশ আর নকল পুলিশ সম্ভবত কোনো এক বিষয়ে একমত হয় এবং তারপরই দুজন নিজ নিজ গাড়িতে উঠে বসে। সম্ভবত কোনো এক প্রকারের সমঝোতার ভিত্তিতে ইন্সপেক্টর সাহাদতের মাইক্রোবাসটি ধীরে ধীরে ব্যাক গিয়ারে চলতে থাকে এবং ইন্সপেক্টর জসিমের মাইক্রোটি সামনের দিকে এগোতে থাকে।
এত সহজে একটি জটিল অঙ্কের সমাধান হতে চলছে দেখে আমাদের পাড়ার লোকজন অসন্তুষ্ট হয়। তাদের আশা ছিল – নিদেনপক্ষে এক-দুই রাউন্ড গোলাগুলি হবে এবং ভুয়া পুলিশ শনাক্ত হবে। আসল পুলিশ তাদের হাতে সেই ভুয়া পুলিশ দলকে তুলে দিলে তারা সাপের মতো তাদের গণপিটুনি দিয়ে মেরে ফেলবে। এজন্য কেউ কেউ আশপাশে মরা গাছের ডাল এবং মাথা থেঁতলে দেওয়ার উপযোগী কিছু ইটও দেখে রেখেছিল। কিন্তু সমঝোতার মধ্য দিয়ে গাড়ি দুটির চলে যাওয়ায় তারা কেউ কেউ রাগে ফেটে পড়ে। সকালের ঘুম নষ্ট করে, বাসিমুখে, প্রস্রাবের গন্ধময় রাস্তায় দাঁড়িয়ে থেকেও কোনো কাক্সিক্ষত সমাধান না পাওয়ায় কারো কারো কাছে সমগ্র ঘটনাটি একটা পাতানো নাটক বলেও মনে হয়। আবার তৃতীয় একটি দল আচমকা কিছু ঘটার আশায় গাড়ি দুটিকে অনুসরণ করতে করতে দলবদ্ধ হয়ে পাকা রাস্তা পর্যন্ত অগ্রসর হয়। কিন্তু কোনো ঘটনার জন্ম না দিয়ে ইন্সপেক্টর সাহাদতের গাড়িটিকে পাশ কাটিয়ে একসময় বড় রাস্তায় উঠে তীরবেগে কোথায় যেন হারিয়ে যায় ইন্সপেক্টর জসিমের গাড়িটি। ইন্সপেক্টর সাহাদতের গাড়িটিও আর আমাদের গলিতে ফিরে আসে না। সেটিও মুখ ঘুরিয়ে রং সাইড দিয়ে ইন্সপেক্টর জসিমের গাড়ির উলটো পথে কোথায় যেন রওনা দেয়। সম্ভবত তারা অনুমান করে যে, পিছিয়ে অন্য গাড়িকে জায়গা করে দেওয়ায় পাবলিকের চোখে তাদের পরাজয় হয়েছে। যেহেতু তারা আসল পুলিশ, সেহেতু পাবলিকের চোখে তাদের এই পরাজয় মর্মপীড়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এমন একটা লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে তারা আর আমাদের পাড়ার মানুষের সামনে উপস্থিত হতে চায় না বলে আমাদের পাড়ার লোকজন দলবদ্ধভাবে সিদ্ধান্ত নেয়।
জমজমাট নাটকের এমন সাধারণ মীমাংসা তাদের মনঃকষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কেউ বাড়ি ফিরতে ফিরতে, কেউবা হোটেল আল-হামজায় নানরুটি খেতে খেতে তাদের অসন্তুষ্টির কথা যখন বলাবলি করতে থাকে, ঠিক তখনই সাইরেন বাজাতে বাজাতে স্থানীয় থানার টহল দলটি নীল রঙের ‘পুলিশ’ লেখা গাড়িতে করে আল-হামজা হোটেলের সামনে থামে।
এই গাড়িটি এ-এলাকার সবার পরিচিত। প্রায়ই টহল দিতে দেখা যায়। তদুপরি গাড়ি থেকে যারা নামে তাদের কারো পরনে সাদা পোশাক নেই। তারা পুলিশের পরিচিত পোশাকেই নামে। এবং আবদুল বাতেন অবাক হয়ে দেখে, সেই গাড়ি থেকে পুলিশের সোর্স এনায়েতও গা-ঝাড়া দিয়ে নেমে আসে। আবদুল বাতেনের ভেতরে ভোলার লালমোহন নিবাসী এনায়েতকে নিয়ে যে-সন্দেহ তৈরি হয়েছিল, তা নিমিষে উধাও হয়ে যায়। সে দ্রুত এনায়েতের কাছে পৌঁছে ঘটনা বয়ানে ব্যস্ত হয়ে যায়।
এই পুলিশ দলটির নেতা সাব-ইন্সপেক্টর জাহাঙ্গীরকে কারো কাছে নিজের নাম বলতে হয় না। তার বুকের কাছে নেমপ্লেটে নাম লেখা আছে। সে প্রথমেই আল-হামজা হোটেলের ম্যানেজার হেমায়েতের কাছে জানতে চায়, ‘এখানে কিছু ঘটছে?’
খদ্দেরের কাছে ভাংতি টাকা ফেরত দিতে দিতে আবেগহীন গলায় হেমায়েত বলে, ‘নাহ, তেমুন কিছু ঘটে নাই। দুই দল ডিবি পুলিশের গাড়ি রাস্তার চিপায় আটকায় গেছিল। পরে একদল ব্যাক গিয়ারে যাইয়া আরেক দলরে যাওনের জায়গা কইরা দিছে।’
সাব-ইন্সপেক্টর জাহাঙ্গীরকে বিভ্রান্ত মনে হয়। সে ইনফরমেশন পেয়েছিল, দুই দল ভুয়া ডিবি পুলিশ এ-মহল্লায় মুখোমুখি হয়ে গুলি ছুড়তে শুরু করেছে। গুলিতে একটি বালক ইতোমধ্যে মৃত্যুবরণ করেছে কিন্তু বাস্তবে দেখে, কিছুই হয়নি। আর জনগণ যেহেতু উভয় পুলিশ দলকেই ‘আসল ডিবি পুলিশ’ বলে স্বীকৃতি দিচ্ছে, সেহেতু তার আর এ-বিষয় নিয়ে খোঁচাখুঁচি করার কোনো মানে হয় না। তবু নিজের ইমেজ রক্ষার্থে জানতে চায়, ‘ডিবি পুলিশ কোনদিকে গেছে?’
তার ভাবখানা এমন যে, খালি দিক নির্ণয় শেষ হলেই সে তার গাড়ি নিয়ে প্রবল বেগে যাত্রা শুরু করবে। কিন্তু উত্তেজনায় সকাল থেকে কাঁপতে থাকা আবদুল বাতেন যখন অগ্রসর হয়ে হাত নাড়িয়ে জানায়, ‘একডা গাড়ি গেছে এই দিগে; আরেকডা গেছে ওইদিগে।’ তখন সাব-ইন্সপেক্টর জাহাঙ্গীরের ঝাঁপিয়ে পড়ব-পড়ব ভাবটা কমে আসে।
যে-রাস্তা দিয়ে কথিত পুলিশের গাড়ি দুটি চলে গেছে, সে-রাস্তাটি সাব-ইন্সপেক্টর জাহাঙ্গীরের থানার অধিক্ষেত্রের বাইরে। নিজ অধিক্ষেত্রের বাইরে ঘটনাটি চলে যাওয়ায় সাব-ইন্সপেক্টর জাহাঙ্গীর এক ধরনের স্বস্তিবোধ করে। পুলিশের সোর্স এনায়েত ইন্সপেক্টর জাহাঙ্গীরের কাছে গিয়ে বিনয়ের সঙ্গে জানতে চায়, ‘দুই দলের মধ্যে কমপক্ষে একদল দল ভুয়া, কিন্তু কোন দল ভুয়া – আপনি কি জানতে পারছেন স্যার?’
সাব-ইন্সপেক্টর জাহাঙ্গীর গাড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটতে ভীষণ অনিশ্চয়তা নিয়ে বলে, ‘দেখি, কালকের পত্রিকায় কী লেখে?’