নাও এখন! ভোরবিহানের এই উঠতি বেলায় অপয়া হ্যাপাটা সামলায় কে বলোদিকিনি? ভিনগাঁওয়ের সেই পোঁদে পোক পড়া মর্কুটে কুত্তাটা মরে চিতিয়ে আছে বাঁশতলায়। কে যাবে ওটাকে বিলভাগাড়ে ফেলে দিয়ে আসতে? রোদ্দুর চড়তে না চড়তেই গন্ধ ছাড়তে লাগবে; তার বেলা?
কাদুবিধবা নাকে আঁচলচাপা দিয়ে বলে, মরণ!
ছাদুমুন্শি বিড়বিড় করে, অস্তাগফের…! আলামত নাজুক!
দুই
মাসটা কী, না বোশেখ – বরং বলা উচিত শেষবোশেখ। শুধু নামই সার। বাও নেই, ঢলক নেই। আকাশ পুড়ে কাল্লাশ। গাছের পাতাটি নড়ে না। বেড়ালেও এঁটো আঁচায় না। কালবোশেখির
দেয়াতুফান? ফুঃ! বিলডহরে শাপলা শুকায় কোলাব্যাঙ কান্দে। চাষির মাথায় হাত। চাষবাস সর্বনাশ।
আছে এক বেতো মজা নদী। নাম কালধুয়ানী। বয় তো বয় না। আঁকাবাঁকা চলনটি তার হেলেসাপের পারা। মনে হয় গোসাপেও চাটে না। ছিল নাকি এককালে রূপবতী যুবতী! ক্যা জানে? হালে দশা চিপ্পুস কঞ্জুসটি। তবু তো ভরসা বটে। গাঁও থেকে দূরে অচিন সাকিনে। তবু ছাওবুড়োর জানপেরমায়ু তারই মর্জিমাফিক।
তিন
– আবে অই বাপ আবাইট্যে! কুণ্ঠে গেচিস র্যা? ই মড়াটো লিয়্যা লদীতে ভাসায়া দিয়্যা আলচিস না কেনে? বিমারী ছড়াইবার লাগবে যি গেরস্থঘরে।
ছাদুমুন্শির নাকসিঁটকানি দেখে আবাই দাঁত কেলিয়ে হাসে হাতের আবডালে। হামি তো আচিই আবাইটো। তুমহি কী ফলনার মুহামুন্শিজি এয়েচেন গ? দাঢ়িনাচন সার খালি! কেনে উ যো মাস্তানগুলান ইয়াবা খায়্যা ছেঁড়িগুলার গুদ শুঁক্যে ফিরছে, অদের বুলছো না কী লেগে? যেচি হামি যেচি। তেলা কুকুরের মড়িটার ঠ্যাঙে দড়ি বেঁধে টানতে টানতে নিয়ে চলল আবাই।
একটান দুইটান হেঁইয়ো! আবাইয়ের জিভ ঝুলে হনু নুয়ে নাচার দশা। আসলে তো বড় বেশি বেচয়েন বেচারার কাঠামোখান। পেটেপিঠে একাকার মিশমার। হাড্ডির উপর খ্যাসখেসে চামড়া। তার ফাঁকে মাংসপেশি ছিলো নাকি? স্রেফ গুটলি-পাকানো দড়িদড়া। ইশ্কুলের পোড়োরা বলে, সেলামজি অবং সাহেব হেল্ত্মিনিস্টার!
গাঁওসীমানার তালতলায় আসতেই হাঁপিয়ে এলে যায় আবাই। কালধুয়ানীটো দূর আচে অখনো। মরুগগা শালোর মড়ি! কাঁচা আম পড়্যে আচে যি গাছতলাতে। লে লে ইবার আম খায়্যা লি। কুকুরের দড়ি ছুঁড়ে ফেলে আম খেতে শুরু করে আবাই। কপাল বলো! আম তো আসলে এবার সব মুকুলেই ঝরে গেছে প্রায়।
শুখা শালো খরায় পুড়্যা পুড়্যা! হামি আবাই এই কাট ইবারা। তারেনারেনারে … … …
একলা আবাই চরজমিনে নেমে যায়।
চার
কালধুয়ানী এখনো বহু দূর বাপা। এ তো সবে শুরু চরের। ধু-ধু ধূসর। পা পুড়ে জ্বালা ধরছে। হাওয়ার গুষ্ঠি ফেরার। তামাশা লেগেছে মাঝআশমানে। শাদা আগুনের ঝিলকি তামাশা। এই দেড়পহর বেলাতেই। জ্যষ্টিআষাঢ়ও শুখা যাবে মন বুলচে। শাঙনভাদর হামার জন্মমাসট্যে বটে। ধুঁকতে ধুঁকতে হাঁটে আর প্রলাপ বকে আবাইসং। একা একলাটি।
অদ্ভুত কাণ্ড! তামাটে স্বভাবের এই তামাম মুলুকে একটাও জনমনিষ্যির ছায়া নেই।
ই শালো কথি যেচি গ হামি? আঁতকা লাগা গলায় নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করে আবাই। সঙ্গে সঙ্গে জবাবও জোগায় খলবলিয়ে, যেচি হামি দেশগাঁও ছা’ড়্যা পরোবাসে। ই বগলে দানাপানি নাইখ।
হুই যে চিকচিকে রুপোলি নাগিনীর পারা কালধুয়ানীর ধারা দেখা যায়। উয়ার ধারা ধর্যা ধর্যা ভাস্যা যাব্যো হামি।
পাঁচ
মানুষ পোড়ে। মাটি পোড়ে। খন্দখামার পুড়ে খাক। ভুঁইজমিনে ফলন নেই। পড়ে আছ অনাবাদি আঁটকুড়ি অফসলা। লয়নের তারা জ্বলে যেচে যি। আল্লামিয়া! ই বছরট্যেয় এতো নারাজ বটে কেনে তু? পানি দিবিনি? হামি আইজ লাও বায়্যা র্পশ্চিম দ্যাশে যাব্যো চল্যা। ব্যুলচি তুকে।
হা কপাল! উ লদীখান দূরে দূরে অখনো। বাগে আসবিনি তু? ঠ্যাঙে যি বাত রসালচে বাপা ইদিকে। হাড়পাঁজরাসার ই গতরখান টানতে লারচে আর।
হেই নসিব! নদীতে আয়্যা পড়নু তেভে? চরণ ধুয়্যা লিই। কিন্তুক শালো পানি ভি ফুটছে আগুনে। উ রি রি পাও জ্বল্যে যায়! তবু তপ্ত পানি আঁজলা ভরে গিলতে লাগে আবাই। পিয়াস লেগে গলা কাঠ। কিন্তুক আঁচ লেগে তলপেটে পিলেটা না ফেটে যায় মা গে!
আবাই নজরে হাত আড়াল করে দূরে বহুদূরে নিশানা খোঁজে। উই যেখানে বাঁক নেবার জন্যে মোচড় মেরেছে কালধুয়ানী।
যাবে কোথায় কত দূরে? উই – উই যি দ্যাখা গেলচে বটে। হাড়পাঁজরাসার গতর হুই তো পানশিখান হামার। কথি যাব্যে ছাড়্যা হামাক? হামার ময়ূরপংখি লাও!
খুঁটোয় বাঁধা নৌকোটা দুলছে মন্দ মন্দ। পাছগলুইতে উঠে দড়ি খুলে দেয়।
সূর্য ফুঁসতে লেগেছে। আবাই নৌকো ভাসায়।
হ্যাঁ! দেশগাঁয়ের বাঁধন ছেড়ে আবাই নিমংগার তালাশে র্পশ্চিমেতে যায়। বদর! বদর!
ছয়
হা রে লদী কালধুয়ানী! তুকে কী বুলব্যোটা কী হামি অখন? ছিলিস কূলছাপানো বানডাকানো ভরসোহাগিনী। অখন হলছিস গতরখুয়োনী সিড়িঙে শুখানী। তুর ই মরণদশা দেখ্যা কান্না পেছে হামার! কালধুয়ানীর পানিতে বৈঠা মারতে মারতে গলার স্বরে হাহাক্কার তোলে আবাই। দুপারে মানুষজন নেই। সাক্ষী কেবল হল্কা ছড়ানো পিচেশ দুপুর। হ্যাঁ বটে, চ্যাতা সূর্য মস্তকসিধা।
উলিপুর যায়, সিলিমপুর যায়; রসুলপুর সেও পিছে পড়ে। বাইতে বাইতে গাঁওর পর গাঁও ছেড়ে আসে নাও। কে জানে এসব গ্রামের নামসাকিন কিবা? লে বাবা! ঘরবাড়িও নেই দু-একখানা। শুধু রোদজ্বলা শুখা চর। চর জুড়ে বালি আর বালি। নদীটাও মরে এসেছে কুঁৎতে কুঁৎতে। কী – মরুভুঁই হয়ে এলো নাকি দুনিয়াটা?
আতঙ্কের তাড়ায় ভুখটুখ মাথায় উঠেছিল বুঝি। নাড়ি চিঁ চিঁ করে কাঁদে তবু। আধথাবা মুড়ি চিবিয়েছিল কোন্ সে রাতপহরে! এতক্ষণে ভস্ম হয়ে গেছে সব। দুটো কাঁচা আম কুড়িয়ে নিয়ে এসেছিল পথ থেকে। তার একটিতে দাঁত বসায় আবাই।
খুঁটোয় নৌকো বেঁধে পাটাতনের উপর ঝিমুচ্ছিল বেশ। নৌকোয় মন্দ মন্দ দুলুনি। তার তালে তালে মৃদু মৃদু নাকডাকানি।
খুসখাস শব্দে চোখ খুলে যায় আবাইয়ের। শুয়ে শুয়ে নজর করে দেখতে থাকে। কারা যেন তীর ধরে হেঁটে যায়। কাঁধে গামছা, হাতে হেঁসো।
কথি যেচো গা বাপ দংগলে মিলে?
ঘরকে ফির্যা যেচি গ বাপ। ইরি ধান কাটবু মন করে্য বাহির হচি। সব চিটে হয়্যা গেলচে হায় হায়! ই খরায় বালবাচ্চাগুলান ভুখায় মইরব্যে মন বুল্যে। তা তু ই অফরওক্তে কুণ্ঠে যেচিস গ বাপজি লাও লিয়্যা?
যাব্যো হামি র্পশ্চিমদ্যাশে বা’জি। দোয়া করো!
হাঁ হাঁ তাই যা গে বাপ। হেথাকে দানাপানি বিলকুল মঙা অখন। আল্লাপাকে নারাজ হলচে। ম্যাঘ নাই ঢলক নাই। লদী স্যাও ভি ম’জ্যা আলচে। মরুভুঁই হয়্যা যেচে তামাম।
সাত
যেতে যেতে পিছু ফেরে দলের একজন। গলা উঁচিয়ে প্রশ্ন করে, তুহার নামটো কী র্যা বাপ? ঘর কুন্ঠে?
নাম হামার আবাই মাত্বার। পিতা দলুই মাত্বার। কেওই নাইখ বেশ্বভেম্মাণ্ডে। অনাথ এতিম। গাঁওর খপর পুছছো গা? নাম তো সি ভাটিগনজো আচে। দোয়া করো।
যা তেভে লিজমনে। আল্লারাসুল ভরসা!
দলটা মুছে যেতে যেতে ভীষণ রকম দুবলা হয়ে পড়ে আবাই। খাই খাই ছিল পেটের মধ্যে। এবারে বড় ফাঁপা ফাঁকা শূন্যতা ঢুস মারে বুকের ভিতর। কথা নেই বার্তা নেই লু হাওয়া ঝলক দিয়ে যায় কানের লতিতে। ছিল রউদের চড়া তার। মাজ মরা ছায়ার ভিরকুটি অখন। কী যেন অপদ্যাও ঘনায় এই উতরঅফরে! কী – কী সে? অনেক পরে খেয়াল হয়, তলায় ঠেকে গেছে নৌকো, বৈঠার গোঁত্তায় নড়ে না চড়ে না। শুধু আওয়াজ ওঠে ঘ্যাসঘ্যাস।
হেই ব্যাটা আবাইসং! তর লৌকো আর আগুবে না যি। হুঁশ নাইখ? লদী আর নাই। হেজেমজে শুখায়্যা গেলছে কখন জানি! ডাবনা চইতা কাঁহাকা!
নৌকো ছেড়ে ভুঁয়ে নেমে পড়ে আবাই। স্রেফ বালু। হাঁটুসমান বালুর মধ্যে গেদে যায় সে। কালধুয়ানী নাই – নাইখ হায়! কথি গ্যালো হামার সি লদীটো? কুথা বটে তু? হামাক র্পশ্চিমেতে লিয়্যা যাবিনি? আঃ, হায় হায় গ! হামার লদীটো!
হাতে আঁচড়ায় পায়ে কোঁদে, নদী কোথাও নেই। শুধু বালু আর বালু। ছুটতে ছুটতে জিভ বেরিয়ে যায়। ঘামে সর্দিতে ন্যালাভোলা আউলা। কিন্তুক ধরা দেয় না কালধুয়ানী।
আট
অয় বাপ কুত্তাটো! খ্যামা দে হামাক! লাশট্যা তুহার আমতলাতে বেসজ্জন দিয়্যা আলচি। গোর দিইনিখ। এই নাককান মুলচি হামি! রপরাদট্যে খ্যামা দে না কেনে! দিশাট্যে দ্যাখায়া দিব্যি না?
হাপুসঝোরে কাঁদতে কাঁদতে চেতন খুইয়েছিল আবাই।
কার যেন এই মিষ্টি গলার সুর? মধুর অধিক মধুর। কোন্ সে আশমান থেকে ঝুরে আসে? নাকি পাতাল উপ্চিয়ে শূন্যে ছড়ায় লোরী?
এ কীসের ম ম খোশবু সারা নাকে এসে লাগে?
আবাই চোখ মেলে চায়। দুচোখে বালির কিচকিচ। ঠোঁটে বালি দাঁতে বালিদানা।
এ তবে কিসের খোশবু? বুক ভরে যায়। মনে লাগে যেন পাকসাফ পারা সারা চরাচর।
কানে এসে পশে প্রাণ জুড়ানো মৌ ঢালা গীতের রেলা। কী যে মিঠা মন মজানো গ! আশনাইয়ে আউরে আসে দিল।
আবাইসং কি দিওয়ানা হয়ে গ্যালো? কখন যে সাঁঝ ঝেঁপে এসেছে মালুম নেই। শুধু আঁধার গগনজোড়া। কালিবরণ আঁধার ভুবনময়।
উই – উই – হুই যে গীত ভেসে আসে সামুনকার অন্ধকার থেকে :
হামি নারী জলবতী কন্যা গ
নিবাস উজান দেশে।
ভাটির দেশের মাঝি গ তুমহি আইসচ
মরা গাঙে ভেসে॥
নয়
উজান দেশের ওই না গীতের লহরী হাতছানি দিয়ে দিয়ে ছুটিয়ে নিয়ে যায় কোন্ সে পশ্চিম মুলুকের ঠিকানায়!
পানির দেশে আস্যো গ মাঝি
জলবতীর দেশে।
তুমায় লিয়্যা গইড়বো গ বাসর
লীলাছলে হেস্যে॥
– মাঝি গ!
বালুস্তূপে থুবড়ে থুবড়ে অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে বইঠামারা হাতের বেদনা ভুলে ধেয়ে চলে আবাই। নদীহারা নৌকোহারা ভুখতিয়াসায় চেতনহারা মানুষটা যোজন উজিয়ে ছোটে।
হা রে বখিল আকাশ! ফুটিক তারাবাতি জ্বেলে হামাক দিশা দ্যাখা। হামি পরশ্চিমেতে যাব্যো, হামি পানির দেশে যাব্যো, হামি জলবতীর দেশে যাব্যো গ!
কলকল কলকল – কানে এসে পশে জলকল্লোলের বাদ্যি। সামনে আঁধারে অদৃশ্য কোথাও দিগন্তপ্লাবী কলরোলের তুমুল ডাক। আবাইকে ডাকে। ভাটির দেশের আবাইটাকে উজান দেশের জলচ্ছল ডাকে অই।
আঃ হায় গ নারী জলবতী ছলকুমারী! এ কী তোমার আখেরি লীলাখেলা! সমুখে তুঙ্গ জাঙাল। ওপারে মাথা খোঁড়ে কুহর তোলা জল। এপারে বালি, ওপারে সমুদ্দুর। কে তুড়বে এই নির্দয় নিষ্ঠুর জলকপাট?
আবাইয়ের রোদনে সারা জাহান আহাজারি করে বটে। নিরেট দেয়াল মুখ খোলে না তবু। শুধু হাহাকার দোজাহান লয় করা।
ই যে গজব লাম্যাছে কারুণ আল্লামালিকের!
দশ
পরদিন ভোরবেলাকার শাদা রোদে দিকদিগন্ত ঝলসে যেতে লেগেছে। আকাশে খেচর পক্ষীর পাখনা পোড়ে। ক্ষুধার্ত শকুন নরমাংসের গন্ধ শুঁকে ভুঁইয়ে নেমে আসে। দাঁতেনখে লোভ আর জিঘাংসা। আর রক্তিম রিরংসা।
শকুনেরা স্বভাবত খেচর। দোপেয়ে মানুষের মতো সীমাবাঁধা ভূচর প্রাণী নয়। ওদের পিঠে জোড়া জোড়া ডানা জুড়ে দিয়েছে বিধাতা। নরমাংসভোজে তুষ্ট পক্ষিকুল জলতেষ্টায় মরিয়া হয়ে উঠলে মরুনদী পেরিয়ে পাখশাট মেলে জাঙাল ডিঙিয়ে ওপারে উড়াল দেয়। ওখানে উর্বরা রসে গর্ভিণী মাটি। নদীগুলোর কূলে কূলে টলমল জল। পারে পারে শ্যামলেসবুজ মনোহারী পাতাবাহার। উজানগাঁওয়ের জলবতী কন্যা হোথায় থাকে গো।