পরিবর্তন

পরিবর্তন
আজ পলাশ শশুড় বাড়ি যাচ্ছে। তাকে বিদায় দিতে সবাই এসেছে। মা চাপা স্বরে কান্না করছে ছেলেকে শশুড় বাড়ি পাঠাচ্ছে এই রাগে। কি ভাবছেন ছেলে শশুড় বাড়ি বেড়াতে গেলে এমন কি হলো? না। পলাশ শশুড় বাড়ি বেড়াতে যাচ্ছে ন। মেয়েরা যেভাবে শশুড় বাড়ি যায় ঠিক তেমন। না, ঘর জামাইও না৷ আমি নীলা। আমি এত দিন শশুড় বাড়ি ছিলাম৷ মানে পালাশদের বাড়ি। এখন পলাশ ওর শশুড় বাড়ি যাচ্ছে মানে আমার বাড়ি। আমরা দুই জনেই মা বাবার একমাত্র সন্তান৷ আমারো কোন ভাই বোন নেই। পালাশের ও৷
আমরা দুইজন প্রায় সাত বছর প্রেম করে এই বিয়ে। আমি বিয়ে করে মা বাবাকে ছেড়ে কখনো যেতে চাইতাম না। একা হয়ে যাবে ওরা। তাই পালাশ কে শর্ত দিয়েছিলাম যদি বিয়ে করতে চাও তাহলে একটা শর্ত। না আসলে দুইটা শর্ত। প্রথম, বিয়ের খরচ দুই পরিবার সমান দিবে। কারণ কেউ বিয়ে করে কাউকে দয়া করছি না যে মা বাবা সারজীবনের জমানো টাকা একদিনের জন্য শেষ করবে। দুই জনেই একই জায়গায় পড়ালেখা করেছি। দুইজনেই জব করি। ইনকাম করি। কেউ কম না। দ্বিতীয় , আমরা যেহেতু দুইজনেই একমাত্র সন্তান আমাদের দায়িত্ব মা বাবাকে দেখা৷ তাই ৬ মাস আমি তোমাদের বাসায় থাকলে ৬ মাস তুমি আমাদের বাসায় থাকবে।
পলাশ মেনে নিয়েছিল। ভেবেছিল হয়ত আমি পরে ভুলে যাব। না আমি ভুলি নি। পলাশ এইটা ওদের বাসায় জানায় নি। কিন্তু আমি ৬ মাস পর যখন চলে আসতে চাইছি ওকে নিয়ে বাধ্য হয়ে ওকে বলতে হলো। অনেক ঝামেলার পর আজ পলাশ শশুড় বাড়ি যাচ্ছে। পলাশের আপত্তি নেই কারণ ও তো শশুড় বাড়ি গেলেই জামাই আদর পায়। কিন্তু ও জানে না এইবার ওর জীবনের সব হিসাব নিকাশ উল্টো হয়ে যাবে। মা খুব যত্ন করে পলাশকে বরণ করেছে। আশে পাশের মানুষ জন ডেকে চা-নাস্তা খাইছে। খুব মজা হয়েছে৷ আমি আসাতে আমার কাজিনরা এসে খুব মজা করেছে৷ পলাশও ভীষণ খুশি। দুই জনেই চাকরিতে চলে যাই। ওর সাথে ঘুরতে যাই। মা বাবা ও আমি আবার বাসায় আসাতে যেন বাসায় প্রাণ এলো। কিন্তু মাস খানিক পার হতে হতে মলিন হতে থাকে পলাশ। পলাশ খেয়াল করে আমি চেঞ্জ হচ্ছি। পলাশ যেহেতু শশুড় বাড়ি এসেছে কিছু তো করতে হবে ঘরের কাজ। বাবা অসুস্থ হওয়াই পালাশকে যেতে হলো বাজারে৷ পলাশের ডিউটি হয়ে গেলো বাজার করা।
প্রায় তারাতারি ঘুম থেকে তুলে দেয় মা ওকে ডাক দিয়ে বাজার করে দেওয়ার জন্য৷ ও বিরক্ত হয় কিন্তু করতে তো হয়। আমাকে বলতে আসে প্রতিদিন সকাল সকাল উঠতে হয় তোমাদের বাসায়। আমি বলি, তো কি হয়েছে? এইটা তোমার কাজ। কেন আমি উঠতাম না তোমাদের বাসায় সকাল সকাল নাস্তা বানানোর জন্য? কই আমি তো কোনদিন বলি নি? পলাশ কিছু বলে না। একদিন ওর ভাল লাগছিল না। তাই দেরী করে উঠে বাজারে যাওয়াই মাছ ভাল পায় নি। এই নিয়ে মা ওকে কিছু না বললেও রান্না ঘরে গিয়ে নিজে নিজে গজগজ করে। পলাশের খুব মেজাজ খারাপ হয়। আমি দেখেও না দেখার ভান করি। আমাকে তো ওর মা সমনাসামনি অনেক কথা শুনাতো ঘুম থেকে উঠতে দেরী হলে। পলাশ তো কোনদিন বলত না।
-মা আজ ওর শরীর ভাল ছিলো না।এইভাবে বলিও না। পলাশ ডাকছে,
-নীলা আমার শার্ট কোথায়?
-কিসের শার্ট? আমি কি জানি ? ওখানে তো আছে সব।
-আছে। একটাও আয়রণ করা নেই।
-তো দোকানে দিয়ে আসো নি কেনো আমার দোষ? করে নাও নিজে পারলে আমার টাও করে না। পলাশ চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে।
-কি হলো?
-আমি এইসব কখনো করেছি? মা করে দিত দোকানে দিতে ভুলে গেলে।
-আমিও তো কখনো করি নি। কিন্তু তুমি আর তোমার মা তো সেদিন বলেছিলে এই সামান্য কাজটাও আমার মা আমায় শিখায় নাই? আমি শিখে নিয়েছিলাম নিজে নিজে। তুমিও শিখে নাও। কেন তোমাকে শেখায় নাই কেন তোমার মা?
-এই আমার মাকে টানতেছো কেনো এইখানে?
-তুমি কেন টেনেছিলে? মনে পড়ে কিছু?
পলাশ কিছু বলে না। আয়রণ ছাড়া শার্ট পড়ে নাস্তা না করে বের হয়ে যায়। পাশের বাসার আন্টি এসেছিলো৷ পলাশ ল্যাপটপে অফিসের ইম্পর্ট্যান্ট কাজ করছিলো। মা বলল- বাসায় ডিম শেষ হয়ে গেছে। একটা নুডলস আর ডিম এনে দাও।
-মা আমার কাজ টা খুব ইম্পর্ট্যান্ট। প্লিজ ১০ মিনিট পরে যাই?
-তোমার কাজের জন্য মেহমানকে বসায় রাখব নাকি?
নীলার মা এমন ভাবে বলল, পালাশের রাগ লাগলেও উঠে যেতে হলো কারণ এইটা ওর মা না৷ চাইলেও ঝাঁড়ি দিতে পারছে না কিংবা সেই আপন ভাব টা পাচ্ছে না। এইটা শাশুড়ি মা। পলাশ দেখল সবাই নাস্তা করার পর ও ওকে কেউ ডাকছে না। তাই ও নিজে গিয়েই নুডলস বাটিতে নিয়ে খেয়ে নিলো। চা টা একদম ঠান্ডা। নীলা তখনো বাসায় আসে নি অফিস থেকে শাশুড়ি গল্পে মজে আছেন। পলাশ নিজে গিয়ে চা গরম করতে গেলো। কিন্তু ঢালতে গিয়ে হাতে লাগল চা। এতে করে হাতের কাপটা হাত থেকে পড়ে গেল। খুব জোরে আওয়াজ হলো। নীলার মা দৌড়ে এল-
-কি হলো? কি ভাঙ্গছে?
-মা, চা গরম করতে গিয়ে হাতে লেগে পড়ে গেছে। মা খুব বিরক্তি এনে মুখে,
-যা জানো না তা করতে কে বলেছে? এত গরম চা খেতে চাইলে গরম থাকতে খাওনি কেন? গেল সেটের কাপ।
আমার খুব লাগল কথা গুলো এখন আমাদের বাসায় হলে মা আগে এসে আমার হাত দেখত। তারপর কাপ৷ কিন্তু খুব জ্বলছে হাত। নীলার মার সেদিকে খেয়াল নেই। বাথরুমে গিয়ে পানি দিলাম এতে আরো জ্বলে উঠল। খুব কান্না আসতে চাইছে হঠাৎ, মায়ের কথা মনে পড়ছে। মা কে ফোন দিলাম।
– মা কেমন আছো?
-ভালো, তুই কেমন আছিস বাবা? ঘর খালি খালি লাগছে তুই নাই তাই!
-আমার ভাল লাগছে না মা। তোমার কথা খুব মনে পড়ছে। এত দিন খেয়ালও করতাম না তুমি আমার কত যত্ন করো।
-কি হয়েছে? তুই ভালো আছিস?
– হ্যাঁ মা ভালো৷ আচ্ছা মা হাতে চা লাগলে কি দিতে তুমি আমায়?
– কি হয়ছে? চা পড়ছে? কিভাবে? বেশি পুড়ছে?
-না না। টেবিলে ছিলো মোবাইল টিপে টিপে ধরতে গিয়ে পড়ছে।
-পেস্ট লাগা তারাতারি। না হলে ফোস্কা পড়বে।কেন তোর বউ আর শাশুড়ি কোথায় ওরা জানে না?
– নীলা এখনো আসে নি। আর ওর মা কে বলি নি।
-অহ আচ্ছা, পেস্ট লাগা।
কি অদ্ভুত চেঞ্জ হয়ে গেছি। কিছুক্ষন পর নীলা এলো। ওর মাকে কাপ নিয়ে প্যানপ্যান করতে দেখে ও রুমে এসে বলল-
-এই তোমার নাকি হাতে চা পড়েছে? কোথায় দেখি? লাগিয়েছো কিছু। ওয়েট আমি বার্নার ক্রিম আনছি।
এতক্ষনের মন খারাপ নীলার এই চিন্তা দেখে দূর হলো। আসলে ও তো আপন শুধু এইখানে। ওকে ভালবেসে তো এসেছি এইখানে।
কিছুদিন পর নীলার কাজিনের বিয়ে। নীলা তা নিয়ে খুব এক্সাইটেট। সবাই মিলে গেলাম বিয়েতে। আমাদের বাসার সবাইকেও আসতে বলছে। আমার মা বাবাকে দেখে সত্যিই কি যে ভালো লাগল। নীলা পার্লার থেকে সেজে মা বাবাকে একটা নমস্কার করে চলে গেলো কাজিন দের সাথে। আমি বসে রইলাম একা। কি আর করব তেমন কাউকে চিনি না নিজের ঘরের বিয়ে হতো খুব মজা করতাম। কিছুক্ষন পর নীলা এসে ছবি তোলার জন্য নিয়ে গেলো। ছবি তোলার পর ও আবার উদাও। একসাথে খাবো তাও না সে তার ফ্রেন্ডদের সাথে খাবে। আমি মায়ের সাথে টুকটাক কথা বলছি। মা বলল- কবে আসবি বাবা? ভালো লাগে না। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলি। আমারো যে শশুড়বাড়ির শখ মিটে গেছে। আমি বলি-
-আর কয়েকটা মাস।
মায়ের চেহেরাটা দেখে কলিজা ছিড়ে যাচ্ছে। হঠাৎ মনে হলো আসলে মেয়েরা মা বাবা ছেড়ে যায় তাদের কত কষ্ট লাগে এত বছরে আদরের মা বাবা ছেড়ে আসতে। নীলা আমার সাথে খেল না। কাজিদের সাথে খেলো। মা বাবা চলে যায়। আমি নীলাকে ডাকতে গেলে নীলা খুব রুডলি বলল- আমি যাব না তুমি মা বাবার সাথে চলে যাও। খুব খারাপ লাগল। সবার সামনে এইভাবে বলেছে। তাও বললাম-
-আমিও থাকব?
-তুমি কি করবে এইখানে মেয়েদের মাঝে। যাও কাল অফিস আছে না?
-তোমার নেই?
-আমি ছুটি নিয়েছি।
-বললে তো আমিও নিতাম।
নীলা পাত্তাও দিলো না। চলে গেল অন্যদিকে আমি ওর মা বাবার সাথে চলে এলাম। কিন্তু সারারাত ঘুম হল না। প্রথমে খুব রাগ লেগেছে এরপর কষ্ট এরপর এক রাশ অভিমান হলো। সকালে ঘুম এলো। নীলা 7 টায় এসেছে। এসেই বিছানায় পড়ল। আমার রাগ কষ্ট অভিমান সব ভোতা হয়ে গেলো। সে একবার আমায় ডাকল ও না। সব ভুলে আমি ডাকলাম,
– বিরক্ত করো না তো।
-কি? তুমি আমাকে ফেলে সারারাত মজা করে এসেছো আমি কিভাবে থেকেছি জানো তোমাকে ছাড়া? তুমি জানো না, তোমাকে ছাড়া ঘুম হয়? নীলা মাথা তুলে বলল –
– তুমি জানতে না? তোমাকে ছাড়া আমারও ঘুম হতো না। তাও তো তুমি তোমার ফ্রেন্ড মহিনের বিয়েতে সারারাত ছিলে না?তোমার মামাতো ভাইয়ের বিয়েতে ছিলে না ? তোমার অন্য ফেন্ডদের সাথে ছিলে না কত রাত? আমি ডাকতে গেলে বলেছিলে- বৌ মানে প্যারা।
আমিও খুব কষ্ট করে কাটিয়েছি। তুমি পাশে ছিলে না তার জন্য না তুমি আমায় ফেলে মজায় ছিলে এই জন্য যেমন টা আজ তোমার লাগছে। পলাশের মনে পড়ল। ও তো অনেক বার নীলাকে বিয়ে বাড়ি থেকে একা পাটিয়েছে। খবর ও নেয় নি। পরের দিন যখন নীলা বলেছিল।আমি বলেছিলাম – ন্যাকামি করো না। এরপর ঘুমিয়ে গেছিলাম ওর অভিমানটা কখনো ভাঙ্গায় নি। নীলার মা বাবা বেড়াতে গেছে। অনেক কাজ করতে হচ্ছে৷ নীলা তেমন কিছুই করে না। এমনকি সেদিন রান্নাটাও করেনি। নিজে নিজে এখন অনেকটা পারি রান্না করে ফেললাম ভাত আর ডিম ভাজা আর রান্না করা মাংস ছিলো। নীলা একটু দেখতেও এলো না কি করছি। নীলাকে ডাকলাম। ও মোবাইলে নিয়ে ভিডিও কলে কথা বলছে।
-আমি তোমাদের বাসায় এসে রান্না করছি আর তোমার কোন ভ্রুক্ষেপ নাই?
– তো তাতে কি? আমিও তো তোমাদের বাসায় গিয়ে প্রতিদিন রান্না করেছি। তুমি তো আজ করছ।
-ওটা তোমার শশুড় বাড়ি।
-আর এইটা তোমার শশুড় বাড়ি এইখানে কাজ করলে ছোট হবে না।
নিজের বাড়ি ভাবো সব ঠিক হয়ে যাবে। আমার মা বাবাকে আপণ ভাবো। পলাশ কিছু একটা বলতে গেল। আপন ভাবাবো না কেন? কিন্তু বলতে পারল না কারণ নীলার বলা কথা গুলো খুব চেনা লাগল। পলাশ বলেছিল নীলাকে। নীলাকে বললাম – আমি ভাত রাঁধছি তুমি টেবিলটা গুছিয়ে রাখো। নীলা সেটাও করল না৷
– নীলা এই সামান্য কাজ টা করতে পারলে না?
-সামান্য কাজ হলে তুমি করোনি কেন?
পলাশের খুব রাগ উঠতেছে। কিন্তু এই কথাটাও চেনা। পলাশ বলেছিলো। সামান্য কাজ হলে তুমি করোনি কেন? আসলেই গেস্ট আসলে ওরা যখন রান্না-বান্না সব কাজ একা হাতে করে সামান্য সামান্য কাজ টেবিল গুজিয়ে দেওয়া থালা বাসন নামানো টুকটাক সাহায্য করলে কতটা ভাল লাগে। নীলার মা বাবা আসার পরে নীলাকে বললাম- -চলো আজ বাসা থেকে ঘুরে আসি রাতে চলে আসব।
-আচ্ছা, মা বাবার থেকে পারমিশন নিয়ে আসো।
-কেন? আমি আমার বাবা মায়ের কাছে যেতে ওদের পারমিশন কেন লাগবে?
-কেন কি আবার? নিতে বলছি নিবা।
-মানে?
– তো আমাকে কেন নিতে হতো তোমার মা বাবার থেকে পারমিশন আমার বাপের বাড়ি আসতে? সবার কাছে গিয়ে গিয়ে? তার উপর কত কথা? জেনো আমি কেনা গোলাম? কিছু না বলে মা বাবার রুমে গেলো।
– আমি আর নীলা একটু আমাদের বাসায় যাচ্ছি। বাবা ভ্রু-কুচকে বলল-
– এত যাওয়ার কি আছে ওখানে ? ঔ দিন না বিয়ে বাড়িতে দেখা হলো।
খুব গা-জ্বালা করছে এমন কথা শুনে। আজব তো। আমাকে ওরা এত বছর মানুষ করছে আর এখন নাকি তাদের কাছে যেতে ওদের পারমিশন লাগবে? নীলার কাছে গিয়ে বললাম-
-তোমার বাবা এইভাবে কথা বলে কেন?
-কিভাবে?
-ওখানে যাওয়ার কি আছে? ঔ দিন তো দেখা হলো।
– শশুড়ে এমন একটু বলতেই পারে। মেনে নাও।
-নীলা,
-কি? মনে পড়ছে না কিছু? সেইম এই কথা গুলো আগেও তো হয়েছে।যখন আমি তোমাকে আসতে বলতাম বাসায়।
-হু, মনে পড়ছে। i m sorry. কিন্তু এখন চলো।
– তুমি একলা যাও, আমি একটু তুহিনদের সাথে বীচে যাব।
এইবার অসহ্য লাগছে। একাই বের হয়ে গেলাম। বাসার কাছাকাছি যেতেই সবাইকে দেখে কি যে খুশি লাগছে। কেমন যেনো সব আপন আপন। বাসায় যেতেই মা কিভাবে বুকে টেনে নিলো। আমিও ছোট বাচ্চার মত চুপ করে আছি। মা কি যে করছে। খাওয়া দাওয়া, কত কথা?
– কি রে তোর বউ এলো না কেন?
– ও নাকি ঘুরতে যাবে।
এত কিছুর পর ও নীলার নামে খারাপ কিছু বলতে ইচ্ছে করছে না। মনে হচ্ছে বললে নিজের গায়েই পড়ছে। তারপর ও মনে হচ্ছে নীলা এলে আরো ভাল হতো। মাকে ওদের বাসায় কি হয় কিছুই বললাম না।
শশুড়ের আনা ঘঁড়িটা দেখালাম। মা খুশিই হলো।
-তাহলে তো ভালোই আছিস শশুড়বাড়ি আমাদের ছাড়া।
-তোমারা তো তোমরা মা।
-থাক বাচ্চারা ভালো থাকলে আমরা মা বাবার ভালো থাকব। রাতে খেয়ে দেয়ে একাই ফিরলাম। নীলাকে দেখে মনে হচ্ছে না কোথাও গিয়েছিল। আমি ডুকতেই মোবাইল টিপতে টিপতে বলল-
-কি করে এসেছো নাকি আমাদের বাসার নামে বদনাম?
-কি বলো তুমি এইসব? আমি তোমার নামে কেনো বদনাম করব?
-ঔ বাসায় গেছো তো এইজন্যই আমাকে ফেলে?
-আমি তোমাকে যেতে বলেছি তুমি যাও নি।
-না,, তুমি তো বলতে আমি বাসায় যায় তোমাদের বদনাম করতে।
-আসলে নীলা আসো আমরা কথা বলি আসলে তুমি চাইছো টা কি? তোমার জন্য শুধু তোমাকে ভালবেসে আমি মা বাবা ছেড়ে এই বাসায় এসে তোমার মা-বাবার সাথে থাকছি।কাজ করছি যা আগে লাইফে করি নি৷ তোমাকে সাহায্য করছি অফিস করছি। তাও তুমি যদি ঠিক না থাকো আমার কেমন লাগে? আমার অসহায় লাগে এইখানে।মা বাবা ছাড়া৷ কেমন যে লাগে বুঝাতে পারছি না। তারপর তুমি আর আগের মতো আমার সেই নীলা নেই৷ নীলা কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বলল।
-বুঝতে পারছো পলাশ আমরা মেয়েরা সবার আদরের মেয়ে সব ছেড়ে শুধু একজনকে ভালবেসে সম্পূর্ণ অচেনা অজানা মানুষদের সাথে নতুন করে শুরু করতে যায়। আমাদের কতটা সাহস। একবার চিন্তা করেছো? চিন্তা করবে কি, কখনো কষ্ট দিয়ে কথা বলার আগে কেউ ভাবো ? আরো কি, এইটা শশুড়বাড়ি এইখানে এমন একটু-আধটু বলে শুনতে হয়,চুপ করে থাকো ঠিক হয়ে যাবে। কেন? আমাদের কথা শুনানোর কি অধিকার দেওয়া আছে তোমাদের? কখনো ভেবেছো মা-বাবা ছাড়া আমরা কতটা অসহায় থাকি৷ কিন্তু শুধু একজনের ভালবাসায় সব হাসি মুখে মানি। ছেড়ে আসি না। আগলিয়ে রাখি সব। নিজেকে হারিয়ে ফেলি সব মানতে গিয়ে৷ কিন্তু কখনো চোখে পড়ে না তোমাদের। গায়ে হাত তুলতে আসো অন্যের কথা শুনে একবার জানতে অবধি চাও না সত্য টা কি? আরো কি বলে, জামাই এমন করতেই পারে। সত্যি তো প্রতিটি কথা৷ কে বুঝে? আমি নীলার কাছে গিয়ে বললাম-
-আমি সত্যিই দুঃখিত , তোমাকে বুঝি নি। কিন্তু ভালবাসি তো ভীষণ।
-আমি কি ভালবাসি না তাও দেখো তুমি এইখানে কেমন হয়ে গেছো শুধু আমার অবহেলায়৷ তোমার বাসায় থাকলে কিন্তু এই ব্যাপারটা কোন দিন বুঝতে না। কোন ছেলেই বুঝে না। সব ছেলেদের শশুড় বাড়ি আসলেই পাঠানো দরকার তারপর তারা বুঝতে পারত একা সংসার হয় না৷ কিছু সাহায্যে করলে মান-সম্মান কমে না৷ সংসারটা সুন্দর হয়।
-হুম। এখন থেকে দুজনে মিলেই সব করব।
আসো প্লিজ এখন একটু জড়িয়ে ধরো। কিছুদিন পর এক শুক্রবার ঘর মুছতে লাগল নীলা। হঠাৎ পা পিছলে পড়ে পায়ে ব্যাথা পেল নীলা। তখন ওকে সোপায় বসিয়ে নিজেই মুছতে লাগলাম। দরজা খোলা থাকায় আমার মা বাবা ঘরে চলে এলো। এসেই আমাকে ঘর মুছতে দেখে চিৎকার করে উঠল।
– তুই এইখানে ঘর মুছতেছিস? আর তোর বউ সোফায় বসে টিভি দেখে?
-মা, ও মুছতেছিল কিন্তু পায়ে ব্যাথা পেয়েছে তাই আমি মুছে দিচ্ছি কি হয়েছে তো?
– কি হয়েছে? ছেলেকে পড়ালেখা শেখায় এত আদর যত্নে বড় করলাম শশুড়বাড়ি এসে ঘর মুছতেছিস?
– মা নীলা ও তো প্রতিদিন ঘর মুছত আমাদের বাসায়৷ ও তো শিক্ষিত মেয়ে। ঘরের কাজ করলে যদি আমি ছোট হয় নীলাকেও তো আমরা ছোট করেছি।
– ও তো মেয়ে। শশুড়বাড়ি গিয়ে কাজ করবে না? বসে বসে খাওয়াব নাকি?
-আমিও শশুড়বাড়ি আছি।
-লাগবে না এমন শশুড় বাড়ি। চল বাসায় এখন। তখন নীলার মা এসে বলল-
-ছেলে মেয়ের সংসারে ছেলের মায়ের কথা না বলায় ভালো। ওদের সংসার ওরা বুঝবে ভাল।
-কি বললেন আপনি? আমার ছেলের ব্যাপারে আমি কথা বলব না? আপনি বলবেন?
-আমার বাসায় যখন আছে আমাদের দায়িত্ব আপনি কেন কথা বলবেন?
-আমার ছেলেকে পড়ালেখা শেখায় এইখানে আমি কাজ করতে পাঠিয়েছি?
-আমরা কি মেয়েকে পড়ালেখা শেখায়নি? ছেলে আর মেয়েদের বই কি আলাদা হয়? পাশ মার্ক কি আলাদা হয়? টিউশন ফি কি আলাদা হয়? সব তো একই হয়। ছেলে মেয়েদের শিক্ষার মান একই হলে মূল্যায়ন কেন এক হবে না। আমার অর্নাস মাস্টার্স করা মেয়ে যদি আপনার ঘরে গিয়ে রান্না বান্না করে খাওয়াই কাজ করে যদি ওর সম্মান নষ্ট না হয় কিছু কাজ করলে আপনার ছেলের ডিগ্রি কি চলে যাবে?
-ফালতু কথা বলবেন না। আমার ছেলেকে আমি নিয়ে যাব।
-আমার মেয়ের গায়ে হাত তোলার পর ও যখন আমি মেয়েকে আনতে গেছিলাম আপনি বলেছিলেন সংসারে এমন হয়। মেয়ের মায়ের এইসবে নাক না গলানো ভাল। আপনার ছেলেকে কেউ মারছে না এইখানে তাও বলছি আপনি এইখানে নাক গলাবেন না৷
-এই পলাশ তুই যাবি নাকি থাকবি?
-মা তুমি যাও আমি ৬ মাস শেষ করেই নীলাকে নিয়ে বাসায় যাব।
মা চলে গেলো৷ আমি ৬ মাস শেষ হওয়ার পর নীলাকে নিয়ে বাসায় গেলাম৷ মা প্রথমে রাগ করে থাকলেও বেশিদিন পারে নি৷ নীলাও বেশ খুশি কারণ আমি সবকিছুতেই ওর সাথে থাকি। সাহায্য করি। ওকে বুঝি। নীলার সারারাত কাজ করছে সকালে ঘুমাচ্ছে আর মাথাও ব্যাথা করছে। আমি উঠে রান্না করলাম৷ সবার জন্য নাস্তা বানালাম। মা উঠল তখন।
-কি এখনো শেষ হয়নি কাজ?
-এই তো মা দিচ্ছি তোমাকে। রান্নাটাও শেষ।
-তুই রান্নাঘরে কি করছিস? তোর বউ কোথায়?
-ও কাল সারারাত কাজ করেছে এখন ঘুমাচ্ছে না হলে অফিস করতে পারবে না। আমি দুজনের টিফিন রেডি করেছি।
-বাহ। বউকে সুখ দিচ্ছিস, আমি কত অসুখ নিয়ে কাজ করেছি তার খবর ও কোনদিন রাখিস নি।
– মা, আমি রাখি নি তা ঠিক না। তুমি আমাকে বুঝতে দাও নি। যদি তুমি আমাকে কাজ করাতে আমাকে ছেলে না ভেবে তোমার সন্তান ভেবে তাহলে আমি তোমাকেও সুখ দিতাম মা তোমার অসুখের সময়।
– এখন আমার দোষ? ছেলেকে নাকি কাজ শিখাব? রান্না করাব? কাপড় ধোয়াব? মেয়ে হলে একটা কথা। মা যে কি তা বুঝবি না এখন। মায়ের চেয়ে বড় কেউ নেই।
– মা, আমি জানি মায়ের চেয়ে বড় কেউ নেই। সৃষ্টিকর্তা যখন ছেলে মেয়েকে আলাদা ভাবে মায়ের পেটে রাখে না । সমান সময় পেটে রাখে দশ মাস। সমান দুধ ছেলে মেয়ে জন্য রাখে৷ কই মেয়েরা পাঁচ মাস থাকবে পেটে ছেলেরা দশ মাস। ছেলেদের জন্য দুধ বেশি মেয়েদের জন্য কম। এমন তো করে না। তাহলে মায়েরা কেন ছেলে মেয়ে আলাদা করবে?
– তাহলে তো সৃষ্টিকর্তা সবাইকে একই বানাতো আর ছেলে মেয়ে বানাত না।
– মা এই পৃথিবীতে হাজার রকম সৃষ্টি আছে। সব আলাদা আর ভিন্ন কিন্তু কোনটা কম নয়। তাই এত সুন্দর এই পৃথিবী। সবচেয়ে বেশি ভিন্ন সৃষ্টি ছেলে আর মেয়ে। মেয়েদের থেকেই তো সব সৃষ্টি। আমি যে ছেলে তার অস্তিত্ব কোথায় মা তুমি ছাড়া?
– বাহ। ছেলেকে শশুড় বাড়ি পাঠিয়ে তো ছেলের অনেক আক্কেল হয়েছে।
– হুম। আমার মতে তো সব ছেলেদেরই অন্তত ৬ মাস শশুড়বাড়ি করানো উচিৎ যাতে মেয়েরা কতটা শক্তিশালী আর সাহসী তা বুঝতে পারবে। তখন নীলা রেডি হয়ে বের হলো।
-চল, দেরি হয়ে যাচ্ছে৷
– হুম। এই নাও টিফিনবাক্স।
পলাশের মা তখন ভাবল আমার ছেলে এত কষ্ট করে ওর জন্য টিফিন বানাল একটা thank-you ও বলল না?
মা বলল- আমার ছেলেকে একটা ধন্যবাদ ও দিলে না? দুজনেই বের হয়ে যাচ্ছিল পিছন ফিরে বলল-
-কেন?
এমন ভাবে ওরা কেন বলল, মা আর কিছু বলতে পারল না। চিন্তা করল। বউ তো প্রতিদিন আমাদের জন্য নাস্তা বানিয়ে রান্না করে ওদের টিফিন রেডি করে কাজে যায়। আমরা তো কখনো ধন্যবাদ দিই না। এইটা ওর কাজ। এইটা আমার ছেলেরেও কাজ। সত্যিই মানুষের চিন্তা-ভাবনা পরিবর্তন করার সময় এসেছে।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত