বিদায় বেলা

বিদায় বেলা
একজনের অনুরোধে লেখা। অবশ্য দুইজনের। একজনের গল্প, সে মানুষটাকে বিদায় জানাতে চায়। অন্য জন্য এমন কথোপকথন চেয়েছে পাঠ করার জন্য। –
শ্রেয়া – রাত জাগছো?
অনি- হু,
-চাঁদ দেখছো?
– হু,
-চাঁদের সাথে কথা বলছো?
– হু,
– হা হা হা, মিথ্যা কথা। আজ তোমাদের বাড়িতে লাল নীল বাতি লাগানো হয়েছে, ছেঁয়ে গেছে সবটা, চাঁদ দেখা যাবে না আজ।
– তোমাদের বাড়িটাও সাজতো আজ একসাথে, তুমিই তো হতে দিলে না।
-আমি যে তোমায় বড্ড বেশি ভালোবেসে ফেলেছিলাম, তাই তোমাকে উপহাসের পাত্র বানাতে চাই নি, আমি যে ডিভোর্সি।
– আমি সব সামলে নিতাম। এতে তো তোমার কোন দোষ ছিলো না।
-( দীর্ঘশ্বাস) সেটাই তো, আমার তো দোষ ছিলো না। যদি দোষ থাকতো তাহলে চেষ্টা করতাম নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে, দোষীই যখন নেই কিসের জন্য যুদ্ধ করব বলো? শুধু শুধু কেন দোষী হবো আমি কারো? হয়ত একসময় তুমিই চেঞ্জ হতে। যা ভাবাও আমার কাছে দুঃস্বপ্ন।
– বিশ্বাস নেই?
– বড্ড বেশী, তাই। এইটাই সম্বল। বাদ দাও সেসব। আচ্ছা কি রঙের শাড়ি কিনেছো? মেরুন নাকি রাণী কালার? আচ্ছা থাক বলিও না, তখন আবার লোভ জাগবে।
-এইভাবে বলছো কেন?
-আচ্ছা বলছি না, জানো আমি কি ভাবছি? ভাবছি যদি আমার জামাই থাকতো তোমার বিয়েতে খুব সুন্দর করে সেজেগুজে যেতাম। তুমি আমায় নীল শাড়িতে দেখতে চেয়েছিলে। কখনো হয় নি দেখা। খোলা চুলে কাঠগোলাপ গুজে হাতে এক ডজন চুড়ি পড়তাম।
-তাহলে তো ভালোই হলো তুমি আসতে পারবে না।
-কেন?
– বিয়ের এত ঝামেলা, সকাল থেকে উপোস। সারাদিন এক জায়গায় বসে। লাইট, ক্যামরা, পোজ, লোকজনের ভীড়, দম বন্ধ করা এসির বাতাস, পাশে বসে থাকা নতুন মেয়েটির সাথে ভবিষ্যত, তোমাকে হারিয়ে ফেলার কষ্ট, চারিদিকে এত সাজগোজের মানুষজনের মধ্যে যখন আমি হাপিয়ে উঠব তখন তুমি এমন করে একখানা গোটা আকাশ গায়ে জড়িয়ে আমার চোখে শুভ্র পরশ লাগাবে। আমি তোমার কাছে ছুটে আসতে চাইবো,কিন্তু পারবো না। তখন তো আমার বুকের ধুকপুক বেড়ে যাবে। যদি সামলাতে না পেরে ওখানেই দম বন্ধ হয়ে মরে যাই?
-তাহলে তো ভালোই হতো।
-তাই বুঝি?
-আচ্ছা তুমি বলেছিলে শিউলি ফুলের গাছ লাগাবে যা বেয়ে তোমার দইুতলার ব্যলকনিতে আসবে। ফুল ফুটবে ভোর রাতে। লাগিয়েছিলে?
– হুম, লাগিয়েছিলাম। তবে ফুল ফুটেনি এখনো।
-আজ ফুটবে। আচ্ছা তুমি সেই বেতের দোলনা টা কিনেছো? যেটাতে বসে জোৎস্না দেখবে বলতে।
– না,
-কেন? কিনতে, বউয়ের সাথে বসে দেখতে।
-সবাই কি আর তোমার মতো? ওর হয়ত এইসব চাওয়া নাও থাকতে পারে। দামী শাড়ি, গয়না কিংবা উত্তাল বিছানা চাওয়া থাকতে পারে।
– কি জানি, আমি তো আর জানবোই না কি চাওয়া হচ্ছে তোমার কাছে। দেখবো না কখনো আর।
– কেন?
-তোমাকে সব জায়গায় থেকে ব্লক করে দিবো আজ। যাতে আর আমাদের যোগাযোগ না হয়৷
– আমার কথার উপর ভরসা নেই? আমি কি তোমাকে বিরক্ত করব?
– যে প্রতিশ্রুতি দেয়, সে থাকে দায়বন্ধ, তার থাকে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করার আবেগ। আর যে প্রতিশ্রুতি নেয় সে দায়বন্ধ নয় তার যে ভাঙ্গতে চাওয়া ভীষণ ইচ্ছে জাগে৷ তোমার উপর আছে নিজের উপর বিশ্বাস নেই।
-কেমন?
– যেমন ধরো, কাল থেকে শুরু হবে তোমাকে ট্যাগ করে ছবি আপলোড করা, আমি যদি না দেখতে চাই আগামী সপ্তাহ খানিক ঢুকতে পারবো না, কিছুদিন পর তুমি নিজেই চেঞ্জ করবে ডিপি, আমি মেসেঞ্জারে মেসেজ শূন্য আইডি যখন ক্লিক করব তোমার ছবি জ্বলজ্বল করবে, সহ্য হবে না।
কিছুদিন পর মাই ডে দিবে, তোমাকে দিতে হবে। আমার ঘুম না আসার কারণ হবে ওরা। তারপর কেটে যাবে বহুদিন। সব অয়োজন শেষে যখন ক্লান্তদিনে ফেরা হবে তোমার, আমাকে রাতের বেলা অনলাইন দেখে একটা লাইক কিংবা ইমুজি দিয়ে বলবে, ভুলে চলে গেছে। আমি যদি ওহ বলে চুপ হয়ে থাকি তাও তুমি বলবে, কেমন আছো? আমি শত বার বলার চেষ্টা করব ভালো নেই, ভীষণ রকম ভালো নেই। কিন্তু পারবো না বলতে, বলবো ভালো আছি। হয়ত ওখানে থেমে যাবে হয়ত যাবে না। যে কারণে আমার সংসার ভেঙ্গেছে আমি সত্যি চাই না অন্য কারো সে কারণ হতে। তারচেয়ে এই ভালো তুমি ভালো আছো এই জেনে আগেই সব ব্লক করে দেওয়া।
– বাব্বা, কত কিছু ভেবে রেখেছো। আমি যদি ফোন করি তোমায়?তখন কি ফেরাতে পারবে? পারবে কথা না বলে থাকতে?
– না, পারবো না! তাই তো এই কল টা শেষ হলে ফেলে দিবো এই সিম। তারপর ঘুম দিবো লম্বা। একদিন দুইদিন ঘুমিয়ে তারপর প্লান করেছি মামাতো বোনের সাথে নদীর পাড়ে ঘুরতে যাবো। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ছেলেদের টিস করব। হা হা হা।
– হাসছো তুমি? ভাগিস্য ফোনে কথা বললে হাসির সাথে পড়তে থাকা চোখের পানি দেখা যায় না। কিন্তু তুমি জানো না তোমার কাঁপা স্বর আমায় তা দেখাচ্ছে। সত্যিই কোন যোগাযোগের রাস্তা রাখবে না?
– না। জানো কয়েকদিন ধরে তোমার নাম্বার টা মুখস্ত করার চেষ্টা করছিলাম। তবে লাস্ট দুটো ডিজিট ছাড়া৷
– তা কেন?
– ধরো এক বৃষ্টি রাতে আনমনা হয়ে ভীষণ মনে পড়ছে তোমায়, আমি মরিয়া হয়ে উঠেছি তোমাকে তা জানাতে,
আমার যে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে তোমায় ছাড়া। আমি মুখস্থ নাম্বারে কল করতেই থাকি। তবে শেষ নাম্বার মিলাতে পারি না। এক দুই, দুই তিন, দুই এক, তিন দুই এইভাবে মিলাতেই থাকব। কোনটাতে কল যাবে না, কোনটায় যাবে, কেউ খ্যক করে উঠবে, কেউ ধরবেই না৷ আমি রাগে অভিমানে একসময় ঘুমিয়ে পড়ব। যখন সকালে ঘুম ভাঙ্গবে তখন মনে হবে ভালোই হলো কাল তোমার কাছে কল যায় নি।
– তবে, আমি কি জানবো না, কেমন আছো তুমি? আছো কিনা তাও?
অনেকক্ষন চুপচাপ কেটে গেলো সময়। তখন ভোরের আলো ফুঠছে, চারিদিকে যেন কেউ ইচ্ছে মতো লাল কালো তুলি ছড়াচ্ছে এলোমেলো কাচা হাতে। শ্রেয়া বলল আবার,
– সকাল হচ্ছে।
– হু,
– তোমার সাথে আমার হাজারটা সূর্যোদয় দেখার কথা ছিলো, মনে আছে?
– হুম। আছে।
– আজ কয় টা হলো জানো?
– কয়টা?
– চারশো তিপ্পান্ন টা। এখন থেকে তুমিও আবার যখন ভোর বেলায় সূর্যোদয় দেখবে গুনতে থাকবে। আমিও গুনব। প্রকৃতি ঠিক দুজনকে একসাথে দেখাবে। আমরা ভুলে যায় প্রকৃতি সব মনে রাখে। যেদিন হাজারটা পূরণ হবে দেখবে এরপরের সূর্যোদয় টা ভীষণ মলিন হবে। তখন বুঝবে আছি এখনো তোমার ভালোবাসায়।
– তুমি কি করবে আমি যাওয়ার পর? অন্য কারো হবে না?
– অবশ্যই। ভেঙ্গেচুরে যাওয়া এই আমিকে তুমি রং চিনিয়েছো।
শিখিয়োছো ভালবাসা কত গভীর হতে পারে, না ছুয়ে, না দেখে, না জানিয়ে, ভালোবাসা যাই বছরের পর বছর। এই জীবন আমি কেন বৃথা দিবো। তোমার চোখে যা দেখেছি তার পয়েন্ট জিরো জিরো ওয়ান পার্সেন্ট ও কারো চোখে দেখি তাকে ভালোবেসে জীবন কাটাতে পারবো আমি। সত্যিই।
– তারপর,
– তারপর আর কিছু না।
– এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। আমাকে ক্ষমা করে।
– দূর পাগল, ভাবো না আমরা কত ভাগ্যবান শেষ বিদায় টা কি সুন্দর হচ্ছে। কয়জনের ভাগ্যে জোটে এই বিদায় বেলা?
-হুম।
– তোমার শিউলি গাছে ফুল ফোটছে দেখো।
– হু,
-সুবাস ছড়াচ্ছে?
– হু।
-তোমার গাছের শিউলি ফুলের সুবাস আমায় ঘিরে ধরছে। আমার ঘুম পাচ্ছে ভীষণ ঘুম। তুমিও ঘুমাও। আজ তোমার ব্যস্ত দিন। আজ যে তোমার বিয়ে।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত