আজ আমার বাল্যবন্ধু রাতুলের ১১তম মৃত্যুবার্ষিকী; ক্লাস ওয়ান থেকে এস.এস.সি পাশ করা অব্দি আমরা একসাথেই পড়াশোনা করেছি। তারপরে আমি কলেজে ভর্তি হলেও ওর আর কলেজ চৌকাঠে পা রাখার সৌভাগ্যটা হয়নি।
যে দিন সকাল ১০টায় ফলাফল ঘোষণা হয়,সেদিন রাত ন’টায় ওর লাশ আমরা নদীতে খুঁজে পাই। এবার একটু পেছনে ফিরে তাকানো যাক, তিন ভাইবোনের রাতুল সবার বড় ছিলো। ওর বাবা কাঠমিস্ত্রীর কাজ করতো। কোনো এক অজানা কারনে,ছোটোবেলা থেকেই ও বাবা মায়ের ভালোবাসা বঞ্চিত ছিলো। বিশেষ করে মায়ের অনাদরে ওর বড় হওয়া। স্কুলের টিফিন দেওয়া থেকে বেতন কিংবা অভিভাবক সমাবেশ সবকিছুতেই ওর পরিবারের কেমন একটা তাচ্ছিল্যতা ছিলো। যখন ক্লাস ফোর এ পড়তো তখন একবার ওর মায়ের লুকানো টাকা থেকে দশ টাকা চুরি করে আইসক্রিম কিনেছিলো; ওর মা সেটা জানতে পেরে ওকে সেদিন হাত পা বেধে ভীষণ রকম মারছিল,ওর সেই চিৎকারে আশেপাশের এলাকা ভারী হয়ে গিয়েছিলো; এরপর টানা দুই দিন খেতে দেয় নি ওকে। সেদিনের পর থেকে মায়ের সাথে ওর দূরত্বটা আরো বৃদ্ধি পেতে থাকে। পুরানো জামা,ছেঁড়া স্যান্ডেল নিয়ে স্কুলে যেতো কিন্তু ওর পরিবারের কারো বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপও ছিলোনা।
এরপরে অবস্থাটা এমন এক পর্যায়ে দাঁড়ায় যে, বাসার যে কোনো জিনিস হারিয়ে গেলে বা যদি কোনো হাঁস মুরগিও হারিয়ে যায় তাও একদম নির্দ্বিধায় ওর মা ওর নামে চালিয়ে দেয় যে ও নিয়ে বিক্রি করে দিয়েছে। আর এই অযুহাতে ওর কপালে জোটে বেদম প্রহার; এমন সব কারণে অতিষ্ঠ হয়ে সেই ছোটোবেলা থেকেই ও অন্তত ৮-১০ বার বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছিলো। অবশ্য লেখাপড়ার দিকে বেশ মনোযোগী ছিলো; এমনি করে একটা অসুস্থ পরিবেশে ওর বেড়ে ওঠা। প্রাথমিকের গন্ডি পেরিয়ে ততদিনে আমরা মাধ্যমিকে পৌঁছে গেছি। নবম শ্রেণিতে পড়াকালীন সময়ে আমরা স্কুলের ছাত্রাবাসে উঠি। ও আর আমি একসাথেই ছিলাম। কিছুদিন পর ওর বাবা স্কুলের টিউশন ফি ও বন্ধ করে দেয়। ওকে অনেকবার নিতেও এসেছিলো,ও যায়নি তার সাথে; রাতুলের বাবা যতক্ষণ স্কুল হোস্টেল না ছাড়তো ততক্ষণ ও স্কুলের পুরানো ভবনটার ছাদেই বসে থাকতো। উনি চলে গেলে ও রুমে আসতো।
ও জানতো তার সাথে দেখা করলেই ওকে ভুলিয়ে ভালিয়ে বাড়ি নিয়ে যাবে, আর কোনো একটা কাজে লাগিয়ে দেবে; পড়াশোনাটা ওখানেই শেষ হয়ে যাবে। তাই তার সাথে ও দেখা করতে চাইতো না। টিউশন ফি জোগাতে কাছেই একটা খাবার হোটেলে রোজ বিকেলে কাজ শুরু করে, পরে অবশ্য হেড স্যার জানতে পেরে ওর টিউশন ফি মওকুফ করে দেয়। এমনি করে দেখতে দেখতে আমরা এস এস সি পরীক্ষা দিলাম। এরপরের ফাঁকা সময়টায় রাতুল ওর বাবার সাথে কাজে লেগে পরে। ওদের পুরানো ঘর টা ভেঙে নতুন বাড়ি তৈরির কাজ পুরোদমে চলছে; দু তিন জন শ্রমিক ও রাখা হয়েছে। এদের মধ্যে বাদল নামের একজনের সাথে ওর বেশ আলাপ জমে। বাদল আবার একটু অন্য কেসেমের লোক, কাজ করার ফাঁকে ফাঁকে তার সিদ্ধি খেতে হয়। একটা পলিথিনে করে রোজ নিয়ে আসে আর দু ঘন্টা কাজ করে খানিকটা ব্রেক নেয় আর সেই সময়টায় আশেপাশের থেকে একটা শক্ত কাগজ কুড়িয়ে সেটায় মুড়ে সিদ্ধি টানে, এতে নাকি সে আশ্চর্যরকম কর্মশক্তি ফিরে পায়।
ওইদিন রাতুলকে আমিই খবরটা দিলাম যে আগামীকাল পরীক্ষার রেজাল্ট দিবে। সকাল ন’টার দিকে একবার এসেছিলাম ওদের বাড়িতে; তখন অব্দি সব একদম ঠিকঠাক ই ছিলো। দশটার সময় রেজাল্ট দিলো,এ গ্রেড পেয়ে পাশ করেছে রাতুল। বেশ উচ্ছাসিত,ওর বাবাকেও সামান্য খুশি মনে হচ্ছে কিন্তু ওর মায়ের মধ্যে কোনোরূপ পরিবর্তন লক্ষ করা যায়নি। এই আনন্দের ফাঁকে বাদলও সিদ্ধি খাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে, পুরানো আসবাবের সাথে পড়ে থাকা একটা হলুদ রঙের শক্ত কাগজ দেখে রাতুলকে সেটা আনতে বললো; ও কাগজটা নিয়ে এসে যখনই বাদলের হাতে দেবে তখন হঠাৎ করেই কাগজটার মাঝ বারবার ওর নাম লেখা দেখে একটু বিস্মিত হয়। পরক্ষণেই বুঝতে পারলো এটা ওর ছোটোবেলার টিকা নেয়ার কার্ড। কিন্তু কাগজটা পড়তে গিয়ে হঠাৎই ও চমকে যায়, চমকে যাওয়া না ঠিক ও ফ্যালফ্যাল করে অনেক্ক্ষণ তাকিয়ে থাকে। বাদল জিজ্ঞেস করলেও কোনো উত্তর না দিয়ে ও সেদিন আমার কাছেই প্রথম চলে আসছিলো।
ওর মায়ের নামটা ভিন্ন ছিলো ওই কাগজটায়; মানে ও এতদিন যাকে মা ডাকতো বা সব ফর্মে মায়ের নামের জায়গায় যেই নামটা লিখতো সেই মানুষটা আর ওর জন্মের পরের টিকাদানের কার্ডে যে মহিলার নাম তারা দুটো আলাদা মানুষ,আলাদা অস্তিত্ব। বুঝতে পারছিলাম ও ভেতরে ভেতরে শেষ হয়ে যাচ্ছে। ওর সতেরো বছরের মায়ের ভালোবাসা বঞ্চিত জীবনটা হঠাৎ যেন মায়ের জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠলো। বাবার কাছে সাহস করে জিজ্ঞেস করার শক্তিটা বরাবরই ওর ছিলোনা। ওর কাছের মানুষ বলতে আর একজন ছিলো,বাড়ির পাশের এক বৃদ্ধ মহিলা। সম্পর্কে ওর দাদি হন তিনি। দুপুর সাড়ে বারোটার দিকে রাতুল তার কাছে যায়, রাতুলের ভীষণ অনুরোধকে উনি প্রত্যাখ্যান করতে পারেন নি। উনি বলা শুরু করলেন, তোর মাকে যখন তোর বাপ ছেড়ে দেয় তখন তোর বয়স সবে আড়াই বছর। এর ছ’মাসের মাথায় তোর বাপ আবার বিয়ে করে।
রাতুলের মনে তখন অন্য একটা প্রশ্ন ঘুরছে,যে প্রশ্নটা এতগুলো কথার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। রাতুল জিজ্ঞেস করলো আচ্ছা দাদি, আমার মা এখন কোথায় জানো তুমি..? ওর দাদি বললো শুনেছিলাম গাঙ্গের ওপারের হালিমের সাথে নাকি এই ঘটনার দুবছর বাদে আবার বিয়ে হয়ে গেছে। রাতুলের মন অবশ্য এগুলোর তোয়াক্কা করেনি। যেমন করেই হোক মায়ের সাথে দেখা করেই ছাড়বে। সমীর মাঝীর জ্বর তাই আগেরদিন থেকে খেয়া পারাপার বন্ধ হয়ে আছে। ওপারে যাওয়ারও উপায় নেই; যেতে হলে কেবল ওদের ছোট ডিঙ্গিটা নিয়েই যেতে হবে। এদিকে আকাশে বেশ মেঘ জমেছে। ডিঙি টা নিয়ে গেলেও নদী পেরোতে পাক্কা আধঘন্টা লাগবে। ওর সাথে আমার শেষ দেখা ওইটাই মানে ওইদিন দুপুর ১২টার দিকে।
রাতুল ডিঙি নৌকাটা নিয়ে একাই বৈঠা নেড়ে চলা শুরু করলো। পিছন থেকে ওর বাবা দৌড়ে এসে ওকে অনেক্ক্ষণ ডাকলো,জিজ্ঞেস করলো কোথায় যাস ? ও কোনো সাড়াশব্দ না করে ভরা জোয়ারেই চলা শুরু করলো। চল্লিশ মিনিট লেগে গেলো ওপারে যেতে,ভীষণ আকাশ ডাকছে,যে কোনো মুহূর্তেই ঝড় উঠতে পারে। এক লোককে জিজ্ঞেস করে,ও সেই হালিমের বাড়ির দিকে হাঁটা শুরু করলো। ৫ মিনিটের মাথায় পৌঁছেও গেলো। একটা টিনের দোচালা ঘর। ছোট উঠান,পাশেই ঘন সুপারি বাগান; উঠোনের এক কোণে একজন দাঁড়ি-গোঁফওয়ালা লোক কাজ করছেন,পুকুরধারে ৬-৭ বছর বয়সী দুটো বাচ্চা খেলছিলো। আর নীল কাপড়ে মাঝবয়সী এক মহিলা বৃষ্টি আসবে ভেবে শুকনো মরিচ ঘরে তুলছেন। রাতুল কি করবে কিছু বুঝতে পারছিলনা; ও তো ওর মাকে চিনেনা,বুদ্ধিজ্ঞান হওয়ার পর দেখেওনি কোনোদিন। বাচ্চাদুটো মা মা বলে চিৎকার দিয়ে ভদ্রমহিলার কাছে আসলো,এবারের মা শব্দটা কেন জানি রাতুলের বেশ বুকে লাগলো।
রাতুল হয়তো চলেই আসতো ওর মাকে এক নজর দেখে,এটাই বোধহয় উপযুক্ত ছিলো; কিন্তু বয়সটা যে সতেরো; এ বয়সের ছেলেমেয়েরা যে কোনো কিছু করার আগে খুব একটা ভাবে না। রাতুল চাইছিলো অনেকবার মা বলে ডাক দিবে কিন্তু ওর ‘মা’ বলে চিৎকার দেয়া শব্দটা গলা থেকে আর বাইরে বেরুলো না। একটু পরে ভদ্রমহিলা ঘরের মধ্যে চলে গেলেন। হঠাৎ পুকুরের একপাশটায় দাঁড়ানো হালিমের চোখে পড়লো ওর দিকে; জিজ্ঞেস করলো ওর পরিচয়,আর কি চায় এখানে..? ওর কোনো উত্তর ছিলোনা। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে তারপর বললো, এই বাড়িতে আমার মা থাকেন; আমি তাকে নিতে এসেছি। হালিমের তৎক্ষনাৎ মেজাজ বিগড়ে গেল। কষে একটা চড় দিয়ে বললো, “যত্তসব পাগলে ভরে গেছে এলাকা” এখান থেকে যদি না যাস তাহলে কিন্তু তোকে চোর বলে গ্রামবাসীর হাতে তুলে দেব। পিটিয়ে মেরে ফেলবে।
– তা ফেলুক কিন্তু আমি মায়ের সাথে দেখা করবো,মাকে না নিয়ে যাবোনা।
– হালিম ওকে এক ধাক্কায় ওকে মাটিতে ফেলে দিল;
– রাতুল হাতজোড় করে বললো একবার আমার মায়ের সাথে দেখা করতে চাই।
– হালিম ওর প্রত্যেকটা কথায় ওকে আরো শাসাচ্ছে; গুড়ি গুড়ি বৃষ্টিটা ক্রমশ মুশলধারে শুরু হতে চলছে তখন। এদিকে গোলমালের শব্দে ‘সুলতানা বানু’ মানে ওর মা ঘর থেকে বেড়িয়ে এসে বললো,
-কিরে ওখানে কে ও ? আর তুমি ঘরে আসোনা কেনো, বৃষ্টি আরও বাড়তেছে তো। হালিম বুঝতে পারলো ওকে না বিদায় করে ঘরে আসলে কাজ হবে না, ও আবারও আসবে। তাই স্ত্রীর কথায় কান না দিয়ে তিনি ওকে ধমকে যাচ্ছিলেন। সুলতানা কাছাকাছি এসে পড়ায় হালিম বললো, দেখো কত্ত বড় সাহস ও আমার গাছের ডাব চুরি করছিলো। ওকে আজ উচিত শিক্ষা না দিলে আবার চুরি করবে। রাতুলের মুখের দিকে তাকিয়ে সুলতানা বানু বললো,এ ছোকরাকে তো এ পাড়ায় দেখিনি আগে। হালিমের চড়ে তখন ঠোট ফেটে সেখান থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে রাতুলের। সুলতানা বানু জিজ্ঞেস করলো তুই কে রে…বাড়ি কই…? রাতুল তখন হু হু করে কেঁদে উঠলো।
হালিম বললো তুমি ঘরে যাও আমি একে চৌকিদারের বাসায় তুলে দিয়ে আসি, পিটিয়ে হাড় গুড়ো করে দিক,শালা চোরের জাত। রাতুলকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছিলো হালিম আর এদিকে সুলতানা বানুও ঘরের দিকে যাওয়া শুরু করলেন; যেইনা উনি ঘরে পা দিলেন হঠাৎ রাতুল জোরে চিৎকার দিয়ে উঠলো …মা… সুলতানা বানু থমকে দাঁড়ালেন; দৌড়ে আসছিলেন রাতুলের দিকে। হালিম তখন ওকে ছেড়ে সুলতানা বানুকে জোর করে ঘরে নিয়ে গেলেন। পেছন থেকে রাতুলের আধভাঙ্গা গলায় মুহুর্মুহু চিৎকার ও মা,মাগো,আমি তোমাকে নিতে এসেছি মা। সুলতানা বানুকে ঘরে ঢুকিয়ে দড়জা লাগিয়ে দিলেন হালিম। এদিকে কাকভেজা হয়েও রাতুল টানা দু ঘন্টা ধরে পড়ে আছে ওই বাড়ির দরজায় আর ক্ষনে ক্ষনে মা মা বলে ডাকছে। আড়াই ঘন্টা পর সুলতানা বানু ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। রাতুলকে দূর থেকেই বললেন, আমি তোর মা না,তুই চলে যা। বলেই আবার ঘরে চলে এলেন।
[পাঠকদের জ্ঞাতার্থে: হালিম ঘরে নিয়ে সুলতানাকে মারধোর করে এবং এমন একটা পর্যায় দাঁড়ায় যে,তার হাতে দুটো অপশন থাকে, রাতুলকে পরিচয় না দিয়ে নিজের এই ঘরের দু সন্তান নিয়ে থাকবে আর নয়তো রাতুলের সাথে বেরিয়ে যাবে আর কোনোদিন ওকে ঘরে ঢুকতে দিবে না, সুলতানার মন তখন মাতৃস্নেহকে উপেক্ষা করে সমাজ আর সংসার রক্ষাকে বেশি গুরুত্ব দিতে বাধ্য হলো] রাতুল অনেক্ক্ষণ দড়জাবন্ধ বাড়িটার দিকে তাকিয়ে রইলো শেষমেশ কাঁদতে কাঁদতে ডিঙিটায় এসে বসলো। বৃষ্টি এতক্ষণে কিছুটা কমলেও বাতাস খুব বাড়ছে,সেই সাথে নদীর পানিও। ওর তখন নিজের জীবনের প্রতিই একটা অনীহা জন্মে গেলো। বৈঠা চালানো শুরু করলো রাতুল; বাতাসের গতিও আস্তে আস্তে বাড়তে শুরু করলো। এক সময় বাতাসের ঝাপটায় মাঝনদীতে উল্টে যায় ওর ছোট্ট ডিঙিনৌকা, আর সেই সাথে ডুবে যায় রাতুলের মাতৃস্নেহের আবদারটুকুও। বিকেলের পর ওকে খোঁজা শুরু হয়।
প্রচন্ড ঝড় উপেক্ষা করেও রাতুলের বাবা একটা বড় নৌকা নিয়ে নেমে পড়ে রাতুলের খোঁজে; সন্ধ্যে সাতটা, তখন অব্দি ও নিখোঁজ। এরপর রাত ন’টার দিকে রাতুলের লাশ ভেসে ওঠে পায়রা নদীর খেয়াঘাট থেকে সামান্যদূরে। আমার একজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষক একদিন একটা কথা বলেছিলেন ‘অনেক পুষ্প লোকচক্ষুর অন্তরালেই ঝড়িয়া পড়ে’ কেন যেন আজ সেই অদেখা পুষ্পের সাথে আমার বাল্যবন্ধু রাতুলের বড্ড মিল খুঁজে পাচ্ছি।।
গল্পের বিষয়:
গল্প