তখন আমি ইন্টারমিডিয়েট ফার্স্ট ইয়ার এর ছাত্রী।বলিউড হিরো আমির খান ছিল আমার ক্রাশ। সেই আমাকে কিনা লাভ লেটার দেয় আমার বন্ধু মহলের কাছ থেকে হিরো চেঙ্গিস খান খেতাব প্রাপ্ত ছেলেটি! এত্তো বড় আস্পর্ধা! ওহো হিরো চেঙ্গিস খানের পরিচয়টাই তো দেয়া হয়নি এখনো আমাদেরই ক্লাসমেট ছিল সে। ‘কিম্ভুতকিমাকার’ শব্দটা যেন তার জন্যই প্রযোজ্য।
আর তার হাঁটার স্টাইল তো আরো অদ্ভুত, এক পা সামনে ফেলে বাঁশের কঞ্চির মতো শরীরটাকে বাইন মাছের মত একটা মোচড় দিয়ে তারপর দ্বিতীয় কদম ফেলত। মোট কথা, অসহ্য, হাস্যকর এক জোকার ছাড়া আমার কাছে সে কিছুই ছিলনা। অথচ লোকমুখে শুনেছি আমার জন্য সে নাকি জীবন পর্যন্ত দিতে পারে। একবার তার প্রমাণও অবশ্য পেয়েছি। আমার বাসা থেকে কলেজের দূরত্ব খুব বেশি ছিলোনা। পায়ে হেঁটেই আসা-যাওয়া করতাম। একদিন কলেজ থেকে ফেরার পথে কোত্থেকে এক পাগলা কুকুর এসে আমার দিকে তেড়ে আসছিল, ঠিক এই সময় ঘটনা স্থলে হিরো চেঙ্গিস খানের আবির্ভাব ঘটল।
তড়িঘড়ি করে হাতের কাছে যা পেয়েছে, তাই নিয়ে ঝাঁপিয়ে পরেছে সে। আমি ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে দেখলাম, আমার আর পাগলা কুকুরের মাঝখানে দাড়িয়ে নারিকেল পাতার শলার মত চিকন একটা কিছু নিয়ে সেই ভয়ংকর কুকুরটার সাথে হুশ – হুশ – যা – যা বলে যুদ্ধ করে যাচ্ছে হিরো চেঙ্গিস খান। যুদ্ধের এক পর্যায়ে পাগলা কুকুরটি চেঙ্গিস খানের পায়ের মধ্যে কামড় বসিয়ে দিল, আর আশপাশের লোকজন ধরাধরি করে তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেল। এই ঘটনার পরেও তার প্রতি আমার সামান্যতম সহানুভূতি জাগ্রত হয়নি, ভালবাসা তো দূরের কথা। তাকে দেখলেই আমার মেজাজ খারাপ হয়ে যেতো। সেও জানতো যে আমি তাকে দু’চোখে দেখতে পারিনা।
আমাদের বাসাটা ছিল মফস্বলে। তাই দরকারি কিছু কিনতে হলে মাঝে মধ্যে আমাদেরকে জেলা শহর বরিশালে যেতে হতো। তো সেই কারনেই এক দিন আমি আর আম্মু বরিশাল গিয়েছিলাম। কেনাকাটা শেষ করতে – করতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। একটা রিকশা নিয়ে বাস স্ট্যান্ড চলে এলাম, তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে হবে।আকাশে বেশ মেঘ জমেছে। একটু একটু ঝড়ো বাতাসও বইতে শুরু করেছে।একটা বাস স্টার্ট নিয়ে ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। আম্মু বললেন, তাড়াতাড়ি এই বাসটার টিকেট কেটে আন। আম্মুকে ওখানেই দাঁড় করিয়ে আমি ছুটলাম টিকেট কাউন্টারের দিকে।
হঠাৎ একটা হিমশীতল দমকা হাওয়া এসে লাগল আমার গায়ে। কানের কাছে খসখসে কন্ঠে কে যেন বলে উঠল, “এই বাসে উঠবে না প্লিজ”। পিছনে ফিরে আবছা অন্ধকারে দেখি একটি ছায়ামূর্তি আমার পাশ কাটিয়ে দ্রুত হেঁটে দূরে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। তার হাঁটার ভঙ্গী দেখেই বুঝে ফেলেছি, এ যে হিরো চেঙ্গিস খান! জানিনা তার কন্ঠে কি এমন অদ্ভুত কিছু ছিল, যার ফলে আমি এই বাসের টিকেট না নিয়ে এর পরের বাসের দুইটা টিকেট কেটে নিলাম। আম্মুর কাছে গিয়ে বললাম, আমার খুব মাথা ব্যথা করছে, কোথাও বসে এক কাপ চা খেতে হবে। তাই পরের বাসে যাব।
পরের বাসে করে যাচ্ছিলাম, কিছু দূর যাওয়ার পরে দেখি, আমাদের আগে যেই বাসটা ছেড়ে এসেছিল, সেটা এ্যাকসিডেন্ট করেছে, রাস্তার পাশের ডোবার মধ্যে পরে আছে। বাসায় পৌঁছানোর পর আমার কাঁপিয়ে জ্বর উঠল। পরেরদিন কলেজে না যাওয়ায় ইয়াছমিন, কোনিও, পলি, শান্তা, সোহাগী সবাই এসে হাজির। ওদের মুখে যা শুনলাম, তা শুনে তো আমি একেবারে হতবাক হয়ে গেলাম—- গতকাল বিকালে নাকি চেঙ্গিস খান মারা গেছে, আর এশা’র পরে তাকে দাফন করা হয় !
কতোটা গভীর ভালবাসা থাকলে একটা মানুষ ওপারের জগতে চলে যাওয়ার পরেও এপারের জগতে এসে এভাবে তার ভালবাসার মানুষের উপকার করতে পারে ভেবে অবাক হলাম। অথচ এই মানুষটাকে কত তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছি! ঠিক সেই মুহুর্তে প্রতিজ্ঞা করলাম, জীবনে কখনো কাউকে তার বাহ্যিক রূপ দেখে বিচার করবো না। পরঃক্ষনেই ভাবি, সত্যিই কি সে এসেছিল? নাকি পুরোটাই ছিল আমার হেল্যুসিনেশন!
গল্পের বিষয়:
গল্প