আমার যখন সাত বছর বয়স তখন থেকেই খুব করে আমি মা-বাবার অভাব অনুভব করতাম। বাবা মা থাকা সত্ত্বেও তাদের ভালোবাসার অভাব বোধ করতাম আমি। আমার বাবা মা দুজনেই চাকরি করতেন। যার কারণে তারা আমাকে খুব একটা সময় দিতে পারতেন না। সকালে অফিসে চলে যেতেন আর রাতে ফিরে আসতেন। যেদিন খুব বেশি ক্লান্ত থাকতো তারা সেদিন রাতে আমার খোঁজ নিতো না। আমি যখন দেখতাম সবার মা তাঁদের ছেলেকে নিজ হাতে টিফিন খাইয়ে দিচ্ছেন। তখন আমি আমার মায়ের ভালোবাসাটা খুব করে অনুভব করতাম। আমারও ইচ্ছে হতো আমার মাও আমাকে নিজ হাতে টিফিন খাইয়ে দিবে। কিন্তু আমার মা তখন কাজে ব্যস্ত থাকতো। আমার বয়স কম হলেও,আমি ছোট হলেও আমার খাবার আমাকেই খেতে হতো। অন্যদের মতো আমার আম্মু আসতো না,আমাকে নিজ হাতে খাইয়ে দিতো না।
ছুটি শেষে যখন সবাই যার যার মা কিংবা বাবার কোলে দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরতো। তখন আমি অবাক চোখে একবুক হতাশা নিয়ে সবার দিকে তাকিয়ে থাকতাম। এই বুঝি আমার মাও দাঁড়িয়ে আছে। আমার খুব করে ইচ্ছে করতো দৌড়ে গিয়ে আমার মা-বাবাকে জড়িয়ে ধরি। কিন্তু আমার ইচ্ছেটা অপূর্ণ হয়ে থাকে। আমার বাবা মা আমাকে কখনো কোনোদিন নিতে আসে না। আসবে কি করে? তারাতো কাজে ব্যস্ত। আমার যদি খুব অসুখ করতো তখনও আমি আমার বাবা মার যত্ন পেতাম না। আমাকে যত্ন করার জন্য কাজের লোকই পারফেক্ট মনে করতো তারা। আমার বাবা মা কখনো বুঝেনি তাদের ছেলে তাদের কাছে টাকা পয়সা চায় না। একটু সময় চায়,একটু ভালোবাসা চায়। কিন্তু তাদের সেই সময়টা কখনো হয়ে উঠতো না।
সবাই ছুটির দিনে ঘুরতে যেতো। আমারও ইচ্ছে করতো বাবা মার সাথে ঘুরে বেড়াতে। যখন তাদের বলতাম তখন তারা খুব ক্লান্ত থাকতো। সপ্তাহে একদিন বন্ধের দিন তারা একটু শান্তি চাইতো। ঘুরতে যেতে তাদের ইচ্ছে হতো না। আমার জন্যও কখনো তাদের ইচ্ছে হতো না। দেখতে দেখতে কলেজে উঠে যাই। অনেকের সাথে বন্ধুত্ব হয়ে যায়। হোস্টেলে থাকতে শুরু করলাম। যদিও বাসায় থাকতেও আমাকে হোস্টেলের নিয়মেই চলতে হতো। হোস্টেলে যেমন বাবা মায়ের সঙ্গ পেতাম না, বাসায় থাকতেও তো তাদের সঙ্গ পেতাম না। তাই আমার কাছে হোস্টেল লাইফ আর বাসার লাইফের মধ্যে কোনো পার্থক্য ছিলো না।
শহরের উঁচু উঁচু দালানের ভিতরে থাকলেই জীবনে সুখে থাকা যায় না,শান্তিতে থাকা যায় না। আমার এক বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে সেটা আমি খুব করে বুঝতে পেরেছিলাম। তারা হয়তো খুব সচ্ছল ছিলো না। বাড়ির পরিবেশটাও ভালো ছিলো না। কিন্তু তারা তাদের ছেলেকে অনেক ভালোবাসতো সেটা বুঝতে পেরেছিলাম। তখন আমার মনে হয়েছিল এরাও তো বাবা মা। ছেলে এতো বড় হয়েছে তবুও কতো আদর করে,যত্ন নেয়। তাহলে আমার বাবা মা কেনো এমন হলো? যখন ভার্সিটিতে ভর্তি হলাম তখন বাবা মায়ের থেকে অনেক বেশি দূরে চলে গেলাম। মাঝে মাঝে শুধু ফোনে কথা হতো। তবে সেটাও খুব কম। সর্বোচ্চ হলে পাঁচ মিনিট। সবাই যখন তাঁর মা বাবার সাথে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলতো,সুখ দুঃখের কথা বলতো,তাদের গ্রাম কিংবা শহরের অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইতো। তখন খুব কষ্ট হতো,খারাপ লাগতো। চোখ দিয়ে অঝরে পানি পড়তো।
আমার বাবা মায়ের ঘন্টার পর ঘন্টা তো দূরের কথা ত্রিশ মিনিট কথা বলার সময়ও তাদের হতো না। ভার্সিটি লাইফে একদিন একটা অনুষ্ঠানে সবার মা বাবাই এসেছিল। শুধু একজন ছাত্রের বাবা বা উপস্থিত থাকতে পারেনি। সেই অভাগা ছাত্রটা আর কেউ নয়,আমি ছিলাম। সবকিছুর পরেও একজন মেয়েকে আমি ভালোবেসেছিলাম। যে আমার অন্ধকার জীবনটাকে আলোকিত করেছিল,একাকিত্ব জীবনটাকে খুন করে নতুন একটা জীবন দিয়েছিল। তাঁর কথা যখন বাবা মাকে বলেছিলাম তাকে বিয়ে করতে চাই। তাকে বিয়ে করলে আমি জীবনে সুখী হবো। তখন তারা বাবা মায়ের দোহাই দিয়ে বলেছিল।
আমাকে তারা জন্ম দিয়েছেন,মানুষের মতো মানুষ করেছেন,আমার জন্যই তারা দিনরাত পরিশ্রম করে গিয়েছেন। আমার জীবনের সব সিদ্বান্ত নেওয়ার অধিকার শুধু তাদের। তাই আমিও আমার ভালোবাসার মানুষটাকে আপন করে নিতে পারিনি। একসময় চেয়েছিলাম বাবা মার ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে যাকে ভালোবাসি তাকে বিয়ে করি। কিন্তু কোনো এক অদৃশ্য বাঁধার কারণে সেটা করতে পারিনি। সেও আমার জন্য মায়া কান্না করে নিজের জীবন নষ্ট করেনি। বিয়ে করে নিয়েছে বাবার মার পছন্দে অন্য কোনো পুরুষকে। ড্রিম লাইটের সোডিয়াম আলোর রাস্তা দিয়ে হাটঁছি আমি। আজকে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে। চাকরি পাওয়ার পরেই বাবা মা বিয়ে ঠিক করে ফেলেছেন। মেয়ে অনেক সুুন্দরী, শিক্ষিত। সবদিক থেকেই পারফেক্ট। মেয়েকে যখন বলেছিলাম বিয়ের পর আপনি কি চাকরি করবেন?
তখন সে বলেছিলে- হ্যাঁ,অবশ্যই। আমি নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই। আর এতো পড়ালেখা করেছি কি জন্য? যদি চাকরিই না করবো তাহলে পড়াশোনা কেনো করেছি? আর কিছু বলতে ইচ্ছে করেনি। ফোনটা রেখে দিয়েছিলাম। খুব ভয় হচ্ছে,আমার মতোও কি আমার ভবিষ্যতে সন্তান বাবা মার অভাব অনুভব করবে? বাবা মার শৈশবকালের ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হবে? আমি যেমন দীর্ঘ সাতাশটা বছর বাবা মাকে খুব করে কাছে পাইনি কখনো। আমার সন্তানও কি তেমন তাঁর বাবা মাকে কাছে পাবে না প্রয়োজনের সময়?
গল্পের বিষয়:
গল্প