এটা সেই সময়ের গল্প যখন অনার্স ও মাস্টার্স কোর্স চালুর মাধ্যমে মফস্বলের ডিগ্রি কলেজগুলোকে বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজে পরিণত করা হয়েছিল। বড় শহরে গিয়ে পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করার সুযোগ ছিল না যাদের তাদের জন্য ওই ব্যবস্থা এক স্বর্ণযুগের সূচনা করে। ছোটবেলা থেকে আমার নিজের স্বপ্ন ছিল ইংরেজি সাহিত্য পড়ব অনার্স নিয়ে। আমার সেই স্বপ্ন নিজের কাছেই বরাবর সুদূরপরাহত বলে মনে হয়েছে। বাবা তো এত টাকা খরচ করতে পারবে না আমার জন্য। আমাদের জেলাশহরের ডিগ্রি কলেজটা বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে রূপান্তরিত হলে আমার স্বপ্নপূরণের সুযোগ হাতের মুঠোয় আসে।
ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পর নবগঠিত স্বর্ণকমলপুর বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হয়ে গেলাম। তেমন ভালো টিচার পাওয়া গেল না বলে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে হচ্ছিল।
আমার অনুগামী হয়েছিল দুই প্রাণের বন্ধু এহলাম আর আমান। জীবনের যা কিছু ভালো-মন্দ কাজ ছোটবেলা থেকে আমরা একসঙ্গে করেছি। খেলাধুলা, সাঁতার, শিকার, পিকনিক, টোটো করে ঘুরে বেড়ানো, বিড়ি-সিগারেট ফোঁকা, গান-বাজনা, সিনেমা দেখা, এমনকি প্রেম-ভালোবাসা। ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে পড়ার সময় অগ্র-পশ্চাৎ বিবেচনা না করে তিনজন একসঙ্গে একই মেয়ের প্রেমে পড়েছিলাম। সৌভাগ্যবশত মেয়েটি তিনজনের একজনকেও পাত্তা দেয়নি বলে যৌবনের প্রারম্ভে মানসিক বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিলাম।
অনার্সের সঙ্গে সাবসিডিয়ারি সাবজেক্ট চুজ করতে গিয়ে তিনজনেই ইকোনমিক্স আর পলসায়েন্স নিয়েছিলাম।
ইকোনমিক্সকে তখন বলা হতো ধনবিজ্ঞান। ধনসম্পদের সেই শাস্ত্রটা আমাদের পড়াতেন দীর্ঘদেহী সুদর্শন এক শিক্ষক যার নাম ছিল সৈয়দ বখতিয়ার। ছ-ফুটের ওপর ইঞ্চি দুয়েক তো বটেই। টকটকে ফর্সা গায়ের রং। নাকের নিচে চওড়া গোঁফ। দু-চারটে সাদা। ব্যাকব্রাশ করা চুল। তা সেখানেও একটা-দুটো পাকা চুল উঁকিঝুঁকি মারছিল। খুব ভালো পড়াতেন। চোস্ত ইংরেজি বলতেন। ইনট্রোডাকটরি ক্লাসে ইকোনমিক্সের সংজ্ঞা বলতেন ইংরেজিতে : ইকোনমিক্স ইজ অ্যা স্টাডি অব ম্যান ইন দ্য অর্ডিনারি বিজনেস অব লাইফ,…। তারপর তিনি মাইক্রো আর ম্যাকরো ইকোনমিক্সের ডেফিনেশনে চলে যেতেন।
আমরা যারা ইন্টারে ধনবিজ্ঞান পড়েছিলাম তাদের ওই লেকচার ফলো করতে মোটেও অসুবিধা হতো না। ওসব কথা আমরা আগেই শুনেছিলাম। তবে ইংরেজি সংজ্ঞা তিনি সরল বাংলায় অনুবাদ করে শোনাতেন বলে প্রায় সবার কাছেই তা পানির মতো পরিষ্কার হয়ে যেত। পরের ক্লাসগুলোতে তিনি মার্কেট, প্রোডাকশন, কস্ট, সাপ্লাই অ্যান্ড ডিমান্ড, মার্কেট ফেইলিওর, পাবলিক অ্যান্ড প্রাইভেট সেক্টর, গ্রোথ বিজনেস সাইকেল, আনএমপ্লয়মেন্ট, ইনফ্ল্যাশন, মনিটরি পলিসি, ফিসক্যাল পলিসি ইত্যাদি পড়িয়েছিলেন। মার্কসিজম পড়াতে শুরু করেছিলেন কেবল।
লেকচার শেষ হলে তিনি কোশ্চেন অ্যান্ড আনসারের জন্য ফ্লোর ওপেন করলে আমি, এহলাম ও আমান স্যারকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করতাম। অন্যরা কথাই বলত না। তা দেখে বখতিয়ার স্যার আমাদের তিনজনকে ট্রোইকা বলে চিহ্নিত করেছিলেন। ট্রোইকা কথাটা সেই প্রথম শুনি আমরা। বস্ত্তত স্যারের সঙ্গে আমাদের তিনজনের একটা পার্সোনাল ও আন্তরিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি আমাদের নিক ধরে ডাকতেন।
মার্কসিজমের মতো কঠিন ও নিরস একটি বিষয় তিনি পানির মতো সহজ করে বোঝাতেন বলে ক্লাসের গোবর গণেশ পানু, হালু, ডালু, বিজু, লিলি, মিলিরাও বুঝতে পারত।
‘আমরা যে-সমাজে বাস করি, সে-সমাজ হলো অন্যায় আর অবিচারে ভরা। কখনো আমরা তা দেখি, কখনো দেখি না। কখনো আবার প্রতিবাদ করি, করি বিদ্রোহ।’
বলতেন স্যার, ‘সমাজের অনেকেই পরিশ্রম না করে আরামে থাকে। গাড়ি-বাড়ি করে। বেশিরভাগ লোকই দিন-রাত হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে প্রায় না-খেয়ে থাকে। এর চেয়ে বড় অন্যায় আর কী হতে পারে? বড় লোকেরা খাটবে না, অথচ সুখে থাকবে। গরিবেরা খাটবে অথচ কষ্ট করবে। এই হলো আমাদের সমাজের নিয়ম।
‘কিন্তু ওই নিয়ম মোটেও স্বাভাবিক নয়। পৃথিবীতে এমন দেশ আছে যেখানে গরিব-ধনী বলে কিছু নেই। সমাজব্যবস্থার নাম সমাজতন্ত্র। সেখানে সবাই কাজ করে। কোনো লোক না-খেয়ে মারা যায় না। কাউকে ভিক্ষেও করতে হয় না। থাকতে হয় না বেকার। ওখানে যে-ব্যবস্থা চালু আছে তা এসেছে মার্কসবাদ থেকে। মার্কসবাদ হলো একটি বিজ্ঞান, যা সমাজ সম্পর্কে আমাদেরকে জ্ঞান দান করে। কেন-ই বা সমাজ পরিবর্তিত হয় আর কীভাবে তা পরিবর্তন করা যায় তা বাতলে দেয়,…।’
তা সেই বখতিয়ার স্যার দুম করে একদিন ক্লাসে অ্যাবসেন্ট। শোনা গেল তিন দিনের ক্যাজুয়াল লিভে আছেন।
চতুর্থ দিনেও তিনি অনুপস্থিত। আমরা ভাবলাম লিভ এক্সটেনশন। সাতদিন পার হওয়ার পরও তিনি জয়েন না করায় আমরা একরকম আতান্তরেই পড়লাম। দলবেঁধে গেলাম প্রিন্সিপালের কাছে। তিনি আমাদের আশ্বস্ত করে বললেন, ‘দেখো আর কটা দিন। না হলে বিকল্প ভাবতে হবে।’
দিন পনেরো পরে অলটারনেটিভ টিচার এলেন। আকিলুর রহমান। লেকচার খুব একটা ভালো দিতে পারেন না, তার ওপর তোতলামির ভাব আছে। আমাদের পছন্দ হলো না।
মাসখানেক পরে আমরা ধনবিজ্ঞানের শিক্ষকের সন্ধানে বেরোলাম। স্যারের বাড়ি স্বর্ণকমলপুর শহর ছাড়িয়ে মাইল দুয়েক। কলেজের দফতর থেকে ঠিকানা সংগ্রহ করে আমরা তিনজন এলাম দাস ক্যান্টিনে। শীতের বিকেল। বেশ ক-কাপ চা আর সিগারেট ধ্বংস করে স্যারের বাড়ির উদ্দেশে রওনা হলাম। তিনজনের সঙ্গে তিনখানা সাইকেল।
শহর ছাড়ানোর পর চকের মাঝখান দিয়ে সরু পথ। অবাক হয়ে দেখলাম ডেয়োর মতো শত শত রিকশা এগিয়ে যাচ্ছে। আরোহীদের পরনে লম্বা কুর্তা, মাথায় টুপি। জিকির করছিল তারা – লাইলাহা ইল্লাল্লাহ…
আমি এহলামকে বললাম, ‘এনারা কোথায় যাচ্ছে জানিস নাকি?’
‘এদের আর আমাদের গন্তব্য একই। গ্রাম দশহারা। এরা যাচ্ছে পিরের বাড়ি। আমরা স্যারের। ছোট্ট একটা কবিতা হয়ে গেল না?’
আমি বললাম, ‘কোনো একটা ঋতু যোগ হলে হাইকু হতো।’
এহলাম বলল, ‘তাহলে ঋতু লাগিয়ে দিই –
ওরা যাচ্ছে পিরের বাড়ি
আমরা স্যারের
শীতের স্নিগ্ধ বিকেল।’
‘বাহ্, চমৎকার হাইকু তো! হাইকু কিন্তু মজার একটা জিনিস। আমাদের কবিগুরু হাইকুতে মজে বাশোউর একটা হাইকু অনুবাদ করেছিলেন – পুরনো এঁদো ডোবায় ব্যাঙের লাফ আর ঝপাৎ শব্দ দিয়ে, এখন ঠিক মনে পড়ছে না। তা কোন পির রে? আমাদের আশপাশে তো কোনো পিরের খানকা নেই।’
‘কী জানি একটা নাম বলল, হজরত মাওলানা সৈয়দ বখতিয়ার খলিল খানকাপুরী।’
‘ও, নতুন কেউ হবেন। চল না দেখি। রথ দেখা কলা বেচা, পির দেখা সব একসঙ্গে হবে।’
কিন্তু আমাদের সাইকেল এগোতে চায় না। কম করে হলেও পাঁচশো রিকশা এ রুটে ঢুকে পড়েছে। শেষ পর্যন্ত কোনো রকমে দশহারা গ্রামে পৌঁছা গেল। তার বাড়িটা কোন দিকে জিজ্ঞেস করায় ছোকরা মতন লোকটা হাসল। বলল, ‘পিরবাড়ি।’
‘পিরবাড়ি?’ জিজ্ঞেস করলাম আমি।
‘জি হ্যাঁ, পিরবাড়ি।’
‘পির কে?’
‘তিনিই পির। অধ্যাপক সৈয়দ বখতিয়ার।’
‘স্বর্ণকমলপুর বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের ধনবিজ্ঞানের অধ্যাপক সৈয়দ বখতিয়ার?’
‘জি হ্যাঁ।’
আমরা তিনজনেই থ। সাইকেল ঠেলতে-ঠেলতে পিরবাড়ির দিকে এগোতে থাকি। বাড়ির সামনের বিশাল মাঠে শামিয়ানা টানানো। তার নিচে হাজার-হাজার লোক বসে আছে। শামিয়ানা যেখানে শেষ সেখানে একটা বাড়ির শুরু। সামনে বিশাল টিনের ঘর। গাছপালা। পেছনেও নিশ্চয়ই আরো ঘর আছে। ভিড়ের কারণে সাইকেল ঠেলতে অসুবিধা হচ্ছিল। স্রোতের মতো মানুষ শামিয়ানার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
একটু এগোতেই চোখে পড়ল সারসার দোকান – টুপি, জায়নামাজ, তসবিহ, মোমবাতি, আগরবাতি এসব বিক্রি হচ্ছে। তার পাশেই ধর্মীয় পুস্তকের দোকান। বাংলা কোরান শরিফ, হাদিস শরিফ, নামাজ শিক্ষা ইত্যাদির সমারোহ। তারপরেই মেসওয়াক আর আতরের দোকানে লোকজনের ভিড়।
একজন বুদ্ধি দিলো – সাইকেল সামনের ওই বাড়িটাতে রেখে হেঁটে যান। এহলাম বলল, ‘যদি চুরি হয়ে যায়?’ ওর কথা শুনে খুব রাগ ধরল আমার। বললাম, ‘মানুষের বাড়িতে রেখে যাব, চুরি হবে কেন?’
সাইকেল তো রাখলাম; কিন্তু লোকজনের চাপে সামনে এগোনো যাচ্ছিল না। আমান বলল, ‘চল ফিরে যাই।’
আমি বললাম, ‘এতদূর এসে স্যারের সঙ্গে দেখা না করে?’ আমান বলল, ‘আমাদের যদি চিনতে না পারেন? এখন তো আর শিক্ষক নন।’
ওকে একটা ধমক দিয়ে বললাম, ‘কী যে বলিস না। এক মাসেই প্রিয় ছাত্রদের ভুলে যাবেন?’
ঘণ্টাখানেক পরে আমরা একেবারে পিরসাহেবের খানকা শরিফের কাছে গিয়ে পৌঁছলাম। সদ্য গদিনশিন পির। কামানো মাথায় জিন্নাহ ক্যাপ। গোঁফ নেই। পানে রাঙানো টুকটুকে লাল ঠোঁট। ঘরময় আতরের গন্ধ। আগরদানিতে লোবান পুড়ছে। নিশ্বাস ভারি হয়ে আসে।
ঢোকার পথে বাধা দিলো একজন। ‘আপনারা কোথায় যাবেন?’ আমি বললাম, ‘স্যারের কাছে যাব, আমরা ওনার ছাত্র।’
‘ছাত্র আবার কী, এখানে সবাই মুরিদ। আমরা পিরভাই।’
‘আপনারা মুরিদ। আমরা ছাত্র। তাকে আমাদের কথা বলুন। এহলাম, আমান, ফরিদ। ইকোনমিক্স সাবসিডিয়ারি, ফার্স্ট ইয়ার।’ বললাম আমি।
লোকটা বলল, ‘ইংরেজি বলতে পারব না।’
‘আমাদের নাম বললেই হবে।’
দূর থেকে দেখলাম মুরিদান-পরিবেষ্টিত হয়ে আছেন। একজন তার কানে কানে কী যেন বলল। খানিক পরে ডাক পড়ল আমাদের। মৃদু হেসে সালাম দিলেন আমাদের – ‘আসসালামু আলাইকুম।’ আমরা চান্সই পেলাম না সালাম দেওয়ার। ‘আসুন, আসুন। আপনাদের এখানে দেখে অবাকই হচ্ছি।’
আমরা অবাক হচ্ছিলাম তার ওয়েলকাম রিসেপশনের বহর দেখে। এহলাম বলল, ‘আমাদের আপনি করে বলছেন কেন স্যার?’
‘এখানে আপনারা আমার মেহমান। তমিজের সঙ্গে কথা বলাই তো দস্ত্তর। তাই না?’
আমান বলল, ‘আমাদের সঙ্গে আবার তমিজ কী। আপনি ক্লাসে যাচ্ছেন না কেন স্যার? আমাদের খুব অসুবিধা হচ্ছে। মার্কসিজমের ওপর ক্লাসটা তো আপনিই নিচ্ছিলেন।’
তিনি খুকখুক করে কেশে উঠলেন। প্রথমে মৃদু, তারপর জোরে। চিলুমচি হাতে দৌড়ে এলো একজন। তিনি ঘন কফ ফেললেন, সঙ্গে রক্তের মতো থুতু। সারাঘরে জর্দার ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ল। আমার গা-টা গুলিয়ে উঠল।
‘ক্লাস নেওয়া আর হবে না আমার।’ ততক্ষণে কাশি প্রশমিত হয়েছে। ‘দুনিয়ার কাজ তো অনেক করা হলো, এবার দ্বিনের কাজ করতে চাই। মার্কসিজম বোঝার জন্য তো এমিল বার্নসই আছে। অ্যান ইনট্রোডাকশন টু মার্কসিজম পড়ুন। ন্যাশনাল বুক এজেন্সির বাংলা অনুবাদ পাবেন।’ তিনি আবার কাশতে লাগলেন। একজন ছুটে গিয়ে পানি নিয়ে এলো। যে পানি নিয়ে এসেছিল তাকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘আমার এই তিন মেহমানের জন্য তোবারকের বন্দোবস্ত্ত করো।’ আমরা তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। বললেন, ‘তোবারক না খেয়ে যাবেন না। এখন আমি মুরিদানদের উদ্দেশে বয়ান করব। ইচ্ছে করলে আপনারাও শুনতে পারেন। দ্বিনের কাজে তো আপনাদেরও অংশগ্রহণ প্রয়োজন।’
আমরা নীরব। তিনি এগিয়ে যান। শামিয়ানার নিচে অপেক্ষমাণ কয়েক হাজার লোক উঠে দাঁড়ায়। গুঞ্জন ওঠে, ‘ওই তিনি আসছেন’, ‘ওই আসছেন তিনি…’।
এহলাম বলল, ‘স্যারের বয়ান শুনবি নাকি?’ কেউ কোনো কথা বলল না। ভিড় ঠেলে হাঁটতে লাগলাম। এহলাম একজনের সঙ্গে আলাপ জুড়ে দিলো। ‘বাড়ি কই আপনের?
‘ঠাকুরগাঁ।’
‘এতদূর থেকে এই পিরসাহেবের কাছে ক্যান আইছেন? আপনে গো দিকে কোনো পির নাই?’
‘আছে।’
‘তার কাছে ক্যান যান নাই?’
‘এইটা আপনে বুঝবেন না। কেন একজন মানুষ ঘরের কাছে পির রেখে অন্য পিরের কাছে বায়েত নেয়। পির তালাশের এই তাগিদ কেমনে মানুষের মধ্যে আসে? যার দরকার সে-ই শুধু জানে আর খুঁজে নেয়। পির পেলেই ধরতে হবে এমন কথা নাই। সময় নিয়া যাচাই-বাছাই করে তবে তা নির্ধারণ করতে হয়। পির দেখলাম আর ধরলাম এইটা ঠিক না।’
এহলাম বলল, ‘সে না হয় বুঝলাম; কিন্তু পির না ধরলে কী হয়? এই যে আমরা তিনজন। আমাদের কোনো পির নাই।’
‘সেইটা আপনাদের ব্যাপার। আমার ধরা লাগে, কারণ আমার জ্ঞান কম। যিনি পির তিনি গুরু আবার তিনিই মুর্শিদ। তিনি পথ দেখাবেন, সেই পথে আমরা চলব, তারপর মকসুদের মঞ্জিলে পৌঁছাব। কী বুঝাইতে পারলাম?’
কিছু না বলে এহলাম বোকা-বোকা হাসল। আর লোকটা গেল এগিয়ে। এবার অনেকটা পথ ঘুরে যেতে হবে আমাদের। খানিক এগোতেই দেখলাম উন্মুক্ত একটা জায়গায় চালের বিশাল একটা স্তূপ। তারপর ঢাই করে রাখা মিষ্টি কুমড়ো, লাউ, মুলা, গাজর, পটোল, পেঁপে, শসা।
‘বাজার বসেছে নাকি?’ আমান জিজ্ঞেস করল একজনকে। ‘ধুর, কী যে কন! সব মুরিদানদের জন্য রান্না হবে। তারাই এনেছেন এসব। ওই যে দ্যাখেন গরু আর খাসির পাল। সব জবেহ হবে কাল।’ তাকিয়ে দেখলাম চারটে উটও আছে। দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে মানুষ দেখছে।
মাইকে ভেসে আসছে ধনবিজ্ঞান স্যারের কণ্ঠস্বর : ‘কুলিল্লাহুম্মা মালেকাল মুলকে তুওতিল মুলকা মান্তাশায়ো – ওয়াতানযিয়োল মুলকা মিম মানতাশায়ো ওয়াতো ইযযো মানতাশায়ো ওয়াতো যিললো মানতাশায়ো – বেয়াদিকাল খায়ের – ইন্না কা আলা কুললি শাইঈন কাদির – তুয়ো লিযুল লাইলা ফিন্ নাহারে ওয়া তুলিযুন নাহারা ফিল লাইলে ওয়াতুখ্ রিযুল হাইয়া মিনাল মাইয়াতে ওয়া তুখ্রিযুল মাইয়াতা মিনাল হাইয়ে ওয়া তারযুকো মান্তাশায়ো বেগায়রে হেসাব!’ এরশাদ হচ্ছে :
কুল মুলুকের ওগো মালিক মহান,
তুমিই সর্বশক্তিমান
যারে তুমি চাও রাজ্য দাও, যখন ইচ্ছা ছিনিয়ে নাও
যারে চাও তুমি দাও সম্মান, যারে চাও তুমি করো অপমান
কল্যাণময় তোমার বিধান
তুমিই সর্বশক্তিমান
জীবতকে মৃত, মৃতকে জীবিত তুমিই করো
রাত্রিকে দিন, দিনকে রাত্রি তুমিই করো
যারে তুমি চাও বিত্ত-বৈভব অগণিত করো দান
(সুরা আল ইমরান, ৩ পারা ২৬-২৭ আয়াত। অনুবাদ : বেলাল মোহাম্মদ)
আমরা তিনজন স্তব্ধ হয়ে রিসাইটাল শুনি। তখন ফিকে হয়ে আসছিল আলো। পৃথিবীতে নামছিল অন্ধকার। ভিড় ঠেলে আমরা দ্রুত এগোতে থাকি।