ক্রাইসিস

প্রথমটা বুঝতে পারেনি বিতান। ভেবেছিল গলায় ঘুমের রেশ লেগে থাকাটাই কারণ হবে হয়তো। সকাল থেকে দুজনকে ফোন করেছে। দুজনেই ওর খুব চেনা। নিয়ম মেনে প্রত্যেকদিন না হলেও প্রায় প্রতিদিনই কথা হয়। অথচ কেউই বিতানকে চিনতে পারেনি।

ভালো করে চোখ-মুখ ধুয়ে এসে, জল খেয়ে বাসবীকে ফোন করল বিতান। বাসবী ওর কলিগ। পাশের টেবিলেই বসে। সারাদিন কাজের ফাঁকে নানারকম ঠাট্টা-ইয়ার্কি চলতেই থাকে। অফিসের পরও অনেক সময় কথা হয় ফোনে। নিছক বন্ধুত্বই। বাসবীও যখন চিনতে পারল না গলা, এক অদ্ভুত সন্দেহ শুরু হলো নিজের ভেতরে। বিতান বুঝে উঠতে পারছিল না, সত্যি সত্যিই কি বদলে গেছে ওর গলা, নাকি সবাই মজা করছে ওর সঙ্গে। কিন্তু সবাই একজোট হয়ে মজা শুরু করবে কেন এই সাত সকালবেলায়?

বাসবীর পর খোকন, গুপ্তাজি, বিকাশদা। তারপর মিস্টার মেহেরা। সব জায়গাতেই একই পুনরাবৃত্তি। কেউই চিনতে পারছে না বিতানকে। একবার আয়নার সামনে নিজেকে দেখল। না, কোনো পরিবর্তন নেই। অঙ্গসৌষ্ঠবে বদল তো কিছু চোখে পড়ছে না! আয়নার সামনে দাঁড়িয়েই একবার চিৎকার করল বিতান। দর্পণের সঙ্গে শব্দের কোনো সম্পর্ক নেই। অন্যেরা কেন ওকে চিনতে পারছে না বুঝে উঠতে পারল না বিতান। ক্রমশই মুষড়ে পড়তে থাকল ভেতরে ভেতরে।

বিতান ঘোষাল। বয়স ছত্রিশ। থানার সাব-ইন্সপেক্টর এবং অবিবাহিত এহেন যোগ্যতা থাকলে একজনের যা যা সৎ বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠতে পারে তার প্রায় সবই রয়েছে বিতানের। ঝকঝকে স্মার্ট আর ব্যতিক্রম চোস্ত ইংরেজিতে কথা বলতে পারা। এহেন বিতানকে কেউ চিনতে পারছে না। সবাইকে পরিচয় দিতে হচ্ছে। বিতান কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিল না কোথায় ঘটে গেছে বিপর্যয়।

এরকম অবস্থায় প্রথমেই যেটা ঘটে, তা হলো লোকে হারিয়ে ফেলে আত্মবিশ্বাস। গতকাল অবধি সব ঠিক ছিল, সকালে উঠেই আইডেন্টিটি ক্রাইসিস। বিতানকে পাড়ার সকলেই চেনে। পুরনো বাসিন্দা, সুপুরুষ, তায় পুলিশে চাকরি। কিন্তু এখন নিষ্কৃতির উপায় কী? ভাবল, পাড়ায় একটু হেঁটে আসি। না হয় দেরি করেই অফিসে যাব।

হাঁটতে বেরিয়ে ভেতরে একটু তটস্থ বিতান। মোড়ের মাথার চায়ের দোকানের ছেলেটি বলল, কী স্যার, আজ হেঁটে? সাধারণত নিজের মোটরসাইকেল ছাড়া বের হয় না বিতান। একচিলতে শীতের রোদ্দুরের মতো হিমানী বউদি আলতো হাসলো। এই হাসিটুকু এক মটকায় যেন অনেকখানি আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে দিলো বিতানের।

যে-কয়েকজনের সঙ্গে দেখা হলো, সকলের সঙ্গেই হেসে সৌজন্য বিনিময় করল বিতান; ইচ্ছে করেই কারো সঙ্গে কথা বলল না। শুধু মাস্টারদা বলে পরিচিত চকোলেটের বাবা বললেন… একবার তোমার অফিসে যাব, কিছু কথা আছে। আমার একটা জমি নিয়ে সমস্যা হচ্ছে, যদি হেল্প করতে পারো।

খুব সতর্ক হয়ে আলতো স্বরে বিতান বলল, ঠিক আছে। একদিন সময় করে চলে আসবেন। কথাটা শেষ করে টেন্সড হয়ে গেল বিতান। মাস্টারদা কিছু বুঝতে পারেননি তো! ওনার হাবভাবে কোনো পরিবর্তন নজরে পড়ল না বিতানের।

বাড়ি ফিরে আবার আয়নার সামনে ভালো করে নিজেকে দেখল বিতান। এরপর স্নানে যাবে। নিজেকে দেখতে দেখতেই আয়নার সামনে খুলে ফেলল সমস্ত পোশাক। ওর অনাবৃত পুরুষ সৌষ্ঠব দেখে শালবৃক্ষের কথা মনে হলো। শীতের পাতাঝরা শুষ্ক শালবৃক্ষ অথচ অঙ্গসৌষ্ঠবে সৌন্দর্যের গরিমা। সবই তো ঠিক আছে। তাহলে ফোনে ওর গলা কেউ চিনতে পারছে না কেন?

এই সময় মানুষ ভয় পায়, শীত করে। কেউ হয়তো কোনো নির্দিষ্ট লোকালয়ে থাকে। একদিন সকালে উঠে যদি কেউ আর কাউকে চিনতে না পারে! এ যেন অস্তিত্ব থেকে অনস্তিত্বে পৌঁছে যাওয়া। শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঠান্ডা সাপ নামতে থাকে।

রাগে দুঃখে অপমানে হতাশায় আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ওই অবস্থাতেই আবার চিৎকার করে ওঠে বিতান। নিজের গলার স্বরটা বারবার শুনতে চাইছে নিজেই। আবার এই হঠাৎ এসে পড়া ক্রাইসিসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদও। পাশের ফ্ল্যাট থেকে ছটুর গলা ভেসে আসে। কিছু হয়েছে?

ভাঙা গলায় বিতান উত্তর দেয়, না, আরশোলা। এছাড়া আর কীই-বা বলতে পারে ও। বিতান যেন এখন আয়নার ভেতরের বিতানকে অাঁকড়ে ধরতে চাইছে।

থানায় ঢুকতে ঢুকতে প্রায় দুপুর গড়িয়ে গেল বিতানের। প্রতিদিনই থানায় ঢুকে বড়বাবুর সঙ্গে মিটিং করতে হয়। মোটামুটি দিনের প্ল্যানটা ঝালিয়ে নেওয়া। বড়বাবুর ঘরে উঁকি দিয়ে দেখল দেয়ালে ঝোলানো ঘড়িটাতে দুটো বাজে। সত্যিই অফিসে আসতে খুব দেরি হয়ে গেছে। এই সময় বড়বাবু দোতলার ছোট ঘরে চলে যান। ঘণ্টাখানেক ঝিমিয়ে না নিলে চলে না। থানার পাশের চায়ের দোকানের নাড়ু তখন আসে। বড়বাবুর গা হাত পা টেপে। বড়সড় ঘটনা না ঘটলে এইসময় বড়বাবুকে বিরক্ত করা নিষেধ।

ঠিক বিরক্ত করতে নয়, দোতলার ছোট ঘরে উঁকি মেরেছিল বিতান। নাড়ুর তখন শেষ রাউন্ড। চোখ বন্ধ করে ঘাড়টা ঝুঁকিয়ে বসা। নাড়ু ঘাড়ের কাছটা টিপছিল। দরজাটা একটু ফাঁক হতেই চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে বললেন… কী ওস্তাদ, নাইট ডিউটি করতে এলেন নাকি?

অস্তিত্বের সংকট হলে এক ধরনের বিবমিষা গ্রাস করে। এই সময় বড়বাবুকে কিছু বলা বিপজ্জনক। তবু মিনমিন করে কী একটা বলল। নাড়ু তখন বড়বাবুর ঘাড়ে একটা কাঁচি মেরেছে সবে। কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। ঘড়ঘড় ছাড়া কোনো আওয়াজই বের হলো না। মনে হলো মুখটা ভ্যাংচাচ্ছে।

বিতানের মনে হলো, আসলে বড়বাবুর গলার স্বরটাই বদলে গেছে। আর গলার স্বর বদলে গেলে চরিত্রটাও বদলে যায় অনেকখানি। একেই চরিত্রহানি বলে। বিতানের মনে হলো বড়বাবুর চরিত্রহানি হয়েছে।

বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সমস্যাটা বদলে যাচ্ছে। সকালে ওর গলার স্বর চিনতে পারছিল না কেউ। থানায় এসে অবধি যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে কথা বলা এড়িয়ে যেতে। সহকর্মীরা ইয়ার্কি মারলেও উত্তর দিতে গিয়ে চুপ করে গেছে বিতান। সকালে বিতানকে কেউ চিনতে পারছিল না। এখন উলটোটা মনে হচ্ছে। বড়বাবু এখনো দোতলা থেকে নামেননি। অপেক্ষা করতে করতে বিতানের মনে হলো, যারা ওকে চিনতে পারছে না, আসলে এই বদলে যাওয়ার অসুখটা তো তাদেরই।

এক বৃদ্ধ এসেছেন থানায় অভিযোগ জানাতে। কনস্টেবল রামরতন সিং অভিযোগ লিখছে। বৃদ্ধের অভিযোগ, তার পুত্র বাইরে থাকে, পুত্রবধূ ঠিকমতো দেখভাল করে না এবং পুরুষবন্ধু নিয়ে বাড়ির ভেতরই ফষ্টিনষ্টি করে। প্রথম প্রথম লুকোছাপা ছিল। এখন সেই সম্মানটুকুও বৃদ্ধ শ্বশুরকে দেয় না।

রামরতন এর মধ্যে অন্য গন্ধ পাচ্ছে। চোখ-মুখ দেখলেই বোঝা যায়। রোববার দুপুরে মাংস বা পোলাও রান্নার গল্পের মতো এই ঘ্রাণ। বৃদ্ধের কাছে ও জানতে চায় :

– বউমার বয়স কত?

– চল্লিশের কাছাকাছি হবে।

– দেখতে কেমন, ফর্সা?

বৃদ্ধ একটু ইতস্তত করে। কেস ডায়েরির সঙ্গে অভিযুক্তকে দেখতে কেমন এর সম্পর্ক বুঝতে পারে না। কিন্তু লক্ষ করে, রামরতনের গলাটা যেন রামরতনের মতো আর নেই। অন্যরকম শোনাচ্ছে। এমনিতে রামরতনের গলা বেশ জোরালো, এখন আড়াল থেকে শুনলে ধরাই যাবে না রামরতনের গলা বলে।

কে যেন ডাকছে – বিতান বিতান। থানার মধ্যে এভাবে কে ওকে ডাকবে? বিতান বসে একটা বড় ঘরে অন্য চার-পাঁচজনের সঙ্গে। বেরিয়ে এসে দেখল বড়বাবু। গলার স্বর একেবারে বদলে গেছে।

বড়বাবু ওনার ঘরে ডিসি হেড কোয়ার্টার্সের একটা নোটিশ পড়ে শোনাচ্ছিলেন বিতানকে। বিতানের কানে কিছুই ঢুকছিল না। সামনে বসা বড়বাবু আবছা হয়ে আসছিলেন ক্রমশ। এই বড়বাবুকে বিতান চেনে না। গলার স্বর আলাদা, কথা বলার ভঙ্গি আলাদা। একটা চেনা লোক চোখের সামনে অচেনা হয়ে গেলে নিজেকেও তখন অচেনাই মনে হয়।

তবু সাহস সঞ্চয় করে বড়বাবুকে বিতান জিজ্ঞাসা করল, আপনার কিছু হয়েছে?

হাঁ করে চেয়ে থাকেন বড়বাবু। এই বিতানকে উনি চেনেন না। নিজের মধ্যেই এক অযথা সমস্যার সম্মুখীন হয়ে পড়েন। কী করবেন বুঝতে না পেরে লাগোয়া টয়লেটে গিয়ে আয়নায় নিজের মুখ দেখেন। চেনা মুখই। কিছুটা আশ্বস্ত হয়েই আবার ফিরে আসেন ঘরে।

স্যার, আপনার গলার স্বরটা যেন কীরকম লাগছে!

কী বলছ বিতান! গলার স্বর তো তোমার পালটে গেছে। থানার বাকি অফিসাররাও তাই বলছে।

কথাটা শুনে হাসি পেল বিতানের। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে হাসতে শুরু করল। বন্যার জলের মতো ফোঁপানো হাসির গমক ভেতরে বাড়তে থাকল বিতানের। কী করা উচিত বুঝতে না পেরে বড়বাবু চিৎকার করে ডাকতে শুরু করল।… তপন… দুলু…। একটা অশুভ ইঙ্গিত পেয়ে হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেল বিতান।

মানুষগুলোর সামগ্রিক অস্তিত্বটাই যেন তখন নড়বড়ে হয়ে উঠেছে। একটা পরিকাঠামোর মধ্যে পালটে গেছে সকলে। কেউ কাউকে তাদের চেনা পরিসরের মধ্যে মেলাতে পারছে না। বিতান বড়বাবুকে ভাবছে বদলে গেছে। অন্যরা ভাবছে বিতান বদলে গেছে। কেউ কাউকে চিনতে পারছে না।

এটা একটা অসুখ। এই অসুখের নাম কেউ জানে না।

এমন বিপর্যয়ের মুখে বিতানকেও যে কখনো পড়তে হতে পারে, স্বপ্নেও কখনো ভাবেনি ও। মানুষ যখন ব্যক্তিসত্তা হারিয়ে ফেলে, বিষাদ এসে গ্রাস করে। এই বিষাদই অবসাদ। হঠাৎ একদিন কোনো একজনকে সেই লোক বলে আর কেউ চিনতে পারছে না। আইডেন্টিটি ক্রাইসিস। বিতান ঘোষাল আর বিতান ঘোষাল নয়। তখনই মনে হয় বেঁচে থেকে কী লাভ! আত্মহত্যার প্রবণতা জন্ম নেয়।

ডা. ঝম্পটি বড়বাবুর ছেলেবেলার বন্ধু। টেলিফোনে বিতানের ব্যাপারটা বলে অ্যাপয়েন্টমেন্ট ঠিক করে দিলেন। বললেন, ঝম্পটি আমার অনেকদিনের বন্ধু, এ-বিষয়ে একজন অথরিটি। ওকে একবার দেখিয়ে নাও। তোমার গলার ব্যাপারটা ফেলে রেখো না।

বিতানকে সব দেখেশুনে ডাক্তারবাবু বললেন, আত্মবিশ্বাসের অভাব হলে এরকম হয়। নানা ঘটনা যা জ্ঞানে বা অজ্ঞানে ঘটে যাচ্ছে তার প্রভাবে অনেক সময় আত্মবিশ্বাসের অভাব হতে পারে। অনেক সময় কোনো স্বপ্নও কাউকে বিপর্যস্ত করে। যার ফলে আত্মবিশ্বাসহানি হয়। আত্মবিশ্বাসহানির অনেক সিনড্রোম। একটা হচ্ছে গলার স্বর পালটে যাওয়া।

ডাক্তারবাবু আরো খোলাসা করে বললেন, অনেক সময় গলার স্বর পালটে যায়, আবার অনেক সময় প্রকৃত যায়ও না। মনে হয় স্বরটা পালটে গেছে। অনেক সময় স্বরটা পালটে পরিচিত কারো সুরের মতো হয়ে যায়। লোকে তখন প্রায়শই তাকে অন্য লোক ভেবে ভুল করে।

ডাক্তারের চেম্বার থেকে অনেকটা আত্মবিশ্বাস সঞ্চয় করে বেরোয় বিতান। পাশে সিডির দোকান থেকে শ্যামল মিত্রের পুরনো গান ভেসে আসছে। গানের সঙ্গে গুনগুন করে গলা মেলায় বিতান। ওর ভেতরে এক অদ্ভুত স্ফূর্তি এসেছে। ওর মনে হচ্ছে, এই বদলে যাওয়াই বা মন্দ কী? বাড়ির কাছাকাছি এসে নিজেই চিৎকার করে ডাকল চেনা কয়েকজনকে। কেউ চমকে গেল না। সকলেই স্বাভাবিকভাবে কথা বলছে। কেউ বলেনি গলার স্বরটা অস্বাভাবিক লাগছে। বিতানের কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। পালটে-যাওয়া জীবনের আনন্দে পূর্ণিমার জ্যোৎস্নার মতো যেন ভেসে যাচ্ছে বিতান।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত