সুখের বমি

সুখের বমি
শেফা ওয়াক ওয়াক করে বারান্দায় বসে বমি করছে। তাকে দেখে আমাদের পাশের বাড়ির এক ভাবী ঠোঁট টিপে হেসে বললেন,’কয়মাস চলে গো বউ?’ শেফা আস্তে করে বললো,’ওসব কিছু না ভাবী। পেটে খুব গ্যাস হয়েছে তাই বমি হচ্ছে।’ ‘ও।’ এই ভাবীই দুদিন পর আম্মার কাছে এসে বললেন,’চাচী আম্মা,আনোয়াররে বিয়া করাইছেন তো কমদিন হয়নাই।কম হইলেও চাইর বৎসর এর উপরে।এর মাঝেও যেহেতু কোন সংবাদ নাই তাইলে বুঝছইন তো এইখানে একটা কিন্তু আছে। আমার মনে হয় শেফা বাজা মাইয়া।
চাচী আম্মা, আপনার মাত্র এক পোলা।ওর যদি পোলা মাইয়া না হয় তাইলে বংশ কূল রাখবো কেলা কন? ডাক্তার দেখাইয়াও যেহেতু ফল শুভ হয়নাই আপনার উচিত চাচী আম্মা আনোয়াররে আরেক বিয়া করানো। পুরুষ মানুষ দুই চাইর বিয়া করলেও ঝামেলা নাই।সে তো আর মনের শখে বিয়া করবো না।সে বিয়া করবো বংশ রক্ষার লাইগা ।’ আম্মা খুব নম্র এবং ভদ্র মহিলা। কারোর সাথে কোনদিন তিনি উচ্চ গলায় কথা বলতে পারেন না। মিষ্টি করে হেসে হেসে তিনি কথা বলেন।কেউ তাকে আঘাত করে কথা বললেও তিনি আঘাতকারীর সাথে ভালো আচরণ করেন। কিন্তু সেদিন আম্মার কেন জানি রাগ উঠে গেল ভাবীর প্রতি। তিনি উচ্চ গলায় বললেন,’আমারে তোমার কূট বুদ্ধি দেওন লাগবো না বউ।কী করন লাগবো না লাগবো তা আমি বুঝি।’
ভাবী আম্মার সাথে যুত করতে না পেরে মুখ কালো করে আমাদের বাড়ি থেকে চলে গেলেন। কিন্তু এই কথাগুলো শুনেছে শেফাও। তাকে যে বাজা মহিলা ডাকা হয়েছে তাও শুনেছে সে।তাই রাতের বেলা বিছানায় শুয়ে আমার কাছে বড় কাতর গলায় শেফা বলল,’আপনার কাছে আমার একটা অনুরোধ আছে। রাখবেন অনুরোধটা?’ ‘রাখার হলে রাখবো ‌।বলো কী অনুরোধ।’ ‘আপনি আরেকটা বিয়ে করেন।’ কথাটা বলতে গিয়ে শেফার চোখ জলে টলোমলো হয়ে উঠলো।তার শ্বাস-নিঃশ্বাস হয়ে উঠলো ভারী। আমি ধীরে স্হীরে ওর হাতটা টেনে ধরলাম। তারপর তাকে কাছে টেনে ওর চুলগুলোতে আঙুলে বিলি কেটে দিতে দিতে বললাম,’কেন বিয়ে করতে হবে আরেকটা?’
শেফা প্রায় কেঁদেই ফেললো।ভেজা গলায় বলল সে,’আমি তো বাজা মেয়ে ছেলে। আপনাকে সন্তান দিতে পারবো না আমি।’ ‘সন্তান দেয়ার মালিক কী তুমি?’ এবার শেফা চুপ হয়ে যায়।ঢুকরে কেঁদে উঠে সে। সেই কান্না শুনে দৌড়ে আমাদের ঘরে আসেন আম্মা। এসে অস্হির হয়ে বলেন,’কী হয়েছে আমার মায়ের কী হয়েছে?’ শেফার কান্না আরো বাড়ে। আমি আম্মার কাছে সবকিছু খুলে বলি।আম্মা তখন শেফাকে কাছে টেনে নেন। আম্মা খাটের উপর বসে শেফার মাথাটা নিজের কোলে নিয়ে ছোট বাচ্চাকে যেভাবে তার মা হাত বুলিয়ে দেয় সেভাবে তার মাথায় আম্মা হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলেন,’মা,মারে,সবর হইলো বিরাট ফলবান একটা জিনিস। এই সবর যার আছে তার অনেক কিছুই আছে।
পৃথিবীতে এমন কত পুরুষ আছে যার স্ত্রীর সন্তান হবে না কোনদিন এটা জেনেও তারা সংসার করে যাচ্ছে! আবার অনেক নারীও আছে এমন,যার স্বামী সন্তান দানে অযোগ্য। কিন্তু তাদের ভালোবাসা এতোটাই মজবুত যে তারা আমৃত্যু একসাথে থাকছে।আর সংসার করলেই সন্তান হতেই হবে, কিংবা যে করেই হোক বংশ রক্ষা করতেই হবে এটা মানুষের ভ্রান্তি। কারণ বংশের মান মর্জাদা মানুষ নির্ধারণ করে না। করেন আল্লাহ। আর সন্তান তিনিই দান করেন। মরিয়ম আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে যদি কোন স্বামী ছাড়াই সন্তান দিতে পারেন তিনি তাইলে তুমি কেন একদিন সন্তানের মা হইতে পারবা না। তোমার তো স্বামী আছে।ডাক্তারেরা তো আর সন্তান দিবে না। সন্তান দিবেন আল্লাহ। তিনি তো আর না বলেননি।তার কাছে চাও। কাঁদো।দেখবে আল্লাহ সবচেয়ে বড় আশ্চর্য জনক কিছু ঘটিয়ে দিবেন। ইনশাআল্লাহ।’
আম্মার কথা শুনে শেফার কান্না আরো বাড়লো।সে আম্মার কোলে মাথা রেখে এমন ভাবে কাঁদছে যেন পৃথিবীতে এরচেয়ে সুন্দর করে আর কেউ কাঁদতে পারে না।আর পবিত্র কান্না গুলো তো এমনই হয়। তিন বছর পরের কথা। শেফা আবার ওয়াক ওয়াক করে বমি করছে।তার মাথা ধরেছে খুব। এবার আর উঠে বারান্দায় যেতে পারেনি। বিছানায় বসেই বমি করে তার সব কাপড় আর বিছানার চাদর নষ্ট করে দিয়েছে।আমি তখন শেফার বোরখাটা ইস্ত্রি করছিলাম।কারণ আমাদের ডাক্তারের কাছে যাওয়ার কথা। কিন্তু ওর বমির জন্য আর ইস্ত্রি করে শেষ করতে পারিনি। দৌড়ে গেলাম রান্নাঘরে। ওখান থেকে লেবুর একটা কাঁটা টুকরো নিয়ে ওর কাছে এসে এক হাতে ওর নাভী চেপে ধরলাম আর অন্য হাতে লেবুটা নিয়ে ওর নাকের কাছে ধরলাম। এবার একটু কাজ হলো।শেফার বমিটা কমলো।বমি কমার পর শেফা মুচকি হাসতে লাগলো। আমি বললাম ,’এভাবে হাসছো কেন?কী হয়েছে বলতো?’ শেফা আমাকে দু হাতে জড়িয়ে ধরে বললো,’এটা অসুখের বমি নয় তাই হাসছি।’
আমি বড় অবাক হয়ে বললাম,’তবে এটা কিসের বমি? শেফা হু হু করে হেসে উঠে বললো,’এটা সুখের বমি।’ সেদিন রাতেও আম্মা আমাদের ঘরে আসলেন।তার হাতে মিষ্টির প্যাকেট। প্রতিবেশীদের কাছে তিনি মিষ্টি বিতরণ করেছেন। এখন আমাদেরও খেতে হবে। আম্মা আমার আর শেফার মুখে দু দুটো মিষ্টি পুরে দিয়ে বললেন,’সবরে মেওয়া ফললো তো?’ শেফা গাঢ় করে হাসলো। আম্মা আবার বললেন,’আল্লাহর কাছে কোন কিছু চাইলে তিনি ফিরিয়ে দেন না।তার ধন ভান্ডারে কোন কিছুর অভাব নাই!’ আমি আর শেফা তখন চিৎকার করে বলে উঠলাম,’আল্লাহ মহান।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত