রেল কম

ছেলে শিশির। মেয়ে বিজলি। পড়াতে বসেছে বাপ রাজেন মন্ডল। পড়ানো মানে পাশে থাকা। যাতে আনমনা না হয়। না ঢুলতে শুরু করে। সকালে মাস্টার আসে। এগারোটায় স্কুল। পিঠে পববত ঝুলিয়ে চারটেয় ফেরা। বিকেলে বাদার মাঠে ফুটবল ক্রিকেট হাডুডু। সন্ধে নামতে দেরি। চোখ ঢুলঢুল। সময় ফুরসত থাকলে রাজেন পাশে নিয়ে বসে। নিজের লেখাপড়া হয়নি। অক্ষরজ্ঞান নেই। শিশিরই তাকে গোটা অক্ষরে নাম লিখতে শিখিয়েছে। দরকারে সই দিতে পারে। ছেলেমেয়েরা নিজেরাই বইখাতা নিয়ে বসে। এতেই তার দেশ-বিদেশের অনেক কথা জানা হয়। মানুষ নাকি চাঁদে বেড়াতে যাবে। সেখানে নাকি ঘরবাড়ি তৈরি হবে। রাজেন রাতের আকাশে তাকিয়ে ভাবে, সে-বাড়ি ইটের নাকি জোছনার!

কলোনির মাঝখানে সরু ফালি রাস্তা। পাশে কাঁচা নর্দমা। দুপাশে ছোট ছোট ঘরবাড়ি। অধিকাংশই মাটি অথবা ইটের। ওপরে টিন-টালি। তবে ইলেকট্রি আছে। ঘরে ডুম জ্বলে। কারো পাখাও আছে। রাজেনের বাপও ঘর গড়েছিল মাটির। রাজেন সেটা পাকা করেছে। ইটের দেয়াল। লাল সিমেন্টের মেঝে। ওপরে অ্যাসবেস্ট। সীমানা ঘিরেছে বাখারির বেড়ায়। ইটের থামে লোহার গেট।

মাঝে মাঝে নিজের চৌহদ্দি ঘুরেফিরে দেখে। লাউগাছের গোড়া খোঁচায়। লংকাগাছের হলুদ পাতা ছেঁড়ে। আর কত কী যে ভাবে। শিশির বড় হচ্ছে। পরের বছর মাধ্যমিক দেবে। পাশ দিয়ে বেরোলে মিগেন বিশ্বাসের লোহালক্কড়ের কারবারে লাগিয়ে দেবে। বছর দুয়েকে হিসেব-কিতেব বুঝলে চকবাজারে দোকান দেবে। নিজের ব্যবসা। এই ব্যবসায় আজকাল অনেক লাভ। বিজলির বিয়ে দেবে বড় ঘরে। অ্যাসবেস্ট ফেলে ঢালাই ছাদ। ওপরে ওঠার সিঁড়ি। চাঁপার বড় শখ গরমের সময় সন্ধেবেলা ছাদের ঠান্ডা হাওয়ায় বসার। রাজেন তাই টাকা জমায়। আর বছর পাঁচেক টানতে পারলে… এখন ভরসন্ধে। চাঁপা রান্নাঘরে। দিনটা ফাঁকা দেখে সে রাজেনকে বলেছিল, ছেলেমেয়েরা মাংস মাংস করে। একটু এনে দাও না। কাঁহাতক কচুঘেঁচু আলু-কুমড়ো-পটোল খাওয়া যায়।

সেই মাংস পেঁয়াজ-আদা-রসুনের মশলায় টগবগ ফুটছে। ঢাকনা ঠেলে বেরিয়ে আসা ভাপ গন্ধ ছড়িয়েছে ঘরময়। শিশির পড়তে পড়তে আনমনা। বলে, আজ আমাকে তিন টুকরো দিতে বলবে বাবা। মা শুধু তোমাকে দেয়! দিবে দিবে। তুই মন দিয়ে পড়াটা কর। পাশ দে। আমার মতো যেন রাতবিরেতে…

রাজবাবু আছেন, রাজবাবু?

এই নামেই ডাকে ওরা। তবে আজ হঠাৎ বাবু জুড়ে দেওয়ায় অচিনা লাগছে।

বাড়ির সবাই থমকে যায়। আড়ষ্ট। এই ডাকে ওদের আতঙ্ক। চাঁপা বিরক্ত। ঝামটা দিয়ে বলে, তুমি চুপটি করে বসে থাক। যা তো শিশির। বলে দে, বাবা ঘরে নাই। যতসব অসময়ের আপদ!

রাজেনই এগিয়ে যায়। লোহার গেটে এসে দাঁড়ায়। অল্প আলোর আভাসে শুকনো দুঃখী মুখ। বছর আঠারোর একটি ছেলে কাতর চোখে তাকিয়ে। পাশে রেলের পয়েন্টম্যান হরিশ। রাজেন জানতে চায়, কোথায়? কুন লাইনে? এই লাইনেই। দত্তপুকুরের আগের স্টেশন, বিড়া।

কাটা, না খাম্বার ধাক্কা?

কাটা। তিন টুকরা।

লাশের হাল-হদিস?

লাশ নয়, আমার বাবা। ছেলেটির উত্তর।

কাটা পড়লে সে আর বাবা কাকা মামা নয়। লাশ হয়ে যায়। তা আপনি কেন, ছেলেমানুষ!

আমাদের আর কেউ নেই রাজবাবু।

ছেলেটির দুঃখী মুখের দিকে আর একবার তাকায় রাজেন। মনটা ভিজে যায়। বেচারি! এক ভয়ংকর স্মৃতি ঝলসে ওঠে মনে। চাপা দিয়ে বলে, একটু দাঁড়ান। আসছি।

বাড়ির পেছনে ছাউনির একাংশ। সেখানে নাইলনের দড়িতে তার লাশঘাঁটা প্যান্ট। কালোর ওপর লাল ডোরার গেঞ্জি। কাল রাতে ফিরে ধুয়ে মেলে দিয়েছিল। গেঞ্জিটা শুকোলেও প্যান্টের কোমরের দিকটা ভেজা। সেটাই পরে রাজেন। পকেটে ছোট ছুরি। চাঁপা এসে দাঁড়ায়, চললে যে। মাংস নামিয়েছি। দুমুঠো মুখে দিয়ে যাও।

তুই কি নতুন এলি চাঁপা। জানিসনি, পেট ভরা থাকলে আমার বমি পায়!

ভোরের দিকে যেতে না হয়। মুখের গরাশ ফেলে যাওয়া। হ্যাঁ। ততক্ষণে লাশ পচে ফুলে ঢোল। কুকুর-শিয়ালে চাদ্দিকে ছড়াবে। কাজের ডবল অসুবিধে।

আর লোক নাই!

থাকলে আমাকে ডাকবে কেন! আর বকাসনি। এটা তো মা-বাপের দিয়া ব্যবসা।

চাঁপার চোখ ছাপিয়ে জল আসে। একটা বেলাও ছেলেমেয়েরা বাপের সঙ্গে আহ্লাদ করে খেতে বসতে পায়নি! অবুঝের মতো কথা বলিসনি পাগলি। এতেই সংসারের ভাত, কাপড়, বলে গেট ঠেলে বাইরে আসে।

ছোট স্টেশন বিড়া। টানা প্লাটফর্ম। প্রায় ফাঁকা। স্টেশনমাস্টারের ঘরের বাইরে দাঁড়ালে হরিষকে দেখে বলে, এসেছ। একটু দেরি হলো। এই যে ইনি, লাশের আত্মীয়। অপেক্ষা করছেন। তাকে দেখে ছেলেটি এগিয়ে যায়। ডুকরে ওঠে, মামাবাবু! মামাবাবু তাকে বুকে জড়িয়ে বলে, চিন্তা কোরো না অন্বয়। আমরা তো আছি।

রাজেন জিজ্ঞাসা করে, লাশ কুনদিকে?

স্টেশনমাস্টার বলে, ওই লাস্ট সিগন্যালের ওপারে।

আগন্তুক মামার দিকে রাজেন এসে বলে, দুশো টাকা দিন মামাবাবু। পেলাস্টিক দড়ি মোমবাতি কিনতে হবে। অত টাকা তো সঙ্গে আনিনি। খবর পেয়েই দৌড়ে এসেছি। আমার কাছে আছে। মা দিয়েছে, বলে অন্বয় রাজেনের হাতে দুটো একশর নোট দেয়।

স্টেশনের বাইরে বাজার। রাত্রি প্রায় সাড়ে আট। রাজেন দড়িদড়া ইত্যাদি নিয়ে দুর্ঘটনার জায়গায়। লাইনের পাশে ঝোপঝাড়। জোনাকি। দুটো কুকুর, নাকি শেয়াল! মাঝে মাঝে পাথর ছুড়ে তাড়াচ্ছে তিনটে লাইনের ওপারে দাঁড়ানো রেলপুলিশ। মোমের আলোয় রাজেন দেখে লাশ লাইনের মাঝখানে। বুকের ওপর দিয়ে চাকা চলে গেছে। বাইরের দিকে একটা হাত-সমেত বুকের অন্য অংশ। কিন্তু আর একটা হাত! এদিক-ওদিক খুঁজে বেড়ায় রাজেন। শেষে ঝোপের পাশ থেকে তুলে আনে। খানিকটা খেয়ে শেষ করেছে কুকুর বা শেয়াল। কাক পিঁপড়েয় খেয়েছে একটা চোখ, নাকের খানিকটা। শরীরে পাথরে ছেঁচড়ানোর চেরা দাগ। পকেট হাতড়ে কিছুই পাওয়া যায় না। আগেই সাফ। তবে তার এত দরদ কেন! এমন অনেক খাবলানো-খুবলানো লাশ দেখতে দেখতে চোখ পচে গেছে। পাথরে বিছানো পলিথিনে টুকরো-টাকরা রেখে লাশের পা ধরে হিড়হিড় ছেঁচড়ে টেনে আনে। পুরো শরীর ঢেকে পলিথিন পেঁচিয়ে একটা লম্বা বালিশের আকৃতি। মাথা থেকে পা পর্যন্ত দড়ি জড়িয়ে বাঁধে। টানতে টানতে প্লাটফর্মের শেষপ্রান্তে। স্টেশনমাস্টারকে খবর দেয়, লোকাল এলে লাল বাতি জ্বেলে রাখবেন।

অন্বয় এবং মামাবাবু শেষ দেখার আগ্রহে সঙ্গে আসে। রাজেন বলে, কিছু দেখতে পারেননি। মর্গ থিকে লাশ হাতে পেলে দেখবেন।

তবু তারা অকারণ সঙ্গে থাকে। পলিথিন-জড়ানো লাশের দিকে তাকিয়ে অন্বয় ফুঁপিয়ে কাঁদে। মামাবাবু সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করে। ট্রেন আসে। রাজেন বলে, আপনারা উঠে পড়ুন। বারাসতে নামবেন।

বডি? মামাবাবুর জিজ্ঞাসা।

যাবে। কামরায় নয়। পেসিঞ্জাররা কাটা পচা লাশ কামরায় তুলতে দিবেনি। বডি থাকবে আমার হিপাজতে। শেষে। যান উঠে পড়ুন। আমাকে কাজ করতে দিন।

ট্রেনের পেছনে, বাফারে দড়ি জড়িয়ে শক্তভাবে লাশকে বাঁধে রাজেন। টেনেটুনে পরীক্ষা করে। ঝাঁকুনিতে ছিঁড়ে বা খুলে না যায়। সব ঠিক থাকলে গার্ডকে ইশারা করে। নিজে বাফারের দুদিকে পা ছড়িয়ে পেছনের আলো অাঁকড়ে বসে থাকে। ট্রেন ছুটে চলে।

এভাবেই ঝুঁকি নিয়ে বসতে হয়। বসে থাকত তার বাবা। বাফারে বাঁধা লাশ। এমনই বাতি অাঁকড়ে। এভাবেই লাইন থেকে সাড়ে ছশোর বেশি লাশ পৌঁছে দিয়েছে নানা মর্গে।

বয়স হয়েছিল তার। একা সামাল দিতে পারতনি। তবু রেহাই নাই। ডাক আসত। বেরিয়ে পড়তে হতো।

রাজেন তখন ছোট। তার শিশিরের চেয়েও ছোট। মাকেও যেতে হতো। শিয়ালদার কত যে লাইন! লক্ষ্মীকান্তপুর ক্যানিং, রানাঘাট, কেষ্টনগর, ডানকুনি, বারাসাত, বনগাঁ, লালগোলা, মুর্শিদাবাদ, হাসনাবাদ, টাকি… আরো কত। দুজনের ছোটাছুটি লেগেই থাকত। মা কাজে বেরোলে, গোলাপিমাসিকে বিশটা টাকা দিয়ে বলত, ছেলেটাকে দুমুঠো খেতে দিস গোলাপি।

এতেই রাজেনের মজা। কোথাও যেতে বারণ নেই। স্কুলে লেখাপড়াও নেই। সারাদিন খেলে বেড়ানো। রবারের ফুটবল। পাটার ক্রিকেট। বাদায় কাদা মেখে জল ছেঁচে মাছ ধরা। ক্ষেতের আলে আলে কাছিমের ডিম হাতড়ানো। কখনো দুপুরে, কখনো মাঝরাতে তার ডাক পড়ত। তাও বাপ আসে তো মা নেই।

সেবার পরপর তিনটে দিন পেরিয়ে গেল। কেউ এলনি। রাতের খাবার দিয়ে মাসি ঘরে গেল। হঠাৎ ভোররাতে ডাকা দরজা খুলতেই মায়ের বুকফাটা কান্না। মাসি-মেসোরা ছুটে আসে। পাড়ার লোকজন। মাকে থামায়। শান্ত হলে, মা বলে, চ বাবা আমার সঙ্গে, শ্মশানে।

কিন্তু শ্মশানে কেন? তার যে ভয় করে!

মা তখন পাগলপারা। একা একাই শ্মশানদিকে ছুটে চলে। মাসি-মেসো পাড়ার লোকও আসে। শ্মশানে মণ দুয়েক কাঠে চিতা সাজানো। ওপরে পলিথিন-জড়ানো বালিশ। পচা-গন্ধে কেউ এগোতে পারেনি। নাকে ধুতি অাঁচল চাপা। মেসো বলে, উটা কে বঠে রে মিনতি! তুই কেন। ডোমরা কোথা!

মা হাহাকার করে উঠল, উ-ই তো রাজেনের বাপ! মর্গের মড়াকাটা ডোমরা অনেক টাকা চাইছিল। দিতে পারিনি। দুদিন পর পচিয়ে লাশ ফিরত দিলো। এখানের ডোমরা পচা-মড়া পুড়াতে বেশি টাকা চাইছে…

মরল কী করে!

আমার পুড়া কপাল। আমি তো কাছে ছিলমনি। খবর পেয়ে লাশ উঠাতে গিয়ে দেখি, কোমরে জালকাঠি বাঁধা। বুকটা ধড়াস করে উঠল। উলটে দেখি, হ্যাঁ আমার কপাল পুড়ছে গো দাদা… মাথা ঠিক রাখতে পারলমনি। উল্টা দিকের লোকালে ঝাঁপ দিতে ছুটছি। লোকজন আগুলে ধরল। রেলের বাবুরা বলল, তুমিও গেলে মানুষের গতি করবে কে!

তখন কি বাবার জন্যে কেঁদেছিল রাজেন। নাকি গন্ধে ঘেন্নায় দূরে দাঁড়িয়েছিল। ঠিক মনে নেই। শুধু মনে পড়ে, মা বলেছিল, ওই নুড়োটা জ্বেলে বাপের মুখে ধর।

দুটো দিনও মা ঘরে থাকতে পায়নি। লাশ উঠাবার ডাক। মাকে ছাড়তে চায়নি রাজেন। বলেছিল, আমার একলা থাকতে ভয় লাগে গো মা।

মা বলল, একলা থাকবি কেন। মাসিরা আছে। দিনের বেলা চাদ্দিকে লোকজন।

মাসিরা দরজা আটকে ঘুমায়। ঘরে থাকে। শুধু একলা আমি। ঘরে থাকতে ভয়। মাঠে যেতে ভয়। সন্ধ্যাবেলার বাদাবনেও ভয়।

এত ভয় কেন তোর!

আগুন দিবার সময় আমি যে বাবার মুখটা দেখেছি। চোখ নাই। দুটা গত্ত। নাক ঠোঁট নাই। দাঁতগুলো বেরিয়ে আছে। ওই মুখটা মনে আসে। আর ভয়…

ঘরে থাকলে তো চলবেনি। কাজে না গেলে, লাইনে অন্য কেউ এসে যাবে। ভাত জুটবেনি।

আমিও তোমার সঙ্গে যাব।

চ তবে। লিখাপড়া তো হলনি। কাজ শিখবি চল। আমি মরলে খাবি কী!

সেই কাজ শিখতে আসা। মায়ের কাজ দেখতে দেখতে হাত লাগানো। তাতেই বমি। গন্ধে নাক চেপে থাকা। মাথায় চাঁটি দিত মা। গাল দিত, বমি কেন রে মড়া। গন্ধ কী রে হারামি! ধর শক্ত করে। হ্যাঁ, ইবার উঠা উপরে। দড়ি বাঁধ।

লাশ ঘাঁটতে ঘাঁটতে, দড়ি পেঁচাতে পেঁচাতে ষোলো বছর বয়সেই সে ওস্তাদ। ঝটপট কাজ করতে পারে। দিনে তিনটে লাশ মর্গে জমা করেও হাঁপিয়ে পড়ে না। কদর বাড়তে থাকে। পকেটে টাকা খচখচ করে। ফুর্তির সিগারেট। চুল্লুর পাঁইট। রাতে ছিনাল বাড়িতে মস্তি।

মা বুড়ি হয়। মানুষ কাটা পড়ে। ডাক আসে। সেদিনও এসেছিল। শান্তিপুর লাইনে। তখন বেলা দুপুর। দুজনে হাত লাগিয়ে ঘরে ফেরার তাড়া। সন্ধেয় কুটুম আসবে।

বাফারে লাশ বেঁধে মাকে বসানো। কাউকেচার বেয়ে মা আর উঠতে পারে না। তাকে বাফারে বসাতে হয়। ট্রেন হু-হু করে ছুটে চলে। একদিকে মা। আর একদিকে সে। মা বলছিল, চাঁপার বাপকে আজ কথা দিয়ে পাকা করব। এই ফাগুনেই তোর বিয়ে। শক্তপোক্ত মেয়ে। খাটতে…

আচমকা ট্রেনের ব্রেক। ঝাঁকুনি। মা ছিটকে পড়ে গেল। কিন্তু ট্রেন আবার ছুটতে শুরু করেছে। যখন গতি কমল, হুমড়ি খেয়ে লাফ দিয়ে নেমেছিল রাজেন। দৌড়ে এসেছিল মায়ের কাছে। লাইনের ওপরে মাথা। ঘটি থেকে জল বেরোনোর মতো গলগল রক্ত। হাত পা কাঁপছে থরথর।

তাড়াতাড়ি লাইন থেকে পাশে সরিয়ে কোথায় একটু জল পাওয়া যায় ভাবতে ভাবতেই কাঁপুনি থেমে গেল। হাত-পা থির। লাশ হয়ে গেল তারই হাতে ধরে থাকা আটশো লাশ কুড়ানির জীবন। চোখ দুটো শুধু চেয়েই থাকল।

বারাসাতে রাজেন লাশের দড়িদড়া খোলে। প্লাটফর্মের কিনারে টেনে তুলতে হাঁপিয়ে ওঠে। ঘেমে যায়। লাশ ফুলে ফেঁপে ভারী হয়েছে। রেলপুলিশ আসে। রাজেনের সই নেয়। মামাবাবু অন্বয়ও এসেছে। রাজেন পুলিশকে বলে, একটু দেখো ভাই। ভ্যান-রিকশা ডেকে আনি।

সব ভ্যান-রিকশা লাশ তোলে না। স্ট্যান্ড ছাড়িয়ে পুকুরপাড়ের গলি থেকে ডেকে আনতে হয়। দুজনে ধরাধরি করে ভ্যানে তোলে। রাস্তায় এসে রাজেন বলে, আমরা মর্গে যাচ্ছি মামাবাবু। অন্য রিকশা নিয়ে আপনারা আসুন। ছুটন্ত রিকশায় লাফ দিয়ে রাজেন লাশের পাশে বসে।

তখনই পিছুডাক। রেলের লোক দৌড়োতে দৌড়োতে এসে জানায়, আরে রোকো ভেইয়া। এখুন খবর আসল, হাসনাবাদ লাইনে ঔর এক লাশ গিরেছে।

রাজেন বিরক্ত। শালা লাশের এখন সিজিন। আগে এটা খালাস করি। তারপর সেখেনে গেলে শুনব, কোনো নতুন খবর। মর্গ শহরের বাইরের দিকে। জায়গাটা ফাঁকা ফাঁকা। মর্গের কিছু আগেই রাজেন নামে। ভ্যান-রিকশা মর্গের দিকে যায়। রাজেন বলে, আমার সঙ্গে চলুন মামাবাবু। ওইদিকে ডোমপাড়া। লাশ পচাতে না চাইলে ওদের সঙ্গে রফা করুন। ওরই তো কাটফাড়া করবে। মর্গের দিকে যাবেননি। সকালের ভাত উঠে আসবে। শালা মানুষ এত ভালো তাজা খাবার খায়। মরে গেলে এমন উৎকট গন্ধ যে কেন ছড়ায়, বুঝিনি। কেন মর্গে ডাক্তার নেই!

ডাক্তার আছে। শহরে। রাতে আসবেনি। যা করার এরাই। বয়মে বুক পেট মাথা তুলে রাখে। ডাক্তার শুধু কাগজে সই দেয়। ডগরু, ডগরু আছিস নাকি?

ঝাঁকড়া চুল। মোটা গোঁফ। ডাকাতের মতো চেহারা। কাছে এগিয়ে আসে। ভুরভুর দেশি মদের গন্ধ। মামাবাবু পেছনে সরে যায়। রাজেন বলে, বেশি ঝামেলা করিসনি ডগরু। ওই কচি ছেলেটার মুখের দিকে চেয়ে কথা বলবি। লাশ ওর বাপ, বলে মর্গে লাশ জমা করতে যায়।

কিছুক্ষণ পরে ফিরে এসে বলে, এই কাগজটা রাখুন। কাজ সারা হলে লাশ আপনাদের হাতে দেবে। একটা লরি ভাড়া করবেন। এরাই বেবস্থা করে দেবে। এবার আমাকে বিদায় দিন। আবার তো শুনলেন, হাসনাবাদ ছুটতে হবে। শেষ লোকাল এগারোটায়। পলিশিট কেনার টাকা দিয়েছিলাম দুশো। ফেরেনি কিছু? ও হ্যাঁ। এই যে শিলিপ। সব মিলে একশো বাহান্নো। আর এই বিয়াল্লিশ ফিরত। ছ টাকা রিকশা ভাড়া।

থাক থাক। ওটা তোমার।

গরিবের মেহনতের দাম দিবেননি বাবু!

তোমার তো রেল কোম্পানির মাইনে আছে।

হাসে রাজেন। আমরা রেলের লোক নয়। মাইনাও নাই। পেটের দায়ে করি। আমার মা বাপ মরতে রেল কোম্পানি এক টাকাও দেয়নি। আশ্চর্য। কাজ করিয়ে নেয়, অথচ মাইনে দেয় না!

দেয়। লাশপিছু পঞ্চাশ টাকা। সাত আট মাস পরে। কখনো তাও জুটেনি। আপনাদের নিয়ে পরিবার পালি। বেওয়ারিশ হলে খাটনি বেকার।

কত লাশ তুলেছ?

হাজার পেরিয়ে গেছে বাবু।

এত মানুষ কাটা পড়ে। আবার বলছ, সিজিন!

এখন গরম কাল। কামরা আগুন হয়ে থাকে। গাদাগাদি ভিড়। বাবুরা যাওয়া-আসার সময় হাওয়া পেতে গেটের দিকে ঝুলতে থাকে। লাইনের পাশের খাম্বায় চোট খেয়ে পাখির মতো রোজ  দু-একজন খসে পড়ে। আমাকে ইবার ছাড়ুন বাবু। লোকাল ফেল হলে মালগাড়িতে উঠতে হবে।

অন্বয় বলে, কত দিতে হবে রাজুবাবু।

আপনি তো দেখলেন, মুখের গরাশ ছেড়ে এসেছি। আজ আর খাওয়া জুটবেনি। খুশি মনে দিন শ-ছয়েক।

মামাবাবু মধ্যস্ত করে, পঞ্চাশ টাকা দাও অন্বয়।

রাজেনের পেতে রাখা হাতে একশ টাকা দিয়ে অন্বয় বলে, কোথাও খেয়ে নিও।

যাই বাবু। আর দেখা হবেনি। আমার কাজ তো দেখলেন। এই কাজে আমার বাবা গেছে বজবজ লাইনে। মা শান্তিপুরে। আমিও কবে কুন লাইনে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকি। কে লাশ তুলবে। কুন মর্গে চিরাই ফাড়াই হবে নিজেই জানিনি… বলতে বলতে স্টেশনের দিকে দূরের আলোর বিন্দুতে হারিয়ে যায়।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত