স্টেশনে বসে আছেন প্রণবেশ রাজবংশী। আখাউড়া রেলস্টেশনে। বাংলাদেশের অন্য দশটা স্টেশনের মতোই এটি। তবে আকারে বড়, জংশন। নোংরা, ময়লাযুক্ত এখানে-ওখানে থুতু। এ-ধারে ও-ধারে ছেঁড়া কাগজ, কমলার খোসা, সিগারেটের দোমড়ানো প্যাকেট, পাউরুটির কাভার, ডিমের খোসা, গাজরের আধ-খাওয়া অংশ, বিড়ি-সিগারেটের শেষাংশ, ছাগলের নাদি, কাকের পায়খানা ছড়ানো।
এসব দিকে খেয়াল নেই প্রণবেশ রাজবংশীর। মনে এক গভীর ঘোর এবং শরীরে মৃদু ক্লান্তি অনুভব করছেন তিনি। চট্টগ্রামে থাকেন। চাকরির প্রয়োজনে বা ব্যক্তিগত কোনো কারণে ঢাকা-চট্টগ্রাম যাতায়াত করেন। ট্রেনে। কখনো সুবর্ণতে, কখনো বা মহানগর প্রভাতীতে। যেতে-আসতে জানালা দিয়ে এই আখাউড়া জংশন দেখেছেন। এইটুকু। এত বছরের ট্রেনজার্নিতে কখনো এই স্টেশনের প্লাটফর্মে নামেননি। আজ সেই স্টেশনের প্লাটফর্মে বসে থাকতে হয়েছে তাকে। প্লাটফর্মে নতুন চেয়ার বসিয়েছে রেল কর্তৃপক্ষ। আকাশি রঙের ঝকঝকে হেলান-দেওয়া চেয়ার। ওই রকম একটা চেয়ারে বসে আছেন প্রণবেশবাবু। তাঁর সামনে তিন তিনটে ব্যাগ। ঠাঁসা। দুটিতে বইপত্র। অন্যটিতে নানা কসমেটিক্স, বিস্কুট আর লজেন্সের প্যাকেট।
ক্লান্ত দেহটাকে চেয়ারে এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজলেন রাজবংশীবাবু। ভোরে উঠতে হয়েছিল তাঁকে। সকাল আটটার মধ্যে বর্ডারে পৌঁছার তাড়া ছিল। এই সময় মোবাইলটা বেজে উঠল। সুভাষদার ফোন। আগরতলা থেকে করেছেন। ‘দাদা, ঠিকঠাক মতন পৌঁছতে পেরেছেন তো? ওপারে ঝামেলা হয়নি তো?’ সুভাষদা বললেন।
প্রণবেশবাবু কাতরস্বরে বললেন, ‘না দাদা, অসুবিধা হয়নি কোনো। বাংলাদেশের চেকপোস্টে আমার এক ছাত্র পেয়ে গেছি। ও-ই সবকিছু সহজ করে দিয়েছে। আখাউড়া স্টেশনে বসে আছি। ট্রেন লেট।’ তারপর কণ্ঠ নামিয়ে গাঢ় গলায় বললেন, ‘বুকের মধ্যে বড় চিনচিন করছে দাদা। আপনাদের জন্য।’
ও-পাশে সুভাষ দাস কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। বললেন, ‘আমাদেরও ভালো লাগছে না দাদা। আপনার যাওয়ার পর থেকে রাতুলদা এক্কেবারে চুপচাপ হয়ে গেছেন। যা হোক দাদা, চট্টগ্রাম পৌঁছে ফোন দেবেন।’ বলে ফোন কাটালেন সুভাষ দাস।
প্রণবেশ রাজবংশী একটা প্রাইভেট কলেজে বাংলা পড়ান। সাতান্ন ছুঁই-ছুঁই বয়স। দীর্ঘদেহী। মোটার দিকে গড়ন ছিল এক সময়। ডায়াবেটিস ধরা পড়েছে। ডাক্তারের নির্দেশ, অ থেকে চন্দ্রবিন্দু পর্যন্ত মানছেন। নিয়মিত ওষুধ, কম ভাত, সকালে ঘণ্টাখানেক হাঁটা, সম্পূর্ণভাবে শর্করাজাতীয় দ্রব্যাহার বর্জন – সবকিছু কড়াকড়িভাবে মেনে চলেছেন প্রণবেশবাবু। ফলে শরীর থেকে মেদ ঝরে গেছে। স্লিম শরীর যাকে বলে সেরকমই হয়ে গেছে প্রণবেশবাবুর দেহ। বুকে সামান্য ধুকপুকানি, মাঝেমধ্যে মাথা চক্কর দেওয়া ছাড়া তেমন অসুখ নেই তাঁর শরীরে। প্রণবেশবাবুর জীবনে শোক আছে। একটা নিবিড় বেদনা তাঁকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। এই বেদনার কথা দু-চারজন কাছের মানুষ ছাড়া অন্য কেউ জানে না। কষ্টটাকে নিজের বুকের মধ্যে চেপে রেখেছেন তিনি। মাঝেমধ্যে সেই কষ্টটা তাঁর মধ্যে চাগিয়ে ওঠে। বড় বিষণ্ণতা বোধ করতে থাকেন তিনি। চারপাশটা অাঁধার অাঁধার লাগে তখন তাঁর। চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বোজার পর সেই কষ্টটা তাঁকে পেয়ে বসেছিল। সুভাষদার ফোন প্রণবেশবাবুকে বাঁচিয়ে দিলো। তিনি সংবিতে ফিরলেন।
টুকটাক লেখালেখি করেন প্রণবেশ রাজবংশী। একদা কবিতা লেখার চেষ্টা করেছিলেন। দু-একটা কবিতা স্থানীয় পত্রিকায় বের হলে টিপ্পনী কানে ভেসে এসেছিল – ‘যার তার কাজ নয় কবিতা লেখা। এলেম লাগে।’ কবিতা লেখা ছেড়েছিলেন তিনি। রফিক আজাদ, হেলাল হাফিজ, টোকন ঠাকুর, মন্দাক্রান্তা সেন, সুনীলের কবিতা পড়তে পড়তে তিনি বুঝে গিয়েছিলেন – তাকে দিয়ে আর যাই হোক কবিতা হবে না। প্রবন্ধ লেখার মহড়াও দিয়েছিলেন একদা। ওটাও হয়ে উঠল না। একদিন ঘোর লাগা সময়ে একটা কাজ করে ফেললেন রাজবংশীবাবু। আস্ত একটা উপন্যাসই লিখে ফেললেন। লেখার পর শরমে আর মরণে এক হয়ে গেলেন তিনি। লেখার আনন্দ আর লজ্জার বিষণ্ণতায় ভুগলেন তিনি বেশ ক’মাস। একদিন মুখ খুললেন রাশেদ কামালের কাছে। রাশেদ কামালের স্বাক্ষর নামের প্রকাশনা সংস্থা আছে। অনেকটা রাশেদ সাহেবের পীড়াপীড়িতে উপন্যাসটি বের হলো – জলমানুষের গালগল্প। পাঠকরা বইটা নিল। সমুদ্রপারের জেলেদের নিয়ে লেখা উপন্যাসটি। বিষয় পুরনো, স্টাইলটা নতুন। পুরস্কার-টুরস্কারও পেলেন ‘জলমানুষের গালগল্পে’র জন্য।
এর পর আরো কিছু বই লিখলেন প্রণবেশবাবু। পাঁচ-সাতটা উপন্যাস, দুখানা গল্পের বই বের হলো তাঁর। জীবনানন্দের গভীর নিমগ্নতা ছিল তাঁর। তাঁকে নিয়ে একটা অভিধানের মতো করে বই লিখলেন। নাম দিলেন গোধূলির দিনলিপি। বইটি বিদ্বজ্জনের নজর কাড়ল। তার পরও কেন জানি পাঠকরা প্রণবেশ রাজবংশীকে মনে রাখল জলমানুষের গালগল্পের জন্য। এমনই হয় – একজন সাহিত্যিক অনেকগুলো গ্রন্থ রচনা করলেও সাধারণ পাঠকের কাছে একটি বইয়ের জন্য খ্যাতিমান হয়ে থাকেন। মানিকের পদ্মানদীর মাঝি, অদ্বৈতের তিতাস একটি নদীর নাম, মাইকেলের মেঘনাদ বধ কাব্য, জীবনানন্দের বনলতা সেন, মনোজ বসুর নিশিকুটুম্ব, শংকরের চৌরঙ্গী, সেলিনা হোসেনের গায়ত্রী সন্ধ্যা, ইমদাদুল হক মিলনের নূরজাহান – এসব বই রচয়িতাকে ছাড়িয়ে যেন সামনে এসে দাঁড়িয়ে আছে। প্রণবেশবাবুর ক্ষেত্রে সেরকম ঘটনাই ঘটেছে। পরবর্তী বইগুলো পাঠকপ্রিয়তা পেলেও সাধারণ মানুষ প্রথম উপন্যাসটির জন্যেই প্রণবেশবাবুকে বেশি করে সম্মান জানাল।
এই বইটির জন্যই প্রণবেশ রাজবংশীর ত্রিপুরা যাওয়া। ত্রিপুরা রাজ্য সরকার প্রতিবছর ঘটা করে অদ্বৈত জন্মবার্ষিকী উদযাপন করে। প্রতিবছর একজন প্রধান বক্তা নির্বাচন করে সরকার। এবার প্রধান বক্তা হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন রাজবংশীবাবু। জলমানুষের গালগল্পের সৌরভ সুদূর ত্রিপুরা পর্যন্ত ছড়িয়েছে। নইলে বাংলাদেশে এত এত খ্যাতিমান লেখক থাকতে প্রণবেশবাবুকে কেন নিমন্ত্রণ করা হলো? আরেকটি সূক্ষ্ণ কারণ হয়তো আছে। অদ্বৈতের সম্প্রদায়ে রাজবংশীবাবুর জন্ম। রাজ্য সরকারের কর্তাব্যক্তিরা হয়তো ভেবেছেন – অদ্বৈতের জন্মতিথিতে বক্তা হিসেবে প্রণবেশবাবুই যথার্থ লোক।
সুভাষ দাসের ফোন পেয়ে বিস্মিতই হয়েছিলেন প্রণবেশবাবু। প্রথমে সুভাষবাবুর কথার মর্মার্থ ধরতে পারেননি। পরে যখন বুঝতে পেরেছেন, জিজ্ঞেস করেছেন, ‘বাংলাদেশে এত খ্যাতিমান সাহিত্যিক থাকতে আমি কেন দাদা? আমি একজন সাধা…।’
মুখের কথা কেড়ে নিয়েছিলেন সুভাষ দাস, ‘আপনি সাধারণ কি অসাধারণ ত্রিপুরায় এলে বুঝতে পারবেন। আপনাকে নির্বাচন করে নির্বাচকরা বোকামির পরিচয় দেননি।’
পরে আগরতলায় গিয়ে প্রণবেশবাবু জেনেছেন – নির্বাচকদের একজন ছিলেন সুভাষবাবু। পর্যটন করপোরেশনের ডাইরেক্টর তিনি। কিন্তু তাঁর বিচরণক্ষেত্র নাট্যজগতে। ত্রিপুরারাজ্যের প্রথমসারির নাট্য-নির্দেশক তিনি। বইটই পড়েন। লেখেনও একটু-আধটু। জলমানুষের গালগল্প তাঁকে চমকে দিয়েছিল। সেই থেকে প্রণবেশ রাজবংশীর খোঁজখবর নিতে থাকলেন তিনি। বাংলাদেশের বন্ধুবান্ধবদের প্রণবেশবাবুর অন্যান্য বই পাঠাতে অনুরোধ করতেন। নির্বাচনী সভায় তিনিই প্রস্তাব করেছিলেন প্রণবেশ রাজবংশীর নাম। কমিটিতে তাঁর গুরুত্ব ফেলনা নয়। আমন্ত্রণপত্র পেলেন প্রণবেশবাবু।
সেই সুবাদে আগরতলায় যাওয়া তাঁর। দু’জায়গায় বক্তৃতা দিতে হয়েছিল তাঁকে – কেমতলীতে আর আগরতলায়। আগরতলার মুক্তধারা হলরুমে প্রণবেশবাবুর বক্তৃতা ছিল ইনটেলেকচুয়াল। জ্ঞানগম্যিওয়ালা মানুষজন শ্রোতা ছিলেন। কেমতলীর বক্তৃতাতে নিজেকে উজাড় করে দিতে পেরেছিলেন প্রণবেশবাবু। হাজারদুয়েক শ্রোতার অধিকাংশই ছিল জেলে। রুদ্রসাগরের চারদিক ঘেঁষে জেলেপল্লিগুলোর গড়ে ওঠা। জেলেপল্লির মানুষগুলো দেশান্তরী মানুষ। পঁয়ষট্টির পাক-ভারত যুদ্ধের সময় আর একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেকে এই কেমতলীতে বসতি গড়ে তুলেছে। দেশান্তরী মানুষগুলোর মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মানুষ বেশি। তারা সঙ্গে করে স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি আনতে পারেনি। কিন্তু হৃদয় করে নিয়ে এসেছে অদ্বৈত নামের সম্পদটিকে। তাদেরই উদ্যোগে প্রতিবছর অদ্বৈত-উৎসব। নিজের মানুষদের পেয়ে নিজের মানুষটি সম্পর্কে বলতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন প্রণবেশ রাজবংশী। বহু কষ্টে নিজকে সংযত করেছিলেন।
আখাউড়া স্টেশনে বসে থাকলেও মনটা পড়ে ছিল তাঁর ত্রিপুরায়। রাজধানীর রাস্তার পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, রবীন্দ্র শতবার্ষিকী ভবনে সিনেমা দেখা, মন্ত্রিবর্গের সহজ জীবনযাপন পদ্ধতি, নারী দ্বারা পরিচালিত ট্রাফিক ব্যবস্থা, ভিক্ষুকহীন রাস্তাঘাট, মহারাজাদের রাজপ্রাসাদ, মিউজিয়াম – এসবের স্মৃতি বারবার মনে পড়ছিল প্রণবেশবাবুর।
এই কটা দিন ব্যক্তিজীবনের বেদনাটিকে ভুলে থাকতে পেরেছিলেন প্রণবেশবাবু। মধ্যবিত্তের জীবন তাঁর। এক মেয়ে এক ছেলে। মেয়েটি বড়। ছেলেটি এবার চুয়েট থেকে পাশ করে বেরিয়েছে। আসার সময় ছেলের কাছে শুনে এসেছিলেন – তার চাকরি হবে। ডিএসআরএমে ভালোই ইন্টারভিউ দিয়েছে তাপস। কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসার সময় আশ্বস্ত করেছে বোর্ড। কথাটি এ-মুহূর্তে চেয়ারে হেলান দিয়ে ভাবছিলেন প্রণবেশবাবু। ছেলেটার চাকরি হলে সংসারের দারিদ্রে্যর অনেকটা কেটে যাবে। সুহাসিনীকে ভালো করে খাওয়াতে-পরাতে পারেননি প্রণবেশবাবু এতদিন। ছেলেটার চাকরিটা হলে সুহাসিনী খুব খুশি হবে।
সুহাসিনীর কথা ভাবতেই পঁয়ত্রিশ বছর আগের স্মৃতি মনে ভিড় করে দাঁড়াল তাঁর। অনেক কষ্টে সুহাসিনীর সন্ধান পেয়েছিলেন প্রণবেশবাবুর বাবা। ছেলে এমএ পাশ করে বছর দুয়েক চাকরি করতেই গৌতম রাজবংশী ঠিক করেছিলেন, ছেলেকে বিয়ে করাবেন। কিন্তু মেয়ে পাবেন কোথায়? জেলে-মেয়েদের আবার অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে যায়, লেখাপড়াও তারা তেমন করে না। কিন্তু গৌতমবাবুর সিদ্ধান্ত – নিজ সম্প্রদায়ের মেয়েই বিয়ে করাবেন ছেলেকে। খুঁজতে খুঁজতে শেষ পর্যন্ত সুহাসিনীকে পেয়ে গেলেন গৌতমবাবু। গৌরাঙ্গ হালদারের মেয়ে সুহাসিনী। জেলেবংশে জন্মালেও গৌরাঙ্গবাবুর পেশা মাছধরা নয়। একটা প্রাইভেট ফার্মে কেরানির চাকরি করতেন। সুহাসিনী সবে এসএসসি পাশ করে কলেজে ভর্তি হয়েছেন। উভয়পক্ষের কথায় মিল খেলে প্রণবেশ-সুহাসিনীর বিয়েটা হয়ে গিয়েছিল।
সেই যে সুহাসিনী প্রণবেশের ঘরে ঢুকেছেন, গত পঁয়ত্রিশ বছর চোখবুজে সংসারের ঘানি টেনে গেছেন। ভারি পরিবারের রান্নাবান্না, থালাবাসন মাজা, উঠান ঝাঁট দেওয়া, শ্বশুর-শাশুড়ির কাপড়-চোপড় ধুয়ে দেওয়া – সবগুলো একার হাতে করে গেছেন সুহাসিনী। তার পরও হাসি-হাসি মুখ সুহাসিনীর। সুহাসিনী নাম রেখে মা-বাবা দূরদৃষ্টির পরিচয় দিয়েছিলেন। নামের সঙ্গে আচরণের গভীর মিল ছিল সুহাসিনীর।
হাসি-উচছলতা হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল দীপান্বিতা জন্মালে। জন্মানোর পর মেয়েটি কাঁদল না। সবাই বলল – কিছু কিছু বাচ্চার মধ্যে ওরকম দেখা যায়। কাঁদে না। চুপচাপ থাকে। পরে ওর হল্লায় পাড়া মাথায় ওঠে। কিন্তু মায়ের মন। কেমন করে সুহাসিনী বুঝতে পারল – তার মেয়েটি বোবা। তার সকল আননদ নিবে গেল। পরে তাপস জন্মানোর পরও সুহাসিনীর বিষণ্ণতা আর কাটল না।
তাই বলে দীপান্বিতার প্রতি কোনো অবহেলা দেখাননি সুহাসিনী। পরম যত্নে মেয়েকে বড় করে তুলেছেন। স্কুলে পাঠিয়েছেন। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠও চুকিয়েছে দীপান্বিতা। দীপান্বিতার শরীরে জোছনার স্নিগ্ধ আলো পড়েছে। গৌরবর্ণের দীর্ঘদেহ তার। টানা টানা চোখ। আজানুলম্বিত চুল। সবকিছু আছে দীপান্বিতার, শুধু মুখে বাক্যের স্ফুরণ নেই। কত ঘর এলো-গেলো। সবাই পছন্দ করল। যেই না বুঝল দীপান্বিতা বোবা, নানা অজুহাত দেখিয়ে সটকে পড়ল।
মনের কষ্টটা সুহাসিনী যেভাবে প্রকাশ করেন, প্রণবেশবাবু করেন না। ভেতরের রক্তক্ষরণটাকে হাসির আবরণে ঢেকে রাখেন তিনি। কিন্তু সুভাষবাবুর বাড়িতে একরাতে নিমন্ত্রণ খেতে গিয়ে বেদনাটা উথলে উঠেছিল প্রণবেশবাবুর। সুভাষবাবুর সদ্যবিবাহিত কন্যাটি বাপের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলেন সে-রাতে। চেহারা দীপান্বিতার মতো নয়। শ্যামলা রঙের মেয়েটি বরের সঙ্গে যেরকম সোহাগী-কণ্ঠে কথা বলেছিল, প্রণবেশবাবুর মনে হয়েছিল – মেয়েটির মতো সুখী এই পৃথিবীতে বুঝি আর কেউ নেই। সেই মুহূর্তে দীপান্বিতার কথা মনে পড়েছিল প্রণবেশবাবুর। দীপান্বিতার তো এরকম একজন বর থাকতে পারত। সেও তো বাপের বাড়িতে স্বামী নিয়ে বেড়াতে আসতে পারত। নিজের বিষণ্ণতাকে লুকাতে পারেননি প্রণবেশবাবু। সুভাষবাবু জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘হঠাৎ বিষণ্ণণ লাগছে কেন দাদা?’
খাওয়ার পর নিভৃতে সব খুলে বলেছিলেন প্রণবেশবাবু। সুভাষবাবুর হাত চেপে ধরে অনুরোধ করেছিলেন, দেখেন না দাদা, আমার দীপান্বিতার জন্য একটা ছেলে জোগাড় করতে পারেন কিনা? ওপারে তো পারলাম না, এপারে যদি একটা ছেলে জোটে।’
গাঢ় কণ্ঠে সুভাষবাবু বলেছিলেন, ‘আমি আপ্রাণ চেষ্টা করব দাদা। চেষ্টা নয়, যেভাবেই হোক দীপান্বিতা মায়ের জন্য আমি ছেলে জোগাড় করবই।’
আজ সকালে আখাউড়া স্টেশনে বসে সুভাষবাবুর সেই কথাটাই ভাবছিলেন প্রণবেশবাবু। কী আনন্দটাই না হবে। সুহাসিনীর বিষণ্ণতা কেটে যাবে, তাঁর নিজের বিপন্নতা কেটে যাবে। দীপান্বিতার চারদিক জোছনায় ভেসে যাবে।
কখন মহানগর প্রভাতী স্টেশনে এসেছে, থেমেছে, কখন যাত্রীরা হুড়মুড়িয়ে ট্রেনে উঠেছে আর কখন যে ট্রেনটি ছাড়ার হুঁইসেল বেজেছে কিছুই খেয়াল করেননি প্রণবেশ রাজবংশী। তাঁর চোখের সামনে তখন বরযাত্রীর দল, তাঁর কানে তখন ঢোল-ডগর আর সানাইয়ের আওয়াজ।